#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২৯
Writer তানিয়া শেখ
বনের মধ্যে আঁধার লুটিয়ে পড়ে। অপরাহ্ণের পর থেকে আকাশে বজ্রনির্ঘোষ শোনা যাচ্ছে। বেলা শেষ হওয়ার পূর্বে ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেল আকাশটা। আজ যেন বেশ আগেই সন্ধ্যা নামল। ঘন বনের মধ্যে আঁধারটা আরেকটু যেন গাঢ় মনে হয়। ইহুদি রিফিউজিদের আশ্রমে খাবার নেই। ভুখা পেটে অধীর আগ্রহে বসে আছে সকলে। দৃষ্টি পথের দিকে স্থির। আকাশে কালো মেঘ দেখে ওরা যেন আরো বিচলিত হয়ে পড়ল। এই যৎসামান্য ছাউনি ঘেরা মাথার গোঁজার ঠাঁই প্রবল বৃষ্টির দাপট সইতে কি পারবে? এমনিতে নিত্যদিন জোঁক, মশা মাছি সহ নানান বন্য প্রাণীর উপদ্রবে অতিষ্ঠ জীবন। তার ওপর এই বৃষ্টি আরও একদফা উপদ্রব বৈ আর কী! আশ্রমের সকলের একটাই প্রার্থনা, যিহোভাহ আসন্ন সকল সংকট থেকে তাদের নিরাপদ রাখুক। বৃষ্টি বোধকরি সংকট নয় তাইতো সকল প্রার্থনা উপেক্ষা করে সে পৃথিবীতে নামল। সুচের ন্যায় জমিনের ওপর পড়ল ওর এক একটা ফোঁটা। দেখতে দেখতে বৃষ্টির দাপট আরও বেড়ে গেল। কাঠের আগুন ছিল এদের রাতের আঁধার দূরীকরণের একমাত্র সম্বল। আজ সেটাও বার বার বৃষ্টির সাথে বয়ে আসা বাতাসে নিভে যাচ্ছে। একটা ছাউনির নিচে কয়েকজনের সাথে বসে আছে ইসাবেলা। ওর সাথের সকলে হা হুতাশ করছে এই অনিরাপদ জীবন নিয়ে। এতবড়ো পৃথিবী অথচ তাদের ঠাঁই হলো কেবল এই জঙ্গলে! খাবার নেই, পানি নেই। কী জীবন! তবুও এই জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। বাঁচার সাধ বুঝি এমনই!
“তুমি ঠিক আছো?”
ইশারায় জানতে চাইল ইসাবেলার পাশে বসা মেয়েটি। ওর বয়সও ইসাবেলার মতো। সতেরো কী আঠারো হবে। ওর নাম তালিয়া। ভাষা কখনও বন্ধুত্বের মাঝে দেয়াল হয় না। বন্ধুত্বের নিজস্ব এক ভাষা থাকে। চোখের ভাষা, মনের ভাষা। ইসাবেলা ম্লান হেসে মাথা নাড়ায়। তালিয়া ওর কম্পিত বাহুতে হাত রেখে বলল,
“না, তুমি ঠিক নেই। রীতিমতো কাঁপছ ঠকঠক করে। কোর্ট টা পরে নিচ্ছো না কেন বলোতো?”
কোলে রাখা নিকোলাসের কোর্টটার দিকে তাকাল। ধরে রাখা মুঠিটা শক্ত হয়। তালিয়া ওকে নতুন কাপড় দিয়েছে পরতে। সেই থেকে নিকোলাসের কোর্টটা ও এমনই করে কোলে রেখেছে। তালিয়ার কথাতে কোর্টটা পরে নিলো। কোর্টে এখনও নিকোলাসের গায়ের সেই সোঁদা মাটির গন্ধ রয়ে গেছে। হাতাটা মুখের কাছে এনে ও খুব করে শ্বাস টানল। মাটির গন্ধ এত চমৎকার হয়! তালিয়া হাসছে ওর দিকে চেয়ে। ইসাবেলা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। চট করে মুখের সামনে থেকে হাতটা সরিয়ে কোলের ওপর রাখে। তালিয়া এবার সামান্য শব্দ করে হাসে। ভারি রাগ হলো ইসাবেলার। এত হাসার কী আছে?
“তুমি খুব ভালোবাসো তাকে তাই না?” কোর্টটা আলতো ছুঁয়ে ইশারায় জানতে চাইল তালিয়া। ইসাবেলা সজোরে মাথা ঝাঁকাল। তালিয়া ফের হাসে।
“বলতে চাইছ স্বামীকে তুমি ভালোবাসো না?”
ইসাবেলার মনে পড়ল নিকোলাস এদের বলেছে ওরা স্বামী স্ত্রী। গাল ফুলিয়ে এমন একটা ভাব করল যে তালিয়া বুঝল পূর্বের কথাটা নিছক অভিমান ছিল। রাত যত বাড়ছে বৃষ্টিও বাড়ছে। ইসাবেলার দৃষ্টি বার বার যায় ওই পথে যে পথে নিকোলাস সহ বাকিরা খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছে। ওই মিশমিশে কালো আঁধারেও ওর দুইজোড়া চোখ কাওকে অস্থিরভাবে খুঁজে যায়। ভ্রমের ঘোরে আঁধারের ক্যানভাসে একটা মুখ ও বার বার দেখে। মনটা কেমন যেন করে। তখন বলেছিল নিকোলাসকে ও বিশ্বাস করে। এখন কথাটা ওকে বেশ ভাবাচ্ছে। এমনটা কেন বলেছিল? পরিস্থিতি মানুষকে ওই উপলব্ধি করিয়ে দেয় যা সে বার বার অবহেলা করে এড়িয়ে যেত। মন গহিনের সুপ্ত চেতনা তখন হঠাৎই জাগ্রত হয়। নির্ভয়ে প্রকাশিত হয় দিনের আলোর ন্যায়। সেই প্রকাশিত আলো নিয়ে ওর মনের মধ্যে একচোট দোনোমোনো চলে। দিনান্তে এসে বুঝিয়ে দেয় ঘৃণিত ব্যক্তিকে মানুষ বিশ্বাস করে না। হয় ওর বিশ্বাস মিথ্যা নয়তো ওর ঘৃণা। ঘৃণায় যদি করবে তবে এভাবে পথে চেয়ে থাকা কেন? বিদায়কালে নিকোলাস ওর কপালে চুমো খেয়েছিল। নিকোলাস রক্তচোষা পিশাচ। সে রক্তখাবে, চুমু কেন খেল? মাথাটা বড্ড ধরল এবার ওর। একে না খাওয়া তার ওপর এই ভাবনা বেশ নাজেহাল করছে। গা থেকে কোর্টটা খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে হিম বাতাস ধা করে এসে লাগল গায়ে। কাঁপুনি দিয়ে ওঠে শরীর।
“ও কী! কোর্ট খুললে কেন?”
তালিয়ার প্রশ্নে ইসাবেলা প্রত্যুত্তর করল না। দৃষ্টি সামনে স্থির। সে তাকাবে না ও পথপানে। যখন আসার আসবে নিকোলাস। এত কেন ভাববে ওকে নিয়ে? তালিয়া ওর পরিবর্তন লক্ষ্য করল। কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসল ও। ইসাবেলা খেয়াল করতে হাসিটা নিভে যায়। মুখখানা কেমন গম্ভীর হয়ে আছে ইসাবেলার। ওর এই গম্ভীরতার জন্য দায়ী মনের এই গোলযোগ। সারারাত এভাবেই বসে রইল। ভোরের দিকে বৃষ্টিটা কমল খানিকটা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে এই মুহূর্তে। চোখটা লেগে এসেছিল। শোরগোল শুনে চমকে উঠে বসল।
“স্যামুয়েলরা এসে গেছে।”
তালিয়া বলল। স্যামুয়েল লিডারের ভাই। তালিয়ার সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক। কথাটা আশ্রমের সকলে কমবেশি জানে। স্যামুয়েল ভেজা শরীরে ঘোড়া থেকে নামতে ছুটে গিয়ে ওকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল তালিয়া। ঠোঁট বাড়িয়ে চুমু খেল। আগামি কয়েকদিনের জন্য যথেষ্ট খাবার আনা হয়েছে। সকলে পেট ভরে আহার করছে। এই পর্যাপ্ত খাদ্য সংগ্রহে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রেখেছে নিকোলাস। লিডার সেটাই সকলকে বলছে। খেতে খেতে সকলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল নিকোলাসের প্রতি। ইসাবেলার জন্য খাবার নিয়ে এলো তালিয়া। সবটা সে ইশারায় বলল ওকে।ইসাবেলা হাসিমুখে খাবার গ্রহণ করলেও খায় না। এদের সাথে নিকোলাস নেই। তালিয়াকে ও বলে স্যামুয়েলকে প্রশ্ন করতে। একটু পর সেখানে স্যামুয়েল নিজেই চলে এলো। সে বলে, বৃষ্টির জন্য ওদের ফিরতে বিলম্ব হয়েছে। ভোরের কিছু আগ দিয়ে বৃষ্টি কমলে রওনা হয়, কিন্তু নিকোলাস সাথে ছিল না। কোথায় গেছে দলের কারো জানা নেই। ইসাবেলার তখন খেয়াল হলো ভোরের আগে নিকোলাস অন্ধকারে আশ্রয় নেয়। তখন সে কেবল মৃত। স্যামুয়েল ওকে আশ্বস্ত করে নিকোলাস ফিরে আসবে। ইসাবেলার মন যেন কী এক চিন্তায় ছটফট করতে লাগল। তালিয়া ওকে অনেকবার বুঝিয়ে সামান্য কিছু খাওয়াতে সক্ষম হয়। তারপর স্যামুয়েলকে সাথে করে চলে গেল ও। বেলা বাড়তে সূর্য উঁকি দেয় মেঘের ফাঁকে ফাঁকে। নিকোলাস এখন ফিরবে না জেনেও ইসাবেলা পথ চেয়ে বসে আছে। স্যামুয়েল দূর থেকে ওকেই দেখছিল। ওদের দৃষ্টি এক হতেই একটুখানি ম্লান হাসল স্যামুয়েল। জোরপূর্বক হাসে ইসাবেলা। স্যামুয়েলের দৃষ্টি ওকে অস্বস্তি দেয়। উঠে দাঁড়ালো ও। হাঁটতে হাঁটতে আশ্রম থেকে একটু দূরের একটা গাছের নিচে বসল। জায়গাটা গতরাতের বৃষ্টিতে ভেজা, কর্দমাক্ত। নিকোলাসের কোর্টটা খুব সাবধানে যত্ন করে কোলের মধ্যে রেখেছে।
“এখানে একা কী করছ?”
চকিতে ঘুরে তাকাল ইসাবেলা। স্যামুয়েল গাছের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো। জবাব না পেয়ে এগিয়ে এসে পাশে বসল। গায়ে গা লাগতে পারত কিন্তু ইসাবেলা সরে বসেছে। স্যামুয়েল এমন ভাব করল যেন খেয়ালই করেনি।
“বললে না কী করছ একা? ”
“কিছু না।” মাথা নাড়িয়ে বুঝাল ও। স্যামুয়েল ওকে দেখছে। ইসাবেলার খুব অস্বস্তি হচ্ছে এবার। উঠে দাঁড়াবে ভাবতে স্যামুয়েল ওর কোলের কোর্টটা ছুঁয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“স্বামীকে খুব ভালোবাসো দেখছি।”
ইসাবেলা বুঝল না ওর কথা। কপাল কুঁচকে গেল স্যামুয়েলের ম্লান হাসি দেখে। ইসাবেলার চোখে চোখ রেখে বলল,
“চলো উঠি। এই স্থান নিরাপদ নয়।”
ইসাবেলা ওর কথাতে উঠে দাঁড়ায়। ওরা আশ্রমের কাছাকাছি যেতে একটা হট্টগোল শোনা গেল। তালিয়া চিৎকার করে স্যামুয়েলকে ডাকতে ডাকতে এদিকেই এলো।
“সৈন্যরা এদিকে আসছে। আমাদের পালাতে হবে স্যামুয়েল।”
অশ্বরব আর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া যুদ্ধ বিমান দেখে স্যামুয়েল আতঙ্কিত হলো। ইসাবেলার হাতটা ও শক্ত করে ধরেছে।
“এসো।”
“কোথায়?”
“এখান থেকে পালাতে হবে আমাদের। খুব তাড়াতাড়ি।”
ইসাবেলা হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নেয়। স্যামুয়েল ওর দিকে অসন্তোষে তাকাল। ইসাবেলার প্রতি ও আকর্ষণ অনুভব করে। বিবাহিতা জেনেও তা কিছুমাত্র কমে না। এমন নয় যে তালিয়াকে ও ভালোবাসে না। ভালোবাসা আর আকর্ষণে প্রভেদ তো আছে। অদূরে নাৎসি সৈন্যদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছে ওরা। তালিয়া স্যামুয়েলের হাত ধরে টানল,
“চলো স্যামুয়েল।”
স্যামুয়েল অন্যহাতে আবার ইসাবেলার হাত ধরতে যায়। তালিয়া সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল সেদিকে। স্যামুয়েলের কাছ থেকে সরে দাঁড়ায় ইসাবেলা।
“তোমরা যাও। আমি নিকোলাসের জন্য অপেক্ষা করব। ওকে দেওয়া ওয়াদা ভাঙতে পারব না আমি।”
“পাগলামি করো না। নাৎসিদের হাতে পড়লে ওয়াদাও ভাঙবে সাথে তুমিও মরবে।”
তালিয়া এবার টেনে নিয়ে চলো ওকে। একপলক স্যামুয়েলের দিকে তাকাল সে। এখনও ইসাবেলার দিকেই তাকিয়ে আছে। ঈর্ষার কাঁটা খুব করে বিঁধল বুকে। চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আশ্রমে সকলে বনের দক্ষিণ দিকে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। তালিয়া ইসাবেলাকে টানতে টানতে সেদিকে ছোটে। স্যামুয়েল ওদের পেছনে।
“ওই যে পালাচ্ছে ওরা। ধরো ওদের।”
পেছনে নাৎসি সৈন্যদের চিৎকার। একটু পর গুলির শব্দ কানে এলো। চোখের সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল কয়েকজনের দেহ। কিছুক্ষণ মৃত্যুযন্ত্রনা সয়ে নিভে গেল ওদের প্রাণ প্রদীপ। আতঙ্কে এলোমেলো ছুটছে সবাই। তালিয়া ছুটতে ছুটতে তাকাল ইসাবেলার আতঙ্কিত মুখের দিকে। স্যামুয়েল সামনে লিডারদের সাথে। একটু পর পর সে ওদের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত হচ্ছে। তালিয়া হঠাৎ ইসাবেলার হাত ছেড়ে দিলো। সরে গেল ওর কাছ থেকে। একা দিশাহীন এদিক ওদিক ছুটতে লাগল ইসাবেলা। গুলির শব্দ ওকে ভীতসন্ত্রস্ত করে। কোনদিকে যাবে ঠিক করতে পারে না। ওর সামনের দুজন ইহুদি মহিলা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ঠিক তার পরেই একটা গুলি এসে লাগে ওর ডান পায়ে। আর্তনাদ করে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে ও। স্যামুয়েল ওর নাম ধরে চিৎকার করে ওঠে। ও এদিকেই আসছিল কিন্তু হঠাৎ থেমে গেল ওর পা। লিডার এবং কয়েকজন ওকে টেনে নিয়ে চলে গেল দৃষ্টি সীমার বাইরে। তালিয়াকে দেখল শেষবার। কাঁদছিল সে। ইসাবেলা রক্তাক্ত পা টেনে টেনে এগোতে লাগল সামনে। ঘোড়ার খুরের শব্দ ধীরে ধীরে ওর নিকটে আসছে। সাথে নাৎসি সৈন্যদের পৈশাচিক উল্লাস। আহত ইসাবেলাকে ওরা ঘিরে ধরে। এক একজনের চোখে পৈশাচিকতা। যেন নরক থেকে এইমাত্র পৃথিবীতে নেমে এসেছে। ওদের মধ্যে থেকে একজন হেঁটে এলো ইসাবেলার দিকে। ঠোঁটের হাসি জানান দেয় ওর কুপ্রবৃত্তি মনোভাবের। লোকটা ইসাবেলার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল। চোয়াল চেপে ধরে লোলুপ চোখে চেয়ে বলল,
“বেশ খাসা মাল জুটেছে আজ।”
জিহ্বা দিয়ে ইসাবেলার গালটা চেটে পৈশাচিক হাসি হাসল মধ্যবয়সী সৈন্যটা। বাকিও মেতে উঠল অট্টহাসিতে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে ইসাবেলা। অস্পষ্ট হয়ে এলো চোখের সামনেটা। লোকটা ওর বুকের এক স্তন খুব জোরে চেপে ধরেছে। চেয়েও তার হাতটা সরাতে পারছে না ইসাবেলা। চোখ দুটো ভিজে আরো ঝাপসা লাগছে দৃষ্টি। লোকটার মুখ ঝুঁকে এলো ওর ঠোঁটের দিকে। চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে মাথাটা এগিয়ে আনল। ইসাবেলা শক্তি সঞ্চয় করে মুখটা ঘুরিয়ে নেয়।
“সুন্দরী দেখি চুমু খাবে না।”
হাসতে হাসতে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো ইসাবেলাকে। ব্যথায় ককিয়ে উঠল ও। কিছু বুঝার আগেই শয়তানটা ঝাপিয়ে পড়ল ওর দুর্বল দেহের ওপর। সম্ভ্রম বাঁচাতে চিৎকার করে সাহায্য চায়। কিন্তু কেউ আসে না। লোকটার অপবিত্র স্পর্শ ওর পবিত্র শরীরে বিচরণ করে। সেটা সরিয়ে দিতে গিয়েও পারে না। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে ধীরে ধীরে। এই দুঃসময়ে একটা নামই মনে এলো। ডাকল,
“নিকোলাস।”
এবং তখনই পরিচিত সেই সুবাস পেল। সেই সোঁদা মাটির গন্ধ। বিশ্রী অপবিত্র স্পর্শটা থেমে গেল। বিকট একটা গর্জন শুনতে পায়। আর অনেক মানুষের আর্তনাদ। মানুষ! না, ওরা মানুষ নয়। ওর ওপর থেকে অসহ্য ভারটা সরে যায়। বড্ড হালকা লাগে। আহত তনুমন কাতর হয়ে অপেক্ষা করে একটা উষ্ণ স্পর্শের। নিরাপদ একজোড়া বাহুবন্ধনের। অপেক্ষার অবসান হয়। নিরাপদ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয় ও। দুর্বল হাতে নিকোলাসের গলা জড়িয়ে ধরে মুখ লুকায় ওর ঘাড়ে। ফুঁপিয়ে কাঁদে।
“নিকোলাস, নিকোলাস।”
“এই তো আমি এসেছি বেলা। আর কেউ ছোঁবে না তোমায়। আর কোনো ভয় নেই তোমার।”
স্বস্তিতে চোখ বন্ধ করল ইসাবেলা।
চলবে,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩০
Writer তানিয়া শেখ
পোল্যান্ড এবং লিথুনিয়া সীমান্তের কাছাকাছি একটি ছোট্ট গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে নিকোলাস। ইসাবেলার পা থেকে গুলি বের করা হলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ওর শরীর একেবারে দুর্বল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই ভীতিকর পরিবেশে ডাক্তার জোগাড় করা সহজ ব্যাপার ছিল না মোটেও। কিন্তু যখন প্রসঙ্গ আসে ইসাবেলার, তখন নিকোলাসের কাছে কিছুই কঠিন নয়। ওরা এখন আছে ডাক্তারের পরিচিত এক আত্মীয় বাড়িতে। দ্বিতল কাঠের বাড়িটির ওপরের তলার ছোট্ট একটি ঘরে ওদের আশ্রয় হয়েছে। এ ঘরে একটিমাত্র বিছানা। ইসাবেলার পায়ে মোটা ব্যান্ডেজ। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় ওকে। নিকোলাসের হয়েছে ঝামেলা তাতে। এই ঘরের মেঝেতেও তেমন জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে বিছানার এককোণে শুতে হয় ওকে। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ইসাবেলার পাশে শুয়ে থাকা সত্যি কষ্টসাধ্য ওর জন্য। ও কেবল দিন গুনছে। রিগা পৌঁছানো মাত্র হাঁপ ছাড়বে। ইসাবেলার পায়ে গুলি না লাগলে কবেই রিগা পৌঁছে যেত। লিথুনিয়া থেকে রিগা খুব বেশি দূরে নয়। মাত্র কয়েক ঘন্টার পথ। এই কয়েক ঘন্টা এখন কয়েকদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের মনকে সে পর্যন্ত বশ মানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু একটা ভয় ওর সেই চেষ্টাকে বার বার শেষ করে দিচ্ছে। ইসাবেলা আজকাল আর ঘৃণার চোখে তাকায় না। কয়েকবার আড়চোখে তাকাতে ধরে ফেলাতে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ওঠে ইসাবেলা। এই দৃষ্টি আর ওর পূর্বের দৃষ্টি এক নয়। ভয়টা এখানেই নিকোলাসের। ইসাবেলা ওর প্রতি ভালো লাগা দেখালেই মন বশ করার আপ্রাণ চেষ্টা বৃথা যাবে। বদলে যাবে ও। দুর্বল হবে। দুর্বল হতে চায় না ও। এই বিশ্ব শাসন করতে চায়। শাসকের দুর্বল হলে চলবে না, দুর্বলতা থাকলে চলবে না। তাছাড়া ও আর ইসাবেলা তেল আর জলের মতো। ওকে নিয়ে কিছু ভাবা বোকামি। মানুষের সাথে পিশাচদের সম্পর্ক খাদ্য আর খাদকের, শিকার আর শিকারির। এর বাইরে কোনো সম্পর্ক হয় না।
“তবে এত মায়া, চিন্তা কীসের জন্য? কেন ওই সৈন্যদের ওমন করে মেরেছ তুমি? কেন আর সবার মতো ওকে শেষ করে ফেলোনি। কেন ওকে বাঁচাচ্ছ বার বার?”
“সেই প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নই আমি।”
ভেতরের শয়তানটা হাসে। বলে,
“নিজের সাথে ছলনা করছ? তা বেশ, করো যত ইচ্ছে ছলনা নিজের সাথে। পস্তাবে শেষে তুমিই। খুব ভুগবে এই বলে দিলাম।”
নিকোলাস চুপ রইল। অদূরে মোরগ ডেকে উঠতে হেঁটে এলো বিছানার দিকে। গভীর নিদ্রায়মাণ ইসাবেলা। ঘুমালে ওকে নিষ্পাপ ফুলের ন্যায় লাগে। ফুল দেখলে যেমনই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়, নিকোলাসেরও তেমন সাধ জাগে ওকে ছুঁয়ে দেখার। সজোরে মাথা ঝাকায়। সে ছোঁবে না ওকে। চুপচাপ গিয়ে সটান হয়ে বিছানার এককোণে শুয়ে পড়ল। প্রভাত গড়িয়ে সকালের সূর্য ওঠে। ইসাবেলা চোখ মেলে তাকায়। অসতর্কে ডান পা নড়তে ব্যথায় ককিয়ে উঠল। নিকোলাস শুনতে পায়। ও জীবন্মৃত। মৃতের ন্যায় নিথর শুয়ে থাকলেও সব শুনতে পায়, বুঝতে পারে। কেবল নড়েচড়ে উঠতে পারে না দুপুরের আগ পর্যন্ত। ইসাবেলা কাতরাতে কাতরাতে উঠে বসল বিছানার ওপর। গা ঘেমে একাকার। আজকাল বেজায় দুঃস্বপ্ন দেখছে ও। পুরো জীবনটাই যেন এখন ওর কাছে দুঃস্বপ্ন। হঠাৎ পাশে শায়িত নিকোলাসের দিকে চোখ পড়তে দৃষ্টি স্থির হলো। দুঃস্বপ্নের মাঝেও খানিক সুখের স্বপ্ন থাকে। যে স্বপ্ন মনকে একটা অন্যরকম অনুভূতি দেয়। সেটা অবশ্য ঘৃণা টিনা নয়। তবে কী? হয়তো বন্ধুত্বের মতো বিশেষ কিছু। এই যে নিকোলাস ওর এত সেবা শুশ্রূষা করছে, বার বার বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে এর জন্য বন্ধু ভাবা তো দোষের কিছু নয়।
“হুম, এই পিশাচই কিন্তু তোমার আজকের এই দশার জন্য দায়ী।”
ইসাবেলা মাথা নাড়ায়,
“না, আজ আমি যেখানে আছি আমার নিজের কারণে আছি। ওর কোনো দোষ নেই। তবে হ্যাঁ, ও যে পিশাচ তা আমি এখনও মানি। কিন্তু ভেবে দ্যাখো একবার, একটা পিশাচ হয়েও আমাকে ও মারেনি বরং সাহায্য করছে। আমাকে খুব অবাক করে এই ব্যাপারটা।”
ইসাবেলার দ্বিতীয় সত্তা ভেবে জবাব দেয়,
“আমার কী মনে হয় জানো? ও তোমাকে পছন্দ করে।”
“যা! কী ভুলভাল বকছ?” সলজ্জে হাসে ও। তারপর আবার নিকোলাসের মুখের দিকে তাকায়। ও মিথ্যা বলবে না আজ। নিকোলাস ওকে আকৃষ্ট করে। এমন সুদর্শন যুবক কাকেই বা না আকর্ষণ করবে। আর ও! ইসাবেলা হাসে। ওকে তো পিটারই ছেড়ে গেছে। আকর্ষণীয় হলে নিশ্চয়ই ছেড়ে যেত না। নিকোলাসের কাছে ও কেবল নির্বোধ। তাছাড়া কর্নেলার পতিতালয়ে একবার বলেছিল তো, ইসাবেলাকে সে পছন্দ করে না। তাহলে কেন এত কেয়ারিং। এখনও মনে পড়ে জ্ঞান ফেরার পর কতটা চিন্তিত দেখাচ্ছিল ওকে। এরপর প্রতিটি দিন ইসাবেলার সেবা শুশ্রূষা করেছে ঠিক আপনজনের মতো। রোজ নিয়ম করে খাওয়ানো, স্নান করতে সাহায্য, ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দেওয়া ইত্যাদি ইসাবেলার সব কাজই ও করেছে। এমনটা ও আশা করেনি। অন্তত নিকোলাসের কাছে তো নয়ই। ওর প্রতি নিকোলাসের এই করুণা বুঝে ওঠে না। হ্যাঁ, এ করুণা ছাড়া আর কী? কিন্তু একজন পিশাচ তো করুণা করে না। এই কয়েক মাসে নিকোলাসের নিষ্ঠুর, নির্মম রূপ দেখেছে। ও ধ্বংসের নামান্তর। কেবল ধ্বংস করতেই দেখেছে ওকে ইসাবেলা। মানুষকে ও করুণা করে না। ইসাবেলাও তো মানুষ তবে ওর বেলায় নিকোলাসের এই পরিবর্তন কেন? দরজায় নক পড়তে সচকিত হয়। নিকোলাসের গায়ে চাদর টানা নেই। পায়ের কাছ থেকে ওটা এনে ওর গলা অব্দি জড়িয়ে দিতে বেশ বেগ পেতে হলো। ব্যথা হচ্ছে পায়ে। কোনোমতে আগের স্থানে বসে বলল,
“আসুন।”
গৃহকর্ত্রী ট্রে হাতে ভেতরে ঢুকলেন। মধ্যবয়সী মমতাময়ী এক নারী লিভিয়া। কী এক কারণে তার মুখটা সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। দু একবার জিজ্ঞেস করেও জবাব পায়নি। নিকোলাস এবং ওর এ নিয়ে সন্দেহ হয়েছে। ডাক্তারকে প্রশ্ন করেছিল নিকোলাস। তিনি বলেন, যুদ্ধের কারণে এমন ভীত থাকে সর্বদা। মৃত্যু ভয়ে বুকের কাছে ক্রুশ ধরে দিনরাত বাইবেলের অংশ জপতে থাকে। জবাবে সন্তুষ্ট না হলেও চুপ করে যায় নিকোলাস। অন্যদিনের মতো আজও লিভিয়া বিড়বিড় করতে করতে ট্রেটা পাশে রাখল। তারপর নিকোলাসের দিকে তাকাল একবার। ইসাবেলা ভেবেছিল অন্যদিকে মতো পায়ের অবস্থা জানতে চাইবে। জবাব পাওয়া মাত্র আবার বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম হলো। লিভিয়া ওর পায়ের কাছে বসে প্রশ্ন করল,
“ও কি রোজ এমনই করে দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়?”
“না, আসলে রাতে আমাকে কয়েকবার ওয়াশরুমে যেতে হয় তো। তাছাড়া ওই ঘটনার পর আজকাল খুব দুঃস্বপ্ন দেখছি। রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয়। ও রাতভর জাগে আমাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে। এতেই ধকল পড়ে যায় বেশি। একটু বেলা পর্যন্ত তাই ঘুমায়।” মিথ্যা বলল ইসাবেলা।
“ওহ!”
আর কিছু বলল না। ইসাবেলা প্রথম যখন লিভিয়ার মুখে রাশান ভাষা শুনেছিল বেশ উৎফুল্ল ছিল। মাতৃ ভাষায় কথা বলার মতো শান্তি দুটো নেই। দেশ থেকে আলাদা হয়ে ও যেন খুব উপলব্ধি করেছে এই কথাটা। কিন্তু লিভিয়ার সাথে কথা বলে মজা পায় না। এমন ভীতসন্ত্রস্ত অস্বাভাবিক আচরণ করা মানুষের সাথে কথা বলে কেই বা মজা পাবে? লিভিয়া উঠে দাঁড়ায়। তারপর আবার বসে। ঝুঁকে এসে বলে,
“তোমাকে একটা কথা বলব ইসাবেলা? ভয় পাবে না তো?”
লিভিয়ার ওমন বিস্ফোরিত লাল চোখ, ভীত গলার স্বর আর হঠাৎ ঝুঁকে আসাতে ও একটু ঘাবড়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“না, বলুন।”
“ওরা আজ আসবে। কদিন ধরে বাড়ির চারপাশে ঘুরছে বুঝলে? কিছু একটার গন্ধ পেয়ে গেছে ওরা। গতরাতেও লনে একজনকে দেখেছি নিচ থেকে তোমাদের জানালার সোজা তাকিয়ে থাকতে। আমার ভীষণ ভয় করছে জানো তো?”
শক্ত করে ক্রুশটা ধরে বিড়বিড় করতে লাগলেন। তার চোখে এবার স্পষ্ট আতঙ্ক। ইসাবেলা ভাবল সোভিয়েত সৈন্যদের ভয়ে বুঝি এমন করছে সে। আবার ভাবে, সৈন্যরা রাতের আঁধারে এসে ঘুরে যাবে কেন? ওরা যে কতটা নির্মম আর নিষ্ঠুর সেদিন জঙ্গলে দেখেছিল ও। লিভিয়া আবার বললেন,
“তোমার স্বামীকে আমার ভালো লাগে না ইসাবেলা। কেমন যেন ওদের মতো গন্ধ ওর গায়ে।”
“কাদের মতো?” প্রশ্নটা করেই বসল ও। লিভিয়া বলল,
“রক্তচোষাদের মতো।”
ইসাবেলা আঁতকে ওঠে। রক্তচোষা! পৃথিবীতে কি আরও রক্তচোষা আছে? ও জানত নিকোলাস এবং ওর পরিবারই বুঝি এমন। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“ওরা এই গায়ে থাকে?”
“হ্যাঁ।”
“এই গাঁয়ের সকলে জানে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু সকলে এমন ভাব করে যেন কিছুই জানে না। লুকিয়ে অনেকে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আমরাও পালাব আজ।”
“আপনারা পালাবেন আজ?”
“হ্যাঁ, তোমরা চাইলে সাথে যেতে পারো। যাবে?”
“কখন যাবেন?”
“এই ঘণ্টাখানেক পরে।”
ইসাবেলা ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘন্টা খানেক মানে তখন দশটা বাজবে। নিকোলাস জাগবে না। এদের বলতেও পারবে না নিকোলাস সম্পর্কে।
“না, থাক।”
“সব জেনেও যেতে চাইছ না?”
“আমার পায়ের অবস্থা তো দেখছেন। এই অবস্থায় কী করে যাই বলুন?”
“তোমার স্বামীকে জাগিয়ে তোলো। সে কোলে করে নিয়ে যাবে, যেভাবে এখানে নিয়ে এসেছিল। তাছাড়া খুব বেশি কষ্ট তো হবে না। বাড়ির বাইরে গাড়ি দাঁড়ানো থাকবে। তোমাকে কেবল কোলে করে নিচ পর্যন্ত নামাবে ও। এক কাজ করো, এখনই জাগিয়ে তোলো ওকে।”
লিভিয়া নিকোলাসের দিকে ফিরে তাকাল। ইসাবেলা স্পষ্ট দেখতে পেল নিকোলাসের গলার অ্যাডাম অ্যাপেল ওপর নিচে হতে। লিভিয়া ওর দিকে সরে বসে বলল,
“এক কাজ করি, আমিই বরং ডেকে সবটা বলি ওকে। তোমাদের নতুন বিয়ে তো। তুমি হয়তো লজ্জা পাচ্ছো বলতে।”
লিভিয়া হাত বাড়াল নিকোলাসের দিকে। লিভিয়ার অন্য হাতে শক্ত করে ধরা ক্রুশ। ইসাবেলার হঠাৎ স্মরণ হলো ভ্যালেরিয়ার মৃত্যুর দিনের স্মৃতি। ক্রুশের কারণে নিকোলাস আর আন্দ্রেই কষ্ট পেয়েছিল। সঠিক নিয়ম জানলে সেদিন হয়তো ওরা দুজনই শেষ হতো এই ক্রুশের আঘাতে। এদিকে ক্রমশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে নিকোলাসের মুখ। শ্বদন্ত চিকচিক করছে ঠোঁটের আড়ালে। যে কোনো সময় বেরিয়ে আসতে পারে। লিভিয়া ছুঁতে যাবে ওমনি ওর হাতটা ধরে ফেলল ইসাবেলা।
“আমি পরে ডেকে সব বলব ওকে। রাতভর ঘুমায়নি বেচারা। প্লিজ কাঁচা ঘুম থেকে তুলবেন না। ওর মাথা যন্ত্রণা করবে।”
লিভিয়া রুষ্ট মুখে বলল,
“তুমি বিশ্বাস করোনি আমার কথা, না? ওরা যে আসবে বিশ্বাস করছ না। বেশ, থাকো আরামের ঘুম নিয়ে। আমার কী? সাবধান করার করে দিয়েছি আমি। এবার যা ইচ্ছে হয় করো।”
লিভিয়া অপ্রসন্ন মুখে উঠে দাঁড়ায়। শেষবার নিকোলাস আর ওর দিকে চেয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
চলবে,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩১
Writer তানিয়া শেখ
লিভিয়ার সব কথা নিকোলাস শুনেছিল। প্রথমদিন থেকেই এই ভদ্রমহিলাকে ওর পছন্দ হয়নি। চোখের দৃষ্টিতে যেন কপটতার জাল। নিকোলাস মানুষের মুখ দেখলে অনেক কিছু আন্দাজ করতে পারে। লিভিয়াকে দেখে ওর সুবিধার মনে হয়নি। ধীরে ধীরে এ বাড়ির সবার প্রতি ওর মনে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। এমনকি ওই ডক্টর, যে সময় পেলে ইসাবেলাকে দেখতে আসে তাকেও ও সন্দিগ্ধ চোখে দেখছে। ইসাবেলাকে অবশ্য এসব ও বলেনি, বুঝতেও দেয়নি। বিপদ আশঙ্কা করেও এ বাড়িতে থাকার মানে হয় না জেনেও আছে। ইসাবেলার পায়ের ক্ষত এখনও শুকায়নি। এই অবস্থা ওকে নিয়ে হঠাৎ করে কোথাও যেতে পারছে না। তবে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে আশপাশে।
“লিভিয়া চলে গেল। আমাদেরও এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।”
ইসাবেলা জানালায় মুখ করে বসে আছে। নিকোলাস বিছানায় বসে ছিল চুপ করে। এবার উঠে দাঁড়ায়। ফার্স্ট এইড বক্সটা হাতে তুলে এগিয়ে যায় ইসাবেলার দিকে। ওর পায়ের কাছে অনুচ্চ টুল এনে বসল। আহত পা’টা তুলে কোলে রাখতে মৃদু কেঁপে ওঠে ইসাবেলা। নিকোলাস ভুরু কুঁচকে তাকাতে লজ্জা আড়াল করে বলল,
“জবাব দিলেন না? আমার কিন্তু সত্যি ভয় হচ্ছে এখানে থাকতে।”
“আমি থাকতে তোমার কোনো ভয় নেই, বেলা।”
ইসাবেলার ফ্রকটা হাঁটুর ওপরে তুললো। হাত রাখল উন্মুক্ত পায়ের ত্বকে। শক্ত করে ঠোঁট চেপে ধরেছে ইসাবেলা। নিকোলাস প্রতিদিন এমনই করে স্পর্শ করে। ওর কাছে এটা হয়তো সাধারণ ব্যাপার কিন্তু ইসাবেলার কাছে নয়। শিহরিত হয় নিকোলাসের হাত পায়ের নগ্ন ত্বকে পড়তে। নিকোলাস ড্রেসিং করছে একমনে। ইসাবেলা অনিমেষ চেয়ে আছে ওর দিকে। লম্বা নাক, ঘন কালো ভুরু আর ওই লাল ঠোঁট। নিকোলাসের ঘন কালো চুলের কিছুটা উড়ে এসে পড়েছে কপালের ওপর। কী অবলীলায় খেলছে ওর কপালে! বড্ড হিংসে হলো চুলগুলোর ওপর ইসাবেলার। ওর দৃষ্টি ফের গিয়ে থামে নিকোলাসের ঠোঁটের ওপর। পিশাচ হবে ভয়ংকর, কদাকার। এমন সুদর্শন কেন হলো?
“ঠিক আছো তুমি?”
“হুঁ?” চমকে ওঠে ইসাবেলা। নিকোলাস এখনও চোখ তুলে তাকায়নি।
“ঠোঁট ফুলাচ্ছ কেন?”
ঠোঁটে হাত উঠে এলো ইসাবেলার। সত্যি তো ও ঠোঁট ফুলিয়ে আছে। জোরপূর্বক হেসে বলল,
“এটাকে ঠোঁট ফুলানো বলে না, পাউট বলে। এই দেখো?” ইসাবেলা পাউট করে দেখায়।
নিকোলাস একপলক দেখে মুচকি হাসে। ইসাবেলা ওর হাসি দেখে বোকার মতো হাসে। তারপর বলে,
“আপনার হাসি কিন্তু চমৎকার সুন্দর। যে কোনো মেয়ে পাগল হয়ে যাবে।”
“তুমি পাগল হয়েছ?”
“হুঁ?” অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ইসাবেলা। নিজের বলা কথাতে ও বেশ লজ্জিত হলো। কেন যে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল কথাটা! নিকোলাসের মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হলো। ড্রেসিং শেষে ওর পা আস্তে করে নিচে রাখল। ফ্রকটা নামিয়ে দিলো নিচে। ইসাবেলা সোজা হয়ে বসল। পায়ে যেন এখনও নিকোলাসের রুক্ষ, কঠিন হাতটার স্পর্শের রেশ রয়ে গেছে। বক্সটা হাতে নিয়ে উঠে গেল নিকোলাস।
“ব্যথা কী এখন তেমন নেই?”
“আছে তো। কেন?”
“ড্রেসিংএর সময় ব্যথা অনুভব করছ না কেন তাহলে? আজ আমি ইচ্ছে করে ক্ষতর ওপর তুলো সামান্য জোরে চেপেছিলাম। তোমার কাছ থেকে কিন্তু ব্যথা ট্যাথার প্রতিক্রিয়া পেলাম না।”
ইসাবেলা হাতটা ব্যান্ডেজের ওপর রেখে আঙুলে মৃদু চাপ দিতে চোখ মুখ শক্ত করে তোলে। ভীষণ ব্যথা! তাহলে তখন কী হয়েছিল? তখন কেন টের পায়নি কিছু?
“বেলা?”
“উম, মনে হয় কিছু ভাবছিলাম। গভীর ভাবনায় ডুবে গেলে এমনটা হয় সচরাচর।”
“আর ইউ সিওর?” নিকোলাস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়। ইসাবেলা চট করে মুখটা জানালার দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
নিকোলাস এখনও দৃষ্টি অনড় রেখেছে ওর দিকে। গভীর ভাবনা না ছাই! ওর ব্যথা ভোলার কারণ ছিল নিকোলাস। বেশ ভালোভাবেই সেটা জানে নিকোলাস।
“বেলা?”
“হুম?”
ক্ষণিক নীরবতা নামল ঘরময়। ইসাবেলা এখনও নিকোলাসের দিকে ফেরেনি। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে নিকোলাস সবটা ধরে ফেলেছে। একটুখানিই তো দেখেছে। ওইটুকু দেখলে কী হয়? ও তো আর নিকোলাসের মতো ঠোঁট বাড়িয়ে চুমু খেতে যায়নি!
“বিছানায় এসে শুয়ে পড়ো।”
হাঁপ ছেড়ে বাঁচে ইসাবেলা। নিকোলাস দরজার দিকে যেতে ও বলল,
“এই পা নিয়ে বিছানা পর্যন্ত কীভাবে যাব?”
ভাবলেশহীন মুখে তাকায় নিকোলাস। কঠিন গলায় বলে,
“সব ব্যাপারে এত পরনির্ভরশীল কেন তুমি, হ্যাঁ? কী ভাবো? আজীবন তোমাকে কোলে করে ঘুরে বেড়াব? এক পা আহত হয়েছে অন্য পা তো ঠিক আছে। চেষ্টা করো নিজে নিজে।”
বলেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল নিকোলাস। ইসাবেলার চোখ ছলছল করছে। খুব আঁতে লাগল নিকোলাসের কথা। অন্য পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে ব্যথায় ককিয়ে উঠল। টলমল চোখের জল এবার গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। পায়ের ব্যথার চেয়ে নিকোলাসের কথার ব্যথা বেশি লেগেছে ওর। আহাত পা হেঁচড়ে চললো বিছানার দিকে। খুব কষ্ট হলো কিন্তু হার মানল না। কারো ওপর বোঝা হয়ে থাকার মতো কষ্ট দুটো নেই পৃথিবীতে। বিছানায় বসে পা’টা মেলে দিলো। সাদা ব্যান্ডেজের খানিকটা রক্তে ভিজে গেছে। ঠোঁট কামড়ে কান্নার শব্দ দমালো। শারীরিক মানসিকভাবে নিকোলাস বহু আঘাত দিয়েছে ওকে। কিন্তু আজকেরটা অন্য সবটার মতো ছিল না। শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল। কাঁদতে কাঁদতেই একসময় ঘুমিয়ে গেল।
লিভিয়ার এই বাড়িটির পেছনের দিকে বিশাল অরণ্য। ডান দিকে সরু লেক। বেশ ফাঁকা ফাঁকা বসতি আশেপাশে। নিকোলাসের রক্তনেশা চেপেছে। ক্রোধ বাড়ছে প্রচণ্ড বেগে। রক্ত প্রয়োজন ওর। তৃষ্ণা মেটাতে রক্ত প্রয়োজন। হাওয়ায় মিশে গিয়ে থামল একটি বাড়ির সামনের সবজি খামারে। এক যুবতী এই ভর বিকেলে সেখানে বসে আগাছা পরিষ্কার করছে। নিকোলাস আশেপাশে সতর্কে দেখল। কেউ নেই। ধোঁয়ার কুন্ডলি হয়ে যুবতীর চতুর্দিকে ঘুরতে লাগল। মেয়েটি প্রথমে খেয়াল করেনি। ভয়ংকর গোঙানির শব্দে আঁতকে ওঠে ও। দ্রুত দাঁড়িয়ে যায়। সূর্যের আলোর তেজ বেশ কমে এসেছে। তারমধ্যে চারপাশ ঘুরতে থাকা ধোঁয়াটা ওর নজরে এলো। সাথে ভয়ংকর গা শিওরে ওঠা চাপা হাসি। মেয়েটি উলটো দিকে দৌড়াবে ওমনি নিকোলাস ওকে ধরে ফেলে। টেনে নিয়ে যায় জঙ্গলের মধ্যে।
“প্লিজ ছেড়ে দাও আমাকে।”
নিকোলাসের ভেতরকার পিশাচটা লোভে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে থাকে। মেয়েটাকে একটা গাছের সাথে দাঁড় করিয়ে ওর গলা চেপে ধরে। নিকোলাসের জ্বলন্ত লাল চোখ, রক্তিম ঠোঁটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে শ্বদন্ত। ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল মেয়েটির মুখ। আকুতি করে,
“আমি গর্ভবতী, আমায় মেরো না। দোহাই তোমার।”
নিকোলাসের চোখ যায় ওর হাত রাখা পেটের ওপর। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল আরেকবার। কানের কাছে ঝুঁকে এসে বলল,
“তবে তো আজ আমার মহাভোজ।”
মেয়েটি কিছু বুঝার আগেই তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত বসিয়ে দেয় ওর ঘাড়ে। চিৎকার করে নিস্তব্ধ জঙ্গল কাঁপিয়ে তোলে মেয়েটি। খানিক পরেই সব আগের মতো শান্ত হয়ে যায়। মেয়েটির ফ্যাকাশে দেহ পড়ে আছে নিচে। নিকোলাসের শরীর চাঙা হয়ে ওঠে। ঘুরে দাঁড়াতে মেয়েটির দুর্বল গলার স্বরে থেমে যায়।
“আমার সন্তান! আমার সন্তান!”
নিকোলাস ঘুরে দাঁড়ায়। মেয়েটির চোখ বোঁজা। হাতটা পেটের ওপর। এখনও সামান্য রক্ত অবশিষ্ট ওর দেহে। এতে কি বাঁচবে ওর সন্তান?
“বাঁচুক কিংবা মরুক তাতে আমার কী?”
“যদি বেলা এই ঘটনা জেনে যায়?” নেকড়ে সত্ত্বা প্রশ্ন করে। পিশাচ বলে,
“ও সব জানে। আমি কী ও ভালো করেই জানে। নতুন কিছু নয় এসব ওর কাছে? আমি এমনই। এমনই নির্মম, নিষ্ঠুর আর স্বার্থপর আমি।”
“তারপরেও ও তোমাকে পছন্দ করেছে, বিশ্বাস করে এখন।”
“কী বলতে চাইছ?”
“তোমার তৃষ্ণা তো মিটেছে তবে এই মেয়েকে বাঁচালে ক্ষতি কী? হয়তো এই কারণে বেলার ভালোবাসাও পেয়ে যেতে পারো একদিন।”
“ভালোবাসা! তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। কারো ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। আমি একে বাঁচাব না।”
নিকোলাস ধোঁয়ার কুন্ডলি হয়ে গলে যায় গাছের সারির ফাঁকে। কিছুদূর গিয়ে ফের ফিরে এলো। মেয়েটি অচেতন পড়ে আছে এখন। কোলে তুলে নিলো ওকে। মেয়েটির অচেতন মুখে চেয়ে বলে,
“তোমাকে আমি বাঁচাচ্ছি কেবল করুণা করে। আর কিছু না।”
নেকড়ে সত্ত্বা ফিক করে হেসে উঠতে রাগে গোঙানি দিয়ে ওঠে নিকোলাস।
“চুপ করো নয়তো একে এখনই ছুঁড়ে ফেলতে আমার বাধবে না।”
পিশাচদের ভরসা নেই। সুতরাং নেকড়েটা চুপ করে গেল।
চলবে,,,