তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৮০+৮১+৮২

0
1021

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮০
Writer তানিয়া শেখ

মধ্য রাত। অদূরে কোথাও গির্জার ঘণ্টা বেজে উঠল। মৃদু কাঁপিয়ে দিলো ইসাবেলাকে। এতক্ষণ আয়নার সামনে তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হুঁশ ফিরতে ফের চোখ পড়ে নিজের বধূবেশের দিকে। সাদা গাউন, মাথায় হিরের সাদা লাল মিশেলের পাথরের টাইরা, কানে ও গলায় একই রঙের কানের দুল এবং হার। বিয়ের সাজে প্রতিটি মেয়েই বুঝি অনিন্দ্যসুন্দরী। নিজেকে এত সুন্দর আগে লাগেনি ওর। নিকোলাসকে পাওয়ার আনন্দ কী এমন করে রঙে, রূপে প্রকাশিত হচ্ছে? আচ্ছা আজ ইসাবেলাকে দেখে মুগ্ধ হবে তো নিকোলাস? ইসাবেলা খুব চায় ও মুগ্ধ হোক। ওর জন্যই তো এত সাজসজ্জা। আজকাল ওর চোখেই নিজেকে দেখে। হীনম্মণ্যতাগুলোকে ভুলে যায়। ও সুন্দর। নিকোলাসের জন্য সুন্দর। লোকে শুনলে বলবে, কী আদিখ্যেতা! প্রেমে বুঝি কেউ আর পড়েনি, প্রেমিকা বুঝি কেউ আর হয়নি। কিন্তু ওরা তো আর ইসাবেলা নয়। ইসাবেলা যেমন করে নিকোলাসকে ভালোবেসেছে আর কে আছে এমন ভালোবাসবে? কেউ না, কেউ না।

মাথায় পর্দা টেনে নেয়। মুখের ওপর ফেলেনি এখনও। আরেকটু দেখবে নিজেকে। আজ নিজেকে দেখতে ওর বেশ লাগছে। কিন্তু বুক ঢিপঢিপানির যন্ত্রণায় এই বেশ লাগাটা ঠিক বেশ হচ্ছে না। কিছু সময় পরেই ও আর নিকোলাস বৈবাহিক সম্পর্কে বাঁধা পড়বে। অবশেষে এক হবে ওরা। জীবনটা যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। যেমন দেখেছিল তেমনই তো হচ্ছে। কী প্রশান্তি!

মনের শান্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। মনে পড়ে রক্তসম্পর্কের আত্মীয়দের কথা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সকলে। ওরা জানেও না ওদের অজান্তে কত বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও। স্বার্থপরের মতো নিজেকে সুখী করতে সকলকে উপেক্ষা করছে, ধোঁকা দিচ্ছে। এই স্বার্থপরতার জন্য কী বিধাতা কঠিন শাস্তি দেবেন? তাঁকেও তো ইসাবেলা অসম্মান করেছে। যে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেনি ও কি না তাকেই সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসল! ভয়ের ডঙ্কা বাজে বুকের ভেতর। কিন্তু সেই ভয় নিকোলাসকে পাওয়ার আনন্দের চেয়ে বেশি নয়। ক্ষণিক জাগা ভয়টাকে আজকের এই সুখের সমুদ্রের অতলে ছুঁড়ে ফেলে। সামনে যত সংকটই আসুক না কেন সাহসের সাথে মোকাবিলা করবে। ভয় কীসের নিকোলাস পাশে আছে না?

দরজায় টোকা পড়ে। পুরুষালি গলায় একজন বলে উঠল,

“ভেতরে আসতে পারি? কাউন্ট আপনাকে নিতে পাঠিয়েছেন।”

ইসাবেলা শেষবার আয়নায় নিজেকে দেখে ফের লম্বা শ্বাস ছাড়ে। বুকের ভেতর যেন আষাঢ়ে মেঘ ডাকছে। চিত্ত বড়ো চঞ্চল। মুখের ওপর পর্দা ফেলে দরজার ওপাশে থাকা ব্যক্তিটিকে প্রবেশের অনুমতি দিলো। পিয়তর গুসেভ এসেছেন। ইনাকে সেদিন ওই মেয়ের উদর ছেদনের সময় দেখেছিল ইসাবেলা। ওদের বাড়ির পাশের সেই কবরস্থানের কবরটিও তো পিয়েতরেরই। এছাড়াও বোধহয় দেখা হয়েছিল। কিন্তু সামনা-সামনি সাক্ষাৎ হয়নি। পিয়েতর কাছে এসে ওর হাতটা ধরলেন। করপুটে চুমো খেয়ে আন্তরিক গলায় বললেন,
“পিয়েতর গুসেভ। আগে দেখা হলেও ঠিকভাবে সাক্ষাৎ হয়নি। চমৎকার লাগছে আপনাকে। কাউন্ট নির্ঘাত বাকরুদ্ধ হবেন।”

ইসাবেলা লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। কথা বলল না। কী বলবে ঠিক খুঁজে পায় না। পিয়েতর মুচকি হাসলেন।

“আমি আপনাকে এখান থেকে বিয়ের আসর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য পেতে পারি, হবু কাউন্টেস?”

মস্তিষ্কে সূক্ষ্ণ ব্যথা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। বাবার অনুপস্থিতি খুব টের পেল। কান্না গিলে ফের মাথা নাড়ায়। পিয়েতর বাহু কোণ করে বললেন,

“কাউন্ট অধীর হয়ে আছে। আর দেরি হলে বেচারার ওপর টর্চার করা হবে। চলুন।”

মজা করে হাসলেন। পিয়েতর বয়স্ক তবে গম্ভীর নন। ইসাবেলার তাই মনে হলো। ইসাবেলা সংকোচের সাথে তাঁর বাহুর ফাঁকে হাত রাখল। অন্য হাতে একগুচ্ছ শুভ্র ফুল। পিয়েতর সারল্য মাখা হাসি উপহার দিয়ে বেরিয়ে এলেন কক্ষের বাইরে।

“নার্ভাস?”

“হুঁ?” পিয়েতরের প্রশ্নে চমকে তাকালো ও। পিয়েতর অন্য হাতটা ইসাবেলার হাতের ওপর রেখে মৃদু চাপ দিয়ে বললেন,

“কাউন্টের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে করুন। দেখবেন নার্ভাসনেস আর থাকবে না।”

ইসাবেলা তাই করল। ফলও পেল। নিকোলাসের সাথে কাটানো মুহূর্ত ওর স্নায়ু শান্ত করে।

“আই উইশ আমি আপনাকে বিয়ে সম্পর্কে ভালো ভালো নসিয়ত দিতে পারতাম। কিন্তু আফসোস এ ব্যাপারে পূর্ব অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই।” বললেন পিয়েতর। ইসাবেলা বিস্মিত হয়ে বলল,

“আপনি কখনো বিয়ে করেননি?”

“দুর্ভাগ্যবশত একবারো না। তবে কাউন্টকে বশ করার কৌশল শেখাতে পারব। যদিও আমার মনে হয় সেটার আর প্রয়োজন হবে না। অ্যাংরি ইয়াং ম্যান আপনার প্রেমে ইতোমধ্যে সফট প্রেমিক পুরুষে পরিণত হয়েছে।”

ইসাবেলা লজ্জায় অধোবদন হয়ে মুচকি হাসল। পিয়েতরও হাসেন। দুজনে দুর্গের ব্যাকইয়ার্ডের নেমে এলো।

রাতটা উজ্জ্বল। চাঁদের আলোয় বিধৌত সমস্ত ব্যাকইয়ার্ড। আকাশে রুপোলী তারার সামিয়ানা। শীতল হাওয়া বইছে। শীতে কাঁপুনি দিয়ে ওঠে ইসাবেলার শরীর। কিন্তু তা সাময়িক। বিয়ের ভেন্যু হ্যাজাকের আলো, কাঠের আগুনে উষ্ণ। ব্যাকইয়ার্ডের একপাশে সুন্দর করে সাদা এবং লাল ফুলে সাজানো হয়েছে। সামনে তাকাতে নিকোলাসকে দেখতে পেল। কালো টুক্সিডো স্যুট পরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কালো সিল্কি চুলগুলো পরিপাটি করে একপাশে সাইড করে আঁচড়ানো। ঠিক আর পাঁচটা বরের মতো সাজলেও ওকে সাধারণ লাগছে না। প্রতিটি মেয়ের স্বপ্নের ক্যানভাসে যে সুদর্শন রাজপুত্রের ছবি আঁকা হয় নিকোলাস যেন তাই। হৃদয় হরণকারী এই সুদর্শন পুরুষটি ওর হবে। একান্ত ওর। আনন্দে চোখে জল টলমল করে।

নিকোলাস একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে আগত ইসাবেলার দিকে। নীল চোখে ঘোর লেগেছে। হাতটা বুকের বা’পাশে। খুব জোরে শব্দ হচ্ছে সেখানে। শব্দ! না না, এ যে মিলন বেলায় বেজে ওঠা মৃদঙ্গ ধ্বনি। ঠোঁটের কোণের প্রসস্থতা ক্রমশ দীর্ঘ হয়।

পিয়েতর ইসাবেলাকে নিয়ে ওর সামনে এসে থামলেন। নিকোলাস হাত বাড়িয়ে ইসাবেলার হাতটা নিলো।

“ধন্যবাদ, পিয়েতর।” বলল নিকোলাস।

ইসাবেলার মনের অবস্থার কথা স্মরণ করে পিয়েতরকে পাঠিয়েছে নিকোলাস। বিয়েতে হাতেগোনা কয়েকজন উপস্থিত। সকলেই নিকোলাসের শুভাকাঙ্ক্ষী। ও জানে এখানে একমাত্র পিয়েতরই আছেন যিনি ইসাবেলার মন ভালো করতে সক্ষম। বাকিরা ঠিক আগের নিকোলাসের মতো বর্বর। পিয়েতর মুচকি হেসে সামনের অতিথি আসনে গিয়ে বসলেন। নিকোলাস আবার তাকালো হবু স্ত্রীর দিকে। পূর্ণিমা চাঁদের ন্যায় সুন্দর যেন ও। এই পূর্ণিমার চাঁদটা ওর আকাশের। হাতের মধ্যে থাকা ওর কোমল হাতদুটোকে মৃদু চাপ দিয়ে বলল,

“ইউ লুক ব্রেথটেকিংলি বিউটিফুল, মাই লাভ।”

পদ্মের মতো কোমল হাতটার ওপর চুম্বন করল। আজ মনে হচ্ছে নিকোলাসের দেহে প্রাণ এসেছে। জীবন্তের মতো আনন্দ, অনুভূতি টের পাচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধ করেছে ইসাবেলার বধূবেশ।

ওদের দুজনের মাঝে দাঁড়ানো পলকে ওরা যেন ভুলেই গেছে। হালকা কেশে উঠল পল। ইসাবেলা সলজ্জে কাতর হয়। নিকোলাস হয় বিরক্ত। মনিব এবং ইসাবেলার ভালোবাসা পলকে পুলকিত করে। এই যে নিকোলাস বিরক্ত হয়ে তাকালো তাতে বেশ মজাই পেল ও। কিন্তু প্রকাশ করবে এমন সাহস নেই। নিকোলাসের অনুমতি নিয়ে বিয়ের কার্যক্রম শুরু করল পল। উপস্থিত সকলকে ভুলে বর কনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। সময় এলো শপথ পাঠের। দুজনের কেউ ই শপথ বাক্য লিখে রাখেনি। আজ মনে যা আসবে তাই শপথ করবে। নিকোলাস শুরু করে,

“যেদিন প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম আমার নিস্পন্দ হৃদয় বহুবছর পর স্পন্দিত হয়। আজও একইভাবে স্পন্দিত হচ্ছে, যতদিন এ হৃদয় আছে এমনই হবে। একমাত্র তোমার জন্য। তোমাকে আমি ভালোবাসি বেলা। এই কথাটা দিন রাতে অসংখ্যবার বলব। ওয়াদা করছি, আমি নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুহূর্ত পর্যন্তও কথাটি আমার ঠোঁটে থাকবে। আমার আঁধার জীবনে আলো তুমি। আজ আমার যা পরিবর্তন কেবলমাত্র তোমার কারণে। ওয়াদা করছি, একজন ভালো পুরুষ ও উত্তম স্বামী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলব শুধু তোমার জন্য। তুমি আমার সঙ্গী, অর্ধাঙ্গিনী। এই জীবন্মৃত দেহের ভেতরের হৃদয়টার অধিকারস্বত্ব তোমাকে দিলাম। চিরতরের জন্য।এই আংটি হাতে নিয়ে আমি ওয়াদা করছি, তোমার বাকি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হব আমি। ওয়াদা করছি, তোমাকে একা ছাড়ব না, তোমাকে আগলে রাখব, ভালোবাসব, তোমার সকল স্বপ্ন পূরণ করব। তোমার কষ্টের কারণ হব না, ঠোঁটে হাসি এনে দেবো, লজ্জায় লাল হবে তোমার সুশ্রী গাল সেই কারণ হব। যতদিন অস্তিত্ব থাকবে এই হাত ছাড়ব না। তোমার ছায়া হব রোদে, বৃষ্টিতে ছাউনি। তোমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে স্মরণীয় করব। ওয়াদা করছি, প্রতিদিন তোমার প্রেমে পড়ব, নতুনভাবে, আগের চেয়ে বেশি করে।”

থামল নিকোলাস। সমস্ত হৃদয় উল্লাসিত। হাতের ছোট্ট হিরের আংটিটি ইসাবেলার অনামিকায় পরিয়ে দিলো। ইসাবেলা চোখ মুছলো। ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে বলতে লাগল,

“প্রথম তোমাকে দেখে আমি নির্বাক তাকিয়ে ছিলাম। কেন যেন বহুদিন পর যন্ত্রণাকাতর মন তোমাকে দেখে শান্তি পায়। বড়ো বিরক্ত হলাম আমি। সূর্য যেমন রাত থেকে দূরে পালিয়ে বেড়ায় আমিও তোমাকে দেখে তাই করেছি। কিন্তু গন্তব্য শেষ তোমার কাছেই হয়েছে। তোমাকে অপছন্দ করতে চাইলাম। যখন তোমার সত্য জানলাম, ঘৃণা করতে চেয়েছি, প্রতিশোধ নিতে চেয়েছি। কিন্তু শেষমেশ ভালোবাসিয়ে ছাড়লে। যত তোমার কাছে গেলাম এক নতুন তোমাকে দেখলাম। যাকে ভালোবাসতে চাইল মন। কিছুতেই বারণ শুনলো না। পূর্বে আমি যা ভালোবাসা ভেবেছি তোমাকে দেখে জানলাম সব ভুল। এই নির্বোধ মেয়েটাকে তুমি ভালোবাসতে শিখেয়েছো নিকোলাস। ওয়াদা করছি, আজীবন এই শিক্ষা আমি ভুলব না। তোমাকে আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এমনই করে ভালোবাসব। প্রতি মুহূর্ত অনুভব করবে আমার ভালোবাসা। তোমাকে প্রেমিক এখন স্বামী হিসেবে পেয়ে নিজেকে পৃথিবীর সেরা ভাগ্যবতী মনে করছি। ওয়াদা করছি, বাকি জীবন তাই মনে করব। পৃথিবীসুদ্ধ লোক তোমার বিপক্ষে গেলেও আমি তোমার পাশে থাকব, তোমাকে ভালোবাসব, বিশ্বস্ত হব। ওয়াদা করছি, আমি এবং আমার হৃদয় একমাত্র তোমার। ওয়াদা করছি, তোমার মৃতসঞ্জীবনী হব৷ তোমার হাসির কারণ, সুখের কারণ হয়ে রবো। ওয়াদা করছি, আমার আজকের ভালোবাসাকে ছাড়িয়ে যাবে কালকের ভালোবাসা। দিনে দিনে ছাড়িয়েই যাবে।”

দম ফেললো ইসাবেলা। হাতে রাখা আংটিটি নিকোলাসের অনামিকায় পরিয়ে দিলো। নিকোলাস ওর সজল চোখের দিকে তাকালো। দুজনের চোখে-মুখে আজ প্রাপ্তির উচ্ছ্বাস। চারপাশ এখন লুপ্ত শুধু পরস্পরকে অনুভব করছে ওরা।

“আমি নিকোলাস উইলিয়াম, গ্রহন করছি ইসাবেলা অ্যালেক্সিভকে আইনত আমার স্ত্রীরূপে। সে আছে এবং থাকবে সকল পরিস্থিতিতে।” এক নাগাড়ে বলল নিকোলাস। ইসাবেলা আবেগে জড়িয়ে আসা গলায় বলে,

“আমি ইসাবেলা অ্যালেক্সিভ, গ্রহন করছি নিকোলাস উইলিয়ামকে আইনত আমার স্বামীরূপে। সে আছে এবং থাকবে সকল পরিস্থিতিতে।”

একে অপরের হাতটা ওরা শক্ত করে ধরে আছে। পল মুচকি হেসে ওদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দিতে সামনের অতিথিরা হাতে তালি দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়। পল নিকোলাসকে বলল,

“আপনি এখন বধূকে চুম্বন দিতে পারে__” পলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইসাবেলাকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে মুখের ওপর থেকে পর্দা সরিয়ে দীর্ঘ গাঢ় চুম্বন দিলো ঠোঁটে। ইসাবেলার টলমল চোখ উপচে জল পড়ল। আনন্দের আতিশয্যে আরও কাছে টেনে নিলো নিকোলাসকে। কলতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে বিয়ের আসর। পল বিড়বিড় করে বলল,

“আমাকে শেষই করতে দিলো না। নো প্রবলেম। বি হ্যাপি। আমার আশীর্বাদ রইল তোমাদের ওপর। মাই গড! একদম আসল ফাদারের মতো বিহেভ করছি দেখি। ফাদার! হেল নো!”

কেক কাটা থেকে শুরু করে বিয়ের বাকি নিয়ম-কানুন ভালোভাবেই শেষ হয়। অতিথিরা নব দম্পতিকে আশীর্বাদ জানিয়ে চলে গেল। পল গেল দুর্গের ওপরে। নোভাকে আজ খুব বেশি মনে পড়ছে। এবার জার্মানি গিয়ে যেভাবেই হোক মনের কথা বলবে। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় নিয়ে নির্জন রাতে দূর আকাশে চেয়ে রইল।
রাত তখন প্রায় শেষ। ইসাবেলাকে বাড়ি ফিরতে হবে। নিকোলাস ইসাবেলাকে কোলে করে ফিরে এলো। প্রবেশ করল ওর রুমটিতে। দু’হাতে ওর গলা জড়িয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে আছে ইসাবেলা।

“ক্লান্ত?” চাপা গলায় বলল নিকোলাস। ইসাবেলা ঘাড়ের ওপরই মাথা দুদিকে নাড়ালো। হাসল নিকোলাস। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাশে বসল। ক্লান্তি জড়ানো চোখে তাকালো ওর দিকে ইসাবেলা। জীবনে এত নার্ভাস কখনো হয়নি নিকোলাস। কত মেয়ের সান্নিধ্যে গেছে। নারী মহলে নির্লজ্জ, বর্বর বলেই পরিচিত। কিন্তু, আজ ইসাবেলাকে স্পর্শ করতে এত জড়তা! অথচ, ওকে ও চায়। ভীষণভাবে। নির্লজ্জ, বর্বর নিকোলাস আজ স্বামী হয়েছে। তখন আর এখনে অনেক ফারাক। এখন ওর সামনে যে সে মেয়ে নয় বরং ওর প্রিয়তমা স্ত্রী। যাকে ও ভালোবাসে।

“কী হয়েছে?” উঠে বসল ইসাবেলা। নিকোলাস গলা ঝেড়ে বলল,

“কই? কিছু না তো।”

ইসাবেলা লক্ষ্য করল নিকোলাস সরাসরি ওর দিকে তাকাচ্ছে না৷ লজ্জা পাচ্ছে?

“তুমি লজ্জা পাচ্ছো!”

“হু-য়াট? লজ্জা! নো ওয়ে।”

“অবশ্যই। দেখো তোমার কান লাল হয়ে উঠেছে। মাই, মাই। রিয়েলি নিকোলাস?” ফিক করে হেসে ওঠে ইসাবেলা। নিকোলাস কান পরীক্ষা করল। সত্যি কী ওর কান লাল হয়েছে! সেটা কী করে সম্ভব!

“বেলা, স্টপ।” ইসাবেলা গুরুত্বই দিলো না। নিকোলাসকে এমন বিব্রত হতে দেখে হেসে খুন ও। স্বামীকে একটু জ্বালাতে কোন স্ত্রীর না আনন্দ হয়? নিকোলাস ওকে বিছানার ওপর ফেলে দুহাত মাথার দুদিকে চেপে ধরে।

“আমাকে লাজুক বলা বন্ধ করো।”

“করব না। কী করবে, হু? দ্য নিকোলাস উইলিয়ামস বিয়ের রাতে বউয়ের চোখে তাকাতে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। হি-হি-হি।” হাসতে লাগল ইসাবেলা। নিকোলাসের মুখটা ধীরে ধীরে ওর দিকে নেমে আসতে শিহরণে জমে গেল। প্যারালাইজড হয়ে রইল ওর নিচে। নিকোলাস মুচকি হাসল। ওকে লাজুক বলা! নির্বোধ বেলা। কার ইগোতে খোঁচা দিয়েছে ধারণা নেই ওর।ইসাবেলার গলায়, ঘাড়ে, কানে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“থামলে কেন? হাসো?”

“নি-কোলাস!”

“হুম? আমাকে লাজুক বলা তাইনা? চলো তোমাকে দেখাই কতটা নির্লজ্জ আর অসভ্য আমি।”

চলবে,,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮১
Writer তানিয়া শেখ

পরদিন যখন ইসাবেলার ঘুম ভাঙল তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। আজ সূর্য ওঠেনি। তাপমাত্রা নেমে গেছে। জানালার বাইরে তুলোর মতো তুষার পড়ছে। সারারাত জ্বলতে থাকা ফায়ারপ্লেসের আগুন নিভে ছাইয়ে চাপা পড়েছে। এই সুযোগে বাইরের হাড় কাঁপানো শীত ঢুকে পড়েছে ইসাবেলার কক্ষে। লেপটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিলো। একটু নড়াচড়া করতে ব্যথায় দাঁত কামড়ে ধরে।

“শেমলেস বিস্ট!”
ইসাবেলা জানে এই শব্দটি শুনলে নিকোলাসের ইগো সন্তুষ্ট হতো। রাতের উষ্ণ মুহূর্ত মনে পড়ে যায়। এখনও যেন অনুভব করছে নিকোলাসের স্পর্শ। লজ্জায় বালিশে মুখ গুঁজে রইল। সমস্ত শরীরে ক্লান্তি আর অদ্ভুত এক ভালোলাগার স্পর্শ জড়িয়ে আছে। নিকোলাস যে বালিশে মাথা রেখেছিল, যেপাশে শুয়েছিল সেদিকে তাকালে বৃহৎ শূন্যতার গিরি তৈরি হয় হৃদয়ে। ওকে না দেখা পর্যন্ত এই শূন্যতার শেষ নেই। হঠাৎ গলার কাছে চিনচিনে ব্যথা টের পেল। গতকাল নিকোলাস মিলন মুহূর্তে ওর রক্ত পান করেছে। ব্যথা আর সুখের চরম উত্তেজনায় উন্মাদ, দিশেহারা করে ছেড়েছিল। দেহ নিয়ে, সৌন্দর্য নিয়ে হীনম্মণ্যতা যা ছিল সব যেন এই চাদরে দলিত মথিত হয়েছে। জীবনের বিশেষ এই মুহূর্তটিকে ইসাবেলার জন্য চিরস্মরণীয় এবং সবচেয়ে মধুর করেছে নিকোলাস। শুষ্ক ঠোঁটে লাজুক হাসি জেগে ওঠে।

“বেলা, জেগেছ?” তাতিয়ানা দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল। ওর কোলে তাশা। পেছন পেছন আজ্ঞাকারী দাসীর ন্যায় এলো রেইনি। ইসাবেলা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ভাগ্যিস ওর পরনে নাইটি ছিল। কিন্তু সেটাও এই মুহূর্তে নিরাপদ নয়। সর্বাঙ্গে স্বামীর ভালোবাসার স্মৃতি বহন করছে। তাতিয়ানা দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। থুতনি পর্যন্ত লেপ টেনে নিলো। ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকা সবচেয়ে নিরাপদ এই মুহূর্তে। কান খাঁড়া করে আছে। না! আর তো ওদের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। চলে গেল কী?

“উহ!” গালে কামড়ের ব্যথায় চকিতে তাকাল। তাশা ওর শিওরে দাঁড়িয়ে আছে। মুক্তোর মতো সাদা দাঁত বের করে হাসছে। খালার আর্ত আরক্ত মুখ দেখে খুব যেন মজা পেয়েছে।

“বে-ল, বে-ল।” বাবার মতোই ডাকে খালাকে। আদুরে হাতে খালার গালটাতে হাত বুলিয়ে দেয়। কাজটা যে মায়ের প্ররোচনায় করেছে। নয়তো কি খালাকে কষ্ট দেয়! ইসাবেলার রাগ উবে যায় ওর মুখে নিজের নাম শুনে। ইচ্ছে করে দুহাতে জড়িয়ে মুখ ভরে চুমু দিতে, আদর করতে।

“এবার তুই তাশাকে নিয়ে যা।” স্মিত হেসে বলল রেইনিকে তাতিয়ানা। মেয়েটি হাসল না। কিংবা বলা যায় হাসেই না। দিনে দিনে বাড়তে থাকা ওর গম্ভীরতা তাতিয়ানাকে অস্বস্তি দেয়। রেইনি নীরবে মাথা নাড়িয়ে তাশাকে কোলে তুলে নিলো। আশ্চর্যের কথা তাশা আপন পিতা-মাতা থেকেও এই মেয়ের সান্নিধ্য এখন বেশি পছন্দ করে। একটা গম্ভীর বালিকাকে কোনো শিশু কী করে এত পছন্দ করতে পারে!

ওরা দুজন চলে যেতে তাতিয়ানা কোমরে হাত রেখে বোনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

“তাহলে তুমি ঘুমের ভান ধরে পড়েছিলে? জানতে পারি কেন?” প্রশ্ন করল তাতিয়ানা। ইসাবেলা ঠোঁট শক্ত করে বলে,

“এমনিতেই। তুমি কিন্তু কাজটা ভালো করোনি। মাতভেইকে বলে দেবো মেয়েকে তুমি বিপথে নিচ্ছো।”

“বিপথে?” ভ্রু তুলল তাতিয়ানা।

“হ্যাঁ, ওর নিষ্পাপ মস্তিষ্ককে ম্যানুপুলেট করছো।”

বোনের রাগ কেন যেন মাঝেমাঝে উপভোগ করে তাতিয়ানা। বিছানার ওপরপাশে যেতে যেতে বলল,

“ওহ! এখন আমি ম্যানুপুলেটিভ মা হয়ে গেলাম? হলে হয়েছি। তোমার মতো অলস আর ঘুম কাতুরে বোনকে শায়েস্তা করতে মেয়েকে আরও ম্যানুপুলেট করব। একশবার করব।”

“কী শয়তানমার্কা বোনই না দিয়েছে আমাকে ঈশ্বর! বেচারা মাতভেই! মাঝে মাঝে ওর জন্য আমার চিন্তা হয়।”

“বেচারা মাতভেই! হু! ও কোনো বেচারা টেচারা নয়।” তারপর বিড়বিড় করে বলে, “তোমার ওই বেচারা মাতভেই আমাকে বেচারি করে ছাড়ে তা কি জানো? জানলে যে তুমি আর মা খুশিতে লাফিয়ে উঠবে সে আমি খুব ভালো জানি।” হঠাৎ মনে হয় ওর গাল দুটো গরম হয়ে উঠেছে। ইসাবেলা লক্ষ্য করার আগে ঘুরে ওপর পাশের জানালা খুলে দিতে উদ্যোত হয়।

“জানালা খুলছো কেন? শীতে মেরে ফেলবে?”

গলা ঝেড়ে জানালা না খুলে ফিরে এলো তাতিয়ানা। বিছানায় বসতে গেলে চেঁচিয়ে ওঠে ইসাবেলা।

“বসবে না ওখানে?”

ভ্রু কুঁচকে যায় তাতিয়ানার।

“কেন?”

ইসাবেলা কী করে বলবে ওখানে ওর নিকোলাস শুয়েছিল। ওই স্থানে অন্য কেউ বসলে ভালো লাগবে না।

“উ-ম… আ-ম…”

“কী উম আম.. করছো বলোতো? এখানে বসলে সমস্যা কী? রাতে হিসু করে দাওনি তো?” তাতিয়ানার পুনরায় বসতে গেলে ফের চেঁচিয়ে ওঠে ইসাবেলা।

“বসবে না।”

“মেজাজ কিন্তু খারাপ করছো এবার তুমি ইসাবেল।” বিরক্ত হলো তাতিয়ানা।

“কাল রাতে ওই পাশে কার্ল ঘুমিয়েছিল। তুমি নিশ্চয়ই কার্লের শোয়া জায়গায় বসবে না। আমি হিসু করিনি তবে ও করেছে। গন্ধ পাচ্ছো না?”
নাক কুঁচকে বলল,

“কী গন্ধ!”

কার্ল এ বাড়ির নতুন পালিত কালো বেড়াল। ছোটোবেলা থেকেই বেড়াল অপছন্দ তাতিয়ানার। কার্লকে তো আরও বেশি। এই দুটো একে অপরকে সহ্য করতে পারে না। তাতিয়ানার ব্যবহারিক কোনো জিনিস সামনে পেলে তাতে মলমূত্র করবেই কার্ল। নানার প্রিয় না হলে এই কার্লকে তাতিয়ানা মেরেই ফেলতো মনে হয়। মানুষ আর প্রাণীতে এমন শত্রুতা থাকতে পারে তা ওদের না দেখলে ইসাবেলা জানতোই না। তাতিয়ানার গা রি রি করে উঠল। লাফ দিয়ে সরে গেল চার হাত দূরে।

“ইয়াক!” মুড একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে তাতিয়ানার। কী যে বলতে এসেছিল তাও ভুলে গেল। এই রুমে এসেছিল প্রসন্ন মনে। এখন রাগে ঘৃণায় তিক্ত ভেতর। বিছানার দিকে আবার তাকালো। মনে হলো কার্ল ওর সামনেই বিছানায় মূত্র ত্যাগ করছে। তারপর হাত নাড়িয়ে ইশারায় কাছে ডাকছে। না! আর এক মুহূর্ত নয় এখানে। দরজার দিকে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল। কী ভেবে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“খুব গন্ধ তাইনা ইসাবেল?”

“হুম, খুব।” নাক চেপে অভিনয় করল ইসাবেলা। তাতিয়ানা দ্রুত পায়ে ওর জানালার কাছে এলো। দুহাতে ঠেলে জানালা খুলতে শো শো করে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকলো।

“কী করছো তুমি!”

“বন্ধ ঘরে গন্ধ একটু বেশি লাগে। এখন আরাম পাবে তুমি।”

ইসাবেলা স্পষ্ট দেখতে পায় তাতিয়ানার ঠোঁট বেঁকে গেছে। রাগে চেঁচিয়ে ওঠে,

“তাতিয়ানা, আই হেইট ইউ।”

“অ্যান্ড আই লাভ ইউ মাই ডিয়ার সিস্টার।”

হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল তাতিয়ানা। কী যেন বলতে এসেছিল ইসাবেলাকে? ধ্যাৎ! পরে মনে করবে।

রাতে নিকোলাস এলো। কেন যেন খুব লজ্জা করছিল ইসাবেলার। নিকোলাস ওর ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল,

“চলো আজ তোমায় আমার দুর্গে নিয়ে যাব।”

“যেখানে তুমি থাকো।”

“হুম।” নিকোলাসের বলতে ইচ্ছে করছিল, যেখানে আমরা থাকব। কিন্তু রিয়েলিটি হলো, ইসাবেলা ওখানে কেবল বেড়াতে যাবে থাকতে নয়। প্রাচীন নির্জন, ভুতূরে বাড়িতে কি মানুষ থাকতে পারে!

নিকোলাস ওকে নিয়ে চললো নিজের আবাস্থলে। এই প্রথম স্বামীগৃহ যাচ্ছে। ভীষণ এক্সাইটেড ফিল করছে ইসাবেলা। দুর্গে পৌঁছে সরাসরি বাগানে নিয়ে এলো নিকোলাস ওকে। প্রাচীন, জড়-জীর্ণ এই দুর্গে একমাত্র এই স্থানটিতে প্রাণের রেশ আছে। বাতাসে ফুলের সুবাস। দিনের বেলা পাখির কিচিরমিচির শোনা যায়। নিকোলাস দূরে দাঁড়িয়ে রাতে ঝিঁঝির ডাক শোনে। কাছে গেলে ওরা চুপ করে যায়। পিশাচকে বুঝি ওরাও ভয় করে। ওদের সাথে কথা বলা গেলে নিকোলাস বলত,

“ভয় কেন পাস রে তোরা? আমার রুচি অনেক হাই বুঝলি? তোদের খাব না। ডাক, প্রাণ খুলে ডাক।”

ইসাবেলার হাত ধরে বসল একপাশের বেঞ্চে। কোনো এক কারণে খুব বেশি ঠাণ্ডা নয় এ স্থান। এখন তুষার পড়ছে না। মেঘমুক্ত আকাশে তারার মেলা। রূপোলী থালার মতো চাঁদ। এখানে বসে দূরের সাদা বরফের সমতল সাদা চাদরের মতো মনে হয়। অন্যপাশে বিশাল ঘন বন। রাতের সৌন্দর্যে অভিভূত হয় ইসাবেলা। নিকোলাস ফের ওর শীতল ঠোঁটে চুমু দেয়। ইসাবেলা দীর্ঘ করে সেই চুমু। হঠাৎ নিকোলাসকে চমকে দিয়ে বিয়ের ব্যান্ড পার্টির মতো বেজে ওঠে ঝিঁঝি পোকা। আজ নিজের ভেতরের শূন্যতা টের পায় না নিকোলাস। বড্ড সম্পূর্ণ,সন্তুষ্ট মনে হয়। ইসাবেলা যদি আরও আগে আসত ওর জীবনে! সেই মানব যৌবনবেলায়!
এক হাতে ইসাবেলার কোমর জড়িয়ে টেনে নিলো খুব কাছে। আদুরে বেড়ালের মতো গুটিশুটি হয়ে রইল ইসাবেলা। মাথাটা নিকোলাসের কাঁধের কাছে, মুখ গলায় লুকানো। ভালোলাগায় দুচোখ বুঁজে এলো ওর। নিকোলাস মাথার ওপর চুমু খেয়ে বলল,

“ঠিক আছো তুমি?”

“হুম।”

“সত্যি?”

ইসাবেলা চোখ খুললো। নিকোলাসের শার্টের বোতাম নিয়ে খেলতে খেলতে নিচু গলায় বলল,

“উমম..ঠিক আছি আমি।”

“কাল নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আ’ম সরি, লাভ।”

“নিকোলাস! বললাম তো ঠিক আছি। চিন্তা করো না।” মনে মনে বলল,”তুমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলে? আমিই ছিলাম যে তোমাকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করেছিল। নির্লজ্জ নতুন বউ।”

নিকোলাস হাত বাড়িয়ে দেয় ওর মুখের কাছে।

“কামড় দাও।”

“হুঁ?” কিছুটা চমকে তাকায় ইসাবেলা।

“ভয় পাচ্ছো? ভেবেছো তোমাকে আমার মতো করতে চাচ্ছি?”

মাথা দুদিকে নাড়িয়ে পরিহাসসূচক মুচকি হাসল ও। আবার বলল,

“তা যদি পারতাম তবে বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু তোমাকে ভালোবেসে সাধুপুরুষ হচ্ছি। না, কোনো অভিযোগ করছি না। তোমার ভালোবাসা সত্যি যেন ঈশ্বরের দূত। যে আমার মাঝের পাপীকে ধীরে ধীরে একজন সাধু পুরুষে বদলে দিচ্ছে। আমি বুঝেও এবার চুপ করে আছি। কোথাও না কোথাও ঈশ্বরকে জিতিয়ে দিতে সাপোর্ট করছি। কেন করছি জানো? তোমার ভালোর জন্য। তোমার জন্য সব করতে পারি, বেলা। সাধুপুরুষের মতো নিঃস্বার্থ হওয়া সেখানে কিছুই না।”

ইসাবেলা ওর হাতটা ধরে কামড় দিলো। ও যদি ওর জন্য পিশাচ থেকে সাধুপুরুষ হতে পারে, ইসাবেলা পিশাচ হতে পারবে না? তাছাড়া ওর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের ওয়াদা করেছিল।

“যথেষ্ট, বেলা।”

নিকোলাসের রক্তের ঝাঁঝালো ধাতুরূপ স্বাদ ক্রমশ মিষ্টি আর নেশাযুক্ত হতে লাগল। ইসাবেলা নেশাগ্রস্তের মতো চুষছে।

“বেলা, থামো।” সতর্ক করল নিকোলাস। ইসাবেলা যেন শুনতেই পায়নি। বাধ্য হয়ে ইসাবেলার ওর পেছনের চুল ধরে টেনে ওর মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নেয়।

“থামতে বলেছি।”

রক্তমাখা ঠোঁটটা জিহ্বাতে চেটে মুখটা পছন্দের খাবার না পাওয়া শিশুর মতো করুণ করে।

“টের পাচ্ছো কিছু?”

ইসাবেলা সপ্রশ্নে ওর দিকে তাকায়। কী টের পাবে?

“ব্যথা। তোমার দেহের ব্যথা কি টের পাচ্ছো?”

আশ্চর্য হয়ে অনুভব করল ওর দেহের সেই ব্যথাগুলো উপশম হয়েছে। নিকোলাস হাসল। আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল,

“তোমার স্বামীর রক্তের ম্যাজিক দেখলে তো?”

চলবে,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮২
Writer তানিয়া শেখ

পুরো দু সপ্তাহ ঘুরানোর পর অবশেষে দেখা দিলো ড্যামিয়ান। রিচার্ড বসা থেকে উঠে দাঁড়ান। দু সপ্তাহের চেপে রাখা ক্ষোভ চোখেমুখে প্রকাশ পেল। ভয় পান বলে তা চেপে রাখবেন না। তাঁকে এভাবে অপদস্ত করার কোনো হক ড্যামিয়ানের নেই। নেহাৎ সিংহাসনটা চান বলে ওর কাছে নত হয়েছেন। নিকোলাসটা যদি তাঁর প্রতিপক্ষ হয়ে না যেত তবে কি এই ড্যামিয়ানের সাহায্য ভিক্ষা চাইতেন? সিংহাসন একবার দখলে আসুক সব শালাকে দেখে নেবেন।
ক্ষমতা, লোভ মানুষকে যেমন নীচ করে তেমনই মস্তিষ্কের সুস্থতা বিনষ্টেও বড়ো ভূমিকা রাখে। লোভের চাকচিক্যে নিজের বোকামিও দেখতে পায় না।

“তুমি নিজেকে কী __”

“পার্টনার, পার্টনার, ভীষণ মিস করেছি তোমাকে আমি।”

এমনভাবে ড্যামিয়ান তাঁকে আলিঙ্গন করল যেন পুরোনো কোনো বন্ধুকে বহুদিন পর দেখতে পেয়েছে। রিচার্ড রাগটা বাধ্য হয়েই গিলে ফেললেন। স্বার্থের জন্য এইটুকু না করে উপায় কী। রাগটা জমা থাক ভেতরে। সিংহাসনের জন্য কত কীই না করতে হবে। আলিঙ্গন মুহূর্ত বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। রিচার্ডকে আসন দেখিয়ে নিজ চেয়ারে গিয়ে বসল ড্যামিয়ান। টি টেবিলের দুপাশে দুজন। রিচার্ড কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ভেতর ঘর থেকে একজন সুশ্রী তরুণীর আগমনে থেমে গেলেন। তরুণীটির পরনে খোলামেলা দু টুকরো ছোটো পোশাক। উৎকট সাজ। হাতে মদিরা ও পানপাত্রের ট্রে। মেয়েটি তাঁকে একটি সুরা পাত্র ধরিয়ে দিয়ে আরেকটা নিয়ে বসল ড্যামিয়ানের উরুর ওপর। আদর সোহাগ দিয়ে সুরা পাত্রটি ড্যামিয়ানের ঠোঁটের ওপর ধরছে। লক্ষী ছেলের মতো সেও বসে বসে মেয়েটিকে সন্তুষ্ট করছে বলে মনে হবে। লক্ষী ছেলে! মনে মনে শ্লেষের সাথে হাসলেন রিচার্ড। লক্ষী ছেলেদের গুন থেকে লক্ষ ক্রোশ দূরের চরিত্র এই শয়তানটার। সুদর্শন চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর এক শয়তান। খুব সাবধানে ওদেরকে দেখছিলেন রিচার্ড। কোনো তরুণীকে এখন পর্যন্ত দ্বিতীয়বার ড্যামিয়ানের সাথে দেখেননি। এই মেয়েটি নতুন। বাকিদের মতো এর ভবিষ্যতে কী লেখা আছে তার কিছুটা হয়তো ধারণা করতে পারছেন তিনি।

“তারপর বলো পার্টনার, হঠাৎ কী মনে করে?”

“হঠাৎ? তুমি কি ভুলে গিয়েছো আমাদের মাঝের চুক্তি? আজ একটা বছর হতে চললো অথচ, নিকোলাসকে হারানোর কোনো লক্ষণ বা চেষ্টা কিছুই দেখছি না৷ তুমি যদি ভাবো আমাকে ধোঁকা দেবে তবে মনে রেখো তা অত সহজ নয়।”

“চুক্তি, ধোঁকা? শব্দদুটো বলার আগে একবার ভেবে নিলে না পার্টনার?”

“হেঁয়ালি শুনতে আসেনি। যা বলবে পরিষ্কার করে বলো।”

“চুক্তির শর্তমতে তোমারও কিছু দেওয়া ছিল, দিয়েছ?”

রিচার্ডের মাঝে এখনও তিল পরিমাণ অবশিষ্ট থাকা পিতৃত্ব তাঁকে বাধা দিয়েছে। বলেছে এ অন্যায়, পাপ! রিচার্ড থমকে গেছে। মেয়েটা তাঁদের মতো হয়েও তাঁদের একজন না। ওর মুখটা দেখলে প্রিয়তমা মৃত স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। কিন্তু লোভ তাঁকে এমনভাবে দাস বানিয়ে ছেড়েছে যে সকল আত্মীয়তা আজ তুচ্ছ। তুচ্ছ হয়েছে বার বার।নোভালিকে উৎসর্গ না করলে সিংহাসন মিলবে না।
মানুষকে ম্যানুপুলেট করতে তাঁর জুড়ি নেই। কেন যেন ড্যামিয়ানের বেলাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন। এই ড্যামিয়ানের মস্তিষ্ককে কেন বশ করতে পারেন না? সন্দেহ জাগলেও তা ভেদ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন৷ ভয় তখনই পান তিনি। যা ভয় জাগায় তা না ঘাটায় ভালো। নোভালির বিনিময়ে যদি কার্যোদ্ধার হয় তাহলে খামোখা ওত ঘাটাঘাটির দরকার কী। ওর মতো দুর্বল মেয়ে পিতার কিছু তো উপকারে আসুক। ভেতরের শয়তানটার আবারও জিত হয়। বলেন,

“বলেছি যখন নোভালিকে তুমি পাবে।”

“পাবে বললে হবে না যে পার্টনার। এই সপ্তান্তে নোভালিকে আমি চাই।”

“তবে সিংহাসন কবে পাব সেটাও নির্দিষ্ট করে বলে দাও। চুক্তি মতে দুজনই সমান লাভ করব। সপ্তাহ শেষে তুমি লাভ করবে আর আমি আশায় থাকব? তা তো হবে না। নির্দিষ্ট দিন চাই।”

ক্লিনসেভ চোয়াল চুলকে ড্যামিয়ান বলল,

“যদি নির্দিষ্ট দিন না দিই কী করবে? চুক্তি ভেঙে দেবে? চলো তাই করি।”

ভড়কে যান রিচার্ড।

“চুক্তি ভাঙবে! না না।”

“কেন নয়? লাভটা যখন আমার বেশি তখন শুধু শুধু তুমি লস করবে কেন? চলো চুক্তি ভাঙি।” বেশ সিরিয়াস শোনাল ড্যামিয়ানের গলা।

“চুক্তি ভাঙলে নোভালিকে তুমি পাবে না।”

“দরকার নেই। ও আর কী! সামান্য এক পিশাচ নারী।”

রিচার্ড দেখলেন প্রয়োজনটা ওঁরই বেশি। যার প্রয়োজন তাকে তো একটু নত হতেই হবে।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে।” হতাশা ও অসহায়ত্বে দুহাত শূন্যে তুলে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,

“তুমি নোভালিকে পাবে। যে সময় বলেছ তার মধ্যেই। কিন্তু মনে রেখো তারপর আমারটাও চাই। যত তাড়াতাড়ি দেবে ততই মঙ্গল। শুধু আমার একার নয় তোমার জন্যও। কারণ বেশিদিন বোনের নিখোঁজ সংবাদ গোপন থাকবে না নিকোলাসের কাছে৷ ও জানলে কী হবে আর বোধহয় তোমাকে মুখে বলার প্রয়োজন হবে না। আসি।” একপ্রকার ক্ষুব্ধতার সাথে দরজার দিকে হেঁটে গেলেন।

“ডার্লিং, নোভালিটা কে?” কোলের তরুণীটি আহ্লাদিত গলায় প্রশ্ন করতে ড্যামিয়ান রিচার্ডের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে জবাব দেয়,

“আমার মিস্ট্রেস।”

রিচার্ডের পা থামে। ড্যামিয়ান মুচকি হাসল তাই দেখে। রিচার্ড বেরিয়ে যেতে তরুণীর ঠোঁটের ওপর ঠোঁট বসিয়ে দিলো।

দিনের চাইতে রাত এখন বেশি প্রিয় ইসাবেলার। কেমন শান্ত আর সুন্দর। সূর্যের প্রখরতার চেয়ে চাঁদের মেদুর আলো ভালো লাগে। পাখির কলতান মিষ্টি কিন্তু নিশাচর আর ঝিঁঝিরডাক মাদকতা মেশানো। রাতটাকে আরও বেশি রোমান্টিক করে। নিকোলাসের সঙ্গ আর নিশীথের এত আয়োজন ইসাবেলার ভাবনা বন্য করে তোলে। কিছুটা নির্লজ্জ, কিছুটা বেপরোয়া। নিজেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে আবিষ্কার করে তখন।
আর পাঁচটা কাপলের মতো হানিমুন হয়নি বলে মোটেও আপসোস নেই। নিকোলাস রোজ নতুন নতুন মনোরম স্থানে নিয়ে যায়। চাঁদের আলোয় পরস্পরের কাছে আছে। আজকাল আর ওই কয়েকটা উষ্ণ চুমু আর আলিঙ্গনে মন ভরে না। আরও কাছে চায়। মন ছাড়িয়ে দেহের সেই তীব্র আকর্ষণকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কার? আদিম শরীরি উন্মত্ততা ওদেরকে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। মনে রাখে কেবল নিজেদের এবং একে ওপরের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা।

গভীর রাতের আঁধার ফিকে হতে লাগল। এবার ঘরে ফেরার পালা। কিছু সময়ের বিচ্ছেদ। ওইটুকু যে কী অসহ্যের তা কেবল ওরাই জানে। গ্রীষ্মের দাবদাহের চেয়েও প্রবল। এত যে কাছে পায় তবুও মন ভরে না। তবুও কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়। এই রাতটাকে যদি মন্ত্র বলে স্থির করতে পারত নিকোলাস! কোথায় গেলো সেই মন্ত্র পাবে? নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটছে দুজন। রাস্তার পাশে প্রাচীন বৃক্ষসারি। মাথাটা ভারে ওপর পাশের জমিনে নুয়ে পড়েছে। ছাউনির ন্যায় তৈরি হয়েছে। খানিক দূরে দূরে গাছগুলোর অবস্থান হওয়াতে চাঁদের আলো মাঝে মাঝে আলোকিত করেছে পথটা। পথ চিনতে কষ্ট হয় না। ইসাবেলার হাত নিকোলাসের মুঠোর মধ্যে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা শুকনো ডালের আচর লাগতে উঁহু করে উঠল ইসাবেলা। সামান্য একটা ডালের আচরে আর কী হয়? কিন্তু নিকোলাস তা মানবে না৷ প্রিয়সীর পা আর ছোঁবে না এই পথ।

“তোমার ভর আমার পিঠের ওপর দাও।”

ইসাবেলা জানে প্রতিবাদ করে লাভ হবে না। ভালো বউয়ের মতো কাঁধ জড়িয়ে স্বামীর পিঠে চড়ে বসল। দুজনে আবার পথ চলতে শুরু করে। এই পথ পায়ে হেঁটে না চললেও হয়। কিন্তু তাতে ইসাবেলার সান্নিধ্যে আরেকটু থাকা হবে না যে। পথের সঙ্গিনী হিসেবে ইসাবেলার চেয়ে আর কে উত্তম।

“নিকোলাস।” ইসাবেলা কাঁধের একপাশে মাথা রাখল। ঘুম ঘুম পাচ্ছে ওর। আবেশে চোখের পাতা ভারি হয়। নিকোলাস সামনের পথপানে চেয়ে বলল,

“হুম?”

“আই লাভ ইউ।”

মুচকি হাসল নিকোলাস। ইসাবেলার বলা এই তিনটি শব্দ অধিক প্রিয় নিকোলাসের। তারচেয়েও প্রিয় ইসাবেলা। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখ দেখে কপালে আলতো করে চুমু দিলো। তারপর বলল,

“আই লাভ ইউ মোর দ্যান আই ক্যান সে, মাই অ্যাঞ্জেল।”

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে