তিক্ত বুকের বাঁ-পাশ পর্ব-০৬

0
836

#তিক্ত_বুকের_বাঁ-পাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৬(আত্মীয় ত্যাগ নাকি আত্মত্যাগ!)

“দেহ তো থাকবে। দেহ জীবিত থাকলে আত্মা একদিন ঠিকই দেব খুঁজে নেবে। অপেক্ষা শুধু সময়ের।”

ফুঁসে ওঠে নম্রমিতা। মণ চাইছে সবকিছু তছনছ করে দিতে। সামনে বসা এই অসভ্য ছেলেটাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে। কিন্তু বাবার সম্মানের খাতিরে দমে যায় সে। তবে মনে মনে ঠিকই ছক কষে নেয় অন্যকিছুর। একদিকে রাগ বিরক্তি সবকিছু মিলিয়ে অস্থির নম্রমিতা, অপরদিকে রাফিদের একের পর এক কল আরো বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে তাকে। বিরক্তির মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমে। পাঁচ বারের মাথায় বিরক্তি নিয়ে কল কেটে দিতেই সামনে এসে দাঁড়ায় রাফিদ। মূলত ফ্রেন্ডের সাথে সে এসেছিলো রেস্টুরেন্টে। নম্রমিতা হকচকিয়ে একবার তাকায় আদিলের দিকে। আবার পরক্ষণে তাকায় রাফিদের দিকে। তার মুখে বিষাদের ছায়া স্পষ্ট। শুকনো ঢোক গেলে নম্রমিতা। আদিলের দিকে তাকাতেই তার রাগ বেড়ে যায় আরো কয়েকগুণ। মিটিমিটি হাসছে আদিল। চোখে মুখে শয়তানির ছাপ স্পষ্ট। আদিল কিছু বলার আগেই রাফিদের হাত ধরে চলে যেতে চায় নম্রমিতা। অথচ রাফিদ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আদিলের দিকে।

“হায়! আদিল আহসান। নম্রমিতার উড বি হাসবেন্ড। আপনি?”

“আবরার চৌধুরী রাফিদ। আপনার উড বি ওয়াইফের পরিচিত কেউ একজন।”

কথা বলার পুরোটা সময় রাফিদ নম্রমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। পূর্ণিমার আকাশে হুট করেই যেনো অমাবস্যা নেমে এসেছে। আঁধারি ঘনঘটায় ছেয়েছে চারিপাশ।

“বিয়ে আগে সুযোগ দিলাম আমার হাফ ওয়াইফকে। কথা বলো তোমরা। কিছু সুন্দর সুন্দর স্মৃতি দিয়ে যেও, বাকিটা জীবন কাটানোর জন্য। আসি আমি।”

কারোর কথার পরোয়া না করেই বেরিয়ে যায় আদিল। নম্রমিতা মনে মনে রাগে কিড়মিড় করলেও চোরা চোখে তাকায় রাফিদের দিকে। অন্যদিকে তাকিয়ে আছে রাফিদ। কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করছে বোধহয়! কান্না পায় নম্রমিতার। এই একটা মানুষের সামনে এসে সে ভেঙেচুরে যায়। পাজেলের মতো খন্ড খন্ড হয়ে যায়। শক্ত খোলসের আড়ালে লুকানো কোমল বিড়ালছানা হয়ে যায় এই পুরুষের সান্নিধ্যে। কি আছে এই পুরুষের মাঝে সে ভেবে পায়না। তবে সে পারেনা নিজ সত্তা ধরে রাখতে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় এদিক সেদিক। কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস, সে খুব সন্তর্পনে ভালোবেসে এক একটা টুকরো কুড়িয়ে নেবে। বুকের মাঝে আগলে নেবে অবলীলায়।

“রাফিদ, শোনো। আমি তোমাকে বলতাম।”

“বিয়ের আগের দিন বুঝি! দাওয়াত দিতে!”

“মোটেই না। আমি ওই ছেলেকে বিয়ে করছিনা।”

“তার নামের রিং পরে বসে আছো, অথচ বলছো বিয়ে করছিনা। বাহ! দারুন ব্যাপার।”

“রাফিদ। আমি নিজের মতো করে সামলাতে চেয়েছিলাম সবটা। তুমি অন্তত ভুল বুঝনা আমাকে! সব ছেড়ে যার দোরগোড়ায় দাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেই যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আমার করা এতো সংগ্রাম যে বৃথা হয়ে যাবে।”

“মানে?”

“বিশ্বাস করো আমাকে!”

“আজও যদি এর উত্তর আমায় নিজের মুখে বলতে হয় তবে বলবো, আমি প্রেমিক হিসেবে ব্যর্থ।”

হাসে নম্রমিতা। সেও কাকে কি প্রশ্ন করেছে! অন্ধবিশ্বাস শুনেছে তবে অন্ধপ্রেমিক নামে যদি কিছু থেকে থাকে তা হলো এই রাফিদ। কেউ কাউকে এতটাও ভালোবাসতে পারে বুঝি! যেখানে আজকাল প্রেম মানেই দেহ, সেখানে এমন এক অন্ধপ্রেমীক কিভাবে জন্মালো! আজ পুরো দুনিয়ার সামনে নম্রমিতার চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে আমার জীবনের একটুকরো সাদা মেঘ তুমি। আমার অমাবস্যার রাতের মাঝে উঁকি দেওয়া একঝলক চাঁদ তুমি। তুমি আমার একাকি ভয়কাতুরে রাত্রির মাঝের জোনাক পোকা। তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কারোর কথা ভাবা ইহজনমে আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

“বিয়ে করবে আমাকে?”

নম্রমিতার নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বলা অভাবনীয় কয়েকগুচ্ছ শব্দ শুনে চমকায় রাফিদ। নিঃশ্বাস নিতেও যেনো ভুলে গেছে সে। দম আঁটকে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নম্রমিতার দিকে। হ্যা এটা তো তার ইচ্ছে ছিলো। কোনো এক সময়ে সে আবদার করেছিলো প্রেয়সীর সম্মুখে। প্রেমের প্রস্তাব রফিদ প্রথম দিলেও বিয়ের প্রস্তাব যেনো নম্রমিতা দেয়। নিছকই কৌতুকে বলা কথা নম্রমিতা মনে রেখেছে! খেয়াল রেখেছে তার ক্ষুদ্র এ সখের কথা!

“কি করবেনা? তবে কি আমি আদিলকে!”

“চুপ। এর চেয়ে একটা শব্দও বেশি উচ্চারণ করবেনা তুমি। তাহলে জানে মেরে দেবো।”

হাসে নম্রমিতা। পরক্ষনেই বেশ খানিকটা সিরিয়াস ভঙ্গিমায় বলে ওঠে,

“পালাতে পারবে আমার সাথে? নইলে এই বিয়ে থেকে মুক্তির আর যে কোনো উপায় নেই।”

“আরে পাগল মেয়ে। পালানোর দরকার নেই। বিয়ে করে সোজা শ্বশুরবাড়িতেই উঠবে। সব ব্যবস্থা আমি করে দেবো। আম্মা এমনিতেই তোমাকে বেশ পছন্দ করেন। বাকিটা আমি ঠিকমতো বোঝালে বুঝবে।”

এতো এতো চিন্তার মাঝেও হাসি ফুটে ওঠে নম্রমিতার মুখে। যে কোনো পরিস্থিতিতেই একজোড়া ভরসাময় হাত আদুরে ভঙ্গিমায় তাকে আগলে নেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত। এ উপলব্ধি বড্ডো বেশি কিছু পাওয়া। ভয় হয় নম্রমিতার। আসলেই সে এতকিছুর যোগ্য তো! আকস্মিক কোনো ঝড় হুট করেই তছনছ করে দেবেনা তো সবকিছু! সবটা তাদের পরিকল্পনামাফিক আদৌ হবে তো! নম্রমিতার চোখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে রাফিদ,

“সল্পতার বাগানে তোমাকে ফুলের মতো কুড়াই।
তুমি ভেবে কুড়িয়ে নিয়,
ফুলের সাথে রাস্তার যতো ধুলোবালি।
দেখা হলেই যাতে একমুঠো পুষ্পবৃষ্টির নামে,
ছুঁয়ে দিয় আঙ্গুলের মাঝে আঙ্গুল।
তুমি থমকাও, তাকাও লাজুক ভঙ্গিতে।”

৭.

বিয়ের তোড়জোড় চলছে নম্রমিতার বাড়িতে। বাবা ছাড়া আর কেউ জানেনা তার নীরব দ্বন্দ্বের কথা। বেশ খানিকটা ভয় ভয় আছেন রায়হান সাহেব। নম্রমিতার অগোচরেই তাকে নজরে নজরে রাখছেন তিনি। রাফিদ বেশ কিছুক্ষণ পর পর ফোন করছে নম্রমিতাকে। ভীষণ ভয় হচ্ছে তার। যদি নম্রমিতা না বের হতে পারে বাড়ি থেকে! যদি কোনো এক কারণবশত বিয়েটা তার হয়ে যায়! এসব চিন্তায় দুই দন্ড ঘুমানো দায়। ঘুম নেই নম্রমিতার চোখেও। দোটানায় ভুগছে সে। আত্মীয় ত্যাগ নাকি আত্মত্যাগ! এ ভাবনা তাকে এক দন্ড শান্তি দিচ্ছে না। বাবা মায়ের সম্মানের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত বদলের কথা ভাবলেও পরক্ষণে নিজেকে সার্থপর প্রমাণ করতে মণ চায়। বাবাকে তো সে সবটা বলেছে। বাবা যদি নিজের জেদের কাছে অটল থাকতে পারে, তবে সে কেনো নয়! কেনো এভাবে নিজের ভালোবাসার কাছে হেরে যাবে সে! ভালোবাসা তো কোনো অপরাধ নয়! সে তো পাপ কাজ করেনি! শুধু মনেপ্রাণে কাউকে ভালোবেসেছে।

নিশুতি রাত। অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারে একফালি চাঁদ আকাশে বিরাজমান। ঘড়ির কাঁটা তিনটে কুড়ি। বুক ধড়ফড় করছে নম্রমিতার। পা টিপে টিপে বাবার রুমে উঁকি দেয় সে। আলতো হাতে দরজা খুলে বাবার ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকায়। অতঃপর আগের মতোই নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। কিছুক্ষনের মাঝেই ভোর হয়ে যাবে। তাই নম্রমিতাকে যতো দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে যেতে হবে। মেইন গেট পেরিয়ে রাস্তায় এসে নম্রমিতার মনে পড়ে তার ফোনের কথা। ফোনটা সে টেবিলেই ফেলে এসেছে। ভেতরে যাওয়ার কথা ভেবে দূর থেকে তাকাতেই চোখে পড়ে বাবার রুমের লাইট জ্বলছে। ফোনের কথা ভুলে প্রাণপণে ছুট লাগায় নম্রমিতা। যতো দ্রুত সম্ভব এই এলাকা ছাড়তে হবে তাকে। ফোন তো নতুন করেও কেনা যাবে। কিন্তু আজ ওই বাড়ীতে ঢুকে গেলে আর বের হতে পারবেনা। রাফিদকে নির্দিষ্ট এক জায়গায় দাড়ানোর কথা ভাগ্যিস আগেভাগেই বলে রেখেছিলো সে।

বাসস্টপের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছে নম্রমিতা। অথচ রাফিদের কোনো খোঁজ নেই। সাথে করে ফোনও নিয়ে আসেনি, যে কল করবে। ভয়ে, উত্তেজনায় দরদর করে ঘামছে সে। এরপর কি হবে তার জানা নেই। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়ির সবাই জেনে গেছে সে পালিয়েছে। তাকে খোঁজাখুঁজিও শুরু করে দিয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু রাফিদ যে এখনও এলোনা। ভয় হচ্ছে ভীষণ নম্রমিতার।

ফজরের আযানের কিছুক্ষন আগেই ঘুম ভেঙে যায় রায়হান সাহেবের। মূলত সারারাত ঠিক করে ঘুম হয়নি তার। কেমন যেনো এক চাপা উত্তেজনা কাজ করছে মণের মাঝে। কোথাও যেনো কিছু ভুল হচ্ছে।

#চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে