তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
1168

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১৪
Writer Taniya Sheikh

ইসাবেলার ধারণা ঠিক ছিল। ভৃত্যটি ওই পরিত্যক্ত ভূতূড়ে প্রাসাদে থাকে না। বাইরে দাঁড়ান টমটমটিও ছিল তার। নিকোলাসের কফিনে আগুন ধরিয়ে সে প্রাসাদের বাইরে এসে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে যায়। অপেক্ষা করছিল কোচওয়ানের জন্য। ভৃত্যটি একটু পরেই বেরিয়ে এলো। কোচওয়ানের সিটে বসতে ইসাবেলা সাবধানে উঠে পড়ে পেছনে। হামাগুড়ি দিয়ে সিটের নিচে লুকিয়ে যায়। কোচওয়ান ঘোড়ার গায়ের চাবুক মারতে হ্রেষাধ্বনিতে ঘোড়া টমটম নিয়ে ছুটতে শুরু করে। মাথার ওপর রৌদ্রজ্বল আকাশ। সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। আকাশটা আগে কখনও এত সুন্দর লাগেনি ওর কাছে। মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলো। মুক্তির আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় ওর চোখ দিয়ে। টমটমগাড়ি সমান্তরাল রাস্তা ছেড়ে ঢালু পথে নামল। গাড়ির ঝাঁকুনির চোটে ইসাবেলার পিঠ টমটমের সিটের নিচের কাঠে খুব জোরে ধাক্কা খায়। ব্যথায় অস্ফুটে গোঙানির দিয়ে ওঠে। পাছে কোচওয়ান ওর উপস্থিতি টের পায় এই ভয়ে হাতের তালুতে সজোরে মুখ চেপে রাখল। ইসাবেলা আশেপাশে দেখার চেষ্টা করছে। সিটের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে মাথা তোলে। ঢালু পথের দু’প্রান্তে গহীন অরণ্য। জানা- অজানা বৃক্ষ, গুল্মলতা চারিধারে । সূর্যের আলো লম্বা লম্বা গাছগুলোর পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। ইসাবেলা পেছন ফিরে তাকায়। প্রাসাদটা দেখা যাচ্ছে না। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে ও। পেছনের পথটা ভালো করে দেখল। বনের মধ্যে এই একটি পথই দেখা যাচ্ছে। কোচওয়ানের চাবুকের হিস হিস ধ্বনিতে কম্পিত হয়। ঘোড়া অশ্ব ধ্বনি তুলে প্রাণপণে ছুটছে সামনে। যতদূর চোখ যায় বন। লোকালয় তো দূরের ওরা দুজন ছাড়া পথে আর কোনো জনমানব চোখে পড়ল না। বেশ উপভোগ করছে মুক্ত বাতাস ইসাবেলা। ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি। পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য তর সইছে না ওর। গাড়ি যত এগোচ্ছে ততই আনন্দ হচ্ছে। সে মুক্ত আজ। নিকোলাসের বন্দিদশা থেকে সে মুক্ত। আবার আগের মতো স্বাভাবিক হবে জীবন। বাবা-মা, তাতিয়ানা, ভ্লাদিমি আর দাদা-দিদিমাকে কতদিন পরে দেখবে সে! খুশিতে আরেকদফা নীরবে কাঁদল। জঙ্গল থেকে টমটম এবার খোলা মাঠের কাঁচা রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছে। এদিকেও কোনো লোকালয়ের দেখা পেল না। আরো ঘণ্টা খানেকের যাত্রার পর অদূরে দু একটা ভগ্ন গির্জা চোখে পড়ে। কাঁচা রাস্তা শেষ হয়ে কংক্রিটের রাস্তায় উঠল টমটম। মাঝেমাঝে জব, গম আর ভুট্টার খেত চোখে পড়ে রাস্তার দু’ধারে। হঠাৎ টমটম থেমে যেতে হামাগুড়ি দিয়ে সিটের তলায় ঢুকল ফের ইসাবেলা। সিটের তলায় খুব বেশি জায়গায় নেই। ইসাবেলা এই ক’মাসে শুকিয়ে যাওয়ায় আজ সুবিধায় হলো। শরীরটা জড়সড় করে কোনোমতে সিটের তলে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সে জানে কোচওয়ান এখানে এলে সহজে ইসাবেলাকে দেখে ফেলবে। আত্মরক্ষার্থে একটা লম্বা ধারালো কাঁচের টুকরো কাপড়ে পেঁচিয়ে বুকের কাছে লুকিয়ে রেখেছে।

কোচওয়ান সিট থেকে নামেনি। সামনে এক পাল শুয়োর রাস্তা পার হচ্ছে। জংলী শুয়োরকে রাগানো যে বুদ্ধিমানের কাজ নয় ভৃত্যটির তা জানে। তাই তো ধৈর্য ধরে সিটে বসে আছে টমটম থামিয়ে। শুয়োরের পাল রাস্তা পার হতে ঘোড়ার পিঠে আবার চাবুক কষাল কোচওয়ান। ইসাবেলা ফের বেরিয়ে এসে বাইরে বসে। ওই তো দূরে আবছা কতগুলো প্রাসাদের মতো দেখা যাচ্ছে। শস্যের খেত ছেড়ে গাড়ি ঢুকল একটা ট্যানেলের ভেতরে। মুহূর্তে চোখের সামনে সবটা অন্ধকার হয়ে যায়। ইসাবেলার বুক ঢিপঢিপ করছে। কিছুদূর পরে ক্ষীণ আলোর রেখা দেখে স্বস্তি ফিরে পায়। যত এগোচ্ছে লোকের সোরগোল শুনতে পাচ্ছে। আনন্দে আত্মহারা হওয়ার অবস্থা ইসাবেলার। অবশেষে সে লোকালয়ে এসে পৌঁছেছে। কত মানুষ এখানে। এরা মানুষ! ওরই মতো মানুষ! এতক্ষণে নিজেকে নিরাপদ ভাবল সে। টমটম থেমে দাঁড়ায়। আশপাশে আরো কতগুলো টমটম, গরুর গাড়ি আর ঠেলা গাড়ি। কোচওয়ান নামতে ইসাবেলার গলা শুকিয়ে এলো। এই বুঝি এসে দাঁড়ায় সে সামনে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার সে এদিকে এলো না। গাড়ি থামিয়ে সামনের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ইসাবেলা ধীর পায়ে নিচে নেমে দাঁড়ায়। লোকাল বাজারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে। খুব বেশি মানুষের সমাগম ইসাবেলার কোনোদিন পছন্দ ছিল না। সে ঘরকুনো, লাজুক মেয়ে। কিন্তু আজ এই এত মানুষের ভিড় তাকে আনন্দ দিলো। বোকার মতো হাসছে আনন্দ। আশেপাশে পথচারীদের কয়েকজন কৌতূহলে চেয়ে আছে ওরই দিকে। ইসাবেলা হাসছে হাসতে মাথা নুয়ে তাদের বলছে,

“হ্যালো, হ্যালো।”

কাপড়, তৈজসপত্র, নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী, বিভিন্ন রকমের সবজি-ফল, মাছ, মাংস আর পশু পাখি ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। ক্রেতা-বিক্রেতা দর-কষাকষি করছে। ওদের ভাষা ইসাবেলা বুঝতে পারল না। হাবভাবে আন্দাজ করে নিচ্ছে। সামনে এগোতে নাকে এসে লাগে ভাজা মাংস আর ভোদকার ঘ্রাণ। পেট গুরগুর করে ওঠে খিদেতে। হাতে টাকা নেই। মুখটা মলিন করে এগিয়ে যায় সামনে। কতগুলো মেয়ে ভারি মেকাপ আর রঙচঙে ছোটো পোশাক পরে ঢলে ঢলে গল্প করছে পুরুষদের সাথে। পাশেই বড়সড় দ্বিতল কাঠের বাড়ি। দুটো মেয়ে গলা জড়িয়ে দুজন পুরুষকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। ইসাবেলা জানে ওরা কোথায় গেছে। ওই বাড়িটার সামনে দিয়ে যেতে ভেতরে নাচ- গানের জোরালো শব্দ শুনতে পায়। কয়েকটি মেয়ে হেসে ওর দিকে তাকাতে দ্রুত পা চালিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। পাশে শুয়োর, গরু, ভেড়া আর হাঁসের মৃতদেহ ঝুলানো একটি দোকানে। কসাই ইসাবেলার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে হাতের বড়ো মাংস কাটার ছুরি দিয়ে ভেড়ার মাথাটাকে দুভাগ করে ফেলে। ইসাবেলা ভয় পেতে পৈশাচিক হাসি ফুটে ওঠে কসাইয়ের পুরু মোছের নিচের ঠোঁট দুটোতে। ভয়ে তাড়াতাড়ি সে স্থান ত্যাগ করে ইসাবেলা। এদিক সেদিক উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে লাগল। কয়েকজন মহিলার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু ওরা ইসাবেলার ভাষা বুঝল না আর না ইসাবেলা ওদের ভাষা বুঝল। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের এক স্থানে মানুষের জটলা দেখে। কৌতূহলে সেদিকে যায়। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। দাস কেনা-বেচা হচ্ছে এখানে! ঠিক আদিম বর্বর যুগের মতো। নিজের বয়সের কতগুলো মেয়েকে দেখল সে। মেয়েগুলো ভয়ে কাঁপছে। পরনের সাদা জামা স্থানে স্থানে ছেঁড়া। পেছনে হাত বাঁধা। দাম হাঁকাচ্ছে টেঁকো, মোটা অসুরের মতো দেখতে একজন ত্রিশোর্ধ পুরুষ। একটা মেয়েকে কিনে নিলো বৃদ্ধ, কদাকার এক লোক। টাকা দেওয়ার সাথে সাথে যুবতি মেয়ের বুকের সামনের কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলল। তা দেখে সমস্বরে উল্লাস করে ওঠে উপস্থিত অনেক যুবক আর মধ্য বয়সী পুরুষ। মেয়েটা কাঁদছে ভয়। বৃদ্ধের দয়া তো হলোই না উলটো জনসমক্ষে যুবতি মেয়েটার ওপর যৌন নিপীড়ন চালাতে লাগল। বুভুক্ষু কুকুরের মতো মেয়েটাকে কামড়ে, খামচে ধরেছে সে। মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ওই জঘন্য দৃশ্য। কেউ প্রতিবাদ করছে না, সাহায্যও করছে না। ইসাবেলা এ দৃশ্য সহ্য করতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলো। মেয়েটার মুখটা বার বার চোখের সামনে ভাসছে ওর। দাস প্রথার গল্প ও কেবল দিদিমার কাছে শুনেছে। কিন্তু এই প্রথার এমন নিষ্ঠুর ভয়াবহতা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত সে। নিকোলাসকেই শয়তান ভেবেছিল অথচ, ওর চেয়েও বড়ো শয়তান মানুষের রূপ ধরে আশেপাশেই রয়েছে। ওর মন চাচ্ছে বুড়ো শয়তানটাকে পায়ে পিষে মারতে। ইসাবেলা জানে নিজের অসহায়ত্ব। মুখ খুললেই বিপদে পড়বে সে। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে নারীর গুরুত্ব কেবল বিছানায় আর ওই দাসীবৃত্তিতে। আওয়াজ তুলতে গেলেই নারীকে সহ্য করতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগের। যদিও ইসাবেলার পরিবার এক্ষেত্রে অনেকটাই ভিন্ন। ওর বাবা ওলেগ মেয়েদের ওপর কখনও জোর করে কিছু চাপিয়ে দেননি। জোর যদি একটু আকটু খাটিয়েছেন তবে তিনি ওর মা আন্না মেরিও। কিন্তু সেই জোরে ভালোবাসা ছিল।

“হেই”

ইসাবেলার ভাবনায় ছেদ পড়ে একজন ভদ্রমহিলার মহিলার গলার স্বরে। পরনে জার্মানির ট্রেডিশনাল dirndl। সাদা কুঁচি গলার ব্লাউজ, লং খয়েরি স্কার্ট আর সবুজ এপ্রোন। চুলগুলো ডানপাশে খোঁপা। তাতে আবার তিনটে বড়ো বড়ো তাজা গোলাপ লাগানো। মুখে গাঢ় মেকাপের প্রলেপ, ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। হাতের জরিদার লাল কাপড়ে কারুকাজ করা পাখাটা নাড়াতে নাড়াতে হাসি মুখে সামনে এসে দাঁড়ালেন। দেখে মনে হলো কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের রমণী।অজানা ভাষায় ইসাবেলাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ইসাবেলা এদের ভাষা বোঝে না। সে বোকার মতো তাকিয়ে রইল ভদ্রমহিলার মুখের দিকে। ভদ্রমহিলা জবাব না পেয়ে ওর আপাদমস্তক ভালো করে দেখে সংশয় মুখে ইশারায় বুঝাতে চেষ্টা করলেন,

“তুমি স্থানীয় নও?”

ইসাবেলা বুঝতে পেরে মাথা ঝাঁকায়। ভদ্রমহিলা হাসলেন আবার। ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন,

“কোথাকার?”

“রিগা।”

“রিগা?”

“রাশিয়া।”

ভদ্রমহিলার অবাক হলেন।

“রাশিয়া!”

ইসাবেলা সামনে পেছনে মাথা নাড়ায়। ভদ্রমহিলা একটু ভাবুক হয়ে আন্তরিক গলায় ভাঙা ভাঙা রাশান শব্দে বললেন,

“সে তো অনেক দূরে।”

ভদ্রমহিলার কণ্ঠে নিজের মাতৃভাষা শুনতে পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ইসাবেলা প্রশ্ন করল,

“আপনি রাশান জানেন?”

ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়

“একটু একটু। তা এতদূরে এলে কী করে? সঙ্গে তো কাওকে দেখছি না। ও ঈশ্বর, বলো না একা এসেছ?”

ইসাবেলা কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। অপরিচিত কাওকে সব ঘটনা খুলে বলতেও দ্বিধান্বিত সে। কিন্তু রিগা পৌঁছাতে হলে কারো না কারো সাহায্য তো তাকে নিতে হবে। এখানকার লোকগুলো কেমন অদ্ভুত করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর মুখের ভাষাও তো এরা বুঝবে না। ভাগ্যিস ঈশ্বরের করুণায় ভদ্রমহিলার দেখা পেল। কিন্তু তাঁকেও তো হুট করে বিশ্বাস করা যায় না। কী করবে এখন ইসাবেলা? সব খুলে বলবে? না কি মিথ্যা বলবে?

“এই মেয়ে, কোথায় হারিয়ে গেলে?” ভদ্রমহিলা ওর মুখের সামনে হাত নাড়ালেন।

“জি, মানে।”

ভদ্রমহিলা ওর হাত ধরে বললেন,

“তোমার চেহারা বলে দিচ্ছে খারাপ কিছু ঘটেছে তোমার সাথে। আমার ঘরে চলো। সেখানে গিয়েই সব শুনব। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা নিরাপদ নয়।”

“আপনার ঘর? এখানে?”

ভদ্রমহিলা হাসলেন। আঙুল তুলে সামনের সেই পতিতালয়ের দিকে লক্ষ্য করে বললেন,

“ওই তো আমার ঘর। চলো।”

ইসাবেলা নড়ে না। ও জানে ওখানে কী হয়। তাতিয়ানা বলেছে ওকে। ভদ্রমহিলা ওর মুখ দেখে বুঝলেন ব্যাপারটা। ইসাবেলার গালের এক পাশে হাত রেখে বললেন,

“ভয় নেই। ওখানে তুমি আমার মেহমান হয়ে যাবে। কেউ কিচ্ছুটি করবে না। এসো।”

ইসাবেলা তবুও নড়ে না। ভদ্রমহিলা হাঁফ ছেড়ে বলেন,

“আমাকে বিশ্বাস করা ছাড়া তোমার উপায় নেই মেয়ে। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে ওরা তোমাকে তুলে দাসী হিসেবে নিলামে তুলবে।” চোখের ইশারায় পেছনের দুজন লম্বা, পেটমোটা পুরুষকে দেখালেন। ইসাবেলার দিকে লালসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরা। ইসাবেলার আর্ত মুখ দেখে ভদ্রমহিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন,

“আমার ঘরে জোর নেই। কিন্তু ওরা তোমাকে জোরপূর্বক যা করাবে তা আর নাই বললাম। দেখেছ তো ওই মেয়েটির সাথে কী করেছে, হুম?”

মহিলার আসল রূপ এতক্ষণে প্রকাশ পেল ইসাবেলার সামনে। সে জানে না গাড়ি থেকে নামার পর পরই এই মহিলার নজরদারিতে পড়েছিল। বেশ চতুর তিনি। কী করে মানুষকে বশে আনতে হয় খুব জানা তাঁর। ইসাবেলার দু’দিকেই বিপদ। কীভাবে বাঁচবে এই বিপদ থেকে। সে জানে চিৎকার করে কোনো লাভ হবে না। কেউ আসবে না সাহায্য করতে। ভদ্রমহিলা শক্ত করে চেপে ধরলেন ওর পেলব ডান হাতটা। টানতে টানতে গণিকালয়ের দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। ইসাবেলা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পেরে উঠছে না।

“ছাড়ুন আমাকে, প্লিজ ছাড়ুন।”

“চুপ করো মেয়ে। একদম চুপ। চিৎকার করলে তোমারই বিপদ।”

ইসাবেলাকে নিয়ে দাঁড়ালেন জলসা ঘরের পাশে। গণিকালয়ের জলসায় তখন চলছে উদ্দাম বেলেল্লাপনা। অর্ধ নগ্ন নর-নারীর অশ্লীল হাসি ঠাট্টা আর শীৎকারে ইসাবেলার কান লাল হয়ে ওঠে। চোখ নামিয়ে ফেলে লজ্জায়। মহিলা অট্টহাসি দিয়ে বলে,

“তুমি তো দেখছি ভারী লাজুক। এত লজ্জা পেলে হবে? ওদিকে দেখো চোখ তুলে, দেখো।”

ইসাবেলার চিবুক শক্ত হাতে তুলে ধরে জোর করে সামনে তাকাতে বাধ্য করেন। ইসাবেলা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে,

“আপনি বলেছেন জোর করবেন না? কেন এমন করছেন আমার সাথে? আমাকে যেতে দিন। প্লিজ!”

“জোর তো করছি না। জোর করা কাকে বলে তুমি ওই দাস বেচার নিলামে দেখেছ তো। আমি তো কেবল তোমাকে বাস্তবতা দেখাচ্ছি।”

ইসাবেলা হাত ছাড়িয়ে কাতর গলায় বলে,

“আমি এসব নোংরা স্থানে থাকতে পারব না। এখনই এখান থেকে চলে যাব।”

“চলে যাবে? কোথায় যাবে? রাশিয়ায়? জানো বর্তমানে কোথায় আছো তুমি? জার্মানির একটা ছোট্ট শহরের বাজারে। যেখানে দিনের আলোতে চলে দাস কেনা-বেচা। তোমাকে ওরা দেখে ফেলেছে মেয়ে। এই দরজা পার হতেই থাবা মেরে ধরবে। কেউ আসবে না বাঁচাতে। তারপর কী করবে জানো? ওই ষাঁড়ের মতো তাগড়া পুরুষ দুটো ছিঁড়ে খাবে তোমাকে। ওদের চাহিদা মিটে গেলে পশুর মতো টানতে টানতে নিলামে তুলবে। তারপর তো কী হয় দেখেছ।”

“আমাকে যে ভয় দেখাচ্ছেন সেই একই কাজ তো আপনি নিজেও আমার সাথে করবেন। ওদের আর আপনার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?”

“পার্থক্য? পার্থক্য তো আছে মেয়ে। ওদিকে তাকাও।” সামনে মিলনরত এক যুগলকে দেখিয়ে বলেন,

“মেয়েটার মধ্যে কি ভয়, ডর দেখতে পাচ্ছ? হাসছে ও। আনন্দে হাসছে। আমার ঘরে সকলে আমোদে মেতে থাকে। আমি কাওকে কিছুতেই জোর করি না। দেখো কাওকে কি জোর করছি? সবাই নিজের মতো আমোদে-প্রমোদে মেতে আছে। পৃথিবীর খেয়াল নেই কারো। এই ঘরে দুঃখ নেই, কষ্ট নেই। কেবল আনন্দ আর আনন্দ। তোমার সকল দুঃখ ভুলে যাবে এখানে থাকলে। থাকবে না মেয়ে?”

“না, আপনার এই আনন্দ নোংরা, কদর্য। ঘৃণা হচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। যেতে দিন আমাকে।”

“বড্ড জেদি তুমি মেয়ে। আচ্ছা যাও। ও হ্যাঁ, এখান থেকে বেরোনোর পথ জানা আছে তো?”

“জেনে নেবো।”

ইসাবেলা মুখ কঠিন করে ঘুরে দাঁড়ায়। দরজার বাইরে পা দিতে সেই দুজন পুরুষ দেখে থেমে গেল। ওকে বেরোতে দেখে এদিকেই আসছে। বুকে লুকানো কাঁচের টুকরোর কথা স্মরণ হয় ওর। কিন্তু এই সামান্য কাঁচের টুকরোতে কী আত্মরক্ষা হবে? মহিলা ফিসফিস করে বলল,

“যাও।”

ইসাবেলা ভেতরে ফিরে আসে আবার।

“প্লিজ আমাকে এখান থেকে যেতে সাহায্য করুন।আমি কথা দিচ্ছি রাশিয়া পৌঁছে বাবাকে বলে আপনাকে অনেক টাকা পাঠাব। সাহায্য করুন আমাকে। আপনার পায়ে পড়ছি।”

মহিলার পায়ের পড়ে ইসাবেলা।

“আরে আরে করছ কী? মেয়েদের অসহায়ত্ব আমি মোটে সহ্য করতে পারি না। ওঠো, ওঠো।”

“আমি আপনার মেয়ের বয়সী। আপনার মেয়ে হলে কি এমন করতে পারতেন বলুন?”

“না।” গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন মহিলা। ইসাবেলা আশার আলো দেখল যেন। মহিলার হাত চেপে ধরে বলল,

“আমাকে সাহায্য করুন মা। আমি আপনাকে মা ডেকেছি। মেয়ে ভেবে আমাকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করুন মা।”

মহিলা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গম্ভীরমুখে বললেন,

“প্রথমত, আমি মা ক্যাটাগরির না। দ্বিতীয়ত, তোমাকে সাহায্য আমি এক ভাবেই করতে পারব। যা আগেই বলেছি।”

ইসাবেলা ক্ষোভে ফেটে পড়ে,

“আপনি নারী নামের কলঙ্ক। ছল করে, অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে গণিকাবৃত্তি করানোকে সাহায্য বলে না। স্বার্থসিদ্ধ হাসিল বলে। কী পাবেন এসব করে? টাকা? টাকার জন্য সব করতে পারেন? সব? কারো চোখের জলে কিছুই এসে যায় না আপনার?”

“তোমার এসব বাজে প্যাঁচাল শোনার সময় আমার নেই। থাকলে থাকো নয়তো দরজা খোলা আছে চলে যাও। জোর করে টেনে এনেছি বলে জোর করে বের করে দেবো না। থাকা না থাকা তোমার ইচ্ছে।”

মহিলা পাখায় বাতাস করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। ইসাবেলা দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। দরজার বাইরে লোলুপ চোখে পুরুষ দুটো এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ইসাবেলা অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে উপায়ন্তর না পেয়ে মহিলার কাছে গিয়ে আরেকবার অনুনয় করার সিদ্ধান্ত নিলো। তিনি বলেছেন জোর করবেন না। কিন্তু এখানে থাকা মানেই গণিকা হয়ে যাওয়া। এই অসম্মানজনক জীবনের চাইতে নিকোলাসের মৃত্যু পুরীই ভালো ছিল। পৃথিবীটা এত জটিল কেন? কেন বার বার বিপদ ওর সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। মায়ের সেই নিরাপদ আঁচল আজ বড়ো মনে পড়ছে ইসাবেলার। কবে ফিরতে পারবে মায়ের আঁচলের ছায়াতলে? আর যে পারছে না সে।
হঠাৎ সামনে থেকে পালোয়ান গোছের একজন যুবক এসে ইসাবেলার হাত ধরে করপুটে চুম্বন দেয়। ভয়ে ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিলো ইসাবেলা। তারপর একছুটে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলো। মহিলা দোতলার মাঝের ঘরের বড়ো সোফাতে বসে সিগারেট ফুঁকছেন। ইসাবেলাকে দেখে চমৎকার হাসি দিলেন। আশেপাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে নর-নারীর শীৎকার। কানে হাত দিয়ে মহিলার সামনে এসে দাঁড়ায় ইসাবেলা। হাঁটু ভেঙে বসে বলে,

“আমি এসব পারব না বিশ্বাস করুন। একটু করুনা করুন আমার ওপর।”

“আবার সেই ন্যাকামি? উফ! বড্ড জ্বালাচ্ছ মেয়ে তুমি। আরে একদিনে কেউ কিছু পারে? এখানে থাকতে থাকতে সব শিখে যাবে। ওঠো, কতবার বলব মেয়েদের অসহায়ত্ব আমি চোখে__” মহিলা হঠাৎ থেমে গেলেন। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,

“নিকো, বাবু আমার, অনেকদিন পরে এলে আমার ঘরে।”

“কর্নেলা।”
পরিচিত গলার স্বর শুনতে পেয়ে ইসাবেলা চকিতে তাকাল পেছনে। জানটা লাফ দিয়ে যেন গলায় উঠে এসেছে সামনের পুরুষটাকে দেখে। হুডিওয়ালা লম্বা কালো কোট পরে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস। চোয়াল কঠিন, দৃষ্টি পাথরের মতো স্থির। শুকনো ঢোক গিললো ইসাবেলা। ভাবছে, কী করে বেঁচে গেল নিকোলাস? এবার বুঝি রক্ষা নেই ইসাবেলার। আতঙ্কিত গলায় অস্ফুটে বলল,

“নিকোলাস!”

কর্নেলা শুনতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন ইসাবেলার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন,

“নিকোকে চেনো তুমি?”

ইসাবেলা জবাব দেওয়ার আগেই নিকোলাস প্রশ্ন করে,

“কে এই মেয়ে? নতুন আমদানি? দেখতে কিন্তু বেশ , কর্নেলা।”

কর্নেলা নাম্নী মহিলা হাসলেন। ইসাবেলা চোখ মুছে কপাল কুঁচকে তাকায়। কেন যেন নিকোলাসের এই না চেনার ভানে মন খারাপ হয়ে গেল। মনের অজান্তে হয়তো ভিন্ন কিছু আশা করেছিল। দাঁত কটমট করে ঠোঁট নাড়িয়ে অনুক্ত স্বরে বলে,

“হারামজাদা, আমার রক্ত খেয়ে এখন আমাকেই চেনে না।”

ওর ঠোঁটের ভাষা বোধহয় নিকোলাস পড়তে পেরেছে। বা’ ভ্রু তুলতে ইসাবেলা মাথা নুয়ে ফেলে।
মহিলা ঢলতে ঢলতে নিকোলাসের গালে চুমু দিয়ে বললেন,

“তা বলো তোমার খাতির যত্ন আজ কীভাবে করব?”

“এখানকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে পাঠাও আমার ঘরে।”

কর্নেলা ইসাবেলার দিকে তাকাতেই নিকোলাস বলে ওঠে,

“ও নয়। ওকে আমার পছন্দ না। অন্য কাওকে পাঠাও কর্নেলা।”

“এখনই পাঠাচ্ছি। ওই রুমে গিয়ে অপেক্ষা করো বাবু।”

নিকোলাসের গালে চুমু খেয়ে কর্নেলা বা’দিকের রুমটা দেখিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। ইসাবেলা মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও টের পাচ্ছে নিকোলাস ওরই দিকে এগিয়ে আসছে। বুক দুরুদুরু করছে ইসাবেলার। চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। নিকোলাস ঝুঁকে ওর কানের কাছে বলল,

“স্বাধীনতা মোবারক বেলা।”

ইসাবেলা চোখ তুলে তাকাতেই মুচকি হেসে কর্নেলার দেখানো ঘরের দিকে চলে যায় নিকোলাস।

চলবে,,,,

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১৫
Writer Taniya Sheikh

রাত বাড়তে গণিকালয়ের জলসা আরো জমজমাট হয়ে উঠল। সর্বত্র বারবনিতাদের খিলখিল হাসি আর মদের ঝাঁঝাল গন্ধ। নিচে মশালের আলোতে জলসা বসেছে। সেখানে মদ, নগ্নতা আর অশ্লীল নাচ-গানে মেতেছে বারবনিতা আর পুরুষের দল। দোতলার রুমগুলো থেকে এক জোড়া বের হচ্ছে তো আরেক জোড়া প্রবেশ করে। নিকোলাস সন্ধ্যার আগেই নিজের প্রয়োজন শেষ করে বিদায় নিয়েছে। যাওয়ার আগে ফিরেও দেখেনি ইসাবেলার দিকে। যেন একেবারে অচেনা। ইসাবেলা অবাকই হলো নিকোলাসের না চেনার ভান এবং এই নীরব প্রস্থানে। কী আশা করেছিল? ও উদ্ধার করতে এসেছে? সে কি ভুলে গেছে নিকোলাস ওদের মতো সাধারণ মানুষ নয়। নিষ্ঠুর, নির্মম একটা রক্তপিপাসু। ইসাবেলার রক্ত ছাড়া আর কিছুই তার দরকার ছিল না। আজ সেই দরকার বোধহয় ঘুচেছে। তাইতো না চেনার ভান করল। ভালোই হয়েছে তাতে। একটা বিপদ তো গেছে মাথার ওপর থেকে। কিন্তু মন এখনও খচখচ করছে। ইসাবেলা ওকে পুড়ানোর চেষ্টা করল আর ও কিছুই বলল না? এত সহজে ছেড়ে দিলো?

“না ছাড়লে মনে হয় খুশি হতি?” মনের ভেতর থেকে কেউ একজন বিদ্রুপ করে। ইসাবেলা কপট রাগে বলে,

“ওর জন্যই ভালো হয়েছে চুপচাপ ছেড়ে দিয়েছে আমাকে। আবার জোর করুক না, কাঁচের টুকরো এবার ওর বুকে বিঁধিয়ে দেবো। খেয়াল রাখব এবার যেন আর না বাঁচতে পারে। আমাকে চেনে না, হুঁ।”

এই সাহসই ইসাবেলার শক্তি জোগায় পুনরায়। হার না মানার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। আঘাত করবে না মা আর ভ্যালেরিয়ার বিশ্বাসে। পাপের এই ক্লেদাক্ত খোঁয়াড়ে কিছুতেই সতিত্ব বিসর্জন দেবে না। এখান থেকে যে করেই হোক বেরিয়ে যাবে। কর্নেলার ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে দেখছিল সবকিছু। এই ঘরের একটা জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তা দেখা যাচ্ছে। রাস্তার অদূরে মশাল জ্বলছে। সরাইখানা আর এই গণিকালয় ছাড়া সব দোকানপাটই বন্ধ। দিনের বেলার মতো রাস্তায় এখন আর সেই জনসমুদ্র নেই। হঠাৎ হঠাৎ দু’একটা টমটম উলটো দিকে ছুটে গেল। চট করে একটা বুদ্ধি আঁটে ইসাবেলা। রাত আরেকটু গাঢ় হতে গণিকালয় থেকে বেরিয়ে যাবে। ওই ষণ্ডামর্কা দাস বিক্রেতা লোকদুটোও হাল ছেড়ে ফিরে যাবে ততক্ষণে। ইসাবেলা একটু যেন আশার আলো দেখল। শান্ত হয়ে বসল কর্নেলার বিছানার এককোণে। সে বেরোবে এখান থেকে। হার মানবে না। সকল বাধা ঠেলে বাড়ি পৌঁছাবেই। সংকল্প আর সাহসে শরীরে যেন বল ফিরে পায়। সামনে খাবার রেখে গেছেন কর্নেলা। ইসাবেলা সারাদিনে কিছু খায়নি। বাড়ি ফিরতে হলে দেহটাকে সচল রাখতে হবে। কোনো ভাবেই দূর্বল হওয়া যাবে না। প্লেটের সবটুকু খাবার গ্রোগাসে খেয়ে নিলো। একগ্লাস ভদকাও পান করল। সারাদিনের ক্লান্তির পর একটু বিশ্রামের জন্য শরীরটা কাতর হয়ে আসে। মনস্থির করেছে রাত গভীর হলে বের হবে এখান থেকে। তার আগে একটুখানি ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না। সেই ভাবনাতেই ইসাবেলা শুয়ে পড়ল বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে ঢলে পড়ে। ঘুম ভাঙল মেয়েলী শীৎকারের আওয়াজে। পূর্ণ যৌবন ইসাবেলার। যৌনতা সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয় সে। দৈহিক অনেক ব্যাপার সে জানে না। এই গণিকালয়ের ওই শীৎকার শ্রবণে দেহে নতুন এক অনুভূতি অনুভব করে। ভাঁটার পরে যেমন নদীতে জোয়ার উছলে পড়ে, ওর দেহেও তেমনই অনুভূতি জাগে। গলা শুকিয়ে আসে। দু’পা জড়ো করে, দুহাতে বিছানার চাদর খামচে ধরেছে। শ্বাস ভারী হয়। নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু যেন রুখতে চাইছে। পাশের ঘর থেকে আরো জোরে জোরে আসছে নর-নারীর শীৎকারের শব্দ। ইসাবেলার ডান হাতটা আস্তে আস্তে বুকের ওপর নেমে এলো। ডান বর্তুলকার বক্ষজের ওপর মৃদু চাপ দিতে বিস্ময়ে চোখের পাতা খুলে ফেলল। হুঁশ ফেরে ওর। তড়াক করে উঠে বসে বিছানার ওপর। কী করতে যাচ্ছিল? লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠল। আশেপাশে তাকাল। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি এই লজ্জাজনক মুহূর্ত। দু’হাতে কান চেপে ধরে স্তননের শব্দ থেকে নিষ্কৃতি পেতে। দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে বসে বসে। এক মুহূর্ত আর এখানে থাকবে না। বেরিয়ে এলো রুমের বাইরে। রাত কত হয়েছে কে জানে? আশপাশের স্তিমিত প্রায় শোরগোলে আন্দাজ করে নিলো বেশ রাত হয়েছে। দোতলাতে দু’একটা ঘর ছাড়া আর সব নীরব। বাইরেও কেউ নেই। ইসাবেলা সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। জলসা ঘরে মাতাল, অর্ধ মাতাল হয়ে পড়ে আছে সব। ইসাবেলাকে ওরা খেয়াল করল না। কর্নেলাও কোথাও নেই। এই সুযোগে সদর দরজা থেকে বেরিয়ে এলো। দরজার সামনে দুটো মাতাল পা ছড়িয়ে নেশার ঘোরে কী সব বিড়বিড় করছে। ওই দাস বিক্রেতা দুটোকেও দেখতে পেল না। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল ওর। মাতাল দুটো টের পাওয়ার আগেই সামনের অন্ধকারে বেরিয়ে এলো। কোথায় যাচ্ছে জানা নেই। কিন্তু পা থামাচ্ছে না। এই আঁধার আর উদ্দেশ্যহীন শূন্য পথে একমাত্র ঈশ্বর ওর ভরসা। সে সতর্কে এগিয়ে যাচ্ছে। শুনশান রাতের এই পথের পদে পদে ভয় আর আতঙ্ক। ইসাবেলা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি এমন দিন তাকে দেখতে হবে, এত ভয় আর আতঙ্ক আসবে জীবনে। দেশ, পরিবার পরিজন বিচ্ছিন্ন হতে হবে। কিন্তু এটাই বোধহয় জীবন, অপ্রত্যাশিত, অনিশ্চিত আর নিঃসঙ্গতা। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের মূল ফটকের দ্বারে এসে থামল। ওই তো লোকালয়। নিঝুম, অন্ধকারের চাদরে মুড়ে আছে টালির ছাদ দেওয়া, কাঠের বাড়িগুলো। হঠাৎ হঠাৎ অদূরে ডেকে উঠছে শেয়াল। ইসাবেলা সামনে আবার চলতে শুরু করে। শূন্য গৃহস্থের আঙিনা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। কয়েকটা বাড়ি পেরোতেই একটা ঘোড়াশাল দেখতে পেল। ইসাবেলার চোখ আনন্দে চকচক করে ওঠে। ওদের বাড়িতে ঘোড়া আছে। পিটার আর ভ্লাদিমির সাহায্যে ঘোড়ায় সওয়ারী হয়েছে অনেকবার। ঘোড়াশালে দুটো ঘোড়া জাবর কাটছিল। একটা কালো অন্যটা বাদামী রঙের। ইসাবেলা বাদামী রঙের ঘোড়াটাকে বশে আনতে সক্ষম হলো। ওটার গলার রশি খুলবে ঠিক সেই সময় কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে থমকে যায়। ঘোড়ার রশি ছেড়ে কাঁচের টুকরোটা বের করে আনল বুকের কাপড়ের ভেতর থেকে। কাপড়ে মোড়া টুকরোটা উন্মুক্ত করে ভয়ে ভয়ে পেছনে ফিরল। কেউ নেই! তবে কি মনের ভুল ছিল? হয়তো তাই হবে। ইসাবেলা শব্দ করে দম ফেলে ফের ঘোড়ার রশি খুলতে আরম্ভ করে। এবার ঘোড়া সামান্য লাফিয়ে উঠল। ঘোড়ার দৃষ্টি ইসাবেলার পেছনে। সস্তা মদের উৎকট গন্ধ নাকে এসে লাগতে গা শিউরে ওঠে ওর। পেছন থেকে ভারী পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। ইসাবেলা দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। ভয়, আতঙ্কে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। হলদেটে, নোংরা দাঁত বের করে হাসছে ষণ্ডামর্কা সেই দাস বিক্রেতা দুটো। ইসাবেলা হাতের কাঁচের টুকরো তুলে ধরে বলল,

“কাছে এগোবি না। এলে পেট ফুটো করে দেবো।”

একটু থামল ওরা। পরস্পরের দিকে চেয়ে শব্দ করে হেসে পা ফেলে ছুটে এলো ইসাবেলার দিকে। দিশাহারা হয়ে উল্টোদিকে দৌড় দেয় ইসাবেলা। বিধিবাম! সামনে কাঠ দিয়ে ঘেরা। লোক দুজন হাসতে হাসতে কিছু বলছে। ইসাবেলা বুঝল না ঠিক। ইসাবেলার সর্ব শরীর থরথর করে কাঁপছে। এখনই হয়তো অচেতন হয়ে পড়বে আতঙ্কে। হলোও তাই। বাঁচার সকল পথ বন্ধ জেনে লোকদুটোর এগিয়ে আসা দেখে সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে নিচে।

প্রখর সূর্য রশ্মি চোখে পড়তে চেতনা ফিরল ইসাবেলার। কানে এলো মানুষের কোলাহল আর কর্কশ গলার চিৎকার। পিটপিট করে চোখের পাতা খুলতে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। গতকাল যেখানে ওই মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল। আজ নিজে দাঁড়িয়ে সেখানে। সর্ব শরীর ব্যথায় টনটন করছে। নড়তে গিয়ে বুঝতে পারল একটা খাম্বার সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে। আশপাশের সেই জনারণ্য। তারই মধ্যে কর্নেলাকে দেখতে পেল। হতাশ, উদ্বিগ্ন। তিনি বোধহয় সত্যিই ইসাবেলার ভালো চেয়েছিলেন। ইসাবেলা কাঁদত লাগল তাকে দেখে। কিন্তু তাঁর চোখের ভাষা বলছে,

“কত সতর্ক করলাম তোমাকে, শুনলে না। এবার বোঝো।”

কর্নেলার কালকের কথা হঠাৎ স্মরণ হয়। শয়তান দুটো ওকে ধর্ষণ করে নি তো? শব্দ করে কাঁদতে লাগল এবার ও। পরনের কাপড় ছেঁড়া, কর্দমাক্ত। শরীরের হাড়ে হাড়ে ব্যথা। গতকালের সেই অসুরের মতো লোকটা এগিয়ে এলো। তার পেছনে শয়তান দুটো। চোখ দুটো চকচক করছে লালসায়। ইসাবেলা চিৎকার করে অভিশাপ, গালাগাল দিতে চাইল। গলা দিয়ে গোঙানির আওয়াজ ছাড়া কিছু বেরোলো না৷ প্রচণ্ড ব্যথা গলায়। অসুরের মতো লোকটা ওর চিবুক রুক্ষ ভাবে তুলে চোখ বুলিয়ে নিলো ইসাবেলার আপাদমস্তক।

“ওর সাথে শুয়েছিস তোরা হারামজাদা? নিষেধ করেছিলাম না তোদের?”

লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনের অনুচরদ্বয়কে ঘুষি দিতে ওরা ভীত কণ্ঠে বলল,

“না, মালিক। মায়ের কসম করে বলছি ওর সাথে কিছু করিনি। টেনে হিঁচড়ে আনতে গিয়ে কাপড় ছিঁড়েছে।”

“সত্যি তো?”

“বউ বাচ্চার কসম করে বলছি। আপনার নিষেধ অমান্য করিনি।”

যথার্থই ওরা অচেতন অবস্থা ধর্ষণ করেনি ইসাবেলাকে৷ মালিককে বাঘের মতো পায়। সেই ভয়েই ইচ্ছে সত্বেও মেয়েটাকে ভোগ করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে।

“এই জন্য আজ মোটা টাকা পাবি। যা এখান থেকে।”
পুরু মোছে তা দিয়ে অনুচর দুটোকে বিদায় করে দাস বিক্রেতা ইসাবেলার পাশে এসে দাঁড়ায়। সামনে দাঁড়ান কর্নেলার হতাশ মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। উপস্থিত জনগণকে উদ্দেশ্য করে ইসাবেলাকে দেখিয়ে যা বলল তা স্থানীয় ভাষায় দাঁড়ায়,

“সতি, যুবতী। সুদূর রাশিয়ান সুন্দরী এই মেয়ে। ঘরের সকল কাজে সিদ্ধহস্ত। এই যুবতি যার হবে সে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি। তো জনাব, বলুন, কে চান এই সুন্দরী যুবতীকে।”

অনেকে হাত তুলল। কিন্তু দামে সন্তুষ্ট হয় না দাস বিক্রেতা। সে চাহিদা দেখে দাম আরো হাঁকায়। অবশেষে ভিড়ের মধ্যে একজন বলে ওঠে,
“দুশো মার্ক”

ভুড়িওয়ালা বিশালদেহী ষাটোর্ধ এক লোক হাত তুলে সামনে এগিয়ে এলো। মুদ্রা ভর্তি থলি হাতে পেয়ে দাস বিক্রেতার চোখ ছানাবড়া। সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে অবশেষে নিলাম বন্ধ করে দিলো। ভুড়িওয়ালা লোকটা লোলুপ চোখে চেয়ে আছে ইসাবেলার দিকে। দাস বিক্রেতা ওর হাতের বাঁধন খুলতে সে ক্রন্দনরত গলায় বহু কষ্টে অনুনয় করে,

“প্লিজ, প্লিজ।”

দাস বিক্রেতার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। ইসাবেলাকে সে টেনে হিঁচড়ে ক্রেতার দিকে এগিয়ে যায়। ইসাবেলা আর্ত চোখে সাহায্যের জন্য এদিক ওদিক তাকায়। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। হঠাৎ রাস্তার এককোনে দাঁড়ান সেই টমটমে নিকোলাসকে বসে থাকতে দেখল। ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না। মাথায় হুডি তুলে আয়েশ করে টমটমে মাথা এলিয়ে বসে আছে। টমটমের সামনে বসা সেই ভৃত্যটি। ইসাবেলা সর্ব শক্তি ব্যয়ে চিৎকার করে তার কাছে সাহায্য চায়,

“সাহায্য করুন আমাকে। ঈশ্বরের দোহাই লাগে সাহায্য করুন।”

লোকটা শুনেও সে কথা শোনে না। একচুল নড়ল না। ভাবলেশহীন মুখে চেয়ে রইল ইসাবেলার দিকে। নিকোলাসও ফিরে তাকাল না ওর দিকে। দাস বিক্রেতা ভুড়িওয়ালার হাতে তুলে দিতে ইসাবেলা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ও জানে সামনে দাঁড়ান এই লোলুপ কুকুরটা এখন কী করবে। রাগে ক্ষোভে চিৎকার করে নিকোলাসকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আজ ভরা মজলিশে আমার ইজ্জত হরণ করবে এই কুকুরটা। এই তো চেয়েছিলে তুমি। আমাকে লাঞ্ছিত, অপদস্ত হতে দেখে আনন্দ হচ্ছে তোমার, তাই না? জানোয়ার, অমানুষ, তোকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না। ঘৃণা করি তোকে আমি, ঘৃণা করি। আমার জীবনের এই পরিণতি আজ তোর জন্য। তুই আমার পবিত্র জীবনটাতে কলঙ্কের কালি মেখে দিলি। তোকে ঈশ্বর কোনোদিন ক্ষমা করবে না। আমার মায়ের হায় লাগবে তোর ওপর__” ইসাবেলার কথা থেমে যায় ভুড়িওয়ালার হাত বুকের ওপর থামতে। অন্যহাতে লোকটা ওর ঘাড় ধরে চুমু খাওয়ার জন্য মুখ নামিয়ে আনে। ইসাবেলা লোকটার মুখের ওপর একদলা থু থু দিয়ে সরে যায়। উপস্থিত জনতা হো হো করে হেসে ওঠে তাই দেখে। অপমানে গজগজ করতে করতে সজোরে চপেটাঘাত করল ইসাবেলার গালে। নিচে পড়ে গেল ইসাবেলা। লোকটা ওর চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে দাঁত খিচিয়ে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিলো। লোকটার অন্য হাত সাপের মতো ওর বুকের জামার ওপর এসে থামে। এরপর কী হবে ইসাবেলা জানে। কিছুক্ষণের জন্য যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেল ও। লোকটার ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসি। ইসাবেলার গলার কাছের জামার কিছু অংশ ছিঁড়ে ফেলল এক টানে৷ লজ্জায় দুচোখ বন্ধ করে ইসাবেলা। নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। লোকটা ওর বুকের কাপড় সম্পূর্ণ ছিঁড়তে যাবে তখনই পেছন থেকে সেই পরিচিত, কাঙ্ক্ষিত গলার স্বর শুনতে পেল ইসাবেলা। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

“ওকে ছেড়ে দাও।”

ইসাবেলা তখনও চোখ মেলেনি। দুচোখ দিয়ে জল পড়ছে। লোকটার হাত সরে গেছে ওর বুকের ওপর থেকে। যেন হাত নয় মস্ত এক অজগর ছিল। ইসাবেলা সরে দাঁড়ায়। রুক্ষ, বিরক্ত হয়ে লোকটা নিকোলাসের দিকে ঘুরে বলল,

” তুই কে রে শালা? রাজা বাদশাহ? ভালোই ভালোই বলছি সটকে পড় এখান থেকে। নচেৎ মেরে বাপের নাম ভুলিয়ে দেবো। টাকা দেখাচ্ছে আমায়।”

নিকোলাস গম্ভীর গলায় আবার বলল,

“তুমি যা দিয়েছ তার তিনগুন দিচ্ছি। ছেড়ে দাও ওকে।”

ইসাবেলা চোখ খুলে তাকাল এবার নিকোলাসের দিকে। নিকোলাস কী বলতে চাইছে বুঝতে চেষ্টা করল। নিকোলাসের আলখেল্লার হুডি নাক পর্যন্ত ঢাকা। ঠোঁট দুটো শক্ত হয়ে আছে। ভুড়িওয়ালার পায়ের কাছে মুদ্রা ভর্তি একটা থলে ছুঁড়ে দিলো সে। লোকটা মুদ্রা ভর্তি থলি দেখে হাসল।

“আরে যা ব্যাটা, এই ছেমরি আমার। ঢের টাকা আছে আমার, কিন্তু এমন সুন্দরী নেই। এই ছেরির ভরা যৌবনের গাঙে আজকে সাঁতার কাটমু আমি।”

উপস্থিত জনতার কয়েকজন হো হো করে হেসে ওঠে। লোকটা স্থানীয় ধনী। মুদ্রা নয় ইসাবেলাকে প্রয়োজন তার। এই মেয়ে এত মানুষের সামনে তার মুখে থু থু দিয়েছে। কেনা দাসীর এত স্পর্ধা! জনসমক্ষে মেয়েটাকে শিক্ষা না দিলে তার শান্তি হবে না। সুতরাং নিকোলাসের কথা আমলেও নিলো না। উলটো তার লাঠিয়াল বাহিনীকে ইশারা করে নিকোলাসকে বন্দি করার জন্য। ইসাবেলার দিকে আবার ফিরল সে। হাত বাড়াল ওর বুকের অর্ধ ছেঁড়া জামার দিকে। ইসাবেলা সাহায্যের আশায় নিকোলাসের দিকে তাকায়। নিকোলাস তেমনই নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার লালসার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে ইসাবেলা। কিন্তু লোকটা ওর গলা চেপে ধরেছে এক হাতে। মুখটা নামিয়ে এনেছে চুমু খাবে বলে। লোকটার অন্য হাত বুকে রাখবে তখনই ইসাবেলার চোখের সামনে ঘটে গেল নৃশংস এক ঘটনা। কোথা থেকে একটা শ্বেতকায় নেকড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভুড়িওয়ালা লোকটার ওপর। মুহূর্তে তার শরীর খণ্ড বিখন্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ইসাবেলা চারিদিকে। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে ইসাবেলা। লোকটার রক্তের কয়েক ফোটা ছিটকে পড়ে ওর গায়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত জনতা স্তম্ভিত। ইসাবেলার সামনে দাঁড়িয়ে সদর্পে গর্জন করছে নেকড়েটা। ওর জ্বলজ্বলে রক্ত লাল দৃষ্টি আর রক্ত মাখা শ্বদন্ত দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠল সব। ছুটোছুটি করতে লাগল এদিক ওদিক। কেবল কর্নিলাকে বিচলিত হতে দেখা গেল না। দাস বিক্রেতার দিকে বিদ্রুপাত্মক হেসে ধীরে ধীরে গণিকালয়ের দিকে চলে গেলেন। দাস বিক্রেতার রেগে যায়। তার আদেশে অনুচর দুটো মারতে ছুটে এলো নেকড়েটাকে। ও দুটোরও ভুড়িওয়ালার মতো একই পরিণতি হয়। এই দৃশ্য দেখে ভয়ে পালায় দাস বিক্রেতা। ইসাবেলা কিন্তু তেমনই জড়বৎ দাঁড়িয়ে আছে ভীত বিহ্বল হয়ে। রক্তে ভেজা ওর সারা শরীর। নেকড়ে ওর দিকে তাকাতেই ইসাবেলা ওই চোখে চেয়ে সম্মোহিত হয়ে যায়। ঘুরে দাঁড়ায় নেকড়ে। হেঁটে যায় টমটমের দিকে। ইসাবেলা কলের পুতুলের মতো সেটাকে অনুসরণ করে। কোচওয়ান আগে থেকে সিটে তৈরি হয়ে ছিল। নেকড়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল টমটমের ভেতরে। তারপর ইসাবেলা আস্তে আস্তে উঠে বসল সেটার পাশে। মুহূর্তে ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষতে টমটম নিয়ে ছুটল ঘোড়া। ইসাবেলার সংবিৎ ফিরতে ঘুরে তাকাল পাশে। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল। পাশে সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরে নিকোলাস বসে আছে। চোখ বন্ধ করে সিটের সাথে মিশে গেছে ওর দেহ। ইসাবেলা চোখ সরিয়ে নেয় লজ্জায়।

“সামনের মোটা কম্বলে ঢেকে দাও ওর শরীর। দ্রুত করো।”

কোচওয়ানের রুক্ষ গলার স্বরে বোকার মতো চেয়ে রইল ইসাবেলা। এই লোক কথা বলতে পারে? রাশিয়ান ভাষাও জানে? কোচওয়ান আবার একই কথা বলল উদ্বিগ্ন গলায়। ইসাবেলা তার কথা মতো সামনে সিটের তলা থেকে মোটা কম্বল বের করে কাঁপা হাতে নিকোলাসের শরীর ঢাকতে লাগল।
ভীত চোখে নিকোলাসের মুখটা দেখছে। কী দেখল একটু আগে? নিকোলাস! রক্তচোষা! নেকড়ে! বড়সড় একটা ঢোক গিললো। হঠাৎ দৃষ্টি থামল নিকোলাসের বুকের বা’পাশের উল্কা চিত্রর ওপর। একটা গোলাপ, পাশে চাঁদের মতো সিম্বোলিক আকৃতির চিত্র। চিত্রটা আরো ভালো করে বুঝার জন্য ঝুঁকে যেতে নিকোলাস চোখ মেলে তাকায়। এই দৃষ্টি ইসাবেলা চেনে। প্রথম যেদিন মাদাম আর ও নিকোলাসকে ঝিলের পাড়ে পেয়েছিল, ঠিক এমন দূর্বল আর অসুস্থ দেখাচ্ছিল ওকে। শ্বাস ধীরে ধীরে পড়ছিল। জ্বরের রোগীর মতো কাঁপছিল নিকোলাস। আজও হুবুহু তাই হচ্ছে। ইসাবেলা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নিকোলাস কম্পিত হাতে ওর হাত থেকে কম্বল কেড়ে নিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে নিলো। বিড়বিড় করে বলল,

“সরে যাও আমার কাছ থেকে, সরে যাও।”

ইসাবেলা ভয়ে ভয়ে সরে বসল। নিকোলাস শব্দ করে অসুস্থ মানুষের মতো শ্বাস ছাড়ছে। নিকোলাস যেন একটা ভুলভুলাইয়া। যত দেখছে ততই মাথা আউলে যাচ্ছে। অপ্রত্যাশিত নতুন নতুন রূপ প্রকাশ পাচ্ছে ওর। ইসাবেলা হতবুদ্ধি হয়। হঠাৎ নিজের দিকে চোখ পড়ে। সারা শরীরে রক্ত দেখে গা শিউরে ওঠে। কী নৃশংস ঘটনাই না প্রত্যক্ষ করল আজ! নিকোলাসের এই নৃশংস রূপ আরো বেশি ভীতসন্ত্রস্ত করে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কত পুরুষই না স্পর্শ করল আজ। গা ঘিন ঘিন করছে। হাত দিয়ে শরীরের এখানে ওখানে মুছতে লাগল। কিছুক্ষণ পর টমটম এসে থামে একটা অচেনা পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে। ইসাবেলা বাড়িটার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে তাকাতে অবাক। নিকোলাস পাশে নেই!

চলবে,,,

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১৬
Writer Taniya Sheikh

বেশ আয়েশিভাবে পাহাড়ের গা বেয়ে কল কল শব্দে ঝর্ণার পানি নিচে গড়িয়ে পড়ছে। আশেপাশে বীচবৃক্ষের সারি। পাখির কলতান আর ঝর্ণার অবিরাম ঝরে পড়ার শব্দে ইসাবেলা বিমুগ্ধ হয়। ঝর্ণার পানিতে স্নান সেরে সকালের নরম রোদে বসে থাকতে চমৎকার লাগে। দিনরাতে এই সময়টাকে সে খুব বেশি উপভোগ করে। রোদের তাপ বাড়তেই নিকোলাসের পরিত্যক্ত প্রাসাদ অভিমুখে রওনা হয়। এই ভূতুড়ে কুয়াশাজড়ানো প্রাসাদে ফেরার পর শুরু হয় বুক ঢিপঢিপানি। এখানে এসেছে এক সপ্তাহ, কিন্তু সেই ঘটনা প্রতি মুহূর্ত তাড়া করে বেড়ায়। রাতে দুঃস্বপ্নে ভর করে কর্নেলা, ওই দাস বিক্রেতারা আর সেই ভুড়িওয়ালা লোকটার ভয়ংকর রুপ এসে উপস্থিত হয়। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তখন। আতঙ্কে ঘেমে নেয়ে ঘুম ভাঙে। শেষমেশ কাঁদতে কাঁদতে ভোর পার করে দেয়। ঝর্ণার পাশে বসে আর নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরের মধ্যেই দিনরাত কাটিয়ে দেয়। নীরবে এসে খাবার রেখে ফিরে যায় ভৃত্যটি। সে এলে ইসাবেলা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে, নয়তো ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। লজ্জা হয় ভীষণ। সকলের সামনে লাঞ্ছিত হয়েছে। সেই লজ্জা এখনও কাটিয়ে উঠতে পরেনি আর না সেই আতঙ্ক। সময় মতো নিকোলাস না এলে আজ ইসাবেলার কী হতো? সেসব ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। এখন যে বিপদ মুক্ত সেটা ভাবা বোকামি। কিন্তু এই প্রাসাদে কেন যেন নিজেকে নিরাপদ মনে করে। ভয় হয়, আবার মনে মনে বিশ্বাসও আছে খুব খারাপ কিছু ঘটবে না। খুব খারাপ অর্থাৎ ওই ওখানে যা ঘটেছিল। নিকোলাস রক্তপিপাসু হোক আর যাই হোক, অন্তত নারী লিপ্সু তো নয়? ওর চোখে রক্ত তৃষ্ণা দেখেছে কিন্তু নোংরা কামুকতা দেখেনি। এর অর্থ এই নয় ইসাবেলা তাকে বিশ্বাস করে। কখনোই না। তার পরে শেষ ব্যক্তি হিসেবে পৃথিবীতে এই নিকোলাস অবশিষ্ট থাকলেও ইসাবেলা তাকে বিশ্বাস করবে না।

“হুম, এই জন্যই তো এই প্রাসাদে এখনও আছো?” মনের ভেতর থেকে কেউ একজন বিদ্রুপ। ইসাবেলা কপাল কুঁচকে বলে,

“বাইরে গেলে আবার যদি বিপদ হয়?”

“তার মানে এখন তুমি বিপদমুক্ত? এই প্রাসাদ তোমার কাছে নিরাপদ। নিকোলাসের ছত্রছায়ায় থাকাকে নিরাপদ মনে করছ। তাহলে উপসংহারে কী দাঁড়াল? বলো ইসাবেলা, বলো?”

ভেতর থেকে আগত পরিহাসে ইসাবেলা মাথা ঝাঁকায়। সামান্য মাথা চুলকে ভেবে বলে,

“আমি আবার পালাব। এই প্রাসাদ, নিকোলাস কাওকে নিরাপদ মনে করি না। কিন্তু আগের মতো না ভেবেচিন্তে পালাব না। প্লান করছি কীভাবে নিরাপদে জার্মান থেকে রাশিয়ায় পৌঁছানো যায়। সেই জন্য চুপচাপ আছি। বুঝেছ?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব বুঝেছি।” ক্রুর হাসে ভেতরেরজন। ইসাবেলা ধমকে ওঠে,

“চুপ করো। সব সময় শয়তানি ইঙ্গিত করো না। অসহ্য লাগে!”

“আমি যে তোমারই অংশ বে-ল-লে।”

“তুমি বলতে চাইছ আমি শয়তানি?”

“না, আমি শয়তানি। কিন্তু আমি আর তুমি তো অভিন্ন, তাই না বেলা?” ভেতরেরজন মুচকি মুচকি হাসে। ইসাবেলা বিরক্ত হয়ে দাঁত কামড়ে বলে,

“উফ! অসহ্য তুমি, অসহ্য। আমি নিষ্পাপ একটা মেয়ে। মোটেও শয়তানি না। আমার ভাবনা থেকে বিদায় হও তুমি, বিদায় হও।”

চোখ বন্ধ করে মাথাটা সজোরে ঝাঁকি দিলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে চলল রুমের দিকে। দরজা খুলতে ভূত দেখার মতো চমকে যায়। বিছানার পাশের ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে নিকোলাস। মাথা চেয়ারের পেছনে, মুখটা ঊর্ধ্বমুখে, দৃষ্টি মুদে আছে। পা ছড়িয়ে দিয়েছে সোজাভাবে, হাতদুটো উরুর ওপর স্থির। সেদিনের ঘটনার পর আজই প্রথম দেখল ইসাবেলা তাকে। বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে আজ। দরজায় দাঁড়িয়ে নিকোলাসের আপাদমস্তক ভালো করে দেখতে লাগল। পরনে নীল ফ্রককোট, তার ভেতরে ওয়েস্ট কোট, নিচে লম্বা প্যান্ট আর বুট জুতো। কে বলবে এ মানুষ নয়? কে বলবে এই শান্ত ভাবের আড়ালে লুকিয়ে আছে হিংস্র এক হায়েনা। হঠাৎ মনে হলো, পৃথিবীর সকল ভয়ংকর বস্তুই কি প্রবল আকর্ষণীয় হয়? না আকর্ষণীয় বস্তু ভয়ংকর হয়?

“নিকোলাস কিন্তু বস্তু নয়, ব্যক্তি।” ভেতরেরজন খিক করে হেসে ওঠে। ইসাবেলা চাপা স্বরে নিজের সেই দ্বিতীয় সত্তাকে ধমক দেয়,

“চুপ, শয়তানি। সব সময় ভাবনায় ফোঁড়ন কাটবে।অসহ্য।”

“বেলা।”

নিকোলাসের কণ্ঠে বেলা ডাকে ভিন্ন কিছু থাকে। ইসাবেলার কেমন যেন অনুভব হয়। সেটা ভালো না খারাপ তা অবশ্য জানে না। জেনেই বা হবে কী? ওসবে কিছু এসে যায় না। ভেতরের জনের বিদ্রুপ শোনার জন্য সতর্ক হয়। না, কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। বিজয়ের হাসি হাসল নীরবে ইসাবেলা। আসলেই নিকোলাসের কোনো ব্যাপারে এসে যায় না ওর।

“বেলা” এবার কর্কশ গলায় ডেকে উঠল নিকোলাস। ইসাবেলা একপ্রকার আঁতকে ওঠে। জবাব দেয়,

“হুঁ?”

“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”

“গোসল করতে গিয়েছিলাম।”

তারপর আবার সেই নীরবতা। নিকোলাস এখনও একই ভাবে চোখ বুঁজে বসে আছে চেয়ারে। ইসাবেলা কয়েকবার ঢোক গিলে দু’ কদম এগিয়ে বলল,

“কেন এসেছ আমার কক্ষে?”

“তোমাকে দেখতে।”

“আমাকে দেখতে!” বিস্ময় ঝরল ইসাবেলার কণ্ঠে। গলা ঝেড়ে পরিহাসের সুরে বলল,

“আমাকে দেখতে না কি আমার রক্ত পান করত?”

নিকোলাস সেভাবেই বসে চোখ খুলল এবার। ঠোঁটের একপাশ বেঁকে গেল। বলল,

“নির্বোধ বেলার ঘটে আজকাল বুদ্ধিও পাওয়া যায় দেখছি। আশ্চর্য!”

“ইতর কোথাকার।”

দাঁতে দাঁত কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল ইসাবেলা। নিকোলাস হাওয়ায় মিশে ওর গর্দান চেপে ধরে রুক্ষ গলায় বলল,

“বড্ড বেড়েছ তুমি এবং তোমার জবান। কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছ জানো তুমি? তোমার ভাগ্য ভালো আন্দ্রেই সুস্থ হয়েছে। ওর কিছু হলে পৃথিবীতে তোমার অস্তিত্ব থাকত না আজ। কী ভেবেছ? তোমাকে খাতির করে রেখেছি রক্ত পান করব বলে? নির্বোধ। আন্দ্রেইর সামনে তোমাকে শেষ করব বলেই বাঁচিয়ে রেখেছি। ততদিনে মৃত্যুর ভয় সারাক্ষণ অনুভব করবে এই প্রাসাদে থেকে। মৃত্যু সন্নিকটে তোমার। আর দুটো দিন। তারপরে চির মুক্তি দেবো।”

নিকোলাসের মুড সেকেন্ডে সেকেন্ড পালটায়। একটু আগের শান্ত, নির্বিকার নিকোলাসের মুখ এই মুহূর্তে কঠিন, দৃষ্টি কঠোর। ওর অতর্কিত এই মুড পরিবর্তনে ইসাবেলার অবস্থা বেগতিক। নিজের পরিণতি জেনে ভীত সন্ত্রস্ত। নিকোলাস ওর গর্দান থেকে হাত সরিয়ে নেয় মাথার পেছনে। মুখটা আরো ঘনিষ্ঠে এনে বলে,

“ভেবেছিলে আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারবে? নির্বোধ বেলা, নিকোলাসকে শেষ করার সাধ্য কারো নেই, কারো নয়। তোমার মতো বাচ্চা মেয়ের তো নয়ই। বাচ্চাদের সবসময়ই গুরুজনের কথা মেনে চলতে হয়। অমান্য করলেই শিক্ষা দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আমাকে শেষ করার চেষ্টা এবং আমার বন্দিশালা থেকে পালিয়ে যাওয়ার দোষে তোমাকে শাস্তি দেবো আমি। আমাকে অমান্য, অসম্মান করার শাস্তি পাবে। যদিও যথেষ্ট শাস্তি নিজের সৌভাগ্যক্রমে ওপস! মিসটেক, সঠিকভাবে হলো দুর্ভাগ্যক্রমে পেয়েছ। সেটা একান্তই তোমার দোষে। তাই বলে আমার তরফ থেকে তোমার জন্য নির্ধারিত শাস্তি এক ফোঁটাও মওকুফ হবে না। এটাই নিকোলাসের আইন।”

ধাক্কা দিয়ে ইসাবেলাকে নিচে ফেলে চেয়ারে গিয়ে বসে। ইসাবেলার ঘাড়টা যন্ত্রণায় অসাড় হওয়ার অবস্থা। স্থির সিক্ত চোখে ফ্লোরে চেয়ে আছে। নিকোলাসের কাছে আর কী আশা করেছিল? নিরাপদে, সসম্মানে রাশিয়া পৌঁছে দেবে? তাচ্ছিল্য ভরে হাসল আপনমনে। নিকোলাস আবার আগের মতো চোখ বুঁজে শান্ত গলায় বলল,

“তোমার প্রথম শাস্তি হলো, এই পুরো প্রাসাদ পরিষ্কার করবে। ঝেড়ে মুছে ঝকঝকে করে তুলবে।”

ইসাবেলা হতবুদ্ধি হয়ে বলে,

“পুরো প্রাসাদ?”

“পুরো প্রাসাদ।”

“আমাকে কি কলের পুতুল মনে হয়? পারব না। কী করবে? মেরে ফেলবে? ও তো দুইদিন পরও মারবে। সুতরাং কোনো কাজই করব না আমি। যা ইচ্ছে হয় করো গে।”

বাবু মেরে বসে চোখ মুছে মুখ তুলল ইসাবেলা। নিকোলাস মুচকি হাসে। বলে,

“এমনিতেই কী নির্বোধ বলি? বেলা, তুমি কি মৃত্যুর আগেই কয়েকটা নেকড়ের আহার যোগাতে চাও? এই ধরো তোমার একটা হাত কিংবা পা যদি ওরা ছিঁড়ে খায়, তবে?”

ইসাবেলার গলা শুকিয়ে এলো। নিকোলাসের ভরসা নেই। ও যা বলেছে তা করতে বাধবে না। মানবিকতার বালাই নেই ওর মধ্যে। রাগে কটমট করে বলল,

“তুই একটা অমানুষ, পিশাচ”

“হ্যাঁ, আমি জানি।”

ইসাবেলা এবার নাক টানতে টানতে পরাজিত গলায় বলল,

“মানবীয় রূপ ধরে আছো। একটু মানবিক হওয়া যায় না? তোমার মধ্যে কী মন বলে কিছু নেই?”

“জীবন্মৃতদের মন থাকে না।”

“জীবন্মৃত! অর্থাৎ তুমি জীবিত আবার মৃত? এ কী করে সম্ভব? এমন কখনও হয়?”

ইসাবেলা ভাবনায় বুঁদ হয়। নিকোলাস কিন্তু চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ পর ইসাবেলা তেতে উঠে বলল,

“এই জন্যই তো আমাকে বলতে পারলে পুরো প্রাসাদ পরিষ্কার করতে। অপদার্থ, অনুভূতিশূন্য! আমি মানুষ৷ সেটাও আবার বা-চ-চা মেয়ে। এত শক্ত কাজ কী করে করব? তোমার মতো অপদার্থ, জীবন্মৃতের দ্বারাও তো এ কাজ একা সম্ভব না। চ্যালেঞ্জ নাও তুমিও হার মানবে কাজ শেষ করতে না পেরে। সাহস থাকে তো চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেখো।”

“দাসী আর মালিকে মোকাবেলা হয় না।”

“দাসী?”

“হুম, উচ্চমূল্যে কেনা দাসী।”

“কার কথা বলছ তুমি?”

“তুমিই আমার উচ্চমূল্যে কেনা দাসী বেলা।”

“কি? আমি দাসী! আবোল তাবোল বকো না। ওই খচ্চর তোমার টাকা নেয়নি। তার আগেই তো মেরে ফেলেছ।”

“সে টাকা নিলো না নিলো তাতে আমার কিছু এসে যায় না। টাকাগুলো আমি দিয়েছি। সুতরাং তুমি আমার কেনা দাসী।”

“স্বৈরচারের মতো আচরণ করছ তুমি।”

“কারণ আমি স্বৈরাচার। এবার চুপ করে কাজে লেগে যাও__”

“যদি না যাই। কী করবে হুম? ভয় দেখাবে? আমি তোমাকে ভয় পাই না। ফাঁসির আসামীর আর ভয় কীসের?”

নিকোলাস উঠে দাঁড়ায়। চোখ দুটো আগুনের ন্যায় জ্বলছে। শ্বদন্ত বেরিয়ে এসেছে ঠোঁটের দুপাশ থেকে। ইসাবেলা এক কদম পিছিয়ে গেল। ভয় ওর চোখে স্পষ্ট। নিকোলাস ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

“ভয় পাও না?”

“না” জোর গলায় জবাব দেয় ইসাবেলা। নিকোলাস চোখের পলকে ছুটে এসে বাহু চেপে ধরে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে ইসাবেলা। হাওয়ায় উড়ে ওকে নিয়ে এলো জঙ্গলের ভেতর। চারপাশে ঘন বীচবৃক্ষ আর গুল্মলতা লতার বাহার। সূর্যের আলো এখানে নামেমাত্র উঁকি দিয়েছে। পায়ের নিচে শুকনো পাতার আচ্ছাদন। নিকোলাস মুখ নামিয়ে আনে কানের কাছে। ওর ভারী নিঃশ্বাসে কাঁধের লোমশ দাঁড়িয়ে যায়। সরে দাঁড়াতে গেলে নিকোলাস মুষ্টি শক্ত করে৷

“ছাড়ো আমাকে।” অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল ইসাবেলা। নিকোলাস চাপা সম্মোহনী গলায় বলল,

“অবশ্যই। তোমাকে ছাড়ব বলেই তো নিয়ে এলাম এখানে, বেলা।”

ভ্রু কুঁচকে তাকায় নিকোলাসের মুখের দিকে। খুব কাছাকাছি দুজনে। ওই চোখে চেয়ে হারিয়ে যায় ইসাবেলা। ভুলে যায় সব ব্যথা। সময় যেন থমকে গেছে। নিকোলাস মুচকি হেসে সামনে ঠেলে দিতে ঘোর কাটে। দেখতে পেল চাপা গর্জন করতে করতে গাছের আড়াল থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসছে কয়েকটা নেকড়ে। ইসাবেলা কিছুক্ষণ দম ফেলতে ভুলে গেল। নেকড়েগুলো বুভুক্ষু দৃষ্টিতে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। ইসাবেলা আর্ত চোখে পেছনে তাকায়। নির্বিকার, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস। নেকড়ের গর্জন ধীরে ধীরে সন্নিকটে আসছে। ইসাবেলার সত্যি এবার ভয় করছে। সভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। নিকোলাস পরিহাস করে বলল,

“ভয় হচ্ছে না বেলা?”

নিকোলাস কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশ দিয়ে ভো দৌড় দেয় ইসাবেলা। নেকড়েগুলোও ছুটল পিছু পিছু। ইসাবেলা প্রাণপণে ছুটছে। ঝোপঝাড়, গাছপালা সব পেরিয়ে সামনে দৌড়াচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে জানা নেই। নেকড়ের গর্জনে কলিজায় পানি নেই। ভাবনা চিন্তা করার অবস্থাতেও নেই এখন। শুধু জানে দৌড়াতে হবে। হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁফ ধরে যায়। দম নিতে কষ্ট হলেও সে পা থামায় না। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত গাছের পড়ে থাকা শুকনো ডালে পা বেঁধে নিচে মুখ থুবড়ে পড়ে। শুকনো ডালের আঁচরে হাত-পা, হাঁটুর চামড়া ছিঁড়ে রক্তাক্ত অবস্থা। নেকড়েগুলো ঘোঁতঘোত শব্দ করে একদৃষ্টি চেয়ে আছে ওর দিকে। প্রস্তুতি নিচ্ছে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। ইসাবেলা উঠতেও গিয়ে পারে না। অগত্যা হার মানতেই হয়। নেকড়ে ওর দিকে লাফ দিতে কাঁদতে কাঁদতে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলে। একটু পর নেকড়ের আর্তনাদে সচকিত হয়ে চোখ মেলে। বিস্ময়ে চেয়ে আছে পাশে। নেকড়েটা পড়ে গোঙাচ্ছে। গলা দিয়ে রক্ত পড়ছে ওটার। নেকড়ের দেহের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাদামি চুলের এক মেয়ে। পরনে ধূসর সিল্কের কোট গাউন। কোঁকড়া বাদামি চুল খোঁপা করা।

“নোভা!”

রাগান্বিত নিকোলাস এসে হাজির হয় সেখানে। ওর পেছনে এখন বাকি নেকড়ের দল। মেয়েটি ঘুরতে ইসাবেলা চিনতে পারল তাকে। ওইদিন নিকোলাসের কফিনের পাশের কফিনে এই মেয়েটিই শুয়ে ছিল। রক্তমাখা লাল ঠোঁট মুছে বলল,

“বড়ো ভাই”

“এখানে কী করছিস তুই?”

জবাব না দিয়ে নোভা হাসি মুখে ইসাবেলার সামনে এসে বসল। ভয়ে জড়সড় হয়ে সরে যায় ইসাবেলা। নোভা বিমর্ষ মুখে বলল,

“ভয় পেয়ো না। তোমার কোনো ক্ষতি করব না আমি। হাত দাও।”
ইসাবেলা এদের বিশ্বাস করে না। নোভা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ওর নজর পড়ে ইসাবেলার হাত-পায়ের ক্ষতের ওপর। পরম মমতায় রক্তাক্ত পায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। আশ্চর্য! ক্ষত উধাও। ব্যথাও অনুভব করছে না এখন আর ইসাবেলা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নোভার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা হেসে ওর হাতটা ধরে পুনরায় বলল,

“ভয় পেয়ো না আমাকে।”

“নোভা” কুপিত দেখাল নিকোলাসকে। নোভা চোয়াল শক্ত করে জবাব দিলো,

“শুনছি আমি বড়ো ভাই।”

“কী করছ তুমি?”

“নির্দোষ, নিষ্পাপ মেয়েটাকে সাহায্য করছি। কেন এমন করছ ওর সাথে? ছেড়ে দাও ভাই ওকে।” উঠে ভাইয়ের মুখোমুখি হয় নোভা। নিকোলাস কর্কশ গলায় বলল,

“আমার কাজে হস্তক্ষেপ করা আমি পছন্দ করি না। হবে তুমি আমার বোন, কিন্তু ভুলে যেয়ো না আমি তোমাদের রাজা।”

নোভা তাচ্ছিল্য ভরে হাসল,

“হ্যাঁ, সেটাই। তুমি রাজা। আমার ভাইয়ের চাইতে বড়ো কথা তুমি রাজা। রাজা মশায়, শাস্তি দিন আমাকে। আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করার শাস্তি তো প্রাপ্য আমার। দিন শাস্তি।”

নিকোলাসের দৃষ্টি নরম হলো। নিচু গলায় বলল,

“চলে যা এখান থেকে নোভা।”

ইসাবেলার বাহু চেপে ধরে দাঁড় করাতে নোভা নিকোলাসের হাতের ওপর হাত রাখে।

“তোকে যেতে বলেছি নোভা।”

“ওকে সাথে না নিয়ে কোথাও যাব না আমি।”

“ও আমার শিকার নোভা। শেষবার বলছি আমার কাজে হস্তক্ষেপ করিস না। সর।”

“আমিও শেষবার বলছি ওকে আমার চাই।”

ইসাবেলাকে ছেড়ে নোভার গলা চেপে হুঙ্কার করে ওঠে নিকোলাস,
“কেন? কেন ওকে চাই তোর? এমন তো না তুই মনুষ্য রক্ত পান করিস, তবে? ওকে দেখে রুচি বদল হয়েছে?”

“আমার একজন দাসী চাই ভাই। বোন হিসেবে উপহার চাইছি। তোমার এই বোনকে এইটুকু কি দেবে না?”

“না”

নিকোলাস ওর গলা ছেড়ে ইসাবেলার বাহু ধরে সামনে যাবে কিন্তু নোভা ইসাবেলার হাত টেনে ধরে।

“প্লিজ ভাই। ছেড়ে দাও ওকে। অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও আমাকে দাও।”

চাপা গর্জে ইসাবেলার হাত ছেড়ে বলে,

“দুইদিন, এর এক সেকেন্ড বেশিও না কমও না। দুইদিন পর ওকে আমি ফিরিয়ে নেবো। খবরদার যদি ওকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিস?”

নোভার মুখখানি উজ্জ্বল হয়। ইসাবেলাকে কাছে টেনে ভাইয়ের সামনে নত মস্তকে বলল,

“ধন্যবাদ ভাই।”

শেষবার ইসাবেলার ফ্যাকাশে ভীত মুখ পানে চেয়ে হাওয়ায় হারিয়ে যায় নিকোলাস। নেকড়েগুলো বন মধ্যে গা ঢাকা দিয়েছে। ইসাবেলা নোভার দিকে ফেরে। মেয়েটার চোখে মুখে কোনো হিংস্রতা নেই। ও যেন নিকোলাসদের একজন হয়েও আলাদা। ইসাবেলা কি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে? বিশ্বাস করবে এই মেয়েকে? সেটা কি ঠিক হবে? হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক করে মাথায়।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে