তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
1666

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪৪
Writer তানিয়া শেখ

একজন যুবক যে ছিল ভীরু, দুর্বল। ব্যথা ভুলতে যে কাপুরুষের মতো মানুষ থেকে পিশাচ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পবিত্র আত্মা পাপের আগুনে পুড়ে ছাইয়ে পরিণত হয়। যে ছাই কেবল অন্ধকারকে অনুভব করেছে। মানবীয় সকল অনুভূতি হারিয়েছিল সেই আঁধারে। যার দৃষ্টিতে আলো আছে সে পৃথিবীটা রঙিন দেখে। যুবকের দৃষ্টিতে আলো নেই, পৃথিবীটা ওর কাছে একরঙা, কালো। ওর হৃদয় পাপের ভারে হলো পাথর। সেই পাথর কারো কান্নায় গলেনি, দুঃখে কাঁদেনি। যে স্বার্থপর পৃথিবী যুবককে পিশাচে পরিণত হতে বাধ্য করেছে, সেই পৃথিবীর আলো মুছে দিতে বেপরোয়া হয়ে উঠল যুবক। জীবন্মৃত নয়, নিজেকে মৃত ভেবেছে সবসময়। মৃতের হারানোর ভয় থাকে না। যুবকেরও আর কোনো ভয় ছিল না। সে নিজেই হয়ে উঠেছিল ভয়ের আরেক নাম। আশ্চর্য! বহুকাল পরে আবার ভয় অনুভব করছে।

ইসাবেলা অ্যালেক্সিভ। এই মেয়েকে প্রথম দেখে নিকোলাসের পাথর হৃদয় জানান দিয়েছিল এখনো খানিক স্পন্দন তাতে অবশিষ্ট। চোখে ঘোর লেগে যায়, হৃদয়ে লাগে দোল। বহুকাল পরে সে এক নতুন অনুভূতির সম্মুখীন হয়। যাকে দুর্বলতা ভেবে বার বার দুরদুর করেছে। বার বারই নতুন উদ্যমে ফিরে এসেছে ওর মনের দুয়ারে। তিক্ত বিরক্ত হয়ে ইসাবেলাকে চিরতরে দূর করতে চায়। রওয়ানা হয় রিগার উদ্দেশ্যে। এই যাত্রা পথে দুজনে কিছুটা কাছে এলো। নিকোলাস বহুকালের স্বভাব ছেড়ে এক মানবীর প্রতি প্রকাশ করল ভালোলাগা। ভালোলাগার মানবীর কিছু হয়ে যায় এই শঙ্কায় শঙ্কিত থাকে। আগলে রাখতে শুরু করে। এদিকে ভেতরে ভেতরে চলে মহাযুদ্ধ। হৃদয়ের সাথে স্বভাবের, মনের সাথে মস্তিষ্কের। এই যুদ্ধে হৃদয়কে তুচ্ছ হতে হয় ম্যাক্সের সাথে ইসাবেলার সম্পর্ক জেনে। আবার নিষ্ঠুরতা দেখায় নিকোলাস। বিপদের মুখে আহত অবস্থায় ফেলে চলে যায়। এই চলে যাওয়া কেবল শরীরের। হৃদয়টা ততদিনে ইসাবেলাকে ধারণ করে নিয়েছে। কত কী করেছে হৃদয় থেকে ওকে ঝেড়ে ফেলতে, কিন্তু পারেনি। ফিরে এসেছে আবার ইসাবেলার দুয়ারে। দূর থেকে মাতভেই আর ইসাবেলার সান্নিধ্য দেখে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে। মনে মনে আশ্চর্য হয়ে ভেবেছে, মৃতের কি ব্যথাবোধ থাকে? যে বাতাসে ইসাবেলার গন্ধ পাওয়া যায় সেই বাতাস ছেড়ে গিয়েছিল নিকোলাস। ও ইসাবেলার জন্য ঠিক নয়, ইসাবেলাও ওর জন্য বেঠিক। এবার শুধু নিজের ভালো চিন্তা করল না, ইসাবেলার ভালো ভাবল। নিকোলাস জার্মানি বসে খবর পেল ইভারলির পরিণতির কথা। এর পেছনে কে দায়ী রিচার্ড খোলাখুলিভাবে জানায়নি। বলেছিল স্থানীয় কেউ একজনের কাজ। নিকোলাস মারতে আদেশ করে দেয়। ভাবেওনি যাকে মারতে আদেশ দিয়েছে সে আর কেউ না ওরই প্রিয়তমা ইসাবেলা। যখন পল সত্যিটা জানায় ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ লিথুনিয়া এসে ইসাবেলার এই ভয়ংকর নির্মম রূপ ওকে স্তব্ধ করে দেয়। ক্রোধের আগুনে প্রজ্জ্বলিত চোখজোড়া নিকোলাসের হৃদয়ে যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। ছুটে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে চায়, কিন্তু এবার দুরত্বের দেওয়াল তুলে দিয়েছে স্বয়ং ইসাবেলা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিচার্ড ইসাবেলাকে মারবে বলে প্রতিজ্ঞা করে। শুধু সে নয়, সমস্ত পিশাচ কমিউনিটির টার্গেট এখন ইসাবেলা। ওকে না মেরে এরা শান্ত হবে না। ভয়, নিকোলাসের ভয় আবার ফিরে এসেছে।

“কাউন্ট, কমিউনিটির নিয়ম অনুযায়ী ওই মেয়েকে আমাদের এখনই শেষ করতে হবে। এ কাজে আপনার অনুমতি চাচ্ছি আমরা।”

কমিউনিটির সদস্যের কথাতে নিকোলাস নিরুত্তর। রিচার্ড খেঁকিয়ে ওঠেন,

“অনুমতি দিচ্ছো না কেন তুমি? কেন ওই মেয়েকে মারতে বিলম্ব করছ নিকোলাস।”

“আপনি ভুলে যাচ্ছেন ছেলে নয় রাজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। বড্ড বেশি ভুল করছেন ইদানীং।” দাঁতে দাঁত পিষে বলল নিকোলাস। রিচার্ড ছেলের অগ্নিদৃষ্টি দেখে গলা সামান্য নামালেও ঝাঁজ বজায় রেখে বললেন,

“বাহ! বেশ বলেছেন কাউন্ট। আমি ভুল করছি, হুম? এখানে ভুল যদি কেউ করে থাকে তবে সেটা আপনি কাউন্ট। আপনার ভুলে ইভারলি, গ্যাব্রিয়েল্লাকে হারাতে হয়েছে আমাদের। আপনার ভুলে কমিউনিটির দুজন সদস্যের ওমন পরিণতি হয়েছে। ওই মেয়েকে মায়া দেখিয়ে আমাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আপনি বাঁচিয়েছিলেন। মনে আছে তো কাউন্ট? এখানের সবার কিন্তু মনে আছে। জিজ্ঞেস করুন।”

নিকোলাস তাকাতে পিশাচ সদস্যেরা দৃষ্টি মেঝেতে সরিয়ে নেয়। পিতার বক্র জবাবে ক্রোধিত হলেও সেটা চেপে গেল নিকোলাস। রিচার্ড ক্রূর হাসল মনে মনে। আবার বলল,

“আজ দুজনকে মেরেছে কাল আরো দুজনকে মারবে ওই মেয়ে। সিস্টার ভ্যালেরিয়ার বংশধর বলে কথা। আমি আগেই সাবধান করেছিলাম। দেখুন এখন কী হলো। পিশাচদের জন্য থ্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে ও। অথচ, এখনো আপনি চুপ করে আছেন। ওই মেয়েকে মারতে আপনার এত ঔদাসিন্যে কেন কাউন্ট?”

“ঔদাসিন্য না ছাই। মরা গাছে বসন্তের হাওয়া লেগেছে।”

সোফিয়ার কটাক্ষে উপস্থিত সকলে ভুরু কুঁচকে তাকাল। নিকোলাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।

“মা!” আন্দ্রেই সতর্ক করল মাকে। নোভা রেগে তাকায়। সোফিয়া নিষ্পাপ ভাব ধরে বসে রইল চুপচাপ। রিচার্ড স্ত্রীর দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন। হাসি স্থির রেখে নিকোলাসকে লক্ষ্য করে বললেন,

“ওহ! তবে এই কারণ? আমাদের কাউন্ট প্রেমে পড়েছেন?”

“রিচার্ড!”

নিকোলাসের চোখে রিচার্ড এবার সম্মান হারালো। বাবা ডাকের সম্মানটুকু ছিল লোক দেখানো। এখন সেটার বালাইও রাখল না নিকোলাস। ওর গর্জনে কেঁপে উঠল কক্ষটি৷ রিচার্ড ঢোক গিললো। কর্কশ গলায় নিকোলাস বলল,

“আপনি যথার্থই বলেছেন ভুল করেছি আমি। হ্যাঁ, করেছি ভুল। আপনাকে সম্মান দেখিয়ে এবং আপনার রক্ষিতাকে আপনার পাশে বসার অনুমতি দিয়ে ভুল করেছি। আজ তার দারুন মাশুল গুনছি। বড়ো বেশি স্পর্ধা দেখালেন আপনারা, বড়ো বেশি। এরপরে ক্ষমা নয় শাস্তি পাবেন আপনি এবং আপনার রক্ষিতা।”

“নিকোলাস! ভুলে যাচ্ছো ও আমার স্ত্রী এবং তোমার মা।”

“আর আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমি রাজা, এটা আমার রাজত্ব। এখানে যদি কারো শাসন, হুকুম চলে তবে সেটা একা আমার। আপনি আপনার স্থান ভুলে গেছেন। আমাকে জ্ঞান দেওয়ার বেয়াদবি করছেন একবার নয় বার বার। আপনার সো কলড রক্ষিতা আমার মা নয়। এরপর তাকে আমার মা বলার দুঃসাহস দেখালে চরম শাস্তি পাবেন আপনি। এই রাজ্য আমার। আমার মতের ওপর কথা বলার স্পর্ধা কারো নেই। অথচ, আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে সেই নিয়ম বার বার ভঙ্গ করেছেন। আমি কাকে মারব না মারব তার কৈফিয়ত কাওকে দেবো না, কাওকে না। কারো স্পর্ধা থাকলে চেয়ে দেখুক কৈফিয়ত!”

নিকোলাস উপস্থিত সদস্যদের দিকে চ্যালেঞ্জ করে বলল। রিচার্ড ইশারা করতে নতুন এক পিশাচ যুবক দাঁড়িয়ে যায়।

“আমি চাই। ওই হারামজাদির প্রেমে পড়ে আপনি পুরো কমিউনিটির সবাইকে বিপদে ফেলবেন আর আমরা চুপ করে থাকব? এ হবে না। আমরা ওকে শেষ করে ফেলব আজই। শুধু ওর রক্ত খাব না, ওর দেহকেও ছিড়বে ফেলব। যেন মানুষ ওর লাশ দেখার পর আমাদের বিপক্ষে যাওয়ার সাহস আর কোনোদিন না দেখায়। এই পিশাচ রাজা মানুষ হওয়ার ভং ধরেছে। এর গোলামি আর নয় ভাইয়েরা। চলুন আজই এর বিদ্রোহ করি। ওই সিংহাসনের উপযুক্ত ও নয়। আমার সাথে আসুন। এই কাপুরুষ রাজার দাসত্ব আর নয়।”

যুবক তলোয়ার কোষমুক্ত করে। তলোয়ারের সূঁচালো অংশে রসুন ঘষা। ওর কথাতে আরো দুজন নিকোলাসের বিরুদ্ধাচারণ করল। নিকোলাস শ্লেষাত্মক হাসল। তারপর গর্জে উঠল,

“পল!”

দরজার বাইরে থেকে ছুটে এলো পল। হাতে কোল্ট এম ওয়ান নাইন হান্ড্রেড পিস্তল।

“পায়ে গুলি কর এদের।”

আদেশ করতে যে দেরি পলের হাতের পিস্তলের ট্রিগার চাপতে দেরি হয় না। পিস্তলের গুলিগুলো হলি ওয়াটারে ভেজানো৷ পিশাচ তিনজনের পা পুড়ে কালো ধোঁয়া উঠছে। চিৎকার করে হাঁটুর ওপর বসে পড়ল ওরা। নিকোলাস বিদ্রোহী প্রথম যুবকের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর হিংস্র দৃষ্টি যুবককে ভীত করে। রিচার্ডের দিকে ফিরে তাকায় সাহায্যের জন্য। নিকোলাস ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে। রিচার্ড ভয়ে পিছিয়ে যায়। নিকোলাসের ঠোঁটে ফুটে ওঠে বক্রহাসি।

“আমার গোলামি করবি না? সিংহাসনচ্যুত করবি আমাকে তোরা? এত সাহস?”

“প্রভু ক্ষমা করুন।”

অপর দুজন ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল। নিকোলাস গর্জে উঠল,

“গোলামি করবি না? বেশ, মুক্ত করব আজ তোদের এই গোলামি থেকে। যা নরকে।”

হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে প্রথম প্রতিবাদি যুবকের পেছনে এসে দাঁড়ায়। মুহূর্তে ওর ধড় থেকে মাথা আলাদা করে। বাকি দুজনেরও একই অবস্থা। পল এসে ওদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলো।
নিকোলাস সিংহাসনে গিয়ে বসে। বলল,

“আর কে আছে কৈফিয়ত চায়? আর কে আছে আমার গোলামি থেকে মুক্তি চায়? কে আছে বেলাকে মারতে চায়? বেলা আমার শিকার। ওর সাথে আমি কী করব সেটা আমার ব্যাপার। আমার আদেশ অমান্য করে ওর দিকে কেউ হাত বাড়ালে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। কে আছে আমার বিরুদ্ধে যাবে? কে?”

উপস্থিত সকলে মাথা নত করে। এমনকি রিচার্ড আর সোফিয়াও বাধ্য হয়।

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪৫
Writer তানিয়া শেখ

ওই ঘটনার পরদিনই মাদাম আদলৌনা মাতভেই এবং ইসাবেলাকে নিয়ে গ্রাম ছাড়েন। কয়েক ক্রোশ দূরে মাতভেইর এক চাচার বাড়ি। সেখানেই আশ্রয় নেন মাতভেই এবং ইসাবেলাকে নিয়ে। ও বাড়ির কর্তা অর্থাৎ মাতভেইর চাচা বেনাস বেশ ধনীলোক। যুদ্ধের এই কঠিন সময়ে যখন লোকে না খেতে পেরে হাহাকার করছে, তখন বেনাস বড়ো সুচতুরভাবে নিজের বিত্তবৈভব ধরে রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁর তোষামোদি স্বভাব বেশ কাজে দিয়েছে। দেশের বড়ো বড়ো লোকের সাথে তাঁর ওঠা বসা। এ বাড়িতে রোজ আনাগোনা চলে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক কর্মীদের। সেই সব উচ্চপর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের আশীর্বাদেই বেনাসের আর্থিক সম্পদ কমেনি বরং বেড়েছে খানিকটা।

আজ পঁচিশে ডিসেম্বর। ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে এ বাড়িতে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। বেনাসের বাড়িটিকে মহল বললে ভুল হবে না। দ্বিতল এই বিরাট বড়ো বাড়িটিই বেনাসের বিত্তবান হওয়ার পরিচয় বহন করে। জাঁকজমক আলোক বাতিতে সাজানো হয়েছে বাড়িটিকে আজ। হল ঘরের একপাশে বসানো হয়েছে বড়োসড়ো এক ক্রিসমাস ট্রি। রান্নাঘরে চলছে রান্নার ধুম। মাদাম আদলৌনা সকাল থেকে রান্নাঘরে। এ বাড়ির আসার পর নিজ ইচ্ছাতে একদিন রান্নাঘরে রাঁধুনিকে সাহায্য করতে গিয়েছিলেন তিনি। টুকিটাকি কাজ করে ফ্রীতে থাকা খাওয়ার খোঁটা শোনার থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন। এদিকে কম চতুর নন বেনাস। বসিয়ে বসিয়ে কাওকে তিনি খাওয়াবেন না। সেদিন মাদামের হাতের রান্না খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। ঠিক তার পরেরদিন মিথ্যা টাকা চুরির দায়ে বিদায় করেন পুরোনো রাঁধুনিকে। স্ত্রীকে দিয়ে মাদামকে বলে পাঠান, নতুন কোনো রাঁধুনি না পাওয়া অব্দি মাদাম যেন নিজের হেঁশেলের মতো রান্নাঘরের দায়িত্ব নেয়। মাদাম সব বুঝতে পেরেও চুপচাপ মাথা নেড়ে রাজি হলেন। ছেলের জন্য এ বাড়ির আশ্রয় তাঁর দরকার। বেনাস ফ্রীতে বেশিদিন রাখবেন না। কাজ করে যদি এ বাড়িতে বেশিদিন থাকা যায় তাতে ভালোই হয় মাদামের। সপ্তাহন্তে তিনি হয়ে গেলেন এ বাড়ির পার্মানেন্ট রাঁধুনি। এ কাজে ইসাবেলা তাঁকে সাহায্য করে মাঝে মাঝে৷ মাদামের কষ্ট কমাতে দু একটা পদ নিজেই রান্না করে। মাদামের যোগ্য শিষ্য যেন এ ক্ষেত্রে ও। এই রান্না ওকে ভুলিয়ে রাখে ডাইনি বধের সেই দুঃসহ স্মৃতি। ভুলিয়ে থাকে আরো অনেক কিছু, কিন্তু চাইলে কি সব ভোলা সম্ভব? বিভৎস স্মৃতিরা নিরালায় চুপি চুপি এসে হানা দেয়। ইসাবেলার এক একটা রজনী দীর্ঘ হয় চোখের জলে, যন্ত্রণা কাতর হৃদয়কে তিরস্কার করে।

রান্না প্রায় শেষ হতেই ইসাবেলা সেগুলোর ডেকোরেশন শুরু করে। দুজন চাকর ওর ডেকোরেশন করা খাবারভর্তি প্লেটগুলো হলঘরের বড়ো টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখছে। মাদাম লেটুস চিংড়ি দিয়ে কী একটা সালাদ তৈরি করবেন। এত কাজের চাপে লেটুসপাতা কোথায় রেখেছিলেন ভুলে গেলেন। ইসাবেলা এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল।

“ইসাবেল, মিস ভিক্টোরিজা তোমায় ডাকছে।”

রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল তরুণী দাসী জুজানি। ভিক্টোরিজা বেনাসের কনিষ্ঠ কন্যা। ইসাবেলার চেয়ে মাত্র তিন বছরের বড়ো। অত্যন্ত সুন্দরী। বেনাসের মতো ধনীলোকের মেয়ে হয়েও ওর মধ্যে অহংকার নেই। পরিচয়ের প্রথমদিন থেকেই ইসাবেলার সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন কাজে ওর পরামর্শ এবং সাহায্য নেয় ভিক্টোরিজা। ইসাবেলা জুজানির দিকে মুখ তুলে বলল,

“এই তো যাচ্ছি।”

লেটুসপাতা পেয়ে মাদামের হাতে দিয়ে ও জুজানির সাথে চলল দোতলায়। সিঁড়ির কয়েক ধাপ উঠতে জুজানি বলল,

“মিস খুব রেগে আছে।”

“কেন?”

“পিরিয়ড হয়েছে। এমন একটা দিনে ওটার কারণে অনেক কিছু লস যাবে বেচারির।”
জুজানি আস্তে করে বলে এক চোখ টিপে হাসল। মাথা নাড়িয়ে শুকনো হাসল ইসাবেলা।

“তুমি বড্ড ফাজিল অ্যানি।”

“সে আমি মানি। যা হোক, আজ সাবধানে থেকো ইসাবেল।”

“তা কেন?” থেমে গেল ইসাবেলা। জুজানি চাপা গলায় বলল,

“শহরের সুদর্শন যুবকের ভিড় হবে আজ এ বাড়িতে। কে জানে কার চোখে চোখ আঁটকে যায়। আর তারপরে_”

জুজানি বাক্য শেষ করে না। ইসাবেলার দিকে অশালীন চাহনিতে তাকায়। ওর ওই চাহনিতে গা গুলিয়ে আসে ইসাবেলার।

“ছি!”

“ছি? সেক্সকে ছি বললে? মিস শুনলে তোমার আজ গর্দান যাবেই যাবে। সেক্স যে কী জিনিস মিসকে জিজ্ঞেস কোরো। সে_”

ইসাবেলা জুজানির মুখের ওপর হাত চেপে ধরে,
“চুপ করো। আমার পবিত্র কানদুটোকে অপবিত্র না করলে তোমার বুঝি চলছে না, অ্যানি?”

ইসাবেলার নাক কুঁচকানো দেখে মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে ফিক করে হেসে দেয় জুজানি।

“আর কতদিন এভাবে চলবে, হুম? একদিন তো সেক_”

“জুজানি!”

দুহাতে কান বন্ধ করে ইসাবেলা। জুজানি ঠোঁট টিপে হাসি রোধ করে ওর গলা জড়িয়ে ধরে কান থেকে এক হাত সরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। গলা থেকে জুজানির হাত ছাড়িয়ে গটগট করে আগে আগে চললো ইসাবেলা। জুজানি পেছন থেকে ডাকতে ডাকতে এগোয়। ইসাবেলা তাকায়ো না ওর দিকে আর।

রুষ্ট মুখে বসে আছে আয়নার সামনে ভিক্টোরিজা। ওর কাঁধের ওপর অবিন্যস্ত পড়ে আছে সোনালি চুল। মুখে একটার পর একটা কুকিজ পুরছে। ইসাবেলা রুমে ঢুকে ওর এই অবস্থা দেখে অবাক। ভিক্টোরিজাকে ও সর্বদা পরিপাটি হয়ে থাকতে দেখেছে। চালচলনে বেশ স্মার্ট। আজ একেবারে ব্যতিক্রম এক ভিক্টোরিজাকে দেখল।

“এত দেরি হলো কেন আসতে তোমার? আমি তৈরি হব কখন? একটা কাজ যদি তোমাদের দিয়ে হয়। সবগুলো অকর্মা, অপদার্থ।” ভিক্টোরিজার ধমকে মুখ নামিয়ে নিলো ইসাবেলা। এর আগে এমন স্বরে কথা বলেনি ওর সাথে ভিক্টোরিজা। হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনতে পেল। মুখ তুলতে দেখে ভিক্টোরিজা কাঁদছে।

“আর একটু পরে অতিথিরা সব চলে আসবে৷ আমার চুল দেখো, আমার ড্রেস দেখো, আমার মুখটাও দেখো। কী বিশ্রী লাগছে আমায়। নিজের গলায় নিজে ছুরি চালাতে ইচ্ছে করছে এখন।”

ইসাবেলা হাঁপ ছেড়ে আলমিরার দিকে যায়। নতুন এবং সুন্দর লাল রঙা বলগাউনটা বের করল। ওর সাথে ম্যাচিং হিরের কানের দুল, হার আর জুতো বের রাখল বিছানার ওপর। ভিক্টোরিজা রাগ রাগ ধূসর চোখে চেয়ে বলল,

“আমি ঘৃণা করি লাল রং, জাস্ট ঘৃণা করি।”

ইসাবেলা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,

“ওঠো। আর সময় নষ্ট করলে চলবে না।”

“আমি নিচে যাব না।”

“তোমার বাবা কিন্তু রাগ করবেন রিজা।”

“আমি ঘৃণা করি আমার বাবাকে, জাস্ট ঘৃণা করি।”

ভিক্টোরিজার মিশ্র অনুভূতি প্রকাশ করে ড্রেস পরে নিলো। ওকে তৈরি হতে সাহায্য করল ইসাবেলা এবং জুজানি। আয়নায় দাঁড়িয়ে শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

“ওরকম ব্যবহারের জন্য দুঃখিত আমি, ইসাবেল। আমার মনটা আজ ভীষণ খারাপ বুঝলে।”

ইসাবেলা মুচকি হেসে বলল,

“আমি জানি, ইচ্ছে করো ওমনটা করোনি তুমি।”

“তবুও খারাপ লাগছে আমার।”

“ইটস ওকে রিজা। আমি কিছু মনে করিনি।”

“এক শর্তে বিশ্বাস করব যদি আমার সাথে নিচে চলো।”

“না না।”

“প্লিজ, ইসাবেল।”

“রিজা, তোমার বাবা রাগ করবেন।”

“তুমি না গেলে আমিও যাব না।”

ভিক্টোরিজা গোঁ ধরে বসে রইল। অগত্যা রাজি হলো ইসাবেলা। তবে শর্ত দিলো সে একা নয় সাথে জুজানিও যাবে। জুজানি সাথে সাথে না করতে ভিক্টোরিজা ধমক দিলো। ভিক্টোরিজার কথা অমান্য করার সাধ্য জুজানির নেই। ওর চুপসে যাওয়া মুখ দেখে ঠিক একই হাসি হাসল যা খানিক আগে জুজানি হেসেছে।

সন্ধ্যার পরপরই হলঘর লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল। ভিক্টোরিজা এসব পার্টিতে সব সময় মধ্যমণি হয়। আগত যুবক, বৃদ্ধ সকলের নজর ওর দিকে স্থির থাকে। ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কত কী করে ওরা! আজ ভিক্টোরিজা এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ওয়াইনের গ্লাস। এ নিয়ে চার গ্লাস গলাধঃকরণ করেছে। সামনে সুদর্শন যুবকের ভিড় অথচ, ও এত দূরে! এই ক্ষোভে ড্রিংক যেন একটু বেশিই করছে। ইসাবেলা আর জুজানি নিজেদের যথাসাধ্য আড়াল করে ভিক্টোরিজার পাশে দাঁড়ানো। ইসাবেলার এত লোকের ভিড় ভালো লাগছে না। এরচেয়ে মাতভেইর পাশে বসে কবিতা শুনলেও ভালো হতো। মাতভেইর স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে আস্তে আস্তে। ও পুরোপুরি সুস্থ হলেই তাতিয়ানার কথাটা বলবে ইসাবেলা।

“ইসাবেল?” জুজানি ডাকল।

“কী?”

“খিদে পেয়েছে।”

টেবিলের খাবারের দিকে ইশারা করে বলল জুজানি। আগত অতিথিদের থেকে টেবিলের খাবারের প্রতি আগ্রহ ওর বেশি। ইসাবেলা লক্ষ্য করেছে ওদের রান্না খাবার ছাড়াও আরো কিছু খাবার আনা হয়েছে বাইরে থেকে।

“ও মাই গড।”

ভিক্টোরিজার বিস্মিত গলার স্বরে সামনের দিকে তাকাল ইসাবেলা আর জুজানি। তেমন কিছু চোখে পড়ল না। ভিক্টোরিজা এক ঢোকে পুরোটা গ্লাস খালি করে মাথা ঝাঁকায়। নেশা পুরোপুরি চেপে ধরেছে। গ্লাস ইসাবেলার হাতে ধরিয়ে বলল,

“ফাক মাই পিরিয়ড। আই নিড দ্যাট সেক্স সিম্বল।”

ভিক্টোরিজা টলতে টলতে এগিয়ে গেল সামনে। কালো টাক্সিডো পরিহিত যুবকের কাঁধে হাত রাখতে যুবক ঘুরে দাঁড়ায় ভিক্টোরিজার দিকে। যুবকের চেহারা দেখে ইসাবেলার হৃৎস্পন্দনের গতি তীব্র বেগে বেড়ে যায়, মুখ হয় ফ্যাকাশে। গ্লাসে হাতের চাপ দৃঢ় হলো। অস্ফুটে ওর গলা থেকে বেরিয়ে এলো,

“নিকোলাস!”

যুবক যেন শুনল। তখনই তাকাল ওর দিকে। সমস্ত হলঘর সেই মুহূর্তে থমকে গেল। ওদের অপলক দু’জোড়া চোখ স্থির হয়।

“চোখ বন্ধ কর, চোখ বন্ধ কর।”

বিড়বিড় করে নিজেকেই নিজে বলল ইসাবেলা। বড়ো চেষ্টায় চোখের পাতা বন্ধ করে। শ্বাস পড়তে টের পেল এতক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে ছিল। চোখ খুলবে না, খুলবে না করেও চোখের পাতা উঠল। অদূরে ভিড়ের মাঝে দাঁড়ানো নিকোলাসের ঠোঁটে চমৎকার দীর্ঘ হাসি। এ হাসিতে ক্রূরতা নেই, সম্মোহনীও নয়। এ হাসি সাধারণ তবুও কী অসাধারণ!

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪৬
Writer তানিয়া শেখ

লোকাকীর্ণ পুরো হলঘর। মিউজিক বক্সে বাজছে ক্রিসমাস সং। বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজন পুরুষ ও নারী ডাইনিং এ বসে ওয়াইনে চুমুক দিতে দিতে গল্প জুড়েছে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা ছুটছে এদিক ওদিক।আগত যুবকেরা যুবতীদের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যস্ত। কেউ কেউ ইতোমধ্যে পরিচয় পর্ব সেরে হাসি ঠাট্টায় মেতেছে। হাতে হাত ধরে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদেরই অনেকে। নিকোলাসের সাথে মিশে দাঁড়িয়েছে ভিক্টোরিজা। পরিচয়ের পর থেকে ঘনিষ্ঠ হওয়ার আভাস দিয়ে যাচ্ছে নিকোলাসকে৷ অন্য সময় হলে ভিক্টোরিজার এই আভাসকে উপেক্ষা করত না, কিন্তু এখন ওর সকল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু কেবল ইসাবেলা। এত মানুষের ভিড়ে হলঘরের এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ইসাবেলাতের ওপরই দৃষ্টি স্থির। ভিক্টোরিজার সকল কথা অবহেলিত নিকোলাসের কাছে। ও বোধহয় ভালো করে একবার মেয়েটির দিকে ফিরেও দেখেনি। দেখলেও বা কী? প্রেমিকের নজরে প্রেমিকা ছাড়া পৃথিবীর সকল কিছু তুচ্ছ।

“নিকোলাস?”

ভিক্টোরিজার ডাকে ইসাবেলার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিরক্ত হয়ে তাকাল নিচে। নিকোলাসের বুকের পাঁজরের কাছে থুতনি ভর করে ঠোঁট ফুলিয়ে আছে ভিক্টোরিজা। নেশায় ঠিকমতো চোখ মেলে তাকাতে পারছে না।

“যাবে?”

“কোথায়?” ভুরু কুঁচকে বলল নিকোলাস। তারপর আবার তাকায় ইসাবেলার দিকে। ইসাবেলা সেই যে একবার চেয়েছিল, এরপর আর সরাসরি তাকাচ্ছে না। তবে ওর চোরা দৃষ্টি নিকোলাস ঠিক ধরে ফেলেছে কয়েকবার। মনে মনে হেসেছে।

“আমার রুমে।” বলল ভিক্টোরিজা।

“তোমার রুমে? কেন?” ওর এই বোকামো প্রশ্নে ভিক্টোরিজা বার কয়েক দ্রুত চোখের পলক ফেলল। একটি যুবতী কেন একজন যুবককে রুমে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় নিকোলাসের কি জানা নেই? সে কি এতই অনভিজ্ঞ? ভিক্টোরিজা জানে না নিকোলাস অনভিজ্ঞ নয়, একজনেতে আত্মবিস্মৃত। খানিক আশাহত হয় নিকোলাসের প্রশ্নে। একটু সরে দাঁড়িয়ে নিকোলাসের আপাদমস্তক দেখল। নিকোলাস শুধায়,

“কী দেখছ?”

“তোমাকে। তুমি কি বোকা?”

“মানে?”

“আমি বলেছি আমার রুমে চলো। তুমি জবাবে হ্যাঁ বা না বলতে পারতে। যদিও না শব্দটা আমি কখনো শুনিনি৷ অথচ, বললে কী? কেন!”

“ওহ!”

“ওহ?” ভিক্টোরিজার গলায় ক্ষোভ ঝরে। কোনো পুরুষের এমন অবজ্ঞায় অভ্যস্ত নয় ও। আত্মাভিমানে লাগে। নেশার কারণে ঠিকমতো ভাবার অবস্থাতেও নেই। পায়ের আঙুলে ভর করে একহাতে নিকোলাসের গলা জড়িয়ে ধরে, অন্যহাতে নিকোলাসের থুতনি চেপে ধরে বলল,

“তুমি কী আমাকে উপেক্ষা করছ?”

নিকোলাসের ভুরু কুঞ্চণ মিলিয়ে গেল। ভিক্টোরিজার দিকে এতক্ষণে মনোযোগী দৃষ্টি দিলো। ওর ওই সম্মোহনী চোখে মুহূর্তে হারিয়ে গেল ভিক্টোরিজা। ঠোঁটে চুমু দেবে বলে ঝুঁকে আসতে নিকোলাস মুখ সরিয়ে কানের কাছে এনে চাপা গলায় বলল,

“এখানে নয়। চলো তোমার রুমে যাই।”

ভিক্টোরিজা খিলখিল করে হেসে ওর গালে চুমু দিয়ে বলল,

“চলো।”
একহাতে ওর কোমড় জড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ায় নিকোলাস। কাঁধের ওপর দিয়ে ইসাবেলা দিকে ফিরে তাকাল আরেকবার। বিভ্রান্ত মুখে চেয়ে আছে ইসাবেলা। নিকোলাস মুচকি হেসে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল ভিক্টোরিজাকে নিয়ে।

“মিসের হুঁশ জ্ঞান সব গেছে ওই সুদর্শন যুবককে দেখে। রুমে তো গেল, কিন্তু এরপরে কী হবে সেটাই আমি ভাবছি!”

জুজানি কথাটা বলেই হাতের প্লেট থেকে পটেটো পেষ্টির কিছুটা মুখে পুরে নিলো। খাবার সামনে থাকলে আর কিছু খেয়ালে থাকে না ওর। ইসাবেলা কিছু বলল না বলে মুখ তুলল। বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে ইসাবেলাকে। জুজানি বলল,

“কী হয়েছে?”

“অ্যানি, আমি রুমে গেলাম।”

জুজানিকে এবার আর বাধা দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে হলঘরের কোণার সংকীর্ণ রাস্তা ধরে রুমের দিকে গেল৷ এতক্ষণ এই জুজানির কারণে যেতে পারেনি। কিছুতেই যেতে দিচ্ছিল না। নিকোলাসকে এখানে আশা করেনি ও। ওর হাসিতে কিছুক্ষণ যেন ঘোরের মধ্যে পড়েছিল। পরক্ষণেই কী এক কারণে কঠিন হলো মুখ। আতঙ্কিত হয় ভেতরে ভেতরে। ভিক্টোরিজার সাথে নিকোলাসের ওমন ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাতে ঈর্ষা জাগে৷ ওদের দিকে তাকাবে না তাকাবে করেও ব্যর্থ হয়। জুজানিকে কত বলল, চলে যাবে, মেয়েটা ছাড়লই না। ইসাবেলার মনের দুরবস্থা ওই মেয়েটা কী বুঝবে আর? নিকোলাসের দৃষ্টির দাবদাহে ও তো আর পুড়ছে না। এদিকে আরেকটা ভয়ের বীজ মনে দানা বাঁধল। নিকোলাস যখন এসেছে তখন ওর সঙ্গীরাও এখানে আছে। ইসাবেলা হলঘরে নজর বুলিয়েও পেল না তেমন কাওকে। তবুও ভয়টা গেল না। মাতভেইকে বাঁচানোর পণ করেছে। তাছাড়া ওর ওপর যে পিশাচেরা খেপে আছে তা বেশ ভালোভাবেই জানে৷ ইভারলি আর গ্যাব্রিয়েল্লার মৃত্যুর শোধ নিতেও আসতে পারে নিকোলাস। হাজার হোক, সহচরী বলে কথা। এই বাক্য তিক্ত করে তোলে জিহবাকে। নিকোলাসকে ও ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। ইসাবেলাকে পছন্দ করে কিন্তু ভালো তো বাসে না। ইভারলি আর গ্যাব্রিয়েল্লা নিকোলাসের বেশি আপন ছিল। ওদের মৃত্যুর কারণ যে তাঁকে নিশ্চয়ই এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না? এমন হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত হয় ইসাবেলা।

ইসাবেলা, মাতভেই এবং মাদাম একই রুমে থাকেন। একদম শেষ কোণার এই রুমটাতেই থাকতে দিয়েছে বেনাস। পরে আরো দুটো রুম আছে। সেগুলো ভাঁড়ার ঘর। দিন রাতে ওদিকটা অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে।
রুমের দরজাটা ভিজানো ছিল। রুমের এককোনে একটা রেডির তেলের টিমটিমে আলো জ্বলছে। ইসাবেলা ঢুকতেই প্রথমে মাতভেইকে দেখল। হলঘরের গানের আওয়াজ এ ঘরে বেশ পাওয়া যাচ্ছে। তা স্বতেও কী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ও। প্রায় রাতে ওর ঘুম হয় না। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। দুঃস্বপ্ন বড়ো খারাপ ব্যাপার!
ইসাবেলা নিঃশব্দে দরজাটা এঁটে দিলো। সেই থলেটা খুঁজতে লাগল খাটের নিচে। ওর মনে আছে এখানেই রেখেছিল থলেটা। মাদাম ফ্লোরে পাতা বিছানায় শুয়েছিলেন। শব্দ পেয়ে চোখ মেললেন। ইসাবেলাকে খাটের তলায় দেখে প্রশ্ন করলেন,

“কী খুঁজছ?”

“থলেটা।”

মাদামের মুখটা আর্ত হয়ে ওঠে সাথে সাথে। উঠে বসেন তড়াক করে।

“থ-থলে! ওই থলে দিয়ে কী হবে?”

মায়ের গলার স্বরে মাতভেই ঘুমের মধ্যে সামান্য কাঁপল। ঘুম ভাঙেনি বলে স্বস্তি পেলেন মাদাম। একবার ঘুম ভাঙলে মাতভেই সারারাতে আর ঘুমাতে পারে না। মাদাম আদলৌনা ছেলের ঘুমন্ত মুখ দেখে চুপ করে রইলেন। আস্তে আস্তে উঠে ইসাবেলার হাত টেনে রুমের একপাশে এনে বললেন,

“ওই থলে কেন খুঁজছ তুমি?”

ইসাবেলা মাদামের ভীত মুখ দেখে ভাবুক হলো। মা ছেলে ওই ঘটনার পরে একেবারে মুষড়ে পড়েছিল। মাদাম আদলৌনা এখনো একা একা কাঁদেন সেই দুঃসময় স্মরণ করে। আপন গৃহের মায়া, পরগৃহের আশ্রিত জীবন তাঁকে যন্ত্রণা দেয়। ইসাবেলা সেই যন্ত্রণা আর বাড়াতে চাইল না। হাসার চেষ্টা করে বলল,

“এমনিতেই।”

মাদামের ওর কথা বিশ্বাস হলো না।

“সত্যি করে বলো।”

“সত্যি বলছি মাদাম আদলৌনা। আসলে হঠাৎ থলেটার কথা মনে পড়ে গেল। থলেটা কোথায় রেখেছি ভুলে গিয়েছিলাম। বলা তো যায় না কখন কী ঘটে! তাই সাবধানতার জন্য ওটা কাছে কাছে রাখতে চাচ্ছি। দরকারের সময় যেন সহজে পেতে পারি।”

মাদামের দৃষ্টি এবং জবাব এড়িয়ে ও আবার থলেটা খুঁজতে লাগল। থলেটা খাটের তলার বেশ ভেতরের ছিল। শরীরের অর্ধেক ঢুকিয়ে বের করে নিয়ে এলো থলেটা। ইসাবেলার পরনে ছিল ভৃত্যাদের পোশাক। বেনেসের স্ত্রীর আদেশ এটাই পড়তে হবে। ফ্রকের ওপরের সাদা এপ্রোনে খাটের তলায় জমা ময়লা লাগল। মাথা ঢাকার বিশেষ কাপড়টাও খাটের নিচের তক্তার সাথের লোহাতে লেগে ছিঁড়ে যায়। এসবে অবশ্য গুরুত্ব দিলো না ইসাবেলা। মাদাম আদলৌনার প্রশ্নাতীত চাহনি লক্ষ্য করে হাসার চেষ্টা করল। মনের ভয়টাকে মাদামের সামনে প্রকাশ করবে না। বলবে না নিকোলাসের কথা। থলেটা একপাশের চেয়ারের ওপর রাখল।

“এটা এখানে থাক। আমি গিয়ে জুজানিকে দেখে আসি।”

মাদাম পুরোপুরি চিন্তা মুক্ত না হলেও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। বসলেন বিছানয়।

“মাদাম, আপনি শুয়ে পড়ুন। মিসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুমে ফিরব। একটু দেরি হবে।”

মাদাম শুয়ে পড়েন। ইসাবেলা দরজার কাছে গিয়ে থেমে যায়। এপ্রোনের পকেটে হাত দিয়ে রসুন কয়টা দেখে নিলো। গলার রোজারির ক্রুশটা মুষ্টি বদ্ধ করে লম্বা শ্বাস নেয়।

ইসাবেলা ওদের থাকার রুমের দরজায় যতটা সম্ভব রসুন ঘষল। তারপর গেল বাড়ির পেছনের বাগানে। যাওয়ার পূর্বে রান্নাঘর থেকে একটা মোমবাতি আর ছাতা নেয়। হলঘরের বড়ো দেওয়াল ঘড়িতে তখন বাজে রাত আটটা। অতিথিদের অনেকে বিদায় নিয়েছে। বাকিরাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসাবেলা সবার চোখের আড়ালে বাগানে এসে পৌঁছায়। বাগানের একদিকে সুন্দর বসার স্থান করা। বেতের চেয়ার, টেবিল তার ওপরে পাকা ছাউনি ছাতার আকৃতির। এদিকটা দিনের বেলা যতটা না মনোরম, রাতে ততটাই ভুতূরে। নিজেদের জানালার পথে পা বাড়ায় ইসাবেলা। ওদিকটাতে ঝোপঝাড় বেশি। মাঝেমাঝে দাঁড়িয়ে থাকা পীচ বৃক্ষগুলোকে বরফের আস্তরণের কারণে দানবাকৃতি দেখায় এই নিশিতে। ইসাবেলাকে সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে বরফের ওপর। কাঁপছে হাতের মোমটা। জানালার কাছাকাছি আসতে মোমটা নিরাপদ দুরত্বে রাখল। এখানে আলো দেখলে মাদাম টের পেয়ে যেতে পারেন। মৃদু তুষার বৃষ্টি আর হাওয়ার কারণে মোমের ওপর ছাতা রেখেছে। সন্তপর্ণে জানালার একপাশে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ হাঁটার কারণে হাঁপ ধরে গেছে। একটু জিরিয়ে নিলো। খেয়াল হলো এই তুষারপাতে জানালায় বরফের আস্তরণ পড়েছে। তাতে রসুন ঘষা নিতান্তই বোকামির কাজ। হঠাৎ আকাশের মেঘ কেটে যায়। আকাশে রাজত্ব তখন পূর্ণ চাঁদের। মোমের আলোর এখন আর দরকার নেই। তবুও আলোটা নিভালো না। রসুন পকেট থেকে বের করতে গিয়ে হাত ফসকে নিচে পড়ে গেল। সাদা জিনিস সাদা বরফে মিশে গেল যেন। ভালো করে খুঁজতেই পেয়ে গেল। ওই তো খানিক দূরে পড়ে আছে। ওদিকে পা বাড়াতে আচমকা দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে। সাথে তুষার বৃষ্টি। মুহূর্তে সামনেটা ঝাপসা হয়ে যায়। আবহাওয়া এই হঠাৎ পরিবর্তন ভালো লক্ষণ না। তাড়াতাড়ি দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায় ইসাবেলা। বুক দুরুদুরু করছে। ছাতা আর মোমের চিহ্ন পর্যন্ত নেই সেখানে। আগের ইসাবেলা হলে হয়তো ভয়ে জীবন বাঁচাতে দৌড়ে পালাত, কিন্তু এই ইসাবেলা পালায় না। পকেট হাতড়ায়, হতাশ হয়।

“রসুন খুঁজছ?”

প্রকৃতি নিমিষেই শান্ত রূপ নিলো। ইসাবেলা মোটেও চমকায় না কণ্ঠস্বরটি শুনে। বরং কঠিন হয়ে ওঠে মুখ। জ্বলন্ত চোখে চাইল নিকোলাসের দিকে। নিরাপদ দুরত্বে দেওয়ালে একপাশ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস। ঠোঁটের পাশ দিয়ে তখনো ভিক্টোরিজার তাজা রক্তের কিছুটা লেগে আছে। ইসাবেলার ক্রোধিত দৃষ্টি অনুসরণ করে ঠোঁটের কোনাতে আঙুল ঘষে রক্তটা তুলে সেই আঙুল মুখে পুরে নিলো।

“মেরে ফেললেন ওকেও?”

“কেন? কষ্ট পেলে?” ইসাবেলার বড়ো ইচ্ছে করল নিকোলাসের ঠোঁটের পৈশাচিক হাসিটা চিরতরে মুছে ফেলতে।

“পিশাচ আবার মানুষের কষ্ট নিয়ে ভাবতে শুরু করল কবে থেকে!”

নিকোলাসের হাসি ম্লান হয়ে গেল, কিন্তু তা একেবারে হারাল না।

“মানুষের না, তোমার কষ্ট নিয়ে এই পিশাচ আজকাল ভাবে।”

ইসাবেলা ঢোক গিলল। ওর চোখের পলক পড়ল না। নিকোলাসের এই কথার ভাবে কোনো রসিকতার রেশ নেই। দৃষ্টিতে সেই তাপ! ইসাবেলা কিছুক্ষণ যেন খেই হারিয়ে ফেলল। নিকোলাসের খুব ইচ্ছে করল নিকটে গিয়ে ওর মুখটা আঁজলা ভরে তুলে ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের উঞ্চতার আবেশে আবেশিত হতে। এগোতে গিয়ে থেমে যায় ওর গলার রোজারি দেখে। গম্ভীর গলায় আঙুল ইসাবেলার গলার দিকে তুলে বলল,

“ওটা খুলে ফেলো। কথা আছে তোমার সাথে।”

“না, যা বলার ওখানে দাঁড়িয়েই বলুন।”

“না? আমাকে তোমার বিশ্বাস নেই?”

“না।”

নিকোলাসের মুখটা বিমর্ষ হয়ে ওঠে। সেটা আজ আর ঢাকার ছল করে না। দেখুক ইসাবেলা, দেখুক ওর এই ‘না’ কতটা আঘাত করেছে নিকোলাসকে। এই দেখানোকে যদি দুর্বলতা বলে, তাহলে ও দুর্বল। এই মানবীর প্রতি নিকোলাস দুর্বল।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে