তিক্ত বুকের বাঁ-পাশ পর্ব-০২

0
897

#তিক্ত_বুকের_বাঁ-পাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_২( লুকোচুরি ভালোবাসা)

রুমের মধ্যে অস্থিরতায় পায়চারি করছে রাফিদ। ক্ষণে ক্ষণে রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে তার। নম্রমিতার বেখেয়ালির জন্য ডাইনিংয়ে আজ সবার সামনে কি পরিমাণ লজ্জায় পড়তে হয়েছে তাকে। ভাবলেই রাগ লাগছে। ইশ! বাবা মা কি ভাবছেন তার ব্যাপারে! পরক্ষণে নিজের ভাবনায় নিজেকেই গালি দিতে ইচ্ছে করছে রাফিদের। একটা স্বাভাবিক বিষয় নিয়ে সে একটু বেশি বেশীই ভাবছে। বিয়ে হয়েছে তার। এমনটা হয়নি ঠিক আছে। কিন্তু হলেও তো খুব একটা ভুল হতনা!

আনোয়ারা খাতুনের হাতে হাতে টেবিলের জিনিসগুলো গুছিয়ে রুমে আসে নম্রমিতা। যদিও আনোয়ারা খাতুন বারণ করেছিলেন অনেকবার। কিন্তু নম্রমিতা শোনেনি। এভাবে কাঠের পুতুলের মতো বসে থাকার তো কোনো মানে হয়না। যেহেতু বিয়েটা পারিবারিকভাবে ছোটখাটো আয়োজনে হয়েছে, সেহেতু বৌভাতের কোনো পালা নেই। তাই টুকটাক কাজ করলে এমন কিছু ক্ষতি হবেনা। আনোয়ারা খাতুন মনে মনে সন্তুষ্ট হন নম্রমিতার ব্যবহারে। তবে মুখে প্রকাশ করে না। যদিও বিয়েটা তিনি মণ থেকে মেনে নিতে পারেননি, তবুও আর পাঁচটা শাশুড়ির মতো ব্যবহারও তার দ্বারা সম্ভব নয়। ছেলেমেয়েদের সুখকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেন তিনি।

বেডের উপর আধশোয়া হয়ে ফোনে কিছু একটা করছে রাফিদ। নম্রমিতা একপলক রাফিদের দিকে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের কাছে যায়। বিয়ের গহনাগুলো এক এক করে বক্সে ভরে বেশ শব্দ করেই বক্সগুলো রাখে টেবিলে। কাঁচের চুড়িগুলো হতে নিয়ে বেশ কয়েকবার রিনিঝিনি শব্দ করে। অথচ রাফিদ একবারও ভুল করে হলেও এদিকে তাকায় না। বরং ফোনের দিকে চোখ রেখেই মিটিমিটি হাসছে। ভ্রু কুঁচকায় নম্রমিতা। রাগে তার শরীর জ্বলছে। মণ চাইছে রাফিদের গলা টিপে মেরে ফেলতে। হাতের জিনিসগুলো টেবিলের উপর রেখে বেডের দিকে যাওয়ার জন্য আনচান করে নম্রমিতার মণ। ভীষণভাবে দেখতে ইচ্ছে করছে রাফিদ কার সাথে এতো হেসে হেসে কথা বলছে! কিন্তু রাফিদের মুখ তো এদিকেই। বেডের কাছে যেতে গেলে রাফিদ টের পেয়ে যাবে। ভাবনার মাঝেই আড়চোখে তাকাতেই রাফিদকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে দেখে খুশি হয় নম্রমিতা। পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় রাফিদের দিকে। কিন্তু রাফিদের মাথা আর ঝাঁকড়া চুলের জন্য কিছুই ঠিকমতো দেখতে পায়না সে। উপায়ান্তর না পেয়ে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে রাফিদের দিকে। এপাশ ওপাশ থেকে দেখার চেষ্টা করে। কারোর সাথে চ্যাট করছে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু নামটা বোঝা যাচ্ছেনা। তবে একটা মেয়ের ছবি। আনমনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে নম্রমিতা। ঘাড়ের কাছে গরম কিছু অনুভব হতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় রাফিদ। নম্রমিতাকে দেখে খানিকটা ভড়কায় সে। সাথে নম্রমিতাও। আকস্মিক রাফিদকে এতো কাছ থেকে দেখে নিজের অবস্থান সম্পর্কে খেয়াল হয় তার। দ্রুতবেগে উঠতে গিয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে রাফিদের বুকে। ঘটনার আকস্মিকতায় অসহায় চোখে তাকায় নম্রমিতা। রাফিদ নম্রমিতাকে বিছানায় ফেলে এক হাত চেপে ধরে বিছানার সাথে। লো ভয়েসে বলে,

“তোহা কি যেনো বলছিলো তখন?”

“কি হচ্ছে এসব ছাড়ুন।”

“কে কামড়েছে তোমার গলায়? রুমে তো আমি ছাড়া আর কেউ বোধহয় আসেনি। তবে কি আমি কিছু..”

“ছিঃ! নিজে যেমন চিন্তা ভাবনাও ঠিক তেমনই। রাতে গয়না না খুলে ঘুমানোর জন্য ঘষা লেগে লাল হয়ে গেছে।”

“তো এটা সবার সামনে বললে না কেন?”

চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায় নম্রমিতা। রাগে কিড়মিড় করে বলে ওঠে,

“তো সেটা আপনার বলতে কি সমস্যা হয়েছিলো? সবাইকে বললেন না কেনো যে আমাদের মধ্যে ওইসব কিছু হয়নি।”

“কেনো তোমার কি ওইসব করার খুব ইচ্ছে ছিলো নাকি? বাই দা ওয়ে, এই ওইসব মানে কি?”

কথা বলতে বলতে আরো খানিকটা ঝুঁকে পরে রাফিদ নম্রমিতার দিকে। থতমত খেয়ে ছাড়া পাওয়ার জন্য জোর জবরদস্তি করে নম্রমিতা।

“দেখুন!”

“উহু। ইন্টারেস্ট নেই।”

রাগে দুঃখে রাফিদকে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাড়ায় নম্রমিতা। চলে যেতে গিয়েও পিছু ফিরে কটমট দৃষ্টিতে তাকায় রাফিদের দিকে। নম্রমিতার রাগকে তোয়াক্কা না করে হাই তোলার ভঙ্গিতে মুখের সামনে হাত নাড়ায় রাফিদ।

” বাড়ির সুন্দর বাগান রেখে অন্যের বাগানের মধু খেয়ে বেড়ানো ছেলেদের এমনিতেও বউদের প্রতি ইন্টারেস্ট থাকেনা।”

কথাটা বলে এক মুহুর্ত দাঁড়ায়না নম্রমিতা। হনহন করে বেরিয়ে যায় রুমের বাইরে। এদিকে হতবম্ব দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে রাফিদ। যেনো কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে গেলো তার।

৩.

প্রকৃতি নিজ উদ্যমে সেজে উঠেছে নতুন রূপে। বসন্তের ছোঁয়ায় রঙের বাহার চারিদিকে। গাছে গাছে থোকায় থোকায় ফুটে আছে নানা ফুল। লাল টিপযুক্ত শিমুল ফুল হামিংবার্ড, টিয়া আর ময়নার পটভূমি। কোকিলের গুঞ্জন শোনা যায় খুব ভোরে। যেনো ঘণ জঙ্গলের মাঝে সাহায্যের জন্য ডাকছে সে।

বসন্তের রঙে রঙে মেতে উঠেছে চারিপাশ। অথচ নম্রমিতার গায়ে সাদা কাতানের শাড়ি। সোনালী রঙের পাড়ে পাতলা শাড়িতে বেশ লাগছে নম্রমিতাকে। তবুও কেনো যেনো রাফিদের চোখে আজ সবচেয়ে কুৎসিত রমণী সে। তাদের বিয়ের আজ তৃতীয় দিন। নম্রমিতার উচিৎ লালের মাঝে ডুবে থাকা। নববধূ সে। অথচ সব রংকে তুচ্ছ করে সাদাকে বেছে নিতে দেখে রাগ হয় রাফিদের। অফিস থেকে মাত্রই বাড়ি ফিরেছে রাফিদ। রুমে ঢুকেই নম্রমিতার এহেন সাজ দেখে রাগ তরতর করে বেড়ে যায় তার। কাঁধের ব্যাগটা শব্দ করে সোফায় রেখে রাগী চোখে তাকায় নম্রমিতার দিকে। মনে মনে ভয় পেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে সে। নম্রমিতাকে কিছু না বলেই রাফিদ ঢুকে পড়ে ওয়াশরুমে। গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে নম্রমিতা পা বাড়ায় কিচেনের দিকে।

এক গ্লাস লেবুর সরবত এনে টেবিলে রেখে নম্রমিতা অপেক্ষা করে রাফিদের বের হওয়ার। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকে একটু বেশীই সময় নিচ্ছে রাফিদ। বেডে বসে পা দোলাতে নম্রমিতা মনে মনে ভাবতে থাকে রাফিদকে কিভাবে বলবে কথাগুলো। তার যে পড়ার মতো আর বেশি শাড়ি নেই। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও লাগবে। ভাবনার মাঝেই মনে মনে হাসে নম্রমিতা। ভাবে জীবনের অদ্ভুত লীলাখেলার কথা। একটা সময় যার কাছে সবকিছু নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যেত, আজকে তাকে সামান্য কিছু কথা বলার জন্য ভাবতে হচ্ছে। যে মানুষটাকে পুরোটা দিনের বর্ণনা না শোনানো পর্যন্ত ঘুম আসতনা নম্রমিতার। আজ তার বউ হয়েও দুজনের মাঝে কতখানি দূরত্ব। এক ছাদ, এক খাটে তাদের বসবাস। অথচ মাঝে কি বিশাল এক অদৃশ্য দেয়াল। আদৌ কি কখনো এ দেয়াল ভাঙবে! আগের মত কাছাকাছি আসতে পারবে তারা! যদি এমনটা নাই বা হয় তবে কেনো হারিয়ে গিয়েও মিললো তারা? কেনো আবারো দ্বিতীয় বিয়ের পিড়িতে বসতে হলো তাকে? তাও সেই মানুষটার জন্য যাকে একবুক দুঃখ দিয়ে ছেড়ে গিয়েছিল!

“কিছু কথা ছিল আমার।”

আয়নার সামনে দাড়িয়ে টিশার্টের কলার ঠিক করতে নম্রমিতার কথা শুনে একপলক তাকায় রাফিদ। অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,

“শুনছি”

“আসলে, আমার কিছু জিনিস লাগতো। প্রয়োজনীয় খুব।”

রাফিদ চোখ ঘুরিয়ে তাকায় রুমের টিকটিক শব্দে ঘুরতে থাকা ঘড়ির দিকে। মাত্র আটটা বাজে।

“পাঁচ মিনিটে চেঞ্জ করে নীচে এসো। শপ বেশিক্ষণ খোলা থাকবেনা।”

“আমি রেডি আছি। চলুন।”

“এই সাদা শাড়ি চেঞ্জ না করলে কোথাও যাওয়া হবেনা তোমার। প্রয়োজনে চুড়িদার পড়ো, তাও যেনো বিধবার সাজ আর না দেখি। আমি মরে গেলে যতো ইচ্ছে পরো।”

শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকায় নম্রমিতা। আজকাল একটুতেই ঠোঁট ভেঙে কান্না আসে তার। ষোড়শী নারীদের মতো গাল ফুলাতে মণ চায়।
“কিন্তু আম্মা..”

“আম্মার সাথে আমি কথা বলে নেবো।”

রাফিদ চলে যেতেই হাসি ফুটে ওঠে নম্রমিতার ঠোঁটে। রফিদের রাগের মাঝে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা ঠিকই টের পায় সে। উহু রাগ নয়, অভিমান।

“নিশুত রাতে স্বপ্ন ভেঙ্গে উঠবে যখন চমকে,
হঠাৎ কারো চেনা ছোঁয়ায় উঠবে ও-বুক থমকে।”

#চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে