তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-২+৩+৪

0
1466

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্ব- ০২
Writer Taniya Sheikh

প্রত্যাখ্যান আর মিথ্যার কণ্টকাঘাতের ব্যথা সর্বাঙ্গে বিষের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মনটা ভেঙে দিয়েছে পিটার ওর। এই বাড়ির মুরুব্বিরাও ইসাবেলাকে কিছু বলেনি। তাঁরা সকলে ঘটনার আগে জেনেছে পিটারের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কথা৷ কেন আড়ালে রেখেছে ওঁরা? কেন পিটার বলল না তাকে? ওর ওই নীরব পলায়ন ইসাবেলাকে যে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। ভেবেছিল দু’ একদিন গেলে হয়ত পিটার ফিরবে কিংবা ওর কোনো পত্র আসবে। কিন্তু সে আশাহত হয়েছে এবারও। বাইরের জগতের প্যাঁচ বোঝে না ইসাবেলা। মানুষের জীবনের ক্ষুদ্র বৃহৎ জটিলতা সম্পর্কে একেবারেই জ্ঞান নেই। মা ওকে যা দেখিয়েছেন তাই দেখেছে। মা দেখিয়েছেন এই ঘর, এই ঘরের হেঁশেলে সীমাবদ্ধ থাকাতেই নারী জীবনের সার্থকতা। বিপ্লব কী? বিপ্লবী কেন হয় মানুষ? এসব ওর জানা নেই। জানা নেই বলেই ভেবে নিয়েছে পিটারের বিপ্লবী হওয়ার কথাটা নিছক সান্ত্বনার বাণী। আদপে সে ইসাবেলাকে চায় না বলেই এভাবে চলে যেতে পেরেছে। আজ দুদিন হতে চলল পিটার ফেরারি। মহল্লায় এ নিয়ে কথা চালাচালি হচ্ছে। সকলে বলছে পিটার আর ফিরবে না। দানিল ছেলের উপর ক্ষুব্ধ। পুলিশ তাকে জেরায় জেরায় নাজেহাল করেছে। ছেলের কোনোরকম খোঁজ-খবর নিতে সে নারাজ। ওলেগ গম্ভীর হয়ে আছেন। একটা থমথমে ভাব পুরো বাড়িময়। বিয়ে উপলক্ষ্যে আগত অতিথিরা সান্ত্বনার বাণী আওড়ে ফিরে গেছে গতকালই। ভ্লাদিমির সেই কথা শুনে ইসাবেল সেদিন মূর্ছা যায়। তাকে ধরে বিছানায় শুয়ে দেওয়া হয়েছিল। আজ দু’দিন হয় বিছানা ছেড়ে নামছে না। জানালায় বসে পথ চেয়ে থাকে, এই বুঝি ও পথে পিটার হেঁটে এলো। কিন্তু না, সে আর আসে না। পিটারকে অধিকার করবে বলে মুখিয়ে থাকা যুবতীদেরদল সকৌতুকে রাস্তা দাঁড়িয়ে গলা তুলে বলছে,

“পালিয়েছে তোমার রাজপুত্তুর। আহা! এবার বুঝলে তো কেউ তোমার মতো সতীসাধ্বীকে চায় না। অমন দাদি-নানি সেজে থাকলে কপালে আর প্রেমিক জুটবে না, স্বামী তো দূর কী বাত।”

তাতিয়ানার ধমকে মেয়েগুলো মুখ ভেংচে চলে যায়। কিন্তু ওদের ওই কথা, ও তো ইসাবেলার হৃদয় বিদীর্ণ করে দিলো। লজ্জায়, অপমানে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার সাধ জাগে। তাতিয়ানা, ভ্লাদিমি ছুটে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরল। কারো সাথে কোনো কথায় সে বলছে না। আর না শুনতে ইচ্ছুক কারো কথা। মা আন্না মেরিও মেয়ের এই দুরাবস্থা চোখে দেখতে পারছেন না। তার নিষ্কলুষ মেয়েটি বিনাদোষে শাস্তি পাচ্ছে। গত দু’দিন হয় সে পানি ছাড়া কিছুই মুখে তোলেনি। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে কাঁদছে। এমনকি ওর প্রিয় আন্টি ভ্যালেরিয়ার সাথেও তেমন কথা বলেনি। ভ্যালেরিয়া ওর মায়ের সৎ বোন। সৎ হলেও দু’বোনের সম্পর্ক খুব ভালো। আন্না মেরিওর অর্ধেক বয়স ভ্যালেরিয়ার। বলা যায় তাতিয়ানার বয়সী। মায়ের অকাল মৃত্যুর পর এ বাড়িতে বছর দশেক ছিল সে। ইসাবেলার সাথে গড়ে ওঠে অসম বন্ধুত্ব। নিজের মনের কথা অকপটে যদি কাওকে ইসাবেলা বলেছে তবে সে ভ্যালেরিয়া। সেই ভ্যালেরিয়া আসার পর থেকে ইসাবেলাকে বুকে আগলে বসে আছে। ওর বুকে মাথা রেখে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে ইসাবেলা।

“তোমাকে একটা কথা বলব ভ্যালেরি?”

ঘুমন্ত ইসাবেলার মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বোনের দিকে তাকায়,

“হুম”

“এবার সাথে করে বেলাকে নিয়ে যাও তুমি। কিছুদিন তোমার সাথে চার্চের মতো পবিত্র স্থানে থাকলে ওর মনটা শান্ত হবে। ঈশ্বরের সান্নিধ্যে মা আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।”

ভ্যালেরিয়া ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে ওকথা শুনে। শুকনো ঢোক গিলে বলে,

“এ অসম্ভব আপা, আপনি জানেন, বিভিন্ন দায়িত্বপালনে চার্চের বাইরে থাকতে হয় আমাকে বেশিরভাগ সময়। তাছাড়া চার্চে ওকে রাখা যাবে না। আচ্ছা, আপনি কী ওকে সিস্টার বানাতে চাইছেন?” শেষটায় কপাল কুঁচকে যায় ভ্যালেরিয়ার। আন্না মেরিও আর্ত কণ্ঠে বলেন,

“না না, আমি শুধু চাইছি এই বাড়ির বাইরে গিয়ে কিছুদিন ঘুরে আসুক বেলা। সেটা তোমার সাথে হলে আমি নিশ্চিন্ত হই।”

ভ্যালেরিয়া বোনকে মনের কথা কী করে বোঝাবে? কী করে বোঝাবে তাঁরা সকলে যা ভাবে সে তা নয়। সে নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করেছে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য, ঈশ্বরের সৃষ্টি এই মানুষদের কল্যাণের নিমিত্তে। কিন্তু সকলের ভাবনার মতো ওত সহজ নয় তাঁর এই ‘সিস্টার’ জীবন। আর দশটা সাধারণ সিস্টারের মতোও নয় তার কাজ। বছর তিনেক হলো সে সিস্টারের শপথ নিয়েছে। তারপর থেকে বাড়িতে আসা হয়নি তেমন। ইসাবেলার অনুরোধ রক্ষার্থে তিন বছরে এই প্রথম এলো। ফাদার জালোনভের কাছ থেকে যখন তখন চিঠি এসে পৌঁছাবে দুয়ারে। চিঠি এলে তাঁকে ফিরতে হবে আবার। আর কোনোদিন এখানে ফেরা হবে কি না জানে না সে। তাকে আনমনা হতে দেখে আন্না মেরিও ফের শুধান,

“নেবে বেলাকে, ভ্যালেরি?”

“আপনি বুঝতে পারছেন না আপা। বেলা এখানেই ভালো থাকবে। রোজ সাথে করে শনি, রবিবারে চার্চে নিয়ে যাবেন। এখানকার চার্চের সিস্টারদের সাথে কথা বলব আমি। অনুরোধ করব ওকে একটু সময় দেওয়ার।”

আন্না মেরিওর মুখ কালো হয়ে যায়। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,

“তোমাকে ছাড়া আর কারো সান্নিধ্যে ওকে দিয়ে ভরসা পাইনা আমি। একটু ভেবে দেখো আমার কথাটা।”

এখানের ভাবার কিছু নেই। ভ্যালেরিয়া পারবেই না ওই বিপদসংকুল জীবনে ইসাবেলাকে জড়াতে। ইসাবেলাকে সে বড্ড ভালোবাসে। মেয়েটার খারাপ কিছু হোক কিছুতেই চায় না। এই বাড়ির বাইরে প্রতি পদে পদে বিপদ ভ্যালেরিয়ার। তাইতো সে পিছুটান ভুলে থাকে। নিজের দুর্বলতাগুলো কাওকে দেখাতে চায় না।

“ভ্যালেরি!”

ইসাবেলার ডাকে সংবিৎ ফেরে। মুচকি হেসে বলে,

“ক্রাসিভায়া( বিউটিফুল) ঘুম ভেঙেছে তোমার? কিছু খাইয়ে দিই?”

“না, খিদে নেই। তুমি আরো কাছে সরে এসো। তোমাকে জড়িয়ে ধরি।”

ভ্যালেরিয়া ওকে জড়িয়ে ধরে। ইসাবেলা আদুরে বেড়ালের মতো ওর বুকে মাথা রেখে অনেকক্ষণ কোনো কথা বলে না। ভ্যালেরিয়া ওর হালকা বাদামি চুলে বিলি কেটে বলে,

“ক্রাসিভায়া, এমন করে তো জীবন চলে না। তোমাকে ধৈর্য শক্তি বাড়াতে হবে। শক্ত হতে হবে।”

“ওরা সকলে আমায় মিথ্যার মধ্যে রেখেছিল ভ্যালেরি। আমি কী করে শক্ত হব? তুমি আমাকে বলছ ভেঙে পড়তে না, ও ভ্যালেরি, আমি যে ইতোমধ্যে ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গেছি। পিটার আমার মনটাকে এভাবে কেন ভাঙল?”

ভ্যালেরিয়া নিরুত্তর। ইসাবেলা ফুঁপিয়ে ওঠে।

“আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে হয় না ভ্যালেরি। এখানে দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার। আর কিছুদিন থাকলে মরেই যাব বুঝি। তোমার সাথে করে নিয়ে যাও না আমায়, নেবে তো?”

“ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। ও কথা বলো না আর। নিজেকে এভাবে দুর্বল করে তুলো না ইসাবেল। এখানে থেকেই তোমাকে বাঁচতে শিখতে হবে। যিশুর জীবনী পড়েছ না? তিনি কত দুঃখ ভুগেছেন। শূলে বিদ্ধ হয়েছেন তবুও আশাহত হননি। কাওকে দোষারোপ করেননি। ভালোবাসেন তিনি আমাদের। ঈশ্বর তোমায় ভালোবাসে। এই দুর্যোগের কাল থেকে বেরিয়ে ঈশ্বরের দেখানো পথে চলতে হবে তোমায়। জীবন থেকে বিশ্বাস হারিয়ো না। ঈশ্বর তোমায় ধৈর্যশীল করুন। মঙ্গল হোক তোমার।”

ইসাবেল ওর গলা জড়িয়ে ধরে,

“আমি কিছু শুনতে চাই না। আমায় তুমি এবার সাথে করে না নিলে মরা মুখ দেখবে। আমি সত্যি মরে যাব ভ্যালেরি। পিটারের স্মৃতি আমায় মেরে ফেলবে। তোমার সাথে না রাখ, কিন্তু এই রিগা শহর থেকে আমায় নিয়ে চলো।”

ভ্যালেরিয়া চিন্তায় পড়ে। ইসাবেলা কাঁদতে কাঁদতে ওর বুকের উপর ঘুমিয়ে যায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের ঘন কালোয় চারপাশ ঢেকে গেছে। ভ্যালেরিয়া ঘণ্টাখানেকের জন্য পার্শ্ববর্তী চার্চে গিয়েছিল। বাড়িতে ঢোকার মুখে উত্তর দিকের রাস্তা থেকে ভেসে এলো ঘোড়ার খুঁড়ের আওয়াজ। থেমে দাঁড়ায় সে। মেরুন রঙের ফিটন এসে থামল ওর সামনে। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন চল্লিশোর্ধ্ব এক লোক। পরনে তাঁর কালো আলখেল্লা। মাথায় কালো পাগরি। মুখভর্তি দাড়িগোঁফ। গলায় ঝুলছে ক্রুশ। অভ্যর্থনা জানায় ভ্যালেরিয়া। লোকটাকে কয়েকবার দেখেছে ফাদার জালোনভের সাথে। চিনতে কষ্ট হলো না তাই। তবে নামটা ঠিক মনে করতে পারল না। লোকটা মাথা মৃদু নুয়ে প্রত্যুত্তর করে পকেট থেকে একটা খাম বের করলেন। শুকনো গোলাপের ছবির স্ট্যাম্পসম্বলিত খামটা দেখে গলা শুকিয়ে এলো ভ্যালেরিয়ার। হাত বাড়িয়ে খামটা নিলো। খামটা হাতে দিয়েই ফিটনে উঠে পড়ল লোকটা। উঠার আগে আরেকবার আশপাশটা সতর্কে দেখে নিলো। কোথাও কেউ নেই। লোকটাকে নিয়ে উত্তর দিকের রাস্তায় ফের হারিয়ে গেল ফিটনটি। ভ্যালেরিয়া গলার ক্রুশটা শক্ত মুঠে ধরে আস্তে আস্তে উঠে এলো দোতলায় ইসাবেলার কক্ষে। ইসাবেলা ঘুমিয়ে আছে। আজ অনেক বলে কয়েক চামচ স্যুপ খাওয়াতে সক্ষম হয়েছে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ইসাবেলার তখনকার কথা। নতুন ভাবনা যোগ হলো আগত চিঠির ভেতরের অদেখা নির্দেশ। চিঠিটা অসতর্কে সামনের ছোট্ট টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকল।

হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে ইসাবেলার। পাশে ভ্যালেরিয়া নেই। বোধহয় পাশের ঘরে নৈশ প্রার্থনায় মগ্ন। ভ্যালেরিয়ার এই পরিবর্তন ভীষণ ভালো লাগে ইসাবেলার। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় সেও সিস্টার হবে। না, সিস্টার নয়, সে হবে নান। কিন্তু মা রাজি হবেন না। বয়সও তো কম। সবে সতেরো পড়ল। নান হওয়ার ইচ্ছেটা এই ক্ষণে প্রবল হলো। এই মোহ, মায়া ত্যাগ করতে পারলেই বুঝি কষ্ট লাঘব হবে। আচ্ছা, মনুষ্য জীবনে এত কষ্ট কেন? গলাটা শুকিয়ে এসেছে। শিওরের পাশে পানির জগটা পেল না। ওই তো ছোট্ট টেবিলের উপর ওটা। অনাহারে দূর্বল শরীরটাকে ঠেলে তুলে দাঁড় করিয়ে চলল সেদিকে। পানি পান করে গ্লাসটা রাখতে যাবে তখনই চোখ পড়ে টেবিলে পড়ে থাকা চিঠির খামটার দিকে। হাতে তুলে নিলো। ভাবলো চিঠিটা পিটারের নয়ত? আনন্দটুকু তার নিমেষে মুছে গেল লেখাগুলো দেখে। পিটারের নয়। প্রেরকের নাম ধাম পড়তে পারল না। বড়ো অদ্ভুত লেখা। কোন দেশের ভাষা কে জানে? কিন্তু চিঠিটা কার? ভ্যালেরিয়ার! হঠাৎ চোখ পড়ল স্ট্যাম্পের শুকনো গোলাপের ছবিটার উপর। সাধারণ শুকনো গোলাপের মতো নয় ওটি। বেশ অন্যরকম। যেন শুকিয়েও জীবন্ত। আচমকা মনে হলো এই রকম একটা চিত্র ও আগেও কোথাও দেখেছিল! কিন্তু কোথায়?

চলবে,,,,

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ০৩
Writer Taniya Sheikh

কিছু কষ্ট ক্রমশ অনুভূতিহীন করে তোলে। তখন কষ্ট, যন্ত্রণা বলে কিছু অনুভূত হয় না। প্রথমে হৃদয় তারপর ধীরে ধীরে শরীরটা অসাড় হয়ে পড়ে।চোখের সামনে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার । বেঁচে থাকাটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ইসাবেলা ভগ্নশরীরে বিছানায় শায়িত। নিজের শরীরটাকে পাখির পালকের ন্যায় মনে হয়। এত হালকা কখনো মনে হয়নি আগে। দিন যত যাচ্ছে ওর অবস্থার অবনতি ঘটছে। ডাক্তার এসে রোজ দেখে যাচ্ছেন। ওষুধে কাজ হচ্ছে না। দু’এক চামচ স্যুপ খেয়ে প্রাণ ধারণ কতটা সফল হয়? বাড়ির সকলে চিন্তিত। আন্না মেরিও বড়ো শক্ত মনের মহিলা। তিনিও মেয়ের এই করুন অবস্থা দেখে না কেঁদে পারলেন না। ওলেগ স্ত্রীর মতো কঠিন মনের নন। মেয়েদের তিনি বরাবরই অত্যাধিক ভালোবাসেন। ইসাবেলা তার বড়ো আদুরে মেয়ে। সেই মেয়ের এই শয্যাশায়ী অবস্থা দেখে তিনি প্রায় ভেঙেই পড়েছেন। ইসাবেলার দাদা-দিদিমার অবস্থা খানিক ছেলেরই মতো। তাতিয়ানা, ভ্লাদিমি বোনকে কত বুঝাচ্ছে! ইসাবেলা যেন সকল বুঝের বাইরে চলে গেছে। এদিকে ভ্যালেরিয়ার যাওয়ার দিন আসন্ন। তিন দিন থাকার জায়গায় তিন সপ্তাহের অধিক হলো এই বাড়িতে আছে। এই বাড়ি আসার পর যেই চিঠিটি পেয়েছিল তাতে ফাদার জালোনভ লিখেছেন, চার দিন পরে ভ্যালেরিয়ার জন্য ফিটন পাঠানো হবে। এবার তাদের মিশন বেলারুশ বর্ডারের কাছাকাছি একটি ছোট্ট গ্রামে। ফাদার তাঁর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে ইতোমধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছেন। ইসাবেলার কারণে ভ্যালেরিয়া আঁটকে আছে এখানে। চারদিন পর আগত ফিটন ফিরিয়ে দিয়েছে। ফাদারকে চিঠি লিখে না যাওয়ার কারণ জানিয়েছে। সাথে লিখেছে যত দ্রুত সম্ভব ফিরবে সে। কিন্তু তা আর হলো না। এই অবস্থায় মেয়েটাকে ফেলে যেতে সায় দিচ্ছে না ওর বিবেক। গতকাল ডাক্তার ইসাবেলাকে পরীক্ষা নিরিক্ষা করে নতুন একটা কথা বলেছেন। ডাক্তার জানিয়েছেন ওষুধ নয় ইসাবেলার এই মুহূর্তে প্রয়োজন হাওয়া বদলের। বাড়ি সকলে স্থির করল ওকে নিয়ে হাওয়া বদলে যাবে অ্যালেক্সিভদের আদি গ্রামে। কিন্তু বাধ সাধে ইসাবেলা। সে কোথাও যাবে না। ডাক্তার নিষেধ করেছেন ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করতে। ভ্যালেরিয়া ইসাবেলাকে এভাবে তিলে তিলে শেষ হতে দেবে না। সে ওর শিওরে গিয়ে বসল। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“তুমি কী চাও, ক্রাসিভায়া? আমরা তো তোমার এই অবস্থা আর দেখতে পারছি না। বড়ো কষ্ট হচ্ছে আমাদের। নিজের সাথে এমন অনাচার করো না প্লিজ।”

ইসাবেলা জবাব দেয় না। শূন্য চোখে চেয়ে থাকে। ভ্যালেরিয়ার চোখে জল চলে এলো এবার। ইসাবেলার হাতের পল্লবে চুমু দিয়ে ফের বলল,

“আমি তোমাকে এভাবে শেষ হতে দেবো না ক্রাসিভায়া। তুমি যাবে গ্রামে। আর__”

“না, আমি কোথাও যাব না ভ্যালেরি। পিটার ফিরে যদি আমায় না পায়? আবার হারিয়ে যাবে ও। আমি ওকে হারাতে দেবো না। ও আসবে ভ্যালেরি। ও আসবে। আমি অপেক্ষা করব ওর জন্য।”

“এভাবে অপেক্ষা করবে? এভাবে তো শেষ হয়ে যাবে তুমি। ওর জন্যও হলেও তো তোমাকে বাঁচতে হবে ক্রাসিভায়া।”

ইসাবেলা নির্নিমেষ চেয়ে রইল ভ্যালেরিয়ার মুখের দিকে। তারপর হঠাৎই ডুকরে কেঁদে ওঠে। ওই দূর্বল শরীরে কাঁদতেও ভীষণ কষ্ট হয়। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,

“আমি কী করব ভ্যালেরি? আমার দম বন্ধ হয়ে আসে এখানে। পিটার কেন চলে গেল? ওর কী একটুও মনে পড়ে না আমায়? একটা চিঠি অব্দি পেলাম না। এতটা পর করে দিলো এক মুহূর্তে? কীভাবে পারল ও? ও ভ্যালেরি, আমি বোধহয় ওর অপেক্ষায় শেষ হয়ে যাব। ও কী আসবে আমার অন্তেষ্টিক্রিয়াতে?”

“হুশ! এসব বাজে কথা বলো না তুমি। তোমার কিছু হবে না। আমি কিছু হতে দেবো না।” ওর চোখের পানি মুছে কপালে আলতো চুমু দিয়ে আবার বলল,

“জীবনের অর্থ কি এই স্থিরতা ক্রাসিভায়া? এভাবে অভিমানে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার নাম জীবন নয়। মানুষের এই পৃথিবীতে আগমনের শুরুটাই হয় লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। তোমাকে শিখতে হবে সেই লড়াই। এই দুঃখ, কষ্টের হলাহল গলাধঃকরণ করে পৃথিবীতে টিকে থাকা খুব কঠিন, নিজেকে শেষ করে ফেলা সেখানে বড্ড সহজ কাজ। ঈশ্বর মানুষকে দুঃখ, কষ্ট কেন দেয় জানো? যেন মানুষ নিজেকে, নিজের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা শক্তিটাকে চিনতে পারে। তুমি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে দুর্বল মানুষদের ন্যায় অন্ধকারে ডুবিয়ে ফেলতে চাইছ নিজেকে। এমনটা করো না। ঈশ্বর তোমাকে ভালোবাসেন। যে তোমার ভালোবাসা বুঝতে চাইল না তার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে মরিয়া, কিন্তু যে তোমায় নিঃস্বার্থ ভালোবাসে সেই ঈশ্বরকে একটুখানিও ভালোবাসো না তুমি। এ তো অন্যায়। ঈশ্বরের প্রতি অন্যায় করছ তুমি ক্রাসিভায়া।”

ইসাবেলার চোখের কোণা দিয়ে অশ্রু ঝরে। শুষ্ক ঠোঁট দু’টো চেপে ধরে দু’চোখ বন্ধ করল। ভ্যালেরিয়ার হাতটা খুব শীতল। ওর কপাল ছুঁয়ে দিলো হাতটা। অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল। ভ্যালেরিয়ার প্রতিটি কথা ভাবছে। সত্যি কী সে ঈশ্বরের সাথে অন্যায় করছে? চোখ মেলে চাইল ভ্যালেরিয়ার মুখের দিকে। সে এখনো চেয়ে আছে ওর মুখ পানে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইসাবেলা বলল,

“ঈশ্বর কি আমার আচরণে রুষ্ট, ভ্যালেরি? আমি কী তাঁকে খুব কষ্ট দিলাম?”

ভ্যালেরিয়া মৃদু হেসে বলল,

“ঈশ্বর ক্ষমাশীল। তিনি আমাদের সকলকে ভালোবাসেন। আমরা অবুঝ, পাপী। কত ভুল হয় আমাদের। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। তাই বলে ঈশ্বর আমাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন না। তিনি ধৈর্যশীল। আমরা যখন অনুতপ্ত হয়ে তাঁর দ্বারে ক্ষমাপ্রার্থনা করি, তিনি খুশি হন। ক্ষমা করতে ভালোবাসেন তিনি।”

ইসাবেলা আবার চুপ হয়ে যায়। ভ্যালেরিয়া ওকে জিজ্ঞেস করে,

“রবিবার যাবে আমার সাথে চার্চে?”

ইসাবেলা ছলছল চোখে হালকা মাথা নাড়ায়। সে যাবে। ভ্যালেরিয়ার বুকের উপর থেকে যেন পাথর সরে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। তার মনে আশা জাগে ইসাবেলা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে।
পরদিন সকালে ইসাবেলাকে ধরে পাশ্ববর্তী চার্চে গেল ভ্যালেরিয়া। সাথে আন্না মেরিও, তাতিয়ানা আর ভ্লাদিমিও ছিল। সকলে প্রার্থনা করে ইসাবেলার সুস্থতার জন্য। ফাদার ওর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। ইসাবেলার ভালো লাগল চার্চের মতো পবিত্র স্থানে গিয়ে। কয়েকজন সিস্টারের সাথেও কথা হলো ওর। ওরাওঁ ভ্যালেরিয়ার মতো বড়ো মমতায় বুঝাল। মনের অস্থিরতা সেই ক্ষণে অনেকটাই কমে আসে। বিষণ্ণতা কিন্তু কাটল না। দৃষ্টিতে সেই আগের মতো উদাসীনতা। বাড়ি ফেরার পথে চার্চের বাইরের খোলা মাঠটাতে কিছুক্ষণ বসল। আন্না মেরিও ভ্লাদিমিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। ইসাবেলার সাথে তখন ভ্যালেরিয়া আর তাতিয়ানা। ইসাবেলা ওর মাথাটা তাতিয়ানার কাঁধে রেখে শূন্য গগনে চেয়ে রইল একদৃষ্টে। ভ্যালেরিয়া কথা বলছে তাতিয়ানার সাথে। তাতিয়ানার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একমাত্র মা আন্না মেরিও নাখোশ নয়, ভ্যালেরিয়াও নাখোশ। তাতিয়ানা অবিবাহিত সিঙ্গেল মাদার। ওর জীবনযাপন খুব উগ্র। তাশা গর্ভে আসার আগে সে রোজ বার, পার্টিতে মেতে থাকত। কোনো কোনো দিন রাতে বাড়িতেও ফিরত না। তাশার বাবা কে এই জবাব সে কাওকে দেয়নি। তবে তাশার জন্মের পর অনেকটাই সভ্য হয়েছে তাতিয়ানা। পার্টিতে গেলেও বারে এখন তেমন যায় না। ভ্যালেরিয়া ওকে বলছে পছন্দ মতো ছেলে দেখে বিয়ে করতে। তাতিয়ানা মুখ কুঁচকে বলল,

“বিয়ে! ও আমার জন্য না।”

“তাশার কথা ভাবো একবার। ওরও তো পিতার আদর পাওয়ার হক আছে।” ভ্যালেরিয়া বলল।

তাশার প্রসঙ্গ এলে তাতিয়ানা নরম হয়ে যায়। মুখ অন্য দিকে ফিরে বলল,

“আমিই ওর বাবা, আমিই ওর মা। কোনো পুরুষের প্রয়োজন নেই আমাদের জীবনে।”

“এত বিতৃষ্ণা কেন পুরুষদের প্রতি তোমার?”

“চুপ করো ভ্যালেরি। এ নিয়ে আর কোনো কথা বলবে না। আমার ভালো লাগছে না এখানে বসতে। ইসাবেল, তুমি ওর সাথে বসো। আমি চললাম।”

ইসাবেলা সোজা হয়ে বসতে তাতিয়ানা উঠে দাঁড়ায়। ওর মুখটা কঠিন দেখাচ্ছে। ভ্যালেরিয়া এবং ইসাবেলা দু’জনই ভ্রুকুটি করে তাকাল। হঠাৎ কী হলো ওর? ভ্যালেরিয়া কিছু বলবে তার আগেই হনহনিয়ে চলে গেল বাড়ির দিকের রাস্তায়।

“তাতিয়ানার এই উগ্রতা আমাকে বড্ড ভাবায় ক্রাসিভায়া। ও কিন্তু এমনটা ছিল না পূর্বে। হ্যাঁ, একটু স্বাধীনচেতা ছিল কিন্তু উগ্র নয়। ওর হঠাৎ বদলে যাওয়ার কারণ আমি আজও বুঝে উঠতে পারি না। আগে সব বলত আমাকে। কোথা থেকে যে আমাদের মধ্যে দুরত্বটা চলে এলো ভেবে পাই না।”

তাতিয়ানার যাবার পথ পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ভ্যালেরিয়া। ইসাবেলাও ভাবুক হয়। ওর মনে পড়ে তাতিয়ানা প্রচণ্ড হাসি- খুশি আর প্রাণোচ্ছল মেয়ে ছিল। ঠিক ইসাবেলার মতো শান্ত, অন্তর্মুখী স্বভাবের না। ওর অন্তরে যা থাকত কোনো রাখ ঢাক ছাড়াই প্রকাশ করত। সবাইকে ভালোবাসত, মাকেও। মায়ের সাথে মতের অমিল ছিল তখনো কিন্তু এখনকার মতো এতটা নয়। এখন মা যেন ওর শত্রু। এই তো বছর দুই আগে কী এক কারণে মা মেয়েতে তুমুল কথা-কাটাকাটি। একপর্যায়ে তাতিয়ানা বলেই বসেছিল ঘৃণা করে মা’কে সে। প্রচণ্ড ঘৃণা করে। বাকরুদ্ধ হয়ে যান আন্না মেরিও। চোখ ছলছল হয়ে গিয়েছিল তাঁর। এরপর তাঁদের সম্পর্কের দেয়ালের এক একটা ইট খসে পড়তে লাগল। ইসাবেলা এর কারণ খোঁজেনি আগে। আজ কেন যেন মনে হলো অকারণে কিছু ঘটে না। মা-মেয়ের এই বৈরি সম্পর্কের মাঝে নিশ্চয়ই রহস্য আছে। কিন্তু কী?

“ক্রাসিভায়া?”

ভ্যালেরিয়ার ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো।

“হুম।”

“সন্ধ্যে হয়ে এলো। চলো উঠি।”

ইসাবেলা সম্মতিসূচক মাথা নাড়াতে ওর বাহু জড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় ভ্যালেরিয়া। হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ইসাবেলার। পা দু’টো যেন জেলির মতো। সোজা হয়ে দাঁড়াতে শক্তি পায় না। আস্তে আস্তে ওরা বাড়ির পথে চলল। কিছু দূর হেঁটে ইসাবেলা জিজ্ঞেস করে,

“কবে ফিরছ তুমি?”

“পরশু।”

ইসাবেলার পা থেমে যায়। ভ্যালেরিয়া চিন্তিত গলায় বলল,

“কী হলো?”

“আমাকে সাথে নেবে ভ্যালেরি? তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই থাকব। একদম ভালো মেয়েটি হয়ে।”

ভ্যালেরিয়া জানে এবার না করলে ইসাবেলা ওই ঘর ছেড়ে আর বেরোবে না। কিন্তু ওকে নিয়ে কী করে ওই বিপৎসংকুল স্থানে যাবে?

“আচ্ছা থাক। তুমিই যাও। আমি কারো উপর বোঝা হতে চাই না।” পাশের গাছটার সাথে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়ায়।

“তুমি আমার উপর বোঝা নও, ক্রাসিভায়া।”

ইসাবেলা কংক্রিটের রাস্তা চেয়ে রইল। ভ্যালেরিয়া আঁজলা ভরে ওর মুখটা তুলে বলে,

“আমি তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসি ক্রাসিভায়া। ঈশ্বরের পরে এতটা ভালো আমি কাওকে বাসি না। বিশ্বাস করো আমাকে?”

ইসাবেলা মাথায় নাড়ায়। সে বিশ্বাস করে ভ্যালেরিয়াকে। ভ্যালেরিয়া মুচকি হাসে। পরক্ষণেই গম্ভীর দেখা গেল তাকে। সে বলল,

“আমি কাওকে সত্যিটা বলিনি। আজ তোমাকে বলছি, আমি সাধারণ সিস্টার নই ক্রাসিভায়া। আমার দায়িত্বও ওদের মতো নয়। প্রতিটি মুহূর্ত মৃত্যুর সাথে লড়তে হয়। ঈশ্বর যেমন আছে শয়তানও আছে এ কথা বিশ্বাস করো তুমি?”

ইসাবেলা ভ্রু কুঁচকায়। ভ্যালেরিয়া একটু সরে দাঁড়ায়। গলার ক্রুশটা মুঠোর মধ্যে ধরে বিড়বিড় করে কিছু বলে। ইসাবেলা চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। ভ্যালেরিয়া আকাশের দিকে চেয়ে বলে,

“পৃথিবীতে এমন কিছু ঘটে যার ব্যাখ্যা সব সময় পাওয়া যায় না। প্রকৃতি বড্ড অদ্ভুত। মানুষের সামনে এমন এমন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় যা থেকে মুক্তির উপায় বিজ্ঞান বাতলে দিতে পারে না। মানুষকে তখন শরণাপন্ন হতে হয় ঈশ্বরের। একমাত্র তিনিই মুক্তির পথ দেখান।” এতটুকু বলে থামে ভ্যালেরিয়া। ইসাবেলা কিছুই বুঝতে পারল না। ভ্যালেরিয়া বলল,

“বিজ্ঞানের জয়জয়কারে মানুষ ধর্মের ছায়াতল থেকে সরে যাচ্ছে। সব কিছু যুক্তিতর্কের বিচারে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে মানুষ। আস্তিকতাকে অযৌক্তিক মনে করে অনেকে। এসবে একজনের প্রভাব প্রবলভাবে বাড়ছে মানুষের মস্তিষ্কের উপর। কার জানো? শয়তানের। শয়তান আদম সন্তানদের ঘৃণা করে। আমরা সকলেই একথা জানি কিন্তু মানি কয়জনে বলো? কিছু মানুষ এসব জেনেও লোভের বশবর্তী হয়ে, বিপথগামী হয়ে শয়তানের পূজা করে। শয়তানকে খুশি করতে মানবজাতি ধ্বংসের লীলাখেলায় মেতে ওঠে। ওরা নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষদের ধ্বংস করে এই পৃথিবীতে শয়তানের রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে। ওদের পথটা খোলা চোখে দেখা যায় না ক্রাসিভায়া। ওরা গুপ্তচক্র। পৃথিবীর বাতাসে মিশে থাকে। আমরা সাধারণ দৃষ্টিতে ওদের দেখতে পাই না। অথচ, আমাদের আশেপাশেই ওঁৎ পেতে আছে সুযোগ বুঝে আক্রমণ করবে বলে। একটু একটু করে এগোচ্ছে ওরা, খুব সাবধানে। শয়তান ওদের নিরপত্তা দেয়। ওরা মানুষের ছদ্মবেশে শয়তান, ক্রাসিভায়া। কায়াটা মানবীয় কিন্তু রূহটা শয়তানের হাতে বন্দি। খুব শক্তিশালী ওরা। কিন্তু ঈশ্বরের চাইতে নয়। আমরা ঈশ্বরের পক্ষ হয়ে ওদের বিরুদ্ধে লড়ি। ওদেরকে সমূলে নির্মূল করা সহজ নয় তবুও চেষ্টা করছি মানুষকে রক্ষা করতে ওদের নিষ্ঠুরতা থেকে। তুমি যদি দেখতে ওদের নিষ্ঠুরতার ছবি!”

ভ্যালেরিয়ার মুখ-চোখ আর্ত হয়ে ওঠে। ক্রুশটা শক্ত করে ধরে আছে। ইসাবেলার কৌতূহল বাড়ে। ভয় যে হয় না তা নয়। কিন্তু কৌতূহলটাই বেশি।

চলবে,,,

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ০৪
Writer- Taniya Sheikh

ক্লান্তি এবং দুর্বলতায় চোখে ঘুম নেমে এসেছে ইসাবেলার। মাথাটা হেলে পড়ল ভ্যালেরিয়ার কাঁধে। ফিটনের সামনের ঘোড়াটা ছুটছে টগবগিয়ে। বাইরে পড়ন্ত বিকেলের রোদের আলো। তাপটুকু প্রখর নয়, মেদুর। জানালার কাঁচ গলে ইসাবেলার বোঁজা নেত্রের উপর এসে পড়েছে সেই স্নিগ্ধ আলো। রাস্তার বড়ো গাছগুলোর সাথে মেদুর রোদের ওই লুকোচুরি খেলা বড়ো বিরক্ত করে ইসাবেলার ঘুমকে। সে একটু নড়েচড়ে ওঠে। ভ্যালেরিয়া বুঝতে পেরে হাতটা ওর চোখের উপর রাখল। ঘুমন্ত ইসাবেলার ঠোঁটের কোনে ক্ষীণ হাসি দেখা যায়। সে আরো নিবিড় হয়ে বসে ভ্যালেরিয়ার সাথে। ভ্যালেরিয়া গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে চায়নি ইসাবেলাকে সঙ্গে নিতে কিন্তু ভাগ্যের বুঝি এই উদ্দেশ্য ছিল। ভাগ্যকে বড্ড ভয় ভ্যালেরিয়ার। সে মনেপ্রাণে ধর্মপ্রাণ। ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত। তথাপি সাধারণ মানুষের মতো ভয়টা তার কিছুতেই কাটে না। ফাদার জালোনভ এই কারণে কতবার সতর্ক করেছে! যে জীবন সমর্পিত তা নিয়ে ভয় কীসের? মরণ তো অনিবার্য। তবে ভয়টা কেন হবে? তাছাড়া গত এক বছরে সে ফাদারের সাথে যেসব বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে তাতে ভয়টা কেটে যাওয়ার কথা। কিন্তু ভ্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে উলটো। এই যে এখন সে ভয়, শঙ্কায় অস্থির। ফাদার বলেছিলেন পিছুটান থাকবে না তোমার। ভ্যালেরিয়া বলেছিল,”নেই।” আজ ভাবছে সেই কথাটা মিথ্যা ছিল। এখানেই তার পাপ। সে পাপী। পাপীদের মৃত্যু ভয় থাকে। ইসাবেলা তার কতটা আপন কেবল সেই জানে। সংসার, পরিজনের মায়া কাটালেও ইসাবেলার মায়া সে কাটাতে ব্যর্থ। ভ্যালেরিয়া জানে ফাদার তাকে এ কারণে তিরস্কৃত করবে। তার সাথীরা তাকে কটাক্ষ করবে। ওই নৃশংসের দল ঘুণাক্ষরেও যদি টের পায় তবে ঘোর সর্বনাশ ঘটে যাবে। ভ্যালেরিয়ার উপর প্রতিশোধ নিতে ওরা মুখিয়ে আছে। ইসাবেলার চোখের উপর থেকে হাতটা নামিয়ে ফর্সা গালের উপর রাখল। অস্ফুটে বলল,

“তোমাকে সব বললাম এই আশায় যে তুমি ভীত হবে, আসতে চাইবে না আমার সাথে। কিন্তু উলটোই ঘটে গেল। কেন এত জেদ করলে ক্রাসিভায়া। আমার যে খুব ভয় করছে এখন। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি যে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।”

ইসাবেলা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভ্যালেরিয়া সিটে শরীর এলিয়ে দিলো। অবসন্ন লাগছে। কোচওয়ানকে বলল,

“সন্ধ্যার আগে কী পৌঁছাতে পারব জনাব?”

“মনে হয় না, রাত হয়ে যাবে বোধহয়।”

ভ্যালেরিয়া চোখ বুঁজল। ইসাবেলাকে সব খুলে বলার পর সে নিশ্চুপ হয়ে ছিল সেদিন। ভ্যালেরিয়া ভেবেছিল ও আর যেতে চাইবে না। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছিল। পরদিন ভ্যালেরিয়া খুশি মনে ফাদারকে ফেরার ডেট জানিয়ে একখানা পত্র লিখতে বসে। কিন্তু বিপত্তি বাধে ফের। ইসাবেলাকে আন্না মেরিও কিছুতেই গ্রামে যেতে রাজি করাতে পারছেন না। মায়ের কথার অবাধ্য ইসাবেলা হতো না আগে। ইদানীং সে বারবার মা’কে হতাশ করছে। নাখোশ দেখা গেল আন্না মেরিওকে। মেয়ের এই বদলে যাওয়া পছন্দ করছেন না। কিন্তু মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ইসাবেলা অসুস্থ। সুস্থ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভ্যালেরিয়াকে এসে ধরেন আন্না মেরিও। ইসাবেলাকে তাঁর পরে কেউ যদি বুঝাতে পারে তবে সে ভ্যালেরিয়া। উদাস চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল ইসাবেলা। ভ্যালেরিয়া বসল ওর পাশে। এই মেয়েটাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ওর মধ্যে আধুনিকতার সেই উগ্রতা নেই, আছে প্রাচীন প্রকৃতির শুদ্ধতা। মনোহরা, পবিত্র ইসাবেলার সৌন্দর্য। ভ্যালেরিয়া কিছু বলবে তার আগেই ইসাবেলা বলল,

“আমি গতরাতে ঘুমাতে পারিনি জানো ভ্যালেরি। সারারাত ভেবেছি তোমাকে নিয়ে।”

“আমাকে নিয়ে!”

ইসাবেলা এবার ওর মুখের দিকে দৃষ্টি সরিয়ে আনল। ছলছল করছে ওর চোখ। বাদামী চোখের মণি জ্বলজ্বল করছে। ভ্যালেরিয়ার মুখের একপাশে হাত রেখে বলল,

“তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাকে ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরেছে। তুমি কেন করো ওসব? তুমি আর ওসবে যাবে না। আমি কোথাও যেতে দেবো না তোমাকে ভ্যালেরি। পিটারকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব। এবার তোমাকেও যদি হারিয়ে ফেলি! না, না। তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না।” ইসাবেলা দু’বাহুর বাঁধনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রিয় খালাকে। ভ্যালেরিয়া একসময় ভাবতো এই পৃথিবীতে ও বড্ড একা। মা নেই, বাবা নেই। যাকে কৈশোরে ভালোবাসলো সেও ধোঁকা দিলো। তারপর ধীরে ধীরে নির্মোহের জালে জড়িয়ে গেল জীবনটা। অনর্থক জীবনটাকে একটা অর্থ দিতে ঈশ্বরের সামনে সমর্পণ করল নিজেকে। সে এবং ঈশ্বর। ঈশ্বরের সৃষ্টি এই জীবকুল হয়ে উঠল তার সন্তানতুল্য। আজ মনে হচ্ছে সে এবং ঈশ্বরের মাঝে ইসাবেলা জায়গা করে নিয়েছে। নিয়েছে! না, সে আগেই ছিল। ভ্যালেরিয়া তাকে দেখতে পায়নি। চোখ দু’টো জ্বালা করতে লাগল। এখনই নামবে বুঝি ঢল। কিন্তু হঠাৎ নিজের জীবনের কঠিন সত্যিটা উপলব্ধি করতে ছিটকে সরে বসল। ইসাবেলা স্তম্ভিত। ভ্যালেরিয়া অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

“তুমি অযথা ভয় পাচ্ছো। আমি মৃত্যুকে ভয় পাইনা।”

“আমি পাই ভ্যালেরি। ভীষণ ভয় পাই। মৃত্যু মানে হারিয়ে ফেলা। প্রিয় মানুষ, প্রিয় স্বজন হারিয়ে ফেলা। সব নিয়ে নিঃস্ব করে দেয় মৃত্যু। আমি মৃত্যু ভয় পাই ভ্যালেরি।”

“আমার হারিয়ে ফেলার ভয় নেই ইসাবেল।” চোয়াল শক্ত করে বলল ভ্যালেরিয়া। ইসাবেলা একদৃষ্টে চেয়ে রইল। বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করে,

“কেন নেই? তুমি কী জীবন ভালোবাসো না? আমাকে ভালোবাসো না ভ্যালেরি?”

সে জীবনকে ভালোবাসে না একথা সঠিক, কিন্তু যদি বলে ইসাবেলাকে ভালোবাসে না একথা মিথ্যা। মিথ্যা বলা মহাপাপ। সে চুপ রইল।
ইসাবেলা সরে এলো। ওর হাতদুটো মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল,

“তুমি আর তাতিয়ানা চোখের নিমেষে বদলে গেলে। কেন বদলে গেলে তোমরা? গতরাতে আমাদের শৈশবের স্মৃতি মনে করছিলাম। হঠাৎ কান্না পেল। শৈশবের সেই মধুরতার রেশ যৌবনের এই ক্ষণে কেন নিরস হলো? তখনকার সুন্দর পৃথিবী আজ এমন বিবর্ণ, বিভৎস কেন হলো ভ্যালেরি? জীবনটা এত অসহ্য কেন হয়ে উঠল আমাদের কাছে?”

ইসাবেলার অশ্রুর কয়েক ফোঁটা এসে পড়ে ভ্যালেরির হাতের উপর। সে শিউরে ওঠে। ইসাবেলাকে জড়িয়ে ধরে নিরবে চোখের জল ফেলে। অতীতের সেই সুপ্ত কষ্ট আজ ফের উঁকি দেয়। ইসাবেলাকে সে বুঝতে দেবে না। কাওকেই নয়। কষ্টগুলো একান্তই তার একার। কাওকে বলতে গেলে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে। নিজেকে, নিজের অনুভূতিগুলোকে আর বিক্ষিপ্ত হতে দিতে চায় না সে। ইসাবেলাকেও সেই কণ্টকাকীর্ণ পথে চলতে দেবে না। যদিও ওই পথের মুখেই দাঁড়িয়ে ইসাবেলা। কারো কারো কেবল মনই ভাঙে না, বরং সমস্ত জীবনটাই ভেঙেচুরে অন্তঃসারশূন্য কঙ্কাল হয়ে যায়। নতুন করে তাতে রক্ত মাংসের শরীর প্রতিস্থাপন করা সম্ভব না। ভ্যালেরিয়া চোখের জল মুছে মৃদু হাসির মুখোশ পড়ে। ইসাবেলার মুখটা আঁজলা ভরে তুলে বলে,

“জীবন গতিময়। নদীর তরঙ্গের মতো সামনে ধাবমান। পেছন ফিরে দেখার চেষ্টা করলেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। আমি পেছন ফিরে তাকাতে চাইনা। তুমিও তাই করবে। আর শোনো, তোমাকে যা বলেছি সব ভুলে যাও।”

“ভুলে যাব? এতটা সহজভাবে কীভাবে বলতে পারলে?”

“কারণ আমার জন্য সব সহজ। আমাকে যেতে বাধা দেবে না তুমি। এ নিয়েও কাওকে কিছু বলবে না। আমার বিশ্বাস ভাঙবে না তুমি ইসাবেল।”

ইসাবেলা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর বলল,

“বলব না। কিন্তু তোমাকেও একা ছাড়ব না। আমি যাব তোমার সাথে।”

“ইসাবেল!”

“তুমি আমাকে নেবে সাথে করে ভ্যালেরি। যদি না নাও তবে আমার মরা মুখ দেখবে।”

“তুমি অসুস্থ। কী বলছো বুঝতে পারছো না।”

“বেশ হয়েছে অসুস্থ আমি। বলো আমায় নেবে কি না?”

“না”

“তবে ঠিকই বলেছো তোমার হারানোর ভয় নেই। বেশ যাও। কালই চলে যাও। আর ফিরবে না। যদিওবা ফেরো আমাকে পাবে না।”

ইসাবেলা উঠে দাঁড়ায় পাশের দেয়াল ধরে। ওর চোখের নিচে বসে গেছে। চামড়া ফেটে গেছে ঠোঁট দু’টো শুকিয়ে। মাথার বাদামী চুলগুলো অবিন্যস্ত। বার বার চোখের পানি মুছছে। দু’ কদম এগোতেই পড়ে যাচ্ছিল। ভ্যালেরিয়া ছুটে গিয়ে ধরতে ইসাবেলা ডুকরে কেঁদে উঠল ওর বুকে।

“ও ভ্যালেরি, আমাকে একা ফেলে যেয়ো না এখানে। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে সাথে করে নিয়ে যাও। পিটার নেই, তুমিও চলে যাবে ওই বিপদের মুখে। আমি কীভাবে থাকব এখানে?”

ভ্যালেরিয়ার কোনো পথ রাখেনি ইসাবেলা। বাড়ির সকলের অনুরোধ উপেক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনন্যোপায় হয়ে শেষে সাথে করে নিয়ে আসতে হলো। আগের চিঠি ছিঁড়ে নতুন করে ফাদারকে লিখে পাঠিয়েছিল সব জানিয়ে। ফিরতি চিঠি এলো দেরিতে। তিনদিন পরেই। রেগে আছেন ফাদার। সে এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হবে ফাদার জানলে এখানে আসতে দিতেন না৷ ভ্যালেরিয়া জানে, ফাদার অন্য সবার থেকে তাকে স্নেহ করে বেশি। তাইতো রাগ স্বত্বে তিনি ইসাবেলাকে সঙ্গে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তবে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন ইসাবেলা তাঁদের সাথে থাকতে পারবে না। মাইল দশেক দূরের একটি গ্রামে ওর থাকার ব্যবস্থা করা হবে। ভ্যালেরিয়া মাঝেমধ্যে দেখে আসতে পারবে। ইসাবেলাকে অবশ্য এসব জানায়নি সে। পৌঁছে জানাবে। ফাদারকে সে বিশ্বাস করে। কিন্তু ভয়টাকে তাড়াবে কী করে? আচমকা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল ফিটনটা। অশ্বরব শোনা গেল তখনই। চমকে চোখ মেলে ভ্যালেরিয়া। আর্ত কণ্ঠে কোচওয়ানকে জিজ্ঞেস করে,

“কী হলো?”

“বরফে আঁটকে গেছে চাকা।”

“এখন উপায়?” ব্যাপারটা খুব বেশি ভয়ের নয়। কিন্তু ভ্যালেরিয়ার গলার স্বরটা খুব বেশি ভীত শোনাল। কোচওয়ান অভয় দেয়,

“ভয়ের কিছু নেই সিস্টার। এখনই বরফ সরিয়ে ফেলছি।” লজ্জিত বোধ করল ভ্যালেরিয়া। স্বাভাবিক গলায় বলল,

“ঠিক আছে।” শুকনো হাসল। কোচওয়ান নেমে পেছনে দাঁড়িয়েছে। ভ্যালেরিয়া গাড়ির জানালার বাইরে তাকায়। সন্ধ্যা নেমেছে প্রায়। গন্তব্য খুব বেশি দূরে নয়। এ অঞ্চল শীত প্রধান। প্রায় সারা বছর বরফাচ্ছন্ন থাকে। যতদূর চোখ যায় শ্বেত শুভ্র বরফ। আশপাশে দেখে বুঝল জনারণ্য থেকে দূরে আছে। গ্রীষ্মে এই জায়গাটা বিস্তৃণ সমতল ভূমিই মনে হবে। সবুজ ঘাসের আচ্ছাদিত থাকবে সবটা। ওই অদূরে পাতা ঝরা নগ্ন গাছগুলো মূর্তির মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। গায়ে লেগে আছে বরফ। কোচওয়ানকে জানালার বাইরে দেখতে পেল। বয়স চল্লিশ হবে হয়তো। মুখে দাঁড়ি নেই, পুরু মোছ। গায়ে ময়লাটে শীতবস্ত্র, মাথায় পশমি জার্মানি টুপি। সে জানাল গাড়ির চাকা বরফ থেকে তোলা হয়েছে। ভ্যালেরিয়া অনুমতি দিতে নিজের সিটে গিয়ে বসল কোচওয়ান। একটু পরে ঘোড়ার পিঠে চাবুকের হিস হিস ধ্বনি শোনা গেল। ঘোড়ার আর্ত অশ্বরবে ইসাবেলা ঘুমের ঘোরে খানিক কেঁপে ওঠে। ভ্যালেরিয়া বুকে জড়িয়ে গায়ে হাত বুলাতে আবার আগের মতো শান্ত হয়ে এলো ইসাবেলার শরীর।

ইসাবেলার ঘুম ভাঙল ভেজা হিম বাতাস গায়ে লাগতে। থরথর করে কাঁপছে সে। ফিটন দাঁড়িয়ে আছে মূল ফটকের বাইরের রাস্তায়। বরফ পড়ে সামনের রাস্তা চেনা মুশকিল। পা দেবে যাচ্ছে বরফে। গোড়ালির একটু উপর অব্দি বরফে ঢেকে যায়। ভ্যালেরিয়া ওর হাত ধরে নিয়ে চললো সামনে কাঠের বাড়ির মূল ফটক ধরে দরজার সামনে। এই বাড়িটির আশেপাশে দু’তিনটে বাড়ি। বেশ দূরে দূরে বসতি। চারপাশটা বরফে ঢাকা। এই মুহূর্তে তুষার বৃষ্টি পড়ছে। ভ্যালেরিয়া সামনের কাঠের দরজায় তিনবার টোকা দিতে এক প্রৌঢ়া দরজাটা হালকা ফাঁক করে উঁকি দিলেন। সারল্যের অভাব তাঁর মুখে। রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

“কাকে চায়?”

“মাদাম ডলি, আমি সিস্টার ভ্যালেরিয়া। ফাদার জালোনভ আমাকে পাঠিয়েছেন।”

প্রৌঢ়া তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বললেন,

“ওহ, মেয়েটি কোথায়?”

ভ্যালেরিয়া ইসাবেলাকে কাছে এনে বলল,

“এ হচ্ছে ইসাবেলা অ্যালেক্সিভ, আমার ভাগ্নি। ওর কথায় ফাদার বলেছিলেন।”

প্রৌঢ়া নাকের ডগার চশমাটা আরেকটু উপরে তুলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আপাদমস্তক দেখলেন ইসাবেলাকে। ইসাবেলা একটুখানি সহবতসুলভ হাসল। প্রৌঢ়া সেই হাসি রীতিমতো উপেক্ষা করে দরজা খুলে দিলেন সম্পূর্ণভাবে।

“এসো।” তাঁর গলার স্বরে অভ্যর্থনার বালাই নেই। মনে হচ্ছে ওরা দুজন অযাচিত। ভ্যালেরিয়ার কেমন যেন ঠেকছে। কোচওয়ান ব্যাগ রেখে বাইরে দাঁড়ায়। প্রৌঢ়া ওদের বসার ঘর দেখিয়ে বসতে বললেন। সামনের ফায়ারপ্লেসের আগুনের তাপে এ ঘর বেশ গরম। ইসাবেলার কাঁপুনি একটু কমলো। ঘরটি বেশ পরিপাটি করে সাজানো। এ ঘরে একটাই জানালা তাতে মোটা রঙিন পর্দা, মাথার উপর সেজবাতি জ্বলছে। সোফার ডানদিকের দেয়ালে দু’টো বড়ো ফ্রেমবন্দী ছবি। একজন বয়স্ক, আরেকজন মাঝবয়সী পুরুষ। নিচের ছোটো ফ্রেমে একটি হাস্যোজ্জ্বল যুবতী মেয়ের ছবি। প্রৌঢ়া সামান্য কেশে উঠতে ইসাবেলা সামনে তাকাল। প্রৌঢ়া ওরই দিকে চেয়ে আছেন। সারল্যে নেই ওতে। বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল ইসাবেলা। প্রৌঢ়া দৃষ্টি সরিয়ে তাকালেন ভ্যালেরিয়ার দিকে। গলা পরিষ্কার করে বললেন,

“আপনি কখন যাবেন?”

ভ্যালেরিয়া মুচকি হেসে বলল,

“একটু পরেই মাদাম।”

“ওহ! তুমি তবে এসো, তোমার থাকার রুমটা দেখিয়ে দিই।”

“আমার থাকার রুম? এখানে একা থাকব আমি? ভ্যালেরি!” ইসাবেলা আর্ত হয়ে ওঠে।

প্রৌঢ়া ভ্রু কুঁচকে তাকান চশমার ফাঁক দিয়ে। ভ্যালেরিয়া তাঁর দিকে চেয়ে বলল,

“আমি একা ওর সাথে একটু কথা বলতে চাই।”

বৃদ্ধা চলে যেতে ইসাবেলাকে সব খুলে বলল ভ্যালেরিয়া। সব শুনে ইসাবেলা কাঁদতে শুরু করে। সে একা এই অপরিচিত স্থানে কী করে থাকবে! বৃদ্ধার আচরণ তাকে আরো বেশি বিব্রত করছে। ভ্যালেরিয়া নিজের সমস্যা বুঝাতে লাগল। তার আর উপায় নেই। তবে সময় পেলেই সে ওকে দেখতে আসবে। ইসাবেলার ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়ে এসেছে। এবার তাকেও ভ্যালেরিয়ার কথা শুনতে হবে। বৃদ্ধা যখন, যেভাবে বলবে সেভাবেই চলতে হবে ইসাবেলাকে। ইসাবেলার মন মানতে চায় না, কিন্তু না মেনেও উপায় নেই। জোর করে এতদূর এসেছে। আর বেশি জোর ভ্যালেরিয়ার কষ্টের কারণ হবে জেনে চুপচাপ মেনে নিলো। ভ্যালেরিয়া হাঁফ ছাড়ে। ফাদার বলেছেন, মাদাম ডলি ইসাবেলার সেবা শুশ্রূষার দায়িত্ব নিয়েছেন। স্থানীয় বৈদ্য হিসেবে তাঁর বেশ সুনাম রয়েছে। ইসাবেলাকে তিনি ঠিক সুস্থ করে তুলবেন। তবে মনটা কেন যেন চাইছে না ইসাবেলাকে একা ছাড়তে। মনকে বশে আনলো ভ্যালেরিয়া, আনতেই হলো।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে