তিনি এবং ও !
৩৪.
হলুদ রঙের লুঙ্গি আর নীল রঙের হাফ হাতা গেঞ্জি পড়ে নিদ্র খাবার টেবিলে অধীর আগ্রহে বসে আছে। খুব খিদে পেয়েছে, সেই সকাল থেকে এই পর্যন্ত সে না খাওয়া। দুপুর ২ টা বেজে ২০ মিনিট।
সুফি সাহেবের বাসা থেকে রীতিমত সে পালিয়ে এসেছে। সুফি সাহেবের স্ত্রী তাকে খুব সাবধানে বাসা থেকে বের করেছেন। নিদ্র রাস্তায় পা দেয়ার পর সুফি সাহেবের স্ত্রী মাথা নিচু করে বললেন
– কিছু মনে করবেননা না খাইয়ে আপনাকে যেতে দিচ্ছি। মৌরি কোনোভাবে যদি জেনে যেত আপনি চলে যাচ্ছেন, তাহলে ও আপনাকে যেতে দিতো না। হয়তোবা আপনার সাথেই রওনা হতো।
নিদ্র কী বলবে ঠিক ভেবে পাচ্ছিলোনা।সুফি সাহেবের স্ত্রী বুঝতে পেরে বললেন
– আপনি এখনি যান। ও চলে আসলে বিপদে পড়বেন।
এতো সকালে এসব গ্রাম্য এলাকায় রিক্সা, ভ্যান কিছুই পাওয়া যায়না। শহরের বাড়ি বিক্রি করে এরকম স্থানে আসার কারণ কি অনুশোচনা?
হতেও পারে,আবার নাও পারে। নিদ্রকে এই মানুষ টাকেই বিশ্বাস করতে হবে। তাছাড়া কোনো উপায় নেই। অদ্রি আর ইখলাস সাহেব সম্পর্ক এ অনেকেই জানতে পারে কিন্তু অদ্রি তাকে সুফি সাহেব ছাড়া কাউকে চিনেন না। সুফি সাহেবও তাকে ঘটনা বলেছেন কিন্তু চরিত্রের নাম বলেননি। হয়তোবা সুফি সাহেব চাননা তাদের সাথে আমার দেখা হোক বা এমন কোনো সত্য যেন আমি জানতে পারি। ইখলাস সাহেব যে মানুষ টা সুবিধার ছিলেননা সেটা তো বাবার বন্ধুর কাছ থেকেই জেনেছি।
নিদ্র চিন্তার খেই খুঁজে পাচ্ছেনা। সে যা শুনেছে তা কি সত্যি?
অদ্রিকে জানাবে নাকি জানাবে না? এভাবে একটি মেয়েকে অন্ধকারে ডুবে যেতে দেয়া যায়না। কতোই বা বয়স এই মেয়ের। নিদ্রের ২-১ বছরের বড়। এই বয়সে তো আজকালকার মেয়েরা বিয়েই করেনা আর তো বিধবার জীবন!
লিলি রান্নাঘরের দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
হলুদ রঙের লুঙ্গী?ভাগ্যিস তার গায়ের রঙ ফর্শা, তা না হলে খাটি খ্যাত লাগতো।
লিলি আজকাল একটা বিষয় খেয়াল করেছে, অদ্রি বেশ হাসিখুশি থাকে। আগের মতো গুমোট হয়ে থাকেনা। সাদা গোলাপ নিজ হাতে ছিঁড়ে এনে ঘর সাজায়। সাদারঙ টা সে পছন্দ করছেনা।
হালকা গোলাপি বা হলুদ বা সবুজ রঙটা তাকে টানছে।
সুফি সাহেব বারান্দায় একমনে কী যেন ভাবছেন।
সত্য বলতে ভাবতে হয়না বেশি বা পরিকল্পনাও করতে হয়না। আর মিথ্যে বলতে হলে আটঘাট বেধে নামতে হয়। মিথ্যে বোকা মানুষ বলতে পারেনা, মিথ্যা বলতে হলে চালাকচতুর হতে হয়। যেন সেটা ধরা না পড়ে।
সুফি সাহেব মিথ্যে বলতে তেমন একটা পছন্দ করেননা। কিন্তু মাঝেমধ্যে বলতে হয়।
ইতি কে সেই অফিসে ডেকে এনেছিলেন। অবশ্য কাজটা সে পরোক্ষভাবে করেছিলেন। নিষিদ্ধ পল্লীর সেই ইতি অনেক বেশি সুন্দরী ছিলো। তিনি টাকা খাইয়ে ওই মেয়েকে ফুসলেফাসলে এনে ছিলেন।
ফুসলেফাসলে কথাটা ঠিক না। অতি মাত্রায় ভালবাসতো মেয়েটি ইখলাস সাহেবকে। ইখলাস সাহেবও তাই কিন্তু তিনি গ্রহণ করবেন না স্ত্রী হিসেবে? কেনো রে প্রয়োজন তো একসময় ঠিকই মিটিয়েছেন আর সামাজিক মর্যাদা দিতে সমস্যা?
এরকম ভালবাসার কী প্রয়োজন? যাকে গ্রহণ করতে পারবো না!
সুফি সাহেব চেয়েছিলেন ইখলাস সাহেব আর ইতিকে এক করে দিতে আর অদ্রিকে মুক্তি দিতে। কিন্তু হয়ে গেলো উল্টো।
ইতি ইখলাস সাহেবের সামনেই আত্মহত্যা করেছিলো।
ইতিকে সে সবকিছু দিতে পারবে কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি দিতে পারবেননা। এক কথায় দুই কথায় ইতি ডেড।
ইখলাস সাহেব আমার চালাকি টা কিছুটা হলেও ধরতে পেরেছিলেন তাই তো আমাকে বিশ্রী ফাঁদে ফেলে দিয়ে গেলেন।
টাকা থাকলে গুপ্তচর পাওয়া অসম্ভব কিছুনা। গুপ্তচর অবশ্য এখনো আমার আছে। নিদ্রের পিছনে লাগিয়েছি। আসলেই কি সে অদ্রির শুভাকাঙ্ক্ষী নাকি ধ্বংস কামনাকারী ; জানতে হবেনা তাকে?
মেয়েটাকে সেই তো মুক্তি দিয়েছে। তবে পুরোটা দিতে পারিনি। এখন যদি এই অল্পবয়সী আবেগী ছেলেটা পারে।
দুটি প্রাণের জন্য তার মাঝে কখনওই অনুশোচনা জাগেনা আর জাগবেও না। কারণ, একটি ঠাণ্ডা মাথার শয়তান কে সে ধ্বংস করেছে। কোনো মানুষ কে সে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়নি। একজন অসুস্থ মানসিকতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইখলাস সাহেব।
নিজের ফুফুকে সে গলাটিপে হত্যা করেছেন আমার সামনে। আমি কিছুই করতে পারিনি। একজন অসহায় বৃদ্ধা মহিলা যে,এই ইখলাস কে তিলেতিলে বড় করেছে তার নিশ্বাসবন্ধ করে দিতে তিনি পিছুপা হননি।
আমার তখন কিছুই করার ছিলোনা। আমাকে উনি ভীষণ ভাবে আটকে রেখেছিলেন এক বিশ্রী ফাঁদে। অদ্রিকে ফুফু সম্পর্কে জানানো হয়েছিলো – তিনি তার নিজ বাড়িতে চলে গেছেন।
এসব সত্যি আমি ফাঁস করে দিলে আমিই ফেঁসে যাবো।
কী দরকার নিজের পায়ে কুড়াল মারার?
ভালোই তো আছি বউ, বাচ্চা নিয়ে।
অদ্রি হালকা নীল রঙের সালোয়ার
কামিজ পড়েছে। ভেজা চুল গুলো ঘাড়ের এক পাশ দিয়ে এলিয়ে দিয়ে সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে।
নিদ্র অদ্রিকে বেশিরভাগ সময় এভাবেই দেখেছে। তবে আজকে একটু পার্থক্য আছে। অদ্রির মাথায় ঘোমটা আজ নেই। হালকা নীলে তাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। নিদ্র দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে আর ভাবছে ঘরে ঢুকবে কি ঢুকবেনা?
অদ্রি বুঝতে পারছে নিদ্র ঠিক তার ঘরের দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
ভিতরে আসছে না কেনো সে তার কারণ খুঁজে পাচ্ছেনা।
অদ্রির মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ব্যবহার, কথাবার্তা, স্টাইলে। মেয়েটা আসলেই সুন্দর। নিদ্র বলল
– ভিতরে আসতে পারি?
অদ্রি পিছন না ফিরেই বলল
– হ্যা পারেন।
– গল্পগুজব করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু আপনাকে দেখে তো সেরকম গল্পের মুডে আছেন বলে মনে হচ্ছেনা।
– যুক্তিটা বলবেন নিদ্র সাহেব?
– উদাসীন হাওয়া যেন আপনার মনের কোণ জুড়ে বয়ে যাচ্ছে।
– তো হাওয়া টা কোথা থেকে আসছে জানেন?
– মনে হচ্ছে আপনার প্রিয় জানালা থেকে।
– আপনার গবেষণা সবসময় ঠিক হয়না সেটা জানেন?
– জানলাম আজকেই প্রথম।
– তো চা না কফি খাবেন?
– খাবো না পান করবো।
অদ্রি উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। নিদ্র তার চলে যাওয়া দেখছে। চুল গুলো ঢেউ খেলানো, হাঁটার সময় দুলে উঠে অনবরত।
চলবে……..!