#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৭৭
Writer তানিয়া শেখ
রাত নেমেছে। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। ঠাণ্ডার তেজ তীব্র। ইসাবেলা দুহাতে নিজেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে এখনও ভাসছে সেই লোমহর্ষক দৃশ্য। একদলা রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড, মেয়েটার ভীত ও করুণ মুখ, ওর পিতা-মাতার সজল শঙ্কিত চেহারা ইসাবেলার ভেতরে কেমন অসহ্য এক অনুভূতির জন্ম দেয়। চারপাশটা বদ্ধ হয়ে আসে। বাতাস যেন এই মুহূর্তে ধারালো সেই ছুরি। শ্বাস নালী কাটছে সূক্ষ্মভাবে।
নিকোলাস উদ্বিগ্ন হয়ে ইসাবেলাকে দেখছে। ওর গোলাপি ঠোঁটজোড়া কাঁপছে থরথর করে। কালো হয়ে উঠেছে। চোখ স্থির শূন্যে। সময় নিলো নিকোলাস। সময় নেওয়াটা জরুরি। নিজেকে সামলে নেওয়া শিখতে হবে ইসাবেলাকে। এরপর ওর জীবনের সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা। ধৈর্য ধরে নিকোলাস। কিন্তু আজ ধৈর্য ধরতে পারছে না। বারবার অধৈর্য হচ্ছে। অস্থিরতা ওর ভেতর-বাহিরজুড়ে। পরীক্ষা কি একা ইসাবেলার? না! আজ নিকোলাসেরও পরীক্ষা। আজকে ওর হার জিত ইসাবেলার ওপর নির্ভরশীল। আস্থা খুব রয়েছে তবুও কীসের ভয়ে যে বুক ধুকপুক করছে! ধৈর্য ধরে থাকাটা এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন।
এই মেয়ে ভাবে নিকোলাস ওকে কাছে পেতে চায় না। আহাম্মক, নির্বোধ কি সাধে বলে? মাঝে মাঝে এত অবুঝ কেন হয়? কথায় কথায় যখন চুমু দিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, জড়িয়ে ধরেছে তখনও কি এই বোধ হয়নি? গতকাল থেকে চুম্বন করেনি ওই প্রিয় ঠোঁটদুটোতে। সংযম তো ছিলোই সাথে ইসাবেলার শাস্তি। ইসাবেলার শাস্তি না ছাই! শাস্তি কাকে বলে ও কতপ্রকার সব মর্মে মর্মে অনুধাবন করছে নিকোলাস। কানে ঝাঁ ঝাঁ করে বাজছে ইসাবেলার সেই ক্ষোভঝরা আত্মসমর্পনের বাক্যটা। কোন পুরুষ প্রেমিকার এমন সমর্পণে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে?
“তোর মতো পিশাচ!” তিক্ত স্বরে নিকোলাসের ভেতরের সত্তা বলল।
“চুপ করো। কথা শেষ হতে দাও।”
মনে মনে কষে ধমক দিলো নিকোলাস। কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটার চাইতেও বেশি অপ্রিয় লেগেছে “তোর মতো পিশাচ” কথাটা। নিকোলাস পিশাচ হতে পারে কিন্তু প্রেমিকও তো। যে প্রেয়সীর ভালোর কথা ভেবে নিজেকে সংযত রেখেছে। কষ্ট কি হয়নি এতে? ভীষণ হয়েছে। ছটফট করেছে প্রতি সেকেন্ড। ইসাবেলাকে চাওয়ার মতো আর কী চেয়েছে জীবনে? ক্ষমতা, শক্তি! তাচ্ছিল্যভরে হাসল নিকোলাস। ইসাবেলার পায়ের নূপুর বানিয়ে দেবে ওই ক্ষমতা ও শক্তি। ঝোঁকের বসে আবেগতাড়িত হয়ে ঘনিষ্ঠ হতে চায় না নিকোলাস। ও জানে এরপর ইসাবেলা পস্তাবে। তাই তো বড়ো কঠোর হতে হয়েছে ওকে।
“নিকোলাস!”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছে ইসাবেলা। এবার ও জবাব শুনতে প্রস্তুত। নিকোলাস বলতে লাগল। কোনো এক পিশাচের খপ্পরে পড়েছিল মেয়েটি। পিশাচটি কেবল ওর রক্তে সন্তুষ্ট ছিল না। মেয়েটিকেও ওর চায়। পরিচয় গোপন করে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুললো। কিন্তু ধরা একদিন ঠিকই পড়ে। মেয়েটি এবার ওকে ভয় পায়। কাছে যেতে চায় না। পিশাচটি পিছু ছাড়ল না। আপোসে নয়তো জোর করে হলেও মেয়েটিকে ও নিজের করবে। এদিকে ঘটনাক্রমে মেয়েটির পরিবার জেনে যায়। মেয়ের ওপর থেকে এতবড়ো বিপদ নামক পিশাচটাকে দূর করতে চার্চের ফাদারের সাহায্য নিলেন। কূটকৌশলে পিশাচটিকে হত্যা করা হলো। কিন্তু ভাগ্যের বুঝি অন্য পরিকল্পনা ছিল। মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়ে যায়। পিশাচদের সন্তান হওয়ার সম্ভবনা খুব রেয়ার। মেয়েটি প্রথমে বিশ্বাস করেনি। পরীক্ষা করে শিওর হয়। মানব শিশুর তুলনায় পিশাচশিশুর বিকাশ দ্রুত ঘটে। কয়েকদিনে ওর পেট ফুটে উঠল। চিন্তায় পড়ে ওরা। মেয়েটির স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে দিনকে দিন। গোপনসূত্রে ব্যাপারটা নিকোলাস জানতে পারে। মেয়েটির পরিবারকে নিজেদের পরিচয় পুরোপুরি দেয়নি। ওরা মেয়ের সুস্থতার আশ্বাস পেয়ে এতটাই খুশি হয়েছে যে নিকোলাস এবং বাকিদের পরিচয় নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। তারপরের ঘটনা ইসাবেলা সচক্ষে দেখেছে। মেয়েটি এখন পুরোপুরি সুস্থ। পরিমিত পিশাচরক্ত পানে দ্রুত আরোগ্যলাভ করেছে।
নিকোলাস এবার ধীর পায়ে ইসাবেলার এক হাত সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইসাবেলা এখনও ভাবনায় ডুবে আছে। নিকোলাস পকেট থেকে আংটির বাক্স বের করে। ভেতরে জ্বলজ্বল করছে নীলকান্তমণি। তারপর এক হাঁটুর ওপর বসে পড়ল নিকোলাস। ইসাবেলার ভাবনার সুতো ছেড়ে। অভিভূত, বিহ্বলিত। দুহাতে মুখ চেপে ধরে রইল। এ যে একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল ওর জন্য। চোখে জল চলে এলো। না, কষ্টের নয় বড়ো আনন্দের। কিন্তু সেই আনন্দে খানিক ভাটার টান এলো নিকোলাসের কথাতে,
“বেলা, একটু আগে যা তোমায় বলেছি ওই সবকিছু তোমার সাথেও ঘটতে পারে। আমি পিশাচ বেলা। আই উইশ আমি সাধারণ মানুষ হতে পারতাম। তবে প্রপোজ ভিন্ন রকম হতো। আমার পথ কাঁটায় ভরা। যাযাবরের ন্যায় চলতে হয়। মৃত্যু প্রতি মুহূর্তে ছায়া হয়ে রয়েছে। আমি রোজ ডাইনিংএ তোমার সাথে খেতে পারব না। সকালের রোদ দেখতে পারব না একসঙ্গে, সন্তান সুখ দিতে পারব না। সংসার পাবে না। পাবে না তোমার কাঙ্ক্ষিত ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রাপ্ত জীবন। আপন রক্তের সম্পর্কও ছাড়তে হতে পারে। তুমি আবেগ দিয়ে নয় ভেবে জবাব দাও। এরপরেও আমাকে তুমি চাইবে? করবে বিয়ে আমাকে? উইল ইউ ম্যারি মি ইসাবেলা অ্যালেক্সিভ?”
বুক কাঁপছে ইসাবেলা। উল্লাসিত বিস্ময় ম্লান হলো। সন্ধানী চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওর দিকে। সব যখন ওর সামনে পরিষ্কার তখন অবিচলিত কণ্ঠে বলল,
“তুমি এসব কেন বলছো বলোতো? তোমার কি মনে হয় এইমাত্র যা বললে তা আমি জানতাম না? হ্যাঁ, এভাবে হয়তো জানতাম না কিন্তু ধারনা তো ছিল। মনে আছে আমাদের প্রেমের শুরু দিকের কথা। দুজনই মনের সাথে যুদ্ধ করেছিলাম। মন্ত্রের মতো পড়তাম, মন দেবো না, ভালোবাসব না। কেন এভাবে বলতাম? কারণ দুজনেরই জানা ছিল আমাদের মাঝে গড়ে ওঠা সম্পর্কে রয়েছে হাজারো বাধা। ভয় পেতাম। পাছে মন ভাঙে, সমাজ না মানে, অভিশপ্ত হই, ক্ষতি হয়, এই হয়, সেই হয় আরও কত কী! এত ভেবেও কী ভালো না বেসে থাকতে পেরেছি? উত্তাল প্রেমের স্রোত আমাদের ভাসিয়ে নিয়েছে অজানার দিকে। পরিণতি না জেনে আমরা এগিয়েছি। ওয়াদা করেছি যাই হোক হাত ছাড়ব না। এখন তবে এসব কথা কেন? একই খাবার টেবিলে বসে হয়তো সাধারণ কাপলদের মতো খাবার খাওয়া হবে না। কিন্তু আমি তোমার সামনে অভ্যাস করব একা খাওয়ার। তুমি চোখের সামনে বসা এই বা কম কীসের? আমার আগে তোমাকে চায় নিকোলাস। সবকিছুর আগে। সন্তান হবে কি না, যদি পেটে এসে যায় তখন মৃত্যুর ঝুঁকি থাকবে ইত্যাদি.. ইত্যাদি। ভবিষ্যতের ওপর ছেড়ে দাও না এসব। নিয়তিকে মানি আমি নিকোলাস। নিয়তি আমাকে তোমায় দিয়েছে। এরপর যদি মৃত্যু দেয় আমি খুশি খুশি মাথা পেতে নেবো, কিন্তু সেদিনও মাথাটা যেন তোমার কোলের ওপরই থাকে।”
“বেলা!” উঠে দাঁড়ায় নিকোলাস।
“চলো, আরেকবার সঠিকভাবে, রোমান্টিকতার সাথে প্রপোজ করো।” ইসাবেলা আদেশের সুরে বলল। গলা জড়িয়ে আসে কান্নায়। নিকোলাস ফের হাঁটু ভেঙে বসতে গেলে হাত তুলে থামিয়ে দেয়।
“থামো।”
ইসাবেলা কয়েক কদম এগিয়ে এলো। এক হাঁটুর ওপর বসতে নিকোলাস বাধা দিতে উদ্যোত হয়,
“বেলা, কী করছো?”
“শাট আপ। একদম নড়বে না। যতক্ষণ প্রশ্ন না করব একটা টু শব্দ করবে না। যদি করেছ_”
ইসাবেলার চোখ রাঙানিতে বাধ্য ছেলের মতো দাঁড়িয়ে রইল নিকোলাস। কিছু বলা উচিত কিন্তু পারছে না। এত সহজে ইসাবেলা ওর হবে! বিধাতা কি এতই প্রসন্ন ওর ওপর? কেন যেন ভয়টার রেশ ওকে খোঁচায়।
“নিকোলাস উইলিয়াম, তুমি আমাকে বাস্তবতা দেখিয়েছো। তোমার ভয় আমার ভবিষ্যতে নিয়ে। অথচ, তুমি জানোই না আমার সবটা আমি কবেই তোমার নামে সঁপে দিয়েছি। তুমি পাশে থাকলে সকল ভয় জয় করব। তোমার হাত ধরে আমি শত সহস্র কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করার সাহস দেখাতে পারি। তুমিহীন জীবন আমার চাই না। মনে করতে পারো আবেগের বশে বলছি। না, ভালোবাসার শক্তির জোরে বলছি। আমি তোমাকেই চাই। থাকতে চাই তোমার সঙ্গিনী হয়ে। এই জীবনের শেষেও যদি কিছু থেকে থাকে সেখানেও। তুমি আমার বিশ্বাস, ভরসা, আমার নিরাপদ আশ্রয়। আমিও তোমার তাই হতে চাই। এক হতে চাই চিরতরে। আই লাভ ইউ জাস্ট দ্য ওয়ে ইউ আর। নাও, উইল ইউ ম্যারি মি নিকোলাস উইলিয়াম?”
নিকোলাস ঘোর লাগা চোখে চেয়ে আছে৷ বার বার মনে হচ্ছে এ কি স্বপ্ন! এ কি স্বপ্ন! ওকে চুপ দেখে চাপা গলায় ধমক দেয়,
“এখনও দাঁড়িয়ে আছো? হাত দাও বলছি।”
নিকোলাস হাত বাড়িয়ে দিলো। বাচ্চা শিশুর মতো দু’হাতে তালি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ইসাবেলা। দু’বাহুতে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
“এখন তুমি শুধুই আমার।”
নিকোলাস ওর বা’হাতে চুমু দিয়ে অনামিকায় নীলকান্তমণির আংটি পরিয়ে দিলো।
“তুমিও শুধুই আমার।”
আংটিটি নাড়াচাড়া করতে করতে ইসাবেলার চোখে জল চলে এলো। আস্তে করে নিকোলাসের বুকের ওপর মাথা রাখে। আজ বড়ো খুশির দিন।
নিকোলাস হাঁপ ছাড়ে। ওর সিক্ত মুখ আঁজলা ভরে তুলে কপালে চুম্বন করল। তারপর ঠোঁটে। দীর্ঘ স্থায়ী হলো সেই চুম্বন। ইসাবেলার শ্বাস আঁটকে যেতে থামল নিকোলাস। কপালে কপাল ঠেকায়। নিচু গলায় বলল,
“নিয়মমতে প্রপোজ আমার করার কথা। হাঁটুর ওপর আমি বসব, তুমি নও।”
“আবার বসবে। সারাজীবন তো পড়েই আছে। ওয়াদা করছি তখন আর বাধা দেবো না।” ইসাবেলার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। নিকোলাস দু’হাতের মাঝে ওর গালটা মৃদু চেপে বলল,
“বড্ড দুষ্টু হয়েছ। বিয়েটা হোক আগে তারপর দেখছি তোমাকে।”
লজ্জায় অধোবদন হয়ে গেল ইসাবেলা। বিয়ে হবে ওর। নিকোলাসের সাথে। যাকে ও সমস্তটা দিয়ে চায়। নিকোলাস ওর থুতনির নিচে তর্জনী রেখে মুখটা কাছে আনল। ঠোঁটে গাঢ় চুম্বন দিয়ে বলল,
“লেটস ডান্স টুগেদার অ্যাট আওয়ার ওয়েডিং।”
চলবে,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৭৮
Writer তানিয়া শেখ
জাদুর বোতলের বন্দিত্বে ছটফট করেন আগাথা। এখান থেকে বের হতে চান তিনি। সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও এই বন্দিদশা ঘোচেনি। চন্দ্রদেবীকে সর্বক্ষণ ডেকে যাচ্ছেন। তিনি জানেন তাঁর সেই ডাক চন্দ্রদেবী পর্যন্ত যাচ্ছে না। গেলে অবশ্যই দেবী সাড়া দিতেন। হতাশ হন। তারপর আবার আশায় বুক বাঁধেন। ডাকেন, বোতলে মাথা কোটেন। একে বন্দিত্বের জ্বালা তার ওপর মনটা কু গাইছে। কেন বন্দি করেছে এরা তাঁকে? কী চায়?
মাঝে মাঝে দু’একজন মানুষের ফিসফিস শুনতে পান। দুজনেই পুরুষ। এদের একজন তাঁকে বন্দি করেছে। দুজনের একজনকেও চেনেন বলে মনে হয় না। কী চায় সেটাও বলে না। প্রশ্ন করলে হেঁয়ালি করে। বিদ্রুপ করে হাসে। কথার ধরণে বোঝা যায় এরা তাঁকে চেনে। তিনি তো আজ মরেননি! তবে কী করে চেনে এরা? অসংখ্য প্রশ্নের জট। কিন্তু তিনি সেই জট ছাড়াতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠেন। এখন একমাত্র চন্দ্রদেবীই তাঁর ভরসা। তাঁর শক্তিবলে যদি আগাথাকে এই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে পারেন নয়তো আর পথ দেখেন না।
চন্দ্রদেবীর সুশ্রী মুখখানায় রাজ্যের চিন্তা। আগাথা এতদিন নিখোঁজ। গোলক পর্যন্ত ওর খবর এনে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বুঝতে পারছেন না কী ঘটছে এসব। কালোরাত কেটে যাওয়ার পরও কেন পৌঁছাতে পারছেন না আগাথা পর্যন্ত! দেবী উঠে দাঁড়ালেন৷ কিছু একটা করতে হবে। এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। দূত মারফত সূর্যদেবের কাছে খবর পাঠালেন। দিনের রাজা তিনি। সবখানেই তাঁর রশ্মি যায়। নিশ্চয়ই একটা আশার খবর তিনি দিতে পারবেন। চন্দ্রদেবী অস্থির, চিন্তিত হয়ে বসে রইলেন সিংহাসনে। কার এত সাধ্য যে দেবীর চোখ ফাঁকি দেওয়ার দুঃসাহস দেখায়। কার? একসময় দেবী সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। তাঁকে এখন ইন্ডিমিয়নের সমাধিস্থলে যেতে হবে৷ প্রেমিকের ঘুমন্ত মুখ দর্শনে চিন্তা যদি কিছুটা দূর হয়।
ইসাবেলা বাবা-মায়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এর বেশি আর ওর পা চলছে না সামনে৷ বরং পিছিয়ে যাচ্ছে বার বার। সকাল থেকে অনেকবার এমন করে দরজায় দাঁড়িয়েছে তারপর আবার ফিরে গেছে রুমে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। ভেতরে শব্দ হতে দ্রতগতিতে প্রস্থান করল। কড়িডোর ধরে নিজের রুমের দিকে এগোচ্ছে। কী বলতে এসেছিল? নিজের বিয়ের কথা? এঁরা মানবে? তাই বলে এঁদের ছাড়া বিয়ে করবে ও! পরক্ষণেই ভেতর থেকে জবাব এলো, “এ ছাড়া আর উপায় কী?” ইসাবেলার মন মানে না। জীবনের বিশেষ মুহূর্তে আপজনদের ও কাছে চায়। জানে এ অসম্ভব তবুও স্থির হতে পারছে না। যদি মিরাকল কিছু ঘটত! কী বোকা ও! চোখ জ্বলতে লাগল। পরশু নিকোলাসের সাথে ওর বিয়ে। কিন্তু পরিবার জানে না। নিকোলাসও এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। কীই-বা মন্তব্য করার আছে ওর। ও তো আর জীবিত কোনো মানুষ নয় যাকে ওর পরিবার জামাতা হিসেবে সাদরে গ্রহণ করবে। ইসাবেলাকে আগেই সাবধান করেছে। সব জেনেশুনে যখন ও বিয়েতে মত দিয়েছে তখন আর কী বলবে নিকোলাস। ইসাবেলা মোটেও পস্তাচ্ছে না মত দেওয়াতে। কিন্তু জীবনের এতবড়ো একটা মুহূর্তে পরিবার থাকবে না তাতে মন খারাপ ওর। অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। বিয়ের গাউন পরবে কিন্তু পরিবারের বড়োদের আশীর্বাদ কপালে জুটবে না। কার হাত ধরে আইল থেকে নামবে? বাবা ওর কন্যা সম্প্রদান করবে না! এসব ভাবলে মন আকাশে একরাশ কালো মেঘ জমে ওঠে। ভালোবাসার পূর্ণতার সুখও পরিপূর্ণতা পায় না তখন।
সারাদিন ভেবে ভেবে মনকে বুঝ দিলো ইসাবেলা। এই ওর নিয়তি। পরিবার অথবা নিকোলসের মধ্যে নিকোলাসকে বেছে নিয়েছে। অপরাধ কি করেছে? হয়তো! ওর এই প্রেমিকা সত্তা পৃথিবীর সবকিছু উপেক্ষা করে নিকোলাসকে ভালোবেসেছে। ভালোবাসবে আর বিসর্জন দেবে না? পরিবার, ধর্ম ও সমাজ এই তো ওর বিসর্জন। প্রেমের ক্ষেত্রে ঠিক-বেঠিক অযৌক্তিক। প্রেমিক -প্রেমিকারা কেবল পূর্ণতা চায়। এই মোহ মাঝেমাঝে বাকি সকল মোহকে ভুলতে বাধ্য করে। ইসাবেলার মনে হয় ও বড়ো অসহায় আজ। ভালোবাসা যেমন সাহস দিয়েছে তেমন দুর্বলও করেছে। নিকোলাসকে হারানোর ভয় এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড়ো ভয় ওর কাছে।
ওর পরিবার নিকোলাসকে কোনোদিন মেনে নেবে না। না মানবে এই সমাজ, এই ধর্ম। সব জেনেই তো ভালোবেসেছে ও। গ্রহণ করেছে নির্দ্বিধায়। তবে কেন এখন এত কষ্ট পাচ্ছে? কেন দুষছে ভাগ্যকে? ভাগ্য এমন নিষ্ঠুর খেলা কেন খেললো? পরিবার ও নিকোলাস দুটোই যে ওর চায়। বাবা-মায়ের মুখ বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে৷ খুব দুঃখ পাবে তাঁরা। পিতা-মাতার দুঃখের কারণ হওয়া প্রতিটি সন্তান অভিশপ্ত। ইসাবেলা অভিশপ্ত হবে। এই ওর নিয়তি। নিকোলাস ওর নিয়তি৷
“বেলা!”
প্রিয় কণ্ঠস্বরটি শুনে ঘুরে তাকায় জানালার দিকে। ওই তো ওর নিয়তি দাঁড়িয়ে আছে। দু’বাহু মেলে কাছে ডাকছে। এই ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য ইসাবেলার নেই। চোখেমুখে নিকোলাসের প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পায়। পরিবার বিচ্ছেদের বেদনা বুকে চেপে মুচকি হাসল।চোখ টলমল। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় নিকোলাসের দিকে। বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে। ও পারেনি পরিবারের বিচ্ছেদ বেদনা চেপে রাখতে। এত কঠোর এখনও হয়ে ওঠেনি। নিকোলাস কিছু বলে না। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ইসাবেলা কাঁদছে। ওর পাপের কারণে আজ ইসাবেলা কাঁদছে। পিশাচ না হলে নিশ্চয়ই কাঁদত না।
চলবে,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৭৯
Writer তানিয়া শেখ
ভীষণ ব্যথাভরা একটা মেয়েলি গোঙানির আওয়াজ আবছা অন্ধকার ঘরের চার দেওয়ালে দাপাদাপি করে থেমে গেল। এখন কেবল হিংস্র চাপা গর্জন শোনা যাচ্ছে। শিকার ধরার পর হায়েনার গলা দিয়ে যে পৈশাচিক শব্দ বের হয় এ তেমনই।
আপাদমস্তক কালো আলখেল্লা পরিহিত একজন লোক বন্ধ দরজার কাছে এসে সেই শব্দ শুনে থমকে গেলেন। তাঁর ভয় থাকার কথা নয়। ভয় মানুষের থাকে। তিনি মানুষ নন। তবুও দুজনকে তাঁর ভীষণ ভয়। একজন এই বন্ধ দরজার অপরপ্রান্তে। হিংস্র জানোয়ারের ন্যায় গজরাচ্ছে। একসময় লোকে তাঁকে বলত বিকারগস্ত, নিষ্ঠুর। ওরা একে দেখলে কী বলবে? মনে মনে হাসলেন। তাঁর মতো বিকারগস্ত লোক যাকে ভয় পায় তার বর্ণনা মুখে বলে কী শেষ হবে? দরজায় টোকা দিতে গিয়ে হাতটা জমে যায় পাথরের মতো। ভেতরের গর্জন ক্রমশ হিংস্র হচ্ছে। এসময় যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু দেখা করা খুব জরুরি। সেখানে দাঁড়িয়ে দোনোমোনো করতে লাগলেন।
“তুমি এখানে কী করছো?” চমকে তাকালেন পেছনে। সামনে দাঁড়ানো লোকটার মুখ কড়িডোরের আঁধারে জড়িয়ে আছে। কিন্তু গলাটা চেনা। এগিয়ে গেলেন লোকটার দিকে। মুখ তুললেন। স্বার্থোদ্বারের প্রয়োজনে মাথা নিচু করতে হয়। অপছন্দের জনদের সাথে মিষ্টি করে বলতে হয় কথা। এসবে তিনি পূর্ব অভিজ্ঞ। অপ্রস্তুত হেসে বললেন,
“ড্যামিয়ানের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। জরুরি কথা ছিল।”
“এখন দেখা হবে না। এই সময় ও কারো সঙ্গে দেখা করে না।” নিরস গলায় জবাব দিয়েই ঘুরে দাঁড়ায়,
“ভালো চাও তো চলে যাও, রিচার্ড।”
“কথাগুলো জরুরি।” পেছন পেছন এলেন তিনি। লোকটা বলল,
“আমাকে বলতে পারো।”
“তোমাকে?”
“হ্যাঁ, আমাকে।”
“থাক। আমি বরং পরেই আসব।”
দাঁড়িয়ে গেলেন। এদের একটাকেও বিশ্বাস করেন না। তবুও জোর করে বিশ্বাসটাকে স্থির রাখতে হচ্ছে। সবই একমাত্র ওই সিংহাসনের জন্য। ড্যামিয়ান ওঁকে কথা দিয়েছে নিকোলাসের সিংহাসন দখল করতে সাহায্য করবে। কথার বরখেলাপ হলে সহজে ছেড়ে দেবেন না তিনি। আর ধোঁকা দেওয়ার সাহস করলে দেখে নেবেন। বোকা ভেবেছে!
“হুঁ!”
ক্ষুব্ধ মনে পাশের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন রিচার্ড।
ভেতরে দাঁড়ানো লোকটার চোয়াল শক্ত হলো। কিন্তু ফিরল না। হনহন করে হেঁটে যেতে লাগল। ওকে হেয় করার উচিত শাস্তি একদিন এই পিশাচটাকে ও দেবে। লোভ, ক্ষমতা মানুষকে অন্ধই করে না, বোকাও বানিয়ে ছাড়ে। লোকে বলে শত্রুর শত্রুকে বন্ধু বানাও। এই পিশাচ তাই করেছে। জানে না, লোকের সব কথা শুনতে নেই। বিদ্রুপের হাসি খেলে গেল ওর ঠোঁটের কোণে।
“রজার!”
ভেতরে পরিচিত গলায় একজন ডেকে উঠল। পাশের জানালা খুলতে কক্ষের হ্যাজাকের আলো ওর মুখের ওপর পড়ে। অশুভ প্রেতমূর্তির মুখের মতো দেখাচ্ছে রজারের মুখ।
আজ রাতে বিয়ে। ইসাবেলার মনের ভেতর বেশ অস্থিরতা কাজ করছে। নিকোলাসের স্ত্রী হবে। প্রেমিকা হওয়া আর স্ত্রী হওয়াতে পার্থক্য আছে। ইসাবেলা এবার একই সাথে ওর প্রেমিকা ও সহধর্মিণী। সহধর্মিণী! কেমন যেন সুখ সুখ অনুভব করে। বুকের ভেতরে প্রসন্ন এক ঢেউ খেলে যায়। ওদের বিয়েটা হয়তো পুরোপুরি সামাজিকতা ও ধর্মীয় নিয়ম মানবে না তবুও তো তা বিয়েই।
এই সময় আপনজনেরা পাশে থাকে। কত কী বলে -বুঝিয়ে নববধূর অস্থিতিশীল মন ভুলায়। ইসাবেলার দুর্ভাগ্য ওর পাশে আপনজন থাকলেও মন ভুলানোর জন্য কেউ নেই। কীভাবে থাকবে? ওদের তো ধারণাই নেই আজ ইসাবেলার বিয়ে। দিনভর ইসাবেলা একা একা থাকার চেষ্টা করেছে। বাবা-মা, ভাইবোনের সান্নিধ্যে এলে কান্না পায় ওর। অপরাধবোধ তীব্র হয়। সত্য সূর্যের ন্যায়। একদিন ভাস্বর ঠিক হবে। সেদিন ওদের মুখোমুখি হবে কীভাবে ইসাবেলা? সারাটাদিন চোখের জল আড়াল করে কেটেছে ওর। অথচ, আজ ওর বড়ো আনন্দের দিন। কিন্তু এই আনন্দে এত বিষাদ কেন?
ওর মন খারাপ যে কেউ খেয়াল করেনি তা নয়। আন্না মেরিও, ওলেগ, তাতিয়ানা ও মাতভেই ঠিকই দেখেছে তাদের প্রিয় বেলার বিষণ্ণ মুখ। কথা বলতে চেয়েছে ওরা। ইসাবেলা বরাবরের মতোই এড়িয়ে গেছে। অপ্রয়োজনীয় হাসি হেসে সকলের চোখে ধুলো দিয়েছে। কিন্তু মা’কে পুরোপুরি ধোঁকা দিতে সফল হয়নি। আন্না মেরিও গত কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছেন ও যেন একটু বেশিই চুপচাপ হয়ে আছে। আজ কাছে ডেকে কথা বলতে চাইলে আসছি বলে সেই যে রুমে গেল আর এলো না। তিনি ভাবলেন মনটা বুঝি আজ ওর কোনো কারণে খুব খারাপ। একা থাক কিছুক্ষণ। পরে গিয়ে কথা বলবেন। তাছাড়া তিনি ইদানীং অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে খুব ভাবছেন। রেইনি মেয়েটা তাশার বেবিসিটার হওয়ার পর থেকে তাশার রোগটা ভালো হয়ে গেছে। আগের মতো সুস্থ দেখাচ্ছে ওকে। বাড়ির সবাই খুশি। কিন্তু আন্না মেরিওর চোখে ধরা পড়েছে রেইনির পরিবর্তন। মেয়েটাকে তিনি পছন্দ করেন এমন নয়। এই অপছন্দের কারণ ওর দাদি। বাবার বিশ্বস্ত, ঘনিষ্ঠ ভৃত্যাটিকে তিনি আগাগোড়াই বক্র চোখে দেখেছেন। তার আপনজনদের বেলাতেও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে না। কিন্তু রেইনিকে অপছন্দ করার দাবিটা কেন যেন শক্ত নয়। মেয়েটার মুখখানি মায়াভরা। ওই মুখে তাকালে মায়া করতে ইচ্ছে হয়। তিনি অবশ্য সে ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় দেন না। তবুও মেয়েটার শূন্য দৃষ্টি তাঁকে আজকাল ভাবায়। তাশা যত সুস্থ হচ্ছে রেইনিকে ততই যেন রোগা দেখাচ্ছে। চোখদুটো আগের মতো জীবন্ত নয়। নির্জীব হচ্ছে দিনকে দিন। তাশার সাথে হাসলেও ওর হাসি প্রানবন্ত নয়। রেইনির এই পরিবর্তন একা তিনি নন মাতভেইও লক্ষ্য করেছে। বেশ চিন্তিত ও। আন্না মেরিও অবশ্য ওকে অভয় দিয়েছেন। বলেছেন, এই বয়সে একটু আকটু ওমন অসুখ হয়। ওষুধ খেলে সেরে যাবে। মাতভেই যে তাঁর কথাতে নিশ্চিন্ত হয়নি সেটা ওর মুখ দেখেই বুঝেছেন। আন্না মেরিও ভাবছেন রেইনির ব্যাপারটা নিয়ে বাবার সাথে কথা বলবেন। তাছাড়া মাতভেই আর তাতিয়ানার বিয়ের দিন-তারিখও তো ঠিক করা দরকার। ইসাবেলার জন্য পাত্র দেখা নিয়েও আলাপ করবেন। কত দায়িত্ব তাঁর! এত কিছুর মাঝে মেয়ের মন খারাপের কারণ জানার কথাটা বেমালুম ভুলে গেলেন আন্না মেরিও।
চলবে,,,,