তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৭১+৭২+৭৩

0
966

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৭১
Writer তানিয়া শেখ

নৈশভোজের জন্য একত্রিত হয়েছে ম্যাক্সওয়েল পরিবারের সবাই। ডাইনিং টেবিলের মধ্যমণি ম্যাক্সওয়েল বংশের বর্তমান কর্তা প্রবীণ মার্কোভিক ম্যাক্সওয়েল পেট্রব। তাঁর দু’পাশে বসেছেন দুই ছেলে রজার ম্যাক্সওয়েল ও ম্যাক্সিম ম্যাক্সওয়েল। তাঁদের পাশে বসা তাঁদের স্ত্রী। পঞ্চাশ বর্ষী রজারের স্ত্রী দাশার পাশেই মার্কোভিকের তৃতীয় সন্তান আন্না মেরিও ও তাঁর পরিবার বসেছে। ওপর পাশে বসেছে রজার ও ম্যাক্সিমের তিন সন্তান। খাবার টেবিলে এদের কারো মুখে রা নেই। এ বাড়ির নিয়ম খেতে বসে কর্তার অনুমতি ব্যতিরেকে কথা বলা যাবে না। এর অন্যথা করার সাহস আজ পর্যন্ত কেউ দেখায়নি। মার্কোভিক ম্যাক্সওয়েল খুব রাশভারি স্বভাবের লোক। গম্ভীরতার দেয়াল যেন সবসময়ই তাঁর চতুর্দিকে থাকে। সন্তানেরা পিতার বাধ্যগত। পিতার কথাই তাঁদের জন্য অকাট্য। নাতি-নাতনিরাও এসব শিখেই বড়ো হয়েছে। কোনোক্রমে আপন পিতা-মাতার অবাধ্য হলেও পিতামহ/ মাতামহের অবাধ্য তারা হয় না। মার্কোভিক ম্যাক্সওয়েলের এমনই প্রভাব ওদের ওপর। তাতিয়ানা সেকথা আবারও প্রমাণ করেছে। সকলের কথা অমান্য করলেও মাতামহের কথা ও অমান্য করতে পারেনি৷ মার্কোভিকের কিছু আশ্চর্যরকমের বিশেষত্ব আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, না কে খুব সহজে হ্যাঁ করাতে পারেন। কীভাবে পারেন সেটা আপাতত এড়িয়ে গেলাম।

নৈশভোজের আগে প্রার্থনার নিয়ম এ বাড়িতে। সেখানে মৃত পূর্বপুরুষদেরকে স্মরণ করা হয়। শান্তি কামনা করা হয় তাঁদের আত্মার। প্রার্থনা শেষ হতে তিখন কারাতের নির্দেশে দাসীরা টেবিলে খাবার পরিবেশন করে। নিঃশব্দে খাচ্ছে সকলে। নীরবতায় বিঘ্ন ঘটে তাশার কান্নার শব্দে। দোতলার রুমে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল ওকে। মেয়েটা আবার দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেল কি না ভেবে উঠে যাবে বলে নড়ে ওঠে মাতভেই। টেবিলের সকলে এমনভাবে তাকায় যেন বেঠিক কিছু করেছে সে। মাতভেই প্রথমে বুঝতে পারেনি। তাতিয়ানা টেবিলের নিচে হাত বাড়িয়ে রাখল ওর হাতের ওপর। মৃদু চাপ দিতে মাতভেই তাকালো। তাতিয়ানা ইশারায় বুঝায়,”উঠো না।” মাতভেইর ভুরু কুঁচকে যায়। একদিকে ওর মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদছে আর মা হয়ে তাতিয়ানা ওকে উঠতে নিষেধ করছে! মা হিসেবে তাতিয়ানার তুলনা হয় না। কিন্তু আজ মাতভেই রুষ্ট হলো। ওর মুখের রুষ্টতা মার্কোভিকের নজর এড়াল না। চশমার ফাঁকে নির্লিপ্ত চাহনিতে চেয়ে রইলেন। তাঁর মৃদু গলা ঝাড়ার শব্দ সবার দৃষ্টি আর্কষণ করল। স্যুপের চামচ ঠোঁটের মাঝ থেকে নামিয়ে বাটিতে রাখলেন মার্কোভিক। ন্যাপকিনে ঠোঁট মুছতে মুছতে বললেন,

“তোমাকে যেতে হবে না মাতভেই। এখনই ওর কান্না থেমে যাবে।”

ঠিক তাই ই হলো। সকলে এর রহস্য জানতে আগ্রহী। মার্কোভিক কিন্তু চুপ করে গেলেন। ফের হাতে তুলে নিলেন স্যুপের চামচ। এর অর্থ সকলকে খেতে নির্দেশ দিলেন তিনি। মাতভেই চামচ বাটির মধ্যে নাড়াচাড়া করলেও মুখে তুললো। একটু পর পরই ওর চোখ দোতলার দিকে যাচ্ছে। মেয়েকে না দেখে খেতে ইচ্ছে করছে না। তাতিয়ানার অবস্থাও একই। আপ্রাণ চেষ্টা করছে সেটা প্রকাশিত না হোক। তাশা এ বাড়িতে নিরাপদ। তা জানা স্বত্বেও তাতিয়ানার মন শান্ত হলো না। মার্কোভিক আড়চোখে দুজনকে দেখলেন। চোখ সরাতে গিয়ে তাতিয়ানার পাশে বসা ইসাবেলার ওপর থামে। স্মিত হাসি ওর ঠোঁটে। গালের একপাশে একটা হাত। অন্যটা দিয়ে বাটির স্যুপে চামচ নাড়াচাড়া করছে। হঠাৎ চোখ তুলে পাশে তাকাতে নানার চোখে চোখ পড়ে যায় ইসাবেলার। হাসি নিভে যায় দপ করে। চকিতে বাটির দিকে তাকায়। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে। নানার কঠোর দৃষ্টিকে ও ভয় পায়। তাশার জন্য আর সবার মতো ও নিজেও চিন্তিত। হঠাৎ নিকোলাসের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে পড়তে খানিক হেসেছিল। সেটায় এখন বেকায়দায় ফেললো। নিকোলাস যেন খুব গোপনীয় একটা চিঠি। যা কেবল একা ইসাবেলা দেখবে, পড়বে। গোপনে হৃদয়পুরের সিন্দুকে লুকিয়ে রাখবে। অন্য কেউ এর ধারণা পর্যন্ত পাক সেটা ও চায় না। তাতে যে ভীষণ বিপদ ঘটতে পারে। ইসাবেলা মনে মনে প্রার্থনা করে নানা যেন কিছু সন্দেহ না করেন৷ চোখের কোণ দিয়ে সতর্কে চাইল একবার। নানা খাবারের দিকে চেয়ে খাচ্ছেন। গোপনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে ইসাবেলা। ও বোঝে না ওর এই অতিসাবধানি অঙ্গভঙ্গি আশপাশের মানুষদের মাঝে আরও বেশি সন্দেহের সৃষ্টি করে।

তাশার খিলখিল হাসি শুনে সিঁড়ির দিকে তাকায় মাতভেই। একা একা সিঁড়ি বেয়ে ওঠা নামা করার সাধ্য তাশার নেই। বয়সের তুলনায় শরীর একেবারে দুর্বল। এখনও ঠিকমতো দাঁড়াতে পারে না। বাড়ির সকলে ডাইনিংএ। রাঁধুনি ছাড়া বাকি কাজের লোকেরাও। রাঁধুনির বাড়ির ভেতর আসার অনুমতি নেই৷ তবে তাশা কার সাথে? শুধু মাতভেই নয় এই প্রশ্ন ডাইনিংএ বসা অনেকের। সকলের প্রশ্নের জবাব একটু পরেই হলঘরে পা রাখে। দশ বা এগারো বছরের একজন বালিকার কোলে চড়ে আছে তাশা। মেয়েটি দেখতে হৃদপুষ্ট, মাথায় বাদামী চুল ও গোলাগাল সুশ্রী চেহারা। মুখটা আনত বলে ওর চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে না। কোমলতার নিবিড় ছায়া ওর মাঝে স্পষ্ট। তাশার মাথাটা মেয়েটার বুকের ওপর। মুখে আঙুল দিয়ে পিতা-মাতার দিকে হাসিমুখে তাকায়। তারপর আবার মেয়েটির মুখের দিকে। ওকে দেখে মেয়েটিও মুচকি হাসল। এত অল্প সময়ে কী ভাব ওদের!

“তুমি কে?” মাতভেইর প্রশ্নে সভয়ে চোখ তুললো মেয়েটি। একজোড়া ডাগর বাদামী চোখ। বোবার মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে টেবিলের সোজাসুজি তাকাল। সেখানে তিখন কারাতে দাঁড়িয়ে। শান্ত তাঁর দৃষ্টি। মার্কোভিকের খাওয়া শেষ। মুখ মুছে চেয়ারে গা এলিয়ে বললেন,

“ও হচ্ছে তিখনের নাতনি। নামটা কী যেন মেয়ে তোমার?”

নামটা আবার ভুলে গেছেন মার্কোভিক। বালিকাটি তিখনের দিকে তাকাতে মাথা নাড়িয়ে জবাব দেওয়ার অনুমতি দিয়ে বলল,

“রেইনি কারাতে।” বিনীত অথচ, ভীত কণ্ঠস্বর। মার্কোভিক মাথা দুলিয়ে বললেন,

“হ্যাঁ, ও হলো রেইনি। তিখনের নাতনি। এখন থেকে ও তাশার সাথে সর্বক্ষণ থাকবে।”

“বেবিসিটার! কিন্তু ও নিজেই তো একটা বাচ্চা মেয়ে।”

মাতভেই বলল। মার্কোভিক সরাসরি তাকালেন এবার মাতভেইর দিকে। নাতনি জামাতা হিসেবে খুব যে ওকে পছন্দ তা নয়। কিন্তু তাতিয়ানার মতো উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো ছেলে পাওয়া মুশকিল। নাতনির মাথা থেকে কুমারি মায়ের দুর্নাম ঘুচাতে মাতভেইকে তিনি নাত জামাতা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নচেৎ প্রতিপক্ষ দেশের ছেলেকে ঘরে আশ্রয় দেওয়ারই পক্ষপাতি নন।

“মাতভেই, এ বাড়ির কর্তা আমি। কার কীসে ভালো তা আমি তোমার চেয়ে ভালো বুঝি। আমার পরিবার সেটা মানে। আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করে ওরা। এ নিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন তোলে না। আমি সেটার অনুমতিও দিই না। তুমি বাইরের লোক। নতুন নতুন আত্মীয়তা হয়েছে। একটু সময় লাগলেও সবটা বুঝে যাবে। ওই যে বসে আছে তোমার হবু শ্বশুর মশাই আর শাশুড়ী। তাঁরা তোমাকে ঠিক সব বুঝিয়ে দেবেন।” মেয়ে এবং জামাতার মুখের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকালেন মার্কোভিক। মাতভেই কাওকে লজ্জিত করতে চাইনি। হবু শ্বশুর ও শাশুড়ীর আনত মুখ দেখে না চাইতেও চুপ করে গেল। নানা শ্বশুরের তিক্ত কথা বেশ ঘায়েল করল ওকে। তাশা ওর মেয়ে। তবে মার্কোভিক কেন কিছু না জানিয়ে তাশার ব্যাপারে একা সিদ্ধান্ত নেবেন? রেইনি নিজেই শিশু। শৈশব উপভোগের সময় এখন ওর। আর এঁরা কি না জোর করে দায়িত্ব চাপিয়ে সেই শৈশবের আনন্দটাকে পিষে মারতে চায়! মাতভেই অনিয়ম, অন্যায় মেনে নিতে পারে না। আপনজনদের মুখ চেয়ে আজ বাধ্য হলো চুপ করে থাকতে। তবে মার্কোভিকের এহেন আচরণে ও মনঃক্ষুণ্ন হয়। ডাইনিংএ বসা সকলে সেটা বুঝতে পেরেও কোনো কথা বলল না। নানাকে ইসাবেলা অপছন্দ করে না৷ কিন্তু তাঁর এমন দাম্ভিক, গম্ভীর স্বভাবকে পছন্দও করে না ও। মাঝে মাঝে তিনি যেন বেশিই নির্দয় আর রূঢ় হয়ে ওঠেন।

খাওয়া শেষে যে যার কক্ষে চলে গেল। তাতিয়ানা ও মাতভেইর সাথে রেইনিকে পাঠানো হয়েছে। ওর আর তাশার জন্য দোতলায় নতুন একটা কক্ষ খোলা হয়েছে। তিখনও গিয়েছে ওদের সাথে।

ইসাবেলার কক্ষটি দাদা-দাদির কক্ষের পাশে। তাদের শুভরাত্রি বলে কক্ষে গিয়ে খিল দিলো। তারপর দ্রুত এলো জানালার কাছে। জানালা খুলে দিতে এক ঝাপটা হিম বাতাস ওর ওপর আছরে পড়ল। কাঁপুনি দিয়ে ওঠে দেহটা। আজ তুষার পড়ছে। যতদূর চোখ যায় যেন শ্বেতশুভ্র ক্যানভাস। যা চোখে ও মনে প্রশান্তি আনে। ইসাবেলার সেই প্রশান্তি বহুগুণ বাড়ে হিম বাতাসে ভেসে আসা সোঁদা মাটির তীব্র গন্ধে। ঠোঁটে হাসি নিয়ে খোলা জানালার কাছ থেকে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। বুকের ওপর টেনে নিলো কম্বল। পিঠ জানালার দিকে। পুরো কক্ষে মৌ মৌ করছে সোঁদা মাটির গন্ধ। জানালার কবাট বন্ধ হতে শুনলো। তারপর ভারি পায়ের আওয়াজ। ধীরে ধীরে সেটি বিছানার দিকে আসছে। ইসাবেলা ঘুমের ভান করে পড়ে রইল বিছানার ওপর।

“বেলা।”
এমন ব্যাকুল ডাক উপেক্ষা করা দায়। মনকে বুঝিয়ে দায়টা পাশে রাখল ইসাবেলা। শিওরের পাশের বিছানা বসে যায়। নিকোলাসের দেহের শীতলতা টের পাচ্ছে ও। তবুও চোখ মেললো না।

“আমি জানি তুমি জেগে আছো বেলা।”

ইসাবেলা একটুও অবাক হলো না। সব জেনেশুনেই ও মিথ্যা ঘুমের ভান ধরে আছে। নিকোলাসকে জ্বালাতে ইচ্ছে করছে কেন যেন। সারাদিন ওকে ছাড়া কম জ্বলেনি ও।

“এসবের মানে কী বেলা? ওঠো বলছি। সেই কখন থেকে অপেক্ষা করিয়ে এখন আবার ঘুমের ভান ধরে পড়ে আছো। বেলা, ওঠো।”

নিকোলাস ওর কাঁধ ঝাঁকাল। ইসাবেলা তাতেও যদি চোখ মেলতো! নিকোলাসকে বিরক্ত করে মজা পাচ্ছে। ওর ঠোঁট চেপে হাসি সংবরণের চেষ্টা নিকোলাসের চোখে পড়ে যায়। মনে মনে বলে,

“ওহ! তাহলে এই কথা!”
নিকোলাস মুচকি হাসল। ওর গা এলিয়ে দেওয়া শরীরটা টেনে বসায় সামনে। শব্দ করে হাফ ছেড়ে বলল,

“সারাদিন ধরে ভেবেছি কথাটা তোমার সামনে কী করে বলব! কিন্তু না বললেও তো ধোঁকা হয়ে যাবে। আ’ম সরি বেলা। আমি সত্যি সরি। আসলে মেয়েটা_”

“মেয়েটা! কোন মেয়েটা?” চোখ পাকিয়ে তাকায় ইসাবেলা। গলা সামান্য চড়ে গেল,

“আসলে মেয়েটা কী? বলো?”

নিকোলাস চুপ করে ওকে দেখছিল। ইসাবেলা চোখে চোখ রাখল। বিশ্বস্ততা দেখছে সেখানে। নিকোলাসের আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। শান্ত হলো ইসাবেলা। সরে এলো ওর খুব কাছে।নিকোলাসের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হলো। বুকের ওপর মাথা রেখে ধরা গলায় বলল,

“কেন কাঁদাতে চাও আমায় তুমি?”

“মেবি আমি স্যাডিস্ট?” ইসাবেলা ভুরু কুঁচকে তাকাতে সিরিয়াস গলায় বলল,

“আ’ম সরি৷ আর এমন করব না।”

ইসাবেলার মাথার ওপর চুমু খেলো নিকোলাস। হাতটা তুলে নিলো হাতে। ওর হাতের আঙুলগুলো নিয়ে খেলতে লাগল। অনামিকা আলতো করে বুলিয়ে দেয়। সেখানে একটা আংটি কল্পনা করে। নিকোলাসের নামের আংটি। দারুন এক অনুভূতির স্রোত বয়ে যায় বুকের ভেতর।

“তুমি আমার নিকোলাস। তোমার সবকিছুর ওপর একমাত্র আমার হক, আমার দাবী। বাকি পৃথিবীর সব মেয়ের জন্য তুমি নিষিদ্ধ।” বুকের সাথে আরও মিশে গেল ইসাবেলা। গুটিশুটি মেরে রইল কোলের মধ্যে।

“আর তুমি?” জানতে চাইল নিকোলাস। ইসাবেলা দৃঢ়তার সাথে বলল,

“আমি তোমার, আমৃত্যু তোমারই।”

নিকোলাসের হৃৎস্পন্দনের গতি তীব্র হয়। ইসাবেলা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। বা’পাশের বুকের ওপর হাত রাখল।

“বলো এই হৃদয় কেবল আমার জন্য স্পন্দিত হয়। বলো নিকোলাস।”

“তোমার জন্য বেলা, শুধু তোমার জন্য।”

চলবে,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৭২
Writer তানিয়া শেখ

চাঁদে গ্রহণ লেগেছে। এই সময়টা বেশ অস্থিরতায় কাটে চন্দ্রদেবীর। কত কী ঘটে পৃথিবীতে অথচ, তখন কিছুই তিনি দেখতে পান না। সাহায্য করতে পারেন না পছন্দের মানুষগুলোকে। এইটুকু সময়ে অনেক কিছু ঘটে যায়, কিন্তু তাঁর সামনে রুদ্ধ আঁধারের দুয়ার। যা ভেদ করা অসম্ভব।

আগাথাকে এতবার বোঝানোর পরেও ওঁ পৃথিবীতে গিয়েছে আজ। বেশ কয়েকমাস ধরেই অনুনয় করছিল। চন্দ্রদেবীকে কিছু নিয়মের মধ্যে চলতে, বলতে ও কাজ করতে হয়। চাঁদের শাসনকর্ত্রী হলেও তিনি পুরোপুরি চলেন সপ্ত আসমানে আসীন স্রষ্টার নির্দেশে। আগাথাকে সে কথা বলেই এতটাদিন পৃথিবীতে যাওয়া থেকে বিরত রেখেছিলেন। ইদানীং আবার আগের মতো গোঁ ধরেছে পৃথিবীতে যাবে। চন্দ্রদেবীর সামনে তাঁর মনের কথা গোপন থাকে না। সন্তানের বিপদ মায়েরা আগে থেকেই অনুধাবন করতে পারে। আগাথাও পেরেছে। নোভার সামনে ঘোর বিপদ। বহুদিন সন্তানদের সামনে যাননি। আজ না গেলেই নয়। আগাথাকে বিশেষ স্নেহ করেন চন্দ্রদেবী। তাঁর বারংবার করা অনুনয় উপেক্ষা করতে পারেননি। না চাইতেও অনুমতি দিতে হয়েছে। এখন সেই জন্য অনুতাপ হচ্ছে। কেন যে অনুমতি দিলেন ওকে! আজ গ্রহণ সরতে আধঘণ্টা লেগে যেতে পারে। এরমধ্যে যদি কিছু হয়! চন্দ্রদেবী তামার গোলকের সামনের এসে দাঁড়ালেন। দু-হাত ওর ওপর রেখে বললেন,

“গোলক গোলক, দেখা,
আগাথার আত্মার রশ্মিরেখা।”

গোলকে ধোঁয়াশা ক্রমশ বাড়ে। চন্দ্রদেবী অধীর হয়ে অপেক্ষা করেন আগাথার আত্মার আলো দেখার জন্য। কিন্তু অনেকক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরও কিছু দেখতে না পেয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়েন। পুনরায় বলেন,

“গোলক গোলক, দেখা,
আগাথার আত্মার রশ্মিরেখা।”

গোলকে এবারও ধোঁয়াশা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। চন্দ্রদেবীর জোর বাড়তে থাকে গোলকের ওপর। এক পর্যায়ে রেগে যান শান্ত দেবী। পাছে দেবীর রোষানলে পড়তে হয় এই ভয়ে মুখ খোলে গোলক।

“অভিবাদন ও দেবী,
আজ গ্রহণে ম্লান আমার দ্যুতি।
নাই থাকে যদি আলো,
কেমনে দেখাই কোথায় কী হলো?”

দেবী শান্ত হলেন। সত্যি তো! তিনি দেবী হয়েই যখন নিরুপায় তখন গোলক আর কী করবে।
কিন্তু মনটা বড়ো বিচলিত দেবীর। সিংহাসনে বসে সামনে অন্ধকারে চেয়ে রইলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন এই কালো ছায়া সরে যাওয়ার। বিড়বিড় করে বললে,

“আগাথা, বাছা আমার! সাবধানে থেকো, সাবধানে থেকো।”

আগাথা পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনতে পেলেন দেবীর কথা। বড়ো দেরি হয়ে গেছে এই সতর্কবার্তা পেতে।

“বহু চেষ্টার পর আজ সফল হয়েছি। এখন থেকে তুই আমার গোলাম। গোলাম।” অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে পুরুষালি কর্কশ কণ্ঠটি। আগাথা লোকটাকে দেখতে পাচ্ছে না। তাঁর সামনে ঘোর অন্ধকার। চতুর্দিকে ঘূর্ণায়মান অদৃশ্য এক রজ্জু। এই রজ্জুর বাঁধন তাঁকে বন্দী করে ফেলেছে। খারাপ কোনো জাদুকরের খপ্পরে পড়ে গেছেন আগাথা। এখন উপায়? দেবীকে স্মরণ করলেন। সাহায্য কামনা করলেন ঈশ্বরের। তাই শুনে আরও জোরে হাসল লোকটি।
“কেউ আসবে না তোমায় বাঁচাতে আগাথা। কেউ না।”

“তুমি আমার নাম জানো?”
জাদুকরেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আত্মাদের বন্দী করে। আগাথা এতক্ষণ ভেবেছিলেন ভুলক্রমে তিনিও এদের ফাঁদে পড়ে গেছেন। তখনই লোকটার পূর্বের কথাটা স্মরণ হয়। উদ্বিগ্নতার কারণে কথাগুলো খেয়াল করেননি। প্লান করেই বন্দী করা হয়েছে তাঁকে। কিন্তু কেন? এখন ভয় তিরতির করে বেড়ে গেল। জাদুকর নিচু গলায় বলল,

“নাম? শুধু নাম নয় আগাথা। তোমার নাড়িনক্ষত্রের সব আমার জানা।”

“কে তুমি?”

“আমি? এখনই জানতে চাও? নাহ! এখন বললে তো মজা নেই। আরেকটু সবুর করো। শুভক্ষণে দৃষ্টিবিনিময়ে হবে আমাদের।”

সিংহাসনে গম্ভীর হয়ে বসে আছে নিকোলাস। রাশিয়া ও জার্মানির যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। হিটলার আশাবাদী ছিল জয়ের। রাশিয়ার অনেক শহর এখন জার্মানির দখলে। হিটলারের বিপুল সংখ্যক সৈন্য এবং সাঁজোয়া অস্ত্রের সামনে দিশাহারা হয়ে পড়েছিল রাশিয়া। সবই জার্মানির পক্ষে ছিল। বিপত্তি বাঁধিয়েছে রাশিয়ার বৈরী আবহাওয়া। শীত, ভারী বর্ষণ জার্মান সৈন্যদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। ক্যাম্পে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। অস্ত্রের সরবরাহ নেই। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব। এই সুযোগটা কাজে লাগালেন জোসেফ স্ট্যালিন। রেড আর্মিদের সৈন্য সংখ্যা বাড়তে লাগল। রাশিয়া নতুন উদ্যমে জার্মান সৈন্যদের মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। হিটলার বেকায়দায় পড়েছে। কিন্তু হার মানতে নারাজ সে। তার এক কথা ‘জার্মানি হবে পৃথিবীর সর্বশক্তিমান নয়তো কিছুই নয়।’ প্রথম চারটি শব্দ প্রতিষ্ঠিত করতে সব করবে সে। অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো নয়। হিটলারের কিছু মিত্র পক্ষের মতে হিটলার এখন যা করছে তা অতিরিক্ত। এই কারণে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে তাদের। পরাজয় এখন সময়ে ব্যাপার। কিন্তু হিটলারকে বুঝাবে সাধ্য কার! না চাইতেও তার ভয়ে মিত্রপক্ষের সেসব নেতারা চুপ আছেন। নিকোলাস ওদের মতো ভীতু নয়। হিটলারকে কোনোকালেই ও ভয় করেনি। সে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে হিটলারকে আর সমর্থন করবে না। রাশিয়া আক্রমণের পর থেকে হিটলারের সাথে ওর মনোমালিন্য শুরু হয়। সেটা এখন বিরোধে রূপ নিয়েছে।

সামনের সভাসদদের আসন থেকে রিচার্ড উঠে দাঁড়ালেন। নাখোশ মুখে বললেন,

“হিটলারের সাথে শত্রুতা তোমার উচিত হবে না। ওকে আমাদের প্রয়োজন।”

“ও এখন আমাদের কোনো কাজের না।” বলল নিকোলাস। রিচার্ড বললেন,

“ভবিষ্যৎ দেখোনি তুমি নিকোলাস। কী করে বুঝলে ওকে আমাদের প্রয়োজন পড়বে না।”

“হিটলারের ভবিষ্যৎ এখন ওর ললাটে দিনের আলোর ন্যায় জ্বলজ্বল করছে। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ও। তোমার মস্তিষ্ক বুড়িয়ে গেছে। সুতরাং দূরদর্শিতা তোমার মধ্যে থাকার কথা না। এসব গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তায় তোমার মতামত দেওয়া উচিত বলে মনে করি না। মানবে না জানি, তবুও বলছি, এই সিংহাসনের উপযুক্ত কোনোদিন তুমি ছিলে না। রাজা হতে কূটবুদ্ধি আর ম্যানুপুলেটিভ স্বভাব ছাড়াও আরও কিছু থাকা লাগে। যা তোমার নেই।”

শান্ত গলায় বলল নিকোলাস। যেচে এসে বারবার মতামত দেওয়া রিচার্ডের বদঅভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব বিরক্ত হয় তাঁর ওপর নিকোলাস। প্রচণ্ড অপমানিতবোধ করলেন রিচার্ড। দাঁতে দাঁত পিষে আসনে বসলেন। সোফিয়া পাশে বসে কটমট করে বললেন,

“আর কত অপমানিত হবে? কত নিষেধ করি চুপ করো। না, উনি আমার কথা শুনবেন না। একজন অপদার্থ, দুর্বলকে ভালোবেসেছি আমি। কেবল অপমানিত হওয়া ছাড়া যার কিছুই করার নেই তার।” হঠাৎ সন্তানের মুখটা মনে যায় সোফিয়ার। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে ওর ক্ষতির আশংকা করে। ঠিক আছে কী আন্দ্রেই? আন্দ্রেইকে খুব মনে পড়ে এখন তার। নিকোলাসের দিকে তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে চেয়ে চাপা গলায় স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“তোমাকে আমি উজাড় করে ভালোবেসেছি রিচার্ড। বিনিময়ে কিছু দেওনি। এবারও আমার নিজের জন্য কিছু চাইবো না। তুমি ওই সিংহাসন ফিরিয়ে নেও রিচার্ড। আমি তোমায় ওই শয়তানটার জায়গায় দেখতে চাই।”

রিচার্ড একদৃষ্টে সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সভাসদদের সাথে আলাপে মশগুল নিকোলাস। এদিক ফিরলে দেখতে ওরই কাছের দুজনের চোখে প্রতিহিংসার ও প্রতিশোধের অনল দাউ দাউ করে জ্বলছে। কী ভয়ংকর তার তীব্রতা!

সভার ইতি টানলো আজকের মতো নিকোলাস।
একে একে সকলে ওকে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিলো। সিংহাসনে গা এলিয়ে দেয় নিকোলাস। ইসাবেলার সান্নিধ্যের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। চোখ বন্ধ করে প্রিয়তমার মুখটা স্মরণ করল। আনমনেই মুচকি হাসল। ওর সকল খুশির উৎস যেন ইসাবেলা। ওকে ছাড়া সব কিছু বিষাদ, বিষণ্নতায় মোড়া, শূন্যতায় ভরা। ওর জীবন্মৃত দেহটা জীবন্ত হয় ইসাবেলার সান্নিধ্যে এলে। বহুকালপূর্বের অনুভূতি টের পায় তখন। কী চমৎকার, সজীব সেই অনুভূতি! এই অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী হোক। ইসাবেলা ওর হোক, সবভাবেই, সব অবস্থায়। যেটুকু দুরত্ব তাও আর না থাক। মিলেমিশে একাকার হতে চায় ওর ভেতর নিকোলাস।

“পল!”

মনিবের এক ডাকে বিনীতভাবে সামনে এসে দাঁড়ায় পল। নিকোলাস সিংহাসন ছেড়ে উঠে বলল,

“তৈরি হ। আজ রাতেই মস্কোর উদ্দেশ্য রওয়ানা হব।”

“বেয়াদবি না নিলে একটা কথা বলব, মালিক?”

মাথা নাড়ায় নিকোলাস,

“হুম।”

“দুই দেশের মধ্যেকার এমন খারাপ অবস্থার মধ্যে না গেলেই কী নয়? তাছাড়া কমিউনিটিতে আপনার শত্রু বাড়ছে। আজও আপনার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অনেকে ছিল। বিশেষ করে_”

“রিচার্ড। তাই তো?” পলকে থামিয়ে দিয়ে বলল নিকোলাস।

“জি।” পল জবাব দিলো। নিকোলাস উপেক্ষিত হাসি হেসে বলল,

“এ আর নতুন কী। রিচার্ড কবে আমার পক্ষে ছিল? যারা বুদ্ধিমান তারা আমার সাথে শত্রুতা করার ভুল করবে না। কমিউনিটির সকলের জানা নিকোলাসের সাথে শত্রুতার ফল কত ভয়াবহ হয়। এ নিয়ে তুই ভাবিস না। ওরা আমার কিছু করতে পারবে না। এত সাহস বা ক্ষমতা ওদের নেই। যা গিয়ে তৈরি হয়ে নে।”

পল প্রস্থান করবে তখনই নিকোলাস থামালো ওকে,

“দাঁড়া।”

প্রশ্নাত্মক চোখে ঘুরে দাঁড়াল পল। একটু ভাবুক হলো নিকোলাস তারপর বলল,

“তুই বিয়ে পড়াতে পারবি?

“বিয়ে? কার?” বিস্ময়ে প্রশ্ন করে পল। নিকোলাস মৃদু ধমকে বলল,

“প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন করবি না৷ পারবি কি না বল।”

“আমি ফাদার নই। চার্চে যাওয়া আসা হয়ই না তেমন। কী করে পারব?”

গম্ভীর হয়ে পায়চারি করতে করতে ভাবল কিছুক্ষণ নিকোলাস। তারপর বলল,
“তুই বিয়ে পড়ানোর নিয়মটা জানিস তো?”

“তা জানি।”

“ব্যস! ওতেই হবে। যা এখন।”

আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পায় না পল। দরজার দিকে যেতে যেতে একটা প্রশ্নই ভাবল,
“কিন্তু বিয়েটা কার? বিয়েটা কার?”

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৭৩
Writer তানিয়া শেখ

রবিবার ম্যাক্সওয়েল পরিবারের সকলে এসেছে স্থানীয় চার্চে। ডান দিকের সারির প্রথমে প্রবীণ ম্যাক্সওয়েল বসেছেন। মাথায় পাতলা সাদা চুল, নাকটা ইগল পাখির ঠোঁটের ন্যায়, বয়সের ভারে ঝুলে যাওয়া ভুরুর কারণে চোখজোড়া ছোটো দেখাচ্ছে। তার মাঝের মণি নীল। ওতে নমনীয়তা নেই। তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আজ তিনি কালো রঙের শার্ট আর টাউজার পরেছেন। অন্যদিনের চাইতে আজ তাঁকে কম গম্ভীর লাগে। পাশে ছেলেরা বসেছে। পেছনে পুত্রবধূ ও দৌহিত্ররা।
দুই সিটের সারি পরে ইসাবেলা বসেছে৷ পাশে রেইনি, ওর কোলে তাশা। মস্কো এসে তাশার স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। বেশ কিছুদিন হলো ঘুমটাও ভালো হচ্ছে ওর। আগে মাঝরাতে ভয়ে চিৎকার করে উঠত। সমস্যাটা ইদানীং দেখা যাচ্ছে না। একা দুদন্ড ছাড়া যেত না ওকে। অবশ্য এখনও ছাড়া হয় না। রেইনি সবসময়ই ছায়ার মতো পাশে থাকে।
পাশের সারিতে মাতভেই তাতিয়ানা আর ভ্লাদিমি বসেছে। একটু পর কী একটা কারণে ভ্লাদিমি উঠে চার্চের বাইরে গেল। মাতভেই সেখানে বসে রেইনির কোল থেকে তাশাকে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এলোই না মেয়েটা ওর কাছে! এই অল্পদিনে পুরোপুরি রেইনিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ওকে ছাড়া এক মুহূর্ত তাশার চলে না। অতটুকু বাচ্চা মেয়ে রোজ নিয়ম করে তাশাকে ঘুম পাড়াবে, ঘুম থেকে উঠাবে, খাওয়াবে, গোসল করাবে আবার খেলে ওর মন ভুলাবে। বেশ চাপ পড়ছে রেইনির ওপর। শুকিয়ে গেছে শরীর। মাতভেইর মনে বেজায় মায়া। কারো কষ্ট ও দেখতে পারে না। রেইনি তো কত ছোটো! ওর কোল থেকে মেয়েকে নিতে চাচ্ছিল। রেইনি হয়তো বুঝতে পারে মাতভেইকে। ম্লান হেসে ইশারায় আশ্বস্ত করে, ওর কষ্ট হচ্ছে না। মাতভেই আশ্বস্ত হয় না। তাতিয়ানা এতক্ষণ দেখছিল সব। চাপা গলায় বলল,

“তুমি যতই চেষ্টা করো কাজ হবে না। এটাই এ বংশের নিয়ম। ওইটুকু মেয়ে বেশ ভালোভাবেই বুঝে গেছে।”

“নিয়ম?”

নিভৃতে হাঁপ ছাড়ে তাতিয়ানা।

“নিয়ম! সভ্য ভাষায় সেটাই বলা চলে। এ বংশের কিছু নিয়ম আছে মাতভেই। আধুনিক যুগে এসেও যার কতকটা বর্বরোচিত।”

“কী বলছো বুঝতে পারছি না।” বলল মাতভেই।

“সব এখন বলতে পারব না। শুধু জেনে রাখো, রেইনির ওপর মায়া দেখিয়ে ওর কষ্ট কমাতে পারবে না তুমি। যে কষ্ট সিলমোহর হিসেবে কপালে লেগে গেছে তা কমানো যায় না।”

মাতভেই এই হেঁয়ালি কথাগুলোও বুঝলো না। ওর মুখ দেখে তাতিয়ানা বলতে বাধ্য হলো।

“রেইনি ম্যাক্সওয়েলদের দাসী মাতভেই। ওর জীবনটা উৎসর্গ করেছে ম্যাক্সওয়েলদের নামে। আমৃত্যু মনিবের সেবা করা ওর ধর্ম। এই ধর্ম থেকে কেউ বিচ্যুত করতে পারবে না, তুমিও না।”

মাতভেই স্তম্ভিত। এইটুকু মেয়ে জীবন উৎসর্গের কী বোঝে? কে বুঝিয়েছে এসব ওকে? মাতভেইর দৃষ্টি থামে মার্কোভিকের পাশে বসা তিখনের দিকে। পাথরের মূর্তির মতো লাগছে আজ তাকে। আপন নাতনির জীবনকে কেউ এমন করে নষ্ট করতে পারে? তিখনের প্রতি শ্রদ্ধাটুকু আর রইল না।
তাতিয়ানা পাশ ফিরে তাকায়। তাশা হাত পা ছুঁড়ে খেলছে রেইনির কোলে বসে। ইসাবেলা মাথা ঝুলিয়ে ফিসফিস করে শিশুসুলভ ভাষায় গল্প করছে। খিলখিল করে হাসছে তাশা। রেইনি একদৃষ্টে ওকে হাসতে দেখছে। হাসি সংক্রমক। যে দেখে সেও হাসে। রেইনির হাসি তাশার মতো প্রানবন্ত নয়, নিষ্প্রাণ।

প্রার্থনা শেষে মার্কোভিক ফাদারের কুশলাদি জানতে গেলেন। বেশ সময় নিয়ে চার্চের ব্যাকইয়ার্ডে কথা বললেন দুজন। বাকিরা লনে অপেক্ষা করছে। রেইনির কোল ছেড়ে নেমে লনের সবুজ ঘাসে দৌড়ে বেড়াচ্ছে তাশা। চার্চে আগত শিশুদের কয়েকজন ওর সাথে খেলতে আগ্রহ দেখায়। তাশা একেবারে উপেক্ষা করছে ওদের। রেইনি ছাড়া আর কারো সাথে খেলবে না ও। ইসাবেলা দূরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে মুচকি হাসে। তাশা আর রেইনির অসম বন্ধুত্ব ভ্যালেরিয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। হাসি নিভে যায়। সামনের শূন্য গগনে চেয়ে থাকে। পাশে আন্না মেরিও ভাবিদের সাথে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলেরা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। মাতভেইর গম্ভীর মুখটা সরস করতে অপ্রয়োজনীয় কথা বলছে তাতিয়ানা। মাতভেইকে মন খারাপ করতে দেখলে কেন যেন মোটেও ভালো লাগে না। রেইনির ব্যাপারটা নিয়ে এত মাথা ঘামাবে জানলে বলতোই না।
একটু পর ফাদারকে সাথে করে মার্কোভিক সেখানে এলেন। মধ্য বয়সী ফাদারের পরনে সাদা ক্যাসক, মাথায় টাক। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা। একে একে পরিবারের সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে ইসাবেলাকে দেখিয়ে বললেন,

“এ হচ্ছে আমার ছোটো নাতনি, ইসাবেলা অ্যালেক্সিভ। ইসাবেলা, ইনি ফাদার কাজিমির।”

“হ্যালো ফাদার।”

“হ্যালো চাইল্ড। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। তোমার সম্পর্কে সব শুনেছি আমি। প্রভু তোমার সাথে ছিলেন বলেই এতবড়ো বিপদের হাত থেকে ফিরে এসেছ। ভ্যালেরিয়ার পরিণতির জন্য আমি মর্মাহত। ওর আত্মার শান্তি কামনা করছি।” বুকে ক্রস আঁকলেন ফাদার। ইসাবেলা আনতমুখে দাঁড়িয়ে রইল। মার্কোভিক বললেন,

“ওর জন্য ভালো পাত্রের সন্ধানে আছি আমরা ফাদার। আশির্বাদ করুন যেন শীঘ্রই সুযোগ্য পাত্র পেয়ে যাই।”

ইসাবেলার বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। চকিতে তাকায় নানার দিকে। মার্কোভিক আমলেও নিলো না সে চাহনি। ফাদার মুচকি হেসে মাথা আগে পিছে নাড়িয়ে হাত আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তুলে বললেন,

“আশীর্বাদ করি।”

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে মার্কোভিক ফাদারের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। চললেন বাড়ির পথে। ফাদারকে পাশ কাটিয়ে যেতে ইসাবেলাকে তিনি থামালেন।

“চাইল্ড, একটু দাঁড়াও।”

“জি, ফাদার?”

ফাদার একটু উশখুশ করে বললেন,

“সিস্টার ভ্যালেরিয়ার কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিল। ওর মৃতদেহ খুঁজে সেটা আমরা পাইনি। পরে শুনেছি ওর যাবতীয় জিনিসপত্র তোমাদের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে। তুমি কি জিনিসপত্র দেখেছিলে চাইল্ড?”

ইসাবেলার গলা শুকিয়ে এলো। চট করে মিথ্যা বলতে গিয়ে কথা জড়িয়ে যায়।

“না, না। আমি তো এ ব্যাপারে কিছু জানিই না।”

ফাদার ওর ফ্যাকাশে মুখ চেয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন,

“ওহ! আচ্ছা এসো তবে।”

হাওয়ার বেগে এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে খুশি হয় ইসাবেলা। ফাদার একদৃষ্টে ওর পথপানে চেয়ে রইলেন। বিড়বিড় করে বললেন,

“প্রভু তোমার মঙ্গল করুন। আমিন।” শেষবার বুকে ক্রস এঁকে চার্চে প্রবেশ করেন।

সারাপথ বুক ঢিপঢিপ করেছে ইসাবেলার। বিয়ের প্রসঙ্গ পর্যন্ত ভুলে গেছে ভয়ে। রুমে এসে দরজায় খিল দেয়। বিছানায় বসে পাশ রাখা গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি পান করে। এখনও ফাদারের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি স্মরণ করে শিউরে উঠছে। ওর কথাগুলো কী বিশ্বাসযোগ্য ছিল? সন্দেহ করেনি তো ফাদার? সন্দেহ করলেই বা কী। চিরকুটটা এখন আর ওর কাছে নেই। বিপদমুক্ত নিকোলাস। আস্তে আস্তে বিছানায় শুয়ে পড়ল ইসাবেলা। নিকোলাসকে নিয়ে ওর ভীষণ ভাবনা হয়। এত শত্রু ওর! মাঝেমাঝে ইসাবেলার মনে হয় নিকোলাস যদি সাধারণ মানুষের মতো হতো! এই ভয়টা তখন থাকত না। দুজনে মিলে ছোট্ট একটা সংসার গড়ে তুলতো পাহাড়ের ওপর। বিত্তবৈভব কখনোই চাইনি ইসাবেলা। কেবল প্রিয়জন সাথে থাকলে চলবে৷ তার হাত ধরে বহুপথ হাঁটবে। দেখবে সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়। কাঁধে মাথা রেখে জোছনা বিলাস করবে। নীল আকাশের নিচে বালুকাবেলার প্রবল বাতাসে দাঁড়িয়ে গাঢ় চুম্বনে সিক্ত করবে পরস্পরের ওষ্ঠদ্বয়। আরও কত ইচ্ছে জাগ্রত হয় ইসাবেলার মনে। কিন্তু সব ধূসর মলিনতায় ছেয়ে যায় অচিরেই। নিকোলাসের সূর্যাস্ত সহ্য হয় না। ও পুড়ে শেষ হয়ে যাবে সকালের সূর্যরশ্মিতে। এমন সূর্যোদয় ইসাবেলা দেখবে? কখনোই না। ইসাবেলার চোখজোড়া ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে এলো। নিকোলাসের সুদর্শন প্রেমময় অবয়ব স্মরণ করে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। পাষাণ বাস্তবতাকে কল্পনার মাধুরিতে ভুলে থাকাতেও সুখ। ইসাবেলার সেই সুখও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বাতাসে জানালার পাল্লার ঠুকাঠুকিতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ঘুম চোখে দেওয়াল ঘড়িতে চেয়ে দেখে রাত পৌনে বারোটা। এত রাত হলো কেউ ওকে ডেকে তুললো না! বিছানা ছেড়ে উঠে খোলা জানালার বাইরে তাকায়। অজস্র তারার মেলা বসেছে। মাঝের চাঁদটা আজ বড়ো উজ্জ্বল। ঘরময় সেই আলো লুটোপুটি খাচ্ছে। বাইরে বাতাস বইছে খুব। জানালার পাল্লা বার বার বাড়ি খাচ্ছে। ইসাবেলা উঠতে যাবে তখনই খেয়ালে এলো গায়ের কম্বলটা। বিকেলে ঘুমানোর সময় কম্বলটা পায়ের কাছে ছিল। দরজাও ভেতর থেকে দেওয়া। চোখজোড়া দপ করে জ্বলে ওঠে। হাসি ঝিলিক দেখা যায় ঠোঁটে।

“নিকোলাস।” তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে নামল। দাঁড়ায় জানালার পাশে। না, ও নেই। হতাশ মুখে ঘুরল। হতাশা মুহূর্তে আনন্দে রূপ নেয় সাইড টেবিলের ওপরে রাখা প্যাকেট দেখতে। কাছে গিয়ে প্রথমে প্যাকেটকা শুকলো। সমস্ত হৃদয় বিমোহিত হয়, দেহে কাঁপন ধরে এই সোঁদা মাটির গন্ধে। প্যাকেটটা খুলতে টকটকে লাল রঙের একটা অফ সোল্ডার, সিভলেস ফ্রক বেরিয়ে এলো। ম্যাচিং লাল রুবি পাথরের ইয়ারিং আর জুতোও ছিল। নিকোলাসের চয়েস মুগ্ধ করে ইসাবেলাকে৷ প্রিয়জনের দেওয়া প্রথম উপহার। এত আনন্দ হচ্ছে ইসাবেলার! ফ্রকের ভাঁজ থেকে বেরিয়ে এলো চিঠি,

“প্রিয়তমা,
আমার হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসা জানাই। বিশেষ কারণে আজ তোমাকে জাগালাম না। কষ্ট নিয়ো না লক্ষীটি, কথা দিচ্ছি কাল সব পুষিয়ে দেবো। দেখা হবে আগামীকাল রাতে। আরেকটি কথা, মা আর নোভা ছাড়া কারো জন্য কিছু কিনিনি আমি৷ এতকাল পরে তোমার জন্য কিছু কিনলাম। তুমি ঠিক বুঝবে না কতটা আনন্দ হচ্ছিল আমার। হয়তো বুঝবে৷ একমাত্র তুমিই তো বোঝো আমায়। তুমি আমার খুব আপন, বেলা। তোমাকে পৃথিবীর সমস্ত খুশি দিতে চাই। এটা তেমনই একটা ক্ষুদ্র চেষ্টা। ড্রেসটা দেখে মনে হয়েছে এটি কেবল তোমার জন্যই তৈরি। আমি একটিবার হলেও এই ড্রেসে তোমায় দেখতে চাই। সাথে তোমার খুশি। উপহার গ্রহণ করে ধন্য করো এই গরিবকে। গরিব? উঁহু! যার তুমি আছো সে গরিব হয় কী করে? তোমাকে পেয়ে নিকোলাস বিত্তেশ হয়েছে। যাইহোক আর কথা বাড়াচ্ছি না। বলে রাখি, যাওয়ার আগে তোমার ঠোঁট চুম্বন করেছি। ওটা আমার হক, হুম? ভালোবাসি বেলা।

ইতি
তোমার নিকোলাস”

চিঠিটাতে চুমু দিয়ে ইসাবেলা বলল,

“ভালোবাসি নিকোলাস।”

ফ্রকটা বুকে জড়িয়ে বিছানায় আবার শুয়ে পড়ে। আগামীকাল রাত আসতে এত দেরি কেন? এই রাত কেন ফুরায় না? কবে ঘুচবে সময়ের এই অপেক্ষা? আর যে বিচ্ছেদ সহ্য হয় না ইসাবেলার।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে