#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪৭
Writer তানিয়া শেখ
ইদানীং বেনাসের বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া চলছে নিকোলাসের। বাড়ির সকলের ধারণা ভিক্টোরিজার নতুন প্রেমিক সে। বেনাসের এতে অবশ্য আপত্তি নেই। স্থানীয় জার্মান এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সূত্রে নিকোলাসের সাথে পরিচয়। জার্মানদের মিত্র এবং ধনী বনিক হওয়াতে বেনাসের বাড়িতে নিকোলাসের বেশ খাতির। ভিক্টোরিজার সাথে যদি কোনোভাবে নিকোলাসের সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় তাহলে খুশিই হন বেনাস এবং তাঁর স্ত্রী। মেয়েকে তারা উৎসাহ দিয়েছেন নিকোলাসের সাথে সম্পর্ক পাকাপোক্ত করতে। ভিক্টোরিজা অতদূর পর্যন্ত ভাবেনি, আপাতত ভাবতেও চায় না। ওর পছন্দের পুরুষের মতো নয় ঠিক নিকোলাস। একদম জেন্টেলম্যান টাইপ। অন্য পুরুষদের মতো ওর মধ্যে দেহক্ষুধা নেই। প্রেমিক প্রেমিক ভাব আছে। দেহের চেয়ে মনকে গুরুত্ব দেয়। প্রথম রাতে তেমন কিছু হয়নি ওদের মধ্যে। নেশায় বুঁদ হয়ে ছিল। কিছু মনেও করতে পারছে না। নিকোলাসকে দেখে ও আকৃষ্ট হয়েছে। দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে সে আকর্ষণ। নিকোলাসের হাসি, ওর চাহনি এবং ওর সুঠাম দেহগঠন ভিক্টোরিজাকে লোলুপ করে তুলছে। প্রবল হচ্ছে কাছে পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। নিকোলাসকে পাশে পেয়েও আকাঙ্ক্ষা পূরণ হচ্ছে না। দিনগুলো কীভাবে যে কাটছে ওই জানে! অধীর ভাবে অপেক্ষা করতে শারীরিক শুচিতার। ততদিন নিকোলাস যেভাবে চাইছে সেভাবেই চলুক। এসব কারণে ওর ধারণা ও বুঝি কামবাইগ্রস্থ স্ত্রীলোকে পরিণত হচ্ছে। কিংবা এতদিন তাই ছিল, নিকোলাসের কারণে এখন উপলব্ধি করতে পারছে সমস্যাটা।
“মিস, আপনার গলায় এ কীসের ক্ষত?”
জুজানির প্রশ্নে সচকিত হয় ভিক্টোরিজা। আয়নার দিকে ঝুঁকে গলার ক্ষতে হাত বুলিয়ে নিলো। ক্ষতটও তাজা, কিন্তু কীভাবে এর সৃষ্টি ভিক্টোরিজা ভেবে পেল না। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। মুখে হাত বুলিয়ে বলল,
“আমার ত্বকটা কেমন সাদাটে হয়ে গেছে, তাই না রে? আমার কি কোনো কঠিন রোগ হলো রে অ্যানি?”
গলার স্বর কেঁপে ওঠে ভিক্টোরিজার। মৃত্যু এখনই চায় না। কত আনন্দ এই সংসারে! এত আনন্দ ফেলে মৃত্যুপুরিতে যেতে রাজি না। অনেকদিন বাঁচার সাধ ওর। মনিব কন্যার চিন্তা দূর করতে জুজানি বলল,
“কী যে বলেন না মিস! রোগ টোগ কিছু না। আজকাল যে ঠাণ্ডা পড়েছে। ঠাণ্ডাতে এমন হয়। এ স্বাভাবিক।”
“আর এই গলার ক্ষত?”
“বোধহয় কোথাও আঘাত টাঘাত পেয়েছিলেন।”
“আমার তো মনে পড়ছে না।”
“আঘাতটা হয়তো বেখেয়ালেই লেগেছে৷ ছাড়ুন তো এসব গম্ভীর কথাবার্তা। ওই যুবকের কথা বলুন। আজও কী আসবেন তিনি?”
“কী জানি। কিছু তো বলেনি।”
নিজের ফ্যাকাশে ত্বক আর ক্ষতের কারণ এখনো অনুসন্ধান করছে মনে মনে। জুজানি মিসের চুল খোঁপা করে সরে দাঁড়ায় এককোণে৷
“আমার মন বলছে তিনি আজও আসবেন। আপনার রূপের আকর্ষণই তাঁকে টেনে নিয়ে আসবে এ বাড়িতে, আপনার রুমে।”
শেষটা রসাত্মক সুরে বলল জুজানি। নিজের রূপ নিয়ে গর্ব করে ভিক্টোরিজা। জুজানির মতোই বিশ্বাস, এই রূপের মোহেই নিকোলাস আসে। কে জানে এই রূপের দাসত্ব করতেও চাইবে একদিন।
বাইরে গাড়ির হর্ণে জুজানি দৌড়ে জানালার কাছে যায়। নিকোলাস গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। জুজানি উত্তেজিত হয়ে ফিরে তাকাল ভিক্টোরিজার দিকে।
“নাম নিতে না নিতেই আপনার প্রেমিক হাজির মিস।”
ভিক্টোরিজা থুতনি উঁচু করে আয়নায় নিজেকে দেখে মুচকি হাসল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“চল, নিচে যাই।”
নিকোলাস সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকল। একজন চাকর অভ্যর্থনার সহিত হলঘরে বসতে দেয়। একটু পরেই সিঁড়িতে হিলের শব্দ শুনে উঠে এগিয়ে গেল নিকোলাস। ভিক্টোরিজা কাছাকাছি আসতে ওর ডান হাতের করপুটে চুম্বন করে বলল,
“তুমি আমাকে অনিয়ন্ত্রিত পুরুষ করে ছেড়েছ রিজা। নিজেকে আজকাল বশে আনতে পারছি না। ঘুরেফিরে তোমার দ্বারগৃহে, তোমার কাছেই ফিরে আসতে হচ্ছে।”
“অনুযোগ করছ?” ভিক্টোরিজা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পাশ কেটে হলঘরে গেল। জুজানি নত মাথায় অনুসরণ করে। নিকোলাস ঘুরে বলল,
“মোটেও না। আমার হৃদয়ের অবস্থা ব্যক্ত করছি মাত্র।”
ভিক্টোরিজা সদম্ভে বসল হলঘরের সোফাতে। জুজানি পেছনে দাঁড়িয়ে। ভিক্টোরিজা বলল,
“তোমার ভয় হয় না?”
নিকোলাস মুখোমুখির সোফাটাতে বসে মোহাচ্ছন্ন প্রেমিকের ন্যায় হেসে বলল,
“হৃদয়ের অবস্থা অকপটে ব্যক্ত করতে?”
“হ্যাঁ।”
নিকোলাস উঠে এসে ভিক্টোরিজা কাছে বসল।
“ভীষণ ভয় হয়, পাছে তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করো, আমার হৃদয় ভেঙে দাও।”
ভিক্টোরিজা সম্মোহিত হয়ে যায়। নিকোলাস ঝুঁকে আসতে চোখ বন্ধ করে ঠোঁট আলগা করে। কিন্তু উঞ্চতা পায় না। কানে আসে কর্কশ কাশির শব্দ। চোখ খুলে দেখল নিকোলাস কাশছে।
“কী হলো?”
“পানি, পানি।”
কোনোমতে বলল নিকোলাস। হলঘরের ডাইনিংএ পানি ছিল। জুজানি এনে দিতে বলল,
“ঠাণ্ডা পানিতে আমার অ্যালার্জি। একটু গরম পানির সাথে মধু মিশিয়ে আনলে গলাটা আরাম পেত।”
ভিক্টোরিজা জুজানিকে বলল,
“যা ইসাবেলকে গিয়ে বল।”
জুজানি গরম পানি নিয়ে ফিরে এসে বলল,
“রান্নাঘরের মধু শেষ। ইসাবেল ভাঁড়ার ঘরে মধু আনতে গেছে।”
ভিক্টোরিজা রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল নিকোলাস থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আপাতত তাহলে পানিটুকুই দাও।”
সামান্য একটু পানি মুখে দিতেই কাশি কমে গেল। গ্লাসটা জুজানির হাতে দিয়ে হঠাৎ কপাল কুঁচকে বলল,
“শিট!”
ভিক্টোরিজা ভুরু কুঁচকাতে নিকোলাস বলল,
“মাফ করো রিজা, আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। জরুরি একটা কাজ ভুলে ফেলে এসেছি।”
“এই তো এলে!”
“আমি কথা দিচ্ছি আবার আসব, আসতে যে হবেই। তোমাকে না দেখে যে থাকতে পারি না।”
ভিক্টোরিজার চুল কানের পাশে গুঁজে গালে আলতো চুমু দিয়ে বলল নিকোলাস। লাজে লাল হয়ে ওঠে ভিক্টোরিজা। যে মেয়ে বিছানার চাদর পরিবর্তনের মতো পুরুষ পরিবর্তন করে তার কাছে এই লজ্জা বেজায় বেমানান। জুজানি অবাক হয়ে দেখল। নিকোলাসের ঠোঁটে তখন কপট হাসি। এই মেয়েকে না মারার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করেনি ও। তাছাড়া না মেরে যদি প্রয়োজন মেটে তবে মারাটা অনর্থক। অনর্থক কাজ পছন্দ নয় নিকোলাসের।
ভাঁড়ার ঘরের ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। রেড়ির তেলের টিমটিমে আলোতে সামনেটা দেখল। স্তুপের পর স্তুপ বস্তা, পলিথিনে মোড়া তৈজসপত্র, শস্য ভর্তি কাঠের বড়ো বাক্সে ভরা ভাঁড়ার ঘর। এত জিনিসের মধ্যে মধুর পাত্র খুঁজে বের করা ঘাসের মধ্যে সুই খোঁজার মতো ব্যাপার। জুজানিকে এত করে বলল ওর জানা নেই মধু কোথায়। মেয়েটা একটাই জবাব দিলো বার বার,
“গেলেই পাবে, গেলেই পাবে।”
পায়ের কাছ দিয়ে কতগুলো ইদুর দৌড়ে যেতে লাফিয়ে উঠল ইসাবেলা। বাতিটা নিভু নিভু করেও জ্বলে রইল। রাগ হচ্ছে খুব। দাঁতে দাঁত চেপে বিদ্রুপের সুরে বিড়বিড় করে বলল,
“এত কষ্ট কেন করছি? দ্য গ্রেট পিশাচ নিকোলাসের কাশি হচ্ছে। মিস. ভিক্টোরিজা প্রিয়তমের কষ্ট দেখতে পারছেন না। তার প্রিয়তমের জন্য মধু দরকার। মধু না বিষ দেবো৷”
“নিষ্ঠুর, পাষাণ।”
নিস্তব্ধ বদ্ধ ঘরে দ্বিতীয় গলার স্বর শোনামাত্র চমকে ওঠে ইসাবেলা। তারপর যখন বুঝতে পারে গলাটা নিকোলাসের রাগে মুখ শক্ত করে ঘুরে দাঁড়ায়।
“শব্দ দুটো আপনার মুখে মানালো না।”
“আমি পিশাচ বলে?” নিকোলাস বিদ্রুপ করল যেন।
ইসাবেলা সে কথার জবাব না দিয়ে চলে যাচ্ছিল। নিকোলাস পিছু নিলো, কিন্তু নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে। এই মেয়েকে এতবার অনুরোধ করা স্বত্বেও গলার রোজারি খোলেনি। ইসাবেলার বিশ্বাস অর্জনের জন্য ভিক্টোরিজার বাড়িতে অসময়েও আসছে। ভিক্টোরিজাকে না মারার এটাও একটা কারণ।
“বেলা?”
ইসাবেলা নিরুত্তর।
“বেলা?”
“কী?” ঘুরল ইসাবেলা। সামান্য গলা চড়ে গেল এবার। নিকোলাস শান্ত গলায় বলল,
“কতবার অনুরোধ করছি, ওটা খুলে ফেলো প্লিজ।”
“আমিও কতবার একই জবাব দিচ্ছি এবং দেবোও, না, না।”
“এত জেদি কেন তুমি?”
“আপনি এত বেহায়া কেন?”
“বেহায়া?”
“হ্যাঁ, বেহায়া। একটু আগে ভিক্টোরিজার সাথে মাখামাখি করে এসে এখন আবার আমাকে পটানোর চেষ্টা করছেন। কতবড়ো নীচ আপনি জানেন? মন তো চাচ্ছে ক্রুশটা আপনার হৃদয় বরাবর বিদ্ধ করি। আচ্ছা, হৃদয় আছে তো আপনার? ওহ! আমি তো ভুলেই গিয়েছি, হৃদয় আছে আপনার, কিন্তু মিথ্যার আবরণে আবৃত। একটু আগে হৃদয়ের মিথ্যা আবেগ অনুভূতি ব্যক্ত করে এসেছেন মেয়েটাকে। প্রতারক কোথাকার!”
নিকোলাস ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর ক্রমেই ঠোঁট প্রসস্থ হলো দু’পাশে।
“জেলাস, হুম?”
“এটাকে জেলাসি বলে না, তিরস্কার বলে।” ইসাবেলা প্রতিবাদ করে। নিকোলাস হাসি চাপার চেষ্টা করে করে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“তুমি যদি দিনকে রাত বলো এখন আমি সেটাও মেনে নেবো, বেলা।”
ইসাবেলার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিকোলাস কেন উঠে পড়ে লেগেছে ওর পিছনে? কী এমন কথা যা দূর থেকে বলতে পারছে না? ইসাবেলা যে ওর কাছে যেতে ভয় পায়। না, মৃত্যুর ভয় নেই। নিকোলাসকে ভালোবেসে ফেলার ভয়ে ভীত ও। এমনিতেই মন বড্ড দুর্বল হয়ে আছে। জীবনটা ইতোমধ্যে কমপ্লিকেশনে ভরপুর। আর কমপ্লিকেশন চাচ্ছে না। নিকোলাসকে ভালোবাসতে চাচ্ছে না ও। এ যে পাপ, অবৈধ।একজন মানুষ পিশাচকে ভালোবাসতে পারে না।
বিরক্ত প্রকাশ করে নাক মুখ কুঁচকে ফেলল। তারপর রাগত গলায় বলে,
“আই হেইট ইউ।”
“আমি জানি।”
ইসাবেলার মুখ বদলে যায়। দরজার দিকে ঘুরে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে। নিকোলাসের ধৈর্যের বাধ ভাঙল। অনেক হয়েছে অনুরোধ। ইসাবেলাকে কাছে চায়। সে ভাবেই হোক। অন্য মেয়েদের যেভাবে চেয়েছে সেভাবে চায় না ইসাবেলাকে। অঞ্জলিপুটে ওর মুখশ্রী তুলে চোখে চোখ রেখে ওকে পড়তে চায়, দুবাহুতে জড়িয়ে ধরে সময় ভুলতে চায়, হাতে হাত রেখে হাঁটতে চায় বহুপথ, ওর কাঁধে মুখ লুকিয়ে, চুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে ওর ভেতর নিজেকে হারাতে চায়।
“বেলা?”
ভাঁড়ার ঘরের সামনের অন্ধকার দাঁড়িয়ে দুজন। ইসাবেলা না ঘুরেই বলল,
“আমার জবাব কোনোদিন বদলাবে না নিকোলাস।”
“এখনই বদলাবে।”
ইসাবেলার পা আবার থামল। নিকোলাস বলল,
“যখন মাতভেই এবং ওর মায়ের জীবনে বিপদ ঘনিয়ে আসবে। বিপদ? উহু, ঠিক বিপদ নয়। মৃত্যুর যে ছায়া থেকে ওদের বাঁচিয়েছ তাই যখন ফিরে আসবে তখন__”
নিকোলাসের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইসাবেলা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“খবরদার নিকোলাস, ওদের ক্ষতির চিন্তা করলে আমি আপনাকে শেষ করে ফেলব।”
নিকোলাসের কপালের রগ দপদপ করে। মনে মনে ভাবে, এত আপন ওই মাতভেই তোমার? ওর জন্য আমাকে মারতে চাও? কিন্তু গলার স্বর শান্ত রেখে বলে,
“সে তোমার সাধ্যের বাইরে। আজ রাতটা সময় দিলাম। আগামীকাল যখন আসব তোমার গলায় ওই জিনিস থাকবে না। আর যদি এই কথা অমান্য করেছ বেলা, আমাকে তুমি ভালো করেই চেনো।”
কথাগুলো বলে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না নিকোলাস। পরাজিত মুখে সামনের আবছায়াতে চেয়ে রইল ইসাবেলা। ঠোঁট ঈষৎ কেঁপে উঠল। অস্ফুটে ভর্ৎসনার সুরে বলল,
“পিশাচ, পিশাচ।”
চলবে,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪৮
Writer তানিয়া শেখ
বারের ভিআইপি রুমে বসে আছে ড্যামিয়ান। হাতে সিগার আর সামনে ভদকার গ্লাস। কোলে বসা বাদামি চুলো এক তরুণী বার ডান্সার। ড্যামিয়ানের খালি হাত মেয়েটির শরীরের সর্ব স্থানে বিচরণ করছে। কিন্তু ওর দৃষ্টি সামনের ব্যক্তি দুজনের দিকে। তাদের কামুক চাহনি মেয়েটির ওপর। ড্যামিয়ান সিগারে টান দিতে তরুণী ঠোঁট চেপে সবটা ধোঁয়া নিজের মুখে নিলো। তারপর ঘুরে বসে সামনের ব্যক্তি দুটোর মুখের ওপর ছেড়ে মুচকি হাসে। ওর কোমরে স্থির ড্যামিয়ানের হাতটা শক্ত হয়। ব্যথায় “উহু” করে উঠল তরুণী।
“বিহেভ!” সতর্ক করল ড্যামিয়ান। তরুণীর মুখটা মলিন হলো। কোমরে ভীষণ ব্যথা দেওয়ায় অভিমান করে। কোল ছেড়ে উঠতে গেলে বাধা দেয় ড্যামিয়ান। বাজখাঁই গলায় বলল,
“রাগ করেছ? কেন? ইউ ওয়ান্ট থ্রিসাম, হুঁ?”
তরুণীর গলা চেপে ধরে এক হাতে। ভয়ে মুখের রঙ উড়ে যায় মেয়েটার। ও ড্যামিয়ানকে চেনে প্রায় এক সপ্তাহ হলো। অর্থবান বলে ড্যামিয়ানের সঙ্গী হওয়ার প্রস্তাবে এক কথায় রাজি হয়েছে। দেখতেও সে সুদর্শন। কিন্তু কয়েকদিন যেতে এই সুন্দরের আড়ালের আসল রূপটা ও দেখতে পায়। লোকটা বিকৃত মানসিকতার। সব কিছু বড়ো অদ্ভুত। ওর কিছু কাজে মেয়েটা ইদানীং ভয় পেতে শুরু করেছে। এই যে এখন যেভাবে তাকিয়ে কথা বলছে তা রীতিমতো ভীতির সৃষ্টি করে।
“সরি স্যার, আ’ম সরি।”
মেয়েটা ক্ষমা চায়। ড্যামিয়ান মেয়েটার ক্ষমা প্রার্থনা এড়িয়ে সামনে বসা ব্যক্তি দুজনকে আদেশ করে,
“বের হ এখান থেকে, এক্ষুনি।”
ব্যক্তি দুজন ভীত মুখে বেরিয়ে যায়। ড্যামিয়ান তরুণীর গলায় চাপ বাড়িয়ে বিকৃত গলায় বলল,
“ওদের দেখে তোর ভেতরের বেশ্যাটা জেগে উঠেছে, হ্যাঁ?”
“স্যা_র” তরুণীর গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে এলো ড্যামিয়ানের হাতের চাপে। ড্যামিয়ানের মায়া হয় না। চোখ দুটো নির্মম, হিংস্র। তরুণীকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে আদেশ করে,
“হাঁটুর ওপর বস, কুক্কুরি।”
তরুণী তাড়াতাড়ি হাঁটুর ওপর বসে ফুপাতে লাগল। ড্যামিয়ান বেল্ট খুলে ওর গলায় বাধে। শেষ অংশ টানতে তরুনীর শ্বাসরোধ হয়ে এলো যেন। মুখ হা করল কথা বলার জন্য। ড্যামিয়ান দু আঙুল মুখে ঢুকিয়ে দেওয়ায় কথাগুলো কেবল গোঙানির মতো শোনায়।
“হামাগুড়ি দে।
তরুণী ইতস্তত করে সামান্য। ড্যামিয়ান বেল্টের শেষ অংশে ফের টান দিতে তরুণীর গলার বাঁধনে চাপ পড়ে। হামাগুড়ি দিতে বাধ্য হয়। ওর দু-চোখ ফেটে জল পড়ছে এই লাঞ্ছনায়, কিন্তু ভয় পায় প্রতিবাদ করতে।
“যতক্ষণ না বলব এভাবেই থাকবি। কোনো কথা হবে না, না কোনো নড়াচড়া। বুঝাতে পেরেছি?”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় তরুণী। মেয়েটি যেন মানুষ নয় পালিত প্রভুভক্ত কুকুর ড্যামিয়ানের কাছে। যার নিয়ন্ত্রণ এখন ওর হাতে৷
কিছুক্ষণ পর বারের ভিআইপি রুমের দরজায় নক পড়ে। বিরক্ত হয় ড্যামিয়ান।
“কে?”
“আমি।”
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে মুখের ওপর থেকে বিরক্ত মুছে গেল।
“ভেতরে এসো।”
আগন্তুক ভেতরে ঢুকতে উচ্ছ্বসিত হওয়ার ভান ধরে বলল,
“পার্টনার!”
আগন্তুক ফ্লোরে হামাগুড়ি দেওয়া মেয়েটিকে দেখে মুচকি হাসল। তারপর তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,
“আমরা পার্টনার নই আর না হব।”
ড্যামিয়ান সামনের কাউচে বসতে ইশারা করে বলল,
“তুমি মানো আর না মানো আমি তো তোমাকে পার্টনারই ভাবি, পার্টনার। এই যে আমরা একে অপরের প্রয়োজনে পরস্পরকে সহযোগিতা করছি, এটা তো পার্টনাররাই করে, তাই না? তাছাড়া আমাদের দুজনের শত্রুও তো ওই একজনই। দুজনের গন্তব্য যখন এক পথে তখন পার্টনার হতে দোষ কোথায়?”
আগন্তুক চুপ করে রইলেন। হামাগুড়ি দেওয়া তরুণীর পশ্চাৎ আগন্তুকের দিকে। আগন্তুকের দৃষ্টি বার বার ওইদিকে যায়। ড্যামিয়ান মুচকি হেসে বলল,
“দেখার জিনিস দেখতে এত সংকোচ করছ কেন পার্টনার?”
আগন্তুক বিব্রতবোধ করে। ড্যামিয়ানের কথা অগ্রাহ্য করে বলে,
“আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি।”
“সাহায্য! আমাকে? এবং কীভাবে?”
“ইসাবেলাকে পেতে সাহায্য করব।”
ড্যামিয়ান হাসল। আগন্তুক ভুরু কুঁচকায়। ড্যামিয়ান ভদকা গলায় ঢেলে বলল,
“যা আমার তা আমি সময় হলে নিজেই হাসিল করে নেবো পার্টনার। তোমাকে তার জন্য কষ্ট করতে হবে না।”
আগন্তুক বলল,
“সেটা আগে হলে পারতে, কিন্তু এখন আর পারবে না। নিকোলাস সর্বক্ষণ ওর সাথে ছায়া হয়ে থাকে। আমার তো মনে হয় ওর প্রেমে পড়েছে। ওই মেয়ের জন্য পুরো পিশাচ কমিউনিটিকে হুমকি দিয়েছে, ভেঙেছে এত বছরের নিয়ম। এখন কারো সাহস নেই ওই মেয়েকে ছোঁয়ার।”
“পিশাচ আর প্রেম? ইন্টারেস্টিং তো! আমার না বোর লাগছিল এতদিন, পার্টনার। এখন এক্সাইটেড ফিল হচ্ছে। একটি ফুলের দুজন দাবিদার। ওয়াও! দারুন জমবে এবার খেলা। প্রতিদ্বন্দ্বী যখন নিকোলাস উইলিয়াম তখন তো গেমস টোটালি জমে যাবে।”
আগন্তুক ভেবে এসেছিল ড্যামিয়ানকে ভয় পাইয়ে, রাগিয়ে কার্যোদ্ধার করবে, কিন্তু হচ্ছে উলটো। এই ড্যামিয়ান যে একটা অপ্রকৃতিস্থ ভুলেই গিয়েছিল আগন্তুক। অপ্রকৃতিস্থেরা ভয় পায় না বরং ভয় পাইয়ে ছাড়ে। আগন্তুকের হতাশ মুখে চেয়ে ক্রূর হাসল ড্যামিয়ান। বলল,
“চিন্তা করো না পার্টনার। তোমাকে আমি সাহায্য করব।”
“আমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”
শব্দ করে হাসল ড্যামিয়ান।
“মিথ্যা বলো না পার্টনার। আমি তুমি দুজনই জানি, আমরা স্বার্থ ছাড়া কাজ করি না। এখন স্বীকার করো, একে অপরের পার্টনার হবে কি না?”
আগন্তুক ভেবে বলল,
“ঠিক আছে, কিন্তু_”
ড্যামিয়ান থামিয়ে দিয়ে বলে,
“কিন্তু আমার একটি শর্ত আছে। তোমার সাহায্য আমার লাগছে না, কিন্তু আমার সাহায্য ছাড়া তুমি তোমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। এতবড় উপকার করে দেবো বিনিময়ে কিছু দেবে না পার্টনারকে?” ড্যামিয়ান বেল্টের শেষাংশ টেনে তরুণীকে দুপায়ের মাঝে আনে। আগন্তুক বলল,
“বিনিময়?”
“হ্যাঁ।” ড্যামিয়ান প্যান্টের চেইন খুলে তরুণীর মাথার পেছনে হাত রেখে ওর মুখটা কোলের ওপর চেপে ধরে। আগন্তুক চোখ সরিয়ে নেয়। মেয়েটির চাপা গোঙানি উপেক্ষা করে প্রশ্ন করে,
“কী চাও?”
“নোভালি।” বা’হাতে ডান গালের কাটা দাগটাতে হাত বুলিয়ে বলল ড্যামিয়ান। আগন্তুকের শান্ত চোখ মুহূর্তে জ্বলে ওঠে।
“কক্ষনো না।”
“তাহলে তোমার স্বপ্নও ভুলে যাও। ওই স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হবে না। ফিরে পাবে না হারিয়ে যাওয়া সেই সম্মান। আমি জানি, তোমার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে পার্টনার। আমি জানি, প্রতিনিয়ত কতটা কষ্টে কাটছে তোমার দিন। আমি এও জানি, তুমি ওই সামান্য ডাইনির জন্য নিজের স্বপ্নভঙ্গ হতে দেবে না।”
আগন্তুক চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ ভাবনা চিন্তার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ঠিক আছে।”
তরুণীকে ঠেলে ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে প্যান্টের চেইন আঁটকে হাত বাড়ায়,
“পার্টনার।”
আগন্তুক হাতটার দিকে চেয়ে নাক কুঁচকায়। ড্যামিয়ান প্যান্টে হাত মুছে পুনরায় হাত বাড়াতে হ্যান্ডশেক করে জবাব দেয় ,
“পার্টনার।”
ঝিম ধরা একটা রাত। আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে মেঘের ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে অনুজ্জ্বল চাঁদ। ইসাবেলা রাশভারী মুখে দাঁড়িয়ে আছে বেনাসের বাড়ির পেছনের বাগানে। রাতের বেলা এদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাকে সরগরম থাকে। আজ একেবারে ভূতুরে নিস্তব্ধতা। কনকনে ঠাণ্ডায় কাঁপছে ও। ইসাবেলা মুখ তুলল সামনে। নিকোলাস এক হাত দুরত্বে দাঁড়িয়ে। ইসাবেলার শ্বাসনালী ভেদ করে দেহের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে যায় সোঁদা মাটির গন্ধ। হৃৎস্পন্দনের গতির তীব্রতায় শ্বাস ভারী হয়। নিকোলাস এগোতেই ও বিড়বিড় করে,
“ঈশ্বর, ঈশ্বর।”
কোনো কিছুতেই আজ আর দুরত্ব তৈরি করতে পারে না নিকোলাসের থেকে। ওর ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া গালের দু’পাশে হাত রাখে নিকোলাস। ইসাবেলা তবুও চোখ তুলে তাকায় না। বিড়বিড়ানি আরো বাড়ে,
“ঈশ্বর, ঈশ্বর।”
নিকোলাস ওর গালদুটো দুহাতে হালকা ঘষে বলে,
“ঠাণ্ডায় জমে গেছো দেখছি।”
ইসাবেলা তখনো একইভাবে আছে। নিকোলাস হাঁপ ছেড়ে ওর কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে লাগল। ওর স্কার্ফে ঢাকা মাথার ওপর চুমু দিয়ে চুপ করে চেয়ে রইল সামনের অন্ধকারে। আজ অন্ধকারটাও কত সুন্দর লাগছে। ইসাবেলার বিড়বিড়ানি শুনে মুচকি হাসতে লাগল। দুজনে এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। ইসাবেলার বিড়বিড় শব্দ একসময় থেমে যায়। নিকোলাস ইসাবেলার মুখটা দেখল। ঘুমিয়ে পড়েছে ও। ইসাবেলার গালটা আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“আমি কখনো সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করিনি। কিন্তু আজ বলতেই হচ্ছে মনোহরা তাঁর সৃষ্টি। মনোহরা তুমি, বেলা।”
ইসাবেলার কপালে চুম্বন দিয়ে আস্তে করে কোলে তুলে নিলো। তারপর হাওয়ার বেগে ছুটে গেল সামনে। মিনিট খানিক পরে এসে থামে একটি কাঠের বাড়ির সদরে। দেখলে অনুমেয় বাড়িটি পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত। হিম বাতাসে দুলছে পায়ের নিচের সবুজ ঘাস। নিকোলাস দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে। ঘরের মাঝে বেশ বড়ো একটি খাট। উঁচু গদির বিছানা। তার ওপর শুইয়ে দিলো ইসাবেলাকে। শীতে কুঁকড়ে যায় ওর শরীর। নিকোলাস মোটা কম্বল টেনে দিলো গলা অব্দি। গাল ছুঁয়ে দেখল এখনো বেশ ঠাণ্ডা। সামনের ফায়ারপ্লেসটা জ্বালিয়ে এসে ইসাবেলার শিওরের পাশে বসল। বিছানায় থুতনি রেখে বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইল। ইসাবেলা পাশ ফিরে শুতে নিকোলাস আবার একইভাবে বসল সেদিকে। রাত গভীর হয়, কিন্তু নিকোলাসের পলক পড়ে না। সামনের জানালার অন্ধকারে একপলক চেয়ে বলে,
“আজ রাত না ফুরাক, এমনই থাক, এমনই থাক। আমি দেখি তোমায়, তুমি তুমি নও, তুমি যেন
মৃত্যুর অমানিশায় জীবনের গান।
আমার আঁধারে আলোর স্ফুরণ।
মৃতসঞ্জীবনী, তুমি আমার মৃতসঞ্জীবনী।”
চলবে,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪৯
Writer তানিয়া শেখ
বন মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙল ইসাবেলার। ঘুমে ভারী চোখের পাতা। টের পেল পাশ থেকে কেউ জড়িয়ে ধরে আছে। মাদাম আর ও পাশাপাশি ঘুমায়, কিন্তু মাঝ খানে যথেষ্ট জায়গা রেখে। ইসাবেলা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘুমাতে অস্বস্তিবোধ করে। মাদাম কি আজ জড়িয়ে ধরেছে ঘুমের ঘোরে? আগে এমন তো হয়নি! একটু নড়েচড়ে উঠল। হঠাৎ মনে পড়ল রাতের কথা। শেষবার ও নিকোলাসের সাথে ছিল। তবে কী! চকিতে তাকাল। দৃষ্টি স্থির হয় ওর পেটের ওপরের পুরুষালি লোমশ হাতটার দিকে। ওর সমস্ত শরীর হিম হয়ে এলো। নিঃশ্বাস ফেলছে খুব আস্তে।
মাথাটা ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে পাশের ব্যক্তিটির মুখ দেখার চেষ্টা করল। বাইরে কুয়াশা কাটেনি৷ ঘরের ভেতর আলসে অন্ধকার। জানালা বরাবরের মতো পর্দায় ঢাকা। পাশে শায়িত ব্যক্তিটির মুখ স্পষ্ট দেখতে না পেলেও ও নিশ্চিত ব্যক্তিটি নিকোলাস। এতক্ষণে সোঁদা মাটির গন্ধটাও পেল। ইসাবেলার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। নিকোলাসের হাতটা পেটের ওপর থেকে সরাতে গিয়ে অবাক হয়। প্রাণহীন হিমশীতল হাতটা। নিকোলাসের হাতের স্পর্শ এর আগেও বহুবার পেয়েছে। তখন সাধারণ মানুষের মতোই উষ্ণ ছিল, কিন্তু এখন ও যেন মৃত। কোথাও শুনেছিল মানুষ মরে গেলে দেহ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। নিকোলাস কি মৃত এখন? ঠিক ওই মানুষগুলোর মতো? নিকোলাস জীবন্মৃত কথাটা ভেবে ততটা খারাপ লাগেনি যতটা কেবল মৃত এই কথাটা ভেবে লাগল। কেন খারাপ লাগল মৃত ভাবতে? বিছানা ছেড়ে নামল। তারপর ঘুরে দাঁড়ায় বিছানার দিকে। নিকোলাস ওর দিকে একপাশ হয়ে শায়িত। ওর মাথার কালো চুল এলোমেলো। ইসাবেলা খেয়াল করে, নিকোলাসের চুল বেশ লম্বা হয়েছে আগের তুলনায়। কপাল ছুঁয়ে কতগুলো চুল চোখের ওপর পড়েছে। মুদিত চোখেও কেউ এমন মুগ্ধ করতে পারে? নিজের ভাবনাকে কষে ধমক দিলো ইসাবেলা। গলা ঝেড়ে দৃষ্টি সরাতে গিয়ে থেমে যায়। নিকোলাসের ঠোঁটের একপাশ কুঁচকে গেছে। থুতনির টোলটা আরো বেশি চোখে পড়ে। এটাকে কি মুচকি হাসি বলে? না! ইসাবেলা যে এতক্ষণ তাকিয়ে আছে সেটা টের পেয়ে ওমন দুষ্টু হাসি হাসছে। ওর হাসি ইসাবেলার অঙ্গ জ্বালিয়ে দেয়।
“ডোন্ট ফ্লাটার ইওরসেল্ফ। আপনার চাইতেও সুদর্শন পুরুষ আমি দেখেছি।”
ইসাবেলার বিদ্রুপ ভালোভাবে নিলো না নিকোলাস। চোয়াল কঠিন হলো। ওর ঠোঁটের দুষ্টু হাসি মুছে দিতে পেরে মনে মনে বিজয়ীর হাসি হাসল ইসাবেলা। দরজার কাছে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিকোলাসের রুষ্ট মুখ দেখে মুচকি হেসে বেরিয়ে এলো বাইরে।
এই পুরোনো কাঠের বাড়ির চারপাশের ঘন বৃক্ষগুল্মের সারি। বারান্দা পর্যন্ত উঠে এসেছে পরগাছা। রেলিঙের এখানে ওখানে বরফ ছড়িয়ে আছে। বারান্দার দরজার মুখের দুপাশে বুনো গাছের পাতা ঢেকে আছে বরফে। সামনের বরফের মাঝে মাঝে সবুজ ঘাসগুলো দেখা যায়। আরো সামনে ঘন কুয়াশা। বাইরে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। ইসাবেলা আরেকটু অপেক্ষা করে। একটু পর সূর্য উঁকি দিতে পাতলা বরফ ছড়ানো ঘাসের ওপর পা রাখল। ঘর থেকে বেরোনোর আগে বুটজোড়া পরতে ভোলেনি। বাড়ির এদিক ওদিক ঘুরে হতাশ হয়। বুঝতে পারে নিকোলাস ওকে নিয়ে এসেছে বেনাসের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। এখান থেকে একা ফিরে যাওয়া অসম্ভব।
সূর্যের তেজ বাড়তে অদূরের কুয়াশা কেটে সবুজ অরণ্য দৃশ্যমান হয়। ইসাবেলা বাড়িটির সামনে পড়ে থাকা স্যাঁতসেঁতে শুকনো গাছের গুড়ির ওপর বসল। এখান থেকে পাহাড়ের সামনে এবং নিচটা দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের এত ওপর থেকে নিচটা দেখতে চমৎকার সুন্দর । সাদা আর সবুজে যেন মিতালি গড়েছে। অদূরের নিবিড় অরণ্যের মাঝে শেষ হয়ে গেছে নীল আকাশ। ইসাবেলা আনমনে অনেকক্ষণ বসে রইল সেখানে। এই নির্জনতা, একাকিত্ব হতাশার অন্ধকারে ঠেলে দেয়। সেই হতাশা, যার শুরুটা ছিল পিটারের চলে যাওয়ার পর।
বসে বসে কত কী ভাবতে লাগল। সবচেয়ে বেশি ভাবে নিজের দুর্বল মনটাকে নিয়ে। ও আর কাওকে ভালোবাসতে চায় না, নিকোলাসকে তো নয় ই। ঈশ্বরের দাসী ইসাবেলা, আর নিকোলাস ঈশ্বরদ্রোহী। ওদের মধ্যে যা হবে সব পাপ। নিকোলাস অভিশপ্ত। ইসাবেলা চায় ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট জীবন। নিকোলাসের সঙ্গ ওর জীবন বদলে দিয়েছে। ওর ভেতরের সরলতা, পবিত্রতা খর্ব হয়েছে। মা আন্না মেরিও আজকের ইসাবেলাকে দেখে খুশি হবেন না। দুঃখ পাবেন তাঁর নিস্পাপ মেয়েটির নির্মমতার কাহিনি শুনলে।
মায়ের মলিন মুখ ভেবে বিষণ্ণ হয়। নিকোলাসকে মা আন্না মেরিও কোনোদিন মেনে নেবেন না। নিকোলাস পিটার নয়, নিকোলাস মানুষ নয়, নিকোলাস পিশাচ। চোখ দুটো ভীষণ জ্বলতে লাগল। পিটার যদি সেদিন ফেরারি না হতো তবে নিকোলাস ওর জীবনে আসত না। ইসাবেলাকে এই কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হতো না।
“আমি তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করব না পিটার, কোনোদিন না।”
ইসাবেলার গাল বেয়ে উষ্ণ বারিধারা বয়ে গেল। উঠে পাহাড়ের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়। এই মুহূর্তে এখান থেকে লাফিয়ে পড়লে জীবনের সকল সংকট দূরীভূত হবে। আন্না মেরিও, পিটার ও নিকোলাস কারো কথা ওকে আর ভাবতে হবে না। মৃত্যু! পিটার চলে যাওয়ার পর এই শব্দটা বহুবার ভাবিয়েছে ওকে। বহুবার মৃত্যুকে চেয়েছে। হৃদয় ভাঙার কষ্টের চাইতে কি মৃত্যুকে বরণ করার কষ্ট বেশি? মৃত্যুর পর আবার বাঁচার সুযোগ থাকলে এই প্রশ্নের জবাব ইসাবেলা খুঁজে নিতো। আগাগোড়াই ও ভীতু। সেদিন হৃদয় ভাঙার কষ্ট গলাধঃকরণ করেছিল মৃত্যু ভীতি এড়াতে। আজ কী করে নিজের মনকে বাঁচাবে দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়া থেকে? কী করে নিকোলাসের সান্নিধ্যে এসে ওর আকর্ষণকে উপেক্ষা করবে? যে ওর মধ্যে থেকে পিটারের প্রতি ভালোবাসা ম্লান করে দিতে পারে, সে সব পারে। ইসাবেলাকে ভালোবাসতে বাধ্যও করতে পারে।
“না না, ভালোবাসি না, ভালোবাসব না।”
ইসাবেলা বেখেয়ালে একেবারে পাহাড়ের শেষ প্রান্তে চলে এলো। আরেক পা এগোলেই খাদে গিয়ে পড়বে। এই মুহূর্তে সেই হুঁশ ওর নেই। মনটা বড়ো অশান্ত। মস্তিষ্ক অস্থির।
“বেলা!” পেছনে নিকোলাসের আতঙ্কিত গলার স্বরে মৃদু কম্পিত হয় ইসাবেলা। ভাবনার সুতো ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে বাস্তবে। কিন্তু এই বাস্তবতা ওকে শান্তি দেয় না। নিকোলাসের উপস্থিতি আরো বেশি বিষণ্ণ করে।
“পালিয়ে যা নিকোলাস কাছ থেকে। অনেক দূরে পালিয়ে যা।”
ভেতরের সেই আহ্বানে অজান্তে সামনে পা বাড়ায়। পাহাড় থেকে শূন্যে ভাসতে ভয়ে দুচোখ বন্ধ করল। মৃত্যু! অবশেষে কি মৃত্যু হবে ওর? ডানা মেলা পাখির মতো নিজের দেহের ভার ছেড়ে দেয় শূন্যের ওপর। কিন্তু ওর মন বলছে ও এবারো মরবে না। নিকোলাস ওকে মরতে দেবে না। ঠিক তাই হলো। কোমরে নিকোলাসের বাহুবন্ধন টের পাচ্ছে ও। দুহাতে শক্ত করে নিকোলাসের বুকের কাপড় মুঠোবন্দি করেছে। রাগে গজগজ করছে নিকোলাস। নিরাপদ স্থানে আসতে চোখ মেলল ইসাবেলা। নিকোলাসের নীল চোখজোড়া রাগে রক্তবর্ণ হয়েছে।
“কেন এমন করলে, বেলা?”
“আপনার কাছ থেকে দূরে যেতে।”
আনত মুখে আস্তে আস্তে বলল ইসাবেলা। কিছুক্ষণ কথা বলতে ভুলে গেল নিকোলাস। তারপর আচমকা ওর চোয়াল চেপে ধরে বলল,
“কী ভেবেছিলে? মৃত্যু আমাদের মাঝে দুরত্ব তৈরি করবে?”
“করবে না?” চোয়ালের ব্যথা গিলে পালটা প্রশ্ন ছোঁড়ে ইসাবেলা। নিকোলাস কাষ্ঠ হাসল।
“নির্বোধ বেলা।”
ইসাবেলা প্রতিবাদ করার আগেই নিকোলাস ওকে পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে ইসাবেলা। নিকোলাস ওর হাত ধরে ফেলল সাথে সাথে। শূন্যে ঝুলছে ইসাবেলা। নিচে গভীর খাদ। পড়লে মৃত্যু অবধারিত।
“হাত ছেড়ে দেবো?” নির্লিপ্ত গলায় বলল নিকোলাস। ইসাবেলা কেঁদে দেয় শব্দ করে।
“না, প্লিজ।”
“কাঁদছ কেন? তুমিই তো একটু আগে মরতে গিয়েছিলে।”
“আমার মাথা ঠিক ছিল না। ভুল হয়েছে। প্লিজ আমাকে ওপরে তুলুন নিকোলাস।”
“ওপরে? না, ওপরে এলে আমাদের মাঝের দুরত্ব ঘুচে যাবে। তুমি তো সেটা চাও না, বেলা।”
“আমি নির্বোধ, আমার ভুল হয়েছে। প্লিজ নিকোলাস।”
ইসাবেলা অঝোরে কাঁদতে লাগল। নিকোলাস তবুও তুললো না। বলল,
“আগে বলো কেন আমার কাছ থেকে দূরে যেতে চাও? যদি মিথ্যা বলেছ, বেলা! বলো।”
“আ,,আম,,উমম” ইসাবেলা তোতলাতে লাগল। ওর হিচকি উঠে গেছে। নিকোলাস হাত ঢিল করতে ইসাবেলা আরো জোরে কেঁদে দেয়। হড়বড়িয়ে বলে,
“আপনাকেভালোবেসেফেলবএইভয়ে।”
“কী? স্পষ্ট করে বলো এবং ধীরে সুস্থে।”
“আপনাকে ভালোবেসে ফেলব এই ভয়ে।” কথাটা বলতে বলতে ওর গাল লাল হয়ে ওঠে। নিকোলাস সাথে সাথে টেনে আনল ওপরে। বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।
“বেলা, বেলা।”
নিকোলাসের গলা দিয়ে আর কোনো শব্দ আসে না। এই কি আনন্দ? একেই খুশিতে বাক্যহারা হয়ে যাওয়া বলে? ইসাবেলা হিচকি তুলে কাঁদছে। ওর মুখটা আঁজলা ভরে তুলে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চোখের জল মুছে দেয় নিকোলাস। ইসাবেলার গোলাপি ঠোঁট লাল হয়ে উঠেছে। কাঁপছে থরথর করে। নিকোলাস ঝুঁকে ওর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলে,
“একটা চুমু খাব, বেলা। শুধু একটা।”
চমকে ওঠে ইসাবেলা। ঠোঁট চেপে মুখের ভেতর ঠেলে সজোরে দুদিকে মাথা নাড়ায়।
“একটা চুমুতে ভালোবাসা হয় না। হবে না।” নিকোলাস বলল। ইসাবেলা ঢোক গিলে আবারো প্রত্যাখ্যানের করবে বলে নিজেকে প্রস্তুত করে। কিন্তু মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,
“সত্যি একটা চুমুতে ভালোবাসা হবে না তো?”
“একদম না। বিশ্বাস না হলে ট্রাই করেই দেখো।”
নিকোলাস ঠোঁট নামিয়ে আনতে ইসাবেলা মাথা পেছনে নেয়। আপত্তি জানাতে চায়, কিন্তু ওর ঠোঁটের দিকে চেয়ে সব গুলিতে ফেলল। বলল,
“শুধু একটা কিন্তু।”
“শুধু একটা।”
ইসাবেলা দুচোখ বন্ধ করে কম্পিত গলায় বলল,
“আচ্ছা, শুধু একটা।”
মুহূর্তে নিকোলাসের ঠোঁট নেমে আসে ওর ঠোঁটের ওপর। ইসাবেলার ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। চোখ দুটো বিস্ফোরিত। অবশ হয়ে এলো অঙ্গ। নিকোলাস প্রথমে ওর ঠোঁট তারপর ধীরে ধীরে সমস্ত মুখের ভেতর আধিপত্য বিস্তার করে।
ভুল বলেছে নিকোলাস। একটা চুমুতেও ভালোবাসা হয়ে যায়। ইসাবেলার মনে পড়ল এই একটা চুমুই ওর প্রথম চুম্বন। নিকোলাস ওর প্রথম চুম্বন অধিকার করে নিয়েছে। চুম্বনের মাঝেই ফের কাঁদতে শুরু করল ও।
চলবে,,