তিনশত পয়ষট্টি পৃষ্ঠা পর্ব-০৩

0
678

#তিনশত_পয়ষট্টি_পৃষ্ঠা
#পর্ব_৩
#মুসফিরাত_জান্নাত

“তায়্যেব বিদেশ যাওয়ার পর এই দুইটা বছর এক বিছানায় কাছে পাশে থেকে তুমি আমার মেয়ে হয়ে উঠছিলে মা।এইটা তুমি রাখো।আরেক মায়ের স্মৃতি হিসেবে রাখো।”

প্রিয়তাকে তার গহনা গুলো আলমারি থেকে বের করে বুঝিয়ে দেওয়ার সময় জামেলা বানু নিজের এক জোড়া বালা দিয়ে উক্ত কথাগুলো বললেন। সেই সাথে চোখের পানি ফেললেন তিনি।সেদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো প্রিয়তা।এটা অপ্রত্যাশিত ছিলো।যেই মহিলা বিয়ের পর প্রথম দিকে তাকে নজরে নজরে রাখতো,খুটে খুটে ভুল ধরতো, আজ প্রিয়তার মনে হলো এই বাড়িতে এই একমাত্র মানুষ যে তাকে মন থেকে ভালোবাসে।জামেলা বানুরও ঠিক এমনটাই মনে হচ্ছে।তিনি অঝোরে চোখের পানি ফেলছেন।আসলে নারী জাতি বড় বিচিত্র অনুভুতির বাহক।যেই মেয়েকে এক সময় তিনি পুত্র বধু রুপে চান না বলে নারাজ ছিলেন।এখন সেই মেয়ের জন্যই তার ভীষন দরদ হচ্ছে।তিনি এই মুহুর্তে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

“তোমাকে এ বাড়ি আনতে না চাইলেও কখনো ওই বাড়ি ফিরিয়ে দিবো ভাবিনি আমি।অথচ ভাগ্য দেখো আজ তাই করতে হচ্ছে।তবে তোমার সাথে আমার সম্পর্ক দূর হবে না কখনো।মায়ের ছায়া হিসেবে দূর থেকে হলেও আমাকে কাছে পাবে তুমি।অনেক বড় হও তুমি।জীবনে অনেক সুখী হও।আমার ছেলের সাথে থাকতে না পারলে অন্য স্বামীর ঘরে সুখী হও।আমি দোয়া দিলাম তোমাকে।”

এমন আরও কত কি বলে গেলেন তিনি।প্রিয়তা নিরবেই সব শুনে গেলো।অন্য স্বামীর ঘর কথাটা কানে ব’জ্রপাতের ন্যায় আঘাত হানলো।সে সত্যি কি কখনো দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হবে?এতকিছুর পরও পুরুষ জাতিকে বিশ্বাস হবে তো তার?জানে না প্রিয়তা।সে কোনো জবাবও দিলো না।কেবলই লেপ্টে রইলো মাতৃতুল্য শাশুড়ীর বুকে।সে যাওয়ার সময় শাশুড়ী মায়ের হাত ধরে নিচু স্বরে বললো,

“ছোট বেলায় নিজের মাকে হারিয়েছিলাম মা।সংসারের এই তিন বছরে আপনাকে পেয়ে মনে হয়েছিলো মায়ের অভাব ঘুচে গিয়েছে।আপনি আমাকে নিজ সন্তানের মতো ভালোবেসেছেন।কখনো সখনো শাসনও করেছেন।আমি যদি উত্তরে কোনো কষ্ট দিয়ে থাকি আমাকে ক্ষমা করবেন।ভালো থাকবেন মা,আসি।”

কথাটা বলে বেরিয়ে আসে সে।সাথে পিছনে জামেলা বানুও এগিয়ে আসে।ড্রয়িং রুমে এগিয়ে আসতেই দেখতে পায় সুমি কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে।ওকে দেখে এগিয়ে যায় প্রিয়তা।ভ্রু কুঁচকে বলে,

“কিছু বলবে ভাবি?”

প্রিয়তার প্রশ্নে সুমি সচকিত দৃষ্টিতে তাকায়।মলিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“চলে যাচ্ছোই তাহলে?”

জবাবে প্রিয়তা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,

“হুম ভাবি।যার উছিলায় এ বাড়ি থেকেছি সেই মানুষটাই যখন চায় না আমি এখানে থাকি সেখানে যু’দ্ধ করে তো আর টিকে থাকা যাবে না।”

সুমি জবাবে দ্বিধা করে বলে,

“কিন্তু তুমিই তো বললে নিজের অধিকার ছাড়বে না।তুমি না গেলে তো জোর করে কেও তোমাকে ডিভোর্সও দিতে পারবে না।আর ডিভোর্স না হলে তোমার বরের নীলির সাথে বিয়েও হবে না।”

সুমির এহেন কথায় দুঃখ মিশ্রিত হাসি দেয় প্রিয়তা।অতপর দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কা’মড়ে বলে,

“এসব করতে হলে তো ওনার সাথে যু’দ্ধ করতে হবে।সেই যু’দ্ধ করে আমি জয়ী হয়ে গেলেও পরবর্তীতে কি কোনো ফায়দা হবে বলো?”

সুমি এবার ক্যাবলার মতো চেহারা করে বলে,

“তোমার সংসার তো টিকে যাবে।এর চেয়ে আর বড় কোনো ফায়দা হয় বলো?”

জবাবে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে সে।অতপর দায়সারা কণ্ঠে বলে,

“যু’দ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করা যায় ভাবি।কিন্তু যু’দ্ধ দ্বারা একে অপরের সাথে আবদ্ধ হয়ে সংসার করা যায় না।এভাবে যু’দ্ধ করে সংসার টিকালে পরবর্তীতে আমার জীবন অতিবাহিত করা কঠিন হয়ে যাবে।বিচ্ছেদের পর সুখে বা দুঃখে একা ভালো থাকা যায়।কিন্তু অন্যের মাঝে এভাবে জোর করে এমন পরিস্থিতিতে সংসার টিকিয়ে ভালো থাকা যায় না।আর আমি চাইও না এভাবে থাকতে।”

সুমি এবার নিরব হয়ে গেলো।সত্যি জোর করে কখনো সংসার হয় না।আর হলেও সেটাতে প্রতি মুহুর্তে অবজ্ঞার য’ন্ত্রণা ছাড়া অন্য কিছু অবশিষ্ট থাকে না।কিন্তু সে চাচ্ছে এই মেয়েটির ঘর না ভাঙুক।এমন মিষ্টি একটি মেয়ে, এতদিন এক সঙ্গে ছিলো এর বিচ্ছেদ না হোক।নিজেদের মাঝের বন্ধনটাকেও ছিন্ন করতে ইচ্ছে করছে না তার।কিন্তু চাইলেও কি আর এই বাঁধন ধরে রাখা যাবে?যেখানে সুতোর টান সেখানেই যে ছিঁড়ে গিয়েছে।সেখানে তাদের দুই জায়ের বিনা সুতোর বন্ধন টিকবে কীভাবে?এই মায়ার বন্ধন হয়তো ত্যাগ করতেই হবে।তপ্ত শ্বাস ছাড়লো সে।মলিন কন্ঠে বললো,

“তোমাকে অনেক মনে পড়বে প্রিয়তা।খুব খুব খুব মনে পড়বে।”

কথাটা বলতে নিয়ে গলা ভিজে এলো তার।প্রিয়তা সেটা লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলো সুমির কাছে।ওকে স্বান্তনা দিতে কাধে হাত রেখে বললো,

“আরে আমি তো চোখের আড়াল হচ্ছি না।এই পাশের বিল্ডিং।মনে পড়লে চলে এসো।”

“হুম।”

মাথা ঝাকালো সুমি।প্রিয়তা আর কিছু বললো না।সেখানে এসে উপস্থিত হলো প্রান্ত।সে প্রিয়তার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

“ব্যাগটা আমার কাছে দে।”

কথাটা শুনে চুপচাপ ভাইয়ের হাতে ব্যাগ এগিয়ে দেয় প্রিয়তা।তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে নিয়ে লক্ষ্য করে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা উপমাকে।সে কেমন ব্যাঙ্গ করে হাসছে তাদের দেখে। সেই হাসি দেখেই শরীর জ্বলে উঠে প্রিয়তার। সে দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো।অতঃপর সবাইকে ডিঙিয়ে বেরিয়ে এলো ফ্লাট থেকে।ড্রয়িং রুমে দাঁড়ানো বড় ভাসুরকে দেখেও যেনো দেখলো না সে।লোকটা তার বউয়ের রেপ্লিকা।তাদের বিয়েতে ঘোর বিরোধ ছিল এই লোকের।নিজ বউয়ের সাথে তাদের বিচ্ছেদ এই লোককেও যেন আনন্দিত করেছে।তার ভাব ভঙ্গিমাতেই তা স্পষ্ট।অথচ তারই আরেক ভাই তামিমকে দেখে মনে হচ্ছে এমন ঘটনায় চরম লজ্জিত সে।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।প্রিয়তা একে একে সবাইকে দেখে শাশুড়ী ও সুমির পাশাপাশি তার কাছেও বিদায় নিয়েছিলো।তারপর আর দেরী করেনি সেখানে।
______
যত দ্রুত সম্ভব অল্প সময়ে প্রিয়তারা বিদায় নিলো সবার থেকে।কি যেন মনে করে নিচে এসে উপরে ফিরে তাকালো একবার।এ বাড়ির চৌকাঠ হয়তো আর কখনো মাড়ানো হবে না তার।প্রতিবেশী হওয়ার খাতিরেও না।তাই শেষবার মুখস্থ করে নিলো বাড়িটাকে।শেষবারের জন্য তাকালো পাঁচ তলায় তাদের ঘরটার দিকে।এখনো কত প্রানবন্ত ঘরটা।অথচ বিদায় নিচ্ছে তার মাঝে থাকা একটি প্রান।হটাৎ দম ব’ন্ধ হয়ে আসে তার।কেমন তিক্ত এক অনুভুতি গ’লা টি’পে ধরে যেনো।এ বাড়ির প্রত্যেকটা ইট সিমেন্ট অসহ্য লাগে।যেখানে ভালোবাসার বিচরণ থেকেও ভালোবাসার মানুষটি নিজের থাকে না,সেখানে থাকাটা যাতনার।ছুটে পালালো সে এই যাতনা চিরে।হাঁটা দিলো সামনের পথে।এইতো পাশের বিল্ডিং এই তার ভাইয়ের বাসা।অথচ এইটুকু দূরত্বই অতিক্রম করতে পারছে না সে।শেষ যাত্রার ভার তার অন্তরের সাথে দেহেও চেপে ধরেছে হয়তো।সে পা ফেলতেই পারছে না।তবুও জোর কদম চালালো সে।

বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে প্রান্ত নিজ বোনের পানে দৃষ্টি দিলো।সে জানে একে নিয়ে বাসায় ঢুকলে আরেক দফা ঝড় বয়ে যাবে এই মেয়ের উপর দিয়ে।তাই সে বোনকে শক্ত করতে সাহস যুগিয়ে বললো,

“শোন প্রিয়তা, নিজের সাথে যাই হয়ে যাক কখনো ভেঙে পড়বি না।মন যদি দুর্বলও হয় বাহিরে তা প্রকাশ করবি না।কেননা এই পৃথিবীর মানুষ গুলো বড় নিষ্ঠুর।নরম কাঠে বল দেখায় এরা।তুই যদি নিজের মনের দুর্বলতা প্রকাশ করিস, তোকে আর কখনো সবল হতে দিবে না কেও।বরং বার বার ভাঙার খেলায় মত্ত হবে।এটা সব স্থানে সমান ভাবে প্রযোজ্য, মনে রাখিস।”

ভাইয়ের কথাগুলোয় প্রিয়তা স্পষ্ট বুঝলো কিসের ভয় পাচ্ছে প্রান্ত।আরেক দফা ধকল যে তার সইতে হবে তার জন্য প্রস্তুত করার ইঙ্গিত এটা, তা তারচেয়ে ভালো আর কে জানে?সে তার বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেয়ালী করে বলে উঠলো,

“শক্ত থাকলেও কি কেও ভাঙা বাদ দেয় ভাইয়া?আব্বু আম্মু মা’রা যাওয়ার পর তো কম শক্ত ছিলাম না আমরা।তবুও কি ভাঙার চেষ্টা কেও বাদ দিয়েছে?তবে কি লাভ এই শক্ত থাকার অভিনয় করে!”

প্রান্ত প্রতিউত্তরে ধাতস্থ কণ্ঠে বললো,

“ভাঙার চেষ্টা করলেও কি ভাঙতে পেরেছে আমাদের?আমরা তো নিজের পাওনা বুঝে নিয়েছি।যদি ওই অভিনয় টুকু না করতাম, তবে মাথার ছাদ থাকতো না আমাদের।এই বিল্ডিং এ জায়গা হওয়া তো অনেক দূর।”

কথাটা শুনে নিরব হয়ে গেলো প্রিয়তা।সত্যি তখন যদি সব দিক থেকে ধেয়ে আসা তী’র গুলোর বিপরীতে শিনা টান করে না দাঁড়াতো তারা, তবে এভাবে নিজেদের পাওনা পাওয়া হতো না।এজন্যই হয়তো শক্ত থাকতে হয়।প্রিয়তা আর কিছু বললো না।কিন্তু তার ভাই তাকে শক্ত থাকতে বললেও সে কি আর তখনের মতো শক্ত থাকতে পারলো?নাহ পারেনি প্রিয়তা।য’ন্ত্রণার পাহাড়ে পুরাতন য’ন্ত্রণাগুলো যোগ হচ্ছে যেনো।মায়ের মুখ মনে পড়ছে।ছোট থেকে করা কষ্ট গুলো মনে পড়ছে।সেই সাথে তায়্যেবের পাশে নীলির অবস্থানের কথা মনে পড়ছে।সব কিছুর ভারে মনটা ভেঙে আসছে তার।সেই রেশ চেহারায় ফুটে উঠছে।সেটা লক্ষ্য করে প্রান্ত বললো,

“তুই কি তায়্যেবের জন্য কষ্ট পাচ্ছিস প্রিয়ু?”

ভাইয়ের প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে তার।নিজেকে দ্রুত ধাতস্থ করে নেয় সে।গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“কই না তো!”

প্রান্ত বিচক্ষণের ন্যায় বলে,

“কিন্তু তোর চেহারা তো বিধ্বস্ত, চোখও ভিন্ন কিছু বলছে।”

প্রতিউত্তরে নিশ্চুপ রয় প্রিয়তা।প্রান্ত কিছু সময় চুপ থেকে খানিকটা দ্বিধা করে বলে,

“তুই ভালোবাসিস তাকে?”

প্রিয়তা এবার চোখ ফিরিয়ে নেয়।নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে,

“মন বেসেছিলো হয়তো।কিন্তু এখন তা ভেঙে গেছে।”

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে