তিক্ত বুকের বাঁ-পাশ পর্ব-০৪

0
818

#তিক্ত_বুকের_বাঁ-পাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৪(তার মনে অন্যকেউ)

৪.
“অনুমতি ব্যতিত কারো ব্যাক্তিগত জায়গায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। জানা নেই বুঝি!”

“ব্যক্তিটাই যেখানে আমার ব্যাক্তিগত সম্পত্তি, সেখানে অনুমতি নেওয়া বিলাসিতা মাত্র।”

নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে যায় নম্রমিতা। ফজরের নামাজ শেষে মাত্রই শুয়েছিল সে। হটাৎ পাশে তাকাতেই চোখে পরে রাফিদের ঘুমন্ত চেহারা। দুজনে একই বেডে ঘুমালেও মাঝে রয়েছে কোলবালিশের দেয়াল। ঘুমের ঘোরে এই দেয়াল নিজ দায়িত্বে পার করেছে রাফিদ। নম্রমিতা বাম হাতের উপর মাথা রেখে বেশ খানিকটা সময় আবেগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাফিদের দিকে। এরমাঝে হুট করেই ঘুম ভেঙে যায় রাফিদের। আধো আধো চোখ খুলে নম্রমিতাকে ড্যাব ড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে মনে হাসে রাফিদ। অতঃপর আগের মতোই চোখ বন্ধ করে দুষ্টুমি করে বলে কথাটা। নম্রমিতাও যেনো কোনো এক ঘোরের মাঝে ডুবে ছিলো। হুট করে রাফিদের কথার এমন এক উত্তর সে ভেবেচিন্তে দেয়নি। অজান্তেই বলে ফেলেছে। কি বলেছে খেয়াল হতেই নড়েচড়ে ওঠে নম্রমিতা। লজ্জায় নিজেকে লুকানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে রাফিদের দিকে পিঠ করে শুয়ে পড়ে।

“পালাচ্ছ মনে হচ্ছে!”

“একদমই নাহ। আমি চোর নাকি, যে চুরি করে পালাবো!”

“এসব বলে তো লাভ নেই। একটু আগে কি যেনো বলছিলে!”

“আমি কিছুই বলিনি। যা বলার তুমি বলেছো।”

“আমি আবার কি বললাম? উম মনে পড়ছেনা তো।”

চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায় নম্রমিতা। অতঃপর রাফিদের দিকে খানিকটা তেড়ে এসে বলে ওঠে,

“নিজেই তো বললে, তোমার ব্যাক্তিগত সম্পত্তিতে নাকি আমি ঢোকার চেষ্টা করছি! তাও বিনা অনুমতিতে।”

“ঢোকার চেষ্টা করছিলেই তো। ভাগ্যিস আমি জেগে ছিলাম। নয়তো যেভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিলে, কখন নাজানি আমার মনের জায়গা দখল করে বসে থাকতে।”

“এহ মোটেই না। এতো সখ নেই আমার।”

নম্রমিতার মুখ ভেংচি দেওয়া দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় রাফিদ। আচমকা একহাতে নম্রমিতার কোমর ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এসে চোখে চোখ রেখে হিশহিশিয়ে বলে ওঠে,

“শোনো মেয়ে, আগুনের সংস্পর্শে আসতে চেয়োনা। নিজেই পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।”

“যদি বলি, আগুন নিয়ে খেলা আমার নেশা। হয় জ্বলন্ত তাপদাহ শিথিল হবে নয় নিজে জ্বলে অঙ্গার হবো।”

সকালের নাস্তা নম্রমিতা নিজেই বানায়। আনোয়ারা হাতে হাতে কিছু এগিয়ে দিতে চাইলেও নাছোড়বান্দার মতো পিছনে পড়ে থাকে নম্রমিতা। তার একটাই কথা, এখন আমি এসে গেছি তো আম্মা। এবার আপনার ছুটি। শাশুড়ি কিচেন থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পায়না সে। নম্রমিতার পাগলামি দেখে মাঝে মাঝে হাসেন আনোয়ারা। দুপুরের রান্নাও সে একাই করে, শুধু কাজের বুয়া থাকেন একজন। মাঝে মাঝে এটা ওটা এগিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রতিদিনের মতো আজও দুপুরের রান্না শেষে শাশুড়ির রুমে আসে নম্রমিতা। আনোয়ারা তখন উপন্যাসের বই পড়ছিলেন ব্যালকনিতে বসে। নম্রমিতা এ বাড়িতে আসার পর থেকে কোনো কাজই করতে দেয়না তাকে। তাই অবসরে উপন্যাসের বই পড়ে সময় পার করেন তিনি।

“আম্মা আসবো?”

“তোমাকে কতোবার বলেছি নম্রমিতা, আমার রুমে আসার জন্য এভাবে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। যখন ইচ্ছে হবে চলে আসবে।”

“আম্মা আসলে এখন যদি একটু কিচেনে আসতে বলি, খুব কি বিরক্ত হবেন!”

“আরে পাগল মেয়ে। বিরক্ত হবো কেনো? তুমি তো এমনিতেই আমাকে কোনো কাজ করতে দাওনা।”

“আসলে আম্মা রান্না তো শেষ। তরকারীতে লবণ ঠিকঠাক হয়েছে কিনা একটু দেখে নিতেন যদি!”

“ঠিকই তো হয় রোজ। তাও যে কেনো রোজ রোজ আমাকে দিয়ে লবণ চেক করাও বুঝিনা বাপু। আচ্ছা চলো।”

আনোয়ারা খাতুনের কপট রাগ দেখে মনে মনে হাসে নম্রমিতা। সে বেশ বুঝতে পারে রোজ লবণ চেক করার কাজে বেশ সন্তুষ্ট হন আনোয়ারা খাতুন। এ সংসারে যে তার গুরুত্ব বেশ, সেটা অনুভব করতে পারেন। শুধু উপরে উপরেই রাগ দেখান। তরকারিতে লবণ চেক করার কাজটা খুব ছোট হলেও গুরুত্বের দিক থেকে তার বহর বেশ। লবণের মতো সামান্য একটা জিনিষ পরিমাপের মাধ্যমে শাশুড়ি আর বউয়ের মাঝে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। এইযে পুরো রান্না নম্রমিতা করলেও লবণ চেক করার জন্য কিন্তু আনোয়ারকে লাগবেই। এই বিষয়টা তাকে উপলব্ধি করায়, আজও এ সংসার তারই আছে। আগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তিনি আজও।

৫.
দেখতে দেখতে বিয়ের একমাস পেরিয়েছে। সেই যে বিদায় নিয়ে এ বাড়িতে নম্রমিতা এসেছে। একবারের জন্যও পিছু ফেরেনি আর। এমনকি রাফিদ নিজেও চায়না ওই বাড়ির কারোর সাথে সম্পর্ক রাখতে। তবে যদি নম্রমিতা নিজে থেকে চায় তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে তবে সে বাধা দেবেনা। নম্রমিতার বাবা মারা গিয়েছেন এক বছর আগে। পৈতৃক বাড়ি হওয়ায় চাচা চাচিদের সাথে একসাথেই থাকে তারা। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরেন নম্রমিতার চাচা। নম্রমিতারা দুই বোন আর চাচার একটামাত্র ছেলে। সেই হিসেবে বাড়ির অংশীদার নম্রমিতার চাচাতো ভাই রায়হান। বাবা মারা যাওয়ার প্রথম দিকে চাচা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে খানিকটা ভরসা পান নম্রমিতার মা রাবেয়া। ছোটো মেয়ে আরুশীকে নিয়ে বাপের বাড়িতে যাওয়া খুব একটা শোভনীয় ব্যাপার নয়। তাই নম্রমিতার চাচার সাহায্যের হাত গ্রহণ করে নেন তিনি। সবকিছু ঠিকঠাক চললেও, এর ঠিক ছয় মাসের মাথায় আকস্মিকভাবে রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায় নম্রমিতার প্রথম স্বামী আদিল। সেদিন নম্রমিতার সাথে বেশ বড়সড় একটা ঝামেলা করেই রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল সে। কয়েকঘন্টা পেরিয়ে যেতেই হসপিটাল থেকে কল আসে তাদের বাড়িতে। সেখানে পৌছানোর আগেই তারা দেহটাকে লাশ নামে ঘোষণা করে দেয়। আদিলের মৃত্যুর দায়ভার পড়ে নম্রমিতার উপর। এরপর শ্বশুরবাড়ি থেকে বেশ কড়া কথা শুনিয়ে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। এমনিতেই রাবেয়া আর আরুশির খরচ বহন করছে তার চাচা। এই অবস্থায় নম্রমিতা নিজেও চায়না সে বাড়ীতে যেতে। কিন্তু এছাড়া যে তার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়েই নাক কান বুঁজে পড়ে থাকে চাচার সংসারে। চাচা চাচির অত্যাচার সবটা মুখ বুঁজে সহ্য করে। বাড়িতে বাড়তি কোনো কাজের লোক রাখতে দেয়নি নম্রমিতা। বিধায় আরুশির পড়শোনা না বন্ধ হয়ে যায় সেই ভয়ে। তবুও দিন রাত বাপের বাড়িতে পড়ে থাকা নিয়ে খোঁটা শোনাতে ছাড়েনি কেউ।

হুট করেই একদিন নম্রমিতার চাচা রাসেল সাহেব আসেন নম্রমিতার ঘরে। প্রথমে শান্ত মেজাজে নম্রমিতাকে নতুন করে নিজের জীবন গুছিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। নম্রমিতা রাসেল সাহেবের কথা বুঝতে পারেনা। অতঃপর সরাসরি বিয়ের কথা বলেন তিনি। নম্রমিতা রাজি হয়না। প্রয়োজনে সে কাজ খুঁজবে। তবুও আর কাউকে বিয়ে করবেনা। একবার তো বাবার পছন্দে বিয়ে করলো সে। সেই বিয়ে করেই জীবনটা নরকে পরিণত হয়েছে। বাবার রাজকন্যা দাসী বাঁদিতে পরিণত হয়েছে। রোজ রোজ লোকের খোঁটা শুনতে শুনতে অতিষ্ট। নম্রমিতার একগুয়েমী দেখে রেগে যান রাসেল সাহেব। কথাবার্তার এক পর্যায়ে বলেন, এই বাড়ি এখন শুধু তার নামে। নম্রমিতাদের কোনো অধিকার নেই এতে। বহু আগে কৌশলে রাবেয়াকে দিয়ে বাড়ির কাগজে সই করিয়ে নিয়েছেন তিনি। এখন যদি নম্রমিতা বিয়ে না করে তবে তাদের সবাইকে পথে বসিয়ে দিতে একবারও ভাববেননা তিনি। শর্ত হিসেবে জানান, তার পছন্দ করা পাত্রকেই বিয়ে করতে হবে নম্রমিতাকে। বিয়ের দিন মূলত রাফিদের ইচ্ছেতেই এক কাপড়ে বিদায় নিয়েছিল নম্রমিতা। ওই বাড়ির কোনো জিনিস রাফিদ নিজের সাথে নিয়ে আসতে রাজি হয়নি।

ঘুম থেকে উঠে নম্রমিতাকে আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে দেখে চট করে উঠে দাড়ায় রাফিদ। হাই তুলতে তুলতে নম্রমিতাকে পাশ কাটিয়ে সে ঢুকে পড়ে ওয়াশরুমে। আহাম্মক বনে যায় নম্রমিতা। হুট করে রাফিদের ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে ওয়াশরুমে ঢোকা সবটাই কেমন যেনো ঘোলাটে লাগছে তার কাছে। যেনো সবটাই ইচ্ছে করে করছে রাফিদ। বিরক্তিতে চ শব্দ উচ্চারণ করে পা গুটিয়ে বেডে বসে নম্রমিতা। রাফিদ গোসল করতে খুব একটা বেশি সময় নেয়না তা জানা নম্রমিতার। তবুও এই সময়টুকু অপেক্ষা করতে পারছেনা সে। রাফিদের উপর রাগ হচ্ছে ভীষণভাবে। হুট করে কিছু একটা মনে পড়তেই বেডের এদিক ওদিক খোঁজ চালায় নম্রমিতা। রাফিদের ফোনটা খুঁজে পেতেই বিশ্বজয়ের হাসি দেয় সে। ফোনটা অন করতেই লক করা দেখে বিরক্ত হয়। লক স্ক্রিনে একটা মেয়ের শাড়ি পড়া পিক দেখে মুখ হা হয়ে যায় নম্রমিতার। মেয়েটার মুখ ক্রপ করে দেওয়া। শুধু গলার পর থেকে দেখা যাচ্ছে। ভালবাসার মানুষটার ফোনে অন্য একটা মেয়ের ছবি দেখে বুক ছ্যাত করে ওঠে নম্রমিতার।তবে কি সত্যিই রাফিদের মনে অন্যকেউ আছে! অজান্তেই একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে।

ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজে সেদিকে তাকায় নম্রমিতা। রাফিদের সাথে চোখাচোখি হতেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা ফিকে হাসি দেয়। এরপর বেড থেকে কাপড়গুলো নিয়ে ঢুকে পড়ে ওয়াশরুমে। রাফিদ অবাক হয়ে একবার ওয়াশরুমের দিকে তো একবার বেডের দিকে তাকায়। নম্রমিতার চুপচাপ থাকার পিছনে খটকা লাগছে তার। রাফিদের এমন একটা কাজের পর তো নম্রমিতা চুপ থাকার মেয়ে নয়। কোমর বেঁধে ঝগড়া শুরু করে দেওয়ার কথা। অথচ আজ কি হলো! এভাবে চুপচাপ চলে গেলো কেনো! হাসিটাও কেমন যেনো প্রাণহীন ছিলো।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে