তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৮৭+৮৮+৮৯

0
974

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮৭
Writer তানিয়া শেখ

প্যানিক অ্যাটাক একবার নয় কয়েক হলো ইসাবেলার। সেই আট বছর বয়সের স্মৃতিতে ধুলো পড়েছে। কিন্তু আজ যে মুখটা দেখল তা ওই ধূসর স্মৃতিতেও কী স্পষ্ট! এ সেই মুখ যা দেখলে ওর রক্ত হিম হয়ে আসে। ফিরে যায় অতীতে। মনে হয় এই তো এখন সেই গাঁয়ের ফার্মে দাঁড়িয়ে আছে। আজানুলম্বিত একটা হলুদ ফ্লোরাল ফ্রক পরনে। কাঁধে লুটিয়ে পড়েছে বাদামি চুল। ঠোঁটে নির্মল হাসি। দেখছে সূর্য ডোবা দূরের আকাশ। ওর নানীর ভেড়ার পাল মাঠে চরে বেড়াচ্ছে। এখন ওরা ফার্মে ফিরবে। একা একা ফিরবে না। বড্ড ত্যাড়া। কাওকে তাড়িয়ে আনতে হবে। কাজটা করে ড্যামিয়ান। ওর দূর সম্পর্কের মামা। কেন যেন ইসাবেলা ওকে দেখলে গুটিয়ে যায়। এই যে নাম মনে করতে গলা শুকিয়ে এলো। পিছিয়ে গেল সেখান থেকে। ড্যামিয়ান আসার আগে বাড়ির ভেতর দৌড়ে পালাবে। কিন্তু পালানো আর হলো না। ড্যামিয়ান বাড়ির মুখে দাঁড়িয়ে। ঠোঁটের কোণে ক্রুর কুটিল হাসি। সমস্ত শরীরে পাক দিয়ে ওঠে ওর হাসি দেখলে। মধুরঙা চোখে কী এক পৈশাচিকতা খেলা করে। ইসাবেলা রাস্তা খোঁজে নিরাপদ মানুষদের কাছে যাওয়ার। কিন্তু ড্যামিয়ান সে সুযোগ দেয় না। কাছে এসে বলে,

“আজও পালানোর পথ খুঁজছ, বেবিগার্ল?”

তারপর ছোট্ট ইসাবেলার চুলের ঘ্রাণ নিলো। কম্পিত ওর ছোট্ট পেলব হাত শুঁকে বলল,

“কী মিষ্টি সুঘ্রাণ। মন বলে সারাদিন শুঁকতে থাকি।” ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায় ইসাবেলা। মনে মনে মা অথবা অন্য কাওকে প্রার্থনা করে। ড্যামিয়ান ওর গাল স্পর্শ করে। একদম ভালো লাগে না ওর স্পর্শ ইসাবেলার। সরে যেতে চায়। কিন্তু শক্ত করে ধরে আছে ড্যামিয়ান।

“কেন দূরে যেতে চাও, হুম? একসময় আমার সাথেই তোমাকে থাকতে হবে। প্রতিটি মিনিট, সেকেন্ড, ঘণ্টা। এখন এমন ভয় পেলে চলবে বলো?”

“আমি বাড়ি যাব।” বহুকষ্টে ইসাবেলা বলল। ওর চোখ সজল। ড্যামিয়ান মুচকি হাসল। গাল আলতো ছুঁয়ে বলল,

“পরিণত হলে খুব সুন্দরী হবে তুমি, তাইনা বেবিগার্ল? অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি দিনটির জন্য। যে দিনে তোমাকে আমি দখলে নেবো। আমার একার দখলে। ভালোবাসবে না সেদিন আমাকে তুমি?”

ড্যামিয়ান ওর গালে চুমো দিতে গেলে মুখ সরিয়ে নেয় ইসাবেলা। জোরে কেঁদে ওঠে,

“আমি মায়ের কাছে যাব। মা, মা।”

মুহূর্তে ড্যামিয়ান ক্ষেপে গেল। ঘাড় শক্ত করে চেপে ধরে,

“মা, মা। কুত্তার বাচ্চা, মা মা কী? আমার নাম তোর মুখে আসে না? আমাকে দেখলে পালাস? এত ভয়ংকর, কুৎসিত তোর কাছে আমি? আজ তোকে শিক্ষা দেবো। এখন থেকেই লাগাম টানতে হবে তোর।”

ছোট্ট ইসাবেলার নরম ঘাড়টা মনে হয় ভেঙে যাবে। ভীষণ যন্ত্রণা আর ভয়ে কাঁপছে, কাঁদছে। ড্যামিয়ান উঠে দাঁড়ায়। তারপর ওর কান্না উপেক্ষা করে টানতে টানতে ফার্মের পেছনে নিয়ে গেল। খুপরি ঘর। জানালা নেই। দিনের বেলা সহজে আলো আসে না। এখনই আবছা অন্ধকার নেমেছে। সেখানে ইসাবেলার গলায় রশি দিয়ে রশির অন্যপ্রান্ত হাতে নেয় ড্যামিয়ান।

“নত হয়ে বস। বস।”

ভয়ে ভয়ে হাঁটু ভেঙে বসল ইসাবেলা। ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। ড্যামিয়ান একটা মোটা কাঠের ওপর ওর সামনে বসল। বলল,

“আজ থেকে আমি যা বলব তাই শুনবি।”

সভয়ে মাথা নাড়ায় ইসাবেলা। ড্যামিয়ান এদিক ওদিক তাকায়। তারপর রশিটা কাঠের এককোণে বেঁধে উঠে দাঁড়ালো।

“একদম নড়বি না। নড়েছিস তো মরেছিস।”

বেরিয়ে গেল এই বলে। অসহায়ের মতো কাঁদছে ইসাবেলা। মা আর পিটার কেন ওকে খুঁজতে আসে না! ড্যামিয়ান এক আঁটি ঘাস নিয়ে ফিরল। ওর সামনে ফেলে বলল,

“খা।”

ইসাবেলা প্রথমে রাজি হয় না। কিন্তু ড্যামিয়ানের হিংস্র দৃষ্টি দেখে শেষমেশ ঘাস চাবায়। সবটা শেষ করতে হলো না। তার আগেই ফার্মের সামনের দিকে পিটারের গলা শুনতে পেল। পিটার ডাকছে। খুশি হয়। অশ্রুসিক্ত লোচনে ভয়ে ভয়ে তাকায় সেদিকে। ড্যামিয়ান কটমট করে বলে,

“বজ্জাতটা এখানেও তোর পিছু নিয়েছে। কবে না জানি ওকে মেরে ফেলি।”

ইসাবেলা শিউরে ওঠে সে কথা শুনে। ড্যামিয়ান বলল,

“খুব ভাব ওর সাথে তোর? কর যত ভাব। যার সাথে ইচ্ছে কর। শুধুমাত্র পরিণত হওয়ার আগ পর্যন্ত ছাড় দিলাম। তারপর আমি ছাড়া আর কেউ তোর থাকবে না। কেউ না।”

গলার রশিটা খুলে শাসিয়ে দেয় এই ব্যাপারে মুখ বন্ধ রাখতে নয়তো পিটারকে মেরে ফেলবে। ইসাবেলা ভয়ে কাওকে কিছু বলে না। কিন্তু ওর আর্ত সিক্ত মুখ দেখে পিটারের সন্দেহ হয়। সেদিন রাতে প্রচণ্ড জ্বর আসে ইসাবেলার। পিটার ওর শিওরে বসে থেকেছে সারাক্ষণ। কদিন অসুস্থতায় ভুগে সুস্থ হলো ইসাবেলা। আন্না মেরিও সহ বাড়ির বাকিদের চিন্তা লাঘব হয়। কিন্তু পিটারের সন্দেহ থেকেই গেল। ইসাবেলা যেন কেমন চুপচাপ হয়ে থাকে। অল্পতেই ভয়ে কেঁপে ওঠে। বিশেষ করে ড্যামিয়ানকে দেখলে।
এদিকে ড্যামিয়ানের কাছে ইসাবেলা খেলার পুতুল। যাকে নিত্যদিন নতুন ভাবে টর্চার করে পৈশাচিক আনন্দ পেত। সেদিন রাগের মাথায় যা শুরু করেছিল আস্তে আস্তে তা ভালো লাগা হয়ে ওঠে। কাউকে ভয় দেখিয়ে এত আনন্দ! এত মজা! ড্যামিয়ানের বিকৃত মস্তিষ্ক ইসাবেলার বয়স, নিষ্পাপ মুখ, সম্পর্ক কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করল না। একদিন রাতেও এমনই পৈশাচিক খেলায় মেতেছিল ইসাবেলাকে নিয়ে। ওর সামনে একটা ভেড়া হত্যা করে টুকরো টুকরো করল। তারপর সেই কাঁচা মাংস দিলো ইসাবেলাকে খেতে। ভেড়াটা ইসাবেলার প্রিয় ছিল। গত জন্মদিনে নানী ওকে উপহার দিয়েছিলেন। ড্যামিয়ান কি না সেটাই শেষ করে ফেললো। ইসাবেলা যাকে ভালোবাসবে তাকেই শেষ করবে? প্রতিনিয়ত টর্চারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় ইসাবেলার। চুপচাপ মাংসটা হাতে নিলো। কিন্তু খেল না। হঠাৎ ছুঁড়ে মারল ড্যামিয়ানের মুখে। রাগে ক্ষেভে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

“জানোয়ার তুমি। এই নিষ্ঠুরতার জন্য ঈশ্বর তোমায় শাস্তি দেবেন। কঠিন শাস্তি দেবেন।”

ড্যামিয়ান ওর চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করায়। তারপর গলা চেপে ধরে বলে,

“তোর ঈশ্বর কেন আমাকে শাস্তি দেবে? সে কে? তুই আমার। আমার জিনিস আমি যা ইচ্ছে তাই করব। আজ তুই আবার আমাকে অমান্য করেছিস। কেন? তোকে না বলেছি আমি যা বলব শুনবি। বলেছি না? কেন শুনলি না? শাস্তি পাবি তুই এরজন্য।”

প্যান্টের বেল্ট খুললো। জোর করে ওটা ওর গলায় পেঁচিয়ে ফেলে দিলো মাটিতে। টেনে নিতে লাগল সামনে। দম বন্ধ হয়ে আসে ইসাবেলার। শ্বাসকষ্টে ছটফট করে মাটিতে। ড্যামিয়ান পাগলের মতো হাসে তাই দেখে।

“আর অমান্য করবি? আর বেয়াদবি করবি আমার সাথে? বল?”

“ড্যামিয়ান!”

মায়ের চিৎকারে ইসাবেলা সচকিত হয়। দুঃস্বপ্নের অতীত থেকে বেরিয়ে এলো। ঘামে ভিজে গেছে শরীর। নিচে মায়ের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে নিচে নামতে তাতিয়ানা বাধা দেয়। ইসাবেলা শুনলো না। জোর করে নেমে গেল। ওকে শুনতে হবে ড্যামিয়ানের সাথে মায়ের কী কথা হয়েছে। মনের কোথাও ভয় আছে পাছে নিকোলাস আর ওর সম্পর্ক না জেনে গেছে ড্যামিয়ান। যদি তেমন হয় তবে ঘোর বিপদ ইসাবেলার সামনে। এই বিপদ মোকাবিলার জন্য এখনও প্রস্তুত হয়নি। তার ওপর নিকোলাসও তো নেই পাশে।

“তোর মুখ আর যদি এ বাড়িতে দেখেছি, ঈশ্বরের শপথ করে বলছি শেষ করে ফেলব তোকে ড্যামিয়ান। দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে।”

আন্না মেরিও সিঁড়ি দিকে ঘুরে দাঁড়াতে ড্যামিয়ান বলল,

“আমি মানছি অতীতে আমি ভুল করেছি।”

“ভুল? ওটা ভুল নয় ঘোর পাপ। পশুর চেয়ে নিকৃষ্টতর কাজ করেছিস তুই।” রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালেন আন্না মেরিও। ড্যামিয়ান অপরাধী মুখ করে বলল,

“ঠিক আছে। আমি মেনে নিচ্ছি পাপ করেছি। আমি অসুস্থ ছিলাম তখন আন্নে। এখন আর সেই আমি নেই। এতগুলো বছর নিজের পরিবার ছেড়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছি।অনুশোচনার আগুনে জ্বলেছি প্রতি মুহূর্ত। আর কী শাস্তি দিলে তুমি খুশি দাও। মাথা পেতে নেবো তোমার সকল শাস্তি আন্নে। তবুও বিশ্বাস করো আমাকে।”

আন্না মেরিও কাষ্ঠ হাসলেন। আঙুল তুলে বললেন,

“বিশ্বাস আর তোকে? যে আমার শিশু মেয়েটাকে দিনের পর দিন টর্চার করেছিল। মামা বলতো তো তোকে ও। তবে কী করে পারলি? আর বাবা, তুমি বলেছিলে ইসাবেলার জন্য পাত্র দেখেছ। এই কি সেই, যে আমার ভাই?”

ড্যামিয়ান কিছু বলবে তার আগে মার্কোভিক বললেন,

“ও তোমার ভাই নয়।”

সকলে বিস্ময়ে তাকালো। এতদিন তো এ বাড়ির লোক এই সম্পর্কই জেনে এসেছে। আজ হঠাৎ সম্পর্ক বদলে গেল! মার্কোভিক কাওকে জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। তিনি মেয়েকে বললেন,

“শান্ত হয়ে যদি দু মিনিট বসতে তাহলে পুরো কথা বলতে পারতাম। কিন্তু সেই স্থিরতা তো নেই তোমার মধ্যে। যা খুশি করো। ড্যামিয়ান খারাপ, আমি খারাপ। পুরো ম্যাক্সওয়েল খান্দান খারাপ। ভালো তো কেবল তোমার ওই মেয়ে। যে আমার বংশ ধ্বংসের পায়তারা করছে।”

ক্ষুব্ধ রক্তিম চোখে মুখ তুলে ওপরের কড়িডোরের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ানো নাতনির দিকে চেয়ে রইলেন। নানার রাগ ইসাবেলাকে স্তব্ধ করে দেয়। বংশ ধ্বংসের পায়তারা! কেন বললো নানা এ কথা? তাতিয়ানা জড়িয়ে ধরল আছে বোনকে।

“ওদের কথায় কান দিয়ো না, ইসাবেলা। চলো রুমে চলো।”

ইসাবেলা নড়ে না।

“কী যা তা বলছেন বাবা?” ওলেগ এবার প্রতিবাদ করলেন।

“সে তোমার আদরের মেয়েকে জিজ্ঞেস করো। আমাদের কথা তো আর বিশ্বাস করবে না। এসো ড্যামিয়ান। এখানে দাঁড়িয়ে ওদের বুঝানো অনর্থক। যা করার আমাদের করতে হবে। ম্যাক্সিম, রজার তোমরাও আমার রুমে এসো।”

মার্কোভিক নিজের কক্ষে চলে গেলেন। ছেলেরাও পিতাকে অনুসরণ করে। ড্যামিয়ান আন্না মেরিওর ভাবিত মুখ চেয়ে ওপরে তাকালো। ইসাবেলার মুখ বিপন্ন। ভয়ের রঙ ছিটিয়ে দিয়েছে ওর মুখ ক্যানভাসে মার্কোভিক। ভেবেছিল কী? গোপনে পিশাচের সাথে প্রেম করবে আর ওরা টের পাবে না? বোকা মেয়ে! নিকোলাস ওকে ড্যামিয়ানের কাছ থেকে আলাদা করবে? এত সহজ?

“এত সহজে তোমার নিষ্কৃতি হবে না বেবিগার্ল। তুমি আমার, আমার, শুধু আমার।”

বিড়বিড় করে বলল। ইসাবেলা তাকালো ওর দিকে। ও যেন পড়তে পারছে কথাগুলো। ভয় খেলা করছে চোখে। এ সেই ভয় যা ড্যামিয়ানের ভীষণ প্রিয়। যা কতকাল দেখতে পায়নি। আজ শান্তি, প্রচণ্ড শান্তি লাগছে। স্মিত হাসল। তারপর পা বাড়াল মার্কোভিকের রুমে দিকে। যেতে যেতে আন্না মেরিওকে বলল,

“মাথা ঠাণ্ডা হলে এসো আন্নে। কত কথা বাকি। সব বলতে চাই। খুব মিস করেছি তোমাকে এতদিন। শান্ত হয়ে এসো আন্নে, এসো।”

পিয়েতরের মাধ্যমে ইসাবেলার চিঠি পেয়েই রাশিয়া চলে এলো নিকোলাস। পথে দুটোদিন লেগেছে। যুদ্ধের দরুন সময়টুকু লাগল। এবার সাথে পল নেই। এ পর্যন্ত দুটো চিঠি এসেছে ওর কাছ থেকে। এখনও গন্তব্য থেকে বেশ দূরে ও। নিকোলাস অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে নোভার খোঁজ জানার জন্য। রিচার্ডকে নিয়েও সন্দেহ আছে। ওর পেছনে গুপ্তচর লাগিয়েছে। এবার রিচার্ড উলটো পালটা করলে নিস্তার পাবে না। রাশিয়া পৌছালো ভোরবেলা। সূর্য উঠতে এখনও মিনিট পাঁচেক সময় বাকি। চট করে ইসাবেলাকে দেখে আসার লোভটা দমন করতে পারল না। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ইসাবেলা। ওকে সহিসালামত দেখে স্বস্তি পেল। আজ আর কথা বলার সময় নেই। মোরগ ডেকে উঠতে স্ত্রীর কপালে ও ঠোঁটে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। একটা চিরকুট লিখবে কি?

“না, থাক। বরং কাল তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো, বেলা।”

চলবে,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮৮
Writer তানিয়া শেখ

ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুশ্চিন্তায় কেটেছে ইসাবেলার। যেখানে ও প্রাণভরে শ্বাস নিতো সেখানেই এখন প্রাণ ওষ্ঠাগত যেন। নানা মার্কোভিক কেন ওভাবে বললেন? নিকোলাস আর ওর সম্পর্কের কথা কি তিনি জেনে গেছেন? তাতেই বা তাঁর বংশ ধ্বংস হবে কেন? মা আন্না মেরিও কি ফের গিয়েছিল নানার ঘরে? ড্যামিয়ানের সাথে কথা হয়েছে আবার? এত প্রশ্ন ওকে জর্জরিত করে তোলে। মাথার ভেতর ফাঁকা হয়ে আসছে। অস্থিরতা সর্বাঙ্গে। ওর ভাই-বোন দুজন এসেছিল। সাথে মাতভেই ও কাজিনেরাও। ইসাবেলাকে সান্ত্বনা দিয়েছে। ওর পাশে আছে ওরা। নানার ওই আচরণকে মোটেও সাপোর্ট করে না। আর ড্যামিয়ানকেও ইসাবেলার আশেপাশে ঘেঁষতে দেবে না। ইসাবেলার ভয় ও শঙ্কা কিছুটা কমে। বাকিটা মা কাছে এলে কমত। কিন্তু ওইদিন মা ওর কাছে এলো না। শান্তি পায়নি ইসাবেলা। সারারাত ছটফট করেছে।
ড্যামিয়ান রাতেই বিদায় হয়েছে। সকালে নাস্তার টেবিলে গম্ভীরতা বিরাজ করছিল। ওর নানা ও মা একে অপরকে এড়িয়ে গেছেন। মামারা বাড়িতে নেই। ইসাবেলার দিকে বাকিদের করুণার নজর। অসহনীয় লাগছিল সব ইসাবেলার। তবুও যদি মা একটু কথা বলতো। হোক না অপ্রয়োজনীয়। এই যেমন,

“খাচ্ছো না যে? সকালে মুখ দেখেছ আয়নায়? চোখদুটো বসে গেছে। মুখটা ওমন শুকনো কেন তো? কাল কিছু খাওনি?”

কিন্তু মা তেমন কিছুই বললেন না। খাওয়ার ফাঁকে এক পলক দেখলেন। তারপর খাওয়া শেষ হতে উঠে রুমে চলে গেলেন। ইসাবেলার ভীষণ কান্না পেয়েছিল তখন। দাদা আর দিদিমা কেন যে কাকার বাড়ি গেল? তাঁরা থাকলেও তো ইসাবেলা ভরসা পেত। বাবা ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন,
“চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ইসাবেলার মনে হচ্ছে এবার আর সব ঠিক হবে না। ঠিক হওয়ার সকল পথে যে ইসাবেলা পাথর ফেলেছে। পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করা তো অন্যায়। জেনেশুনে ও সেই অন্যায় করেছে। দোষ যখন করেছে শাস্তি তো পেতেই হবে। ইসাবেলা কি তৈরি শাস্তি ভোগ করতে?

“ইসাবেল, ঘুমিয়ে পড়েছ?” বন্ধ দরজার বাইরে ভ্লাদিমির গলা শুনে সচকিত হয়। বোনকে নিয়ে ও বেচারার চিন্তা খুব। ভীষণ ভালোবাসে কি না! অথচ, ইসাবেলা ওকেও কষ্ট দিলো। কষ্ট! বোন কাওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। এতে কি ও কষ্ট পাবে? ক্ষমা করবে না কোনোদিন? ইসাবেলার চোখ জ্বলে। এখন আর ও ভাইয়ের মুখোমুখি হবে না। কারো না। ও জানে, খুব শীঘ্রই এই আপনজনেরা ওকে ত্যাগ করবে, নয়তো ওকেই সেটা করতে হবে। এই ওর ভাগ্যলেখা। এতেই সকলের মঙ্গল। কিছু মঙ্গল বড়ো যন্ত্রণার হয়। যা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ও। আজ রাতে খুব কাঁদবে। কান্না ছাড়া উপায় তো দেখছে না।

এমন করে দিন রাত কাটল। এক সময় কান্নাও আর আসে না। অবসন্নতা আর একরাশ মন খারাপ নিয়ে নিজে কক্ষে শুয়ে বসে সময় কাটায়।

শীতের বিদায় প্রস্তুতি চলছে। একটু বেলা হতে রাতে জমা তুষারের স্তূপ রোদের তেজে গলতে শুরু করে। বাতাসে রোদ মিষ্টি আবেশ। তাতিয়ানা, মাতভেই তাশা ও রেইনিকে নিয়ে লনে রোদ পোহাচ্ছিল। ইসাবেলাকে ডাকল কয়েকবার। ভালো লাগছে না অজুহাত দেখিয়ে গেল না ও। ইসাবেলাকে অবাক করে তখন ওর মা আন্না মেরিও মেয়ের কক্ষে ঢুকলেন। যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে মেয়ের সাথে কথা বললেন। ঠিক আগে যেভাবে বলতেন। জোর করে লনে পাঠালেন। মায়ের গম্ভীর মুখ একদম পছন্দ করে না ইসাবেলা। এই যে হাসলেন তাতেই ওর সকল চিন্তা উধাও। সারাটা দিন তারপর ভালোই গেল। সব যেন আবার আগের মতো স্বাভাবিক। রাতে নানা মার্কোভিক ডিনারে এ উপস্থিত ছিলেন না। বিশেষ কাজে বাইরে গেছেন। নানা না থাকলে বাড়িটাতে পার্টির আমেজ সৃষ্টি হয়। বড়োরা ডিনার করেই রুমে ফিরে গেল। বাকিরা মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডা ও আমোদে মেতে রইল। নেশা পানও হলো। ইসাবেলা অবশ্য এক গ্লাস চেরি ওয়াইনই পান করেছে। কড়া সুরাপানে নেশা দ্রুত চড়ে যায়। শেষে উলটো পালটা কিছু করবে মা আবার রেগে যাবে।
বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ ঘুম এলো না। একটা সিদ্ধান্তে এলো সেই রাতে। কিন্তু সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগে নিকোলাসের মতামত দরকার। কবে যে আসবে ও! দু’হাতে নিজেকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করল। ভীষণ মিস করছে নিকোলাসকে। এই রাত, এই অন্ধকার ওকেই বারবার মনে করিয়ে দেয়। ওর নাম জপতে জপতে ঘুমিয়ে গেল।
চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখল সেই রাতে। চাঁদের মতো সুন্দর এক শিশু। বাদামী কোঁকড়া চুল, নীল চোখ। চাহনি খুব চেনা। ঠোঁটে নির্মল হাসি। হঠাৎ ডেকে উঠল,

“মা, মা।”

তারপরেই কোথা থেকে দুটো ভয়ংকর কুৎসিত হাত এসে ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। মুহুর্তে স্নিগ্ধ হাসি কান্নায় পর্যবসিত হয়। ওই নীল চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। বাঁচার আকুতি জানায় হাত বাড়িয়ে। চিৎকার করে ফের ডেকে উঠল,

“মা, মা।”

শীতের সকালেও ইসাবেলা ঘামে ভিজে একসার। ওর বুক ধড়ফড় করছে। মা, মা ডাক এখনও স্পষ্ট কানে বাজছে। শরীরটা কেমন অসাড় লাগল। ঠোঁটে নোনতা কিছু টের পায়। এ কী! ও কাঁদছে? নিছক স্বপ্ন দেখে কেন কাঁদছে ও? ঘুম থেকে উঠলে স্বপ্ন কেমন ধোঁয়াশা হয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্য! ইসাবেলা এখনও সেই পবিত্র কোমল মুখটা, নীল চোখের কাতর চাহনি পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে। অনুভব করছে ওর কষ্ট! কী হচ্ছে এসব?
এক গ্লাস পানি খেয়ে মড়ার মতো শুয়ে রইল বিছানায়। দুপুরে স্নান সেরে একবারে লাঞ্চ করতে এলো। সারাদিন এটা ওটা করেও স্বপ্নের সেই শিশুমুখ কিছুতেই ভুলতে পারল না। ভাবল মাকে বলবে। কিন্তু সেটাও বলা হলো না। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। সন্ধ্যা হতে ঘুমোবে বলে ডিনার না করেই কক্ষে ফিরে এলো। কী ভেবে কোণের টেবিলের সামনের চেয়ার টেনে বসল। সামনে কাগজ, কলম আর পেনসিল আছে। ড্রইংএ তেমন পাকা নয় ও। ওদের তিন ভাই বোনের মধ্যে ভ্লাদিমি এদিকে ভালো। ও আর তাতিয়ানা বাঘ আঁকতে কুকুর এঁকে বসে থাকত। বাবা ছাড়লেন না। আর্টে তাঁর বিশেষ দুর্বলতা। ভালো আর্টিস্ট তিনি। আর তাঁর মেয়েরা আঁকতে গিয়ে পেন্সিল তুলি একাকার করে? কোমর বেঁধে নামলেন। ফলও হলো। দক্ষ না হলেও ভালোই শিখল ওরা। ইসাবেলা আঁকে না অনেকদিন। আজ কেন যেন কিছু অঙ্কনের তীব্র তাড়া অনুভব করছে। পেন্সিল হাতে নিলো। আঁকিবুঁকি করল কয়েকটা সাদা পৃষ্ঠায়। না, ঠিকঠাক হচ্ছে না যে! চেষ্টা থামল না। একের পর এক পৃষ্ঠা দলিতমথিত করে ছড়ালো পুরো মেঝেতে। হতাশায় কিড়মিড় করে। কিন্তু হাল ছাড়ে না। কী এক ভার ওকে চেপে ধরে আছে। চোখ বন্ধ করল। মুখের আদল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। তাকালো সাদা কাগজে। পেনসিল চলছে। ডাগর নীল চোখ, সরু নাক, পাতলা গোলাপি ঠোঁট, প্রসস্থ কপাল, বাদামী কোঁকড়া চুল সবমিলে ছোট্ট মায়াবী মুখ।

“সো বিউটিফুল। লুক লাইক অ্যান অ্যাঞ্জেল। হু ইজ শি?”

চকিতে ঘুরে তাকাল ইসাবেলা। নিকোলাস হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এক লাফে উঠে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গলা জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলল,

“ও হানি, আই মিস ইউ সো মাচ।”

“আমি এখন নিজের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি, তোমার বাহুর বেষ্টনীতে।”

ওর মাথায় হাত বুলিয়ে নিকোলাস আবার বলল,

“কাঁদে না লক্ষীটি। এই তো এসেছি আমি।”

ইসাবেলা ওর সমস্ত মুখে চুমু খেয়ে ঠোঁটে গাঢ় চুম্বন দিলো। শীতল রাতের সমীরণ ক্রমশ উষ্ণ হয়ে ওঠে। বাইরে ঝড় ওঠে। নিভিয়ে দেয় এ কক্ষের আলো। ঝড়ো হাওয়া স্তব্ধ করে চার দেওয়ালে ওদের গোঙানি আর শীৎকার প্রতিধ্বনিত হয়। একাকি গত রজনী, বিরহের যাতনা সব যে আজ ভুলবে এই সুখ উল্লাসে।

ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। খোলা জানালা দিয়ে বাতাসে ভর করে বৃষ্টিকণা ছিটিয়ে পড়ছে এ ঘরের মেঝেতে। ইসাবেলা সেদিকে তাকিয়ে নিজের শ্বাস স্বাভাবিক করছে। মাথাটা নিকোলাসের নগ্ন বুকের ওপর। চোখ মুদে ইসাবেলার চুলে আঙুল চালাচ্ছে নিকোলাস। অন্যহাতে জড়িয়ে আছে। এক টুকরো কম্বলই আজ ওদের নির্বস্ত্র দেহের একমাত্র বস্ত্র। ইসাবেলার ঘুম ঘুম পাচ্ছে। আকাশে বিদ্যুৎস্ফুরণ হয়। এক ঝলক আলো এসে পড়ে টেবিলের ওপরে। নিকোলাস চোখ খোলে তখনই। শিশু দেখলে কেবল ওর শ্বদন্ত বেরিয়ে আসত। ব্যতিক্রম এই ছবির শিশুটির বেলাতে ঘটল। অদ্ভুত এক মায়ায় দৃষ্টি স্থির রইল টেবিলের দিকে, অন্ধকার নামার পরও। কৌতূহলও জাগল ওকে জানার। কী মায়াবী মুখ!

“যার ছবি আঁকলে সে কে?” বলল ইসাবেলাকে। ঘুমের ঘোরে ইসাবেলা কেবল হুঁ করেই চুপ হয়ে গেল। নিকোলাস ফের শুধায়,

“বললে না?”

“কী?” আধো আধো চোখ খুললো ইসাবেলা। নিকোলাস অন্ধকারে মিশে থাকা টেবিলে চোখ রেখে বলল,

“যাকে এঁকেছ।”

“আমাদের মেয়ে।”

নিকোলাসের হাসি মুহুর্তে নিভে গেল। যে হাতে ইসাবেলাকে জড়িয়ে ধরেছিল তা যেন শক্ত হয়। অত জোর কোমরে পড়ায় ইসাবেলা আহ! করে উঠল। ভুরু কুঁচকে তাকাল নিকোলাসের পাণ্ডুর মুখে। তারপর হেসে বলল,

“পাগল একটা! আমি তো মজা করেছি। মেয়ে একদম পছন্দ না আমার। ইনফ্যাক্ট সন্তানও না। আমরা দুজনই বেশ আছি। সন্তান মানে উটকো ঝামেলা। ও আমার কেউ না। কেবল একটা ছবি।”

আর এই ছবির শিশুটিকে ও ইতোমধ্যে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু একথা স্বীকার করবে না। নিকোলাসের সামনে তো নয়ই। ভাবনা চিন্তা বিনা “আমাদের মেয়ে” কথাটা বলেছে। কিন্তু কেন? শিশুটিকে ভালো লেগেছে বলে?
নিকোলাস জোরপূর্বক মুচকি হাসতে ইসাবেলা আগের মতো চোখ বন্ধ করে। ওর হাসি ম্লান হয়। তারপর এই অন্ধকারে লুকিয়ে বাঁচে।
নিকোলাস শূন্যে তাকিয়ে রইল। “আমাদের মেয়ে” কী মধুর শব্দটা। কী পবিত্র! ওর মতো অশুচি পিশাচ পাবে কি এমন পবিত্র প্রাণের ছোঁয়া? না! কোনোদিন না। ও যে অভিশপ্ত। কত শিশুর প্রাণ কেড়েছে। কত মায়ের কোল খালি করেছে। ওই যে ম্যাক্সের অনাগত সন্তান আর ওর মা’কে মেরেছিল। শাস্তি কি পায়নি? এই জীবন্মৃত হয়ে থাকাই তো তার শাস্তি। ইসাবেলা সন্তান চায় না। বোকা মেয়ে। ওর মিথ্যা কি নিকোলাস বোঝে না? নিকোলাসকে ফাঁকি দেওয়া এতই সহজ? আপসোস, সব বুঝেও নিকোলাস নীরব। ওর কর্মফল আজ ওকে শাস্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ ছাড়ছে না। ওর পাপ ওকে পিতা হতে দেবে না। সেই ইচ্ছে পোষণ করলে নিস্তার নেই নিকোলাসের। যা এখন আছে তাও হারাবে। ইসাবেলাকে হারানোর ভয়ে ভীত হয় ও। আরো নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে ইসাবেলাকে। বিড়বিড় করে বলে,

“সন্তান চাই না আমি। আর কিছুই চাই না। শুধু ইসাবেলা থাক আমার।”

চলবে,,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮৯
Writer তানিয়া শেখ

আগাথা হাঁটু ভেঙে বসেছেন চন্দ্রদেবীর সামনে। দুহাত জোড় করে প্রার্থনা করে বললেন,
“দেবী, দয়া করুন। আজ আপনার দয়ার বড়ো প্রয়োজন আমার। আমার সন্তানদের সামনে ঘোর বিপদ। ওদের আপনি বিপদ থেকে উদ্ধার করুন দেবী।”

দেবী হতাশ মুখে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললেন,

“না, বাছা, এ আমার পক্ষে অসম্ভব। নিয়তিকে আমি সংস্কার করতে পারব না। কর্মের ফল ওদের পেতেই হবে।”

“আর শাপমোচন?”

“সেই জন্যই তোমাকে পাঠিয়েছিলাম। খারাপ লাগলেও বলতে হচ্ছে তুমি ব্যর্থ হলে। এখন সব আমার সাধ্যের বাইরে বাছা।”

আগাথা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নুয়ে রইলেন। দুই সন্তানের শাপমোচনের জন্য মরেও যে শান্তি হলো না তাঁর। দেবীর করুণায় কত চেষ্টায় তো করলেন, তবুও ওদের ভাগ্য বদলাতে অসফল হলেন। মনে পড়ল নোভার চিৎকার। মাথা ফের তুললেন।

“দেবী, আমার নোভাকে অন্তত মুক্ত করুণ ওই শয়তানের হাত থেকে। ও বেচারী বিনা পাপে শাস্তি ভোগ করছে।”

দেবী উঠে দাঁড়ালেন সিংহাসন ছেড়ে। একটু পায়চারি করে বললেন,

“ঠিক আছে কিন্তু একটি শর্তে।”

“শর্ত?”

“এরপর তুমি আর পৃথিবীতে যেতে পারবে না।”

“দেবী!”

“তোমাকে মানতেই হবে এই শর্ত আগাথা। হ্যাঁ, না বলার অধিকার নেই। আমার হুকুম এটা। তুমি আর জীবিত মানুষ নও যে পৃথিবীর আলো বাতাস গ্রহণ করতেই হবে। মৃত্যুর পর ওই পৃথিবী এবং ওতে বসবাসরত মানুষের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে তোমার। তোমার সততা, ধর্মনিষ্ঠার কারণে সুযোগ পেয়েছিলে সন্তানদের শাপমোচন করার। তোমাকে বহুবার বলেছিলাম ভাগ্য বদলানোর ক্ষমতা কোনো মানুষের নেই। কর্মে যা ঘটে কর্মেই তা বদলায়। তোমার সন্তানেরা কর্ম বদলায়নি। নিজেদেরও না। মেনে নাও এই ওদের ভাগ্য। এ তুমি বদলাতে পারবে না। অনেক সুযোগ দিয়েছি তোমাকে আমি। আমারও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে আগাথা। এর বেশি সত্যি আমার পক্ষে অসম্ভব।”

দেবীর গলা কঠিন শোনালো। আগাথা বিমর্ষ হয়ে গেলেন। তাঁর সন্তানেরা এভাবেই অভিশপ্ত হয়ে থাকবে? মুক্তি মিলবে না কোনোদিন? মাতৃহৃদয় হাহাকার করে। মৃত্যু মুহূর্তের সেই পীড়া আবার যেন উপলব্ধি করছেন আজ। হঠাৎ মনে এলো ইসাবেলাকে তিনি বলেছিলেন এসব কথা। ও কথা দিয়েছিল তাঁর সন্তানদের শাপমোচনে সাহায্য করবে। এইজন্যই তো তিনি ছলে-বলে ওকে নিকোলাসের কাছে ঠেলেছেন। সেই উদ্দেশ্য তাঁর সফল হয়েছে। আজ তাঁর ছেলে ইসাবেলার প্রেমে পাগল। এখন কি কথা রাখবে না ইসাবেলা?

পল মোসেল নদীর অববাহিকায় একটি বড়ো ছায়াবৃক্ষের নিচে বসল। কাঁধের ব্যাগটা রাখল কোলের ওপর। ট্রিয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। এত পথ কেবল প্রার্থনা করেছে নোভাকে যেন ওখানেই পায়। এর বিপরীত চিন্তা ওর চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, বিশ্রাম থেকে টেনে রাস্তায় নামিয়েছে। অদূরে ফায়ারিং এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে সাঁইসাঁই করে উড়ে গেল কয়েকটি যুদ্ধ বিমান। খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছে পলকে। জঙ্গল হলে সুবিধা হয়। ফাঁকা স্থান যত পারছে এড়িয়ে যাচ্ছে। সামনে ফাঁকা স্থান। তারপর মোসেল নদী। নদীটি পাড় হয়ে কিছু পথ হাঁটলে ট্রিয়ের সেই জঙ্গল যেখানে আন্দ্রেই নির্বাসিত, আর ওর নোভা রয়েছে। সম্ভবত!
শীতের প্রকোপ কমে এসেছে। বৃষ্টি হচ্ছে হুটহাট। বর্ষাকালে এই পথ চলা আরও কঠিন। এক হাঁটু কাঁদা, কীট মাড়িয়ে যেতে সময় ব্যয় হয়। অপরাহ্ণের এই সময় সামনের সমতলের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেমন সময় লাগবে তেমন বিপদও। একটু পর পর যুদ্ধ বিমান যাচ্ছে। সৈন্যদের নজরদারিও এদিকে খুব। পলকে ভিন্ন পথ দেখতে হবে। বৃষ্টি কমতে ও উঠে দাঁড়ায়। পেছনে পাহাড়ি অরণ্য। এখানে ওঠে চারিদিক দেখে নিলে কেমন হয়! সাবধানে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের শিখর সমতলে উঠল। সেখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল আরেক বিপদ। দশ বারোজন পিশাচ ও নেকড়ে অতর্কিতে আক্রমণ করে বসল ওপর। লড়াই করতে গিয়ে ঘায়েল হলো পল। মানুষ রূপে এদের সাথে পেরে উঠবে না। প্রচন্ড চিৎকারের সাথে নেকড়ে রূপে পরিবর্তন হয়। ওইদিন রাতে নিকোলাস নিজের রক্ত ওকে পান করিয়েছিল। পিশাচের রক্তে বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। সেই ক্ষমতা বলেই জন্মগত ত্রুটি সেরেছে। এখন পল ইচ্ছেমতো যখন তখন পুরোপুরি নেকড়ে রূপে পরিবর্তন হতে পারে। পলের ধারণা পথের এ সকল বিপদ অনুমান করেই এতকাল পর ওর মনিব সদয় হয়েছে। কৃতজ্ঞ তার কাছে পল।
উপস্থিত পিশাচ ও নেকড়ে তো বিস্মিত হয় প্রথমে। তাদের বলা হয়েছিল এ সামান্য মানুষ। এখন দেখছে বাদামি লোমওয়ালা এক হিংস্র নেকড়ে। দুই পক্ষে রক্তক্ষয়ী লড়াই চললো। একে একে প্রায় সবগুলোকেই ধরাশায়ী করেছে পল। জয়ের খুব কাছে। তখনই কেউ ওর পিঠে গুলি ছোড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ও। যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। উঠতে গেলে আবার একটা গুলি এসে বিঁধল ওর পায়ে। পড়ে গেল মাটিতে। আহত কয়েকটি নেকড়ে উঠে এলো ওর ওপর। কামড়ে ছিঁড়ে তুলে নেয় দেহের এখান ওখান থেকে খাবলা খাবলা লোমসহ মাংস। ব্যথায় গর্জন করে পল।

“থাম।” একটা পরিচিত গলার স্বর। আদেশ পেয়ে নেকড়েগুলো সরে গেল ওর ওপর থেকে। এখনও দাঁত খিঁচিয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে দেখছে ওরা। পলের নেকড়ে শরীর রক্তে মাখামাখি। মানুষ রূপে পরিবর্তন হওয়ার শক্তি নেই। সিক্ত ব্যথাতুর চোখে তাকালো গলার স্বর অনুসরণ করে।

“আমার পুত্রের বিশ্বস্ত কুকুরটা দেখি নেকড়ে হতে পেরেছে শেষ অব্দি।” রিচার্ড সামনে দাঁড়িয়ে ঠাট্টার সুরে বললেন। হাতে পিস্তল। পল মনে মনে বলল,

“আমার ধারণা তা হলে সত্য ছিল।”

“শতভাগ৷” রিচার্ড শব্দ করে হাসলেন। যেন তিনি বুঝতে পারলেন ওর অনুক্ত কথা। তারপর এগিয়ে এলেন কয়েক কদম।

“কিন্তু আফসোস এখন ধারণা ফারণা করে লাভ হবে না। মরবে কি না।”

পল গর্জন করে ওর ওপর আক্রমণ করতে গেলে ফের ফায়ার করলেন রিচার্ড। পরপর চারটে গুলি ওর পেটে ও বুকে ঢুকিয়ে দিলেন। নিস্তেজ হয়ে মাটিতে আছরে পড়ল পল। নিঃশ্বাস দুর্বল। বুক খুব দ্রুত ওঠানামা করছে। রিচার্ড ওর অশ্রুসিক্ত চোখে চেয়ে দুঃখী হওয়ার ভান করে বললেন,

“বেচারা, শুধু শুধু মরলি। কী দরকার ছিল আমার পথে কাঁটা হওয়ার তোর? নোভা, নোভা করে মাথা খেয়ে ফেলেছিস আমার। আবার ওকে খুঁজে বের করতে বেরিয়েছেন উনি। এত দরদ কেন? ওহ! দরদ নয় এ তো ভালোবাসা।” তারপরে অশ্লীল ভাষায় গালি দিলেন। পলের চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। ঝাপসা দৃষ্টিতে নোভার মুখটা দেখতে পায়। এই মুখ আর বুঝি দেখা হবে! চোখের জলে মাটি ভিজে গেছে। পশুসুলভ ভাষায় গোঙায়,

“নোওওআও, নোওওআওও।”

রিচার্ড ঝুঁকে চাপা গলায় বললেন,

“নোভা! সে যেন কোথায়, কোথায়? আহ! মনে পড়েছে। সে তো ওই ট্রিয়ের জঙ্গলে আন্দ্রেইর কাছে, না?”

পলের দৃষ্টিতে অন্ধকার নামে। তীব্র যন্ত্রণা ক্রমশ ভোঁতা হতে লাগল। ভীষণ হালকা অনুভব করছে। এই কি মৃত্যুর লক্ষণ? মরবে এখন ও? তাহলে নোভার কি হবে? টের পাচ্ছে ওকে টেনে হিঁচড়ে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে এরা। রিচার্ডের গলা আবার শুনতে পেল।

“নোভাকে বেজায় ভালোবাসিস? কিন্তু আফসোস, তোর মতো চাকরের ভাগ্যে নেই ও। ওর রাজকপাল। ড্যামিয়ানের সঙ্গিনী হবে যে নোভালি।”

ড্যামিয়ান! নোভা ওই শয়তানের সঙ্গিনী হবে? না, না। গতবার নোভার ওপর ড্যামিয়ানের অত্যাচারের স্মৃতি স্মরণ করতে শিউরে উঠল।

“প্রভু, আমার প্রানভিক্ষা দাও। চিরজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকব। অতীত ভুলের জন্য তোমার দুয়ারে মাথা ঠুকব। বাঁচাও আমায় প্রভু। আমার নোভার জন্য আমাকে যে বাঁচতে হবে। হে প্রভু, হে জীবনমৃত্যুর মালিক আমায় রক্ষা করো।”

পলের মনের সকল প্রার্থনা থমকে যায় রিচার্ডের আদেশ শুনে,

“ছুঁড়ে ফেল এই পাহাড় থেকে ওকে। ওর চিহ্ন যেন না থাকে আর।”

পরক্ষণেই নিজেকে শূন্যে অনুভব করল পল। ও এখন সত্যি মরবে। নোভাকে আর দেখা হবে না। আর বলা হবে না, “ভালোবাসি তোমায় জংলী ফুল। হা! প্রভু, একটু করুণা হলো না আমার ওপর তোমার? নোভা, নোভা…….ওকেই না হয় বাঁচাও প্রভু। নোভা, নোভা…..”

পলের নেকড়ে শরীর নিচের ঘন অরণ্যে ঘেরা খাদে হারিয়ে যেতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন রিচার্ড। রাস্তা পরিস্কার এখন। ঘুরে দাঁড়াতে পলের ব্যাগটা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিলেন হাতে। একটা জার্নাল, কিছু খাদ্য, পানীয়, অর্থ আর ছুরি। পলের শরীর যেদিকে হারিয়ে গেছে সেদিকেই ছুঁড়ে ফেললেন।

“বেচারা চাকরের আত্মা মুক্তি পাক, আমিন।”

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে