তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৫৯+৬০+৬১

0
989

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৫৯
Writer তানিয়া শেখ

মা ভিন্ন হলেও একই পিতার ঔরসজাত বলেই হয়তো ভীষণ মিল রয়েছে আন্দ্রেই এবং নিকোলাসের চেহারায়। দীর্ঘদেহি গড়ন, চাহনিতে একই তীক্ষ্ণতা দুইজনের। দুই ভাইয়ের বৈসাদৃশ্য খুঁজতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে দুজনের চোখের রঙ। নিকোলাস নীল চোখের অধিকারী। অপরদিকে আন্দ্রেইর চোখের রঙ ওর মায়ের মতো, ফিরোজা। দুই ভাইয়ের বয়সের ব্যবধান আন্দাজ করা মুশকিল। আন্দ্রেই যখন পিশাচে পরিণত হয় তখন ও সদ্য কৈশোর পেরোনো যুবক। পিশাচদের দৈহিক বয়স বাড়ে না। তবে মনোগতভাবে সময়ের সাথে সাথে ওরা আর সবার মতো পরিণত হয়। কিশোর সুলভ দেহে পরিবর্তন এনেছে আন্দ্রেই। শরীরচর্চা করে নিয়মিত। পেশিবহুল দেহ, সেমি লং চুলের কাট, খোঁচা দাড়ি আর পোশাক পরিচ্ছদের কারণে বয়সের তুলনায় বেশ বড়োই মনে হয় এখন ওকে। দুই ভাইয়ের অন্যতম বৈসাদৃশ্য ছিল আন্দ্রেইর তুলনায় নিকোলাস বড়ো বেশি নির্মম আর হিংস্র। কিন্তু আজ সেটা অতীত। আজ আন্দ্রেই নির্মমতার নতুন ইতিহাস গড়েছে। এক মুহূর্তে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে বেনাস নীলসনের প্রাসাদসম বাড়িটিকে। ভিক্টোরিজাকে নিজের সহচরী বানিয়েছে। এই সবকিছুর মূলে কিছু কারণ অবশ্য রয়েছে। প্রথম কারণ নিকোলাসের কাছ থেকে ইসাবেলা নামক দুর্বলতাকে সরানো। নিকোলাস এখানে থাকলে সেটা অসম্ভব ছিল। তাই তো জরুরি প্রয়োজন দেখিয়ে সুকৌশলে নিকোলাসকে জার্মানি পাঠিয়েছে। এখন ওর পথে আর কোনো বাধা নেই। নিকোলাস ফেরার আগে ইসাবেলাকে এখান থেকে বহুদূরে পাঠিয়ে দেবে। নিকোলাসের ধরাছোঁয়ার বাইরে। একটা মেয়ে মানুষের জন্য কত দিনই বা শোক করবে ওর ভাই? একমাস? এক বছর? কিংবা আরো কিছুদিন। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।

“আন্দ্রেই!”

ইসাবেলার ভীত গলার স্বর পুনরায় শুনল আন্দ্রেই। মেয়েটার মুখ ভয়ে সাদাটে হয়ে গেছে। আন্দ্রেই ধীর পায়ে ওর দিকে এগোয়। ওকে এগোতে দেখে পিছিয়ে যায় ইসাবেলা। কী করবে ইসাবেলাকে আন্দ্রেই? মেরে ফেলবে? ইসাবেলার রক্তের স্বাদ এখনও জিহ্বায় লেগে আছে। আন্দ্রেইর শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। ফিরোজা চোখের মণি রক্তের নেশায় লাল হয়ে ওঠে। আন্দ্রেইর মনে পড়ে ইসাবেলার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতি।পরিচিত মহলে ক্যাসানোভা বলেই খ্যাত আন্দ্রেই। নারীদের মন আর দেহ নিয়ে খেলা ওর শখ, অভ্যাস। মা এবং ছোটোবোন নোভা ছাড়া কোনো মেয়েকে ও সম্মান করে না। নারীমাত্রই ওর কাছে দৈহিক চাহিদার নামান্তর। ইসাবেলাকে ও সেদিন তেমনই করে স্পর্শ করেছিল। আজ সেই ইসাবেলা ওর ভাইয়ের প্রেমিকা। থমকে দাঁড়ায় আন্দ্রেই। কেন যেন অস্বস্তি হচ্ছে এখন ইসাবেলার মুখ দেখে। নিকোলাস নিষ্ঠুরতার দিক দিয়ে মেয়ে-ছেলের বৈষম্য করে না। কিন্তু আন্দ্রেই ভিন্ন। ও প্রেমিক পুরুষ। মারলেও ভালোবেসে বড়ো আদর করে মারে। ইসাবেলার ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না। সুতরাং আজ ইসাবেলাকে সে নিকোলাসের নিয়মেই মারবে। ও যখন ইসাবেলাকে মারবে বলে মনস্থির করেছে ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ সজোরে আঘাত করল মাথায়। ভুরু কুঁচকে পেছন ফিরে দেখল চশমা পরা এক যুবক ভীত মুখে দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। যুবকের গলা চেপে ধরতে গিয়ে থেমে যায়। যুবকের গলার রোজারিওতে ঝুলন্ত ক্রুশটা ওকে থামতে বাধ্য করে। রাগে গজগজ করে পিছিয়ে যায় তিন কদম।

ইসাবেলা আন্দ্রেইর এই আগমনের কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। কী চায় ও? আন্দ্রেইর রাগত মুখে ক্রূর হাসি দেখা গেল। ইসাবেলার গলা শূন্য। আন্দ্রেই চোখের নিমেষে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

“কী চাই আমি? তোমার মৃত্যু।”

ইসাবেলার প্রশ্নবিদ্ধ মুখ চেয়ে মনে মনে হাসল আন্দ্রেই। তারপর বলল,

“তোমাকে মরতে হবে ইসাবেলা। আমার ভাইয়ের ভালোর জন্য তোমাকে মরতে হবে।”

আচমকা গলা চেপে ধরে। ইসাবেলা ওর হাত থেকে গলা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ওর মৃত্যুতে নিকোলাসের কী ভালো হবে? কেন বলল এ কথা আন্দ্রেই? আন্দ্রেই ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। ইসাবেলা খুক খুক করে কাশতে কাশতে বলল,

“আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে আন্দ্রেই।”

“বেশ। আরেকটু পর একেবারে নিভে যাবে তোমার প্রাণ প্রদীপ। এই তো চাই আমি।”

আরো জোরে গলায় চাপ দেয় আন্দ্রেই। ইসাবেলা শ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করছে। মাতভেই কী করবে ভেবে না পেয়ে খালি হাতে এগিয়ে এলো। ইসাবেলা হাত নাড়িয়ে ওকে থামাতে চায়। মাতভেইর কিছু হলে তাশা পিতৃহীন হয়ে যাবে। তাতিয়ানার হয়তো সংসার হবে না। মাতভেইর পাওয়া হবে না প্রিয়তমাকে, জানা হবে না পুতুলের মতো একটি কন্যা আছে ওর। মাতভেই হয়তো ইসাবেলা ছাড়া তখন আর কিছুই ভাবেনি। আন্দ্রেইর চোয়ালের একপাশে সজোরে ঘুষি বসাতেই অদৃশ্য হয়ে যায় আন্দ্রেই। ইসাবেলা দপ করে মেঝেতে পড়ে। খুক খুক করে কেশে ওঠে। হা করে জোরে জোরে শ্বাস প্রশ্বাস নেয়। ভয়ে কাঁপছে রীতিমতো। ভয়কে এখনো জয় করে উঠতে পারেনি ইসাবেলা। কোন মানুষই হয়তো পারে না। নয়তো এই হাতে ও ইভারলি, গ্যাব্রিয়েল্লাকে একদিন নির্ভয়ে মেরেছিল। কিন্তু আজ আন্দ্রেইর সামনে দাঁড়িয়ে ভয় কাটাতে পারছে না কেন? মাতভেই হতবুদ্ধি হয়ে রইল কিছুক্ষণ। ওই যুবক মুহূর্তে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল? পুরো রুমটা ঝড়ের তান্ডবে তছনছ। মাদামের মৃতদেহ খাটের এককোণে পড়ে আছে। মাতভেই ইসাবেলাকে তুলতে ইসাবেলা দুহাতে জড়িয়ে ধরল। বিড়বিড় করে বলে,

“তুমি পালাও মাতভেই, পালাও।”

মাতভেই শুনতে পেল। অঞ্জলি ভরে ওর আর্ত মুখটা তুলে বলল,

“তোমাকে একা রেখে কোথাও যাব না আমি।”

“তোমাকে বাঁচতে হবে মাতভেই।”

“বাঁচলে দু’জনই বাঁচব নয়তো মৃত্যু ভালো।”

ইসাবেলা ওর চোখে চেয়ে চোখের জল ছেড়ে দিলো। আজ নিজেকে বড্ড দুর্বল মনে হচ্ছে। মাদাম আদলৌনার মৃত্যুতে শোকাভিভূত ও। শোক সবসময় শক্তি হয় না। মাতভেইর বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“আমি মরতে চাই না মাতভেই। কত কী দেখার বাকি আমার। তোমাকে আর তাতিয়ানাকে একসাথে দেখতে চাই। আরো একজন আছে যাকে দেখলে তুমি হয়তো বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে আনন্দে। আমি তোমার সেই আননঘন মুহূর্তের সাক্ষী হতে চাই মাতভেই। ও মাতভেই, আমি যে এখনও নিকোলাসকে বলিনি আমার মনের কথা। বলিনি আমি ওকে ভালোবাসি। আমি এখনই মরতে চাই না মাতভেই। নিকোলাসকে ভালোবাসাময় পৃথিবী না দেখিয়ে মরতে চাই না আমি।”

“তোমার কিছু হবে না বেল। আমি আছি তো।” মাতভেই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চোখ ছলছল করছে। ও কী পারবে ইসাবেলাকে বাঁচাতে? হঠাৎ পাশ থেকে কারো হাত তালিতে চমকে তাকায় দুজন। আন্দ্রেই আবার ফিরে এসেছে।

“চমৎকার দৃশ্য। কিন্তু আপসোস বেশিক্ষণ এই দৃশ্য স্থায়ী হবে না। অন্তিম যাত্রার সময় হলো। পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নাও।” ওদের দিকে রহস্যময় হাসি হেসে ডাকল,

“রিজা।”

পলকেই অদৃশ্য এক শক্তি ইসাবেলাকে মাতভেইর বুকের ওপর থেকে টেনে ছুঁড়ে ফেলে দরজার মুখে। মেঝেতে আছরে পড়ে ইসাবেলার দেহ। তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে। মাতভেই ওকে বাঁচাতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। কালো ধোঁয়া ক্রমশ ইসাবেলার বুকের ওপর জড়ো হচ্ছে। ক্ষণিকের মধ্যে সেটা একটা নারী অবয়ব নিলো। কাজিন হওয়ার সুবাদে ভিক্টোরিজাকে ও আগে থেকেই চিনত। আজও চিনতে ভুল হলো না। কিন্তু আগের দেখার ভিক্টোরিজা আর এই ভিক্টোরিজাতে মিল কোথায়? এ যে হিংস্র এক ডাইনিতে পরিণত হয়েছে। ইসাবেলার বুকের ওপর বসে লোলুপ চোখে চেয়ে আছে। রক্তিম ঠোঁটের দুপাশে চকচক করছে ধারালো দুটো সাদা সূঁচালো দাঁত। এই একই দাঁত এই যুবকেরও আছে। তবে কী এও পিশাচ? মাতভেই আন্দ্রেইর দিকে ঘুরতে আন্দ্রেই ওর একেবারে সন্নিকটে এসে দাঁড়ায়। মাতভেই কিছু বুঝে ওঠার আগে ওকে সম্মোহিত করে ফেলল। চাইলেও এখন আর একচুল নড়তে পারছে না মাতভেই। আন্দ্রেই ওর ঘাড় ধরে মুখটা কানের কাছে নিয়ে বলে,

“হ্যাঁ, পিশাচ আমি। রক্তপিশাচ।” মাতভেইকে কিছু ভাবার অবসর না দিয়ে শ্বদন্ত ফুটিয়ে দেয় ওর গলার কাছে। ব্যথায় গোঙানি দিয়ে ওঠে মাতভেই। মাতভেইর রক্ত গলায় যেতে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন আন্দ্রেইর শরীরে। মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। ওর গলায় উজ্জ্বল এক দ্রুতি দেখা গেল। ভীষণ অদ্ভুত অনুভূতি হলো ওর। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো মাতভেইর দেহটাকে মেঝের ওপর। পড়ামাত্রই অচৈতন্য হলো। গলা জ্বলছে আন্দ্রেইর। শব্দ করে কয়েকবার গলা ঝাড়ল। না জ্বলুনি কমছেই না। মাতভেইর দিকে ক্রোধিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। এই মানবের রক্তে কি লঙ্কা মেশানো? এত জ্বলছে কেন গলা? ঝড়ো হাওয়ার কারণে শূন্যে ভাসমান দ্যুতিময় পাপড়িবিচ্ছিন ফুলটা ছাঁদের সাথে লেগে ছিল। সবার অলক্ষ্যে একটা একটা করে শুকিয়ে যাচ্ছে এখন। শুকনো পাপড়িগুলো ভস্মীভূতের ন্যায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল একটা পর একটা। বাকি রইল পুষ্পবৃন্ত। সবুজ রঙের পুষ্পবৃন্তটি শুকিয়ে শূন্যে ভাসতে ভাসতে সেটি নেমে এলো নিচে। পড়ল ঠিক আন্দ্রেইর পায়ের কাছে। আন্দ্রেই খেয়াল করল না। পাশ কাটিয়ে চলে এলো মাতভেইর অচেতন দেহের সামনে। এই পর্যন্ত কত মানুষের রক্তই তো ও পান করল৷ কোনোদিন এমন গলা জ্বলেনি। আন্দ্রেই ভাবনায় পড়ল।

ইসাবেলা ভিক্টোরিজার এই রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে রইল। প্রথমে মাদাম আদলৌনার মৃত্যু, এখন আবার ভিক্টোরিজার পিশাচরূপ দেখে মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। হঠাৎ ভাবে, বাড়ির বাকিরা ঠিক আছে তো? মনে পড়ে দরজার বাইরে শোনা সেই আর্তনাদ। এখন এই বাড়িটা নিস্তব্ধতা এক মৃত্যুপুরী মনে হতে লাগল ওর কাছে। এই মৃত্যুপুরীতে কেবল ও আর মাতভেই বুঝি বেঁচে আছে। মাতভেই! ভিক্টোরিজা আক্রমণ করতে উদ্যত হলে ইসাবেলা সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। ডাইনিদের শরীরে অসুরের শক্তি। ইসাবেলা পরাজিত হওয়ার পথে। হঠাৎ ওর নজর যায় একটু দূরের মেঝেতে। মাতভেইর গলার রোজারিও ছিঁড়ে পড়ে আছে। কীভাবে ছিঁড়ল ওটা? বোধহয় ভিক্টোরিজা ওকে মাতভেইর বুক থেকে টেনে আনার সময় অসাবধানে ইসাবেলার হাতের টানে ছিঁড়ে গেছে। মাতভেইকে খুঁজতে লাগল। জানালার পাশের মেঝেতে পড়ে আছে ওর অচেতন দেহ। ওর দেহ খানিক আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে আন্দ্রেইর দীঘল দেহ। ও কী মেরে ফেলল মাতভেইকে? ইসাবেলা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে,

“মাতভেই, মাতভেই!”

না কোনো সাড়া নেই। ভিক্টোরিজা জিতে গেল। দাঁত বসিয়ে দিলো ওর ঘাড়ের কাছে। ইসাবেলা কী করবে এখন? মৃত্যুকে বরণ করে নেবে? এই জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে একজনকেই ওর মনে পড়ল। অস্ফুটে ডাকল,

“নিকোলাস।”

বন্ধ চোখে ভাস্বর হয় নিকোলাসের হাসিমুখ, ওর সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো। আর ওকে দেখবে না ভাবতেই সশব্দে কেঁদে ওঠে। এই জনমে বুঝি অপূর্ণই রয়ে গেল ওদের প্রেম। না, এভাবে মরবে না ও। শেষ লড়াইটা করবে ইসাবেলা।জামার ভেতরে কাঠের সূচালো টুকরোটা এখনও আছে। ভিক্টোরিজাকে মারতে ওর বড়ো কষ্ট হবে। অল্প সময়ে খুব কাছের মানুষদের একজন হয়ে উঠেছিল ও। মনকে সান্ত্বনা দিলো এই বলে যে, এ ওর চেনা সেই ভিক্টোরিজা নয় রক্তপিপাসু এক ডাইনি। চোখ মেলে গভীর শ্বাস নিলো। তারপর জামার ভেতর থেকে বের করে আনে কাঠের টুকরো। ঢুকিয়ে দিলো ভিক্টোরিজার হৃদপিণ্ড বরাবর। আর্তচিৎকারে ছিটকে সরে পড়ল দূরে। বেশ খানিক রক্ত পান করেছে। বড্ড দুর্বল লাগছে ইসাবেলার শরীর। আন্দ্রেই এদিকে আসার আগেই কোনোরকমে রোজারিও হাতে তুলে নেয়। রাগে হিংস্র হায়েনার মতো গর্জন করে আন্দ্রেই। ভিক্টোরিজার কাছে ঘেঁষতে পারছে না। কাঠের টুকরো এখনও ভিক্টোরিজার বুকের মধ্যে গেঁথে আছে। ইসাবেলা এই সুযোগ নিলো। থলেটা কাছাকাছি কোথাও পেল না। খালি হাতেই ও গিয়ে দাঁড়ায় ভিক্টোরিজার পেছনে। ইসাবেলার সাথে পেরে ওঠে না ভিক্টোরিজা। এক হাত ওর থুতনি নিচে রাখল আর অন্য হাতে গলা জড়িয়ে ধরে। আন্দ্রেই ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে চোখ রাঙিয়ে বলে,

“খবরদার ইসাবেলা।”

“তোমার মা আমারই সামনে আমার ভ্যালেরিয়াকে মেরেছে। আর আজকে তুমি আমার ভাগ্নির বাবাকে মারলে। খবরদার করছ? না শুনলে মেরে ফেলবে? বেশ তাই কোরো। নিকোলাস তোমাকে ছাড়বে না আন্দ্রেই। শেষ করে ফেলবে তোমাকে ও।”

আন্দ্রেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

“বোকা মেয়ে। তোমার ধারণা ও তোমাকে ভালোবাসে? হাসালে। পিশাচরা নিজেকে ছাড়া কাওকে ভালোবাসে না। তোমাকে তো ও স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছে৷”

“তুমি বললে আর আমি বিশ্বাস করে নিলাম, হুম? আমার বিশ্বাস এত ঠুনকো না আন্দ্রেই।”

আন্দ্রেই বিছানার একপাশে এসে বসল। পায়ের ওপর পা তুলে গলায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“ঠুনকো নয় তবে অন্ধ। তুমি ভালো করেই জানো ও তোমার বংশকে ঘৃণা করে৷ জানো না বলো?”

“আমাকে ভালোবাসে ও।”

“মুখে বলেছে কখনও?”

ইসাবেলা জবাব খুঁজে পেল না সহসা৷ আন্দ্রেইর ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি দেখা দিলো। ইসাবেলা কপট রাগে বলল,

“সবকিছু মুখে বলার প্রয়োজন পড়ে না আন্দ্রেই। আমি জানি নিকোলাস আমাকে ভালোবাসে।”

“ভ্রম তোমার। যে ভালোবাসে সে প্রকাশ না করে থাকতেই পারে না। নিকোলাস কোনোদিন তোমাকে ভালোবাসেনি আর না বাসবে৷ ও তোমাকে হাসিল করে ড্যামিয়ানকে শিক্ষা দিতে চায়। ড্যামিয়ানকে চেনো তো? আমি শতভাগ নিশ্চিত আমার চেয়ে বেশ ভালোভাবেই চেনা আছে ওকে তোমার। ঠিক বলেছি না ইসাবেলা?”

“স্টপ!”

আন্দ্রেই দু হাত শূন্যে তুলে মেকি অনুতাপের ভঙ্গিতে বলে,

“ওকে আ’ম সরি। রিয়েলি।”

“বাস্টার্ড, প্রথমে ভিক্টোরিজাকে শেষ করব। তারপর তোর ধড় থেকে গলাটা আলাদা করে নরকে পাঠাব তোকে আমি।”

“ওহ! আমি সত্যি ভয় পেয়েছি ইসাবেলা, সত্যি!”

মেকি ভয়ের মুখোশ ছেড়ে দাঁত বের করে হাসল আন্দ্রেই। রাগে মুখ লাল হয়ে ওঠে ইসাবেলার। ওর এই হাসি মুছে দেবে ইসাবেলা। ভিক্টেরিজার ধড় থেকে গলাটা আলাদা করে ছুঁড়ে ফেলে আন্দ্রেইর পায়ের কাছে। সোজা হয়ে বসল আন্দ্রেই। চোয়াল শক্ত করে চাইল ইসাবেলার কঠিন মুখের দিকে। রুমের এককোণে নিভু নিভু হ্যারিকেন এনে আগুন ধরিয়ে দিলো ভিক্টোরিজার মাথা বিহীন দেহে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। আন্দ্রেই ভিক্টেরিজার মাথাটা হাতে তুলে ফুটবলের মতো আঙুলের ওপর ঘুরিয়ে বলল,

“তোমার কী ধারণা এই মেয়ের মৃত্যুতে আমার কিছু এসে যায়? না, না। মেয়েদের দেহ আর রক্ত ছাড়া আর কিছুতেই এই আন্দ্রেইর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ও আমার পেয়াদা ছিল। ওর কাজ শেষ। এখন ও থাকল কি নরকে গেল তাতে আমার বয়েই গেল।”

ভিক্টোরিজার মুন্ডুটা ছুঁড়ে মারল ওর দেহ পোড়া জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। ভিক্টোরিজার চোখ খোলা। আগুনে পুড়তে পুড়তেও ওই দুজোড়া চোখ যেন ইসাবেলাকেই দেখছে। ভীষণ কান্না পেল ইসাবেলার। কিন্তু কাঁদল না। ক্ষুব্ধ চোখে তাকাল আন্দ্রেইর দিকে। বলল,

“এমনই করে তুমিও একদিন জ্বলবে আন্দ্রেই। ঠিক জ্বলবে।”

“তোমার অভিশাপ বৃথা গেল। তোমার বলার আগেই জ্বলছি।” গলায় হাত বুলিয়ে বিরক্ত মুখে মনে মনে ভাবল। ইসাবেলা মাতভেইর অচেতন দেহের দিকে পা বাড়াতে আন্দ্রেই হাওয়ায় মিশে ওর কাছে আগে পৌঁছায়। ভিক্টোরিজাকে যেভাবে ধরে মাথা আলাদা করেছিল, তেমনইভাবে মাতভেইকে ধরেছে। ইসাবেলা আতঙ্কিত হয়ে থেমে যায়। আন্দ্রেই হাসে।

“ওকে আমি এখনও মারিনি ইসাবেলা। কেন জানো? কারণ আমার শিকার ও নয় তুমি। সিদ্ধান্ত এবার তোমার। হয় তুমি নয় ও।”

“ওকে তুমি মারবে না আন্দ্রেই।”

“আচ্ছা?” থুতনির নিচে চাপ দিয়ে মাথাটা পেছনে ঠেলতে ইসবেলা চেঁচিয়ে ওঠে,

“আমাকে মেরে ফেলো। ওকে ছেড়ে দাও প্লিজ।”

আন্দ্রেই ইসাবেলার হাতে প্যাঁচানো রোজারিওর দিকে তাকাতে ইসাবেলা ইতস্তত করে। মাতভেইর গলায় ফের টান পড়তে হাত থেকে খুলে ফেলে ওটা। সেকেন্ড সময়ও লাগে না মাতভেইকে ছেড়ে ইসাবেলার কাছে আসতে আন্দ্রেইর। গলা চেপে ধরে গর্জে ওঠে,

“এখন তুমি মরবে। তৈরি হও পরপারে যাবার জন্য।”

ইসাবেলার শ্বাসরোধ হয়ে আসে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে,

“মৃত্যুর পূর্বে সত্যি বলবে আমায় আন্দ্রেই? নিকোলাস সত্যি কি ভালোবাসেনি আমাকে?”

আন্দ্রেইর হিংস্র চোখজোড়া এক মুহূর্তের জন্য নমনীয় হয়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে পূর্বের রূপ ধরে বলে,

“সত্যি জেনে মরলে কি শান্তি হবে তোমার?”

“খুব হবে।”

আন্দ্রেই কেন যেন মিথ্যা বলতে পারল না।

“হ্যাঁ, ভালোবাসে ও তোমাকে। তোমার জন্য বদলে যাচ্ছে আমার ভাই। আমি চাই না ও বদলাক। তাই তো তোমাকে ওর কাছ থেকে দূর করব।”

ইসাবেলা আনন্দে কাঁদল। আন্দ্রেইর চোখে চোখ রেখে নির্ভয়ে বলল,

“তবে মারো আমায়। আমিও দেখতে চাই আমার মৃত্যু আমাদের মাঝে দুরত্ব আনতে পারে কি না। দূর করতে পারে কি না আমাকে নিকোলাসের কাছ থেকে। তুমি ভালোবাসোনি আন্দ্রেই। তাই জানো না এর শক্তি। দেহের সীমানা ছাড়িয়ে বহু উর্ধ্বে উঠে গেছে আমাদের প্রেম। আমাদের আত্মা ভালোবাসার রজ্জুতে পরস্পরের সাথে বাঁধা। আজ তুমি আমার কথা বুঝবে না আন্দ্রেই। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, এই দিন তোমারও আসুক। ভালোবাসা তোমারও হোক, প্রেম তোমার হৃদয়েও দোলা দিক।”

“চুপ করো, চুপ করো।” আন্দ্রেই গলায় চাপ দিতে ইসাবেলা কাশতে লাগল। ওর মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। তবুও হেসে বলে,

“এত ভয় প্রেমকে তোমার? প্রেম তোমার হবে আন্দ্রেই, নিশ্চয়ই হবে।”

আন্দ্রেই ওকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সামনে। চিৎকার করে বলে,

“প্রেম ভালোবাসা কোনোদিন হবে না আমার। ওসব কেবল দুর্বলদের হয়। আমি দুর্বল নই, শুনেছ তুমি?”

ইসাবেলার চোয়াল চেপে ধরে আবার বলে,

“তোমার মৃত্যু নিকোলাস আর তোমার মাঝের দুরত্ব ঘুচাবে না? ভুলবে না ও তোমাকে?”

“কোনোদিন না।”

“ছয় মাসও লাগবে না তোমাকে ভুলতে ওর। বিশ্বাস হয় না? ঠিক আছে, তবে আমি দেখিয়ে দেবো তোমাদের এসব থিয়েটারি প্রেম ভালোবাসার স্থায়িত্ব। বুঝিয়ে দেবো দুর্বল এক আবেগ এই ভালোবাসা। চোখের আড়াল হলেই যার অস্তিত্ব বলে কিছু থাকে না। মারব না আমি তোমাকে। কিন্তু এখানেও থাকতে দেবো না। নিকোলাসের কাছ থেকে বহুদূরে চলে যাবে তুমি। তোমার দেশ রাশিয়াতে।”

“না, নিকোলাসকে ছেড়ে আমি যাব না।”

“অবশ্যই যাবে। মাতভেইকে বাঁচাতে হলে যেতেই হবে তোমাকে। চাও না ও বাঁচুক? চাও না তাতিয়ানার সংসার হোক। তাশা পিতৃপরিচয়ে পরিচিত হোক? চাও না ইসাবেলা?”

“তোমার দোহাই লাগে আন্দ্রেই। এত নিষ্টুর হয়ো না। নিকোলাসকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা যে মৃত্যুসম।”

“এই তো চাই আমি। তিলে তিলে তুমি মরো। তারপর যেদিন দেখবে নিকোলাস তোমাকে ভুলে গেছে সেদিন একেবারে মরবে। আমার বিশ্বাস সেদিন যথার্থ অর্থেই মৃত্যু হবে তোমার এবং তোমার বিশ্বাসের। এতেই তো আমার জিত।”

“তুমি পাষাণ, নির্মম। আমাদের কর্ম আমাদের দিকেই ফিরে আসে আন্দ্রেই। আজ আমাকে অসহায় পেয়ে যা করছ একদিন এর উচিত শাস্তি তুমি পাবে। সত্য চাপা থাকে না। নিকোলাস একদিন ঠিক জানতে পারবে। সেদিন ভাইকে মুখ দেখাতে পারবে তো আন্দ্রেই?”

আন্দ্রেইর নিস্পৃহ গলায় বলল,

“আমার চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। বলো শর্ত মানবে কি না। মৃত্যু তোমার অবধারিত। বলো কোনভাবে মৃত্যু চাও? পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়ে না এখনই মাতভেইকে সাথে নিয়ে?”

ইসাবেলা জানে আন্দ্রেইকে অনুরোধ করে আর লাভ হবে না। ওর হৃদয় পাথর। ওতে মাথা কুটলে ব্যথাই জুটবে। এখনই মরবে না ও। নিজের ভালোবাসার ওপর আস্থা আছে। নিকোলাস ওকে ঠিক খুঁজে নেবে। সত্যিই যদি ইসাবেলাকে ও ভালোবেসে থাকে তবে দেখা আবার হবেই ওদের। ততদিন ইসাবেলা অপেক্ষা করবে। আন্দ্রেই অদৃশ্য হয়ে যায়। মাতভেই এখনও অচেতন। ইসাবেলা ওর মাথাটা কোলের ওপর নিয়ে নীরবে চোখের জলে মুখ ভাসালো। আন্দ্রেই কিছুক্ষণ পরই ফিরে এলো। বাইরে কোচওয়ানসহ ফিটন দাঁড়ানো। আন্দ্রেইর লোক কোচওয়ান। ইসাবেলা এবং মাতভেইরকে নিরাপদে রাশিয়া পৌঁছে দিয়ে আসবে সে। আন্দ্রেই মাতভেইকে কাঁধে তুলে হাওয়ায় মিশে গেল। অসাড় দেহে উঠে দাঁড়ায় ইসাবেলা। শেষবার মাদাম আদলৌনার মুখটা দেখে দু ফোঁটা চোখের পানি ফেলল। টলতে টলতে রুমে বাইরে এলো। হলঘরে পড়ে আছে জাস্টিনা সহ এ বাড়ির কয়েকজন ভৃত্যদের মৃতদেহ। এদের জন্য খারাপ লাগল। ইসাবেলা বাইরে ফিটনের সামনে গিয়ে থামে। আন্দ্রেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইসাবেলার পা চলতে চায় না। ফিটনে উঠলে নিকোলাসের কাছ থেকে দূরে চলে যাবে। ও ভালোভাবেই জানে আন্দ্রেই নিকোলাসকে বিভ্রান্তকর তথ্য দেবে। রাশিয়া যাওয়ার কথা হয়তো বলবেই না। নিকোলাস কি সত্যিটা জানবে আদৌ? না, বিশ্বাস হারাবে না ইসাবেলা। ওদের ভালোবাসা এত দুর্বল নয়। এত সহজে ভুলে যাবে না নিকোলাস ওকে। ওদের মন ঠিকই একে অপরকে কাছে টেনে আনবে। ইসাবেলা শেষবার বেনাসের বাড়িটিতে চোখ বুলিয়ে ফিটনে উঠে বসে। কোচওয়ান ঘোড়ার পিঠে চাবুক চালাতে সামনে ছুটে চলে ঘোড়া। রাত্রির শেষ প্রহর শেষ হতে চলল। ইসাবেলা ফিটনের জানালা দিয়ে বেনাসের বাগানটা দেখে। কত স্মৃতি ভেসে ওঠে! হাঁটুতে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদে উঠল ও। ঘোড়ার খুরে মিশে ওর কান্না রাত্রির অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। পেছন ফিরল আরেকবার বেনাসের বাড়ির দিকে। ওর চোখ বিস্ফোরিত হয়ে যায় জ্বলন্ত বাড়িটিকে দেখে। ওদের থাকার রুমের খোলা জানালা অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। একটা ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। আন্দ্রেই!

ইসাবেলাকে নিয়ে ফিটনটি অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে আন্দ্রেই এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। মেঝেতে পড়ে থাকা মৃদু আলোর একটা জিনিস চোখে পড়তে থেমে গেল। ঝুঁকে হাতে তুলে নেয়। আশ্চর্য! ওর গলার জ্বলুনি একদম সেরে গেল। হাতের জিনিসটা ভালো করে লক্ষ্য করল ও। দেখতে শুকনো পুষ্পবৃন্ত মনে হলেও বেশ ভারী এটি। পাথরটি অনুজ্জ্বল সবুজ রঙের। নীলকান্তমণি নয়তো তো? কিন্তু আকারটা কেমন যেন। এসব পাথর দিয়ে ওর কী কাজ? ফেলে দিলো জানালার বাইরে৷ ওটা ফেলামাত্রই আবার সেই গলা জ্বলা শুরু হলো। এদিকে আগুন এই রুমকেও ঘিরে নিয়েছে। আন্দ্রেই জানালার বাইরে বেরিয়ে এলো। পাথরটা খুঁজতে শুরু করে। কী বিরক্তিকর অবস্থা! এখন কী ওকে এসব পাথর গলায় ঝুলিয়ে থাকতে হবে না কি? পাথরটা পেয়ে গেল বরফের ভেতর। হাতে নিতে গলা জ্বলা গায়েব। বড়ো অদ্ভুত লাগল ব্যাপারটা। এই পাথরের সাথে গলা জ্বলুনির সম্পর্ক কী? সম্পর্ক খুঁজে পাক আর না পাক বাধ্য হয়ে এই পাথর ওকে কাছে রাখতেই হবে৷ সামান্য একটা পাথরই তো। এ অনায়াসে রাখতে পারবে আংটি বানিয়ে কিংবা গলার লকেট করে। পাথরটা দেখতেও তো বেশ। পকেটে পুরে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো ও। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। আগামীকাল কত কাজ ওর।

চলবে,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬০
Writer তানিয়া শেখ

আন্না মেরিও বসার ঘরের মুখে এসে দাঁড়ালেন। উদাস, বিমর্ষ মুখে জানালার বাইরে একদৃষ্টে চেয়ে আছে ইসাবেলা। কোলের ওপর বইটি খোলা। মেয়ের বিমর্ষতা আন্না মেরিওকে কষ্ট দেয়, ভাবিয়ে তোলে। গত এক বছর মেয়েকে হারিয়ে কেঁদে কেঁদে প্রহর কেটেছে। পিটারের দেওয়া কষ্টে মেয়েটা যখন বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল, বুকে পাথর রেখে ভ্যালেরিয়াকে অনুরোধ করেছিলেন মেয়েটাকে সাথে নেওয়ার জন্য। মেয়েকে বাঁচাতে তখন ওই একটা পথই দেখেছিলেন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না তাঁর পক্ষে। ইসাবেলাকে তিনি কাছ ছাড়া করতে ভয় পান। ছোটোবেলা একবার কাছ ছাড়া করে চরম ভুল করেছিলেন। আজও ভীত হন সেই দিন স্মরণ করলে। মেয়েকে বাঁচাতে সেদিন ভয়টাকে গিলতে হয়েছিল। কিন্তু হজম করতে পারেননি। ইসাবেলা চলে যাওয়ার পর আন্না মেরিও একটা রাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারেননি, এক মুহূর্ত তাঁর স্বস্তিতে কাটেনি। হঠাৎ একদিন ভ্যালেরিয়ার মৃত্যুর খবর এলো। সেই সাথে এলো ইসাবেলার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ। পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন আন্না মেরিও। বোনের মৃত্যু ও মেয়ের নিখোঁজ সংবাদ তাঁকে শোকাভিভূত করল। ওলেগ ছেলেকে সাথে করে কনিষ্ঠ কন্যার খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। ফিরে এলেন শূন্য হাতে। আন্না মেরিও খেয়াল করলেন তাঁর স্বামী সারাক্ষণ কী এক ভয়ে ভীত থাকে। অজানা এক ভয় তাঁকেও আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। ওলেগ সেই ভয়টাকে সেদিন বাড়িয়ে দিলেন।
আন্না মেরিওর বংশের প্রতিষ্ঠা পুরুষ ছিলেন একজন নেকড়ে লিডার। কিন্তু তিনি বিয়ে করেন সাধারণ মানবীকে। মেয়েটি জন্ম দেয় তিনটি সন্তান। একটি মেয়ে দুটি ছেলে। এঁরা প্রত্যেকে অর্ধ মানব অর্ধ নেকড়ে। তাঁদের প্রত্যেকের বিয়ে কোনো এক কারণে মানুষের সাথেই হয়। এভাবেই বংশ এগোতে লাগল। অর্ধ মানব থেকে ক্রমশ পুরোপুরি মানুষ হয়ে জন্মাতে লাগল পরবর্তী প্রজন্ম। কিন্তু তাঁদের রক্তধারায় নেকড়ের রক্তপ্রবাহ ঠিকই রয়ে গেল। কারো বেশি কারো-বা কম। কম বা বেশি থাকলেও সেটাকে অর্ধ মানব অর্ধ নেকড়ে বলা যায় না। আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতোই তাঁরা। এঁদের মধ্যে কয়েকজন ছিল লোভী ও অসৎ প্রকৃতির। মানব জীবন যেন তাঁদের ছোটো করত। গর্বের মনে করে নেকড়ে হওয়াকেই। নেকড়ে জীবন পেতে জড়োপাসক গ্রহণ থেকে শুরু করে নরবলির মতো জঘন্য কাজও তাঁরা করেছে। কতটা সফল হয়েছিল সে বিষয়ে পরের বংশধররা স্পষ্ট নন। তবে জনৈক এক সাধু পুরুষ একবার ম্যাক্সওয়েল বংশের একজনকে দেখে বলেছিল,

“অর্ধ নেকড়ে হয়ে ওরা আবার আসছে এই বংশে। একজন শান্তির কপোতি। অপরজন অশুভ, অমঙ্গল আর অধর্মের কপোতারি৷ একজন চন্দ্রদেবীর আশীর্বাদপুষ্ট, অন্যজন শয়তানের। এই দুইয়ের মিলনে জগতের ক্ষতি ছাড়া ভালো হবে না। কোনো এক আষাঢ়ি পূর্ণিমায় কপোতি এই বংশের আশীর্বাদরূপে আবির্ভূত হবে৷ কপোতারি ওকে হাসিল করতে পারলে হয়ে উঠবে মহা ক্ষমতাধর। পৃথিবীর সুখ, শান্তি চিরতরে মুছে দেবে ও৷ বেড়ে যাবে অশান্তি, দারিদ্র্য, দুর্দশা, জরা এবং পীড়া। শয়তানের রাজত্বে মানুষের জীবন হয়ে উঠবে দুর্বিষহ। ধীরে ধীরে পূন্যকে গ্রাস করবে পাপ। সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে অনাচারে৷”

এ থেকে মুক্তির উপায় জানতে চাইলে তিনি এক কথায় বারংবার বলেন,

“ওফেলিয়া, ওফেলিয়া।”

এই গল্প বহুকাল পরেও প্রচলিত ছিল। আন্না মেরিও শুনেছিলেন তাঁর দিদার কাছ থেকে। ইসাবেলার যেদিন জন্ম হয় সেদিনও ছিল আষাঢ়ি পূর্ণিমা৷ আন্না মেরিওর দিদা তখনও বেঁচে ছিলেন। ইসাবেলার মুখটা দেখে তিনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান। চাঁদ যেন ভূমিতে নেমে এসেছিল সেদিন।
পরক্ষণেই তাঁর খুশি ম্লান হতে হতে ভীত হয়ে ওঠে। আন্না মেরিও বুঝতে পারেন দিদার ভয়ের কারণ। এর মাস খানিক পরে দিদা মারা যান। প্রাণত্যাগের আগে আন্না মেরিওকে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন যৌবনে পা রাখলে ইসাবেলার যেন বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। দিদার কথার কারণে ছোটো থেকেই মেয়েকে আন্না মেরিও আগলে রেখেছেন। যৌবনে পা রাখতে পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু বিধিবাম। পিটার ফেরারি হলো। ইসাবেলার বিয়েটা আর হলো না। দিদার কথা আন্না মেরিও কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন কতবার। কিন্তু পরিস্থিতি দিদার কথাকেই যেন সত্য প্রমাণিত করতে চায়। ওলেগ যখন বলল, ভ্যালেরিয়ার মৃত্যুর কারণ স্বাভাবিক নয় তখনই পুরোনো ভয়টা ফিরে এলো। ইসাবেলা যার বাড়িতে ছিল সেই মাদামের গাঁয়ে গিয়েছিলেন ওলেগ। মাদামের অপ্রকৃতস্থতা এবং আত্মহত্যা, ইসাবেলার রক্তশূন্যতা ও ওর ভয় পাওয়ার সব ঘটনা প্রতিবেশীরা তাঁকে সবিস্তারে বলেছে। ভ্যালেরিয়া আসলে কী করত সেটাও ওলেগ ওখানে গিয়ে জানতে পেরেছেন। গ্রামটা থমথমে হয়ে ছিল ওই ঘটনার পর। ওলেগ কুসংস্কারমুক্ত চিন্তাধারার মানুষ। মেয়ের নিখোঁজের শোকেই হয়তো সেদিন গ্রামের লোকদের কথা প্রভাবিত করল তাঁকে। স্ত্রীকে আস্তে আস্তে সব খুলে বললেন তিনি। আন্না মেরিওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। মেয়ে বিপদে পতিত জেনে তিনি ভেঙে পড়লেন। শয্যাশায়ী হলেন। বাড়ির বাকিদের দিনও চিন্তায় চিন্তায় কাটে।
ইসাবেলার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ পিটার পর্যন্ত পৌঁছাল। রাতে আঁধারে ছদ্মবেশে এলো আন্না মেরিওর সাথে দেখা করতে। ইসাবেলাকে ও ভালোবাসে। চিরজীবন বাসবে। নিজের দায়িত্ব আর ভালোবাসার মাঝে ভালোবাসাকে বেছে নিয়েছিল। শেষপর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। দায়িত্বের দায়ে ভালোবাসা বিসর্জিত হয়। দেশ এবং দেশের দারিদ্র্যপীড়িত অসহায় মানুষগুলোকে শুষে খাচ্ছে শোষকশ্রেণী। এদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমেছে পিটার। পৃথিবীতে যত অনিয়ম, বৈষম্য সবকিছুর বিরুদ্ধে ওর লড়াই। বিপ্লবী ও। যুগের দাবির কাছে সবকিছু তুচ্ছ করে বিপ্লবীরা। ওদের চোখে সংসার দুঃস্বপ্ন, ভালোবাসা বাধা। এসব কারণে কোনোদিন ইসাবেলার সামনে নিজের মনের কথা প্রকাশ করেনি পিটার। প্রকাশ না করলেও বরাবরই ইসাবেলার প্রতি সূক্ষ্ম এক দুর্বলতা ছিল মনে। কখনো কষ্ট দিতে চায়নি মেয়েটাকে। কেবল নিজের দায়িত্বের কারণে ওকে ত্যাগ করেনি। পিটার জানত, ওর মতো বিপ্লবী, গৃহ উদাসী পুরুষের সাথে সংসার করে সুখ পাবে না ইসাবেলা। চিরজীবন দুঃখে জর্জরিত হওয়ার চেয়ে অল্প কিছুদিনের ব্যথা ভালো। কিন্তু কে জানত, ওর দেওয়া ব্যথা এমনভাবে ভাঙবে ইসাবেলাকে। হারিয়ে যাবে সবার কাছ থেকে। ভীষণ অপরাধবোধ হয় পিটারের। চিনচিনে ব্যথা টের পায় বুকের বা’পাশে।

আন্না মেরিও পিটারের প্রতি রাগ করতে পারেন না। বিয়ের কয়েকদিন আগেই ওর বিপ্লবী হওয়ার কথাটা তাঁদের কানে আসে। পিটার অস্বীকার করেনি বরং সেদিন বলেছিল, বিয়ে করা সম্ভব নয় ওর পক্ষে। যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারে। ইসাবেলার যোগ্য পাত্র ও নয়। ইসাবেলার জীবন নষ্ট হোক পিটার তা কখনোই চায় না। কিন্তু কেউ শোনেনি ওর কথা। বিয়ের আগেই পুলিশ গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে হাজির হলো। পিটারের পালিয়ে যাওয়ার পথ প্রায় বন্ধ। নিজেকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু আন্না মেরিও তা হতে দেন না। পিটার তাঁর সন্তান তুল্য। সকলের অগোচরে পিটারকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন।
ইসাবেলার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ শুনে সব বিপদ উপেক্ষা করে ও আবার এ বাড়িতে পা দিয়েছিল। যাওয়ার সময় পিটার কথা দিয়ে যায় ইসাবেলাকে খুঁজে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। কয়েক মাস বাদে ওর একটা চিঠি পেয়েছিলেন তিনি। ইসাবেলার খোঁজে সূদুর জার্মানি পর্যন্ত গেছে পিটার। সংক্ষিপ্ত ছিল চিঠিটা। লিখেছিল, পরের চিঠিতে বিস্তারিত জানাবে। এরপরে বিশ্বযুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিলো। না পেলেন পিটারের চিঠি আর না পেলেন ওর কোনো খোঁজ। মাস গেল, বছর ফুরালো। আন্না মেরিও মেয়ের শোক কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। রোজ চার্চে গিয়ে প্রার্থনা করেন মেয়ের মঙ্গল কামনায়। সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আকুল প্রার্থনা করেন ঈশ্বরের কাছে। ঈশ্বর তাঁর প্রার্থনা অবশেষে শুনেছেন। ইসাবেলা ফিরে এসেছে আবার। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে বুকের জ্বালা জুড়িয়েছেন আন্না মেরিও। মনে মনে ভাবলেন, দিদার কথা গল্পকাহিনী ছাড়া কিছু না। কিন্তু, কয়েকদিন যেতে তিনি লক্ষ্য করলেন ইসাবেলা তাঁদের মাঝে থেকেও যেন নেই। বুঝতে পারলেন গত এক বছরে খুব বদলে গেছে ও। যখন তখন হাসির মুখোশে ভেতরের ব্যথা, চিন্তা সব ঢেকে ফেলে। আগের ইসাবেলার আবেগ-অনুভূতি সহজে মুখের ক্যানভাসে ফুটে উঠত। এই ইসাবেলা ক্ষণে ক্ষণে মুখোশ পরে। কখনো হাসির, কখনো উচ্ছ্বলতার। কিন্তু এখনও সে মা’কে পুরোপুরি ফাঁকি দেওয়া শিখে ওঠেনি। কোনো সন্তানই হয়তো পারে না। ইসাবেলার উদাসিনতা, বারিধারা শেষে আরক্ত চোখ আন্না মেরিও দেখতে পান। দিনের বেশিরভাগ সময়ই ও এই জানালা অথবা নিজ কক্ষের জানালার পাশে বসে দূর রাস্তার পানে চেয়ে থাকতে থাকতে উদাস হয়৷ তিনি মেয়ের এই উদাসীনতার কারণ জানতে উদগ্রীব। কিন্তু ইসাবেলা বললে তো। কেউ সামনে এলেই ওর মুখ বদলে যায়। আন্না মেরিও ধীর পদে রুমের ভেতরে ঢোকেন।

“বেলা।”

বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠে যতবার মায়ের মুখে নিজের এই ডাক নামটা শুনতে পায় ইসাবেলা। খুব বেশি মনে পড়ে তখন নিকোলাসকে। ও কি মনে করে ইসাবেলাকে?

“বেলা।”

মেয়ের জবাব না পেয়ে আবার ডাকলেন আন্না মেরিও। তাঁর পায়ের শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে। ইসাবেলার মনটা বড়ো বিষণ্ণ, কাতর। এখনও একদৃষ্টে জানালার বাইরে চেয়ে আছে। আন্না মেরিও মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। পরম মমতায় শুধালেন,

“সারাদিন কী এত ভাবিস, মা?”

ইসাবেলা নীরবে শ্বাস ছেড়ে মায়ের মুখের দিকে তাকায়।

“কিছু না তো।”

জোরপূর্বক মুচকি হেসে দু’হাতে মায়ের কোমর জড়িয়ে বুকে মাথা রাখে। বরাবরের মতো মিথ্যা বলল। মা’কে মিথ্যা বললে খুব অপরাধবোধে ভোগে। কিন্তু সত্যিটাই বা বলবে কী করে? মা’র চোখে পিশাচরা পাপী, অভিশপ্ত। নিকোলাসকে যে মেনে নেবেন না তিনি। নিকোলাস! ওর কী মনে পড়ে ইসাবেলাকে?
মায়ের বুকে মাথা রেখে বড়ো শান্তি লাগে ওর। অশান্ত মন খানিক শান্ত হলো। মায়ের ছায়া যেন ওর বিরহ কাতর হৃদয়ে যন্ত্রণা উপশম প্রলেপ লাগিয়ে দেয়। বাড়ি ফেরার জন্য কত কী করেছিল গত এক বছরে। এই মাকে, পুরো পরিবারকে দেখবে বলে চোখ ক্ষয়ে যাচ্ছিল। আজ সবাই ওর কাছে তবুও কোথাও যেন নিগূঢ় শূন্যতা।

আন্না মেরিও মেয়ের মেকি হাসি বুঝতে পেরেও প্রকাশ করলেন না। মা মেয়ে দীর্ঘক্ষণ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রইল। দরজার কাছে পায়ের শব্দ পেতে দুজনই সেদিকে তাকায়। মাতভেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর বুকের ওপর তাশা। বাবা- মেয়েকে দেখে আন্না মেরিও মুচকি হাসেন।

“এসো বাবা।”

মাতভেই ভেতরে ঢুকলো। মুখে আঙুল পুরে বাবার বুকে মাথা রেখে রুগ্ন চোখে চেয়ে আছে তাশা। কয়েকদিন যাবত ওর শরীর ভালো যাচ্ছে না। ঠিকমতো খাচ্ছে না, ঘুমাচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎ কেঁদে ওঠে। যেন কিছু দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে। ডাক্তার দেখিয়েও লাভ হয়নি। ইসাবেলা উঠে দাঁড়িয়ে তাশার সামনে দুহাত বাড়িয়ে বলে,

“খালামনির কোলে আয় সোনা আমার।”

তাশা ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর ঝুঁকে পড়ল খালার দিকে। ইসাবেলা কোলে তুলে নেয়। এই কদিনে তাশার ওজন যেন আরও কমে গেছে। সুশ্রী, কোমল মুখখানা রক্তশূণ্য ম্লান দেখায়।

“ও এত রোগা হয়ে যাচ্ছে কেন, মা?”

“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ডাক্তার কবিরাজ তো কম করছি না। তোর দিদা বলল, চার্চে গিয়ে ফাদারকে একবার দেখিয়ে আনতে। বাবা মাতভেই, তুমি আর তাতিয়ানা কাল সকালে একবার ওকে নিয়ে চার্চে যেয়ো।”

মাতভেই কিছু বলবে, পেছন থেকে তাতিয়ানা বলে উঠল,

“আমি একাই যাব। ওকে সাথে যেতে হবে না।”

মাতভেই আহত মুখে তাকাল ওর দিকে। বড়ো আশা নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিল। ভেবেছিল তাতিয়ানার ভালোবাসা পাবে। কিন্তু পেয়েছে প্রত্যাখ্যান। এ বাড়িতে না এলে হয়তো জানা হতো না তাশার কথা। প্রথম দেখেই মেয়েকে চিনতে পারে মাতভেই। বাবা-মেয়ের মুখে বেজায় মিল। কিন্তু তাতিয়ানা মুখের ওপর অস্বীকার করল। যে কেউ এক দেখায় বলে দিতে পারবে এ যে ওরই ঔরসজাত। সুতরাং ওর অস্বীকার কেউ বিশ্বাস করেনি। বাড়ির সকলে মাতভেইকে তাশার বাবা বলে স্বীকার করেছে। তাশার মুখ চেয়ে মাতভেইকে গ্রহন করার পরামর্শ দেয় বাড়ির বড়োরা। তাতিয়ানাকে একরোখা, জেদি। মাতভেইকে কিছুতেই মেনে নেবে না ওর জীবনে। তাতিয়ানার ব্যবহারে মন ভেঙে যায় মাতভেইর। ওর চোখে মাতভেই একবিন্দু ভালোবাসা, ভালোলাগা খুঁজে পায় না। যদি কিছু পায় তা কেবল অপছন্দ। তাশার মুখ চেয়ে মাতভেই সব সহ্য করার সিদ্ধান্ত নিলো। পিতা হিসেবে তাশার জীবনে থাকার অধিকার ওরও আছে। তাতিয়ানা সেই অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। মাতভেই তা কিছুতেই হতে দেবে না। রুষ্ট মুখে তাতিয়ানাকে বলল,

“কেন নয়? তাশা আমারও মেয়ে। ওর সাথে যাওয়ার অধিকার আমার আছে এবং আমি যাব।”

“তোমার মেয়ে? ভুলে যেয়ো না দশমাস দশদিন ওকে আমি গর্ভে ধারণ করে জন্ম দিয়েছিলাম। ও কেবল আমার মেয়ে।”

“রিয়েলি? তা তোমার গর্ভে ও এলো কী করে? তাতিয়ানা মারিয়া আলেক্সিভ, আমার বীর্য তোমার জরায়ুতে প্রবেশ করেছে বলেই তুমি তাশাকে গর্ভে ধারণ করতে পেরেছ। হ্যাঁ, আমি মানছি দোষ আমার আছে। তোমার গর্ভকালীন সময়ে আমি ছিলাম না। কিন্তু এই না থাকাটা তো ইচ্ছাকৃত ছিল না তাতিয়ানা। সেই অনিচ্ছাকৃত ভুলের শাস্তি আমার সন্তানের জীবন থেকে আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে দিতে পারো না তুমি। এত কেন অপছন্দ করো আমাকে তুমি তাতিয়ানা?”

মাতভেইর গলা সামান্য চড়ে যায়। বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে তাশা কাঁদতে আরম্ভ করে। ইসাবেলা মাতভেইর বাহুতে হাত রাখতে শান্ত হলো ও। ভুলেই গিয়েছিল তিনজনের উপস্থিতি। তাতিয়ানা মুখ ফিরিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্না থামাতে লাগল। আন্না মেরিও আর ইসাবেলার দিকে চেয়ে মাতভেই লজ্জিত হয়। নিজের আচরণে অনুতপ্ত হয়ে আন্না মেরিওকে বলল,

“আমাকে ক্ষমা করবেন মিসেস আলেক্সিভ।”

শেষবার মেয়ের ক্রন্দনরত মুখটার দিকে চেয়ে বিমর্ষ হয়ে বেরিয়ে গেল রুমের বাইরে। তাতিয়ানা ওর যাওয়ার পথে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকে। সত্যি বলতে মাতভেইকে ও অপছন্দ করে না, ওর জীবনে মাতভেইর উপস্থিতিকে অপছন্দ করে। ও চায় না মাতভেই ওর আর তাশার জীবনে থাকুক। কোনো পুরুষকে তাতিয়ানার প্রয়োজন নেই। একসময় হয়তো ছিল, সেটা অন্য কারণে। এখন ও একাই ভালো আছে। মাতভেই কেন ওকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না?

আন্না মেরিও মেয়ের জেদটাকে বড়ো বেশি অপছন্দ করেন। মাতভেইর মতো ছেলেকে ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে পাপ করছে। ওর চোখে মেয়ের জন্য অগাধ ভালোবাসা দেখেছেন তিনি। অথচ, তাতিয়ানা ওকে অবজ্ঞা, অপমান করছে। মেয়েকে ভর্ৎসনার সুরে বলেন,

“তুমি ওর সাথে খুব খারাপ করছ তাতিয়ানা। এমনটা ও ডিজার্ভ করে না। জেদে অন্ধ হয়ে গেছো তুমি। তোমার কাওকে প্রয়োজন না হলেও তাশার জীবনে একজন বাবার খুব দরকার। ও বেচারা সব হারিয়ে এই মেয়ের মুখ চেয়ে বাঁচার অবলম্বন খোঁজে। তুমি তা থেকেও তাকে বঞ্চিত করছ। এত নির্দয় কী করে হলে তাতিয়ানা? তুমি কি সত্যি দেখতে পাওয়া না তোমার প্রতি ওর ভালোবাসা? অহংকার তোমাকে এতটাই অন্ধ করে দিয়েছে? এখনও সময় আছে শুধরে যাও। ভাগ্য যা দিচ্ছে হাত পেতে নাও কৃতজ্ঞতার সাথে। নয়তো পরে পস্তাবে।”

আন্না মেরিও রাগ করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
তাতিয়ানা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চুপচাপ রইল। ইসাবেলা ওর কাছে গিয়ে বলে,

“মাতভেই এখানে আসার আগে একমাত্র আপনজন মা’কে হারিয়েছে। তাশাই এখন ওর সব। ওর থেকে মেয়েটাকে আলাদা কোরো না তাতিয়ানা। তোমার মতো হয়তো পুরুষমানুষ চেনার চোখ আমার নেই। কিন্তু যতটুকু আছে তা দিয়ে যাচাই করে দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, মাতভেই খুব ভালো ছেলে তাতিয়ানা। ও তোমায় খুব ভালোবাসে। ছোটোবোন হিসেবে একটা অনুরোধ রাখো আমার, মাতভেইকে একটা সুযোগ দাও। তোমার ভগ্ন হৃদয় ও ঠিক যত্ন করে জোড়া দিয়ে দেবে। প্রকৃত তাতিয়ানাকে ফিরিয়ে আনার একটা সুযোগ ওকে দিয়ো তুমি।”

তাতিয়ানা বোনের দিকে নিস্প্রভ চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নিরুত্তর মেয়েকে কোলে করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ইসাবেলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বইটা হাতে তুলে রুমের দিকে পা বাড়ায়। কড়িডোরে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় তাতিয়ানা তাশাকে কোলে করে মাতভেইর রুমের দিকে যাচ্ছে। এক চিলতে ক্ষীণ হাসি জেগে ওঠে ইসাবেলার ঠোঁটের কোণে। রুমে এসে বইটা বুকসেলফে রেখে জানালার পাশে বসল।

বসন্তের মৃদুমন্দ সমীরণ ইসাবেলাকে ছুঁয়ে যায়। লনের একপাশে ফুটে আছে অসংখ্য সাদা হলুদে মিশানো ডেইজি, রঙ বেরঙের বুনো ফুল। গাছে গাছে সবুজ পাতা দুলে দুলে ওঠে বসন্ত বাতাসে। একটু দূরে চেরি ব্লোসমের সেই অপার সৌন্দর্য। শাখে শাখে থোকায় থোকায় ফুটে আছে হালকা গোলাপি ফুল। বাতাসে মিষ্টি সুবাস ভেসে বেড়ায়। নীল আকাশটার দিকে তাকায় ইসাবেলা। আকাশ আর জমিন যেন সমস্বরে করছে বসন্ত বন্দনা। কিন্তু ইসাবেলার মনে বিরহের বেহালা বাজে। বেদনা বেধুর হয়ে ওঠে সমস্ত হৃদয়। নিকোলাসকে দেখে না প্রায় পাঁচ মাস। এই পাঁচটা মাস পাঁচ সহস্রাব্দের সমান ওর কাছে। কত রাতে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়েছে। কত দিন বিগত হয়েছে বিরহের যন্ত্রণায় ছটফট করে। আজও একফোঁটা কমেনি সেই যন্ত্রণা। বরং দিনেদিনে বেড়ে যাচ্ছে। পাঁচ মাস আগে যে ভালোবাসা কুঁড়ি ছিল, এখন তা পরিণত হয়েছে। দুরত্বে ভালোবাসা কমে না। বহুগুণে বেড়ে যায়। তার অনুপস্থিতি তাকে আরো বেশি মনে করিয়ে দেয়। এত ফুলের বাহার, প্রজাপতির রঙ, পাখির কূজন, ভোরের শিশির বিন্দু, ওই নীল আকাশ, সন্ধ্যাতারা আর নিশুতিরাতে ডাকা ডাহুকের বিরহী গান সবকিছুতে তাকেই খুঁজে পায়। দৃষ্টিসীমার আড়ালে থেকেও সে যেন দৃষ্টির সর্বত্র। ইসাবেলা এমন করে কাওকে ভালোবাসেনি। কখনো দিনরাত জপেনি একই নাম,

“নিকোলাস, নিকোলাস।”

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬১
Writer তানিয়া শেখ

মধ্যরাত। নিস্প্রভ চাঁদের আলোয় রাতটা বড়ো ম্রিয়মাণ মনে হয়। পথঘাটে জমাটবদ্ধ অন্ধকার। নুড়িপাথরে বেছানো রাস্তার চারপাশে ঘন ঝোপঝাড়। ডান পাশে পরিত্যক্ত রেললাইন। বা’পাশে দীর্ঘ এক নদী বয়ে গেছে। সরু সেই নুড়িপাথরের রাস্তা ধরে হেঁটে চলছে অশীতিপর এক ব্যক্তি। মাথায় ক’গাছি পাটের তন্তুর মতো সাদা চুল, কুঁচকে ঝুলে পড়েছে মুখের চামড়া, চোখদুটো মরাপচাঁ মাছের চোখের মতো নির্জীব এবং দেহ কঙ্কালসার। দীর্ঘদেহী দেহটা খানিক বেঁকে গেছে। হাঁটছে অতি ধীর পায়ে। যেন এক এক পা গুনে গুনে ফেলছে। সে খেয়াল করছে তার উপস্থিতি টের পেতে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে জোনাকি, ঝিঁঝিপোকা আর পেঁচারদল। বৃদ্ধের ঠোঁটের কুঞ্চিত চামড়া আরো কুঁচকে যায়। প্রকৃতিও বুঝি বুঝিয়ে দেয় সে একা, অভিশপ্ত। কিছুপথ হেঁটে ক্লান্তিতে হাঁপিয়ে ওঠে। ধপ করে পাশের ঝাড়ের ওপর বসে পড়ল। ওমনভাবে বসার কারণে পুরোনো শরীরের চামড়ার এখানে ওখানে ছিঁড়ে কেটে যায়। বৃদ্ধ তাতে উঁহু! আহা! করে না। একটুবাদে আবার উঠে দাঁড়ায়। আরো কিছু পথ হাঁটার পর নির্জন বনমধ্যে পরিত্যক্ত দুর্গটা চোখে পড়ে। বেশ ঝাপসা সামনের দৃষ্টি। পাঁচ মিনিটের পথ বৃদ্ধ পঁয়ত্রিশ মিনিটে পার করে দুর্গের মুখে এসে শরীর ছেড়ে বসে পড়ল। কঠিন নিস্তব্ধতা দুর্গের মুখে। বৃদ্ধের শরীরে অর্ধেক ঢেকে আছে বেপরোয়া বেড়ে ওঠা সবুজ ঘাসে। একসময় এই দুর্গটি সমাদৃত ছিল। এর চাকচিক্যময়তা লোকের নজর কাড়ত। অসংখ্য সুন্দর, অসুন্দর মুহূর্তের স্মৃতি এখনও দুর্গটি বয়ে বেড়াচ্ছে। সবার কদর একদিন শেষ হয়। কালের বিবর্তনে দুর্গটি এখন পরিত্যক্ত। মানুষের কদর যেখানে শেষ, প্রকৃতির কদর সেখান থেকেই শুরু। শ্রী ছাড়া দুর্গটিকে প্রকৃতি উড়াজ করে ভালোবেসেছে। হাঁটু সমান ঘাস, নানান আগাছা-পরগাছা আর উইলো বৃক্ষের সারির ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে দুর্গটি। চূড়ার শীর্ষে মেঘে ঢাকা আকাশে চাঁদটা লুকোচুরি খেলছে। বৃদ্ধ উঠবে তখনই খচখচ শব্দ কানে এলো। একটু যেন অবাকই হলো। তারমতে এই বনে কোনো পশু থাকার কথা নয়। ইতোমধ্যে নিজের রক্ত তৃষ্ণা মেটাতে সবগুলোকে নিধন করেছে। হয়তো দু একটা থেকেও যেতে পারে। সেই ভাবনায় উঠে দাঁড়ায় বৃদ্ধ। এই মুহূর্তে ভীষণ রক্ত তৃষ্ণা পেয়েছে তাঁর। গত একসপ্তাহ ধরে একফোঁটা রক্ত দাঁতে লাগাতে পারেনি। আজ দুপুর থেকে আশপাশে খুঁজেও কিছু পেল না। প্রাণীটির পায়ের শব্দে পিপাসার চাপ বেড়ে গেল। শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো কুঞ্চিত ঠোঁটের কোণা দিয়ে। হাওয়ায় অদৃশ্য হওয়ার শক্তি তেমন একটা নেই এখন। তবুও বারকয়েক চেষ্টা করল। সফল হলো। সত্যি দেখা পেল একটা হরিণ শাবকের। প্রসন্ন মনে ঘাস খাচ্ছে। বৃদ্ধকে দেখে কানখাড়া করে ভীত চোখে তাকাল। যেই না ভৌ দৌড় দেবে অমনি ওটাকে ধরে ফেলে বৃদ্ধ। কালক্ষেপণ না করে শ্বদন্ত বসিয়ে দেয় ওর গলার কাছে। কিছুক্ষণ ছটফট করে থেমে যায় হরিণ শাবক। শেষ রক্তটুকু শুষে নিয়ে বৃদ্ধ রক্তমাখা মুখটা তোলে। রক্তের নেশা সে কিছুতেই ছাড়তে পারল না। এই নির্জনতা, নিঃসঙ্গতার মাঝেও শারীরবৃত্তীয় চাহিদা কমে না। সংযম রক্ষা হয়ে ওঠে না। মানুষের রক্ত না হোক পশুই চলুক। কিন্তু মানুষ রক্তের মতো সঞ্জীবতা পশুর রক্তে নেই। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াবে ঠিক সেই সময়ই ঘটনাটা ঘটল। একটা তীর এসে ঢুকে যায় তার বুকের বা’পাশে। পুড়ে যাচ্ছে বুকের চামড়া। শুধু চামড়া নয় পুরো ভেতরটাও। কালো ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় সেখান থেকে। তীরটা সাধারণ নয়। ওর মাথা পবিত্র জলে ভেজানো ছিল। পবিত্র জল পিশাচের দেহ সহ্য করতে পারে না। ভীষণ কষ্ট হয় ওদের। বৃদ্ধ শুনতে পায় চাপা গলায় কারা যেন কথা বলছে। কয়েকটা পায়ের শব্দ আশেপাশে টের পেল। তার দিকেই এগোচ্ছে। কালো আলখেল্লা পরিহিত চারটা ছায়া তাকে ঘিরে ধরে। ওদের একজন খেঁকিয়ে বলল,

“শয়তানটাকে অবশেষে বাগে পেয়েছি। আজ ওকে বধ করেই দম নেবো।”

পাশ থেকে আরেকজন বলল,

“ওকে শেষ করতে পারলে মনিব খুশি হয়ে আমাদের পুরস্কৃত করবেন। এইদিনটির অপেক্ষায় বহুকাল ধরে ছিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে ওর অবস্থা দেখে আমার বড্ড মায়া হচ্ছে আজ। আচ্ছা, ওর এমন জীর্ণশীর্ণ দশা হলো কী করে?”

“প্রেমের বিরহে বুঝলে। প্রেম ভালোবাসা বড়ো সাংঘাতিক ব্যাপার। একবার যার হয়ে যায় হয় সে বাঁচে নয় সে মরে। শয়তানটা প্রেমে মরেছে।” প্রথমজন ব্যাঙ্গ করে হেসে উঠল। বাকি দুজন ওর সাথে হাসল। আগেরজন বলল,

“ধুর! পিশাচরা তো আগে থেকে মরা। মরার কী প্রেম হয়?”

“ওই তো প্রমাণ তোমার সামনে। ভালো করে দেখে নাও। যাকে পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাধর মনে করা হতো। আজ সে প্রেমের বাণে আহত দুর্বল, অশীতিপর এক বৃদ্ধতে পরিণত হয়েছে। একে বধ করা এখন খুব সহজ।”

আগেরজন উবু হয়ে বসে থাকা তীর বিদ্ধ বৃদ্ধের পানে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। একদিন এই শয়তানটার জন্য একরাশ ঘৃণা ছিল যে চোখে আজ সেখানে কেবল করুণা জাগল। প্রথমজন তাড়া দিলো বাকিদের।

“অনেক কথা হয়েছে। আর দেরি নয়। এক্ষুনি চলো ওটাকে বধ করতে হবে।”

করুণার স্থায়িত্ব আর কতক্ষণ! তিনজন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। ওরা সতর্ক পায়ে এগিয়ে গেল পিশাচটার দিকে। কোচ থেকে তলোয়ার বের করে ওর দিকে উঁচু করতে কোথা থেকে এক পাল হায়েনার হিংস্র গর্জন শুনতে পেল। থমকে গেল ওরা। হঠাৎ বৃদ্ধ পৈশাচিক হাসি হেসে ওঠে। মুখ তুলে তাকায় ওদের দিকে। ঠোঁটের চারপাশে রক্তমাখা। বৃদ্ধ! না ওকে আর বৃদ্ধ লাগছে না এখন। হরিণ শাবকের রক্ত খেয়ে বয়সটা দশ, বিশ বছর কমিয়ে এনেছে। মাথায় কাচাপাকা পাতলা চুল। চামড়ার ভাঁজ কিছুটা মিশে গেছে। আগের চেহারা এবার বেশ বুঝা যাচ্ছে। সেই শ্যেনদৃষ্টি। সে উঠে দাঁড়ায় ওদের সামনে। ভয়ে চারজনের রক্ত হিম হয়ে এলো। তলোয়ার শক্ত করে ধরে আছে, কিন্তু শক্তি আস্তে আস্তে যেন নিঃশেষ হয়ে যায়।

“মারতে চেয়েছিলি তোরা আমায়?”

“না, নিকোলাস!”

দ্বিতীয়জন আর্ত কণ্ঠে বলে উঠল। নিকোলাস ক্রূর হাসল। এক পা এগোতেই চারজন পাঁচ পা পিছিয়ে যায়। এক ঝাঁক বাদুড় হঠাৎ উড়ে এসে ডানা ঝাপটাতে লাগল মাথার ওপর। তন্মধ্যে একটা এসে ঝুলে পড়ে নিকোলাসের বা’হাতের ওপর। শিকারি চোখে চেয়ে আছে চারজনের দিকে। নিকোলাস ওদের ভীত-সন্ত্রস্ত চেহারা দেখে বলল,

“সত্যি বললে আমি তোদের মারব না। বল কে তোদের পাঠিয়েছে আমাকে মারতে?”

শান্ত চোখে চেয়ে আছে নিকোলাস। এত শান্ত পূর্বে ওকে এরা দেখেনি। ভয় তবুও কমলো না ওদের। নিকোলাসের বুকে এখনও তীরটা গেঁথে আছে। তীরের চারপাশ দিয়ে বের হচ্ছে কালো ধোঁয়া। তীরটাকে বের করার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না ওর মধ্যে। চারজনের নীরবতা বোধহয় বরদাস্ত করতে পারল না নিকোলাসে বা’বাহুর সাথে ঝুলে থাকা বাদুড়টা। দাঁত খেঁচিয়ে উঠল। সাথে সাথে মাথার ওপর উড়ন্ত বাদুড়গুলো নেমে এলো ওদের দিকে। প্রথম দুজন তলোয়ার সেদিকে তুললেও অপর দুজন ভয়ে উলটো দিকে দৌড়ে পালাল। সাথী দুজনকে পালিয়ে যেতে দেখে বাকি দুজন মনে মনে ওদের জঘন্যভাষায় গালি দেয়। বাদুড়গুলো কিন্তু ওদের আক্রমণ করল না। একদম তলোয়ারের কাছ ছুঁয়ে আবার আগের জায়গায় উড়তে লাগল চক্রাকারে। জঙ্গলে যেদিকে দুজন পালিয়ে গিয়েছিল একটুপর সেখান থেকে তীব্র আর্তনাদ শোনা গেল। পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল যুবক দুজন। নিকোলাসের কাঁধে ঝুলন্ত বাদুড়টা দাঁত বের আছে। যেন বিদ্রুপ করে হাসছে দুজনের ভয় পাওয়া দেখে। নিকোলাস আবার প্রশ্ন করল,

“কে পাঠিয়েছে তোদের?”

“বললে ছেড়ে দেবে আমাদের?” বলল দ্বিতীয়জন। নিকোলাসকে জবাব দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে বলল,

“ওকে বিশ্বাস কোরো না বন্ধু।”

“ও আমাদেরকে মেরে ফেলবে জবাব না পেলে।”

“দেখো ওকে। ওর দেহে আজ আর সেই অসীম শক্তি নেই। আমাদের সাথে পেরে উঠবে না। চলো এক্ষুনি ওকে শেষ করে ফেলি।”

দ্বিতীয়জন বয়স্ক নিকোলাসের দিকে তাকায়। ওরা যুবক। একসাথে লড়াই করলে নিকোলাসকে ঠিক হারিয়ে দিতে পারবে। প্রথমজনের কথায় সায় দেয় দ্বিতীয়জন। তলোয়ার হাতে ছুটে যায় নিকোলাসের দিকে। কিন্তু কাছাকাছি যাওয়ার আগেই অদৃশ্য থেকে কেউ যেন আক্রমণ করে বসে ওদের। গলা চেপে ধরে হাত থেকে তলোয়ার কেড়ে নেয়। ছুঁড়ে ফেলে সামনে। আহত শরীর উঠে বসতে নিজেদের নিকোলাসের পায়ের কাছে আবিষ্কার করে। নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে আছে নিকোলাস। ওর পেছন থেকে দৃশ্যমান হয় আন্দ্রেই এবং নোভা। আন্দ্রেই হিংস্র গর্জন করে দ্বিতীয়জনের দেহের ওপর চড়ে বসে। কামড়ে ধরে ওর গলা। বিকট আর্তনাদ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। আন্দ্রেই রক্তমাখা মুখে তাকায় প্রথমজনের দিকে। তলোয়ারটা দু গজ দূরে পড়ে আছে। সেদিকে যাবে বলে উঠতে নিকোলাসের বাহুর ওপর ঝুলে থাকা বাদুড়টা আক্রমণ করে বসে। কামড়ে রক্তাক্ত করে উড়ে যায়। ওর গলা চেপে ধরে আন্দ্রেই। কর্কশ গলায় বলল,

“কে পাঠিয়েছে তোকে?”

“বলব না।”

আন্দ্রেই ওকে মারতে যাবে নিকোলাস থামিয়ে দেয়,

“আন্দ্রেই, ছেড়ে দে ওকে।”

“ভাই!” শুধু আন্দ্রেই নয় নোভাও বিস্মিত হয়। নিকোলাস আবার ইশারা করে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ছাড়া পেয়ে যুবক হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিকোলাস ওকে বলল,

“যা, আমার সিদ্ধান্ত পালটে যাওয়ার আগে পালিয়ে যা।”

যুবকটি পালিয়ে গেল অন্ধকার জঙ্গলে। আন্দ্রেই অসন্তোষের সাথে বলল,

“ও তোমাকে মারতে এসেছিল, ভাই। আর ওকেই কি না বাঁচিয়ে দিলে? এটা ঠিক হলো না মোটেও।”

“ওহ!”

“ওহ?”
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে আন্দ্রেইর। নোভার ভীষণ খারাপ লাগে ভাইয়ের উদাসীনতা দেখে। নিকোলাসের উদাস দৃষ্টি বুকের ওপর পড়তে তীরটাকে একটানে বের করে আনে। একদলা মাংস বেরিয়ে এলো তীরের ধারালো মাথার সাথে। তীরের মাথায় লেগে থাকা মাংসের দলার দিকে চেয়ে রইল। মানুষ হলে হয়তো প্রচন্ড ব্যথা হতো এখন। আজ আবারও আফসোস হলো মানুষ নয় বলে। মানুষ কেঁদে কেঁদে চোখের জল ফেলে দুঃখ হালকা করে। নিকোলাসের বুক ভরা দুঃখ। বড্ড ভারী লাগে ভেতরটা। একটু যদি কেঁদে হালকা হওয়া যেত! একদিন কাঁদবে না বলে অভিশপ্ত জীবন বেছে নিয়েছিল। আজ একটুখানি কান্নার জন্য মাথা কুটে মরে। ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস! হাতের তীরটাকে ফেলে দিলো। চোখের নিমেষে বুকের ক্ষতটা ঠিক হয়ে যায়। সব ক্ষতই পলকে ঠিক হয়ে যায়, কেবল ইসাবেলার কারণে সৃষ্ট ক্ষত দিনেদিনে আরো যেন দগদগে হয়। নিকোলাস মোটেও দুঃখ করে না তাতে। ইসাবেলাকে মনে রাখার এটাও যে একটা মাধ্যম। নিকোলাসের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। মলিন মুখে হেঁটে এলো দুর্গের দ্বারের কাছে। আন্দ্রেই পথ রোধ করে দাঁড়ায়। নিকোলাস বিরক্ত হয়,

“পথ ছাড় আন্দ্রেই।”

“এসব তোমাকে মানায় না ভাই। নিজেকে আয়নায় দেখো একবার। এই কী সেই নিকোলাস উইলিয়ামস? যে পৃথিবীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিল? হতে চেয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়ী। যুগ, কালের উর্ধ্বে উঠে যার লক্ষ্য ছিল মহা ক্ষমতাধর হওয়া, মানুষের চোখে ভীতি সৃষ্টি করা। না, তুমি সে নও। আমার সামনে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে দুর্বল এক বৃদ্ধ। তুচ্ছ এক মানবীর মৃত্যুর শোকে আজ তুমি কোথায় নেমে এসেছ ভাই!”

নিকোলাসের নির্লিপ্ত চোখজোড়া দপ করে জ্বলে ওঠে,

“তুচ্ছ মানবী? খবরদার আন্দ্রেই, আমার বেলাকে তুচ্ছ মানবী বলবি না। হতে পারে তোর কাছে, তোদের কাছে ও তুচ্ছ মানবী। আমার কাছে ও আমার সব। ওকে ছাড়া আমি নিঃস্ব, রিক্ত রে আন্দ্রেই। তুই ঠিকই বলেছিস, এই আমি সেই আমি নই। ইসাবেলা ছাড়া আজ আমি কিছুই না। তুই বলেছিলি ও আমার দুর্বলতা। আজ ও নেই তবুও এত দুর্বল কেন আমি আন্দ্রেই? জানি এর জবাব তুই দিতে পারবি না। তুই ভালোবাসিসনি। আমার ব্যথা, আমার বিরহ তুই বুঝবি না।”

“ভালোবাসলে যদি এই পরিণতি হয় তবে আমি সানন্দে বলব, ভালোবাসা যেন কোনোদিন না হয় আমার। সামান্যের জন্য বেঁচে গেছ আজ তুমি। সময়মতো না এলে ওরা তোমাকে মেরে ফেলত। এখনও কী সতর্ক হবে না? এখনও কী হুঁশ হবে না তোমার?”

নিকোলাস ওর পাশ কাটিয়ে দুর্গের ভেতর প্রবেশ করে। শেওলা পড়া বসার ঘরের ঘুনে ধরা ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে বসল। ইচ্ছে হয় আন্দ্রেইকে বলতে,
“আজ কী মনে হয় জানিস আন্দ্রেই? মনে হয় সেদিন এই অভিশপ্ত জীবন বেছে না নিয়ে যদি মৃত্যুকে বেছে নিতাম। খুব ভালো হতো রে।”

নিকোলাসের কথা বলতে আর ভালো লাগছে না। চোখ মুদে দুলতে লাগল চেয়ারে। আন্দ্রেইর অসহ্য মনে হয় ভাইয়ের এই আচরণ। নিকোলাসকে বলল,

“তাহলে আর ফিরছ না কমিউনিটিতে?”

“তা তো কখনও বলিনি আমি।” আস্তে আস্তে চোখ খুললো নিকোলাস। আন্দ্রেই ক্ষোভের সাথে বলল,

“তবে এসব কী? এমন করে নির্জনে একা থাকা কেন? পাঁচ মাস, ভাই। পাঁচ মাস তুমি এখানে আছো। এই পাঁচ মাসে কমপক্ষে দশবার তোমার ওপর শত্রুরা হামলা করেছে। প্রতিবার সামান্যের জন্য বেঁচে ফিরেছ৷ আর তোমাকে এখানে থাকতে দেবো না। ফিরে চলো ভাই। কমিউনিটিতে তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন।”

“আর ক’টাদিন সময় দে আমাকে আন্দ্রেই। সত্যি বলছি, এরপর সাবধানে থাকব।”

“এই একই কথা আগেও বহুবার বলেছ তুমি।” নোভা এগিয়ে এসে বলল।

“বলেছি বুঝি? আচ্ছা, এবার সত্যি সত্যি সত্যি। তিন সত্যি করে বললাম।”

নোভা হতাশ মুখে মাথা নাড়ায় দুদিকে। আন্দ্রেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ইসাবেলার মৃত্যুর শোকে তুমি সব ভুলে গেছো ভাই। এমনকি আমাদেরও।”

“মৃত্যুর শোক! একে কী মৃত্যুর শোক বলে রে আন্দ্রেই? আমি মনপ্রাণে চাই এমন শোক কারো জীবনে না আসুক।”

নিকোলাস আবার চোখ মুদে দুলতে লাগল। আন্দ্রেইর মুখে ফুটে ওঠে অনুতাপ। ভেবেছিল ইসাবেলা চলে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ হয়তো কিছুদিন সময় নেবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কিছুদিন কিংবা কিছু বছরেও নিকোলাস ইসাবেলাকে ভুলবে না। নোভা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,

“চলো। ভাই আজও শুনবে না আমাদের কথা।”

আন্দ্রেই জানে নোভার কথা ঠিক। আশাহত, বিক্ষুব্ধ মনে ও দরজা মুখো ঘুরে দাঁড়ায়। একবার ভাবে নিকোলাসকে সত্যিটা বলে দেবে। আবার মন বদলে ফেলে। কোন মুখে বলবে ও? ভাইয়ের এহেন দশাও যে আর সহ্য হচ্ছে না। না, আন্দ্রেই সত্যি কথাটা বলে দেবে। স্বীকার করবে নিজের করা অন্যায়। তাতে যা হয় হোক। ভাইয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় পুনরায়। ও মুখ খোলার আগে নিকোলাস বলে ওঠে,

“আচ্ছা, আন্দ্রেই, তুই কী নিশ্চিত বেনাসের বাড়িতে সেদিন ইসাবেলাও পুড়ে মরেছিল? ধ্যাৎ! আমি কেমন বোকার মতো প্রশ্ন করছি। ও তো পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গেছে৷ চেনার মতো অবশিষ্ট কিছুই যে ছিল না৷ ছাই দেখে তুই নিশ্চিত হবি কী করে? কিছু মনে করিস না। আমি তোকে বিশ্বাস করি। কিন্তু মাঝে মাঝে মনটা কেমন করে ওঠে। বিশ্বাস করতে চায় না বেলা আর নেই। মন বলে ও আছে। হুট করে একদিন সামনে এসে চমকে দেবে। বোকা মন। মনটা এত অবুঝ কেন যে!”

আন্দ্রেইর মুখটা হয়ে যায় ফ্যাকাশে। নিকোলাস দেখতে না পেলেও নোভার চোখ এড়ায় না। আন্দ্রেই দৃষ্টি সরাতে নোভার মুখোমুখি হয়ে গেল। ধরা পড়ে যায় ও, হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়।

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে