তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১১
Writer Taniya Sheikh
তীর্যক সূর্যালোক চোখের উপর পড়তে ঘুম ভাঙল ইসাবেলার। পিটপিট করে চোখ খুলতেই আলোকরশ্মি খুব লাগল চোখে। কষ্ট হলেও খুলল চোখজোড়া। অনেকদিন অন্ধকারে থাকার পর আলোতে এলে যেমনটা বোধ হয়, তেমনই লাগছে। কতদিন ধরে ঘুমিয়েছিল তবে সে? প্রশ্নটা ভুলে গেল উঠে বসতে গিয়ে। সর্বাঙ্গ ব্যথায় টনটন করছে। একটা ব্যথাতুর কাতরানি বেরিয়ে এলো ওর গলা দিয়ে।
“আহ!”
হাতদুটোর দিকে তাকাতে অবাক হলো। সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো হাত। পরনের কাপড়ও নতুন, পরিষ্কার। নতুন কাপড়! ইসাবেলা চকিতে তাকায় পরনের সাদা মেক্সি ড্রেসটার দিকে। কে বদলেছে এই ড্রেস? নিকোলাসের নামটা স্মরণ হতে লজ্জায় শরীর অবশ হওয়ার উপক্রম। পরক্ষণেই ভীষণ রাগ চেপে যায় মাথায়। সামনে পেলে খুনই করে ফেলত নিকোলাসকে বুঝি ও। কানে এলো ঝকঝক ট্রেনের শব্দ। ট্রেনের একটি কেবিনে শুয়ে আছে ইসাবেলা। মাথার কাছের জানালাটা বন্ধ। কিন্তু ওর শার্সির সামান্য ফাঁক দিয়ে বাইরের প্রখর রোদ গলে পড়ছে কেবিনে। ভেতরের অন্ধকারে সেই আলো বেশ সুবিধা করে উঠতে পারছে না। ইসাবেলা কষ্টে শিষ্টে উঠে বসে। শরীরের ব্যথাটা বেড়ে গেল তাতে। গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা উষ্ণ জলের ছোঁয়া টের পেল। এই কদিনে শারীরিক, মানসিকভাবে ব্যথা পেয়েছে অনেক। আজ হয়তো সেই কারণে ব্যথাটাকে প্রশ্রয় দিলো না। কেবিনটার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না অন্ধকারে। ট্রেনের ঝকঝক শব্দটাই কেবল শুনতে পাচ্ছে সে। একটু শান্ত হয়ে কান পাতলো। না, মানুষের শোরগোল নেই। এর আগেও ইসাবেলা কয়েকবার ট্রেনে চড়েছে। মায়ের সাথে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল তখন। কতশত মানুষ দেখেছে প্লাটফর্মে, ট্রেনে। কত শব্দ! এই কামরাতে ইসাবেলা নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেল না। একটু যেন গা ছমছম করে। সাহস করে গলা ঝেড়ে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করল,
“কেউ আছেন? শুনছেন কেউ আমাকে?”
ওর কথার আওয়াজ একটা শব্দ তরঙ্গ তুলল যেন। প্রতিধ্বনিত হয়ে অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি করে। নীরবতা ভেঙে কিছু নড়ে উঠল সেই সাথে। কেবিনের গায়ে গায়ে ঝুলে আছে অসংখ্য বাদুড়। এতক্ষণ সেগুলো চোখে পড়েনি ওর। অন্ধকারে মিশে ছিল। কয়েকটা ডানা ঝাপটে আবার স্থির হয়ে রইল। ভয়ে বেরিয়ে আসা চিৎকারটাকে মুখে হাত চেপে রুদ্ধ করে ইসাবেলা। এত এত বাদুড় দেখে ভীত সে। মন বলছে এগুলো ভালো নয়। খারাপ কিছু ঘটতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। ইসাবেলার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। সেদিন ওই শয়তানগুলোর সামনে, বিশেষ করে নিকোলাসের সামনে এত সাহস কী করে দেখিয়েছিল জানে না। অতি শোক, ভয়ই হয়তো সাহসী করে তুলেছিল। কিংবা নিজের স্বাভাবিকতা ভুলে বসেছিল। সেসব নিয়ে এখন ওর ভাববার সময় নেই। মস্তিষ্ক শান্ত করে বসল। যে করেই হোক এখান থেকে পালাতে হবে। ভ্যালেরিয়ার শেষ কথাগুলো স্মরণ করে নীরবে চোখের জল বিসর্জন দিলো। প্রিয়জন হারিয়ে শোকে কাতরই হয় না মানুষ, পাথরও হয়ে যায়। পাথরের কী ভয়, ডর থাকে? যদি কিছু থাকে তবে তা হলো আঘাত করার ক্ষমতা। পাথরের ধর্মই আঘাত করা।
জনমানবশূন্য কামরা। এক ইসাবেলা ছাড়া এতে আর কেউ নেই। হঠাৎ সেদিনের কথা মনে পড়ল। জ্ঞান হারানোর আগে নিকোলাসের শেষ কথা মনে পড়তে অন্তর আত্মা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে যায়। তবে কী নিকোলাসের বন্দি সে? নিকোলাসের প্রতি প্রচণ্ড রাগ ওর। একটা অকৃতজ্ঞ, প্রতারক নিকোলাস ওর কাছে। মাদামের পাগল হয়ে যাওয়া, ইসাবেলার মৃতপ্রায় অবস্থা, ভ্যালেরিয়ার মৃত্যু সবকিছুর মূলে যে নিকোলাস তাকে সে ঘৃণা করে। প্রাণী হত্যা পাপ। জীবনে কখনও কোনো জীবকে হত্যা করেনি ইসাবেলা। কিন্তু নিকোলাসকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছে। তাতে যত পাপ হয় হোক। নিজের এই বদলে যাওয়া রূপকে ঘৃণা করে ইসাবেলা। ভাগ্যকে বার বার শুধায় কোন পাপে তার এই শাস্তি? কেন পাপের পঙ্কিলতায় ডুবে যাচ্ছে ওর নিষ্পাপ জীবন?
ইসাবেলা দূর্বল পায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কামরার শেষের দরজার দিকে। একটু একটু করে এগোচ্ছে আর বাদুড়গুলোকে দেখছে সতর্কে। ভ্রম হচ্ছে এই বুঝি ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওই নেকড়েগুলোর মতো। দরজার কাছে পৌঁছে গেল কিছু সময়ের মধ্যে। মোটা কাঠের হাতলে আস্তে টান দিলো। কিন্তু খুললো না। আরেকটু জোরে তারপর সর্ব শক্তি দিয়ে টানলো। খুলতেই পারছে না। এদিকে ওর শরীরের অবস্থা শোচনীয়। মাথা ভনভন করছে, দৃষ্টি ঝাপসা হয় আসে থেকে থেকে। পা দুটো কাঁপছে। সোজা হয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। দরজায় কপাল আর দুহাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস টানে। হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর শব্দে চকিতে ফিরে তাকায় পেছনে। আঁতকে ওঠে ইসাবেলা। বাদুড়গুলো বুভুক্ষু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে। ঝাঁপিয়ে পড়বে যে কোনো মুহূর্তে। কী করবে ইসাবেলা এখন? বাদুড়গুলো ওকে আক্রমণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একসাথে নয়। ঝাঁক থেকে একটা দুটো হুটহাট এসে শরীরের এখানে ওখানে কামড়ে দিচ্ছে। খেলছে যেন ওকে নিয়ে। চিৎকার করছে ব্যথায় ইসাবেলা,
“আহ! কে আছো বাঁচাও আমাকে। শুনতে পাচ্ছ কেউ। কে আছো দরজাটা খুলে দাও, বাঁচাও আমাকে প্লিজ।”
দরজায় সজোরে করাঘাত করে ইসাবেলা। কিন্তু কেউ আসে না বাঁচাতে। এভাবেই মরে যাবে তবে? বাদুড়গুলোর আক্রমণে নাস্তানাবুদ হয়ে হাঁটু মুড়ে মুখটা আড়াল করল তাতে। দু’হাতে তাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সেই হাতই ওরা কামড়ে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। রক্ত দেখে ওদের মধ্যে চাঞ্চল্য আরো বেড়ে গেল। হিংস্র হয়ে উঠল। ইসাবেলা এভাবে মরতে চায় না। নিকোলাসকে জিততে দেবে না সে। ভ্যালেরিয়ার মৃত্যুর প্রতিশোধ সে নেবেই। কিন্তু তার আগে বাঁচাতে হবে নিজেকে। শরীরের ব্যথা আর ভয় উপেক্ষা করে সেই মুহূর্তে মাথা ঠাণ্ডা করে কিছু ভাবাটা মুশকিল। হাল ছাড়ল না। উঠে দাঁড়ায়। দুহাতের সাথে পা-টাকেও কাজে লাগায়। কিন্তু এই দূর্বল শরীর নিয়ে কতক্ষণ পারবে লড়াই করতে? মনে পড়ল দিদার কথা। একবার গল্পচ্ছলে বলেছিল বাদুড় নিশাচর। এখনও তো অন্ধকারেই রয়েছে। কেবিন অন্ধকার হওয়ার এটাই কী কারণ? চট করে একটা বুদ্ধি চলে এলো মাথায়। একটু দূরে একটা জানালা। ওটা খুলতে হবে। ইসাবেলা দূর্বল পায়ে কোনোমতে হুড়মুড় করে দৌড়ে গেল জানালার দিকে। বাদুড়গুলো যেন কিছু আন্দাজ করল। একসাথে সবগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে ঠিক তখনই ধুলো জমা জানালার শার্সি খুলে দিলো ইসাবেলা। ঈশ্বরের আশীর্বাদ রূপে সূর্যালোক প্রবেশ করে কামরার দরজার দিকটাতে। সেখানেই ইসাবেলা দাঁড়িয়ে। বাদুড়গুলোর আর্তনাদ শুনতে পেল ইসাবেলা। অন্ধকারে সরে গেল ওরা। কিন্তু কয়েকটা সে সময়টুকু পেল না। সূর্যালোকের আলো ওগুলোর শরীরে পড়তে পুড়ে ছাই হয়ে হাওয়ায় মিশে যায়। হতবিহ্বল হয়ে দেখল ইসাবেলা। এমন দৃশ্য এই প্রথম সে দেখছে। নিশাচর বলেই কী সূর্যালোকে পুড়ে গেল, না কি অন্য কোনো ব্যাপার লুকিয়ে আছে? বাদুড়গুলো অন্ধকারে দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে। কী ভয়ানক দৃষ্টি ওদের! নিজের শরীরের দিকে চোখ পড়তে মাথা ঘুরে ওঠে ইসাবেলার। দরজার পেছনে ঠেস দিয়ে বসল। কাঁপছে ইসাবেলা। এই তিলে তিলে মরার চেয়ে একেবারে মৃত্যুও বুঝি ভালো ছিল। ভ্যালেরিয়ার জায়গায় সে মরলেও ভালো হতো। বেঁচে থেকে এই বিভৎস অত্যাচার আর সহ্য করতে পারছে না। হাত থেকে একে একে রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ খুলে ফেলল। শুকনো ক্ষত আবার দগদগে হয়ে উঠেছে। রক্ত বেয়ে পড়ছে ক্ষত থেকে। ব্যান্ডেজের কাপড়ে রক্ত মুছে নিলো। মুখের কয়েক স্থানেও আঁচর দিয়েছে। বাদুড়গুলো এখনও এদিকেই হিংস্র জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে। ইসাবেলা রাগে ক্ষোভে ওদের দিকে রক্তমাখা ব্যান্ডেজ ছুঁড়তে উদ্যত হলো। রক্ত দেখে হুড়মুড় লেগে গেল ওগুলোর মধ্যে। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
“রক্ত খাবি? আয়, আয়। এই তো হাত বাড়িয়েছি। আয়!”
আলো ওদের এবং ইসাবেলার মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাজা রক্তের গন্ধে উন্মাদ হয়ে উঠেছে ওগুলো। ইসাবেলার এখন ভয় থেকে আনন্দই হচ্ছে বেশি। শত্রুর অসহায়ত্ব দেখে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করল সে। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বুঝি লুকিয়ে থাকে একটা করে অপ্রকৃতিস্থ রূপ। ব্যান্ডেজের দলাপাকানো কাপড় সামনে রেখে আয়েশ করে বসল। ঘুম ঘুম পাচ্ছে ফের। জানালার কাছে সরে বসে। সিটে গা এলিয়ে দিলো সম্পূর্ণভাবে। আশপাশের কোনো স্টেশনে ট্রেনটি থামলে ইসাবেলা নেমে পড়বে। আদৌ কী কোনো স্টেশন পাবে সে? বাইরে তাকাল। কোনো জনপদের মধ্যে নয়, ট্রেনটি চলছে উপত্যকার ওপর দিয়ে। শোঁ শোঁ শব্দ করে সরে যাচ্ছে পাশের লম্বা লম্বা গাছের সারি। দূরে সমতল ভূমি, নদী। কিন্তু বরফ আচ্ছাদিত নয়? এতক্ষণে অনুভব করল শীত শীত লাগছে না। গায়ে পাতলা মেক্সিড্রেসেও ঘামছে সে। কোথায় এই মুহূর্তে ও? কতদিন ঘুমিয়ে ছিল এখানে? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখে ঘুম নেমে এলো বুঝতেই পারল না। ঘুম ভাঙল দরজার খ্যাচ খ্যাচ আওয়াজে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। অন্ধকার কামরাতে ইসাবেলার পাশের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো লুটিয়ে পড়েছে। ভারী পায়ের আওয়াজের উৎসের দিকে চকিতে তাকাল। দরজা পেছনে বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিকোলাস। পরনে রাজকীয় জমকালো দামি পোশাক। আজ ওর মুখের ভাব শান্ত হলেও তাতে রাজকীয় জৌলুশ আর প্রতাপের ছাপ। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা। ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি। নিকোলাসের সত্যিটা জানা না থাকলে ওই হাসিতে বিমোহিত হয়ে যেত ইসাবেলা, ওই চোখে সম্মোহিত হতো। আজ গা জ্বালা করে উঠল। ওর ক্ষুব্ধ চাহনি দেখে নিকোলাসের ঠোঁটের ক্ষীণ হাসি আরো দীর্ঘায়িত হয়। হাতের বাতিদানটা নিয়ে এগিয়ে এলো সামনে। ইসাবেলা তড়াক করে উঠতে গিয়ে শরীরে ব্যথা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে জানালা ঘেঁষে দাঁড়ায়। নিকোলাস এক পা বাড়াতেই আঙুল তুলে বলে,
“কাছে এগোবি না শয়তান। যদি এগোস জানালা দিয়ে লাফ দেবো আমি।”
“সত্যি!”
তারপর বিদ্রুপের সুরে শঙ্কিত হয়ে বলল,
“না, না, এমনটা করো না বেলা। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি যে ভীষণ কষ্ট পাব।”
ইসাবেলা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দাঁত বের করে হাসল নিকোলাস। এগিয়ে ওর বাহু চেপে ধরে কর্কশ গলায় বলে,
“তোমার মৃত্যু আমার হাতে। সুতরাং ওসব লম্ফঝম্প দেওয়ার প্লান করে কোনো লাভ হবে না।”
ইসাবেলা বাহু ছাড়াতে গেলে আরো জোরে চেপে ধরে নিকোলাস। ব্যথায় মুখ চোখ খিঁচে বন্ধ করে ইসাবেলা। অশ্রুপাত হয় বন্ধ চোখের পাতার নিচে দিয়ে। নিকোলাস অপেক্ষা করে ওর চোখ খোলার। অপেক্ষা করে ভয়, আতঙ্ক দেখার। আরক্ত সিক্ত চোখে কোনো ভয়, আতঙ্ক নেই। আছে কেবল ঘৃণা। আশাহত নিকোলাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু একটু পরেই শান্তভাবে বলল,
“এসো খাবে।”
ওর বাহু টেনে দরজার দিকে পা বাড়ায় নিকোলাস।
“কী খাব মানুষের রক্ত?”
ইসাবেলার কথা শুনে নিকোলাস মুচকি হেসে ঘুরে তাকায়,
“তুমি ভারী মজার মেয়ে তো।”
ইসাবেলা বাহু ছাড়িয়ে চোখ রাঙিয়ে আগের স্থানে ফিরে যাবার জন্য ঘুরতে নিকোলাস ফের ওর বাহু টেনে ধরে। নিজের দিকে ঘুরিয়ে কানের কাছে ঝুঁকে বলে,
“মানুষের নয় বাদুড়ের রক্ত। খাবে?”
আর্ত হয়ে ওঠে ইসাবেলা। কেবিনের এদিক ওদিক চেয়ে বিস্মিত হলো। কোথায় সেই বাদুড়ের দল? নিকোলাস টানতে টানতে নিয়ে এলো অন্য একটি কেবিনে। বিলাসবহুল হোটেলরুমের মতো এই কামরাটি। মাথার উপর ঝাড়বাতি, ডানপাশে বড়ো লাল সোফা পাতা, সামনে ছোটো টেবিল। পায়ের নিচে কারুকার্য করা লাল কার্পেট। নিকোলাস ওর হাত ছেড়ে রাজার ভঙ্গিতে সোফাতে গিয়ে বসল। ইসাবেলা জড়োসড়ো হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তর্জনী তুলে ডাকল নিকোলাস,
“এদিকে এসো বেলা।”
ইসাবেলা না শোনার ভান করে দাঁড়িয়ে থাকে। নিকোলাস খেঁকিয়ে ডাকল,
“বেলা”
ইসাবেলা কেঁপে উঠল সামান্য। কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর করল না, এক পা-ও এগোয় না।
“আমাকে রাগিয়ো না বেলা। শেষবার বলছি এদিকে এসো।”
নিকোলাসের মুখ বদলে গেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে বেরিয়ে এলো সূচালো সাদা দাঁত দুটো। গলা শুকিয়ে যায় ইসাবেলার। নিকোলাসকে আর বেশি রাগালে হিতে বিপরীত হবে জেনে এগিয়ে গেল। এ ঘরের দেয়ালে নগ্ন নারীমূর্তির ছবি। কয়েকটাতে আবার নর-নারীর অন্তরঙ্গ দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেসব দেখে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ওঠে ইসাবেলা। চিবুক স্পর্শ করে বুক। নিকোলাস লক্ষ্য করল। ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যভরে বলল,
“সতী! ইন্টারেস্টিং।”
রাগে জ্বলে ওঠে ইসাবেলা। নিজেকে সামলে মুখ তুলে কঠিন স্বরে বলে,
“ঈশ্বর আমাকে শক্তি দান করুক তোমাকে শেষ করার। সেদিন তোমার ঠোঁটের শয়তানি হাসি যদি মুছে না দিয়েছি তো আমার নামও ইসাবেলা নয়।”
নিকোলাস হাওয়ায় মিশে এসে দাঁড়াল ওর একদম নিকটে। হাত দ্বারা ওর কোমর বেষ্টন করে বুকের উপর টেনে আনে। নিকোলাসের এই আকস্মিক সান্নিধ্যে ঘাবড়ে যায় ইসাবেলা। ওর হাত অজান্তে থামল নিকোলাসের বুকের উপর। নিকোলাসের ঠোঁটে তখন সম্মোহনী মৃদু হাসি। সেই দাঁত দুটো এখন আর নেই। কে বলবে এ মানুষ নয়, রক্তপিপাসু? নিকোলাসের চোখের নীল সমুদ্রে চেয়ে ইসাবেলার মন নরম হয়। নিকোলাসের মুখ আস্তে আস্তে ঝুঁকে এলো ওর মুখের উপর। দুজনের ঠোঁটের মাঝে কয়েক ইঞ্চি তফাৎ। ইসাবেলার চোখের পাতা বার বার পড়ছে। নিকোলাসের ঠোঁটে চেয়ে ঢোক গিলল কয়েকবার। নিকোলাসের অন্য হাত কোমর ছেড়ে ধীরে ধীরে ইসাবেলার পিঠ ধরে উন্মুক্ত স্কন্ধে এসে থামে। চুলগুলো কাঁধের একপাশে গুছিয়ে রাখল। আলতো করে স্কন্ধের নগ্ন কোমল ত্বক ছুঁয়ে দিচ্ছে নিকোলাসের আঙুল। শিরায় শিরায় রোমাঞ্চ অনুভব করে ইসাবেলা। এতক্ষণ শক্ত করে চেপে ধরা পদ্মের ন্যায় ঠোঁটদুটো ঈষৎ ফাঁকা হয়। ওর ঈষৎ ফাঁকা ঠোঁট দুটো কাঁপছে বাতাসে দোদুল্যমান পদ্ম পাপড়ির মতো। নিকোলাসের ঠোঁট নেমে আসে ইসাবেলার ঠোঁটের তীরে। চুম্বন দিতে কাঁপুনি দিয়ে জমে যায় ইসাবেলার শরীর। সেই সুযোগে ইসাবেলাকে আরো নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিলো। ইসাবেলার বুক মিশে গেল নিকোলাসের কঠিন উদরে। কোনো পুরুষ এভাবে আগে স্পর্শ করেনি ওকে। এত কাছেও যায়নি কোনো পর পুরুষের। পিটারেরও নয়। হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল ইসাবেলার। নিকোলাস ওর ঘাড়ের সেই ক্ষততে আলতো চুমু খেয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তোমার ঈশ্বরের কাছে আগে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তিটুকু চাও। তারপর না হয় আমাকে মেরো, নির্বোধ বেলা।”
ঘোর কাটল ওর। ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল নিকোলাসের শরীর। কান্না ঠেলে এলো। মাথা নুয়ে ফেলে লজ্জায়, অপমানে। ওকে ছেড়ে পুনরায় বসল সোফার উপর নিকোলাস। ভাব ভঙ্গি এমন যে একটু আগে কিছুই ঘটেনি। বিরক্ত গলায় বলল,
“বসো নিচে।”
বিনা প্রতিবাদে কার্পেটের উপর বসে ইসাবেলা। নিকোলাস সামনের টেবিলের উপর থেকে কাপড় সরাতে সুস্বাদু সব খাবার দেখা গেল। গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে খাবারগুলো থেকে। ইসাবেলা মাথা নুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নিকোলাস বলল,
“খেয়ে নাও।”
ইসাবেলা খায় না। তেমনই কাঁদছে। নিকোলাস নরম গলায় বলল,
“খেয়ে নাও বেলা। নয়তো জোর করে খাওয়াতে বাধ্য হব আমি। আমার জোর তোমার পছন্দ হবে না, হবে কি?”
ইসাবেলা অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“তুই একটা শয়তান, শয়তান।”
“আমি জানি বেলা। এখন খাও।”
ক্ষীণ হাসি দেখা গেল নিকোলাসের ঠোঁটে। ইসাবেলা রাগ চেপে হঠাৎ জোরপূর্বক মুচকি হেসে বলল,
“আমাকে খাওয়াতে এত পীড়াপীড়ি করছ কেন, হুম? আমি না খেয়ে থাকলে কষ্ট হবে তোমার? কেন? আমার উপর মায়া জন্মে গেছে বলে? না কি আমার প্রেমে পড়েছ?”
নিকোলাস শব্দ করে হেসে পরক্ষণেই কঠিন মুখে ঝুঁকে বসে বলল,
“তোমার প্রেমে নয়, তোমার রক্তের প্রেমে পড়েছি আমি। ওই প্রেমের খাতিরে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তোমাকে। এখন তুমি খাবে, একটু পরে আমি।”
দেখতে দেখতে নিকোলাসের ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে বেরিয়ে এলো সূঁচালো শুভ্র চকচকে দাঁত।
চলবে,,,,
তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১২
Writer Taniya Sheikh
ইদানীং ওই তপ্তকাঞ্চনবর্ণ সূর্যটাকে ইসাবেলা প্রচন্ড ভালোবাসে। যতক্ষণ ওই সূর্য জ্বলে নির্ভয়ে, স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নেয় ও। কিন্তু গোধূলি নামলে ভয়ে ভেতরটা শুকিয়ে আসতে শুরু করে। প্রতি মুহূর্ত আতঙ্কে কাটে। যদিও নিকোলাস জেগে ওঠে দুপুরের পরপরই। কিন্তু এ ঘরে সে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এলেই প্রবেশ করে। তখন এক চাঁদের ক্ষীণ আলো ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো আলোয় থাকে না। পছন্দের চাঁদের আলো আজকাল আতঙ্কিত করে ইসাবেলাকে। জ্যোৎস্নার প্লাবনে চোখে ঘোর লাগে না, বরং ভীষণ এক ভয়ে চোখজোড়া বুঁজে রয়। কিন্তু সর্বক্ষণ চোখ বুঁজে রাখা বিপজ্জনক। এক নিকোলাস তার শত্রু নয়, এই চার দেয়ালের প্রতিটি ইট যেন ইসাবেলার রক্ত পানের আশায় লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অসতর্কতায় ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে একসাথে। রক্ত শুষে, ছিঁড়ে খাবে ওর দেহটাকে। একটা চাপা আর্তনাদে সচকিত হয় ইসাবেলা। শব্দটা আসছে নিচ হতে। আবার একটা শিকার ধরেছে নিকোলাস। আবার একটা মনুষ্য প্রাণ শেষ হলো ওর তৃষ্ণা মিটাতে। প্রায় এমনই আর্তনাদ শুনতে পায়। কখনও নারীর, কখনও পুরুষের তো কখনও শিশুর। ওরা বাঁচার আকুতিভরা রোদন করে। এই সুন্দর ভুবন ছেড়ে কে-ই বা যেতে চায়? কত মায়া এখানে! ইসাবেলা দু-হাঁটু বুকের সাথে জড়ো করে দু’হাতে কান চেপে ধরেছে। নিকোলাস নিষ্ঠুর, নিমর্ম। ঘৃণা করে ইসাবেলা ওকে, প্রচন্ড ঘৃণা করে। নিচ থেকে আসা আর্তনাদ থেমে গেছে। আবার সেই কঠিন নিস্তব্ধতা। ফুঁপিয়ে ওঠে ইসাবেলা। আজকাল প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছেটা মরে গেছে। মৃত্যু কামনা করে নিজের। বেঁচে থেকে রোজ রোজ এই নির্মমতা সে আর সহ্য করতে পারছে না। ইসাবেলা জানে নিকোলাস এত সহজ মৃত্যু দেবে না তাকে। আরো শাস্তি দেবে আরো। নিকোলাসের সামনে হাঁটু ভেঙে করজোড়ে মৃত্যু ভিক্ষা না চাওয়া অব্দি বুঝি মুক্তি নেই ওর। কিন্তু ভ্যালেরিয়ার শিক্ষাকে সে অপমানিত করতে পারবে না। চাইবে না মৃত্যু ভিক্ষা।
বাড়ির কথা ভীষণ মনে পড়ে ইসাবেলার। পিটার! সে কী ফিরে এসেছে? তার কী মনে পড়ে ইসাবেলাকে? মা-বাবা, তাতিয়ানা, ভ্লাদিমি, দাদু-দিদিমা সকলে কেমন আছে? ইসাবেলার জন্য নিশ্চয়ই সবাই কষ্ট পাচ্ছে। ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে নামে সে। দূর্বল পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় ব্যালকনির রেলিং ঘেঁষে। সেদিন নিজের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিকোলাস সেখানেই বন্দি করে রাখে ইসাবেলাকে। কখন যে কার্পেটের ওপরই নিদ্রা গিয়েছিল মনে নেই। নিদ্রা ভাঙতে নিজেকে এই কক্ষের বিছানায় আবিষ্কার করে। এটা যে একটা প্রাসাদ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আন্দাজ করেছে। জমিন থেকে বেশ উঁচুতে এই কক্ষ। এদিকটার বাইরের দেয়ালের পলেস্তারা খসে ইটগুলো দাঁতের মতো বেরিয়ে এসেছে। স্থানে স্থানে শেওলা পড়া, পরগাছার অবাধ বসতি। দেখেই অনুমেয় এটি প্রাচীন প্রাসাদ। কত প্রাচীন? জানার আগ্রহ বাড়ে এই প্রাসাদ সম্পর্কে।
“শুধু প্রাসাদ?” ভেতর থেকে বিদ্রুপ করে কেউ শুধায়। মাথা ঝাকায় ইসাবেলা। নিকোলাস সম্পর্কেও জানতে চায় সে? ওই পিশাচকে ধ্বংস করতে হলে আগে তো জানতে হবে তার সম্পর্কে। কিছু না কিছু তো আছে যা দ্বারা ওর ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু কী সেটা? কীভাবে জানবে সেই সব কিছু ও? এই কক্ষে বন্দি হয়ে থাকলে সেসব প্রশ্নের জবাব সে পাবে না। মনে মনে পরিকল্পনা করে নিলো আগামীকাল প্রত্যুষে প্রাসাদটা ঘুরে দেখবে। কিছু যদি না পাওয়াও যায় অন্তত এখান থেকে পালানোর একটা পথ ও খুঁজে বের করবে।
অদূরের উইলো গাছের আড়ালে সূর্যটা আস্তে আস্তে অস্ত যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামবে একটু পরেই। সন্ধ্যা যেন আতঙ্কের নাম! যতদূর চোখ যায় ঘন বন। ক্রমশ ধোঁয়াশার জালে জড়িয়ে যাচ্ছে বন।
এখানে দাঁড়িয়ে কোনো লোকালয় সে দেখতে পায় না। তবে কী লোকালয় বিচ্ছিন্ন এই প্রাসাদ? প্রাসাদের দক্ষিণে ছোট্ট একটা নদীর আংশিকাংশ দেখা যায়। গোধূলির বেলায় ওর জলে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তন্ময় হয় সে। ইতোমধ্যে গোধূলির লালিমা মুছে গিয়ে আঁধার নেমে এসেছে। ইসাবেলা ফিরে এলো বিছানায়। যে কোনো মুহূর্তে নিকোলাসের আগমন ঘটতে পারে। সেটাও সম্ভাব্য। দিন তারিখের সঠিকতা জানা নেই ইসাবেলার। তবে হিসেব করলে প্রায় দুই সপ্তাহ হয় এই প্রাসাদে এসেছে সে। এরমধ্যে মাত্র তিন সন্ধ্যে নিকোলাসের মুখোমুখি হয়েছিল। ঘৃণায়, ক্ষোভে সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। নিকোলাস ওর খুব কাছে বসে যখন সম্মোহনী গলায়”বেলা” বলে ডাকে, না চাইতেও তাকায় ওর চোখে। আর তারপরেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যায়। কিছুতেই মনে করতে পারে না তখনকার স্মৃতি। শুধু ঘুম ভাঙলে শরীরটা অবসন্ন আর দূর্বল লাগে। কিন্তু তারপরের চার দিন নিকোলাসের দেখা মেলেনি। পরের সপ্তাহে ঘটে আরেক ঘটনা। এক সকালে ঘুম থেকে জেগে রুমের সেলফে কিছু পুরোনো বই দেখতে পায় সে। খুব বেশি বই পড়ুয়া মেয়ে নয় ইসাবেলা। ভাইবোনদের মধ্যে বইয়ের পোকা একমাত্র ভ্লাদিমি। ইসাবেলা টুকটাক অবসরে পড়ত। এখানে ওর অখন্ড অবসর। সারাদিনে তেমন বই না পড়লেও রাতে একটু আধটু পড়ে। তাতে ঘুমটা তাড়াতাড়ি নামে চোখে। ঘুমিয়ে রাতের বিভীষিকা এড়াতে চায় ও। সেদিন রাতে হোমারের ইলিয়ড পড়ছিল। হঠাৎ খিলখিল হাসির শব্দে লাফ দিয়ে বিছানার উপর উঠে বসে। টিমটিপে তেলের বাতির আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেল ইভারলির সুশ্রী মুখ। ওর লাল চুলগুলো কতকটা দু-কাঁধ ছাড়িয়ে নেমে গেছে। ডাগর চোখ, লাল টুকটুকে ওষ্ঠজোড়ায় মোহনীয় হাসি। পরনে কালো রঙের অফ সোল্ডার ফ্লোরাল গাউন।
“ইসাবেল, আমার প্রিয় ইসাবেল।”
দেহটাকে ছন্দোময় করে এগিয়ে এলো ইভারলি। ইসাবেলা দরজার দিকে তাকায়। আশ্চর্য! দরজা ভেতর থেকে দেওয়া। আর্ত হয়ে ওঠে। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। ইভারলি ঝুঁকে ওর চিবুক তুলে বলল,
“ইসাবেল, তাকাও আমার চোখে, তাকাও প্রিয় আমার।”
ইভারলির সম্মোহনী গলার স্বর উপেক্ষা করতে পারল না ইসাবেলা। তাকাল ওর চোখে। মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেল সাথে সাথে। ইভারলি ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। আঁজলা ভরে ওর মুখটা তুলে বলল,
“তোমায় আমি খুব ভালোবাসি ইসাবেল। নিকোলাস তোমাকে কষ্ট দেয় তা যে আমার সহ্য হয় না। তাই তো এলাম। এবার তোমাকে মুক্তি দেবো আমি। চাও না মুক্তি তুমি? বলো চাও?”
ইসাবেলা ঘোরের মধ্যে মাথা নাড়ায়। ইভারলির হাসি আরো প্রসস্থ হয়। জড়িয়ে ধরে ইসাবেলাকে।
“তোমায় সেদিন খুব কষ্ট দিয়েছিলাম তাই না ডার্লিং? আজ ভালোবেসে সব কষ্ট মুছে দেবো। খুব ভালোবাসব আজ তোমাকে আমি। খুব।”
চাপা মোহমুগ্ধ গলায় বলল ইভারলি। ইসাবেলা ওর উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ পাচ্ছে গলায়। ভেতরে ভেতরে তীব্র ঘৃণায়, অস্বস্তিতে ছটফট করছে সে। কিন্তু প্রকাশ্যে নিশ্চল, মোহাচ্ছন্ন। ডায়নিটার জালে আঁটকে পড়েছে। ইভারলি উদ্দেশ্য বুঝতে বাকি নেই ওর। নিকোলাসের মতো সেও এসেছে ইসাবেলার রক্ত পান করতে। নিকোলাস বাঁচিয়ে রেখেছিল, ইভারলি তা করবে না। ইভারলি তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত ওর রক্তনালিতে ফুটিয়ে দেয়। দু’হাতে ঠেলে সরাতে চাইছে কিন্তু পারছে না। কেউ যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। হঠাৎ সামনের দরজা সশব্দে খুলে গেল। রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস। আগুনের ন্যায় জ্বলছে ওর চোখজোড়া।
চেঁচিয়ে উঠল,
“লি”
হাওয়ায় মিশে ইভারলির ঘাড় ধরে টেনে সরিয়ে নেয়। ইসাবেলার ঘোর কাটল তখনই। জোরে জোরে শ্বাস নেয়। ইভারলির একটু আগের স্পর্শে গা ঘিন ঘিন করছে। ঘাড়ের কাছে হাত দিতে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। নিকোলাস তাকাল ওর দিকে। তারপর ইভারলির গলা চেপে ধরে গর্জে ওঠে,
“এত বড়ো স্পর্ধা তোর? কোন সাহসে এসেছিস এ ঘরে? নিষেধ করেছিলাম কি না? বল নিষেধ করেছিলাম কি না এ ঘরে আসতে?”
ইভারলি কিন্তু একটুও ঘাবড়াল না। হেসে ঢলে পড়ল নিকোলাস গায়ের ওপর। হাতের আঙুল চালাল ওর চোয়ালে। ওর কর্ণ লতিকায় মৃদু কামড়ে প্রলুব্ধ কণ্ঠে বলল,
“নিকো, আমি তো ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছিলাম। ভাবলাম একা থাকে, তাই চলে এলাম সঙ্গ দিতে। তুমি বুঝি রাগ করলে? এসো আমার ভালোবাসায় তোমার সব রাগ ভুলিয়ে দেবো।”
নিকোলাস ওর গলা চেপে ধরে মুখটা দূরে সরিয়ে দেয়। ইভারলির ঠোঁটে আবেদনময়ী হাসি। নিকোলাস ইসাবেলার অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। ইসাবেলা ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিতে ইভারলিকে সাথে করে বেরিয়ে গেল কক্ষ ছেড়ে। এরপর পুরো সপ্তাহে ওর চেহারা দেখেনি ইসাবেলা। তাতে অবশ্য ভালোই আছে সে। শরীরের অবসন্নতা খানিকটা কেটেছে। ঘাড়ের ক্ষততে আজ আবারও হাত বুলাল ইসাবেলা। ব্যথা নেই আগের মতো সেখানে। শুকিয়ে আসছে ক্ষত। এতেই প্রমাণিত আজকাল নিকোলাস ওর রক্ত পান করছে না। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সোজা হয়ে বসল। নিকোলাস আসেনি। সে কখনও দরজায় কড়া নেড়ে আসে না। ইসাবেলা মৃদু গলায় বলল,
“আসুন।”
কালো পোশাক পরিহিত ভৃত্যটি খাবারের ট্রে হাতে রুমে ঢুকলো। এই ভৃত্যটি ওদের মতো পিশাচ নয়। কিন্তু নিকোলাসের বশীভূত। দেখতে যেন পাথর মানব মনে হয়। মুখ, চোখের হাবভাবে কোনোভাবেই স্বাভাবিক মানুষ বলা যায় না তাকে। কয়েকবার ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু টু শব্দটি করেনি সে। ইসাবেলার মাঝেমধ্যে মনে হয় ও বুঝি মূক। কলের পুতুলের মতো খাবার রেখে দরজার দিকে যাচ্ছিল। ইসাবেলা সাহস করে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কি এখানেই থাকেন? নাম কী আপনার?”
ভৃত্যটি থমকে দাঁড়াল। নিরস চোখে একবার তাকিয়ে সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দ্রুত পদে বেরিয়ে গেল কক্ষ ছেড়ে। হতাশ মুখে খাবারের ট্রের দিকে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। দু-চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলো এই খাবারের জন্য, প্রার্থনা করল এই নরক থেকে মুক্তির। কভু কী মুক্তি পাবে সে? ঈশ্বর কী পাঠাবেন কাওকে তাকে মুক্ত করতে? এই অমানিশার মাঝেও আলো খোঁজে ইসাবেলা। এক চিলতে প্রাণের আলোকশ্মি।
চলবে,,,
তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১৩
Writer Taniya Sheikh
সারারাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করে ভোরের দিকে চোখজোড়া লেগে এসেছিল ইসাবেলার। অদূরে বন মোরগের ডাকে কাঁচা ঘুম ভাঙল। তড়িঘড়ি নেমে এলো বিছানা ছেড়ে। চুল আচরে, কাপড় পালটে তৈরি হলো প্রাসাদের রহস্য ভেদের মিশনে। কিন্তু এখনই বের হওয়া রিস্ক। ভৃত্য নাস্তা নিয়ে আসবে ঠিক সাতটার দিকে। ইসাবেলা ঘড়ি ধরে সময়টা খেয়াল রেখেছে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট ওই টাইমেই ভৃত্যটির আগমন ঘটে। সুতরাং, অপেক্ষা করতে হলো সাতটা বাজার। ততক্ষণে প্লান কষে নিলো। নিকোলাস দুপুরের আগে জাগবে না। এর মধ্যেই যা করার করতে হবে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিলো সাথে করে। সুযোগ পেলে পালিয়ে যাবে আজই। ঘড়িতে সাতটা বাজতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। ইসাবেলা ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিতে ভৃত্যটি প্রবেশ করল। ট্রেতে আজ শুকনো রুটি, মাখন, চিজ আর টমেটো স্যালাড। ইসাবেলা অপেক্ষা করে ভৃত্যটির প্রস্থানের। সে চলে যেতে ইসাবেলা গাপুসগুপুস রুটি আর চিজ মুখে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আরেকটু বিলম্ব করে বাইরে বেরোতে। ভৃত্যের পায়ের শব্দ আর পাওয়া যাচ্ছে না। আস্তে করে দরজাটা ফাঁক করে মুখটা বের করে এদিক ওদিক দেখে নিলো। দোতলার মার্বেল পাথরের করিডোর। ভৃত্যের পদচিহ্ন ছাড়া আর কিছু পেল না সেখানে। সতর্কে পা বাড়াল কড়িডোরে। পা টিপে টিপে এগিয়ে কড়িডোরের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাল। গুমোট অন্ধকার পুরো প্রাসাদ জুড়ে। এখানে ওখানে মাকড়সার জাল জড়ানো। হলঘরে কাওকে দেখতে পেল না। ইসাবেলা ধীর পায়ে করিডোর ধরে এগোতে লাগল। বুক ঢিপঢিপ করছে ভয়ে। চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নেয়। বাইরের মতো এই প্রাসাদের ভেতরের সৌন্দর্য ততটা ম্লান হয়নি। এর আভিজাত্য, রাজকীয় জৌলুশ প্রাসাদের দেয়ালে দেয়ালে এখনো খানিকটা উজ্জ্বল। কিন্তু বহু বছরের অযত্নে ধুলোর পুরু আস্তরণ পড়েছে। মাকড়সার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে যতদূর চোখ যায়। দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো পুরোপুরি পৌঁছায়নি। প্রাসাদের ভেতরটা বেশ শীতল। কেমন ধোঁয়াটে ভাব সর্বত্র জুড়ে। গা ছম ছম করছে ইসাবেলার। গোলাকৃতির কড়িডোর পুরো দোতলায়। ইসাবেলার রুমটি পশ্চিমের দিকে। সামনে আরো দুটো বন্ধ দরজা পেল। ওদিকে আরো অনেকগুলো আছে। জং ধরা, মাকড়সার জালে আবদ্ধ তালা দেখলে বোঝা যায় বহুবছর তালাবন্ধ রুমগুলো। জানালা খোলার চেষ্টা করল একটার, কিন্তু বন্ধ সেটা। হাত দিয়ে জানালার কাঁচের ময়লা মুছে ঘরের ভেতরটা দেখতে চায়। স্পষ্ট করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবল কিছু আসবাবপত্র চোখে পড়ল। সামনের সবকটা রুমেরই একই অবস্থা। সিঁড়ির মুখে এসে থামল ও। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নিচের হলঘরে গিয়ে মিশেছে। ইসাবেলা একবার ভাবল পুরো দোতলা ঘুরে দেখা যাক। যদি কোনো তালা খোলা যায় কোনো রুমের? যদি নিকোলাসকে পাওয়া যায়? সে জানে নিকোলাসকে মারার এই উপযুক্ত সময়। কিন্তু যদি অন্য কেউ সেখানে থাকে? মৃত্যু এই প্রাসাদের দেয়ালের ইটের ভাঁজে ভাঁজে ওঁৎ পেতে আছে। প্রতি মুহূর্তে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে তাকে। নিকোলাসকে শেষ করার আগে এখান থেকে বেরোনোর পথটা আগে দেখে নিলে ভালো হয়। এই ভাবনায় নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো সে। এত বড়ো হলঘর আগে কখনো দেখেনি। গল্প কাহিনিতে যেমন রাজকীয় মহলের বর্ণনা করা হয়, এটা কতটা তেমনই। একসময় হয়তো এখানে বলের আয়োজন হতো। শতশত মানুষের পদচারণা, কোলাহলে মুখর ছিল এই হলঘর। সময়ের বিবর্তনে আজ সেই মুখর হলঘর নিস্তব্ধ। ধুলো আর মাকড়সার জালে ভূতুড়ে কুয়াশাজড়ানো। বন্ধ জানালার শার্সির ফাঁক গলে আসা আলোও ভীত হয়ে গুটিশুটি মেরে এককোণে লুকিয়ে গেছে। যত সামনে এগোচ্ছে নাকে এসে লাগছে উৎকট গন্ধ। ইসাবেলা সদর দরজা খুঁজতে শুরু করে। সাবধানে পা ফেলে এগোল সামনে। ওর নিজের পায়ের শব্দও বড্ড কানে লাগছে। বাড়িয়ে দেয় বুকের ঢিপাঢিপানি। অসতর্কে সে পায়ের ছাপ ফেলে যাচ্ছে ধুলো জমা ফ্লোরের ওপর। সদর দরজা খুঁজে পায় না ইসাবেলা। এই ভ্যাপসা আঁধারে কোনটা যে দরজা তাই ঠাহর করা মুশকিল। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে আঁতকে ওঠে। কোথায় লুকাবে এখন সে? সামনেই ধুলো পড়া, মাকড়সার জালে আবদ্ধ বড়োসড়ো কিছু একটা দেখতে পেল। লুকিয়ে পড়ল তার পাশে। আড়ালে বসে দেখল একটা মানবীয় ছায়া ওপাশ থেকে ধীরে ধীরে হলঘরের মাঝে এসে থামল। চিনতে সমস্যা হলো না ভৃত্যটিকে। এক মাথা কটা কোঁকড়া চুল আর ময়লা পোশাক পরনে। পা দুটো নগ্ন। যখনই দেখেছে চোখদুটো সবসময় মাটির দিকে থাকে। ওদিকে কোথায় গিয়েছিল সে? ভাবল ইসাবেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভৃত্যটি আবার এগিয়ে গেল সামনে। এরপরেই ঝপাৎ করে সূর্যালোকে আছড়ে পড়ে এই হলঘরে। সদর দরজা খুলে ভৃত্যটি বেরিয়ে যায়। দরজা আবার বন্ধ হলো। পুনরায় নেমে এলো সেই গুমোট অন্ধকার। ইসাবেলা উঠে দাঁড়ায়। পা টিপে দরজার দিকে গেল। দরজায় খিল আঁটা নেই। ইসাবেলা খুলল না দরজা। কান পেতে রইল। বাইরে ঘোড়ার নাক ছিটকানো ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেল না। অগত্যা সরে এসে এক চিলতে আলো অনুসরণ করে জানালার শার্সি খুলে চোখ রাখল বাইরে। চোখ দুটো তৎক্ষনাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বাইরে টমটমগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এই মোক্ষম সুযোগ পালানোর। কিন্তু কোচওয়ান কোথায়? আরেকটু খেয়াল করতে ভৃত্যটিকে এদিকেই ফিরে আসতে দেখল। দ্রুত আগের স্থানে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে সে। ভৃত্যটি এবার হলঘরের অন্যদিকে হেঁটে গেল। ইসাবেলা কালক্ষেপণ না করে উঠে দাঁড়ায়। যে জিনিসটার আড়ালে লুকিয়ে ছিল তার গায়ে হাত দিতে টুং করে বেজে ওঠে। সাথে সাথে নিস্তব্ধ হলঘরের এদিকটা সরগরম হয় ইঁদুর খচখচানি আর বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে এলো ওর। এই বুঝি ছুটে এসে আক্রমণ করবে ইঁদুর আর বাদুড়ের দল। পাশের দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে রইল অনেক সময়। একটু পর আবার সেই নিস্তব্ধতা নেমে আসতে জিনিসটার সামনে এসে দাঁড়ায়। টুং করে বেজে ওঠা জিনিসটা ভালো করে দেখল। একটা পিয়ানো! ময়লা আর মাকড়সার জাল জড়িয়ে পিয়ানোর বেহাল দশা। চিনে ওঠায় মুশকিল। ইসাবেলার মা আন্না মেরিও চমৎকার পিয়ানো বাজাতে পারেন। মেয়েকেও শিখিয়েছেন নিজের পছন্দের বাদ্যযন্ত্রটি। পিয়ানো দেখে মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ল ইসাবেলার। চোখ ছলছল করে। নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সদর দরজার কাছে। সদর দরজা খুলবে কিন্তু থেমে গেল তখনই। ভেতরে প্রতিশোধস্পৃহা দপ করে জ্বলে ওঠে। নিকোলাসকে সহ ওই পিশাচগুলোকে এভাবেই ছেড়ে যাবে? ভ্যালেরিয়ার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে না? কেবল নিজের কথায় ভাবছে? নিজের এই স্বার্থপরতায় মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করে। ফিরে এলো সদর দরজা থেকে। সে আজই পালাবে কিন্তু নিকোলাসকে মেরে। যদি না পারে তবে আবার ফিরে আসবে উপযুক্ত হাতিয়ার সমেত। তার আগে শেষ চেষ্টা করা যাক। কোথায় পাবে নিকোলাসকে এই মুহূর্তে? দোতলার সব রুম তালাবন্ধ। আগে নিচে খুঁজে দেখা যাক। একটু আগে ভৃত্যটি যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকেই গেল। দরজাটা ভেজানো ছিল। ইসাবেলা দরজাটা ঠেলতে একটা সিঁড়ি দেখতে পেল। সিঁড়িটা এঁকেবেঁকে নিচে নেমে গেছে। ইসাবেলা আস্তে আস্তে নেমে এলো। যত নামছে সামনের অন্ধকার ঘন হচ্ছে। শেষের সিঁড়িতে পা দিয়ে বিস্ময়াহত। প্রাসাদের এই স্থানটি হলো কবরস্থান। স্যাঁতসেঁতে মাটির গন্ধে নাক কুঁচকে ফেলে ইসাবেলা। হঠাৎ ওর একটা ব্যাপার খেয়াল হলো। এই গন্ধটা ওর চেনা। নিকোলাসের সান্নিধ্যে এলেই গন্ধটা টের পেত। শুধু নিকোলাস নয়, আন্দ্রেই এবং ইভারলির গা থেকেও এই একই গন্ধ পেয়েছিল। তবে কী এখানেই আছে ওরা? মনের ভয়টা আরো গাঢ় হলো ওর। কী করবে? ফিরে যাবে? ঘুরে দাঁড়ায় সিঁড়ি ওপরের দিকে। এক পা ওপরে দিতে থেমে গেল। এককোণে ল্যাম্পের বাতি জ্বলছে। ওই টিমটিমে আলো কিছুটা যেন দূর করেছে কবরস্থানের আঁধার। ইসাবেলা ওটা হাতে তুলে নেয়। নরম মাটিতে পা ফেলে আলোটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল চারপাশটা। দৃষ্টি স্থির হয় দেয়ালের কোন ঘেঁষা বস্তুর ওপর। তিনটে কফিন! ইসাবেলা শুকনো ঢোক গিলে ভয়টাকে একপাশে সরিয়ে কফিন তিনটের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত কাঁপছে ওর। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলো। ঈশ্বরের নাম জপল কয়েকবার। তারপর চোখ মেলে তাকায় কফিন তিনটের দিকে। বার্নিশ করা কাঠের চকচকে কফিন তিনটে। হাতের আলোটা একটার উপর রেখে প্রথম কফিনটা খুলল। হতাশ হলো ইসাবেলা। কিছুই নেই ভেতরে। তারপর আরেকটার পাল্লা সরাতেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই তো নিকোলাস! আলোটা হাতে নিয়ে ঝুঁকে দেখল ওর মুখ। নিকোলাস ওর কাছে ভয়ের, আতঙ্কের আরেক নাম। কিন্তু আজ ওকে দেখে ইসাবেলার আনন্দই হলো। প্রথমদিন দেখা নিকোলাসের চেয়ে এই ঘুমন্ত নিকোলাস যেন আরো সুদর্শন। ঘুমন্ত অবস্থা ভারী নিষ্পাপ দেখাচ্ছে তাকে। কে বলবে এই নিদ্রারত নিষ্পাপ মানবীয় দেহের মধ্যে লুকিয়ে আছে একটা হিংস্র, নিষ্ঠুর পিশাচ। নিকোলাসের লাল টুকটুকে ঠোঁটে স্মিত হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় ইসাবেলা। সে কি টের পেয়েছে ইসাবেলার উপস্থিতি? ভীত হয় ইসাবেলা। সেধে সিংহের গুহায় ঢুকে পড়ল না তো? এখন যদি জেগে ওঠে শয়তানটা? এখান থেকে সিঁড়ির দূরত্ব আরেকবার দেখে নিলো। নিকোলাস জেগে উঠলে ভোঁ দৌড় লাগাবে। কিন্তু সে জানে, তাতে খুব একটা সফল হবে না। শয়তানটা জাগলে মৃত্যু নিশ্চিত আজ ওর। নিকোলাসের মুখের দিকে তাকায় ফের। ওর ঠোঁটের স্মিত হাসি আরো দীর্ঘায়িত হয়েছে। ইসাবেলার ভয় পাওয়া মুখটা দেখেই বুঝি মজা পাচ্ছে সে। রাগে পায়ের তলা জ্বলছে ইসাবেলার। মুখ কঠিন করে আলোটা হাতে তুলে পরের কফিনটা খুললো। একটা অপরিচিত সুন্দরী যুবতি শুয়ে আছে সেখানে। তাকে আগে কখনও দেখেনি ইসাবেলা। মেয়েটার মুখটা ভালো করে দেখল। নিকোলাসের সাথে বেশ মিল আছে ওর। তবে কী নিকোলাসের বোন মেয়েটি? সে সরে এলো নিকোলাসের কফিনের কাছে। জোর করা মুচকি হাসি হেসে বলল,
“আমাকে এখানে দেখে নিশ্চয়ই খুশি হওনি তুমি, হুম? ভেবেছিলে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে রুমের এককোণে লুকিয়ে থাকব?”
ইসাবেলা আরেকটু ঝুঁকে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“আমি জানি তুমি শুনতে পাচ্ছ। শোনো, তোমাকে আমি ভয় পাই না নিকোলাস কুরিগিন। ওহ! আচ্ছা তোমার আসল বংশ পদবী কী? আমি নিশ্চিত সেটা কুরিগিন নয়। উম, লুসিফার? নিকোলাস লুসিফার। ওয়াও! দারুন মানিয়েছে নামটা। শয়তানে শয়তানে মাসতুতো ভাই।” নিকোলাস হাসছে নিঃশব্দে। ওর ঘুমন্ত মুখে সে হাসি স্পষ্ট দেখতে পাওয়া গেল। ইসাবেলা সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
“তুমি জানো আজ আমি পালাব তোমার এই নরক থেকে? হুম, পালিয়ে যাব। কিন্তু ভীতুর মতো নয়। তাইতো তোমাকে বিদায় জানাতে এলাম।”
এবার নিকোলাসের ঠোঁটের হাসি উবে গেল। শক্ত হয়ে উঠেছে চোয়াল। ইসাবেলা নিষ্পাপ মুখ করে বলল,
“ওমা! রাগ করলে?”
ঠিক তখনই খুলে গেল নিকোলাসের চোখ। আগুনের শিখার ন্যায় জ্বলছে চোখ দুটো। ইসাবেলা লাফ দিয়ে উঠল ভয়ে। বুক ধড়ফড় করছে ওর। এই বুঝি উঠে এসে গলা চেপে ধরবে নিকোলাস। কিন্তু না, সে তেমনই শুয়ে আছে। ঠিক যেন প্যারালাইজড রোগী। সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে এসে ইসাবেলা বলল,
“আমার মা বলতেন অত্যাচার সহ্য করাও একপ্রকার অপরাধ। আমার সাথে যা যা করেছ আজ সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেবো তোমাকে। না, তোমার রক্ত পান করব না। ও কাজ কেবল তোমার মতো শয়তানের।”
ইসাবেলা প্রজ্জ্বলিত ল্যাম্পটা হাতে তুলে নেয়। নিকোলাস ক্ষুব্ধ চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে। ইসাবেলা মৃদু হেসে কটমট করে বলল,
“তোমার সেই প্রেমিকা কোথায়? হারামজাদিটা আমাকে খুব মেরেছিল। আবার এসেছিল ভাব জমিয়ে রক্ত পান করতে। আমার রক্তে মধু আছে, হ্যাঁ? যে কেউ দৌড়ে আসে রক্ত চুষবে বলে। মন তো চেয়েছিল হারামজাদিকে কেটে টুকরো টুকরো করে ওই নেকড়ে দিয়ে খাওয়ায়। আজ ওকেও শেষ করে যেতে পারলে শান্তি হতো। কিন্তু সময় নেই আজ আমার হাতে। কিছুদিন অপেক্ষা করো নরকে গিয়ে। তোমার ওই ভালোবাসায় ভরিয়ে দেওয়া প্রেমিকাকেও পাঠাব সেখানে আমি। তারপর তোমার যত জ্ঞাতিগুষ্টি আছে সব গুলোকে। তোমার সৎমার সাথে হিসেব এখনও বাকি আমার। আমার ভ্যালেরির মৃত্যু শোধ নিয়েই ছাড়ব।”
তারপর হঠাৎ ভাবনায় বুঁদ হলো সে। ভাবনা থেকে বেরিয়েই নিকোলাসের গালে কষে চড় বসিয়ে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলল,
“কেন মারলাম জানো? এই যে ঠোঁটের কিনারে চুমু দিয়েছিলে সেদিন, সেই জন্য। আমার জীবনের প্রথম চুমু, প্রথম সবকিছু পিটারের জন্য। তোমার মতো শয়তান, পিশাচের জন্য নয়। আমি তোমাকে ঘৃণা করি নিকোলাস। সারাজীবন ঘৃণা করব।”
হাতের ল্যাম্পটা কফিনের কাঠের কাছে ধরে ইসাবেলা। একটু একটু করে আগুন জ্বলে ওঠে কফিনের কাঠে। ইসাবেলা প্রসন্ন মুখে বলল,
“আলবিদা, নিকোলাস।”
মেয়েটির কফিনে কেন যেন আগুন দিতে গিয়েও দিলো না ইসাবেলা। পুড়লে সবই পুড়বে আস্তে আস্তে। সিঁড়িতে উঠে এলো সে। দাউদাউ করে নিকোলাসের কফিনে আগুন জ্বলছে। সেই আগুনে স্পষ্ট দেখা গেল শায়িত নিকোলাসের মুখ। রাগান্বিত চাহনিতে ইসাবেলার দিকেই তাকিয়ে আছে সে।
চলবে,,,,