#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮৩
Writer তানিয়া শেখ
নিজ শহরে এসেছে পল। সাথে নিকোলাস। পলের বুক ধুকপুক করছে প্রাসাদের সামনে এসে। আজ ও নোভার সামনে নিজের মনের কথা প্রকাশ করবে। সারা পথ কথাগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে সব আবার আগের মতো এলোমেলো হয়ে গেল।
নিকোলাস গাড়ি থেকে নেমে কোনো কথা না বলে সোজা নিজ কক্ষে চলে গেল। পুরোটা পথ গম্ভীর হয়ে ছিল। নববধূর থেকে আলাদা হওয়ার বেদনা বুঝি ওই গম্ভীরতা। আগামী একমাস ইসাবেলাকে দেখবে না ও৷ কথা বলারও তো সুযোগ নেই। ওই এক পত্র আলাপ ছাড়া। পল আগে হলে নিকোলাসের বিষণ্নতা বুঝতে পারত না। কিন্তু এখন বোঝে। নোভাকে ভালোবেসে পৃথিবীর সকল প্রেমিকের কষ্ট বোঝে।
গাড়ি পার্কিং করে ধীর পায়ে প্রাসাদে প্রবেশ করল। অপরাহ্ণেও এই প্রাসাদটিতে ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। এতে পল অভ্যস্ত। কিন্তু পদে পদে অগ্রসর হতে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে তাতে ও মোটেও অভ্যস্ত নয়। যত যাই হোক আজ ও বলবেই নোভাকে। প্রত্যাখ্যাত হলে হবে। প্রত্যাখ্যান! কয়েক ধাপ ওপরের উঠতে পা থমকে যায় সিঁড়িতে। গলাটা শুকিয়ে আসে। বুকের বা’পাশ মথিত হয় নির্মমভাবে। কিছুক্ষণ লাগল এই দুর্বলতা কাটাতে। তারপর আবার ও একধাপ, দুধাপ এমন করে ওপরে উঠতে লাগল। নোভার কক্ষের দরজা পর্যন্ত আসতে মনে হলো পাহাড় চড়েছে৷ পৃথিবীর সর্বোচ্চ পাহাড়।
“একটা মেয়েকে ভালোবাসিস। একটা মেয়ে! তার সামনে ভালোবাসি বলতে এত ভয়! তুই কি পুরুষ? ছি!”
ওর ভেতর থেকে তিরস্কার এলো। পলের যে লাগল না তা নয়। হাজার হোক পুরুষ তো। সিনা টান করে বলল,
“ভয়? ওকে আমি একটুও ভয় পাই না। পিচ্চি একটা মেয়ে।” কিন্তু তখনই নোভার ক্রুর রক্তিম চোখ মনে পড়তে খুক খুক করে কেশে ওঠে। বুকে ঝড় তোলে ওর ডাগর চোখের কঠোর চাহনি। টানটানে সিনে হয়ে যায় সংকুচিত। তিরস্কৃত ভেতরের জনকে কটমট করে বলল,
“একটা মেয়ে, একটা মেয়ে বলছিস? জীবনে কাউকে ভালোবাসি বলেছিস যে আমার ভয় বুঝবি? ওর চোখে তাকালে কেন যেন আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। হাঁটু ভেঙে আসতে চায়।
“তুই শালা গেছিস। ভয়ে নয় প্রেমে।”
পল একথা অস্বীকার করে কী করে। প্রেমে ও সত্যি ভেসে গেছে। নোভা যদি এখন ওকে কূলে তোলে, নয়তো কোন অকূলদরিয়ায় ভেসে যাবে নিজেও জানে না।
“এখানে কী করছিস তুই?” রিচার্ডের বাজখাঁই গলা শুনে চমকে তাকায় পল। চোর ধরা খাওয়ার মতো কিছুক্ষণ দিশেহারা অবস্থা হয়। দ্রুতই সামলে নেয় নিজেকে। কিছু একটা জবাব দিতে হবে।
“উম.. রাজকুমারীর সাথে একটু কথা ছিল।”
“কী কথা?”
পল ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তারপর চোয়াল শক্ত করে বলল,
“কথাটা রাজকুমারীর সাথে ছিল আপনার সাথে না।”
রিচার্ড যে ওর কথার ভঙ্গি পছন্দ করলেন না তাঁর মুখ দেখে বেশ বুঝতে পারে পল। তাতে ওর বয়েই গেল। এই মহলে নিকোলাস, নোভা আর আন্দ্রেই ওর কাছে সম্মানিত। বাকি পিয়েতর সহ কয়েকজনকে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু রিচার্ড বা সোফিয়া তাদের মধ্যে পড়ে না। এঁদেরকে এমনিতেও পছন্দ করে না পল। দরজার দিকে ঘুরে কড়া নাড়ল। একবার, দু’বার। না, ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। আড়চোখে পাশে তাকায়। রিচার্ড দুহাত বুকের ওপর ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে ও ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের রেশ। দাঁতে দাঁত পিষল পল। নোভা দরজা খুলছে না কেন?
“রাজকুমারী, রাজকুমারী?”
“খুলছে না? আহা! কী করে খুলবে বলো তো বাছা! ও কি আর এই কক্ষে আছে? চোখ দেওয়ার সাথে সাথে তোমার ঈশ্বর যদি মাথায় একটু বুদ্ধি দিতো তো দেখতে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। দেখো।”
সত্যিই প্রেম ওকে বোকাসোকার ক্যাটাগরিতে নামিয়ে নিয়েছে। বাইরে থেকে বন্ধ তা ও খেয়ালই করেনি! নোভা তবে কোথায়? জবাবটা এলো রিচার্ডের কাছ থেকে।
“ও আমাদের ছেড়ে আন্দ্রেইর কাছে চলে গেছে।” পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“চিঠিটা নিকোলাসকে দিয়ো। আমিই দিতাম কিন্তু বিশেষ একটি কাজে এই মুহূর্তে দেশের বাইরে যেতে হবে আমাকে। চিঠিটা পড়লেই নিকোলাস বুঝবে কেন নোভা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
পল চিঠিটা হাতে নিলো। সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এলো। নোভা চলে গেছে! ওর মনের কথা না শুনেই চলে গেল! বুকের ভেতর এই অব্যক্ত ভালোবাসা চেপে নিঃশ্বাস নেবে কি করে এখন?
চিঠি পড়ে থম ধরে বসে আছে নিকোলাস। মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। হাতের মুষ্ঠিতে দুমড়ে-মুচড়ে ফেললো চিঠিটা। নোভা মাত্র পাঁচ লাইনে বুঝিয়ে দিয়েছে নিকোলাসের থেকে আন্দ্রেই ওর আপন। নিকোলাস স্বার্থপর, নিষ্ঠুর। যে ছোটো ভাই-বোনের ভুল ক্ষমা করতে পারে না, নিষ্ঠুরভাবে ত্যাগ করে তাকেও নোভা ভাই বলে স্বীকার করবে না আর। মাঝে মাঝে শব্দ তলোয়ারের চেয়েও ধারালো হয়। নোভার চিঠির শব্দ তেমনই ছিল। নিকোলাসের অপরাধী হৃদয়টাকে খণ্ড বিখণ্ড করেছে। যোগ্য শাস্তি দিয়েছে ভাইকে ও। চলে গেছে নিকোলাসকে ছেড়ে। দোষ কার? নোভালির? না, নিকোলাস আবার নিজের দোষে আপনজন হারালো। আপন মায়ের পেটের বোন ওকে ছেড়ে গেল এবার। আর কে রইল ওর পাশে? ইসাবেলা। এক ইসাবেলা ছাড়া আর কেউ রইল না নিকোলাসের। সেও কত দূরে! দুচোখ বুঁজে এলো। রাগটা একপাশে সরিয়ে ভাই-বোনদুটোকে ক্ষমা করলে আজ এই শূন্যতা অনুভব করতে হতো না। এত নিষ্ঠুর, নির্দয় কেন হয়েছিল! অসময়ে অনুশোচনা করে লাভ কী। তাতে তো আর নোভা ফিরে আসবে না। তাছাড়া আন্দ্রেইর কাছেই ভালো থাকব। ওর মতো নোভাকে অবহেলা করবে না, কষ্ট দেবে না ও। যথাযোগ্য সম্মান ও স্নেহ-ভালোবাসা পাবে। আপনজনদের ভালোবাসতে কার্পণ্য করে না আন্দ্রেই। প্রকাশের বেলাতেও না। স্বজনপ্রীতি খুব। বিশেষ করে নোভা ও বড়ো ভাইয়ের প্রতি। এখানেই জিতে গেল ওর থেকে আন্দ্রেই।
“আমাদের ওকে খুঁজতে যাওয়া উচিত। বেশিদূর হয়তো যায়নি।” বলল পল। নিকোলাস চোখ বন্ধ করেই মাথা নাড়ায়,
“কোনো দরকার নেই। থাকতে দে ওদেরকে ওদের মতো।”
“কিন্তু_”
“পল!” সতর্ক করল নিকোলাস,
“এখন যা এখান থেকে। একা থাকতে দে আমাকে। যা।”
পল চুপচাপ মাথা নুয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ইসাবেলা থাকলে ভালো হতো। একমাত্র ওই তো নিকোলাসের মন গলাতে পারে। দরজার কাছে যেতে নিকোলাস আবার ডেকে ওঠে।
“পল, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ভাই তাই না রে? খুব খারাপ, খুব খারাপ।”
পল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। নিকোলাস ঠিক আগের মতোই বসে আছে। শেষ লাইন মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করছে। বোন হারানোর ব্যথা ওর মুখে স্পষ্ট দেখতে পেল। পলের মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগল, নোভা কি সত্যি মনে করে ওর ভাই পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ভাই? এই ভাইকে পরিত্যাগ করাই শ্রেয়? পল কেন তবে একমত হতে পারছে না।
এরপরের কয়েকদিন নিকোলাস এবং পলের মধ্যে নোভালিকে নিয়ে কোনো কথা উঠল না। পল ভেবেছিল আস্তে আস্তে বুকের ব্যথাটা সহনীয় হবে। ক্ষণে ক্ষণে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসার সমস্যাও একসময় ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দিন যত যায় ততই অসহনীয় হয়ে ওঠে সব। অপ্রকাশিত ভালোবাসা ভারি হতে লাগল বুকের ওপর। এত ভার যে মাঝে মাঝে শ্বাস আঁটকে আসে। রাতে ঘুম হয় না। একদৃষ্টে মূক আসমানে চেয়ে থাকে৷ উফ! সেখানেও সেই হৃদয়হরণীয়ার মুখ, সেই চিত্ত চঞ্চল করা ডাগর চাহনি। বিছানার চাদর কাঁটা মনে হয়। নিদ্রাহীন উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় রাতে আবার দিনেও।
কমিউনিটির বাকিরা আড়ালে আবডালে নোভার চলে যাওয়া নিয়ে কটাক্ষ করে। অনেকে খুশিই হয় ওর মতো দুর্বল সদস্যের চলে যাওয়াতে। নিকোলাস নিয়ম করে রোজ দরবারে আসে, সকলের সুবিধা-অসুবিধার কথা শোনে, আদেশ, নিষেধের ফরমান জারি করে। সবই মনে হয় স্বাভাবিক। নোভার শূন্যতা যেন কাউকে স্পর্শ করেনি। কিন্তু ভুল। নিকোলাসের ভেতরটা তেঁতো হয়ে উঠেছে। সূক্ষ্ম ভোঁতা যন্ত্রণা কোথাও টের পায়। নোভাকে ও মিস করছে। ওর আর আন্দ্রেইর শূন্য আসনে তাকালে বুকের ভেতর হা হা করে ওঠে। রাগ করে বলেছিল ওর মুখ দেখবে না। এখন ঠিকই আর কোনোদিন ও মুখ দেখাবে না।
যে রাজত্ব ও ক্ষমতার জন্য এতকাল এত সর্বনাশ, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল আজ সব পাপ মনে হয়। পাপের দহন ক্রমাগত ওর পায়ের পাতা ছিদ্র করে শিরায় পৌঁছে জ্বালাচ্ছে। এই তো সেদিনও ভেবেছিল পুরো পৃথিবী দখল করবে। পুরো পৃথিবী চায়, পৃথিবীর মানুষের দাসত্ব চায়। আজ মনে হয় পৃথিবীটা দখল করে হবে কী? এত মানুষের দাসত্বে করবে কী? দাসত্ব নয় ভালোবাসা চায়। যা ও পেয়েছে। সবার নয় কিন্তু ইসাবেলার ভালোবাসা। সাত রাজার ধনও এর সমতুল্য নয়। বড়ো ভাগ্যবানেরা সাধনা করে এমন ভালোবাসা আর ভালোবাসার মানুষ পায়। ও তো বিনা সাধনায় পেয়েছে। কী ভাগ্যবানই না ও! যে ওকে এত দিলো তাঁকে নিকোলাস কী দিয়েছে? অস্বীকৃতি আর অসম্মান! কেউ বলেছিল, সৃষ্টিকর্তার কাছে যাওয়ার অনেক পথ আছে। ভালোবাসার পথ তারমধ্যে অন্যতম। নিকোলাসও জেনে না জেনে সেই পথেই এগোচ্ছে। এত ঔদ্ধত্য, এত পাপের পর সৃষ্টিকর্তা কী গ্রহন করবে ওকে?
“তুমি কি নত হচ্ছো? মানছো তাঁর প্রভুত্ব?”
ভেতর থেকে তিক্ত স্বরে বলল। নিকোলাসের জিহ্বা জড়িয়ে আসে। ছোট্ট জবাব, হ্যাঁ অথবা না। কিন্তু এই দুটো ছোট্ট জবাবের একটাকে আজ বেছে নিতে প্রচণ্ড এক অন্তর্দন্দের সৃষ্টি হলো। যা শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিতই রয়ে গেল।
নৈশ তৃষ্ণা মিটিয়ে কক্ষে ফিরল রাতে। বাইরে আর ভালো লাগছে না। বিষণ্ণ মনে ইসাবেলাকে চিঠি লিখতে বসল। কেমন আছো, কী করছো ইত্যাদি ইত্যাদি লিখল। নোভার কথা ওকে লেখে না। খামোখা চিন্তা করবে। নিঃসঙ্গ রাতে ইসাবেলার উষ্ণতার অভাব ভীষণভাবে উপলব্ধি করে।
“তুমিহীন সত্যি আমিই মৃত, বেলা। বড্ড একলা। চারপাশে ঘোর অমানিশা। আন্দ্রেই বলেছিল, তুমি ও তোমার ভালোবাসা আমাকে দুর্বল করে ছাড়বে। আঁতে লেগেছিল ওর কথা। প্রতিবাদ করেছিলাম। এখন দেখছি ঠিকই বলেছিল। তুমি আমার শক্তির উৎস হয়ে গেছো। তুমিহীন দুর্বল আমি। কিন্তু এই দুর্বলতাকে ভালোবাসি। তখন মনে হয় আমি আবার আগের মতো মানুষ হয়ে গেছি। আজকাল মানুষ ভাবতে এত কেন ভালো লাগে বলতে পারো, বেলা?……………”
চলবে,,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮৪
Writer তানিয়া শেখ
নোভার দরজায় মস্ত এক তালা ঝুলছে। কে লাগিয়েছে পল জানে না। কী মনে করে কয়েকদিন ধরে ভাবছে নোভার কক্ষে ঢুকবে৷ হয়তো ওখানটা ওর স্মৃতি জড়ানো বলে। একটু ছুঁয়ে দেখবে ওর ব্যবহৃত জিনিসপত্র। ব্যর্থ প্রেমিকেরা কত কী করে। তালাটা প্রথম বাধা হয় ওর।
তালার চাবি খুঁজতে যেতে সংকোচ হয়। কারণ কী দেখাবে? প্রেমে না পড়লে সংকোচ থাকত না। কিন্তু কক্ষে এখন ও ঢুকবেই। লুকিয়ে হলেও। ভোরে সকল পিশাচ কফিনে ঢুকতে পল সাবধানে রশির সাহায্যে নোভার কক্ষের বন্ধ জানালা পর্যন্ত এলো। ওর বলিষ্ঠ হাতে জানালার একটা পাল্লা টেনে খুলে ফেলে। ফ্রেঞ্চ জানালা হওয়াতে সুবিধা হয়েছে। বাধাবিঘ্ন ছাড়াই এক লাফে নোভার খালি কক্ষে প্রবেশ করল। এই প্রথম নয় এখানে এসেছে পল, তবুও আজ আবেগতাড়িত হলো। এই কক্ষের জংলী ফুলের ম্লান সুবাস নোভার স্মৃতি বহন করে। পল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল দেওয়াল, আলমিরা, ফুলদানি, বিছানা, বালিশ শেষে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। টেবিলে এখনও কয়েকটি বই, লেখার খাতা আর কলম পড়ে আছে। মনে পড়ল এই জায়গায় দাঁড়িয়ে জার্নালটা লুকিয়ে ফেলেছিল নোভা। সেই বন্ধ ড্রয়ারে চোখ পড়ল এবার। এখনও বন্ধ সেটা। খুলে দেখবে কী? নোভাকে দেখতে চাওয়া ছাড়া পলের জীবনে এই মুহূর্তে দ্বিতীয় কোনো বাসনা থাকলে তবে তা ওর জার্নালটি পড়া। কিন্তু দুটোই অসম্ভব। নোভা জার্নালটি কাছ ছাড়া করবে না। ওর জীবন্মৃত সময়ের শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সবই ওতে রয়েছে। প্রকৃতি নয় বলেই সব গোপন করে। কিন্তু পলের যে খুব জানতে ইচ্ছে হয় সেসব। বিবেকের সাথে এক চোট লড়ে একসময় ড্রয়ারটা খুললো। হতাশ হবে ভেবে নিশ্চিত ছিল। তবুও কেন খুলতে গেল? সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায় না।
আশ্চর্য! ওই তো জার্নাল। পল আস্তে আস্তে ওটা হাতে তুলে নেয়। খোলে না। অনিমিখ চেয়ে আছে। হঠাৎ যেন ভাবোদয় হলো এমনভাবে কক্ষের চারিদিকে তাকালো। জার্নালটা রেখে দৌড়ে গেল আলমিরার কাছে৷ খুললো ওটা। কাপড় অগোছালো। কিছু কাপড় নেই। জুয়েলারি বক্স খুলে দেখল এবার। শূন্য। তবে কী সত্যি স্বেচ্ছায় গেল নোভা? পল তবুও ভালো করে আলমিরা ঘেঁটে দেখছে। ঠিক তখনই চোখে পড়ল জিনিসটা। একদম নিচের তাকের অগোছালো কাপড়ের ভাঁজে চকচক করছে। কাপড়টা সরাতে বেরিয়ে এলো নোভার প্রিয় আংটি আর হার। পেঁচিয়ে আছে একটার সাথে অপরটা। পলের সন্দেহ প্রবল হতে লাগল। ভালো করে সবকিছু দেখছে। সব ঠিক নেই। এত তাড়া কীসের ছিল নোভার? ভাইকে ঘৃণা করে, তাই বলে এত তাড়া? গুছিয়ে কিছু নেবে না? এমনকি এই জার্নাল, যা ওর এত প্রিয় সেটাও না! পলের মুখের রক্ত সরে গেল। মনে পড়ল নোভা এর আগেও কিডন্যাপ হয়েছিল। এবারো এমন কিছু হলো কি? জার্নালটা কোমরে গুঁজে বের হয়ে এলো নোভার কক্ষ থেকে। নিকোলাসের জেগে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নোভার খারাপ কিছু হওয়ার আশংকায় ও স্থির থাকতে পারছে না।
দুপুরের পরে নিকোলাস কফিন ছেড়ে নিজের কক্ষে যেতে চিন্তিত পলকে দেখল।
“কী হয়েছে?” দুর্বল গলায় জানতে চাইল। রক্ত তৃষ্ণা পেয়েছে ওর৷ মনে মনে বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু পলের মুখ দেখে বুঝল তাতে বাধা পড়বে৷
“নোভা আন্দ্রেইর কাছে যায়নি, মনিব।”
“কী বলতে চাস?” চকিতে ঘুরে তাকাল ওর মুখের দিকে ফের। পল একে একে সব খুলে বলতে গম্ভীর হয়ে যায় নিকোলাস। চেয়ার টেনে বসে পড়ে। কেমন যেন লাগছে৷ তৃষ্ণার্ত বলে নয়।
“দরবারের কোথাও চিঠিটা ফেলে দিয়েছিলাম। সবার শেষে আমিই বের হয়েছি ওখান থেকে। চিঠিটা এখনও দরবারের কোথাও পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আয় ওটা। ভালো করে আরেকবার দেখব।”
পল যাচ্ছিল আবার ডাকল,
“জার্নালটা দিয়ে যা।”
জার্নালটা এখনও জামার নিচে লুকিয়ে রেখেছে পল। খুলে দেখেনি৷ কিংবা বলা যায় দেখতে পারেনি। নিকোলাস নিলে খুলে পড়ে দেখবে৷ নোভা যখন জানবে নিশ্চয়ই খুশি হবে না। ওর ইতস্তত দেখে ধমকে ওঠে নিকোলাস।
“আমার মনে হয় জার্নালে ওর নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে তেমন কিছু লেখা নেই।” পল শুকনো ঢোক গিললো। নিকোলাস বলল,
“তবুও ওটা আমার দেখতে হবে। দে এদিকে।”
পলের হাত অসাড় হয়ে আসে। নিকোলাসের চোখের রং বদলে গেছে। ভয়ংকর দেখাচ্ছে। পল কী করবে এখন! ওর দেরি অসহ্য হয়ে ওঠে নিকোলাসের কাছে৷ হাতটা চেয়ারের আর্মরেস্ট খামচে ধরেছে।
“পল!” বজ্রনির্ঘোষের মতো শোনা গেল। পল না চাইতেও দিতে বাধ্য হয়। খপ করে কেড়ে নিয়ে খুলতে গিয়ে আবার পলের পাথর হয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকালো।
“এখনও গেলি না?”
পল দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে নিজেকে সহস্র তিরস্কার করে। জার্নালের কথাটা না বললেই হতো। কেন যে বললো? নোভা ফিরে এসে যখন জানবে পলকে আরও বেশি ঘৃণা করবে৷
পুরো দরবার খুঁজেও চিঠির চিহ্ন পেল না। হতাশ হয়ে ফিরে এলো নিকোলাসের কক্ষে। নিকোলাস চোখ বন্ধ করে বসে আছে। জার্নালটা এখনও ওর কোলের ওপর। একহাতে শক্ত করে ধরে আছে। পলের উপস্থিতি টের পেয়েও তেমনই রইল।
“নোভার চিঠিটা পেলাম না।”
নিকোলাস উঠে জার্নালটা সশব্দে পাশের টেবিলের ওপর আছরে ফেলল।
“তুই এটা পড়েছিস?”
“কী?”
“জার্নালটা পড়েছিস তুই?” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল নিকোলাস। পল মাথা নাড়ায়,
“না, ওখানে কী নোভার হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে কিছু লেখা আছে?”
নিকোলাস জবাব দিলো না। চুপ করে ওর দিকে অগ্নিচোখে চেয়ে রইল। পলের মুখে আজ রাজকুমারী নয় নোভা! পল সহজে মনিবের চোখে চোখ রাখে না। দৃষ্টি তাই পায়ের দিকে। কঠিন নীরবতা ভেঙে নিকোলাস বলল,
“রিচার্ডকে ডাক।”
রিচার্ড স্বাভাবিকভাবে এসে দাঁড়ালেন পুত্রের সামনে।
“কী হয়েছে?”
“নোভা কোথায়?” নিকোলাসের প্রশ্নে ভুরু কুঁচকে ফেললেন রিচার্ড।
“কেন চিঠি পাওনি? ওখানে তো সব লিখেছে ও।”
“চিঠি ও আপনাকে নিজে হাতে দিয়েছে?”
“না, আমার চাকরের হাতে।”
“তাকে ডাকা হোক।”
একটু পর চব্বিশ পঁচিশ বছরের এক পিশাচ যুবক এসে দাঁড়ায় সেখানে। সোনালি চুলের মাথাটা অবনত করে অভিবাদন জানালো।
“নোভা তোর হাতে চিঠি দিয়েছিল?”
“জি, কাউন্ট।”
“কিছু বলেছিল?”
“চিঠিটা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, বাবাকে দিয়ো।”
“আর কিছু না?”
“না, কাউন্ট।”
একটু ভাবল নিকোলাস। এই ফাঁকে চাকরটির ভীত রক্তশূন্য দৃষ্টি সাবধানে মনিবের দিকে যায়। রিচার্ড ইশারায় বুঝালেন সন্তুষ্ট হয়েছেন চাকরের অভিনয়ে। পল নোভার চিন্তায় ডুবেছিল। পাশে দাঁড়ানো দুজনের যড়যন্ত্র ওর নজর এড়িয়ে গেল তাই অনায়াসে। নিকোলাস চাকরটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালো করে ভেবে বল দেখি, সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলি কি না।”
চাকরটি ভাবল। সময় নিয়ে বলল,
“তেমন কিছু তো দেখিনি কাউন্ট। তবে তাঁকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। ছোটো মনিব যাওয়ার পর থেকে মনমরা থাকতে দেখেছি৷ কিন্তু সেদিন যেন খুব বেশি মনমরা ছিলেন।”
অপরাধবোধের চপেটাঘাত পড়ল যেন নিকোলাসের মুখে৷ চাকরটিকে বিদায় দিয়ে রিচার্ড বললেন,
“খামোখা চিন্তা করছো। জানোই তো আন্দ্রেইর সাথে ওর কত মিল। সৎ ভাইয়ের চোখে দেখেছে কখনো? ওর ভাই বলো বন্ধু বলো ওই একটিই, আন্দ্রেই। সেই ছোটোবেলা থেকে একে অপরের ছায়া হয়ে থেকেছে ওরা। ও যে আন্দ্রেইর টানে যাবে সে আমি আগেই জানতাম৷ এতদিন যখন কাছে ছিল খোঁজও নেওনি বোনের। চলে যেতে এত দরদ জাগছে কেন তোমার? না কি আন্দ্রেইকে হিংসে করছো?”
“সংযত হয়ে কথা বলুন রিচার্ড। আন্দ্রেইকে হিংসে করতে যাব কেন?”
“নোভার হাতের লেখা চিঠি পড়ার পরও তাহলে এত ঝামেলা করছো কেন? কমিউনিটির সকলে শুনলে আমার মতোই ভাববে। হয়তো তারচেয়েও বেশি।”
“থামুন। সুযোগ পেলেই আবোল-তাবোল বকতে থাকেন৷ আপনার প্রয়োজন শেষ এবার আসুন।”
রিচার্ড রাগ রাগ মুখে বেরিয়ে গেলেন দরজার বাইরে। পল এগিয়ে এলো।
“আমার কেন যেন রিচার্ডের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনি একবার নোভার কক্ষে ঘুরে আসুন। ওখানে সব ঠিক নেই। আমি কী করে বুঝাব আপনাকে! আচ্ছা এসব না হয় বাদই দিলাম। বাইরে যুদ্ধ চলছে। এই অবস্থায় ওর কি অতদূর একা যাওয়া ঠিক? পথে যদি কিছু ঘটে?”
“পরিষ্কার করে বল।” ক্ষোভ প্রকাশ পেল নিকোলাসের গলায়। পল বলল,
“আমি ট্রিয়ের সেই জঙ্গলে যেতে চাই যেখানে আন্দ্রেই নির্বাসিত।”
“পল!”
পল এবার আকুতির পর্যায়ে চলে যায়,
“আমাকে যেতে দিন, মনিব। সত্যিটা আমাকে জেনে আসতে দিন৷ আমি জানি, বোনের জন্য আপনারও চিন্তা হচ্ছে। রিচার্ডের কথায় ভরসা করে চুপচাপ বসে থাকা আমাদের ঠিক হবে না। তাছাড়া নোভা একা এতদূর গিয়েছে। পথে বিপদ টিপদও হতে পারে। আপনার শত্রুর অভাব নেই। এর আগেও একবার ও কিডন্যাপ হয়েছিল। আমার মন কু গাইছে। আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিন। আমি ওর খোঁজ নিয়ে আসলে আপনিও নিশ্চিন্ত হবেন।”
নিকোলাস ওকে গভীর দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। তারপর হাঁপ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
“যা।”
পল খুশি হয়ে বলল,
“আজই রওয়ানা হই?”
“হুম।” জার্নালটির দিকে চেয়ে নিকোলাস পুনরায় বলল,
“আজ থাক। কাল সকালে রওয়ানা দিস। আজ রাতে তোর সাথে আমার কিছু কাজ আছে।”
পলের মুখের খুশিটুকু মলিন হলো। তবুও জোরপূর্বক স্মিত হেসে খুব নিচু গলায় বলল,
“ঠিক আছে।”
রিচার্ড দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কান পেতে সব শুনলেন। দাঁত কামড়ে বিড়বিড় করে বললেন,
“বাস্টার্ড পল, খুব নোভা নোভা করছিস। ভেবেছিস বুঝি না কিছু? বাগে পাই একবার তারপর তোর নোভা নোভা জপ ছুটিয়ে দেবো শালা।”
চন্দ্রদেবীর সামনে সূর্যদেবের দূত এসে বন্দনা জানালো।
“কী সংবাদ নিয়ে এসেছো?” বললেন দেবী।
“আগাথার হদিস পাওয়া গেছে।”
দেবী স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
“কোথায়?”
“পাতালপুরীর উপরিভাগে।”
দেবী অবাক হলেন।
“পাতালপুরীতে!” তারপর বললেন,
“সূর্যদেব সেখানে কী করে পৌঁছালেন?”
“আপনি তো জানেন সূর্যদেবের স্বভাব। সমস্ত উপরিমণ্ডল খুঁজেও যখন আগাথাকে পেলেন না ভীষণ রেগে গেলেন। ব্যর্থতা তাঁর আত্মগরিমাকে আঘাত করে। পণ করলেন যে করেই হোক আগাথাকে খুঁজে বের করবেন। আমাদের কোথায় না পাঠিয়েছেন! শেষমেশ পাতালপুরীতে রাতের গুপ্তচরদের পাঠানো হলো। কোনো একটা কারণবশত ওদের সর্দার তাদের মিথ্যা বলেছিল। এর শাস্তি অবশ্য পরে সূর্যদেব তাকে দিয়েছেন। সূর্যদেব তবুও থামলেন না। গুপ্তচররা একসময় খবরটা দিলো। এক জাদুর বোতলে বন্দি করা হয়েছে আগাথাকে। অমাবস্যার আঁধারের এক টুকরো কালোতে জড়িয়ে শূন্যে রাখা হয়েছে বোতলটা। স্থানটিকে সকলের চোখের আড়াল করতে জাদুকরি পন্থা অবলম্বন করেছে। সফলও হয়েছিল বলা যায়। কিন্তু ধরা একসময় ঠিক পড়ল। এর জন্য দায়ী আসল ব্যক্তি কে তা এখনও শনাক্ত করা যায়নি।”
দূতের কথা শুনে দেবী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,
“আগাথা এখন কোথায়?”
সূর্যদেবের দূত কাউকে ডাকতে একটা বোতল হাতে একজন সেবক এগিয়ে এলো। ভেতরে অস্পষ্ট ধোঁয়াশা। তারমধ্যে আগাথার দুর্বল আত্মাটার এক ঝলক দেখলেন দেবী।
চলবে,,,,