তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৬৫+৬৬+৬৭

0
1014

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬৫
Writer তানিয়া শেখ

কবি হোরেস বলেছিলেন, “যে লোভী সে সর্বদা অভাবী থাকে।” নোভার মনে হচ্ছে রিচার্ড ঠিক তেমনই একজন লোভী ব্যক্তি। ক্ষমতার লোভ যাকে নীচ করে ছেড়েছে। এই অভাব পূরণে আশপাশের সবটা গ্রাস করতে শুরু করেছেন তিনি। ক্ষমতার লোভে একদিন পিশাচ হতে বাধেনি। শুধু নিজে নয় আপন পরিবারকেও সেই পথে টেনেছেন। স্বার্থের কাছে সম্পর্ক যেন তুচ্ছ তাঁর কাছে।

“আপনার মধ্যে সন্তানবাৎসল্যের ন্যূনতম ছিটেফোঁটাও কি অবশিষ্ট নেই, বাবা? কী করে পারলেন এমনটা করতে?”

“কী করে পারলাম?” রিচার্ড মেয়ের দিকে রেগে তাকান। তারপর বলেন,

“নিকোলাস যেভাবে আমাকে সিংহাসনচ্যুত করতে পেরেছে সেভাবে পেরেছি। আন্দ্রেই যেভাবে আমাকে অমান্য করে বার-বার অসম্মান করেছে সেভাবে করেছি, এবং বেশ করেছি করে।”

“ওহ! তবে এসব আপনার প্রতিশোধ?”

“প্রতিশোধ!” রিচার্ডের ক্রূর হাসি নোভার দৃষ্টি এড়াল না। ভুরু কুঁচকাতে রিচার্ড গম্ভীর মুখে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন,

“আমার অনেক কাজ রয়েছে। যাও এখন। তোমার মতো অপদার্থের সাথে কথা বলে আমার মূল্যবান সময়টুকু নষ্ট করতে চাই না।”

“অপদার্থ! হ্যাঁ তাই তো আমি। তবুও তো ভালো এই অপদার্থ আপনজনের পিঠে ছুরিকাঘাত করার কথা ভাবে না। আপনার কাছে ভালো ব্যবহার কখনো আশা করি না। জানি সবার দ্বারা সব হয় না।”

“নোভা! তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার পিতা।”

“আর আপনি মনে রেখেছেন? লজ্জা করে না? বিবেকে বাধে না সন্তানের ক্ষতির চিন্তা করেন পিতা হয়ে? ক্ষমতার লোভে নিকোলাসকে পশু করে ছেড়েছেন। আন্দ্রেই ভুল করেছে। পিতা হিসেবে ভুল শুধরে দেওয়া উচিত আপনার। তা না করে কী করলেন? নিকোলাসকে রিগা পাঠিয়েছেন আন্দ্রেইকে ওর চোখে খারাপ করতে। ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতার সূত্রপাত করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে চান? আমি থাকতে তা কোনোদিন হবে না।”

“কী করবে? এতক্ষণে হয়তো সব জেনেও গেছে নিকোলাস। আন্দ্রেইর কঠিন শাস্তি দেখা এখন সময়ের অপেক্ষামাত্র। জানো তো, প্রতারকদের কতটা ঘৃণা করে নিকোলাস।” ঠাট্টার সুরে হাসলেন রিচার্ড। নোভা পিতার দিকে ঘৃণিত চোখে চেয়ে বলল,

“নিজেকে আপনার মেয়ে ভাবতে লজ্জা হয় আমার।”

“তাহলে ভেবো না। এখন যাও আমার সামনে থেকে, যাও বলছি।”

চেঁচিয়ে ওঠেন রিচার্ড। নোভা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পিতার রুম থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। রিচার্ড নিজের স্টাডি টেবিলের সামনের চেয়ারটাতে গিয়ে বসলেন। ড্রয়ার খুলে নতুন একটা চিঠি বের করলেন। খামের ওপরে শুকনো গোলাপের চিত্র আঁকা। খামটার মুখ খুলে বের করে আনলেন চিঠি। পড়া শেষ করে মুচকি হাসেন। নোভালির কণ্ঠ নকল করে বলেন,

“আমি থাকতে তা কোনোদিন হবে না।” নিজ কণ্ঠে বলেন,

“বেচারী বোকা মেয়ে আমার, তুমি থাকলে তো? আমাকে বাবা বলতে আর তোমার লজ্জা হবে না। কারণ নরকে তুমি একাই যাবে।” উঠে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। একটুপর তাঁকে দেখা যায় নিকোলাসের কক্ষের ভেতর, ওর বড়ো পোট্রের্টের সামনে। ছবির নিকোলাসের পরনে রাজকীয় পোশাক, কোমরে তলোয়ার। চোখ-মুখে রাজা সুলভ দম্ভ। এই সাজ একদিন রিচার্ডের ছিল। রিচার্ডের ঘাড় উঁচু হয় ওর মুখের দিকে তাকাতে। নিকোলাসের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় ক্ষীণ হাসি। এই হাসি ওর ক্রূরতার চিহ্ন। এই হাসিতে ও বুঝায় ওকে হারানো নিছক বোকার কল্পনা। নিকোলাসের এই অহং ভেঙে দিতে চায় রিচার্ড। ওর ছবির দিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে তাঁর মুখ। দাঁতে দাঁত পিষে বলেন,

“নিকো, মাই ডিয়ার সান। হ্যাঁ, তুমি আমারই ছেলে। বহু আগেই তা প্রমাণ করেছ। মনে আছে না সেদিনের কথা? আহা! তোমার কোমল, পবিত্র হাতে ম্যাক্সের সন্তান এবং সন্তানের মায়ের রক্ত লেগে যায়। আমি কিন্তু আশা করেছিলাম ম্যাক্সকেও তুমি মারবে। মারলে না। আমি তোমার পিতা কিন্তু ভালোবাসলে, পিতৃত্বের স্বীকৃতি দিলে কি না ওই নেকড়েটাকে? তোমার মা আর তুমি অন্যায় করেছিলে আমার সাথে। তোমরা আমার। ম্যাক্সকে কী করে তোমাদের অধিকার করতে দিই, হুম? ওকে আমি ঘৃণা করি। আর তোমরা কি না আমাকে ত্যাগ করে ওকে গ্রহণ করলে? তোমার মা তোমাকে ভীতু বানিয়ে রেখেছিল। আমার কারণে নিজের আসল স্বত্ত্বাকে খুঁজে পেয়েছিলে। কত কী দিয়েছিলাম তোমাকে, ধন-দৌলত, আরাম-আয়েশ আর নারী। অথচ, তুমি আমার সাথে বেঈমানী করলে। আমার এত ত্যাগ, স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করতে তোমার হাত কাঁপল না। একশ বছর কারাগারে বন্দি রেখেছিলে। একশ বছর! আমি তোমাকে ছাড়ব না নিকোলাস। আমার সবকিছু আমি ফিরিয়ে নেবো। ফিরিয়ে দেবো ওই একশ বছরের যন্ত্রণাময় দিন। অপেক্ষা করো মাই ডিয়ার সান, অপেক্ষা করো।”

নোভা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে পিতার সব কথা শুনলো। ওর মন বলছে রিচার্ড আবারও খারাপ কিছু ঘটাতে চলেছে। যেমনটি সে ঘটিয়েছিল বহু’শ বছর পূর্বে। নিকোলাস প্রথম থেকে এমন নির্দয়, নিষ্ঠুর ছিল না। পিতার লোভে ওর এমন পরিণতি। স্বার্থের কাছে সন্তানও তুচ্ছ রিচার্ডের কাছে। মহাক্ষমতারধর হতে চেয়েছিলেন। আত্মা সঁপে দিয়েছিলেন শয়তানকে। শয়তান এবার পবিত্র আত্মা চাইল। রিচার্ডের কুনজর গেল নিকোলাসের ওপর। কিশোর নিকোলাসকে ম্যানুপুলেট করতে খুব বেশি কষ্ট হয়নি তাঁর। আগাথা এবং ম্যাক্স ছিল নিকোলাসের দুর্বলতা। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সুচতুরভাবে নিকোলাসকে বশ করেন তিনি। ওর পবিত্র হাতে রক্তের দাগ লাগে রিচার্ডের ষড়যন্ত্রে। ওকে সম্পূর্ণভাবে চাচ্ছিলেন। সেদিন পেয়ে গেলেন। পাপের অনুশোচনায় দগ্ধ ওর আত্মাকে সুকৌশলে শয়তানকে উৎসর্গ করলেন। নিকোলাস যে একেবারে কিছু বোঝেনি তা নয়। মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন সে ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পেরেও মন্দকে বেছে নেয়। শয়তানের প্রভাবটা তখন খুব বেশি থাকে।আর থাকে তার অতীত কর্মের পাপের ভার। এই ভারটাই দুর্বল করে দেয়। ধৈর্য হারায়। ডুবে যায় অন্ধকারে। নিকোলাস সেদিন দুর্বল, অসহায় ও অবুঝ ছিল। ওপরে উঠতে ওকে দিয়ে সকল নীচকর্মই করিয়েছেন রিচার্ড। সন্তান নয় প্রভুভক্ত কুকুর বানিয়ে ফেলেছিলেন। রিচার্ডের সকল আদেশ বিনাবাক্যে মানতো নিকোলাস। রিচার্ডের লোভের সাথে বাড়ল ওর নিষ্ঠুরতা, পৈশাচিকতা। এদিকে দাসবৃত্তি অসহ্য হয়ে উঠল নিকোলাসের কাছে। পিতাকে এত দিয়েও মন ভরাতে পারেনি। প্রাপ্ত সম্মান তো দূরের কথা সন্তান হিসেবে মূল্য পর্যন্ত দেয়নি রিচার্ড। রিচার্ডের ওপর কমিউনিটির অনেকে নাখোশ ছিল। তারাও নিকোলাসকে গোপনে গোপনে পিতার বিরুদ্ধে করে তুললো। নিকোলাস তখন দুর্বল নয় বরং শক্তি, বুদ্ধিতে অনন্য। কমিউনিটির রাজা হওয়ার জন্য রিচার্ডের চেয়ে যোগ্যতা ওর বেশিই ছিল। তবে কেন ও দুর্বল রাজার দাসবৃত্তি করবে? অহংকারে লাগল এবার। শক্তির জোরে খুব সহজে পিতাকে হটিয়ে সিংহাসন দখল করে নিলো৷ রিচার্ড নিক্ষিপ্ত হয় কারাগারে। তাঁর কিছু করার ছিল না তখন। নিকোলাস সবদিক থেকে কোনঠাসা করে রাখে। এত বছরে রিচার্ডের দুর্বলতা ওর জানা হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া নিকোলাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো লোকবল এবং শক্তি কোনোটাই তখন তাঁর ছিল না। নিকোলাসের পরে কমিউনিটিতে যদি কেউ শক্তি, বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ হয় তবে সে আন্দ্রেই। ছোটো ছেলেকে বশে আনার সব রকমের পন্থা অবলম্বন করেও ব্যর্থ হন। তাঁর আঙুলের ইশারায় চলা সোফিয়াও ছেলেকে নিকোলাসের বিপক্ষে করতে অসমর্থ হয়েছিলেন। সেদিনই রিচার্ড পণ করেছিলেন ভাই ভাইয়ের এই জোড় তিনি ভাঙবেন। বিশ্বাসঘাতকতার কঠিন শাস্তি দেবেন নিকোলাসকে। তাঁকে অমান্য করার উচিত শিক্ষা পাবে আন্দ্রেই। নিকোলাসের কাছে বহুভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে অবশেষে মুক্তি মেলে। সেই থেকে একটু একটু করে নিকোলাসের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইসাবেলা নিকোলাসের সম্পর্কের ব্যাপারে বেশ খবর রাখেন রিচার্ড। একবার যে ভুল করেছিলেন এবার আর করবেন না। প্রতিপক্ষের প্রতি পদক্ষেপের খবর তিনি নখদর্পনে রাখেন এখন। শক্তিতে না পারেন অন্য যেকোনো ভাবেই হোক সিংহাসন তাঁর ফেরত চায়। নিকোলাসকে রিগা পাঠানো তাঁর পরিকল্পনার অংশ। এক ঢিলে দুই পাখি মারবেন তিনি এবার।

ড্যামিয়ান রিগাতে নেই। এবারো ভুল খবর দেওয়া হয়েছে নিকোলাসকে। এত সহজে রিচার্ডের কথা মেনে এখানে আসা উচিত হয়নি। উচিত হয়নি? এখানে না এলে ইসাবেলাকে পেত কী করে? রিচার্ডের ওপর রাগটা পড়ে যায়। ইসাবেলার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে শুধু ড্যামিয়ান কেন পৃথিবীর সব যেন ভুলে যায়।

” আমি তোমাকে ভালোবাসি নিকোলাস। খুব ভালোবাসি।”

ইসাবেলার সেদিনের সেই ভালোবাসা প্রকাশ আজও নিকোলাসকে রোমাঞ্চিত করে। দীর্ঘ হাসি দেখা দেয় ঠোঁটে। নিকোলাস এখনও নিজের মনের কথা ওকে বলেনি। না, আজ আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই মনে। ইসাবেলাকে ভালোবাসে সেকথা বলতেও সংকোচ নেই৷ উপযুক্ত সুযোগটা পায়নি ভালোবাসি বলার। মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য সেদিন রাতে দেখা হয়েছিল ওর সাথে। একে অপরকে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে দীর্ঘ বিরহের যাতনা ভুলতে ব্যস্ত ছিল যখন তখনই ইসাবেলার কাজিনের গলা শুনে আলাদা হয়ে যায়। না চাইতেও ইসাবেলাকে নিকোলাসের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল সেই রাতে। মুখটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে ইসাবেলার। চোখ ছলছল করছিল। ভীষণ খারাপ লাগছিল নিকোলাসের। ইসাবেলাকে নিজের থেকে আলাদা করতে চাইছিল না একমুহূর্তের জন্য। কিন্তু উপায়ও তো ছিল না। ওদের সম্পর্কের স্বীকৃতি কেউ দেবে না। কারো স্বীকৃতির ধার ধারে না অবশ্য নিকোলাস। ভয়টা ইসাবেলাকে নিয়ে। জানাজানি হলে ইসাবেলার বিপদ হতে পারে। আগে নিকোলাস নিজেকে নিয়ে ভাবত। আজকাল ওর সকল ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ইসাবেলা। সেদিন বিদায়কালে কথা দিয়েছিল শীঘ্রই দেখা করবে ওর সাথে। মাঝখানে কিছুদিন কেটে গেল ড্যামিয়ানকে খুঁজতে। ওকে না পেলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। নিকোলাস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এই মুহূর্তে ইসাবেলার সান্নিধ্য ওর প্রয়োজন। ওকে ছাড়া এক মুহূর্ত দীর্ঘ, অর্থহীন মনে হয়। কী করে যে কেটেছে এই ক’টা দিন তা শুধু ওই ই জানে।
হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে ইসাবেলার রুমে প্রবেশ করলো। বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ইসাবেলা। নিকোলাস নিঃশব্দে ওর শিওরে গিয়ে বসল। মুখ নামিয়ে আনল ওর গলার কাছে। জোরে শ্বাস টানে। কী মিষ্টি সুবাস! লাল গোলাপের ঘ্রাণের মতোই যেন। এই সুবাস ধরে এই রুম পর্যন্ত আসতে ওর খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। ইসাবেলার ঘুমন্ত মুখের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ ওর ঠোঁটে দৃষ্টি স্থির হয়। মনে পড়ে সেদিন একটা চুমো আবদার করেছিল। ওর কাজিনরা ওভাবে হা করে তাকিয়ে না থাকলে নিকোলাস কি না করত? কখনো না। নিকোলাস ধীরে ধীরে মুখটা নামিয়ে আনে ইসাবেলার ঠোঁটের দিকে। ঠোঁট ছোঁয়াতেই যাবে ওমনি চোখ মেলে তাকায় ইসাবেলা। ঠোঁট দুটো ঠেলে মুখের ভেতর নিয়ে মাথা দুদিকে নাড়ে। নিকোলাস ভুরু কুঁচকে বলে,

“চুমু দেবো না?”

ইসাবেলা আবার মাথা নাড়ায়। যার অর্থ না।

“কেন?” নিকোলাস জানতে চায়। ইসাবেলা এবার ঠোঁটের ওপর হাত রেখে বলে,

“আমি ব্রাশ করে ঘুমায়নি।”

“তো?”

“বাসি মুখে চুমো খাবে ঘিন্না করবে না তোমার?”

“না, এবার হাত সরাও।”

ইসাবেলা হাত সরায় না।

“বেলা!”

“না, সবসময়ই তোমার কথাতে হবে না কি? সেদিন আমি চেয়েছিলাম তুমি দাওনি। আজ আমিও দেবো না। শোধবোধ। শীঘ্রই আসব বলে পুরো তিনদিন পরে এসে আবার ঘুমিয়ে থাকার সুযোগে চুমো খেতে চাওয়া? এত সহজ?” শেষ দুটো বাক্য বিড়বিড় করে বললেও নিকোলাস বুঝতে পারে। ওর অভিমানী গাল ফুলানো মুখটার দিকে মুচকি হেসে হাতদুটো মাথা কাছে চেপে ধরে।

ইসাবেলা ভড়কে যায়। আমতা আমতা করে বলে,

” কী করছো? ছাড়ো বলছি।”

“না। আগে যা চাই তা দাও।”

“এটা কিন্তু রীতিমতো স্বেচ্ছাচারিতা।”

“তাই বুঝি?” নিকোলাস ওর দিকে আবার ঝুঁকে আসতে ইসাবেলা চোখ বন্ধ করে ফেলে। ও সত্যি এই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত নয় এখন। অনেকক্ষণ পরেও যখন ঠোঁটে কিছু টের পেল না চোখ মেলে তাকাল। নিকোলাস সোজা হয়ে বসে আছে শিওরে। ঠোঁটে মুচকি হাসি। তাড়াতাড়ি উঠে বসল ইসাবেলা। নাইটির রোবটা সরে গিয়ে বুকের অনেকখানি দেখা যাচ্ছিল। নিকোলাস গলা ঝেড়ে অন্যদিকে মুখ করে বসল। লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে দ্রুত রোবটা ঠিক করে নিলো ইসাবেলা। দুজনই চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। দেওয়াল ঘড়িতে টিকটিক বেজে চলছে সেকেন্ডের কাঁটা। মধ্যরাত। নীরবতা ভেঙে একসময় ইসাবেলা বলে উঠল,

“তুমি রাগ করলে?”

“আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি রাগ করেছি?” ইসাবেলার দিকে ঘুরে বসল নিকোলাস। ওর হাতটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল,

“আমি ভীষণ অসভ্য, ইতর। যা চাই তা নিজের করে ছাড়ি। আমি তোমার জন্য সভ্য ও মনুষ্যত্ববান হতে চাইছি বেলা।”

ইসাবেলা স্মিত হাসল। নিকোলাসের গালের একপাশে হাত রেখে বলল,

“আমি তোমাকে তোমার মতোই ভালোবাসি নিকোলাস। সে তুমি যেমনই হও না কেন।”

“এভাবে বলতে থাকলে আবার কিন্তু চুমো খেতে চাইব, বেলা। শিট! কন্ট্রোল নিকোলাস, কন্ট্রোল।”

ইসাবেলা খিলখিল করে হেসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। তারপর গালে চুমো দিয়ে বলে,

“ওয়েট, আমি ব্রাশ করে আসছি।”

দু মিনিট পরে ব্রাশ করে ফিরে এলো ইসাবেলা। নিকোলাস বিছানায় আধশোয়া হয়ে ছিল।ইসাবেলাকে দেখতে হাত বাড়িয়ে ডাকল,

“কাছে এসো, বেলা।”

ইসাবেলা কাছে যেতে ঠোঁটে গাঢ় চুম্বন দিলো। তারপর কপালে কপালে রেখে বলল,

“আর দূরে যাবে না।”

“তুমি গেলে?”

“আমার সকল পথের গন্তব্য তোমার কাছে এসেই শেষ হবে, বেলা, তোমার কাছেই। তুমি আমার ঘর। আমার ভালোবাসা। বড্ড ভালোবাসি তোমায় আমি।”

চলবে,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬৬
Writer তানিয়া শেখ

শূন্যে ভাসছে ইসাবেলা। চোখদুটো একটুকরো কালো কাপড়ে বাঁধা। একা নয় ও। ওকে জড়িয়ে ধরে আছে নিকোলাস। কিছুক্ষণ আগে কথা বলতে বলতে হঠাৎ এক টুকরো কালো কাপড় হাতে নিয়ে নিকোলাস বলেছিল,

“বিশ্বাস কোরো আমায়, বেলা?”

“নিজের চাইতেও বেশি।” জবাব দিয়েছিল ইসাবেলা। মিথ্যা বলেনি ও। দু চোখ বন্ধ করে নিকোলাসকে বিশ্বাস করে এখন। নিকোলাস সন্তুষ্ট হয়েছিল জবাব পেয়ে। ওকে নিয়ে শূন্যে ভাসল। গন্তব্য এখান থেকে বেশ দূরে। প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে নির্দিষ্ট গন্তব্যের কাছে গিয়ে নামল। পায়ের নিচে নরম ঘাস অনুভব করছে ইসাবেলা। পা ভিজে যায় শিশিরবিন্দুতে। আসার পূর্বে চটি জোড়া পরতে ভুলে গেছে। নিকোলাস ওর হাত ধরে সামনে এগোতে লাগল। কৌতূহল দমাতে না পেরে ইসাবেলা বলল,

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

“বড্ড অধৈর্য তুমি, সুইটহার্ট। আরেকটু সবুর কোরো সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে।” কানে আলতো চুমু দিয়ে চাপা গলায় বলল নিকোলাস। ইসাবেলা মৃদু কম্পিত হলো ওর উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে। গলা ঝেড়ে বলল,

“হু! তোমায়ও একদিন এমন করে চোখ বেঁধে কোথাও নিয়ে যাব। সেদিন দেখব কত ধৈর্য তোমার।”

“তোমার ক্ষেত্রে একেবারে ধৈর্য নেই আমার।” ইসাবেলার হাতের পল্লবে চুমু দিলো নিকোলাস। তারপর আবার বলল,

“তবে কোনো একদিন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ তোমাকে দেবো। তখন চোখ বাঁধো অথবা যা ইচ্ছে হয় কোরো। কিছু মনে করব না।”

নিকোলাস সম্মোহনী গলায় বলল। ওর কথার অর্থ বুঝতে পেরে লাজে রাঙা হয়ে ওঠে ইসাবেলা। গলা দিয়ে আর কথা বেরোয় না। ওর লাজুক মুখ দেখে মুচকি হাসে নিকোলাস। থেমে যায় মূল গন্তব্যে এসে৷

“পৌঁছে গেছি আমরা।” চোখের বাঁধন খুলে দেয় নিকোলাস। ইসাবেলা সামনে চেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সরু এক ঝিরির পাশের ঘন সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত সমতলে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। শুধু এদিককার ঘাসগুলো শুকনো। সামনে কাঠ পুড়ে আগুন জ্বলছে। একটু দূরে তাবু টানানো। তাবুর সামনে সাদা চাদর বেছানো। তার ওপরে সাজানো আছে চিজবোর্ড, ফুল এবং পাশে রাখা বাস্কেটে কুকিজ, শ্যাম্পেইন। শুল্ক পক্ষের চাঁদের আলো নিকোলাসের এই রোমান্টিক প্রয়াসকে আরও খানিক সফল করেছে।

সেই ছোটোবেলা থেকেই ইসাবেলা এমন একটা পিকনিক ডেট-এর স্বপ্ন দেখেছে৷ একসময় মনকে বুঝিয়েছিল সবার সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। মনের গোপনে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নটা নিকোলাস পূরণ করবে ওর কল্পনাতেও আসেনি। খুশিতে ইসাবেলার চোখ ছলছল করে ওঠে। নিকোলাসের দিকে তাকাল। বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে ওকে। ইসাবেলার দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না। ঘাড়ে হাত নেড়ে বলল,

“তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা বেলা। এর আগে প্রেম কিংবা ডেট কোনোটাই করা হয়নি। এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা একেবারে নেই। কিন্তু আমি চাই তোমার সাথে সবকিছু উপলব্ধি করতে । সকল অনুভূতি ভাগ করে নিতে চাই তোমার সাথে। এই যে এসব আয়োজন করেছি সবটাই নিজের ধারণা থেকে। মনে বলছিল তোমার পছন্দ হবে।”

ইসাবেলা আচমকা ওর গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে।

“বুদ্ধু, শুধু পছন্দ হয়েছে? তোমার মতোই তোমার ধারণার প্রেমে পড়ে গেছি। ভালোবাসি তোমাকে, খুব খুব ভালোবাসি।”

নিকোলাস স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। শক্ত করে জড়িয়ে নিলো ইসাবেলাকে। ওর মাথার একপাশের স্কার্ফের ওপর চুমো দিয়ে বলল,

“ভালোবাসি, ভালোবাসি এবং ভালোবাসি।”

কাপড়ের ওপরে বসল মুখোমুখি দুজন। ইসাবেলার দৃষ্টি প্রথমে গেল ফুলদানিতে। ডেইজি, আপেল ব্লসম, রেড টিউলিপ ও রেড রোজের গুচ্ছ না ছুঁয়ে পারল না। নাকের কাছে এনে সুবাস নিলো। এরপরে চোখ গেল সামনের চীজবোর্ডের ওপরে। চীজ, বেরি, সসেজ, ড্রাইফ্রুট, অলিভ, চাটনি ও আপেল দিয়ে সাজানো বোর্ডটি। ইসাবেলা ওখান থেকে একটা বেরি টুপ করে মুখে দিয়ে হেসে তাকাল নিকোলাসের দিকে। আরেকটা তুলে নিয়ে বলল,

“খাবে?”
নিকোলাস মুচকি হেসে মাথা দুদিকে নাড়ায়। পাশের বাস্কেট থেকে শ্যাম্পেইনের বোতল হাতে ছিপি খুলে ওয়াইন গ্লাসে ঢাললো। এগিয়ে দিলো ইসাবেলার দিকে। তারপর নিজের জন্য একটা গ্লাস ভরে সামনে এগিয়ে বলে,

“চিয়ার্স, আমাদের প্রথম ডেট-এর জন্য।”

ইসাবেলা নিজের হাতের গ্লাসটা নিকোলাসের গ্লাসে লাগিয়ে একই কথা বলল। আগেও ইসাবেলা শ্যাম্পেইন পান করেছে, কিন্তু আজকেরটা যেন ভিন্ন রকম। এর স্বাদ অনন্য। শুধু এই শ্যাম্পেইন কেন? এখানে যা আছে সব অন্যরকম। এই রাতের প্রকৃতিও আলাদা, শিহরণ জাগানো, হৃদয় দোলা দিয়ে যাওয়া এক রাত। শীত আসন্ন। রাত বাড়তেই ঠাণ্ডার প্রকোপ বাড়তে লাগল। হাঁটু সমান চকলেট কালার ফ্রক আর ওপরে পাতলা একটা সোয়েটার জড়ানোর ইসাবেলার গায়ে৷ রাতের হিম বাতাস কাঁপিয়ে দেয় ওকে। নিকোলাস ওঠে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে বলল,

“ওঠো।”

ইসাবেলা ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। নিকোলাসের ঠোঁটের কোণে সারাক্ষণ লেগে আছে ক্ষীণ সম্মোহনী হাসি। এই সুদর্শন যুবকের রূপে বার বার মুগ্ধ হয় ইসাবেলা। এত দেখেও যেন মন ভরে না।
নিকোলাস ওকে নিয়ে এলো তাবুর ভেতরে। বিছানা পাতা সেখানে।

“আজ কি আমরা এখানে থাকব?” বলল ইসাবেলা। নিকোলাস এখনও ওর হাত ধরে আছে।

“যদি তোমার আপত্তি না থাকে।”

“আমার আপত্তি নেই। তোমার সাথে পৃথিবীর যে কোনোখানে থাকতে পারব আমি।” নিকোলাসের বুকে মাথা রাখল। হাতটা ওর হাতের ওপর। নিকোলাস সেটাতে চুম্বন করে। দুজনে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়ল পাশাপাশি। নিকোলাসের গলায় মুখ গুঁজে আছে ইসাবেলা। ওর মাথার স্কার্ফ আস্তে আস্তে খুলে ফেললো নিকোলাস। চুলে হাত বুলাতে লাগল। একসময় বলল,

“বেলা, ঘুমিয়ে পড়েছ?”

“উঁহু।” নাক ঘষলো ওর গলায় ইসাবেলা। নিকোলাস একটু যেন কেঁপে ওঠে। গলা ঝেড়ে বলে,

“কাল আমাকে জার্মানি ফিরতে হবে। আমি_” ওর কথা শেষ না হতেই তড়াক করে উঠে বসে ইসাবেলা।

“তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে নিকোলাস?” আতঙ্কে ওর চোখে। অবোধ শিশুর মতো ঠোঁট ফুলিয়ে ফেললো। নিকোলাস ধীরে ধীরে উঠে বসল। দুহাতে বুকে টেনে নিয়ে বলল,

“কে বলেছে ছেড়ে যাচ্ছি?”

“তুমিই তো বললে জার্মানি ফিরতে হবে।”

“ফিরতে হবে মানে একেবারে ছেড়ে যাওয়া না পাগলি মেয়ে। আবার আসব আমি। বলেছিলাম না, আমি যতদূরেই যাই গন্তব্য তোমার কাছেই।”

ইসাবেলা এবার সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে ওকে। গলা ধরে আসে। নিকোলাস ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“বেলা।”

“হুম।”

“গার্লফ্রেন্ড হবে আমার?”

ইসাবেলা মুখ তুলে রেগে তাকায়।

“এতদিন কী ছিলাম তাহলে?”

নিকোলাস হাসল। বলল,

“এটাই ছিলে কিন্তু জিজ্ঞেস করা তো হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মতি চাচ্ছি।”

“ওহ!”

ইসাবেলা ফের শুয়ে পড়ল। নিকোলাস ভুরু কুঁচকে বলল,

“ওহ? এটা তো জবাব হলো না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে? ঠিকঠাক জবাব দাও বেলা।” নিকোলাস ওকে টেনে উঠিয়ে সামনে বসায়। এতবড়ো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে এমন গা ছাড়া জবাব কেউ দেয়? ইসাবেলা জবাব না দিয়ে গুম মেরে বসে রইল। নিকোলাস মৃদু ধমকের সুরে ফের জবাব চাইতেই সশব্দে কেঁদে ওঠে। বেকায়দায় পড়ল নিকোলাস। গার্লফ্রেন্ড হবে কি না জবাব চেয়েছে। তার জন্য কাঁদতে হবে কেন?

“বেলা, কান্না থামাও।”

ইসাবেলা আরও জোরে কাঁদছে। শেষে উপায় না পেয়ে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বসিয়ে দিলো। কান্নার শব্দ গিলে নিলো নিকোলাস। ইসাবেলা আস্তে আস্তে কান্না থামিয়ে দুহাতে নিকোলাসের গলা জড়িয়ে ধরে। আশপাশটা যেন মুহূর্তে তপ্ত হয়ে ওঠে। আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল ইসাবেলা। ঠোঁট ছেড়ে নেমে এলো নিকোলাসের গলায় তারপর আরও নিচে। পরনের শার্ট খুলতে নিকোলাস খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে।

“বেলা! কী করছ?”

গলা শুকিয়ে এলো ইসাবেলার। আসলেই! কী করছে ও? শ্যাম্পেইনের প্রভাব পড়েছে। দ্রুত হাত ছাড়িয়ে লজ্জায় অধোবদন হয়ে ওঠে। শ্বাস ভারি হয় ওর। শারীরিক সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই ইসাবেলার। এই নিয়ে কম কথা শোনেনি। নিজের শরীর নিয়েও হীনম্মণ্যতায় ভুগেছে সবসময়। আজ তবে কী হলো? ও কী তৈরি শারীরিক সম্পর্ক করতে? নিকোলাসের জন্য তৈরি ও? মায়ের কথা মনে পড়ল তখনই। মা বলেছিলেন,

“বেলা, তোমার শরীর মন্দিরসম। মন্দির যেমন একমাত্র ঈশ্বরের পূজার জন্য তৈরি। তোমার দেহও তেমনই একজন পুরুষের, তোমার স্বামীর।”

তাড়াতাড়ি মুখ লুকিয়ে উলটো দিকে শুয়ে পড়ে ইসাবেলা। মায়ের এই শিক্ষাকে ধর্ম বলে মেনে এসেছিল এতদিন। আজ এতটা দুর্বল হলো কেন? লজ্জায় ওর মাথা কাটা যাওয়ার উপক্রম। নিকোলাস যেন বুঝতে পারল। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।

“আমার দিকে ফেরো বেলা।”

ইসাবেলা মাথা নাড়ায়। ফিরবে না। নিকোলাস জোর করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর থুতনি তোলে।

“তাকাও আমার চোখে।”

সিক্ত চোখের পাতা তুলে তাকায় ইসাবেলা। নিকোলাস শুধায়,

“একটু আগে যা হয়েছে তারজন্য লজ্জিত তুমি?”

মৃদু মাথা নাড়ায় আনত মুখে ইসাবেলা। নিকোলাস জানে ইসাবেলা সতী। ভয়, হীনম্মণ্যতা থাকবে স্বাভাবিক। তাই তো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে ওর কাছাকাছি এলে। জোর দেয়নি শারীরিক সম্পর্কে। সহজ হলে আপনাতেই সব হবে। আজ হঠাৎ ওর ওমন বোল্ডনেস ওকে বিস্মিত করে। ইসাবেলা এখনও তৈরি নয় ওর জন্য। ওকে ওর চেয়ে ভালো জানে নিকোলাস। ঝোঁকের বসে কিছু করে ইসাবেলা অনুশোচনা করুক নিকোলাস চায় না সেটা। থামিয়ে দিয়েছিল সে জন্য। ও যে সঠিক কাজ করেছিল তার প্রমাণ ইসাবেলার এখনকার আচরণ। ওর চোখেমুখে পাপবোধ ফুটে উঠেছে। সতী বলে শারীরিক সম্পর্কে ভয়, লজ্জা থাকতেই পারে কিন্তু পাপবোধ কেন থাকবে? ও কী সম্পূর্ণভাবে নিকোলাসকে চায় না? পিশাচ বলে ওর দেহকে ঘৃণা করে? চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল নিকোলাসের ।

“কেন?” জানতে চাইল নিকোলাস। নিজের মায়ের শিক্ষা ধীরে ওর সামনে প্রকাশ করে ইসাবেলা। স্বামী ভিন্ন কাওকে দেহ সমর্পণ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল চার্চের গিয়ে। আজ তা ভঙ্গ করতে যাচ্ছিল বলে অনুতাপের শেষ রইল না।

“তাহলে তুমি আমাকে চাও না?” নিকোলাসের প্রশ্নে চমকে তাকায়। ঢোক গিলে বলে,

“চাই, তোমাকেই চাই। কিন্তু_”

“কিন্তু এভাবে নয় তাইতো?”

ফের মাথা নাড়ায় ইসাবেলা। আজ এই ঘটনা ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে নিকোলাসকে ও কতটা চায়। কিন্তু ধর্ম বিসর্জন দিয়ে চাইতে গেলেই যে থমকে যায় বিবেকের দংশনে। নিকোলাস নিশ্চয়ই এমন মেয়েকে চাইবে না। অপেক্ষা করবে না বিয়ে পর্যন্ত। আদপে কী বিয়ে করতে চায় ও? অবিশ্বাসী ও। বিয়ে নামক সামাজিক, ধর্মীয় বন্ধনে বাঁধতে ঘোর আপত্তি করবে। কেন ভাবেনি এই কথাগুলো আগে ইসাবেলা! এখন কী হবে? কী করে এগোবে এই সম্পর্ক? এই সম্পর্কের ভবিষ্যতই বা কী?

ইসাবেলা সরাসরি তাকায় নিকোলাসের দিকে। গভীর ভাবনায় ডুবে আছে ও। ও কী ইসাবেলার মতোই ভাবছে? দুজনের দৃষ্টি তখনই এক হলো। মুখে না বললেও ওরা যেন পরস্পরের মনের কথা বুঝে নিলো। কেউ আর কোনো কথা বলল না।

কঠিন নীরবতা নামল চারপাশে। অদূরে হায়েনার ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ। হিটলার চুক্তি ভঙ্গ করে রাশিয়া দখলের প্লান কষেছে। কয়েকটি শহর ইতোমধ্যে দখলে নিয়েছে। ওদের অতর্কিত আক্রমণে জোসেফ স্ট্যালিন খানিকটা ভড়কে গেছেন। তার সৈন্যরা সুবিধা করে উঠতে পারছে না হিটলারের সৈন্যদের সাথে। হিটলাকে বিশ্বাস করা ভুল ছিল। সেই ভুলের মাশুল গুনছেন এখন তিনি। হিটলারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল নিকোলাসের। ও দেশের ওপর কর্তৃত্ব করবে আর ওর ওপর করবে নিকোলাস। তারপর একে একে পৃথিবীর সমস্ত দেশের ওপর অধিপত্যে গড়ে তুলবে৷ সেসব দেশের প্রধানরা হবে ওর হাতের পুতুল। এমনই পরিকল্পনা করে এসেছিল এতদিন। কিন্তু ইদানীং ও বদলে যাচ্ছে। শুধু ও নয় ওর চিন্তা-ভাবনা, মন মানসিকও বদলে যাচ্ছে। এর কারণ ইসাবেলা। ইসাবেলা ছাড়া আর কিছুতে ওর মন লাগে না। ক্ষমতার লোভ এখন আর আগের মতো ওকে আকর্ষণ করে না। মানুষ থাকতে কৈশোরে একটা সুখী পরিবারে স্বপ্ন দেখতো। মা, ম্যাক্স ও নোভা ছাড়াও একজন সঙ্গিনীকে কল্পনা করতো সেই পরিবারে। যদিও কাওকে তখনও মনে ধরেনি। কিন্তু মনে মনে একজনের ছবি আঁকত। ঠিক ওর মায়ের মতো কোমল, সরল একজন ওর জীবনে আসবে। আহামরি সুন্দর না হোক ওকে ভীষণ ভালোবাসবে। পাশে থাকবে বিশস্ততার সাথে। যাকে একসময় বিয়ে করবে, সন্তান হবে। একসাথে বৃদ্ধ হবে দুজন, হাতে হাত রেখে শেষ নিঃশেষ ত্যাগ করবে। জীবনের বুঝি অন্য ভাবনা ছিল। অতি সাধারণ সেই চাওয়াটুকুও অপূর্ণ রয়ে যায়। মায়ের দেখানো পৃথিবী পালটে দেয় ওর পিতা। চোখের নিমেষে ভয়ংকর নির্মমতার কালো ছায়া ওকে গ্রাস করে ফেলে। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় সব স্বপ্ন। পাপের নরকে বিসর্জন দেয় নিজের আত্মাকে। অন্তঃসারশূন্য নিকোলাস। ওর আত্মার দখল শয়তানের মুষ্টির ভেতর। আত্মা ছাড়া মানুষ হওয়া যায় না। সামাজিকতা কেবল মানুষকেই মানায়। এই সমাজে নিকোলাস এখন বেমানান। ইসাবেলার মতো একজন ছিল মানুষ নিকোলাসের স্বপ্নের সঙ্গিনী। এখন এই নিকোলাসেরও। বড্ড অসময়ে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ভবিষ্যৎ না ভেবেই এতদূর এগিয়েছে ওরা৷ এতদূর যে এখন আর পেছন ফেরার সুযোগ নেই। বাহুর ওপর ইসাবেলা হাত রাখতে চমকে ওঠে নিকোলাস।

“আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী নিকোলাস?”

“আমি জানি না বেলা।” হতাশ গলায় বলে,

“আমাদের সম্পর্কের নিশ্চিত কোনো ভবিষ্যৎ আমার জানা নেই। আমার ভয় হয় একদিন না আমার কারণে তোমাকে সব হারাতে হয়। ধর্ম, সমাজ, পরিবার হয়তো জীবনও। আমি সত্যি মন থেকে তা চাই না। একটু আগে জানতে চেয়েছিলাম তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড হবে কি না। এই অল্প সময়ের ব্যবধানে সব কেমন বদলে গেল। এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাকে ছাড়াই তুমি হয়তো ভালো থাকবে।”

“আর তুমি? আমাকে ছাড়া তুমি ভালো থাকবে?”

নিকোলাস কথা বলে না। ইসাবেলা কাছে এলো। গালের একপাশে হাত রেখে বলল,

“ছেড়ে যাওয়ার কথা বোলো না আমাকে নিকোলাস। আমি বোধহয় মরেই যাব তোমার বিরহে এবার।”

“আমিও বেলা। তুমিহীন আমিও ধ্বংস হয়ে যাব।”

“তাহলে আর ছেড়ে যাওয়ার কথা বলব না আমরা। ওয়াদা করো সামনে যত বাধা আসুক একে অপরের হাত ছাড়ব না।”

“ওয়াদা। তুমি আমার, তোমার হৃদয় আমার। আমার বেলাতেও একই কথা।”

পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে ওরা। খানিক পরে ইসাবেলা বলল,

“আবার কবে ফিরবে?”

“সপ্তাহে খানেক পরে।”

“নিকোলাস।”

“হুম?”

“আমি তোমাকে চাই, সম্পূর্ণভাবে।”

নিকোলাস ওর মুখ দুহাতের মাঝে তুলে চোখে চোখ রাখল। ইসাবেলা মন থেকেই কথাগুলো বলেছে। ওর চোখের চাহনিতে সেই আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট।

“ঈশ্বরকে দেওয়া তোমার প্রতিজ্ঞার কী হবে? আমি পরে তোমার মাঝে অনুশোচনা দেখতে পারব না বেলা।”

“তবে কী পুরোপুরি তোমাকে পাব না আমি? আমাকে পেতে ইচ্ছে করে না তোমার?”

“তুমি ধারণাও করতে পারবে না কতটা চাই তোমাকে। কিন্তু আমার চাওয়া পূরণ করতে তোমাকে পাপী হতে দিই কী করে? একটু সময় দাও। কথা দিচ্ছি সব ঠিক করে দেবো। আমি তুমি শীঘ্রই পুরোপুরি এক হব। আমাদের মাঝে না থাকবে শারীরিক দুরত্ব আর না এমনি দুরত্ব।”

ইসাবেলা নিরাশ মুখে তাবুর ওপরে শূন্য চোখে চেয়ে আছে। জীবনটা জটিল কেন? যা চায় কেন সহজে মেলে না? ঈশ্বরের কাছে করা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে পাপ হবে। ইসাবেলা বরাবরই পাপ করতে ভয় পেয়েছে, কিন্তু আজ এই ক্ষণে পাপের ভয়ের চেয়ে বড়ো ভয় নিকোলাসকে হারিয়ে ফেলার। এই শারীরিক দুরত্ব পাছে নিকোলাসকে ওর থেকে আরও দূর করে না দেয়!

“তুমি বড্ড বেশি ভাবছ, বেলা। বলেছি তো সব ঠিক করব আমি। বিশ্বাস হয় না আমাকে?” বলল নিকোলাস।

“খুব হয়। কিন্তু _”

নিকোলাস বাকি কথা বলার জন্য ওর ঠোঁটদুটোকে সুযোগ দিলো না। বাইরে জ্বলতে থাকা আগুন নিভে গেল ধীরে ধীরে। জ্যোৎস্না স্নাত রাতটা ক্রমশ গাঢ় হয়। দুজনের হৃৎস্পন্দনের শব্দ আর ঘাসে শিশির পড়ার টুপটাপ শব্দ মিলেমিশে একাকার এই নিশুতিতে।

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬৭
Writer তানিয়া শেখ

জার্মান সৈন্যরা রিগার পার্শ্ববর্তী শহর দখলে নিয়েছে। যে কোনো সময় রিগা আক্রমণ করবে ওরা। অনেকেই বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেছে। ওলেগ আলেক্সিভ সপরিবারে এই শহর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখানে এক মুহূর্তও আর নিরাপদ নয়। কিন্তু সমস্যা হলো এতগুলো মানুষ নিয়ে যাবেন কোথায়? বরাবরের মতো এবারও তাঁকে চিন্তামুক্ত করলেন আন্না মেরিও। মস্কোতে তাঁর বাবার পৈতৃক ভিটা। সেখানেই সপরিবারে উঠবেন বলে জানালেন আন্না মেরিও। তাঁর বাবা এখনও বেঁচে আছেন। ভাইয়েরাও কম ভালোবাসে না! কতদিন সেখানে যাওয়া হয় না। সবাইকে দেখলে খুশিই হবে তাঁরা৷ সুতরাং সিদ্ধান্ত নেন আগামী পরশু সকালেই মস্কোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে সকলে। খবরটা বাড়ির সব সদস্যের কানে পৌঁছেছে। নিজেদের বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়ে থাকতে যেতে কারই বা আনন্দ হয়? তবুও জীবন বাঁচাতে কত কী করতে হয় মানুষকে! বাড়ির সবাই যখন গোছগাছ করতে ব্যস্ত তখন ইসাবেলা সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। পুকুরের পাশ ঘেঁষে ঝোপঝাড় পেরিয়ে ইটের রাস্তায় উঠল। কিছুদূর হাঁটলেই পুরোনো গির্জা। গির্জার পেছনে কবরস্থান।
নিকোলাস বলেছে এক সপ্তাহ পর আবার আসবে রাশিয়া। এসে যদি ইসাবেলাকে এখানে না পায় কী হবে তখন? ওকে ছাড়া এক মুহূর্তও ভালো লাগছে না ইসাবেলার। নিকোলাস যেন সাথে করে ওর মন, আত্মা সব নিয়ে গেছে। এই এখানে আছে ওর বিরহ কাতর দেহটা কেবল। তাতে আনন্দ নেই, সুখ নেই। সব যেন বিষাদ, শূন্য। এত আপনজন থাকার পরও হৃদয়টাতে কেবলই বৈরাগীর দোতরা বাজে। নিকোলাস ছাড়া সত্যিই ও শূন্য। ভালোবাসার মানুষটি ছাড়া এই এক সপ্তাহ শতাব্দীসম দীর্ঘ। আরও দীর্ঘ হোক ইসাবেলা চায় না। নিকোলাস তো না ই। তাই তো এখানে আসা ইসাবেলার।

দুপুর এখনও হয়নি। সকালের রোদের তেজে শীতটা একেবারে জবুথবু হয়ে পড়েছে। এতক্ষণ দ্রুত পায়ে হেঁটে আসায় ঘেমে উঠেছে ইসাবেলা। গায়ের সোয়েটার খুলে ফেললে আরাম পাওয়া যেত, কিন্তু সেই সময় যে নেই। কেউ এখানে ওকে দেখলে সমস্যা হতে পারে। স্থানীয়দের ধারণামতে এই কবরস্থানটিতে অশুভ কিছু রয়েছে। রাত তো দূরের কথা দিনের বেলাতেও এদিকে আসা-যাওয়া করে না কেউ৷ একপ্রকার নিষিদ্ধ স্থানটিতে নিরুপায় হয়ে এসেছে ইসাবেলা। সাবধানে গির্জার পলেস্তারা খসা দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। সামনে কবরস্থান। তার মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ক্রুশচিহ্ন। সতেরো বছরের আগের ইসাবেলা হলে এই নিস্তব্ধ, গুমোট এবং মৃতের রাজ্যে আসতে ভয়ে জ্ঞানই হারাত। আজ যে ভয় করছে না তা নয়। বেশ ভয় করছে। কফিনের ভেতরে সবাই তো আর নিকোলাস নয়। ইসাবেলা গলার ক্রুশটা ধরে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে করতে বা’দিকে এগিয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে এটা ও পরে নিয়েছিল। কবরস্থানের চারিপাশে বড়ো বড়ো নানান গাছের সারি। চারটে কবর পেরিয়ে থামল ও। সামনের সমাধিস্তম্ভে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা,
“পিয়েতর গুসেভ
একজন ভাই, একজন পিতা।
(১৮২০-১৮৭৬)
The great art of life is sensation, to feel that we exist, even in pain.– Lord Byron

সমাধিস্তম্ভে লেখা কথাগুলো মনে মনে কয়েকবার আওড়ালো ইসাবেলা। ভ্লাদিমির কাছে একটু আকটু ইংরেজি শেখা। ইদানীং অবসরে ইংরেজি সাহিত্য পড়ছে। আগের তুলনায় ভাষাটা সহজ এখন। লেখাগুলো বেশ ভাবালো ওকে। কোনো এক কারণে এই পিয়েতর লোকটা সম্পর্কে জানার কৌতূহল বাড়িয়ে দিলো। এবার দেখা হলে নিকোলাসকে লোকটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। ইসাবেলা ফ্রকের বুকের কাপড়ের ভেতর থেকে চিঠিটা বের করল। নিকোলাস জার্মানি ফিরে যাওয়ার আগে বলেছিল, বিশেষ প্রয়োজন হলে এই কবরের ডালার ফাঁকে চিঠি রেখে যেতে। সময় মতো নিকোলাস পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। ইসাবেলা ডালার ফাঁকে গুঁজে রাখল চিঠিটা। চোখটা আবার স্তম্ভশীলার নামটার ওপর পড়ল। হঠাৎ একটা প্রশ্ন মাথায় উদয় হলো। পিয়েতর গুসেভও কি পিশাচ? এই শহরেও পিশাচ আছে? গির্জার সামনের দিক থেকে মানুষের গলা শুনে চমকে ওঠে ইসাবেলা। প্রশ্নটা যেভাবে উদয় হয়েছিল সেভাবেই কোথাও মিলিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ও সেখান থেকে সরে এলো। আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল মানুষগুলোকে। এরাও বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাচ্ছে। গির্জার সামনে দিয়ে চলে যাওয়া ইটের রাস্তা ধরে এগোচ্ছে ওরা। দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতে ইসাবেলা বেরিয়ে এলো। তাড়াতাড়ি বাড়ির পথ ধরল ও। সরাসরি বাড়িতে ঢুকলো না। মা ওকে এমন এলোমেলো পোশাক ও ঘর্মাক্ত শরীরে দেখলে হাজারটা প্রশ্ন করবেন। ইসাবেলা মায়ের প্রশ্ন এড়াতে পেছনের দরজা খুলে ঢুকলো। যাওয়ার আগে ভেতর থেকে দরজাটা খুলে রেখে গিয়েছিল। চুপিচুপি জানালা ডিঙিয়ে হলঘর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে এক দৌড়ে নিজের রুমে ঢোকে। ঘামে ভেজা কাপড় পালটে গোসল খানায় গিয়ে গোসল করে নিলো আগে। শরীরে তোয়ালে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে রুমে ঢুকতে মাকে দেখতে পেল। গভীর ভাবনায় বুঁদ হয়ে বিছানার ওপর বসে আছেন। সারাক্ষণ রাশভারি মুখ করে থাকলেও মমতার সূক্ষ্ম ছায়া রয়েছে তাতে। মায়ের ব্যক্তিত্ব ভীষণভাবে আকর্ষণ করে ইসাবেলাকে। এই বয়সে এসেও তিনি যেমন স্মার্ট তেমনই সুন্দরী। বাবা ওলেগ প্রায়ই হেসে বলেন,”তোর মাকে প্রথম দেখেই নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। জীবনে বিয়ে যদি করি তবে একেই করব। তোর মা দয়া করে আমায় বিয়ে না করলে আমি নিশ্চিত সন্ন্যাসী হতাম।”

ইসাবেলার জানে বাবা মজা করে বললেও এ কথার সত্যতা শতভাগ। মাকে ওর বাবা খুব ভালোবাসেন। শুধু রূপের কারণে নয়। আন্না মেরিও আপাদমস্তক গুণবতী রমণী। লোকে বলে রূপবতীদের বুদ্ধি আধুলি সমান। মাকে দেখে ইসাবেলা জেনেছে লোকের সব কথা সত্য হয় না। বুদ্ধি বিচক্ষণতার জোরে এ বাড়ির সর্বেসর্বা আজ ওর মা। এমনকি ওর দাদু-দিদাও বড়ো পুত্রবধূর মতামতকে ধ্রুব বলে মানে। ইসাবেলা নিজেকে যেন মায়ের ঠিক বিপরীত ভাবে। কতবার এই নিয়ে ছোটোবেলা আক্ষেপ করেছে। মা ওকে বুঝিয়েছে , প্রতিটি মানুষের নিজস্ব সত্তা থাকে। আমাদের উচিত নিজের সেই সত্তাটাকে ভালোবাসা। নিজের চোখে যে নগন্য পরের চোখে অনন্য হবে কী করে সে? আরও কতভাবে বুঝিয়েছিল। কিন্তু মায়ের মতো হতে না পারার আক্ষেপ ওর কিছুতেই যায়নি।

“মা?”

“হুঁ?” চকিতে তাকালেন মেয়ের দিকে আন্না মেরিও। যেন ভিন্ন এক জগত থেকে এইমাত্র এখানে এলেন।

“এত কী ভাবছিলে বলো তো?”

“মায়েদের কত ভাবনা থাকে! সে যাক। যেটা বলতে এসেছিলাম।” বলেই দম নিলেন। উঠে দাঁড়ালেন। সদ্য স্নান সেরে আসা মেয়েকে দেখে হতাশ গলায় বললেন,

“আহ! তুই দেখছি গোসল করে নিয়েছিস। ভেবেছিলাম তোকে একটু বেসমেন্টে যেতে বলব।”

“এখন বেসমেন্টে? কোনো বিশেষ দরকার আছে কি সেখানে?”

“তেমনই। কিন্তু তোর তো আর যাওয়া হচ্ছে না। আমাকেই যেতে হবে তাহলে।”

“আমি যাব। কী আনতে হবে বলো।”

তোয়ালের নিচে অন্তর্বাস পরে আলমারি থেকে পুরোনো একটা ফ্রক পরে নিলো ইসাবেলা। আন্না মেরিও একটা ফর্দ সামনে ধরে বললেন,

“এই জিনিসগুলো বেসমেন্টের স্টোরেজ থেকে নিয়ে আসবি। আর একটা নীল দাগের ছোট্ট বাক্স আছে সেটাও নিয়ে আসবি।”

ইসাবেলা ফর্দটা হাতে নিয়ে বলল,

“ঠিক আছে। তাহলে আমি যাচ্ছি।”

মা এবং মেয়ে হলঘরে এসে থামল। আন্না মেরিও আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন কী কী আনতে হবে। তারপর চলে গেলেন নিজের রুমের দিকে। অনেক কাজ পড়ে আছে তাঁর। রাতের ভেতর সব গুছিয়ে নিতে হবে। ইসাবেলা বেসমেন্টে চলে এলো। হাতে ল্যাম্প। স্টোরেজের ঢুকে ল্যাম্প এককোণের উঁচু স্থানে রাখল। প্রথমে ফর্দে লেখা জিনিসগুলো একটা কাঠের বাক্সে ভরলো। কাজটা শেষ হলে মায়ের বলা নীল বাক্সের সন্ধানে নামে। ওটা খুঁজতে গিয়ে সেখানে রাখা একটা বাক্সের ওপর চোখ পড়ল ওর। ধুলোর আস্তরণেও বাক্সের ওপরের নামটা পুরোপুরি ঢেকে যায়নি। ফুঁ দিয়ে হাতের সাহায্যে ধুলো ঝাড়তে নামটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সিস্টার ভ্যালেরিয়া। এই নামটা ইসাবেলাকে বিষণ্ণ করতে যথেষ্ট। বাক্সটা তালাবদ্ধ। বাক্সটা খুলবে না খুলবে না করেও তালা ভাঙবে বলে মনস্থির করে বসে। ভারি পাথুরে একটি বস্তু দিয়ে সহজে তালাটা খুলে ফেললো। যা ভেবেছিল তাই। এতে ভ্যালেরিয়ার ব্যবহৃত জিনিসপত্র রয়েছে। সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে চোখ ভরে এলো ইসাবেলার। একটু পর পুনরায় গুছিয়ে রাখতে গিয়ে হঠাৎ চোখ গেল কালো রঙের একটা ফ্রকের দিকে। ভ্যালেরিয়া এসব পোশাক পরা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। এখানে কেন তাহলে? ইসাবেলা কালো ফ্রকটাতে হাত বুলিয়ে দেখছিল। হঠাৎ কিছু একটা বাধল হাতে। ভালো করে দেখতে বুঝতে পারল শক্ত গোলাকৃতির কিছু হবে। ফ্রকের কাপড়ে এমনভাবে বাঁধা যে খুঁজে পেতে গিয়ে সময় লাগল। নিচের কুচির ভাঁজের সাথে কৌশলে সেলাই করে আঁটকানো বাক্সটা। এত কৌশল করে বাক্সটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে কেন? ইসাবেলা কৌতূহল দমাতে না পেরে বাক্সটা বের করে ছাড়ল। কাপড়টা তাতে ছিঁড়ে গেল। বেজায় খারাপ লাগল ইসাবেলার। ভ্যালেরিয়ার শেষ স্মৃতি নষ্ট হোক চায়নি। মন খারাপ করে চেয়ে রইল লাল মখমল কাপড়ে মোড়ানো বাক্সটার দিকে।

“এই ঘোড়ার ডিমের বাক্সের জন্য আমার ভ্যালেরির জামাটা ছিঁড়ে গেল।” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল ইসাবেলা। যে বাক্সটার জন্য ওর প্রিয় ভ্যালেরির জামা ছিঁড়ল তার রহস্য জেনেই ছাড়বে। চারপাশের লেছ খুলে সাবধানে ওটার মুখ খুললো। এক টুকরো কাগজ ছাড়া ওতে কিছু নেই। এইটুকু কাগজে কী এমন আছে যার জন্য এত রাজকীয় ব্যবস্থা! কাগজটার ভাঁজ খুলে দেখল সেটা একটা ম্যাপ। কিছু সাংকেতিক চিহ্নও রয়েছে তাতে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না ইসাবেলা। কাগজটা আবারো উলটে পালটে দেখল না। না, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

“বেলা, এখনও কাজ শেষ হয়নি তোর?” আন্না মেরিও ওপর থেকে জিজ্ঞেস করলেন।

“এই তো হলো মা।”
মায়ের ডাকে ঘাবরে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে ভ্যালেরিয়ার ব্যবহৃত জিনিসের বাক্সটা বন্ধ করল। তারপর আবার সেই নীল দাগের বাক্স খুঁজছে। তখনই খেয়াল হলো এখনও সেই কাগজটা ওর হাতে। কাগজটা আগের বাক্সে রাখবে বলে এগোয়। তাড়াতাড়িতে পায়ের সাথে কিছু বাধা লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তেও পড়ল না। কিন্তু ওর হাতের ধাক্কায় কাপড়ে ঢাকা বড়ো আয়নাটা ভেঙ্গে পড়ে ফ্লোরে।

“বেলা, কী ভাঙলি?” আন্না মেরিওর গলা উদ্বিগ্ন শোনায়। ইসাবেলা কপাল চাপড়ে নিজেকে মনে মনে বকে। মাকে উদ্দেশ্য করে মিথ্যা বলল,

“তেমন কিছু না মা। এই একটা পুরোনো গ্লাস।”

আন্না মেরিও গলা নামিয়ে কী যেন বললেন। বেসমেন্টের সিঁড়িতে তাঁর হিলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ইসাবেলা এখন কী করবে? সব গুছিয়ে রাখতে গিয়ে ওর চোখ স্থির পায়ের কাছের কাঁচের টুকরোর ওপর। কাগজটা উলটে আছে টুকরোটার ওপরে। সরাতে গিয়ে থমকে যায়। পরিচিত একটা নাম যেন দেখল! কাগজটা আবার উলটে পালটে দেখে৷ না, মনের ভুল। সারাক্ষণ ওকে নিয়ে ভাবছে বলেই হয়তো এমন ভুল হয়েছে। কিন্তু মন মানল না। ভাঙা আয়নার টুকরোটার দিকে ফের তাকাল। হাতের কাগজের টুকরো নিলো ভাঙা আয়নার সামনে। মনের ভুল না। এই তো নামটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ওই যে সাংকেতিক চিহ্ন ওগুলোর মাঝে এই নামটা লুকিয়ে ছিল। আয়নার প্রতিবিম্বে দেখা যাচ্ছে সেটা। নিকোলাসের সাথে এই কাগজের সম্পর্ক কী?

“বেলা।”

স্টোরেজের দরজা ঠেলে আন্না মেরিও ভেতরে ঢুকতে দ্রুত কাগজটা বুকের কাপড়ের নিচে লুকিয়ে ফেললো ইসাবেলা। ওর মাথায় হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কাগজটা ভালো করে দেখতে হবে আরেকবার। যে করেই হোক এর ভেতরের রহস্য উদঘাটন করতে হবে ওকে। জানতে হবে নিকোলাসের নামটি কেন লেখা।

“বেলা, কী হয়েছে?” মেয়ের চিন্তিত মুখ দেখে প্রশ্ন করলেন আন্না মেরিও। জোরপূর্বক হাসল ইসাবেলা। ঢোক গিলে বলল,

“আয়না ভেঙে গেছে মা।”

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে