তিনি এবং ও!
১২.
রাতে খাবার সময় বাবা বললেন
– তুমি তোমার মায়ের সাথে কয়েকদিন থেকে আসো। ভালো লাগবে তোমার।
দাদী কিছু বললেন না। চুপচাপ খাচ্ছিলেন। পরেরদিন সকালে দাদী আমার ব্যাগপত্র গুছিয়ে দিলেন। বাবার কথার অমান্য করার সাহস আমার কখনওই হয়নি।মায়ের বাসায় বাবাই আমাকে নিয়ে গেলেন। আমি অবাক হচ্ছিলাম বাবা কীভাবে জানে মা এখানে থাকে?
আমাকে ব্যাগপত্র সহ দেখে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমি কী বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
বাবা এতো সহজে আমাকে এখানে রেখে গেলো কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর টাই আমি দিনরার খুজছিলাম।
মার সাথে আমার তেমন কোনো কথা হতো না প্রথম দিকে। মা আমাকে বাচ্চাদের মতো ট্রিট করতো। নিজ হাতে খাইয়ে দিতেন। গোসল করার পর মাথা মুছে দিতেন।
একদিন মাকে প্রশ্ন করেই বসলাম – আচ্ছা মা, আমাকে বাবা এতো সহজে এখানে রেখে গেলো কেনো?
মা বলল – তোমার বাবা তোমাকে বলে নি?
আমি বললাম – কী বলবে?
মা বলল – আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বেশিদিন হাতে সময় নেই। তুমি আমার স্বাস্থ্য দেখেও বুঝতে পারোনি?
আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো। এই অল্প সময়ের জন্য মায়ের কাছে এসেছি? আর আমি বুঝতেও পারলাম না মা অসুস্থ?
মা আমার কপালে চুমু দিয়ে বলল
– নিড্র, তুমি মন খারাপ করোনা। আর তুমি বুঝবেও বা কীভাবে? আমাকে তো আগে কখনওই দেখোনি।
– মা তুমি মজা করছো তাই না?
– নিড্র তোমার বাবা এতো উদার নয় যে, আমার কাছে তোমাকে রেখে যাবে। আমার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। সে জানে, আমার মৃত্যুর পর তোমাকে ফিরে পাবে!
আমি বাচ্চাদের মতো মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম আর বললাম
– তুমি আমাকে কেনো রেখে চলে এসেছিলে?আমার শৈশব তোমাকে ছাড়া কেটেছে মা। মা তুমি জানো তোমার আদর ভালবাসাকে আমি কতোটা মিস করেছি?
কথাগুলো অদ্রিকে বলতে বলতে নিদ্রের চোখে পানি চলে এলো।
অদ্রি বলল
– আপনার মা এখন কেমন আছেন?
নিদ্র বলল
– মা আমাকে আবারো রেখে চলে গেছে। মা তো মাই হয়। জানেন অদ্রি, ক্যান্সার যখন মাকে একদম জাপটে ধরলো তখন মা কথা তেমন বলতে পারতেন না। অল্প কিছু বাংলা শিখেছিলো আমার কাছ থেকে।
হাত পা নড়াচড়াও করতে পারতো না। শুধু বলতো – নিড্র, ফিল কোল্ড।
আমি তখন তার গায়ের কম্বল ঠিক করে দিতাম।
দেখুন না অদ্রি আমার ভাগ্য, মাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলেছি। সেই ছোটো থেকে মাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছি। সবসময় ভাবতাম আমার মা থাকলে মায়ের জন্য এটা করবো ওটা করবো। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারতাম না। সে তার শেষ জীবন টা ঠিকি একমাত্র সন্তান কে নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে।
অদ্রি বলল
– আপনার মায়ের ছবি আছে?
– আছে। মা মারা যাবার ১ সপ্তাহ পরই বাবা আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিলেন। এখানে পাঠানোর আরেকটা কারণ লুসি।
– আপনার প্রেমিকা?
– নাহ তা ঠিক না। আমার মায়ের নার্স ছিলেন। খুব ভালো ফ্রেন্ড ছিলাম আর আমার ভালোও লাগে। তাই আরকি তাকে নিয়ে ভাবি। আসলে কিছু একটা করে তো সময় কাটাতে হয়।
অদ্রি বলল
– অনেক রাত হয়েছে আমি আসি।
– হুম।
অদ্রি চলে যাবার পর নিদ্র দরজা আটকে দিয়ে তার ব্যাগ থেকে মায়ের সাথে তার ছবিটা দেয়ালে টানালো।
একদৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।
অদ্রি লিলির রুমে গিয়ে দরজায় নক করলো। লিলি ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে বলল
– কিছু লাগবে?
অদ্রি বলল
– তুই এখানকার সবকিছু চিনিস না?
– হ আপা। পুরো এলাকা, পাশের এলাকা সব আমার চেনা।
– কাল আমাদের নিয়ে সব দেখাতে পারবি?
– একদিনে তো আপা হইবো না।অনেকদিন লাগবো।
– অনেকদিন লাগুক। তুই পারবি তো?
– হ আপা পারুম।
– আচ্ছা ঘুমা তুই।
অদ্রি তার রুমে এসে জানালার পাশে দাঁড়ালো। মাথার ঘোমটা খুলে দিয়ে চুলের খোঁপা খুলে দিলো।
কোনো বাতাস নেই, গুমোট গুমোট লাগছে। তারপরও আজ খুব একটা খারাপ লাগছে না তার। অদ্রির মনে হচ্ছে, ভালো একজন বন্ধু পাওয়া গেলো বটে।
নিদ্র তার চোখ মুছে মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মা হাসছে, কতোই না সুন্দর সেই হাসি। মায়েরা কখনওই অসুন্দর হয়না। মাতৃত্ব মা জাতির সৌন্দর্য টাকে বাড়িয়ে দেয়।
নিদ্র আর তার মা একই ফ্রেমে আবদ্ধ কিন্তু তার মা যে নেই। তার মায়ের হাসিটা এভাবেই থেকে যাবে কিন্তু তার……
নিদ্র আর ভাবতে পারছে না। তার মাথা ভার হয়ে আসছে। বুকের মধ্যে কোথাও যেন কাটা বিঁধছে।
নিদ্রের মনে হলো কেউ তাকে ডাকছে। তার বিছানার উপর কেউ শুয়ে আছে।
নিদ্র বিস্ময় চোখে দেখতে লাগলো, তার মা বিছানায় শুয়ে আছে। আবারো নিদ্র শুনতে পেলো
– নিড্র ফিল কোল্ড।
নিদ্র বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে পায়ের কাছে রাখা চাদর তার মায়ের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল
– মা, ঠিক আছে?
নিদ্র বুঝতে পারছে তার হ্যালুসেনেশন হচ্ছে।তারপরও সে চাচ্ছে, আজীবন এভাবেই কাটিয়ে দিতে মায়ের সাথে।
চলবে……!