#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৭৪
Writer তানিয়া শেখ
বিশেষ এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছে নিকোলাস। ইসাবেলাকে নিজের করে চেয়ে নিতে বিশেষ মুহূর্তটা খুব দরকার। স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই মুহূর্তটি আগামীতে। ইসাবেলাকে সারপ্রাইজ দিতে কত কী ভাবছে। ভীষণ নার্ভাসও ও। পাছে অন্য কিছু ঘটে যায়! ইসাবেলা যদি খুশি না হয়? পিশাচকে ভালোবাসা সহজ নয়, কিন্তু ভালোবেসেছে ও। প্রেমিকরূপে গ্রহন করেছে, স্বামীরূপে গ্রহন করবে কী? নির্ভীক পিশাচটাও আজ ভয় পায়। মনের ভেতর চঞ্চলতা বাড়ে। বিয়ে মানে সামাজিক বন্ধন। নিকোলাস তো সামাজিক নয়। বৈবাহিক সম্পর্কে কত চাওয়া-পাওয়া থাকে। সেসব ভাবতে কেমন যেন হয়ে যায়। অপেক্ষার পালা আরও দীর্ঘ হয়। এক এক সেকেন্ড সহস্র বছরের সমান মনে হতে লাগল।
“কবে প্রপোজ করবেন কিছু ভেবেছেন?” পল সাহস করে জিজ্ঞেস করে পাশ থেকে। নিকোলাস আনমনে স্টাডি টেবিলের পাশের চেয়ারে বসেছিল। দুর্গের জানালার বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিল যে পলের কথা শুনতে পেল না। পল ওকে পরখ করে হাঁপ ছাড়ে। এত কী ভাবে তার মনিব? ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে এ কী এতই কঠিন? এর চেয়ে ঢের কঠিন কাজ করতে দেখেছে মনিবকে। কই তখন তো এত ভাবেনি। অতি ভাবনায় সব গুলিয়ে যায়। মনিব কি তা জানে না?
বিয়ে পড়াতে যা শিখতে হয় তার অনেকটাই সে শিখে নিয়েছে। কেন যেন মনিবের বিয়ের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহ ওর।
“নোভাকে পাওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যাবে বলে।”
ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠতে চমকে ওঠে পল। ধরা যেন খেয়েই গেল। লজ্জায় কান লাল হয়ে ওঠে৷ লজ্জা! তার মতো পুরুষ লজ্জা পেল? লজ্জা কথাটা আসলে পলের স্বভাবের সাথে যায় না। নোভার প্রেম ওকে আজ লজ্জাশীল পুরুষ করেছে। তাড়াতাড়ি ঘুরে এটা ওটা নাড়তে লাগল। মনিবের চোখে পড়া যাবে না। স্মৃতিতে ভাস্বর হয় নোভার মুখ। অনেকদিন ওকে দেখে না। কেমন আছে কে জানে! মনটা সহসা আবার খারাপ হয়। স্বীকার এখন করতেই হয় প্রেমে পড়েছে ও। ভালোবেসে ফেলেছে নোভাকে। কিন্তু নোভা ওকে ভালোবাসে না, হয়তো কোনোদিন বাসবেও না। একপাক্ষিক ভালোবাসা বড্ড যন্ত্রণার। নিজেকে সামলে ও আবার ঘুরে দাঁড়ায় মনিবের দিকে। দু’বার গলা ঝাড়তে নিকোলাস ফিরে তাকাল।
“কিছু বলবি?”
“না, মানে, বলছিলাম ইসাবেলাকে প্রপোজ কবে করবেন কিছু ভেবেছেন?”
নিকোলাস গম্ভীর হয়ে বলল,
“উপযুক্ত সময় আসুক।”
তারপর চুপ করে আবার বলল,
“বললেই প্রপোজ করা যায় না। আগে মনে হয়েছিল ব্যাপারটা সহজ। এখন মনে হচ্ছে খুব কঠিন। অনেকদূর ভাবতে হচ্ছে আমাকে। প্রেম আর বিয়ে দুটো আলাদা ব্যাপার।”
পলের প্রশ্নবিদ্ধ মুখ চেয়ে বলল,
“এখনও বুঝলি না? শোন, বিয়ের পর মানুষ সংসার চায়। আমাকে কি তোর সংসারি বলে মনে হয়? আচ্ছা সেটাও না হয় কোনোভাবে চালিয়ে নিলাম। কিন্তু এরপরের চাওয়ার কী হবে?”
“এরপরের চাওয়া?”
“হুম, সন্তান। ইসাবেলা মা হতে চাইবে একদিন। সব স্ত্রীই তাই চায়। আমি সে ইচ্ছে কী করে পূরণ করব বল? আরও কত যে জটিলতা আছে! সেসব ভাবলে প্রপোজ করতে সাহস পাই না। মনে হয় এভাবেই বেশ আছি। কিন্তু কোথাও যেন অপূর্ণতা থেকে যায়। বিয়েটাই কি?”
পিশাচের ঔরসে সন্তান হয় না বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে রিস্ক অনেক। মানব নারীর ঔরসে এর আগেও অনেকে সন্তান জন্মদানের চেষ্টা করেছিল। সফল হয়নি তেমন। দুএকজন মানব নারী গর্ভে ধারণ করতে পারলেও প্রসব করার আগেই মৃত্যুবরণ করেছিল। গর্ভে থাকা পিশাচ সন্তানই মায়েদের মৃত্যুর কারণ হয়। তবে নারীদের পেট কেটে কয়েকজন শিশুকে সময়ের আগেই বের করে আনা হয়েছিল। তারা এখনও বেঁচে আছে কি না সে খবর নিকোলাসের জানা নেই। সন্তানের জন্য ইসাবেলার ক্ষতি নিকোলাস কোনোদিন হতে দেবে না। ইচ্ছে থাকার পরেও এই কারণে ইসাবেলার সাথে দৈহিক সম্পর্ক করেনি ও। একদিকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, অপরদিকে এত ভয়, শঙ্কা ওকে প্রায় দিশাহারা করছে।
এতক্ষণে পলও বুঝল প্রপোজ নিয়ে মনিবের গড়িমসির কারণ। আজকাল মনিবকে যত দেখে তত অবাক হয়। কত বদলে গেছে সে। নিজের আগে এখন ইসাবেলাকে প্রাধান্য দেয়। ওর ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবে। কত কেয়ার করে। ভালোবাসার সম্পর্কই বুঝি এমন। পল মনিবের কাছে ভালোবাসা শেখে। ভালোবাসতে শেখে।
ভালোবাসার জয় হবেই। মনের ভয়, শঙ্কা কাটিয়ে নিকোলাস ঠিক প্রপোজ করবে ইসাবেলাকে। পল নিজে দাঁড়িয়ে ওদের বিয়ে দেবে। স্বপ্ন! হ্যাঁ, নিশ্চিত পূরণ হওয়া স্বপ্ন এটা। নিকোলাস আজ না হোক কাল এই স্বপ্ন সত্যি করবেই। পল বাজি ধরে সে কথা বলতে পারে।
মানুষ আর পিশাচে বিয়ে হবে। কত নিয়ম, কত প্রথা ভাঙবে নিকোলাস। নতুন কিছুর সূচনা হবে কমিউনিটিতে এবং এর বাইরেও। পল নিজে নয় অনেক পিশাচও চাইছে পরিবর্তন আসুক। মানুষ আর পিশাচ এক হোক। এই দুইয়ের মাঝের চিরদিনের তফাৎ, দ্বন্দ্ব নিরসন হোক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এর বিপরীত পক্ষের চাপও খুব বেশি। নিকোলাস ইসাবেলাকে বিয়ে করলে যতটা না পরিবর্তন হবে তারচেয়ে বেশি ঝামেলার সৃষ্টি হবে। কমিউনিটিতে নিকোলাসের বিপক্ষের দল ভারী হবে। এমনিতেই তো আন্দ্রেই চলে যাওয়ার পর নিকোলাসকে খুব বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। আন্দ্রেই ওর ঢাল ছিল। নিকোলাস অভ্যস্ত ছিল সেই ঢালে৷ কিছুটা বিপাকে সে পড়েছে কিন্তু স্বীকার করবে না। খুব বেশি ইগো ওর। পলকে তাই সতর্কে থাকতে হবে সর্বক্ষণ।
অদূরে ভোরের মোরগ ডেকে উঠতেই নিকোলাস কফিনে ফিরে যায়। পল ভালো করে রুমটা তালাবদ্ধ করে নিচে চলে এলো। দূর্গের একেবারে ওপরের ছোট্ট কক্ষের পুব দিকের জানালার পাশে চেয়ার টেনে বসল। এই কক্ষে মোট তিনটে জানালা আর একটা দরজা। চারদিকে দিয়ে দুপুর পর্যন্ত কড়া নজরদারি চলে। বিশেষ দুরবিনটা এসময় কাজে লাগে। অনেকক্ষণ নজরদারি চললো। আশপাশে ঘন সবুজ জঙ্গলে ঘেরা।প্রতিদিনের মতোই দুএকটা পাখি আর পশু ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ল না। গত দুরাতে ভালো ঘুম না হওয়াতে বেলা বাড়তে চোখদুটো লেগে এলো। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরই পেল না। ঘুম ভাঙল শেয়ালের ডাকে। তড়াক করে উঠল চেয়ার ছেড়ে। শেয়ালের ডাক অনুসরণ করে সেদিকে দুরবিন ধরল। ঘন ঝোপঝাড়ের মাঝে শেয়ালটাকে উঁকি ঝুঁকি দিতে দেখে। ভীত-সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে ওটাকে। পল দুরবিন এদিক ওদিকে সরিয়ে দেখল। শেয়ালটা ওর পোষা। এমনিতে এই অবেলায় ডেকে উঠবে না। তারপর কারণ ছাড়া ভীত দেখাবে কেন? কারণটা একটু পড়েই দুরবিনে ধরা পড়ল। আপাদমস্তক কালো আলখেল্লা পরিহিত দুজন লোককে দেখতে পেল দুর্গের দিকে তাকিয়ে থাকতে। শেয়ালটা এখনও ডেকে যাচ্ছে দেখে সন্দেহ হলো ওদের। ছুরি হাতে খুঁজছে ওটাকে।
পলের ঠোঁটে ক্রূর হাসি। মনিব আজ জেগে উঠে খুশিই হবে। দুটো শক্ত সামর্থ্য মানুষের রক্তে আহারটা জমে যাবে। দরজার কাছে গিয়ে মানুষ দুটোর দিকে তাকাতে ওর পেট ডেকে ওঠে। খিদে জানান দিচ্ছে। চোখদুটো ক্রমশ লোলুপ ও হিংস্র হয়ে ওঠে। নাক কুঁচকে ঘোঁৎ ঘোঁৎ আওয়াজ করে। ঠোঁট প্রসারিত হতে দুপাটি দাঁতের সামনে থেকে চারটা সূচালো দাঁত বেরিয়ে আসে। সারা শরীরে লোম বাড়তে লাগল। কিন্তু পুরোপুরি কাঙ্ক্ষিত রূপটিতে যেতে পারল না। আরও কিছুক্ষণ চেষ্টার পরেও ব্যর্থ হলো। নেকড়ে হওয়ার চেষ্টায় বনমানুষ হয়ে যাওয়াটা মোটেও ভালো লাগে না। মেজাজ খিঁচরে যায়। এই জন্যই এইরূপে আসে না। বনমানুষ হওয়ার চেয়ে মানুষ হয়ে থাকা ঢের ভালো। অন্তত চোখের শান্তি। ভুলে থাকতে চায় এই রূপটাকে। শত্রু মোকাবিলা মানুষরূপেও বেশ ভালোভাবে করে। পলের বাবা ছিলেন অর্ধ নেকড়ে। মা মানুষ। জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মেছে পল। চাইলেই রূপবদল করতে পারে না। বুকে ব্যথা অনুভব করে, মাঝেমাঝে অসুস্থও হয়ে যায়। এই কারণে নেকড়ে হতে পারে না৷ এখন ওর সারা শরীর কাঁপছে। বুকে চাপ অনুভব করছে। ছোটো থেকেই নিজদলের অপমান, গঞ্জনা সইতে হয়েছে। দুর্বল মানুষ বলে উপহাস করেছে ওকে সবাই। আপনদলের অপমান, গঞ্জনার জবাব দিতে কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে সেরা যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলেছে। নেকড়ে হতে পারুক আর না পারুক লড়াইয়ে ও এক হাতে তিন চারটা নেকড়েকে ধরাশায়ী করতে পারদর্শী। নিকোলাস ওর মধ্যে কিছু তো দেখেছিল। নইলে বিশ্বস্ত দাস হিসেবে এত বছর কাছে রাখবে কেন? পিশাচদের মাঝে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া চাট্টিখানি কথা ছিল না। নিজের শক্তি ও বুদ্ধির জোরে পিশাচমহলে আজ ওর অবাধ বিচরণ।
মানুষরূপে এখন তাঁকে দুর্গ ছেড়ে বেরোতে হবে। এছাড়া উপায় তো নেই। লোকদুটোকে এমনি এমনি ছাড়বে না। পিশাচের দুর্গে এসে বেঁচে ফিরবে এ হতে দেবে না পল। কোমরে ছুরি গুঁজে সাবধানে সেই আলখেল্লা পরিহিত মানুষদুটির দিকে এগিয়ে যায়। একটুপর মানবীয় আর্তচিৎকার আর নেকড়ের গর্জনে কেঁপে ওঠে দুর্গের বাইরের জঙ্গল। ক্ষনিকবাদে শান্তও হয়ে যায়। অচেতন আহত আলখেল্লা পরিহিত মানুষ দুটোকে দু ‘ কাঁধে করে ফিরে এলো পল। ঢুকলো দুর্গের ভেতরে। ওর পেছন পেছন শেয়ালটাও এলো।
বিকেলে মেয়েদের চায়ের আড্ডার আসর বসে মাক্সওয়েল বাড়ির বসার ঘরে। প্রতিবেশিনী অনেকে আসেন আড্ডা দিতে। আজও ব্যতিক্রম ঘটেনি। ইসাবেলার দুই মামি এই আড্ডার মধ্যমণি। ইদানীং তাতিয়ানাও যুক্ত হয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনের অনেক কিছু নিয়ে আড্ডা হয়। রূপের বড়াই, সম্পদের দম্ভ, গুনের মাপ -পরিমাপ সবই হয়। কোনো কোনো সময় তল্লাটের নির্দিষ্ট কাওকে নিয়ে চলে আলোচনা সমালোচনা। আন্না মেরিও এসব আড্ডা আগাগোড়া অপছন্দ করেছেন। ইসাবেলাকেও নিষেধ করেছেন এসব আড্ডা থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু তাতিয়ানা ধরে বেঁধে প্রায় এই আড্ডায় ওকে নিয়ে আসে। বোনকে বদলানোর চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে ও।
এদের আড্ডার আসরে বসে একেবারে যে ইসাবেলার ভালো লাগে না তা নয়। মানুষ কত বিচিত্র এখানে এসেই টের পায় ইসাবেলা। অনেক কিছু শেখে। অবশ্য শিক্ষাগুলো ইতিবাচক৷ চুপচাপ এককোণে বসে সকলের কথা শোনে। মাঝেমাঝে একই আলাপ শুনে শুনে বোর হয়ে উঠে চলে যায়। এ নিয়ে উপস্থিত মহিলামন্ডলি হাসাহাসি করে। বলে, “ও এখনও সামাজিক হয়ে উঠল না। মায়ের মতোই রয়ে গেল।”
আজ অবশ্য তেমন কিছু ঘটল না। ইসাবেলা আগ্রহ নিয়ে ওদের আলাপ শুনছে। প্রতিবেশী কোনো এক দম্পতির শীঘ্রই ডিভোর্স হবে। ডিভোর্সের কারণ এরা জেনে এসেছে। পুরুষটি সন্তান নেবে না৷ অপরদিকে মেয়েটির সন্তান চাই ই চাই। এ নিয়ে মতবিরোধ বাড়তে বাড়তে ডিভোর্স পর্যন্ত গড়িয়েছে। একজন এই কথা শুনে বলল, তার স্বামীও বিয়ের প্রথম কয়েক বছর সন্তান নিতে খুব অনীহা প্রকাশ করেছিল। সম্পর্কচ্ছেদ হতো তাদেরও। শেষমেশ সন্তান নিতে আগ্রহ দেখাতে সম্পর্ক টিকে যায়। অন্য একজন বলল, বেশিরভাগ পুরুষই বিয়ের পরপরই সন্তান নিতে চায় না। বয়স্ক একজন উপস্থিতদের উপদেশ দিলো, বিয়ের আগে সকলের উচিত সন্তানের এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলে নেওয়া। এতে করে পরবর্তীতে সংকট সৃষ্টি হবে না। ওদের নানান মতামত শুনতে শুনতে ইসাবেলার ভাবনা অন্য দিকে ঘোরে। নিকোলাস আজপর্যন্ত ওকে স্পর্শ করতে আগ্রহ দেখালো না সন্তান তো দূরের কথা। যদিও সন্তান নিয়ে এখনই তেমন ভাবনা নেই। সন্তান যে চায় না তা নয়। আগে বিয়েটা তো হোক তারপর না হয় ভাববে। বিয়ে! নিকোলাস একবারো তো বিয়ের কথা মুখে আনে না। বিয়ে ছাড়া কাছাকাছি আসা কি হবে? আর কত লোকের বিদ্রুপ সহ্য করবে। প্রতিজ্ঞা ভুলে যতবার কাছে গিয়েছে নিকোলাস দূরে ঠেলেছে। মনে করিয়ে দিয়েছে প্রতিজ্ঞার কথা। আজ এ নিয়ে ভারী অভিমান হলো। বিয়ের কথাও বলবে না আবার কাছেও টানবে না। ওর কী মন চায় না ঘনিষ্ঠ হতে? ধর্মের বালাই নেই যার মধ্যে সে কেন ইসাবেলার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে এত সচেষ্ট হবে? না কি ইসাবেলাকে আদৌ কামনা করে না। আকৃষ্ট হয় না ওর প্রতি। সতি বলেই কী এত অবহেলা? নিজেকে নিয়ে বরাবরই হীনম্মণ্যতায় ভুগেছে ও। আজও তাই হলো। নিকোলাস ওর প্রতিজ্ঞার সম্মান করে এই ভাবনা উপেক্ষা করে নতুন ভাবনার জন্ম হলো আজ- নিকোলাসের চোখে বুঝি বড্ড অসুন্দর ও। তাই তো ছুঁয়ে দেখে না। অন্য কাওকে কাছে টানে না তো? ও জানে শেষ কথাটার ভিত্তি নেই। তবুও মান হলো। দুরন্ত যৌবনে যখন জোয়ার ওঠে তখন দেহমন অস্থির হয়। অস্থিরতায় কাঁদো কাঁদো হয়। মনে মনে বলে,
“কেন যে বিয়ের আগে কুমারী থাকার পণ করেছি! এখন কেউ চায় না আমায়, যাকে ভালোবাসি সেও না।”
চলবে,,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৭৫
Writer তানিয়া শেখ
গাল ফুলিয়ে বসে আছে ইসাবেলা। আসার পর থেকে চুপচাপ। অনেকক্ষণ খেয়াল করে নিকোলাস বলেই ফেললো,
“সত্যি করে বলোতো কী হয়েছে তোমার? আসার পর থেকে গুম মেরে বসে আছো। কথা বললে জবাব দিচ্ছো না ঠিকমতো। সমস্যা কী?”
ইসাবেলা মুখ খুলতে নিকোলাস শাসিয়ে বলল,
“খবরদার যদি বলেছো কিছু না, বেলা।”
ইসাবেলা একদৃষ্টে ওকে দেখে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। বলে,
“আমার ভালো লাগছে না। বাড়ি যাব।”
“বেলা।”
“আমি বাড়ি যাব নিকোলাস।” চেঁচিয়ে ওঠে আচমকা। নিকোলাস ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ইসাবেলা রেগে আছে। সেদিন রাতে দেখা করেনি বলে কি এই রাগ? হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ধরতে গেলে পিছিয়ে যায় ইসাবেলা।
“তুমি নিয়ে যাবে না? ঠিক আছে। লাগবে না তোমাকে। একাই বাড়ি ফিরব।” বলেই উলটো দিকে হাঁটা ধরে। মধ্য রাত। চাঁদ পূর্ণ কিরণ ঢালছে। ইসাবেলা নেমে গেল হাঁটু সমান বরফ পড়া রাস্তায়। নিকোলাস হতবুদ্ধি হয়ে ওকে দেখল। তারপর উঠে ছুটে এলো ওর সামনে।
“বেলা।”
থামাতে চাইল। কিন্তু থামল না ইসাবেলা। পাশ কাটিয়ে যেতে নিকোলাস ওর হাত টেনে ধরে। দ্বিধান্বিত হয়ে বলল,
“কেন এমন করছো? করেছিটা কী আমি?”
“কিছুই করোনি। সমস্যাটা এখানেই।” হাত ঝাড়া মেরে বলল ইসাবেলা। নিকোলাস বলল,
“মানে?”
“হুয়াই ডোন্ট ইউ জাস্ট ফাক মি, হুঁ?”
চিৎকার করে ওর বুকের শার্ট খামচে ধরে। নিকোলাস বজ্রাহতের ন্যায় চেয়ে রইল। কী বলেছে বুঝতে পেরে দুহাতে মুখ চেপে ধরে ইসাবেলা। লজ্জিত হয়ে পিছিয়ে যায় কয়েক কদম।
“আমি ওভাবে বলতে চাইনি। হা! ঈশ্বর!”
ইসাবেলা ঘুরে ভোঁ দৌড় দিলো। বেশিদূর যেতে পারে না দৌড়ে। নিকোলাস ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মুখের ভাব বোঝা মুশকিল। ইসাবেলা চোখ নামিয়ে নেয়। নিকোলাস নিশ্চয়ই ওকে এখন কামোন্মাদিনী ভাবছে। আচরণ তো তেমনই করেছে। লজ্জায় ভূগর্ভে বিলীন হতে ইচ্ছে করছে। নিকোলাস ওকে ছুঁয়ে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে না, বিয়ের কথা তোলে না। আর কতদিন এভাবে চলবে? এমন সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ আছে? সময়ের সাথে নিকোলাস হয়তো ওর প্রতিও আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ভগ্নহৃদয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু ভালো। ও নিশ্চয়ই নিকোলাসের মনমতো হতে পারেনি। নয়তো কাছে আসতে আগ্রহ দেখায় না কেন? অতীত ঘাটে। নিকোলাস কী কোনোদিন ওকে পেতে আগ্রহ দেখায়নি? ভাসা ভাসা মনে পড়ে একটু। বোধহয় দেখিয়েছিল। ওই তো একটু! তারপর? ইসাবেলা ভার্জিন হয়ে মরতে চায় না। লোকে ওর কফিনে দাঁড়িয়ে হাসবে। সে দৃশ্য কল্পনা করতে শিউরে ওঠে।
বয়সই বা কত! আঠারো বছরের আবেগে ভেসে নিজের মনমতো যা ইচ্ছে ভেবে নেয়। ঠিক, বেঠিকের পরোয়া না করে জেদ করে। সামনের পক্ষকে বুঝতে চায় না তখন। তারপর ভেতরে ভেতরে মান করে, কাঁদে। অস্থিরতায় কী করবে দিশা পায় না।
“বেলা!” নিকোলাস ওর দু-কাঁধের ওপর হাত রাখল।
“আমি জাস্ট, জাস্ট__”
নিকোলাস জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে৷ মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“হুশ। কিছু বলতে হবে না।”
দুজনের কেউ ই আর কথা বলল না। ইসাবেলা বড়ো কষ্টে কান্না লুকাল। আজকাল কি ও ছিচকাঁদুনে হয়ে যাচ্ছে? মনে মনে ভাবল।
ইসাবেলাকে বড়ো বাঁচা বাঁচিয়ে সেদিন নিকোলাস ওই প্রসঙ্গ নিয়ে কোনো কথা বলল না। যে যার গৃহে ফিরে গেল ভোরের আগে। ফেরার পূর্বে যথারীতি আবার দেখা করার প্রতিজ্ঞা করল নিকোলাস। ভীষণ অন্যরকম দেখাচ্ছিল ওকে।
পুরোটাদিন প্রচন্ড অস্থিরতায় কেটেছে ইসাবেলার। নিকোলাসের ভেতর কী চলছে জানতে ইচ্ছে করছে ওর। তখনকার নীরবতা খুব ভাবাচ্ছে। লজ্জা শরম ভেঙে ওমন একটা কথা বলে ফেললো, অথচ নিকোলাস চুপ করে রইল। কিছুই কি বলার ছিল না? আবার ভাবল, কিছু বলেনি এই ভালো। ও আর কোনোদিন এই ব্যাপারে কথা বলবে না। মরে গেলেও না। প্রয়োজনে আমৃত্যু ভার্জিন থাকবে। শেষ কথাটা ভাবতে ফের বুক ভার হয়ে ওঠে। নিকোলাস কি সত্যি ওকে চায় না?
“ইসাবেল, কী করছো তুমি?”
তাতিয়ানা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ইসাবেলা দাঁত কামড়ে বলল,
“সং সেজে নৃত্য করছি, করবে?”
“আরে বাপরে! মেজাজ দেখছি সপ্তমে চড়ে আছে মহারাণীর। তা রাগটা হলো কী কারণে শুনি?”
ইসাবেলা মুখ ভার করে নিরুত্তর বসে আছে। তাতিয়ানা পাশে বসে বলল,
“বলবে না? ওমা! কেঁদে দেবে না কি?”
ইসাবেলা সজোরে দু’দিকে মাথা নাড়ায়। তাতিয়ানা জোর গলায় বলে,
“আমি স্পষ্ট তোমার চোখ ছলছল দেখছি। কেউ কিছু বলেছে? আমাকে বলো, তার পিন্ডি চটকে দেবো।”
ইসাবেলা ফিক করে হেসে দিতে চোখ বড়ো বড়ো করে তাতিয়ানা। বলে,
“আবার হাসছো? চোখে জল ঠোঁটে হাসি! মাঝেমাঝে তোমাকে আমার উইয়ার্ড মনে হয়। কিছুটা কনফিউজিংও। নিজেকে বদলাও নাহলে কোনো পুরুষ তোমার দিকে আকৃষ্ট হবে না। পুরুষদের জীবনে এমনিতেই বহুত প্যারা। তোমার মতো কনফিউজিং মেয়েলোক হ্যান্ডেল করার সময় কই তাদের।”
“খুব পুরুষ বিশেষজ্ঞ হয়েছো, না?”
তাতিয়ানা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। মুখটা কাছে এনে বলল,
“পুরুষ বিশেষজ্ঞ কি না জানি না। তবে বেশ অভিজ্ঞ বলতে পারো।”
তাতিয়ানা অজান্তেই ইসাবেলার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে দিলো। রাগে মুখ লাল হয়ে উঠল ইসাবেলার। মেকি হাসি দিয়ে বলল,
“তাতিয়ানা।”
“হুম?”
“দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। এক্ষুনি।”
চলবে,,,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৭৬
Writer তানিয়া শেখ
আয়নার সামনে শেষবার নিজেকে দেখে নিলো ইসাবেলা। গলার মাফলারটা আরেকটু ভালো করে পেঁচিয়ে লম্বা করে শ্বাস ছাড়ে। বাড়ির সকলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাত্রির গম্ভীরতা সর্বত্র। দেওয়াল ঘড়িটার টিক টিক শব্দ কানে লাগছে খুব। আয়নার ভেতর থেকে সময় দেখল। ২টা সাতাশ বাজে। আজ ওর দেরি হচ্ছে। একবার ভাবল আজ আর নিকোলাসের সাথে দেখা করতে যাবে না। কারণ জিজ্ঞেস করলে, শরীর ভালো নেই বলে বাহানা দিয়ে দেবে। বিছানার কোণায় গিয়ে গুটিশুটি হয়ে বসল। সংকোচ হচ্ছে নিকোলাসের মুখোমুখি হতে। গতকাল রাতের ঘটনা স্মরণ হলে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠছে। কী একটা পাগলামি করেছে! মাঝেমাঝে এমন অধৈর্য হয়ে যায়! নিকোলাস না জানি কী ভাবছে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা এসে গেল। টের পেল কেউ ওকে বিছানা শুইয়ে মাথার তলে বালিশ দিয়ে দিলো৷ আলগোছে খুললো গলার মাফলার। ইসাবেলার ঘুম তখন পাতলা হয়ে এসেছে। বুকের কাছে কম্বলের ভার টের পাওয়ার সাথে সাথে নাকে সেই সুমিষ্ট সোঁদা মাটির ঘ্রাণ পায়। এক ঝটকায় চোখ মেলে তাকালো।
“তুমি!”
নিকোলাস ওর পাশে বসে আছে। বিলি কাটছিল চুলে। মুচকি হাসল। ওর মুখ চেয়ে গতকালের কথা মনে পড়ে গেল ইসাবেলার। লজ্জায় চোখ নামিয়ে উঠে বসতে গেলে বাধা দিলো নিকোলাস।
“এখন আর উঠো না। ঘুমাও। কাল বরং বাইরে যাব।”
ইসাবেলা নীরব রইল। নিকোলাসও আর কথা বলল না। চুপচাপ ওর আনত বদন দেখে গেল। একসময় উঠে দাঁড়ায়। বলে,
“আজ আমি আসি।”
ইসাবেলা খপ করে ওর হাত ধরে বলল,
“আরেকটু থাকো না।”
সাথে সাথে লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলো।
“ঠিক আছে।” বসল আবার ওর পাশে নিকোলাস। তারপর বলল,
“তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
ইসাবেলা দুচোখ বন্ধ করল। নিকোলাস ওর চুলে বিলি কাটতে শুরু করে। ইসাবেলা অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারল না। হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল। উদ্বিগ্ন হলো নিকোলাস।
“কী হয়েছে? কাঁদছো কেন, বেলা?”
“তুমি আমার ওপর রাগ করেছ,না? আমি ভারী পাগল। তুমি ঠিকই বলো, নির্বোধ আমি। যা মনে আসে বলে ফেলি। আসলে_” উঠে বসল বিছানার ওপর। নিকোলাস থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ওসব কেন বলছো? আর তোমার ওপর রাগই বা কেন করব?”
“ওই যে গতকাল ওই কথা বলেছি বলে।”
নিকোলাস ঢোক গিললো। সহজ ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“ধুর! ওই কথায় কেউ রাগ করে না কি। আমার তো মনেও ছিল না।”
বিড়বিড় করে বলল,
“রাগ তো ভীষণ করেছি তবে তোমার ওপর না। রাগ করেছি আমি আমার ওপর।”
ইসাবেলা ওর বিড়বিড়িয়ে বলা কথা বুঝতে পারল না৷ কথাটা মনেও রাখেনি নিকোলাস! এত তুচ্ছ ছিল? মনে মনে ভারী অভিমান করল। মুখে তার ছায়া খানিকটা পড়ল। বুঝতে না দিয়ে শুয়ে পড়ে।
নিকোলাস কিন্তু ঠিকই বুঝেছে। তবুও মুখে আনল না। হেসে ওর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল,
“রাগ করলে এখানে তোমার পাশে বসে থাকতাম, বলো? তোমার ওপর রাগ করা আমার কোনোদিনই হবে না। তুমি আমার হাসির কারণ, সুখের কারণ, কিন্তু রাগের কারণ নও, বেলা। ওই কথা নিয়ে আর ভেবো না। মন খারাপ করো না। চোখ বন্ধ করে ঘুমাও তো এখন।”
ইসাবেলা কোনো কথা না বলে চোখ বন্ধ করে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। নিকোলাস ওর কথা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করল? আজ ওর কথা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে কাল ওকে করতে বাধবে? রাগে, অভিমানে অনেক কথা মনে এলো। কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। করবেই না আর। নিকোলাসের যদি এভাবে চলতে ভালো লাগে তাহলে তাই চলুক। হঠাৎ মনে হলো ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। দৈহিক মিলনের কথা মনে করলেও এখন কেমন বিতৃষ্ণা জাগে।
পরদিন ওকে চমকে দিয়ে নিকোলাস দুপুরের পরেই রুমে এসে হাজির। ইসাবেলার মনটা ভালো ছিল না বিধায় রুমেই শুয়ে ছিল। নিকোলাসকে এই সময় দেখে অবাক হলো।
“তুমি? এই সময়ে?”
“তৈরি হও। বাইরে যাব।”
“কেউ দেখবে না?”
“না, ব্যবস্থা আছে। ওঠো তো।” একপ্রকার জোর করে উঠিয়ে পছন্দমতো কাপড় খুঁজল আলমারিতে। নিজের দেওয়া সেই ড্রেসটা দেখে থমকে গেল। মুখখানা মলিন হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে তামাটে স্কার্ট ও বেবি ব্লু ব্লাউজ বেছে নিলো।
“যাও পরে এসো।”
পোশাকগুলো হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওর দিকে ইসাবেলা। তারপর বলল,
“আজকের দিন কি স্পেশাল?”
নিকোলাস বিছানায় বসে বলল,
“না তো।”
ইসাবেলা আশা করেছিল ও বলুক, তোমার সাথে কাটানো প্রতিদিন স্পেশাল। স্পেশাল হলে তো বলবে। ইসাবেলা গোমরা মুখে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। কাপড় পরে ওয়াশরুম ছেড়ে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরিপাটি করে। ড্রেসটায় বেশ মানিয়েছে৷ আকর্ষণীয় লাগছে কি? এখান থেকে বিছানা দেখা যায়। নিকোলাস সেখানে বসে একদৃষ্টে ওকেই দেখছে। চোখে যেন কামনার তীব্র শিখা জ্বলছে। কামনা! ইসাবেলা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। নিকোলাস ততক্ষণে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। ভুল ভেবেছে ইসাবেলা। নিকোলাস ওকে মোটেও কামনার চোখে দেখবে না। তেমন কিছু ফিলই করে না। পাশ থেকে গরম কোর্টটা গায়ে চাপিয়ে বলল,
“আমি তৈরি।”
নিকোলাস কাছে এলো। সবসময়ের মতোই ওর কপাল এবং হাত দুটোতে চুম্বন করে কোমর জড়িয়ে ধরে। ওষ্ঠ চুম্বনও করে কিন্তু গতকাল করেনি আজ এখনপর্যন্তও না। ওর স্পর্শে ইসাবেলা বরাবরই রোমাঞ্চিত হয়। আজ রোমাঞ্চিত ব্যাপারটাতে শৈত্যপ্রবাহের একটা চাপ এলো। শান্ত, চুপচাপ হয়ে রইল ও। সকলের অলক্ষ্যে নিকোলাস ওকে নিয়ে ছুটল অনেকদূরে। মাঠ, তেপান্তর, বন পেরিয়ে ওরা এসে থামল একটি গ্রামীণ এলাকায়। লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে নেমে পায়ে হেঁটে এগোতে লাগল। কাঁচা রাস্তা ধরে হাটতে হাঁটতে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নেয় ইসাবেলা। চারপাশে ঘন সবুজ বন, সরু লেক, শীতকালীন গমের ক্ষেত। বসতিগুলো বেশ ফাঁকা ফাঁকা। কিছুদূর এগোলেই কোলাহল কানে এলো। লোকাল বাজারে এসে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয়দের বেশভূষা ওদের থেকে কিছুটা আলাদা। ভিড় ঠেলে এগোনোর সময় কয়েকজন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো। বাজারে বিভিন্ন জিনিসের পসরা বসেছে। নিকোলাস ওকে নিয়ে বসল একটা ব্যস্ত রেস্তোরায়।
“কী খাবে বলো?” জিজ্ঞেস করল নিকোলাস। ইসাবেলা আশপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
“এটাও কি সারপ্রাইজ ডেট?”
“হ্যাঁ।”
ইসাবেলার ধারণা ডেট ফেট কিছু না। গতরাত থেকে না খাওয়া ও। আসার সময় হয়তো ওর পেট ডেকে ওঠা শুনেছে। তাই এখানে আসা। পরক্ষণেই ভাবল, নিকোলাস যে ডেট জাতীয় কিছু করতে পারে এতে অবিশ্বাসের কী আছে। এর আগেও সারপ্রাইজ ডেটের আয়োজন করেছিল। এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল? আজেবাজে ভেবে, অভিমান করে একটু বেশিই জটিল করে তুলছে না তো সম্পর্ক? সম্পর্কে টক্সিক হতে নেই। ও কি টক্সিক হয়ে যাচ্ছে? না, না আর এসব ভাববে না। নিকোলাস ওকে ভালোবাসে। সবার ভালোবাসা তো আর এক রকম হয় না। তাছাড়া ও তো আর সাধারণ কোনো মানুষ নয়। ইসাবেলা কেন যে ভুলে যায় এই কথা। সব সম্পর্কে ত্যাগ ও মানিয়ে নেওয়ার মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ ভিতস্বরুপ। কোনো মানব পুরুষকে ভালোবাসলে দুটোই করতে হতো। পিশাচ পুরুষের বেলায় একটু বেশি মানিয়ে চলতে তো হবেই। ত্যাগও করতে হবে৷ হঠাৎ করেই যেন চেতনা ফিরল ওর। পুষে রাখা রাগে-অভিমান বরফের ন্যায় গলে গেল। হাসল। নিকোলাসকে ভালোবেসে ও সব পারবে। চিরজীবন কুমারী হয়ে থাকতেও।
ইসাবেলার একটু আগেও খিদে ভাব ছিল না। এখন মনে হচ্ছে কিছু খেলে ভালো লাগবে। পেটে ক্ষুধা থাকলে ভেতর-বাহির দুর্বল হয়ে যাবে। আরও উলটো পালটা ভাবনা এসে জেঁকে বসবে। আর নেগেটিভ ভাববে না। বেয়ারা খাবারের লিস্ট বলতে অনেকগুলো খাবার অর্ডার করে ফেললো ইসাবেলা। নতুন কিছু খাবার ট্রাই করার কৌতূহল সামলাতে না পেরেই কাজটা করল। অথবা, অন্য কারণে৷ খাবার আসতে সময় লাগল। এই সময়ের মধ্যে দুজনের কেউ ই কথা বলল না। নিকোলাস অন্যমনস্ক হয়ে আছে। ইসাবেলা চেষ্টা করেছিল কিন্তু নিকোলাসের গম্ভীর মুখ দেখে চুপ রইল। খাওয়া শেষ হলে লম্বা একটা হাসি দিয়ে কথা শুরু করবে। কিন্তু কী বলবে? একরাতে লজ্জা বেড়ে গেছে ওর।
টেবিল ভরে গেল খাবারের আইটেমে। কয়েকটা বেশ লোভনীয় দেখতে। কয়েকটা দেখে নাক কুঁচকে গেল। মনে মনে স্থির করল যেমনই হোক সব ট্রাই করবে। দুটো আইটেম খেল। একটা খুব মজা আরেকটা মোটামুটি। খেতে গিয়ে হঠাৎ নিকোলাসের দিকে তাকায়। গভীর মনোযোগ দিয়ে ওকে দেখছে। অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। হাতের চামচটা নামিয়ে বলল,
“তুমি যে কিছু খেলে না? এটা খাও। হা করো।”
নিকোলাস শান্ত গলায় বলল,
“তুমি হয় ভুলে গেছো নয়তো জানা নেই যে, নরমাল মানুষের মতো খাবার খেতে পারি না আমি। রক্ত আর কিছু তরলখাদ্য আমার খাবার। মাঝে মাঝে অবশ্য কাঁচা মাংসও খেতাম। তবে সেটা এখন অতীত।”
ইসাবেলা এখনও চামচ ওর মুখের কাছে ধরে আছে। আস্তে আস্তে সেটা প্লেটে নামিয়ে কিছু ভাবল। তারপর বলল,
“মাদামের বাড়িতে তো খেয়েছিলে।”
“মাদামের যেন সন্দেহ না হয় তাই। রাতে বদহজম হয়েছিল। অসুস্থতা বেড়ে গিয়েছিল সেই কারণে।”
ইসাবেলার খেতে অস্বস্তি হচ্ছে। একই টেবিলে একজন খাবে অন্যজন চেয়ে চেয়ে দেখবে! আগের ডেটে নিকোলাস শ্যাম্পেইন ছাড়া কিছু মুখে দেয়নি৷ সেদিন ব্যাপারটা এমন ছিল না। আজ নিকোলাসের কথাগুলো শুনে ক্ষুধাভাব মরে গেল।
“আমার পেট ভরে গেছে। চলো উঠি।”
“সারাজীবন এমন করে পেট ভরে যাবে?”
“মানে?”
“ধরো, যদি আমাদের একসাথে থাকতে হয়। তখন আমি খাই না বলে কি তুমিও খাবে না?”
ইসাবেলার ভুরু কুঁচকে যায়। নিকোলাস কী বুঝাতে চাইছে ওকে? সন্ধানী চোখে তাকাল। কিন্তু নিকোলাস তখনই বলল,
“আচ্ছা বাদ দাও৷ চলো ওঠা যাক।”
খাবার বিল মিটিয়ে ওরা আবার নেমে এলো রাস্তায়। নির্জন একটি স্থানে এসে নিকোলাস ফের ওকে শূন্যে নিয়ে ছুটল। এসময় চারপাশটা দ্রুতবেগে সরতে থাকে। ঠিক সময়ের মতো। ইসাবেলা মুখ তুলে নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে আছে। তখনকার বলা কথাগুলো এখনও ভাবাচ্ছে।
ওরা এবার একটি বাড়ির অদূরে বাগানে এসে থামল। সূর্য ঢলে পড়েছে। ম্লান আলো চারিদিকে। নিকোলাস আগে আগে হাঁটছে। ইসাবেলা ওর থেকে একটু পেছনে৷ বাড়ির কাছাকাছি আসতে কান্না শুনে চমকে ওঠে। নিকোলাস থামল না। দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। ইসাবেলা অনুসরণ করে। পলকে এই বাড়িতে দেখে অবাক হলো ও। নিকোলাসকে দেখে পল এবং একজন মধ্যবয়স্কসহ আরও দুজন লোক এগিয়ে এলো। দুজনের একজন বেশ বয়োজ্যেষ্ঠ। আরেকজন পলের কাছাকাছি বয়সের। বেশ চেনা মুখ কিন্তু এই মুহূর্তে মনে পড়ল না ইসাবেলার। ওর দিকে একপলক তাকালো তারা। মধ্য বয়স্ক লোকটাকে ভীষণ রুগ্ন আর বিষণ্ণ লাগছে। নিচু গলায় কথা বলছে ওরা। কান্নারত মহিলার দিকে তাকাল ইসাবেলা। তারপর সামনে শায়িত মেয়েটির দিকে। নিথর হয়ে পড়ে আছে। রক্তশূন্য মুখ, শুকনো ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। চোখ বসে গেছে। ইসাবেলার চোখ গেল ওর উঁচু পেটটার দিকে। ও কী গর্ভবতী? চামড়া লাগানো কঙ্কালের ন্যায় লাগছে মেয়েটিকে। পেটটা সেই কারণে বুঝি বিশাল দেখাচ্ছে৷
পল মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মধ্যবয়স্ক লোকটি গিয়ে কান্নারত মহিলাকে কিছু বলতে বিস্মিত চোখে তাকাল। তারা স্বামী-স্ত্রী। মেয়েটি বোধহয় ওদের সন্তান। মহিলার মুখ ভীত হয়ে ওঠে।
“না, না। ও মরে যাবে।”
“এটা না করলে নিশ্চিত মরবে। শেষ চেষ্টাটুকু করতে দাও। ঈশ্বরের ওপর ভরসা রাখো।”
মহিলাটি ফের কাঁদতে লাগল। লোকটি তাকে নিয়ে একটি রুমে ঢুকে যায়। কিছু সময় পরে একা ফিরে এলো একটা ট্রে হাতে৷ ট্রেতে কোনো খাবার পানীয় নেই। ধারালো ছুরি, সেলাই করার সুই সুতো, ব্যান্ডেজ আরও কিছু আছে কিন্তু ইসাবেলা বুঝতে পারল না দূরে দাঁড়িয়ে। এগিয়ে যেতে নিষেধ করেছে নিকোলাস। ওকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। কী করতে যাচ্ছে মেয়েটির সাথে? ভাবল ইসাবেলা। পল ধারালো ছুরি হাতে তুলে নিতে মেয়েটির বাবা বাধা দিলো। তাকালো ইসাবেলার দিকে।
“ও থাকবে।” বলল নিকোলাস। মেয়েটিকে তরল কিছু খাওয়ালেন বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটি। কিছুক্ষণ পর ওর ঠোঁট কাঁপা-কাঁপি বন্ধ হয়ে গেল। নিশ্চল দেহ। পল ছুড়ি হাতে ঠিক ওর পেটের পাশে দাঁড়ায়।
“ও-ও কী করতে যাচ্ছে?” আর্ত গলায় বলে ইসাবেলা। নিকোলাস এক হাতে ওর কাঁধ চেপে মুখটা আড়াল করে বুকের ওপর। ইসাবেলা কাপড় ছেঁড়ার শব্দ শুনতে পেল। নিকোলাসের হাতটা এখনও ওর মাথার পেছনে চেপে ধরে আছে। ইসাবেলা যেন বুঝে গেছে কী করতে যাচ্ছে পল মেয়েটির সাথে৷ কিন্তু কেন? ডাক্তারের কাছে কেন নিচ্ছে না মেয়েটিকে?
“নিকোলাস, ওকে থামাও।”
“শান্ত হও তুমি। সব ঠিক হয়ে যাবে।” কথাগুলো যেন ইসাবেলা নয় নিজেকেও বলছে ও। ইসাবেলা শান্ত হতে পারে না। বুক ঢিপঢিপ করছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে নিকোলাস ওর মাথার ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো। ভয়ে ভয়ে ঘুরে তাকালো ইসাবেলা। পলের হাতে একদলা রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড। কাপড়ে মুড়িয়ে রাখল সেটা। বাচ্চাটাকে ওরা এভাবে শেষ করে দিলো? ক্রোধে জ্বলছে ইসাবেলার চোখ।
“আর দেরি করো না। তাড়াতাড়ি তোমার রক্ত ওর মুখে দাও।” পলের বয়সী লোকটিকে বলল বয়োজ্যেষ্ঠ। এগিয়ে এলো সে। নিজের হাতের কব্জিতে কামড় বসিয়ে দেয়। বেরিয়ে আসে কালো রক্ত। মেয়েটির ঠোঁটের ওপর ধরে হাতটি। একফোঁটা, দুফোঁটা, তিনফোঁটা….
“যথেষ্ট।” হাত ধরে সরিয়ে নেয় বয়োজ্যেষ্ঠ।
“এর বেশি ওর জন্য প্রাণনাশক।”
মেয়েটির ঠোঁট নড়ে ওঠে। রক্তের ফোঁটাগুলো মুখের ভেতরে প্রবেশ করে। সকলের দৃষ্টি ওর দিকে স্থির। এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট, চার মিনিট এবং ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় এক আশ্চর্য ঘটনার লক্ষ্য করল ইসাবেলা। কঙ্কালসার মেয়েটি চোখের নিমেষে সুস্থ ও সুন্দরী এক যুবতীতে পরিবর্তন হয়েছে। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। অপরিচিত মুখগুলো দেখে ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে। বয়োজ্যেষ্ঠ ওকে অভয় দিলো। মেয়েটির বাবা মা মেয়েকে সুস্থ ও স্বাভাবিক দেখে খুশির জল ফেললেন। স্তব্ধ হয়ে দেখছিল এতক্ষণ ইসাবেলা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে নিকোলাস। ওকে সেভাবে রেখে মেয়েটির কাছে গেল। নিচু গলায় কিছু বলল ওদের। তারপর ইসাবেলার কাছে এসে হাত ধরে বলে,
“এসো।”
“ও-ও__” ওর তোতলানো দেখে সকলে তাকালো। নিকোলাস বলল,
“সব বলছি এসো।”
ইসাবেলা বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে শেষবার বাড়ির ভেতরে তাকালো। মেয়েটি ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
চলবে,,,,