#তিক্ত_বুকের_বাঁ-পাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৩(কিছু অতীত কিছু ভালোবাসার সমাহার)
ফাল্গুনী বাহারে-চাঞ্চল্য শেষে আসে চৈতালী উন্মত্ততা। ঝোড়ো হাওয়ার সাথে মাঝে মাঝে শিলা বৃষ্টির তোপে তছনছ হয় প্রকৃতি। সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হয় নগরজীবনের নাগরিক। চৈত্র মানেই প্রখর দাবদাহের সাথে ঝড়ের তাণ্ডবলীলা। এক সর্বনাশী খেলায় মেতে ওঠার পালা। তাইতো কবিগুরু বলেছিলেন, ‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস,
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।’
ভোরের আলো উদ্ভাসিত হয় প্রকৃতিতে। প্রখর উত্তাপের তোপ আর ঝড়ের দংশনে একলা পাখিটাও ভুলে যায় কুঞ্জন। ভ্যাপসা এক গরমের সকাল। অথচ চৌধুরী বাড়ি কি প্রাণোচ্ছল! যেনো বসন্ত এসেছে এ বাড়িতে। রঙে রঙে মেতে উঠেছে সকলে। বাহারি পোশাকে আচ্ছাদিত সকলে ভুলতে বসেছে এ যে চৈত্র মাস। তামাম বাতাসের ছন্নছাড়া এক প্রহর। হঠাৎ আগত ঝোড়ো বৃষ্টির আদুরে আলিঙ্গনে কিছুটা জলমগ্ন হলেও কিছুতেই রুক্ষতাকে আড়াল করেনা চৈত্র।
চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলে আবরার চৌধুরী রাফিদের বউ বরণের অনুষ্ঠানে আজ এ আয়োজন। রাফিদ আর নম্রমিতার প্রণয়ের সংসার তিন বছরের। সেই সুবাদে চৌধুরী বাড়িতে মোটামুটি সবাই চেনে নম্রমিতাকে। কখনও সামনাসামনি দেখা না হলেও ফোনালাপ আর রাফিদের কাছ থেকে নানান কথা শুনেছে তারা।
ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট নম্রমিতা, সপ্তাহ খানেক আগেই হুট করে মুখোমুখি বসে পাত্রপক্ষের। আগাম বার্তা বিহীন পরিবারের এহেন কাজে বেশ রাগ হচ্ছে নম্রমিতার। বাবার মুখের উপর কিছু বলার সাহস কোনোকালেই ছিলোনা নম্রমিতার। মধবিত্ত কিনা! এদের জীবনের চেয়ে আত্মসম্মানের দাম বেশি। তাই সাময়িক সময়ের জন্য নিজেকে শান্ত করে। পরিবারের ইচ্ছেতে বসে পাত্রপক্ষের সামনে। মনে মনে ভয় আর জড়তা বাসা বাঁধলেও তা সম্পূর্নরূপে উপেক্ষা করে সে। দেখতে এলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায়না! তাছাড়া মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের জন্য বিয়েটা একটা সংগ্রামের মতো। একের পর এক রিজেকশনে গা গুলিয়ে উঠলেও পাত্র দেখার রীতি অব্যাহত থাকে। মেয়ের বয়স হচ্ছে কিনা! ফর্সা আর রূপসী ছাড়া মধ্যবিত্ত মেয়েদের বিয়ের সংগ্রাম সম্পর্কে বেশ ধারণা আছে নম্রমিতার। ফুফাতো বোন নমিতার বিয়ে নিয়ে হওয়া সব সমস্যা নিজের চোখেই দেখেছে সে। প্রতিটা সম্মন্ধ মেয়ে পছন্দ হয়েছে বলার পরেই মোটা অঙ্কের যৌতুক চেয়ে বসে। কতো হা হুতাশ শেষে কিছুদিন আগেই আধ বয়সী এক লোকের সাথে বিয়ে হয় নমিতার। তাও বেশ মোটা অঙ্কের যৌতুকে।
পারিবারিক কথাবার্তার মাঝেই পাত্রের সাথে কথা বলার জন্য পাঠানো হয় নম্রমিতাকে। বেশ খানিকটা হতাশা নিয়েই ছাদের দিকে পা বাড়ায় নম্রমিতা। পিছনে তাকে দেখতে আসা পাত্র। এতক্ষণে একবারের জন্যও পাত্রের দিলে চোখ তুলে তাকায়নি নম্রমিতা। পাশাপশি বেশ খানিকটা দূরত্বে ছাদের রেলিং ঘেঁসে দাড়িয়ে আছে দুজনে। নীরবতা ভেঙে খানিকটা কেশে ওঠে পাত্র। সেদিকে না তাকালেও খানিকটা নড়েচড়ে ওঠে নম্রমিতা।
“হায়! আদিল আহসান। আপনি..”
“বিয়েটা ভেঙে দিন”
আদিলের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার মাঝেই রুক্ষ কণ্ঠে বলে ওঠে নম্রমিতা। ভ্রু কুঁচকে তাকায় আদিল। অতঃপর রসিকতার কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছে। সম্ভবত আজই আংটি পরানোর কথা রয়েছে।”
চমকায় নম্রমিতা। হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকায় আদিলের দিকে। এই প্রথম সে দেখলো আদিলকে। বয়সের বিশাল এক তারতম্য আদিলের চোখে মুখে স্পষ্ট। হয়তো পৌঢ় নয়তো যৌবন আর পৌঢ়র মাঝের বয়সী যুবক সে। সুঠাম পেশীবহুল দেহ। দেখতে হয়তো খারাপ বলা চলেনা। অন্তত নম্রমিতার এমনটাই মনে হয়। কিন্তু তবুও নম্রমিতা তার প্রেমিক পুরুষকেই চায়। একটু জেদি, খানিকটা রাগী, কিছুটা অগোছালো সেই পুরুষকেই চায়। যাকে মনের মনিকোঠায় আশ্রয় দিয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে।
“আমি ভালোবাসি কাউকে ভীষণভাবে।”
“বিয়ের পর ভুলে যাবেন। এখন কয়েকটা দিন নাহয় আরও কিছুটা ভালোবেসে নিন। বাকিটা জীবন তো সেই ভালোবাসার স্মৃতি নিয়েই কাটাতে হবে।”
“যে পাখি খাঁচায় বাঁধার স্বপ্ন দেখছেন, সে নিজে থেকে ধরা না দিলে তাকে বাঁধা তো দূর, ছুঁয়ে ফেলার ক্ষমতাও কারোর নেই। সূর্যশিশির দেখেছেন! দূর থেকেই সুন্দর। কাছে গেলে দুমড়ে মুচড়ে নিঃশেষ করার ক্ষমতা সে রাখে।”
নম্রমিতার তেজের রোষানলে খানিকটা ভড়কায় বোধহয় আদিল। তবুও চনমনে দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে শার্টের কলার টেনে নিজেকে স্বাভাবিক প্রদর্শনের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় সে। আড়ালে মুচকি হাসে নম্রমিতা। মনে মনে খানিকটা শান্ত হয়। এবার বোধহয় আর এই ছেলে তাকে বিয়ে করতে চাইবেনা।
রিক্সার ঝাঁকুনিতে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে নম্রমিতা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অতীতের স্মৃতি মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। আড়চোখে তাকায় পাশে বসে থাকা পুরুষটার দিকে। চোখ বন্ধ করে রিক্সার সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে রাফিদ। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। মায়া হয় নম্রমিতার। আনমনেই কপালের বিন্দু বিন্দু আকারে জমে থাকা ঘামগুলো ওড়না দিয়ে মুছে দেয় নম্রমিতা। চোখ খুলে তাকায় রাফিদ। থতমত খেয়ে সরে আসতে গেলে শক্ত এক বাহুবন্ধনের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে বিস্মিত হয় নম্রমিতা। ভালোলাগা বেড়ে যায় আরো খানিকটা। এতো ক্লান্তির মাঝেও মানুষটা একহাতে তাকে আগলে রেখেছে। ভাবনার মাঝেই কোমরে টান অনুভব করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নম্রমিতা। রাফিদ আবারো আগের মত চোখ বন্ধ করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“এটা তোমার বেডরুম নয়। রিক্সায় এতো ছোটাছুটি করলে নীচে পড়ে পিষে যাবে।”
বেশ খানিকটা রাগের সাথে মণ খারাপ হয় নম্রমিতার। সে কতোটা উতলা হয়ে থাকে রাফিদের থেকে একটু কথা শোনার জন্য। অথচ সেই মানুষটা পদে পদে অপমান করার একটাও সুযোগ ছাড়েনা। বরাবরের রাগী আর জেদী মেয়েগুলো কি ঠিক এভাবেই কাউকে ভীষণভাবে ভালোবেসে ফেলে! তাদের সমস্ত রাগ, জেদ ঝলসে নমনীয় রূপে ধরা দেয় কারোর কাছে! ভালবাসার বুঝি এতো ক্ষমতা! আছে বৈকি। তাইতো সবচেয়ে বেয়াদব বাউন্ডুলে ছেলেটাও কাউকে ভালোবেসে সংসারী হয়ে ওঠে। জেদী, অহংকারী মেয়েটাও স্বামীর সংসারে শত অপমানে মুখ বুঁজে পড়ে থাকে। ভালবাসার সংজ্ঞা এক এক মানুষের কাছে এক এক রকম। এ এমন এক বিচিত্র জিনিস, যার ব্যাখ্যায় ফুরিয়েছে কবিদের কলমের কালি। সাহিত্যিকদের শব্দভান্ডার হয়েছে ফিকে। পাতার পর পাতা উপন্যাস লিখে ফেলার মতো এক শব্দ হলো ভালোবাসা।
শপিং মলের বিভিন্ন দোকান ঘুরে প্রয়োজনের এটা ওটা জিনিস কিনে ফেলে নম্রমিতা। সবশেষে দুজনে ঢোকে একটা শরীর দোকানে। নিত্যদিনের ব্যবহারের কয়েকটা সুতির শাড়ি পছন্দ করে নম্রমিতা। সেগুলো প্যাকিং করতে বলে নম্রমিতাকে রেখে রাফিদ যায় অপর পাশে। বেশ কিছুক্ষনের মাঝেই কয়েকজোড়া চুড়িদার আর জামদানি শাড়ি নিয়ে আসে সাথে করে। অবাক হয় নম্রমিতা। এতো জিনিস একসাথে কেনার ইচ্ছে তার ছিলোনা। কিন্তু রাফিদকে এই মূহুর্তে কিছু বললে সে শুনবে না এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত নম্রমিতা। শপিং সেরে বেরোতে বেরোতে রাত এগারোটা দশ বেজে গেছে। দোকানপাট প্রায় সব বন্ধের মুখে। কিছু দোকানের ঝাঁপ ফেলাও শেষ।
“কে এফ সি যাবে নাকি ডমিনোস?”
“কোথাও যাবনা। বাড়ি চলুন।”
“দেখো নম্রমিতা, এতো প্যাঁচাল ভালো লাগছেনা। আমি খুব ভালো করেই জানি তোমার হয় পিজা নয়তো কে.এফ.সি চিকেন খেতে ইচ্ছে করছে। বাইরে বের হলেই এগুলো না খেলে মণ ভরেনা তোমার। মনে নেই…”
থামে রাফিদ। পুরনো কথা সে মনে করতে চায়না। এই মেয়েটা আস্ত এক নেশালো নীল বিষ। যা সেচ্ছায় পান করে সে। ক্ষণে ক্ষণে মরছে। আবারও মায়ায় জড়াচ্ছে। আজকাল রোজ সকালে নিয়ম করে সে চা নয় বরং এক কাপ করে নীল বিষ পান করে। ব্যাথা হয়, তবুও পান করে। এ যে বড্ডো নেশালো কারো ছোঁয়ায় বানানো।
“বাদ দিন না প্লিজ। এভাবে রাস্তায় না দাড়িয়ে থেকে বাড়ি চলুন।”
রাগী দৃষ্টিতে তাকায় রাফিদ নম্রমিতার দিকে। এই রাগটা বিয়ের পরের দিন সকাল থেকেই হচ্ছে। আর তরতর করে বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। যতবারই নম্রমিতার সাথে কথা বলছে রাগটা আরো খানিকটা বাড়ছে। তবুও তা যথাসম্ভব গিলে ফেলার চেষ্টা করে রাফিদ। কিন্তু বর্তমানে আর সম্ভব হচ্ছেনা। সমস্ত রাগ উগলে দিতে ইচ্ছে করছে নম্রমিতার উপর। অতঃপর দাঁতে দাঁত চেপে রাগী কণ্ঠে বলে উঠে,
“আপনি আপনি করে এত সম্মান দেখাতে কে বলেছে বলেছে?”
“অপরিচিতদের আপনিই বলতে হয়।”
“আমি অপরিচিত?”
“অবশ্যই তাই। চেনা মুখে অপরিচিতর মুখোশ।”
“মানে?”
“উপরওয়ালা এতো বড়ো একটা মাথা দিয়েছেন অথচ বুদ্ধি দিতে কি ভুলে গিয়েছেন নাকি?”
“নম্রমিতা, রাগাবেনা আমাকে। এর ফল অনেক খারাপ হবে কিন্তু।”
“এই যে তুমি কথায় কথায় নম্রমিতা নম্রমিতা করে চিল্লাচ্ছ, এটা ঠিক তাইনা? শুধু আমি কিছু বললেই আমার দোষ।”
“আমি তাকে ভালোবেসে নম্র ডাকতাম।”
“এখন বাসোনা?”
“জানিনা। হয়তো ভালোবাসারা মরে গেছে কারো বিদঘুটে অপমানে।”
“সে অপমান করেছিলো বুঝি!”
“করেনি বলছো!”
“তাই তো মনে হয়। নিরবে সরে যাওয়াকে অপমান তো আর বলা যায়না।”
রাগে ফুঁসে ওঠে রাফিদ। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে দুটো চর লাগিয়ে দিতে নম্রমিতার গালে। কিন্তু সে পারেনা। এই গালেই তো আদুরে চুম্বনের স্বপ্ন দেখেছিল সে। আদর ছাড়া সেখানে আঘাতের স্পর্ধা যে তার নেই। কিভাবে এতটা ভালো সে বসলো নম্রমিতাকে! নম্রমিতা কি জানে, সে কতোটা উতলা হয়ে মাঝরাত পর্যন্ত জেগে দুচোখ ভরে দেখে তাকে! সে কি জানে, বেঘোরে ঘুমানো তাকে রোজ রাতে নিয়ম করে কেউ উষ্ণ ছোঁয়া দেয়। কপালে ছড়িয়ে পড়া অগোছালো চুলগুলো খুব যত্নে গুছিয়ে কেউ চুম্বন আঁকে ললাটে। রাফিদের মনে পড়ে কোনো এক বিকেলের কথা,
“নম্র, বিয়ের পর তোমার ওই ঠোঁট দুটোও আমার হবে।”
“এই এই, তুমি আবার শুরু হয়ে গেছো। অসভ্য অসভ্য কথা বললে চলে না তোমার?”
“ইশ! কি বলছো। এগুলোকে বলে রোমান্টিক। শুধু রোমান্স হবে রোমান্স।”
“হু বলেছিলো তোমাকে। আমি যদি কিস করতে না দিয় তখন?”
“অপেক্ষা করবো। প্রয়োজনের জনম জনম অপেক্ষা করবো তোমার সম্মতির। পাখি যেদিন নিজে থেকে আসবে আমার খাঁচার একেবারে বুকে টেনে নেবো। সম্মতিবিহীন কোনো নারীকে ছোঁয়ার সাধ কিংবা সাধ্য একজন প্রেমিক পুরুষের হতেই পারেনা। যদি হয় তবে সে প্রেমিক নয়। দেহ পাওয়া বড্ডো সহজ রমণী, মণ পাওয়া এক দুঃসাধ্য অভিযান।”
#চলবে!