তিনি এবং ও !
২৬.
ড্রয়িংরুম এ ছোট্ট ছোফার উপর নিদ্র বসে আছে। বাড়িটায় কেমন যেন গুমোট ভাব আছে। নিদ্রের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তার সামনে টিভিতে ইন্ডিয়ান একটা গানের চ্যানেল খোলা আর তাতে বাম ডিগি ডিগি বাম গান চলছে। নিদ্র ভাবছে হুট করে কেউ চলে আসলে এই গান চলা অবস্থায় তাহলে খুব লজ্জায় তাকে পড়তে হবে। এই গানের মিনিং টা খুব খারাপ লাগে নিদ্রের কাছে। পৃষ্ঠদেশ নিয়ে এভাবে কেউ গান লিখে? আর তাতে যে নাচ দিচ্ছে তাতেও স্পষ্ট ভাবে ওই অঙ্গ দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে বারবার। কী অরুচিকর গান!
সুফি সাহেব চলে আসলে যাও কম লজ্জা পাওয়া যাবে ওনার স্ত্রী আসলে খুবই লজ্জাকর পরিস্থিতি!
তার কপাল ঘামে ভিজে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর বাড়ির ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসছে। সুফি সাহেব সেই যে তাকে এখানে বসিয়ে রেখে গেছেন আর খোজ নেই।
বাচ্চার কান্নার আওয়াজ বেড়ে যাচ্ছেই।নিদ্রের মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেলো।
২৫-২৬ বছরের একজন নারী এক গ্লাস লেবুর শরবত নিদ্রের সামনের টি-টেবিলে রেখে বললেন
– কিছু মনে করবেন না। উনি একটু কুটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। উনি এক্ষণি আসবেন। আপনি শরবত খান। আমার শরবত এই বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ!
লাস্টের কথাটা বলে সেই নারী মুখ টিপে হাসলেন।
নিদ্র এরকম কুচকুচে কালো নারীকে এতো সুন্দর করে কখনো হাসতে দেখেনি।
মুখ টিপে হাসার কারণে তার দুই গালে টোল পড়েছে। কী সুন্দর হাসি!
এরকম সুন্দর হাসির মেয়েকে যে কেউ বিয়ে করতে চাইবে। কালো গায়ের রঙ কে ছাপিয়ে গেছে এই হাসি।
রমণী চলে গেলেন। নিদ্র নিজেকে শাসন করলো। এভাবে হুট করে কারো মায়ায় পড়তে নেই।
শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে লাস্টের কথার সত্যতা বুঝতে পারলো।
মৌরি ইচ্ছে করেই মুখ টিপে হেসেছে। অজানা কাউকে এভাবে চমকে দিতে তার ভালো লাগে। সে জানে তার হাসির তুলনা কখনওই হয়না। আর শরবত এর তো কথাই নেই।
ছেলেটা চমকে যাবার পর বেশ বোকাসোকা লাগছিলো। চোখ দুটো বড় বড় করে হা করে তাকিয়ে ছিলো। ছেলেটা অবশ্য খুবই সুন্দর। কী সুন্দর তার চুলের রঙ। অবশ্য বয়সে তার অনেক ছোটো। তবে…. এরকম চিন্তা করতে করতে মৌরি আবারো মুখ টিপে হাসলো।
ছেলেটাকে আবারো চমকে দিতে হবে।
নিদ্রের চোখের সামনে এখনো সেই হাসি ভেসে ভেসে উঠছে।
মাথাব্যথা টা আর এখন নেই।
মেয়েটা সুফি সাহেবের স্ত্রী তো নয়? হলেও বা কী? নিদ্রের তাতে কিছুই যায় আসেনা। নিদ্র নিজেই অবাক হচ্ছে এতকিছু কেনো ভাবছে সে?
সুফি সাহেব বাচ্চা কোলে নিয়ে নিদ্রের পাশের সোফায় বসলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন
– শুনো ভাই, আমার বাসায় ওসব ব্যাপারে কথা বলা যাবেনা। আমার ইলেকট্রন কিছুই জানেনা। আমি তাকে জানাইনি।
নিদ্র ধীরেধীরে বলল
– আমার খুব দরকার ছিলো যে।
– আমরা বাইরে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে বের হবো। তখন না হয়……
সুফি সাহেবের কোলের বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো।
সুফি সাহেব বেশ জোড়ে বললেন
– এই কুটির মা, নিয়ে যাও কুটিরে।
ফর্শা মতোন একজন নারী মাথার ঘোমটা ঠিক করতে করতে এসে বাচ্চাকে নিয়ে গেলেন।
নিদ্র বুঝতে পারলো, ইনিই সুফির সাহেবের স্ত্রী। তাহলে সেই কৃষ্ণ নারী কে?
সুফি সাহেব ফিসফিস করে বললেন
– আমার শালীর হাতের শরবত খেয়েছেন? দারুণ না?
নিদ্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করলো।
সুফি সাহেব হেসে বললেন
– আমার শালীর হাসিও দেখেছেন তাই না?
– হ্যা।
– সে হাসিতে অনন্যা।
নিদ্র বলল
– আমার বাসায় যাওয়া দরকার। রাত হয়ে গেলে ঝামেলায় পড়তে হবে।
সুফি সাহেব উচ্ছসিত হয়ে বললেন
– আপনি কি ভেবেছেন, ১ দিনেই আপনাকে আমরা ছেড়ে দিবো?বাসায় মেহমান এসেছে আর তাকে আদরযত্ন করবো না? তা কী হয়?
– না মানে আমার যেতেই হবে।
– আরে মিয়াঁ থামেন। আগে খেয়ে দেয়ে স্বাস্থ্য ভালো করুন। তারপর……
আর আপনার যা জানার দরকার আমি ডিটেইল বলবো যদি এখানে আমাদের ইচ্ছামত থাকেন। আর না থাকলে একটা শব্দও শুনতে পারবেন না।
অগ্যতা নিদ্রকে রাজি হতে হলো।
সুফি সাহেব বললেন
– একটু বসেন, আপনার জন্য যে ঘরটা খোলা হয়েছে ওটা পরিষ্কার করা হচ্ছে।
কথাটা বলে সুফি সাহেব চলে গেলেন।
নিদ্র কোথায় ফেঁসে গেছে, কী হবে? কীভাবে বের হবে বুঝতে পারছেনা।
ওদিকে অদ্রি রাতের খাবার রান্না করে অপেক্ষায় থাকবেন। বেচারি দেখা গেলো না খেয়েই….
নিদ্র তার মনকে বলল – সে আমার জন্য না খেয়ে কেনো থাকবে?
এসব কী এলোমেলো চিন্তা তার মাথায় ঘুরছে।
টিভিতে এখন অন্য একটা গান হচ্ছে, সেটা বিংশ শতাব্দীর গান। কিন্তু এটাকে রিমেক করে আবারো বের করা হয়েছে। নায়িকা ভিন্ন, নায়ক ভিন্ন প্রায় সবই ভিন্ন।
নিদ্র গানে মনযোগ আনার চেষ্টা করছিলো তখন মৌরি এসে বলল
– গান শুনতে ভালো লাগছে না বুঝি?
নিদ্র কিছু বলবে আর তখন মৌরি বলল
– আপনার ঘর পরিষ্কার হয়ে গেছে। চলুন আমার সাথে দেখিয়ে দিয়ে আসি।
মৌরির পিছুপিছু নিদ্র এগোলো। বেশ গোছানো একটা ঘর। একটা বেড, ছোট্ট টেবিলে বই ভরা, সাথে চেয়ার। একটা ওয়ারড্রব আর বিশাল জানালার সাথে ইজি চেয়ার রাখা। ইজি চেয়ারে বসেই জানালা দিয়ে বাইরের সবকিছু দেখা যাবে। কিছু মুহূর্ত এর জন্য নিদ্রের এমন একটা ঘর পেয়ে ভালো লাগতে শুরু করলো। কিন্তু পরক্ষণেই মৌরির কথায় তার ভালো লাগাটা কমলো ।
– ওয়ারড্রবে সম্পূর্ণ নতুন জামা কাপড় আছে। আপনি সহজেই ব্যবহার করতে পারবেন। আর একটু গোসল করেন। এতো ফর্শা মানুষটাকে কেমন কালো কালো লাগছে।
নিদ্র বোকা বনে গেলো। এ কীরকম কথা মেয়ের?
মৌরি দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। তার ইচ্ছে করছিলো পিছন ফিরে তাকাতে কিন্তু সে তাকালো না। ছেলেটা আরেকটু বোকা হোক না।
তাকে বোকা অবস্থায় বেশি ভালো লাগে।
অদ্রি নিদ্রের ঘর সুন্দর করে গুছিয়ে একগোছা সাদা গোলাপ ফুলদানিতে রেখে দিলো।
ফুলগুলো সে নিজ হাতে রুমন মালির বাগান থেকে। ফুলের বোটা থেকে এখনো কস পরছে। নিদ্রের মনে হয় সাদারঙ এর গোলাপ খুব পছন্দ।
অদ্রির আজকে খুব ভালো লাগছিলো। গতকাল রাতে নিমপাতা ভর্তা খাইয়েছে ভেবে আনমনে হেসে ফেলল অদ্রি। বেচারা তাও খেয়েছে। আজকে তার পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করবো। অদ্রি মনে মনে ঠিক করে নিলো। খুব খুশি হবে মানুষটা।
চলবে…….!