#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬৮
Writer তানিয়া শেখ
মহল কাঁপানো শব্দ করে রুমের দরজা খুলে যেতে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে নোভা। গভীর মনোযোগ দিয়ে জার্নাল লিখছিল। হাতে কলমটা এখনও রয়ে গেছে। মুখের চমকটা মুছে একরাশ ক্ষুব্ধতা প্রকাশ পেল। রাগে ফুঁসে উঠে বলল,
“এত দুঃসাহস তোমার! আমার কক্ষে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করো? এবং এমন অশিষ্টের মতো?”
পল অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলল,
“মাফ করবেন রাজকু_”
“তোমার জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলব ফের ওভাবে সম্বোধন করেছ যদি। বেরিয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে, বেরিয়ে যাও বলছি।”
পল একচুল নড়ল না দেখে নোভা ওর কলার চেপে ধরে। লম্বায় ও পলের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি ছোটো। ঝুঁকতে হয় পলকে। নোভার এই আচরণে বিস্মিত না হয়ে পারে না। আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। ওর হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হয়। মনে হয় এখনই হৃদপিণ্ড ফেটে যাবে। নোভার দৃষ্টির তাপে ভেতরটা শুকিয়ে আসে। চোখ নামাতে গেলে কলার ধরে রাখা মুষ্টির চাপ দৃঢ় হয়। আড়ষ্ট হয়ে আসা জিহ্বা বহু কষ্টে নড়ে।
“এ কী করছেন? ছাড়ুন আমাকে।”
পল বাঁচতে চায়। নোভা ছাড়লেই ও বাঁচবে। নয়তো লক্ষণ ভালো নয় বেশি। হঠাৎই নোভার রাগ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ সম্মোহনী হাসি৷ এই হাসির অর্থ পল বোঝে। চট করে চোখ বুজে ফেললো। কী চাইছে এই মেয়ে? পলকে এভাবে নাজেহাল না করলে কী চলছে না ওর? ওই’ই বা সেই সুযোগ দেয় কেন নোভাকে? পল নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে। তারপর ছাড়িয়ে নিতে চায় নোভার মুষ্টি থেকে শার্টের কলার। নোভা ছাড়ছেই না। পল আরও জোর দিতে নোভা ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দেয়। তারপর বিড়বিড় করে কিছু যেন বলে। পল নিজেকে সামলাতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে খেয়াল করে না।
“বেরিয়ে যাও। শীঘ্রই আমার সামনে আসবে না। যদি আসো তো তোমায় আমি শাস্তি দেবো। এমন শাস্তি যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। যাও।” আবার ওর গলা কর্কশ হয়ে উঠল। মুখটা কঠিন। পল মনে মনে ওর বলা কথায় বার বার ভাবে। শাস্তি দেবে! কেন পলকে ওর এত অপছন্দ? ওর কারণে পল বহুদিন কোনো নারীসঙ্গ উপভোগ করেনি। ওর কারণে পল কোনো মেয়েকে বিছানায় কামনা করতে পারে না। আর কী বাকি আছে যা করলে পলকে নোভার পছন্দ হবে? কী সেটা? কী? ভেতরে ভেতরে চাপা ক্ষোভে ফুঁসতে লাগল। পরক্ষণেই অবাক হলো নিজের প্রশ্নে। কবে থেকে নিজেকে নোভার পছন্দ অপছন্দের ছাঁচে ফেলতে শুরু করল ও? মন জবাব দিলো, অনেক আগে থেকেই। উপলব্ধি আজ হলো। চোখ তুলে দেখল একবার নোভাকে। বদরাগী, অহংকারী ডাইনি নয় আজ নোভা ওর চোখে। নোভা সুদর্শনা এবং খানিকটা অন্যরকম। যা হৃদয় তোলপাড় করে।
কবি সাহিত্যিক হলে পল ওকে হয়তো এই মুহূর্তে তুলনা করত, ভোরের শিশিরবিন্দু আবার গহীন অরণ্যে ফোটা ভীষণ সুগন্ধি মনোমুগ্ধকর এক জংলি ফুলের সাথে। এই জংলি ফুলকে পল ঘৃণা করে না, পছন্দ করে। তাই তো নিজেও চায় নোভার পছন্দ হতে। কিন্তু তা কী সম্ভব?
“এখনও যাওনি?”
নোভার কর্কশ গলা পলকে মলিন করে দেয়। নিজের প্রশ্নের জবাবে নিজেই যেন মনে মনে বলে,
“এই জনমে তোমার পছন্দ হয়ে ওঠা হবে না, জংলী ফুল। এই ভাবনা কেন যেন বিবশ করে তুলছে!”
“পল!”
“মনিব আপনাকে সাথে নিয়ে যেতে বলেছেন।” পলের নিস্পৃহ গলার স্বরে গাঢ় চোখে তাকায় নোভা। পল দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। কেন যেন নোভার দৃষ্টির তাপ অসহ্য হয়ে ওঠে। তখনই টেবিলের ওপরে রাখা নোভার জার্নালটাতে চোখ পড়ল। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করতে নোভা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি জার্নালটা বন্ধ করে ড্রয়ারে লুকিয়ে ফেললো। পল এবার ভুরু কুঁচকায়। এত দূরে দাঁড়িয়ে জার্নাল পড়া অসম্ভব ওর জন্য। নোভা কী বোঝেনি সেটা? না কি পল তাকাল বলে এমন করল। নোভা যে জার্নাল লেখে তা জেনেই অবাক হয় পল। কী লেখে ওতে? ওর মনের কথা, মনের মানুষের কথা? মনের মানুষ! নোভা কী কাওকে পছন্দ করে? পল অনুভব করল ঈর্ষার একটা সূক্ষ্ম সূচ ওর মনে বিধঁল। ও ড্রয়ারের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে দেখে ড্রয়ার শরীরে পেছনে আড়াল করে দাঁড়ায় নোভা। আঙুল চোখের সামনে ধরে বলল,
“আমার চোখ ওপরে পল।”
“ওই চোখেই তো তাকাতে ভয় করে আমার।” ওর বিড়বিড়ানি স্পষ্ট শুনতে পায় না নোভা। বিরক্তি ঝেড়ে বলে,
“কী বললে?”
মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“চলুন।”
“কোথায়?”
“মনিবের জলসা ঘরে।”
“তুমি যাও। আমি একটু পরে আসছি।”
“মনিব আমাকে আদেশ করেছেন আপনাকে সাথে নিতে যেতে।”
“যদি না যাই। জোর করবে?”
“আপনি ভালো করেই জানেন সেই দুঃসাহস আমার নেই।”
“কী করে জানব? বাড়ি কাঁপিয়ে আমার দরজা খোলার তো সাহস দেখিয়েছ আজ।” নোভা টেবিলের পাশ থেকে বিছানার দিকে হেঁটে এলো। পলের পিঠ ওর দিকে। পল বলল,
“ক্ষমা করবেন বেয়াদবির জন্য। আমি অনেকক্ষণ ধরে দরজায় কড়া নাড়ছিলাম। আপনি জার্নাল লেখায় এত মগ্ন ছিলেন যে টের পাননি।”
“তার জন্য ওমন করে দরজা খুলবে?” অভিযোগ করল নোভা। পল কী করে বোঝাবে এতবার কড়া নেড়ে ওর সাড়াশব্দ না পেয়ে চিন্তা হচ্ছিল। দরজাটাতে জোর সেই কারণেই পড়েছে।
“ভুল হয়েছে। আবারও ক্ষমা চাচ্ছি। এবার প্লিজ চলুন আমার সাথে।”
পলের এমন অনুনয়ে নোভা আর তর্ক করতে পারল না। দুজনে হেঁটে চললো কড়িডোর ধরে। নিকোলাসের জলসাঘর নিচতলার হলঘরের পুবের দিকে। পল আগে আগে হাঁটছে। নোভা পেছনে। পলের কেন মনে হচ্ছে নোভা ওর দিকে চেয়ে আছে? মনের কৌতূহল দমাতে না পেরে ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছনে ফিরল। নোভা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। হতাশ মুখে সামনে মুখ ঘুরায় পল। জলসা ঘরের কাছাকাছি আসতে উগ্র, অশ্লীল সংগীত শুনতে পায় নোভা। একটু যেন ধীর হয় ওর চলার গতি। সাথে পলেরও। জলসা ঘরের দরজার কাছে যেতে যে দৃশ্য দেখে তাতে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় নোভা। দশ বারোটা অর্ধ বসনা ডাইনি নিকোলাসের চারপাশে। নোভা এদের চেনে। কমিউনিটির পতিতালয়ে এদের বাস। আগে এই মহলে বেশ আসা-যাওয়া ছিল ওদের। না, আন্দ্রেই আনত না। আন্দ্রেই ক্যাসানোভা হলেও ওর কিছু নীতি আছে। নিজ মহলে কোনোদিন কোনো মেয়েকে আনেনি। পতিতাগুলো আসত নিকোলাসের জন্য। দৈহিক প্রয়োজনে খুব কম ডাইনিগুলোকে ব্যবহার করেছে। জলসাঘর বসতোই মূলত বিভিন্ন কুটনৈতিক প্রয়োজনে। গত এক বছর কিন্তু কোনো প্রয়োজনেই নিকোলাস জলসার আসর বসায়নি, ডাকেনি ওই কামুক ডাইনিগুলোকেও। কেন তার জবাবও নোভা জানে। ইসাবেলার কারণে। ওর ভালোবাসা বদলে দিয়েছিল নিকোলাসকে। কিন্তু আজ যেন সেই পুরোনো নিকোলাসকে দেখছে ও। আন্দ্রেইর ধারণা তবে ঠিক ছিল। নিকোলাস অবশেষে ভুলে গেছে ইসাবেলাকে! আন্দ্রেইর অপরাধ ঢাকতে সত্য গোপন করলেও মনে মনে ও চেয়েছিল নিকোলাসের মন থেকে ইসাবেলার প্রতি ভালোবাসা কোনোদিন না যাক। ভালোবাসা ওর দুর্বলতা না হোক, শক্তি হোক। আন্দ্রেইকে সাপোর্ট করলেও ওর মনোভাবকে কোনোদিন নোভা সাপোর্ট করে না। ভালোবাসার পক্ষে ও। তবে সেটা কেবলই মনে মনে। প্রকাশ্যে আনলে কমিউনিটির সকলে হাসবে৷ এমনিতেই তো সবার নজরে দুর্বল ও। আজ নিকোলাসকে এই রূপে দেখে খারাপ লাগল। রাগ হলো ওই ডাইনিগুলোর ওপর। একজন দরজায় দাঁড়ানো সুঠামদেহি পলের দিকে এগিয়ে এলো। গলা জড়িয়ে ধরল কাছে এসে। পল মানুষ হলেও এরা ওর ক্ষমতা জানে। নিকোলাসের ডান হাতের ক্ষতির চিন্তা ভুলেও করবে না। কিন্তু একটু আনন্দ উপভোগ তো দোষের না৷ ডাইনিটা ঠোঁট এগিয়ে আনতে পল নোভার দিকে তাকায়। রক্তচক্ষু নিয়ে ওদেরকেই দেখছে নোভা। এই আগুন দেখতে এত কেন ভালো লাগছে পলের? ডাইনি ঠোঁট বসিয়ে দেওয়ার আগেই ঠেলে ফেলে দিলো পল। মুহূর্তে ওটা দাঁত খিঁচিয়ে গালাগাল দিয়ে ওঠে। পল কিন্তু তখনও আড়চোখে নোভাকেই দেখছিল। নোভা সুন্দর। রাগলে আরও সুন্দর দেখায়। হাসল পল। পলকে গালাগাল দিয়ে ডাইনিটা সুরা হাতে নিকোলাসের পাশে বসল। নোভার দৃষ্টি ফের গেল ভাইয়ের দিকে। ওরই দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে নিকোলাস। কয়েকজন ডাইনি যেন গায়ে মিশে যেতে চাচ্ছে। নিকোলাসের সেদিকে কোনো হুঁশ নেই। আগের ডাইনিটা হাতের সুরাপাত্র একটু পর পর নিকোলাসের ঠোঁটের কাছে নেয়। ইচ্ছে করে পাত্রটা নাড়িয়ে দেয় যেন। সুরা নিকোলাসের থুতনি বেয়ে গলা দিয়ে নামতে নামতে অর্ধখোলা বুকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ডাইনিগুলো ঠোঁট নামিয়ে আনতে চায়। কিন্তু বাধা পায়। এক একটার চুলের মুঠি টেনে সরিয়ে দেয় নিকোলাস। বাধা পেয়ে রূপের আড়ালের হিংস্র পিশাচিনী হিসহিসিয়ে ওঠে। আবার শান্ত হয়ে কাছে আসে। লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয় নোভা। ভাইয়ের এই নির্লজ্জতা দেখে মনে মনে ভীষণ কষ্ট পায়। নোভার মনে পড়ে না পূর্বে কখনও এমন নির্লজ্জতা দেখিয়েছে ওর ভাই। মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে ওর?
“নোভালি, মাই ফাইয়ারক্রাকার। কাছে এসো।”
ছোটোবেলায় এই উপনামে ম্যাক্স বাবা ও নিকোলাস নোভাকে ডাকত। পিশাচ হওয়ার পর খুব কম ডেকেছে এই নামে। যতবার ডেকেছে আবেগতাড়িত হয়েছে নোভা। কিন্তু ওই ডাইনিগুলো ওর সকল আবেগ ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। রাগ প্রকাশে ভাই বোন কেউ কারো চেয়ে কম নয়। ভাইয়ের নির্লজ্জতাকে কটাক্ষ করে বলল,
“এখানে দাঁড়িয়েই বেশ দেখছি। বিশ্বাস করো বমির উদ্রেক হচ্ছে তোমাকে দেখে। আমাকে কি এই নোংরামি দেখানোর জন্যই এনেছ? এত অধঃপতন হয়েছে তোমার?”
“অধঃপতন? আহ! আমি আরও ভাবলাম মুভ অন করেছি দেখে খুশি হবে। এটাই তো চাচ্ছিলে তোমরা। বিশেষ করে তুমি এবং আন্দ্রেই। তাহলে রেগে যাচ্ছো কেন? খুশি হওনি ইসাবেলার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠেছি আমি?”
শেষ কথা নোভাকে চুপ করিয়ে দেয়। ভাইয়ের দিকে ভালো করে তাকায় এবার। নিকোলাসের ঠোঁটে সেই চেনা ক্রূর হাসি। ও কি কিছু টের পেয়েছে? গলা শুকিয়ে আসে নোভার। পল চুপচাপ ভাই-বোনকে দেখছে। মনিবকে ও খুব ভালো করে চেনে। যতই নীচ করুক বোনের সামনে এমন বেলেল্লাপনা করার মতে হীন কাজ আগে করেনি। আজ কেন করল তবে? সামনা সামনি এই প্রশ্ন করার সাহস পলের নেই। কিন্তু এটা জানে যে, কারণ ছাড়া এত নীচ কাজ ওর মনিব কোনোদিন করবে না। মনিবের গত কয়েকদিনের কর্মকান্ড ভাবতে লাগল। তাতে যদি কোনো ক্লু পাওয়া যেত। রাশিয়াতে ইসাবেলাকে জীবিত পাওয়া অপ্রত্যাশিত ছিল ওদের দুইজনের জন্য। ইসাবেলা নিজের বেঁচে থাকার যে ঘটনা বলেছিল পল শুনেছে। পুরোপুরি যে বিশ্বাস করেছে তা নয়। ইসাবেলা গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে না। সহজেই মিথ্যাটা ধরা যায়। নিকোলাস সেই মিথ্যার আড়ালের সত্যিটা জানতে উদগ্রীব। জার্মানি ফেরার পর পলকে নিষেধ করেছে ইসাবেলার ব্যাপারে মুখ খুলতে। তারপর ও যায় দাদোম এর কাছে। দাদোম এখানকার কালো জাদুর সম্রাজ্ঞী। নিকোলাসের সাথে ওর পুরোনো সখ্যতা। সেখানে গিয়ে দুজনের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে পল জানে না। ওই পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি ওর নেই। এখন হঠাৎ মনে হলো ইসাবেলার ওই মিথ্যার আড়ালে ঢাকা সত্যের সাথে নোভার কোনো সম্পর্ক নেই তো? উদ্বিগ্ন হয়ে তাকাল নোভার দিকে। নোভার স্নায়ুযুদ্ধ স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে ওর মুখে। পল এবার নিশ্চিত নোভা কিছু করেছে। ভীষণ চিন্তা হতে লাগল ওর জন্য।
“হু?” নিকোলাসের গলা শুনে দুজনেই চমকে তাকায়। উঠে দাঁড়িয়েছে নিকোলাস। এখনও দৃষ্টি নোভার দিকে স্থির। ওর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যেন বোনের সবটা পড়ে নিয়েছে। ডাইনিগুলোকে ইশারা করল রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে। ক্ষোভ নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা। নোভা বার বার ঢোক গিলছে। নিকোলাস বেশ স্বাভাবিক ছন্দে বোনের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর সারা গা দিয়ে মদের বিদঘুটে গন্ধ। নাক কুঁচকে ফেলে নোভা। মদকে ও ঘৃণা করে।
“খুশি হওনি ফায়ারক্রাকার?” আবারও বলল নিকোলাস। নোভা হাসার চেষ্টা করে বলল,
“তোমার খুশিতেই আমার খুশি।”
“আমার খুশিতেই তোমার খুশি?”
“হ্যাঁ।”
“মিথ্যা বলছ তুমি ফায়ারক্রাকার।” নিকোলাসের আকস্মিক গর্জনে কেঁপে ওঠে নোভা। পল করুণ চোখে তাকায়। কী করবে এখন ও? নিকোলাসকে শান্ত করা ওর পক্ষে অসম্ভব।
“আ…মি_”
নোভার তোতলানো বন্ধ হয় নিকোলাসের হিংস্র গর্জনে। ওর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে বলে,
“তুমি আমার খুশিতে কোনোদিন খুশি হওনি। দেখেছিলে না বেলাকে ছাড়া কেমন কষ্টে দিনাতিপাত করেছিলাম আমি? প্রতিনিয়ত মরেছি তোমাদের সামনে। আর তোমরা সব জেনেও দিনের পর দিন, মাসের পর মাস মিথ্যা বলেছ। কষ্ট, যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখেও সত্যিটা বলোনি। বলোনি আমার বেলা জীবিত। বলোনি ওকে আন্দ্রেই ভয় দেখিয়ে বাধ্য করেছে আমাকে ত্যাগ করতে। একটুও দয়া হয়নি আমাকে দেখে তোমাদের নোভা? একটুও করুণা হলো না? লোকে বলে আমার চেয়ে নির্মম পৃথিবীতে দুটো নেই। আমি তো দেখি তোমরা এখন আমাকেও ছাড়িয়ে গেছ। এই তুমি আমার বোন নোভালি? বোনেরা এমন করে আঘাত করে ভাইকে? তবে প্রয়োজন নেই তোমার মতো প্রতারক, মিথ্যাবাদী বোনকে আমার।”
নোভার ঠোঁট কাঁপতে লাগল। মাথা নুয়ে পড়েছে। কম্পিত গলায় উচ্চারণ করল,
“ভাই।”
“ভাই ডাকবে না।” চেঁচিয়ে ওঠে নিকোলাস। নোভা ওর সামনে হাঁটু ভেঙে বসে দুহাত জোড় করে বলে,
“আমাদের ভুল হয়েছে ভাই। ক্ষমা করো। আন্দ্রেইকে ক্ষমা করো ভাই। তোমাকে হারানোর ভয়ে ভুল করে বসেছে ও। শুরুতেই ব্যাপারটা জানলে ওকে আমি বাধা দিতাম। বিশ্বাস করো আমাকে। আমাদের অপরাধ মার্জনা করো।”
নিকোলাস ওকে উপেক্ষা করে সরে দাঁড়ায়। রাগে কাঁপছে রীতিমতো। পলকে বলল,
“ধরে নিয়ে আয় ওই প্রতারককে। ও আমার বিশ্বাস ভেঙেছে। আমাকে আঘাত করেছে। যার শাস্তি ওকে পেতেই হবে।”
চলবে,,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬৯
Writer তানিয়া শেখ
কাউকে বিশ্বাস করা নিকোলাসের পক্ষে সহজ ছিল না। তবুও আন্দ্রেইকে বিশ্বাস করেছিল। ইসাবেলাকে নিয়ে যা বলেছিল ছেলেমানুষী ভেবে গুরুত্ব দেয়নি তখন। কে জানত ওই জায়গাতেই ভুল করেছে নিকোলাস। আন্দ্রেই নিজেকে ঠিক দেখাতে এতটা নীচে নামতে পারল! ক্রোধের তীব্রতায় নিকোলাসের মস্তিষ্ক টগবগ করে ফুটছে। বহুবছর পরে আবার সেই প্রতারিত হওয়ার অনুভূতি ফিরে এলো। আপনজনের প্রতারণা বড্ড দুঃসহ। বিশ্বাস হারিয়ে গেলে সেখানে সকল সম্পর্ক অর্থহীন। নোভার অপরাধ আন্দ্রেইর চেয়ে নগন্য হলেও নিকোলাস বোনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। রাগই ওর বড়ো শত্রু। রাগ ওকে বিধ্বংসী করে তোলে। আপন পরের হিসেব তখন আর থাকে না। চিৎকার করে জানিয়েছে আর কোনোদিন আন্দ্রেইর মুখ দেখবে না। আন্দ্রেইকে ও ক্ষমা করবে না। কমিউনিটির নিয়ম অনুযায়ী প্রতারণার শাস্তি মৃত্যুদন্ড অথবা নির্বাসন। রাজা ছাড়া কেউ এই শাস্তির উর্ধ্বে নয়। সুতরাং নোভা এবং আন্দ্রেইকে শাস্তি দেওয়ার জন্য মিটিং বসল। যেহেতু নিকোলাস আন্দ্রেইর মুখ দেখবে না বলে জানিয়েছে তাই ওকে পাশের কক্ষে বসতে হয়েছে।
ভাই ওর মুখ দেখবে না। এ সেই ভাই যার কারণে আন্দ্রেই পিশাচ হতে দু’বার ভাবেনি। যাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে যার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছিল। ইসাবেলাকে নিকোলাসের থেকে দূর করতে চেয়েছে নিকোলাসের ভালোর জন্য। এই ভালো করতে গিয়ে খারাপ বনে গেছে ও। বিশ্বাস ভেঙেছে ভাইয়ের। মানুষ আর পিশাচে মাঝে কি কোনো সম্পর্ক হয়? হয়, শত্রু শত্রু সম্পর্ক হয়। ইসাবেলা শত্রু বংশের কন্যা। কী করে বিশ্বাস করবে ওকে আন্দ্রেই? সেই শত্রুর বংশের মেয়ের জন্য আজ কি না ভাইকে ত্যাগ করতে দু’বার ভাবল না নিকোলাস! পাগলের মতো নিঃশব্দে হাসল আন্দ্রেই।
“ঠিক হয়েছে। খুব ভাই ভাই করেছিলি না? দ্যাখ, এবার। দ্যাখ, তোর সেই ভাই আজ তোকে কত সহজে ত্যাগ করল। ওই শয়তানটার জন্য কত কী করেছিস! বিনিময়ে কিছু পেয়েছিস তুই? ওর ভালো করতে গিয়ে আজ শেষ হতে যাচ্ছিস আন্দ্রেই।” পাশে বসে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন সোফিয়া। মানুষ হলে এখন তিনি কেঁদেকেটে অস্থির হতেন। কাঁদতে পারছেন না বলেই রাগটা আরও বাড়ছে। আন্দ্রেই বিরক্ত হয়ে বলল,
“কানের কাছে ঘ্যানঘ্যানানি বন্ধ করো।”
“আমি কিছু বললেই ঘ্যানঘ্যানানি, না? মায়ের কষ্ট তুই কি বুঝবি?”
আন্দ্রেই শব্দ করে হেসে ওঠে।
“মায়ের কষ্ট! বাহ! শুনতে ভালোই লাগল।” হাসি থামিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“এই কষ্ট কোথায় ছিল যখন দুধের শিশুকে দিনের পর দিন দাসীর কাছে ছেড়ে দিয়েছিলে? তুমি জানো ক্ষুধা- তৃষ্ণায় আমি যখন মা মা করে চিৎকার করতাম ওই দাসিগুলো কী করত? জানো না। কী করে জানবে? কখনো তো বলিইনি তোমাকে। আজ বলব কারণ তুমি আমাকে মায়ের কষ্ট বুঝাতে চাইছ না? আজ তোমাকে আমি সন্তানের কষ্ট বুঝাব। দাসীরা আমার কান্না থামাতে ব্যর্থ হয়ে মুখে কাপড় গুঁজে দিতো। তাতেও না থামলে মুখের ওপর বালিশ চেপে ধরেছে। শ্বাস নেওয়ার জন্য হাত পা ছুঁড়তাম আমি। ওই দৃশ্য ওদের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠল। অবুঝ আমি। তোমাকে দেখে চোখের পানিতে সেসবই বলতে চাইতাম। মায়েরা না কি সন্তান না বলতেই সব বোঝে। আমি তোমায় কত ইঙ্গিত দিলাম তুমি তবুও বুঝলে না। দাসীদের কড়া সুরে আদেশ দিলে তোমার ছেলে যেন এক মুহূর্তের জন্যও না কাঁদে৷ ওরা সত্যি এবার আমার কান্না বন্ধ করল। কীভাবে শুনবে? আফিম খাইয়ে। এবার তুমি খুশি হলে। তোমার ছিঁচকাঁদুনে ছেলেটা হঠাৎ ঝিম মেরে গেল বলে খানিক অবাকও হলে। কিন্তু এর বেশি বুঝতে যাওয়ার সময় কোথায় তোমার? স্বামীকে দখল করতে হবে তো! তাঁর মন আবার প্রথম স্ত্রীর প্রতি দুর্বল। পাছে তোমাকে ছেড়ে দেয়! সেই ভয়ে সারাক্ষণ স্বামীর সাথে ছায়ার মতো থাকো। তাঁর মনকে বশ করার চেষ্টায় তুমি আমাকে একেবারে ভুলে গেলে। মায়ের একটু ভালোবাসা, একটু মমতার পরশের জন্য ছটফট করে কেটেছে আমার শৈশব। কোথায় ছিলে তখন তুমি মা? মা! হ্যাঁ, এই শব্দে আমি সেদিনও ভীত কণ্ঠে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি, যেদিন ওই দাসীদের একজন আমায় শরীরের নিচে দলিতমথিত করেছে। তুমি আসোনি মা। কতরাত সেই কষ্ট থেকে বাঁচতে তোমায় ডেকেছি। তুমি শুনতে পাওনি। আমার কষ্ট দূর করতেও আসোনি। আর তুমি কি না বলছ আমি তোমার কষ্ট বুঝি না।”
“চুপ করো। চুপ করো।” সোফিয়া কানে হাত দিয়ে বলে ওঠেন। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। সোফিয়া ভালো প্রেমিকা হয়েছেন, স্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু ভালো মা হয়ে ওঠা হয়নি তাঁর। সন্তান জন্ম দিলেই মেয়েলোক মা হয়ে ওঠে না। মা হতে মমতা লাগে, টান লাগে। সোফিয়ার তা ছিল না তখন। অল্প বয়সে মা হয়েছেন নিতান্ত অনিচ্ছায়।আন্দ্রেইকে তিনি পেটে ধরেছিলেন রিচার্ডের সাথে সম্পর্ক শক্ত করতে। করেওছেন সেটা। বাবা হিসেবে রিচার্ড মোটেও দায়িত্বশীল, যত্নশীল নন। আন্দ্রেইর প্রতি তেমন টান তাঁর ছিল না। ওর কারণেই সোফিয়াকে না চাইতেও বিয়ে করতে হয়েছে। মনে মনে বিরাগ ছিল তাই আন্দ্রেইর প্রতি। এই বিরাগে ছেলেকে কাছে টানেননি। সোফিয়ার সেদিকে কোনো খেয়াল ছিল না। নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে ধরে রাখতে গিয়ে পৃথিবীর সব উপেক্ষা করেছেন। একমাত্র সন্তানকেও। এই উপেক্ষার পরিণাম এত ভয়াবহ হবে সোফিয়ার কল্পনাতীত ছিল। নিজেকে এখন পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মা মনে হচ্ছে। মায়েরা নিঃস্বার্থ হয়, তিনি স্বার্থপর। মায়েরা মমতাময়ী হয়, তিনি পাষাণ। তবুও আন্দ্রেই তাঁকে মা ডাকে৷ তবুও তিনি মা। মা হয়ে তিনি সন্তানকে আগলে রাখতে পারেননি। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়।
আন্দ্রেই চুপ করে হয়ে গেল। দুচোখ বন্ধ করে। চোখের সামনে বাল্যকালের দুঃসহ স্মৃতি ভেসে ওঠে। শক্ত হয়ে আসে দেহটা।
নিকোলাসের রাজদরবারে পিশাচ কমিউনিটির উচ্চপর্যায়ের সকল সদস্য উপস্থিত। গম্ভীর মুখে আন্দ্রেই ও নোভার শাস্তি নির্ধারণ নিয়ে কয়েকজন আলাপ করছেন। রিচার্ড এককোণে বসে চুপচাপ দেখছেন, শুনছেন। মৃত্যু অথবা নির্বাসন। শব্দ দুটো তাঁকে পৈশাচিক আনন্দ এনে দিচ্ছে। বাবা হিসেবে এমন আনন্দিত হওয়া ঠিক না। ভেতরের পৈশাচিক আনন্দ একটু যেন ফিকে হলো। ভালো-মন্দের পার্থক্যবোধ এখনও একেবারে ধুয়েমুছে যায়নি। কিন্তু যখনই সামনের সিংহাসনের দিকে তাকান ওই পার্থক্যবোধটুকু লাথি মেরে সরিয়ে দেন। লোভে চকচক করে ওঠে চোখদুটো। অতীত সোনালি দিন স্মরণ হয়। কত প্রতাপ, প্রতিপত্তিশালী ছিলেন। এতদিন সিংহাসনে থাকলে অর্ধেক পৃথিবীর শাসন হাতের মুঠোয় চলে আসতো। এই অপ্রাপ্তি, ক্ষমতাশূনতার কারণ ওই নিকোলাস আর আন্দ্রেই। নোভাও ভাইদের দলেই ছিল। বহু বছর ওরা তাঁকে বন্দি করে রেখেছিল। সেই সব কষ্টের দিনগুলো আরও প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। বাবা নন তিনি। এরা বাবা বলে মেনেইছে বা কবে! এরা কেবল তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী। একে একে যাদের পরাজিত করবেন।ক্ষমতারলোভ তাঁকে বিবেকহীন, বিকারগ্রস্ত করে। রিচার্ডের দৃষ্টি স্থির নিকোলাসের দিকে। থমথমে মুখে অন্যমনস্ক হয়ে সিংহাসনে বসে আছে ও। আপনজনের কাছে ফের একবার প্রতারিত হয়েছে। এবারও এর পেছনে কলকাঠি রিচার্ডই নেড়েছেন৷ একমাত্র তাঁরই তো জানা ওর দুর্বলতা।
সিংহাসনে সিংহের মতো বসে থাকলেও আজ ওর মনটা বিষণ্ণ, ভগ্ন। ভাই-বোন ওর সবচেয়ে কাছের। সেই কাছের দুজনকে হারাবে আজ ও। ওরা সরলে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহজ হবে রিচার্ডের। আর এই জন্য আন্দ্রেইর মৃত্যু অথবা নির্বাসন যে কোনো একটি ভীষণ দরকার। সিদ্ধান্ত নিতে এরা এত দেরি করছে কেন? রিচার্ড অধৈর্য হয়ে ওঠেন। সেই সময়ই সামনে বসা একজন মধ্য বয়সী দীর্ঘ বলিষ্ঠদেহি লোক দাঁড়িয়ে গেলেন। জাতিতে কৃষ্ণবর্ণের আফ্রিকান। হিংস্র ও কপট তাঁর চাহনি। নিকোলাসকে অভিবাদন জানিয়ে নির্মম কণ্ঠে বললেন,
“বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ক্ষমা নেই। আজ আপনার সাথে করেছে কাল কমিউনিটির সাথে করবে। আমরা সকলে নিজেদের কসম খেয়ে ওয়াদা করেছিলাম রাজার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব। এর অন্যথা হলে মৃত্যু মাথা পেতে নেবো। যে ভাবেই হোক আন্দ্রেই ও নোভালি ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। এর শাস্তিও ওদের পাওনা। তাই সবদিক বিবেচনা করে আমি এবং কমিউনিটির আরও বিশজন আন্দ্রেইর মৃত্যুদন্ড কামনা করছি। আর নোভার নির্বাসন। বাকিটা মহামান্য রাজার যা ইচ্ছে হয়।”
লোকটা আড়চোখে রিচার্ডকে দেখলেন। ক্ষীণ হাসি দেখা গেল তাঁর ঠোঁটে। কারও চোখে পড়ার আগেই মাথা নুয়ে অভিবাদনের ভঙ্গি করে বসলেন নিজ আসনে। দরবারে ফিসফাস শুরু হলো। আরও অনেকে সম্মতি জানায় লোকটার কথাতে। নিকোলাসের দমবন্ধ হয়ে আসছে এদের মাঝে। এই সিংহাসন কাঁটার মতো বিঁধছে সারা দেহে।
দরবারে ফিসফাস বন্ধ হয় একজন বয়োজ্যেষ্ঠের গলা ঝাড়ার শব্দে। কাঁচা পাকা চুল, ঠোঁটের ওপর পুরু গোঁফ, বুকসমান কাঁচা পাকা দাড়ি ও পরনে লম্বা কোট তাঁর। লোকটির চোখ-মুখে বিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট। কোনো এক কারণে আন্দ্রেইকে তিনি বিশেষ স্নেহ করেন। সেই স্নেহের টানে চুপ করে থাকতে পারলেন না। নিকোলাসকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন,
“একপাক্ষিকভাবে শাস্তি দেওয়াটা এই কমিউনিটির নিয়ম বহির্ভূত। অপরাধীর আসনে যে বসে আছে তার কথাও আমাদের শুনতে হবে। তার দিক_”
বয়োজ্যেষ্ঠকে থামিয়ে দেয় আন্দ্রেই,
“পিয়েতর গুসেভ, আমি আমার অপরাধ অকপটে স্বীকার করছি। কিন্তু নোভাকে শাস্তি না দেওয়া হোক। ওই বেচারি নির্দোষ। ও যখন সত্যিটা জেনেছে তখন ভাই রাশিয়া ভ্রমণে রওয়ানা হয়েছিল। নয়তো ও বলত। সুতরাং যা মিথ্যা আমি বলেছি। দোষ একা আমার।”
“আন্দ্রেই!” পিয়তর গুসেভ ও নোভা ওকে বাধা দিতে গেলে আন্দ্রেই বলে,
“আমাকে বলতে দিন। আমি স্বীকার করছি ভাইকে আমি মিথ্যা বলেছি, ধোঁকা দিয়েছি, আঘাতও করেছি।” বড়সড় ঢোক গিললো আন্দ্রেই। তারপর বলল,
“এর জন্য যে শাস্তি প্রাপ্য আমি মাথা পেতে নেবো। কিন্তু এই কথাও সেই সাথে বলব, ওই মেয়ের সাথে যা করেছি তাতে আমি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই। আমি এখনও বলছি, ইসাবেলাকে আমি আমার ভাইয়ের সঙ্গী হিসেবে মানি না, মানবো না।”
“হু দ্য হেল আর ইউ?” গর্জে ওঠে নিকোলাস,
“ইসাবেলাকে আমার সঙ্গী হিসেবে মানা না মানার তুই কে? কেউ না তুই আমার আন্দ্রেই, কেউ না।”
“ভাই বলে অস্বীকার করছ তবে?”
“হ্যাঁ, করছি।”
আন্দ্রেইর গলায় যেন ভীষণভাবে কিছু বিঁধে গেল। তড়িৎ গতিতে এসে দাঁড়ায় নিকোলাসের সিংহাসনের সামনে। ইসাবেলা ওকে বলেছিল, “আমার সাথে যা করছ সেটা প্রকাশ পেলে ভাইয়ের মুখোমুখি হতে পারবে?” আন্দ্রেই সামনে তো এসে দাঁড়িয়েছে কিন্তু চোখে চোখ রাখতে পারছে না। ওই চোখে আন্দ্রেইর জন্য কোনো মায়া নেই, আছে শুধু অসন্তোষ। কতটা অপ্রিয় হলে কেউ সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারে!
নিকোলাস লড়ছে নিজের ক্রোধের নিজে। ক্ষমা মহৎ গুন। কিন্তু আফসোস নিকোলাস মহৎ নয়। আন্দ্রেইর মুখ না দেখে যে কথাটা বলেছে। সেই একই কথা এখন আর বলতে পারবে না। জিজ্ঞেস করুক কেউ ওকে? নিকোলাস অন্যদিকে তাকিয়ে রাগত গলায় বলল,
“আমি তোর মুখ দেখতে চাই না আন্দ্রেই। সরে যা আমার দৃষ্টির সামনে থেকে।”
আন্দ্রেই সরে না। বজ্রহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। ভাইকে ও ভীষণ ভালোবাসে। আর সেই ভাই মুখ ফিরিয়ে নিলো। অস্বীকার করল। ভালোবাসা! আবার সেই শব্দ। এই শব্দের কারণে আজ ওর এত কষ্ট, এত দুর্গতি। যে ভালোবাসে সে সেই মানুষটিকে আগলে রাখতে চায় সকল বিপদ থেকে। আন্দ্রেইও তাই চেয়েছিল। ভাই ওকে ভুল বুঝল। পর করে দিলো ওই মেয়েটার কারণে। ঘৃণা করে ইসাবেলাকে আন্দ্রেই। প্রচন্ড ঘৃণা করে।
“আমি মৃত্যু চাই।”
আন্দ্রেই নিস্পৃহ গলায় বলল। নিকোলাস চকিতে তাকায়। জ্বলন্ত চোখে বলল,
“অপরাধীর শাস্তি নির্ধারণ করার ক্ষমতা অপরাধী রাখে না।”
“কিন্তু শেষ ইচ্ছে তো রাখা হয়। এটাই আমার শেষ ইচ্ছা। আমি মৃত্যু চাই। শেষ করে দেওয়া হোক আমাকে।” চিৎকার করে বলল আন্দ্রেই। নিকোলাস শক্ত করে সিংহাসন ধরে আছে। গর্জন করে বলল,
“কমিউনিটির বিচারবিভাগকে অবমাননা করছিস তুই আন্দ্রেই।”
“তাহলে আরেকটা শাস্তি পাওনা হলো। আরও শাস্তি দাও। কিন্তু মৃত্যুর চেয়ে বড়ো শাস্তি আর কী হতে পারে ভাই। ওহ! তুমি তো এখন আর আমার ভাই নও। রাজা নিকোলাস। আপনাকে কুর্নিশ রাজা নিকোলাস।”
নতমাথায় শ্লেষোক্তি করতে নিকোলাস হুঙ্কার দিয়ে ওঠে,
“প্রহরী নিয়ে যাও এই বেয়াদবটাকে আমার চোখের সামনে থেকে।”
প্রহরীরা এগোতে এলেই রক্তচক্ষু নিয়ে ওদের দিকে তাকায় আন্দ্রেই। ঠোঁটের দু’পাশে শ্বদন্ত বেরিয়ে এসেছে।
“তুমি আমার সামনে ওদের ভয় দেখাতে পারো না আন্দ্রেই।”
“এখন আমি সব পারি রাজা নিকোলাস।”
একজন প্রহরী এগিয়ে আসতে আন্দ্রেই ওকে মেরে হাঁটুর ওপর বসিয়ে পেছন থেকে একটানে শিরশ্ছেদ করে।
“আন্দ্রেই!” নিষেধ করে নোভা, সোফিয়া ও পিয়েতর। আন্দ্রেই সেদিকে কর্ণপাতও করে না। প্রহরীরা ঘিরে ধরল ওকে। উপস্থির সদস্যদের কয়েকজন সমস্বরে বলে ওঠে।
“রাজদ্রোহ, ঘোর রাজদ্রোহ।”
হট্টগোল লেগে যায় দরবারে। নিকোলাস সিংহাসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। গলা চড়িয়ে আদেশ করল,
“আত্মসমর্পণ করো আন্দ্রেই। এটা আমার আদেশ।”
আন্দ্রেই ভাইয়ের আদেশ অমান্য করে কী করে! আত্মসমর্পণ করল। প্রহরীরা জোর করে হাঁটুর ওপর বসায়। আন্দ্রেইকে জোর করা এই মুহূর্তে খুব সহজ। রিচার্ডের উস্কানিতে পিশাচ সদস্যেরা আন্দ্রেইর এহেন আচরণকে রাজদ্রোহ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে। শাস্তি চায় ওর। এই প্রথম দিশেহারা হয়ে পড়ল সিংহাসনে বসে নিকোলাস। সদস্যরা চাপ দিতে লাগল আন্দ্রেইর মৃত্যুদন্ডের। একজন দুইজন এমন করে পঞ্চাশজন।
“রাজদ্রোহী, প্রতারকের শাস্তি চাই। মৃত্যুদন্ড, মৃত্যুদন্ড।” একসাথে চেঁচিয়ে ওঠে পিশাচেরা। আন্দ্রেইর পক্ষে যারা তারা আজ নিতান্ত কম। কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। রা নেই ওদের মুখে। আন্দ্রেইর বিপক্ষ শক্তির চাপ বাড়তে লাগল ক্রমশ নিকোলাসের ওপর। ক্ষিপ্ত, ক্রোধিত নিকোলাস বজ্র কণ্ঠে বলে ওঠে,
“থামো সবাই।”
মুহূর্তে নিস্তব্ধ দরবারে। নিকোলাস গভীর শ্বাস নিয়ে আন্দ্রেইর দিকে তাকায়। ভাবলেশহীন মুখে চেয়ে আছে আন্দ্রেই। নিকোলাস ওর দিকে দৃষ্টি অনড় রেখে বলল,
“আন্দ্রেইকে নির্বাসিত করার হুকুম জারি করলাম আমি। ট্রিয়েরের দুর্গম জঙ্গলের গুহাতে ফেলে আসা হোক ওকে।”
বলামাত্রই উঠে দাঁড়াল নিকোলাস। দরবারের সবার দিকে চেয়ে বলল,
“আমার হুকুমের বিপক্ষে কে আছে এখানে?”
উপস্থিত সকলে মাথা নত করে জানিয়ে দেয় নিকোলাসের হুকুমের পক্ষে তারা। ট্রিয়ের দুর্গম জঙ্গল মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। রিচার্ড যেন মনে মনে দারুন খুশি হলেন। সোফিয়া ও নোভা করুণ চোখে আন্দ্রেইর দিকে চেয়ে রইল। আন্দ্রেই নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। বিদায়কালে একবার ফিরে দেখুক ওকে ভাই! একবার! নিকোলাস ফিরেও ওকে আর দেখল না। হনহন করে বেরিয়ে গেল দরবার ছেড়ে। পেছনে দাঁড়িয়ে সেই পথে চেয়ে আন্দ্রেই হাসল। বড়ো কষ্টের সেই হাসি। বিড়বিড় করে বলল,
“বিদায় ভাই, বিদায়।”
চলবে,,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৭০
Writer তানিয়া শেখ
তিনতলার একেবারে পুবদিকে ইসাবেলার নানা মার্কোভিক ম্যাক্সওয়েলের স্টাডি রুমটা।
সোজাসুজি কড়িডোর ধরে দু পা সামনে এগোলে শেষ প্রান্তের জানালাটা চোখে পড়ে। তুষার জমে সাদা আস্তরণ পড়েছে তাতে। বাইরের তীব্র ঠাণ্ডা বাড়ির ভেতরে এসে মিইয়ে গেছে ফায়ারপ্লেসের আগুনের তাপে। তাপ এমন নয় যে গায়ে ঘাম ছোটে। তবুও ইসাবেলা ঘামছে। এর কারণ ওর মনের ভীতি। নানা মার্কোভিকের স্টাডি রুমে আসার অনুমতি সকলের নেই। ইসাবেলা এসেছ নেহাৎ নিরুপায় হয়ে।কোনোভাবে যদি ধরা পড়ে যায় তবে আর রক্ষে নেই৷ কেন এখানে এসেছে? প্রয়োজন কী? আরও কত প্রশ্ন! ইসাবেলাকে সকলে স্নেহ করে ও ভালোবাসে। পরিবার এবং বংশে ভালো মেয়ে বলতে যা বোঝায় সবটাই ওর আছে। আজ ধরা পড়লে সবাই বাঁকা চোখে তাকাবে। যারা সোজা চাহনীতে অভ্যস্ত তাদের আবার বাঁকা নজর অসহ্যের ও অসম্মানের। দরজা খোলার আগে কড়িডোরের রেলিং ধরে সাবধানে নিচে তাকাল। হলঘরে এই মুহূর্তে পার্টি চলছে। তাতিয়ানা আর মাতভেইর বাগদানের পার্টি। তাতিয়ানা যে এত সহজে বাগদানে মত দেবে ইসাবেলার কল্পনাতীত ছিল। অবাক হয়েছে বাকিরাও। স্থায়ী সম্পর্কে বরাবরই অনাসক্তি দেখিয়ে এসেছে। এই ক মাসে মাতভেইর সাথে সম্পর্কের উন্নতি হলেও বিয়েতে রাজি ছিল না। কয়েকদিন আগে নানা মার্কোভিক ওকে স্টাডি রুমে ডেকে নেয়। দুজনের মধ্যে কী কথা হয়েছে এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে মার্কোভিক ঘোষণা করল আজ ওদের বাগদান হবে। তাতিয়ানাও জানালো এতে ওর অমত নেই। খুশি তো সবাই হয়েছিল। তবে মাতভেইর খুশি অন্তরিক্ষে পৌঁছায় যেন।
যুদ্ধের কারণে পার্টিটা জমে ওঠেনি। সকলেই এই যুদ্ধ নিয়ে চিন্তিত। হিটলারের সৈন্যরা ক্রমশ মস্কোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ওদেরকে রুখতে শুধু এদেশের সরকার বাধা হয়নি, আবহাওয়াও বৈরিরূপ দেখাচ্ছে। মার্কোভিক সহ বাড়ির পুরুষেরা দেশের ভবিষ্যত নিয়ে আলাপে মগ্ন। ইসাবেলা সেই সুযোগে সবার অলক্ষ্যে ওপরে চলে এসেছে। কড়িডোরের রেলিং ছেড়ে স্টাডি রুমের দরজার সামনে দাঁড়ায়। লম্বা শ্বাস নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। নিকষ কালো অন্ধকারে আবদ্ধ রুমটা। আসার সময় মনে করে একটা মোম আর দিয়াশলাই এনেছিল ইসাবেলা। এখন সেটা কাজে লাগল। এই রুমে আগে আসেনি ও। বিশাল বড়ো বুক সেলফ ভর্তি হাজার হাজার বইয়ের দিকে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইল। এত বই একসাথে পূর্বে দেখেনি। এই রুমটা বেশ পরিপাটি করে গুছানো৷ এই দায়িত্বটা পালন করে এ বাড়ির পুরাতন ও বিশ্বস্ত ভৃত্যা তিখন কারাতে। চারপাশে তাকিয়ে তিখনের কাজের প্রশংসা আপনাআপনিই করল ইসাবেলা। প্রৌঢ়া এই বয়সেও কী নিখুঁত কাজ করে! রুমের মাঝামাঝি লম্বা স্টাডি টেবিলটা। তার সাথে লাগোয়া তিনটে চেয়ার। একটা মার্কোভিক ম্যাক্সওয়েল পেট্রবের এবং বিপরীতের দুটো অতিথিদের জন্য। বাতিদান খুঁজে আলো জ্বেলে নিলো ইসাবেলা। তারপর যে কাজে এসেছিল তাই শুরু করে। ড্রয়ার, টেবিলের কাগজ খুঁজে হতাশ হতে হলো ওকে। শেষ আশা সামনের বিশাল বড়ো বুক সেলফ। এত বইয়ের মাঝে কাঙ্ক্ষিত বইটি খুঁজে পাওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ইসাবেলার হাতে সময় কম। কী করবে তাই যখন ভাবছিল তখনই সোঁদা মাটির সেই হৃদয় ব্যাকুল করা গন্ধটা নাকে এলো। চকিতে ঘুরে তাকাল বাম দিকে। বাতিদানের মৃদু আলোয় নিকোলাসের মুখটা অপার্থিব লাগছে। ঠোঁটের কোণে সেই হৃদয় কাঁপানো হাসি। দু’হাত মেলে দিতে ওর বুকে আছরে পড়ল ইসাবেলা।
“নিকোলাস, আমার নিকোলাস।” কাঁধ জড়িয়ে মিশে যেতে চাইল ওর ভেতর ইসাবেলা। আনন্দের আতিশয্যে কাঁদল। নিকোলাস বাহুবন্ধন শক্ত করে। ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দেয়। ইসাবেলা তাতে সাড়া দিয়ে স্বাগত জানায় প্রিয়তমকে। এক সপ্তাহের বিরহ যেন পরস্পরকে এভাবে আঁকড়ে ভুলতে চায় ওরা। কিছু সময় পর দুজনই শান্ত হয়। ইসাবেলার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দই তখন কেবল প্রতিধ্বনিত হয় দেওয়ালে দেওয়ালে। নিকোলাস বাহুবন্ধন সামান্য ঢিলে করতে মেঝেতে পা রাখে ইসাবেলা। ওর ফ্রকের ভেতর থেকে এক টুকরো সাদা কাগজ মেঝেতে পড়ে৷ কালো মেঝেতে সহজে সেটা নিকোলাসের নজরে এলো।
“ওটা কী?” জিজ্ঞেস করল ইসাবেলাকে। জবাবের অপেক্ষা না করেই ঝুঁকে হাতে তুলে নিলো। ঘাবড়ে যায় ইসাবেলা। পাছে কাগজটা দেখে ভুল বোঝে ওকে! কাগজটা হাতে নিয়ে মুখ তুলে আবার ইসাবেলাকে দেখল নিকোলাস। ওর ঘাবড়ে যাওয়াটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে মুখে। কী লুকাচ্ছে আবার ও?
“বেলা!” কড়া সুরে ডাকল নিকোলাস। ইসাবেলা ভীত চোখে কাগজটার দিকে চেয়ে বলল,
“কথা দাও অবিশ্বাস করবে না।”
“কোনোদিন না।”
ইসাবেলা চোখ তুললো। নিকোলাসের স্থির চোখজোড়া ওর কথার সত্যতা নিশ্চিত করে। কিছু বলবে তখনই দরজার ওপাশে জুতার খটাখট শব্দ শুনে ভীত হয়ে ওঠে। নিকোলাস হাত চেপে ধরে আতঙ্কিত গলায় বলে,
“এখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে চলো আমায়। তাড়াতাড়ি।”
নিকোলাসের প্রশ্নাত্মক চাহনি দেখে বলল,
“সব বলব আমি। এই মুহূর্তে এখান থেকে নিয়ে চলো আমাকে। প্লিজ!” কাতর শোনাল এবার ওর গলা। আর কোনো প্রশ্ন করল না নিকোলাস। দরজার খোলা আগ মুহূর্তে ওকে জড়িয়ে ধরে হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই হাওয়ার দাপটে নিভে গেল বাতিদানের আলো। মার্কোভিক খোলা দরজার মুখে দাঁড়িয়ে সামনের অন্ধকারে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন।
“মঁসিয়ে, কোনো সমস্যা?” পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তিখন। মার্কোভিকের গম্ভীর মুখটার একাংশ দেখতে পাচ্ছে সে। কিছুক্ষণ পর শুনতে পেল,
“না।”
পার্শ্ববর্তী একটি পার্কের নির্জন লেকের পাড়ে এসে বসল ইসাবেলা ও নিকোলাস। কাগজটি এখনও নিকোলাসের হাতে, কিন্তু খোলা। ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে ইসাবেলা। বুঝতে চাইছে প্রতিক্রিয়া। শক্ত ঠোঁট দুটোর এককোণা বেঁকে গেল। হাসছে! ভুরু কুঁচকে যায় ইসাবেলার৷ কৌতূহল ক্রমশ বাড়ছে। কাগজটির লেখা পড়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে নিকোলাস। দম্ভ কতটা অন্ধ করেছিল ওকে! ভেবেছিল ওকে শেষ করার সাধ্য কারো নেই। ফাদার জালোনভ সেই দম্ভ চুর্ণ করেছেন। আজ তিনি বেঁচে থাকলে নিকোলাস অস্তিত্ব মিটে যেত হয়তো। আন্দ্রেইর কারণে লক্ষ্যের দোরগোড়ায় গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন ফাদার জালোনভ। আন্দ্রেই! নিকোলাসের বুকের ভেতরটা মুচরে ওঠে। দুচোখ বন্ধ করে মনে মনে জপে,
“শক্ত করতে হবে মনটাকে নিকোলাস। আরও কঠিন হতে হবে৷ ভুলে যা ওই প্রতারককে, ভুলে যা।”
“নিকোলাস!” ধৈর্যের বাধ ভাঙে ইসাবেলার। নিকোলাস চোখ মেলে তাকায় প্রেয়সীর দিকে। উৎকণ্ঠা ইসাবেলার চোখে-মুখে। জানতে উদগ্রীব কাগজে লেখা রহস্য।
“কাছে এসো বেলা।” ইসাবেলা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাছ ঘেঁষে বসে। নিকোলাসের তবুও মন ভরে না। টেনে কোলে বসিয়ে ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজলো।
“এর ভেতরে কী লেখা তা জানতে মার্কোভিকের স্টাডি রুমে গিয়েছিলে?”
নিকোলাস আলতো করে নাক ঘষে ইসাবেলার গলায়। শিহরণে জড়সড় হয়ে গেল ইসাবেলা। নিকোলাসের শীতবস্ত্র এখন ওর পরনে। তবুও কাঁপছে। শীতে নয় শিহরণে।
“হুম?” নিকোলাস ফের প্রশ্ন করতে ধাতস্থ হয় ইসাবেলা।
“হুম।” কোনোমতে জবাব দিলো ও। সরে বসতে চায়। নিকোলাস ছাড়ে না। এমন করলে মনোযোগ কীভাবে দেবে ইসাবেলা?
“ওখানে এর জবাব পাবে কী করে বুঝলে?”
“গতকাল দুজন আগন্তুক এসেছিল নানার কাছে। বসার ঘরে কথা বলছিল তাঁরা। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ওদের হাতে একধরনের সাংকেতিক চিহ্ন সংবলিত কাগজ দেখতে পাই। নানার কাছে এর অর্থ জানতে এসেছিলেন ওঁরা। তিখনকে জিজ্ঞেস করলে ও বলল নানা কাছে এসব সাংকেতিক চিহ্ন বুঝার বই আছে। আমাদের কোনো এক পূর্ব পুরুষ বইটা লিখেছিলেন। সেটাই খুঁজতে গিয়েছিলাম।” থামল ইসাবেলা। নিকোলাস নীরবতা ভেঙে বলল,
“আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারতে। তোমার কাছে কিছু গোপন করতাম না আমি।”
অপরাধীর মতো মুখ করে ইসাবেলা বলল,
“ক্ষমা করো আমাকে। আমি তোমায় অবিশ্বাস করি না। কাগজটা আমাকে খুব বেশি কৌতূহলী করে তুলেছিল।”
একটু চুপ করে নিকোলাস বলল,
“কাগজটা আমাকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট বেলা। আমার প্রাসাদের ম্যাপ রয়েছে এতে। আমাকে খুব সহজে শেষ করা যেত এই কাগজের সূত্র ধরে।”
ইসাবেলা খামচে ধরেছে নিকোলাসের কাঁধের শার্ট। এমন কিছুই আশঙ্কা করেছিল ও। তাই তো এত রিস্ক নিয়ে স্টাডি রুমে যাওয়া। নিকোলাসের বিপদ আশঙ্কা ওর নিদ্রা কেড়ে নিয়েছিল। নিকোলাস আবার বলল,
“অহংকার মানুষকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। কথাটা এতদিন শুনেছি। আজ মর্মে মর্মে অনুধাবন করলাম। আন্দ্রেইর না থাকলে এই অহংকার আমাকে কবেই শেষ করে দিতো। তোমার ভালোবাসা আমার আর পাওয়া হতো না। কতটা আফসোস আর শূন্যতা নিয়েই না সমাপ্তি ঘটত এই আমার! আন্দ্রেই কেন তোমার সাথে এমন করল বেলা? কেন বুঝল না আমাদের ভালোবাসা? এতটা জেদ না করলেই কী হতো না ওর?” নিকোলাসের বিমর্ষ গলা ইসাবেলাকে চিন্তায় ফেলে। ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল। নিকোলাস কি সব জেনে গেছে তবে?
“তু..তুমি সব জেনে গেছো!” আমতা আমতা করে ইসাবেলা। নিকোলাস মাথা নাড়ায়।
“কেন সত্যি বলোনি বেলা?” অভিযোগ তোলে নিকোলাস। ইসাবেলা নিচু গলায় বলে,
“তোমাদের সম্পর্ক আমার কারণে নষ্ট হোক তা আমি চাইনি নিকোলাস। কী করে জানলে তুমি?”
নিকোলাস এড়িয়ে গেল সে প্রশ্ন। দু’হাতে ওর কটিদেশ জড়িয়ে ধরে আরও নিকটে এনে বলল,
“কথা দাও এরপর আমাদের মাঝে আর কোনো গোপনীয়তা থাকবে না। কিছু লুকাবে না কোনোদিন।”
“কথা দিলাম।”
দ্বিধাহীন ওয়াদা ইসাবেলার। ঝুঁকে নিকোলাসের কপালে কপাল রাখল। দুজনে একে অপরের চোখে হারিয়ে গেল সেই মুহূর্তে। এই অন্ধকার চাদর হয়ে জড়িয়ে নিলো ওদেরকে৷ দু’জোড়া ঠোঁট কাছাকাছি এসে আলতো করে ছুঁয়ে যায়। নিকোলাস নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মন্ত্র জপতে থাকে। কনকনে হাওয়ায় বয়ে এলো রোমাঞ্চকর তপ্ততা। ইসাবেলার ওষ্ঠজোড়া থরথর করে কাঁপছে। চোখ বন্ধ। নিকোলাস একবার ওর কম্পিত ঠোঁটে তারপর মুদিত নেত্রপল্লব দেখল। চাপা গলায় বলল,
“কতটা ভালোবাসো আমায় তুমি বেলা?”
ধীরে ধীরে চোখ মেলে ইসাবেলা। স্থির ওর চাহনি। অবিচলিত কণ্ঠে বলল,
“ভালোবাসা নিক্তিতে মাপতে জানি না আমি নিকোলাস। যদি জানতাম তবে পরিমাপটা বলে দিতে পারতাম। তবে এইটুকু জেনে রেখো, প্রেমের রেজিস্ট্রার অফিসে আমার সবটা এখন তোমার নামে দলিল হয়ে গেছে। তুমি চাইলেই আমি বাঁচি, আবার মরতেও পারি।”
নিকোলাস দুহাতে ওর মুখটা ধরে ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিলো। একফাঁকে বলল,
“তুমি আমার আত্মসংযমের জন্য বড্ড হানিকর বেলা, বড্ড হানিকর।”
চলবে,,,