#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_২৭(প্রপ্তিময় সুখ)
“মিষ্টার আরিয়ান চৌধুরী, আপনার ছেলে বেডে নেই। তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা।”
প্রায় ছয় ঘন্টারও বেশি সময় হয়ে গেছে নম্রমিতাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও ডক্টরদের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। মাঝে মাঝে একজন করে নার্স কিছু প্রয়োজনের জন্য বাহিরে আসছেন। পরিবারের সকলের উৎকণ্ঠা আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে নিরস মুখে আবারও ঢুকে পড়ছেন ওটির মধ্যে। এদিকে রাফিদের জ্ঞ্যান ফেরেনি। তাই অযথা সেই রুমে কাউকে ভীড় করতে বারণ করেন ডক্টর। ফলস্বরূপ সকলে নম্রমিতার সুখবরের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে ওটির বাইরে। ইতিমধ্যেই হুট করে রাফিদের নিখোঁজ হাওয়ার ঘটনা আরও একবার নাড়িয়ে দেয় পুরো পরিবারকে। এবার শক্তপোক্ত আনোয়ারা খাতুনও হু হু করে কেঁদে ওঠেন। পরিবারের প্রাণভোমরা এই দুটো মানুষ। অথচ আজ কেউই ভালো নেই। জীবন তাদের থেকে কিসের হিসেব নিচ্ছেন, জানা নেই তার।
একজন নার্সের দেখানো পরিষ্কার আর ফাঁকা একটা ঘরে দাঁড়িয়ে আছে রাফিদ। অতঃপর পরিষ্কার একটুকরো কাপড় বিছিয়ে নামাজে দাড়ায় সে। নামাজের প্রতিটা সুরার সাথে সাথে তার চোখ হতে নির্গত হয় অশ্রুধারা। নামাজের মাঝেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে দুই হাত মেলে ধরে সৃষ্টিকর্তার দরবারে।
“ইয়া মাবুদ, আমি তোমার কাছে দ্বিতীয়বারের মতো কিছু চাইতে এসেছি। শেষবার অভিযোগের সুরে বলেছিলাম, নম্রমিতা কেনো আমার হলোনা! কি দোষ ছিল আমার ভালোবাসায়! কেনো তুমি তাকে আমার না করে অন্য কারোর ঝুলিতে ঢেলে দিলে! তাকে আমার দেওয়ার গুজারিশ করেছি বারংবার। তুমি আমায় নিরাশ করোনি। সময়ের ফেরে নম্র আমার হয়েছে। আমার ভালবাসা ফিরে এসেছে আমার কাছে। আজ আমি সেই ভালোবাসা আবারো ফিরে পেতে এসেছি মাবুদ। হে রহমানের রহিম, তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আমার জীবিত অবস্থায় তাকে মৃত ঘোষণা কোরোনা। আমি সহ্য করতে পারবো না। দরকার হলে আমার আয়ুষ্কালও তাকে দিয়ে দাও। কিন্তু বেঁচে থাকা অবস্থায় এমন কিছু শুনিও না। হে মাবুদ, আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো, আমার প্রাণভোমরা সে। তাকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবো আমি! তুমি তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। আর কিচ্ছু চাইনা। কখনও কিছু চাইবো না। শুধু আমার নম্রকে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে দাও। ফিরিয়ে দাও তাকে।”
কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে গেছে রাফিদের। অসুস্থ শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ ঠিকমতো বসে থাকতে পারছেনা। ছেড়ে দিচ্ছে শরীর। অতঃপর কাঁদতে কাঁদতেই এক সময় লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। নার্সের কথামতো রুমে ঢুকে রাফিদকে অজ্ঞান অবস্থায় পান আরিয়ান চৌধুরী। অস্থিরচিত্তে ডক্টরকে ডাক দেন তিনি। আবারও শুরু হয় রাফিদের ট্রিটমেন্ট।
একনাগাড়ে আরও দুটো ঘণ্টা পেরিয়েছে। রাফিদকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। ফলস্বরূপ গভীর ঘুমে সে। বসে থাকতে থাকতে মাত্রই চোখ লেগে এসেছিলো তোহার। রণকের কাঁধে মাথা দিয়ে মাত্র চোখ বুঁজেছে সে। এমতাবস্থায় হুট করে অফ হয় ওটির লাইট। আরুশি চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,
“আমার আপু, আমার আপু। আপু আছে তো! অপারেশন শেষ, কিন্ত আমার আপু!”
তিনজন ডক্টর বেরিয়ে আসেন একসাথে। তাদের মুখ থমথমে। তাদের অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে নম্রমিতার মা। আরুশি দুইহাতে জড়িয়ে ধরে তাকে। পরিবারের সকলেরও খানিকটা আন্দাজ হয়ে গেছে ঘটনা। আরিয়ান চৌধুরী কিছু বলে ওঠার আগেই ভেসে আসে সদ্যোজাত বাচ্চার কান্নার শব্দ। পিছনে তাকাতেই লক্ষ্য করেন নার্সের কোলে তোয়ালে প্যাঁচানো একটা ফুটফুটে বাচ্চা করুণ সুরে কাঁদছে। সেও বুঝি বুঝতে পেরেছে তার মায়ের ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা! তার বিদায়বেলার আগাম বার্তা কি সেও পেয়েছে!
হুট করে তিনজন ডক্টর একসাথে বলে ওঠেন, “কংগ্রাচুলেশন মিষ্টার চৌধুরী। বাচ্চা আর মা দুজনের গ্র্যান্ড ওয়েলকামের ব্যবস্থা করুন।”
একেবারে থ হয়ে গেছেন আরিয়ান চৌধুরী। খুশীর মাত্রা এতোটা বেশি যে, এই মুহূর্তে তার ঠিক কেমনভাবে রিয়েক্ট করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারছে না। উপস্থিত সবাই আরও একবার কেঁদে দেয়। যে কান্নার মাঝে নেই কোনো বেদনা, বরং যা আছে আছে তা প্রাপ্তি আর উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ।
“আজ সত্যিই মিরাকেল হয়েছে। বাচ্চাকে সুস্থভাবে বের করা গেলেও পেশেন্টকে কোনোভাবেই স্টেবেল করা যাচ্ছিল না। এমনকি একসময় তার হার্টবিটও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। আমরা মনে মনে তাকে মৃত ঘোষণাও করে ফেলি। কিন্তু বিধাতার লীলাখেলা বোঝা যে বড্ডো মুশকিল। হয়তো কারোর ভালোবাসার জোরের সাথে পেরে ওঠেনি তার সিদ্ধান্ত। কারোর আবেগে লুটিয়ে পড়া কান্না দেখে হুট করেই বদলে ফেলেন সিদ্ধান্ত। জোরে শ্বাস টেনে ওঠে পেশেন্ট। নাও, শি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার। তবে অনেক কেয়ারফুলি রাখতে হবে তাকে। অনেক বেশি ধকল গেছে এই কয়েকমাসে তার উপর দিয়ে। শরীরে নূন্যতম শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই।”
৩৩.
ছয় বছর পর,
কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে ছোটো নুরির পিছনে পুরো রুম জুড়ে ছোটোছুটি করছে নম্রমিতা। নুরি কখনও ব্যালকনিতে আবার কখনো বেডের এপার থেকে ওপার ছুটে বেড়াচ্ছে। তাকে খাওয়াতে গিয়ে নাস্তানাবুদ অবস্থা নম্রমিতার। বিগত ত্রিশ মিনিট ধরে অর্ধেক খাবারটাও শেষ করানো যায়নি। ক্লান্ত হয়ে বেডে বসে পড়ে নম্রমিতা। নুরি মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হেঁসে ওঠে। অতঃপর জেদী কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আব্বু না আসলে আমি খাবোনা। খাবোনা মানে খাবোনা। একটুও নাহ।”
এইটুকু মেয়ের এমন একগুঁয়েমি আর জেদ দেখে বরাবরই অবাক হয় নম্রমিতা। তার ধরনা, একমাত্র রাফিদের জন্যই মেয়েটা দিনকে দিন এমন বাঁদর হচ্ছে। তার জেদ ক্রমাগত বাড়তেই থাকছে। রাগী দৃষ্টিতে নুরির দিকে তাকায় নম্রমিতা। কণ্ঠ খানিকটা উঁচু করে বলে ওঠে,
“বয়স মাত্র ছয়। অথচ তোমার সব কথা আমাদের শুনে চলতে হবে! এতো জেদ কোথা থেকে আসে! যেমন জেদ দেখিয়েছ, তেমন আজকে সারাদিন না খেয়েই থাকবে। একটা খাবারও পাবেনা আর।”
মায়ের উঁচু কণ্ঠের আওয়াজে কাঁচুমাচু হয়ে যায় নুরির মুখ। চোখে ভীড় করে অশ্রুকণারা। কাঁদো কাঁদো মুখে তাকায় নম্রমিতার দিকে। তবুও মন গলেনা নম্রমিতা। শব্দ করে হেঁটে বের হয়ে যায় রুম থেকে। মুখভঙ্গি দারুন কঠোর।
“আমার নুরি পাথর কি আজও বকা খেয়েছে আম্মুর কাছে?”
বেডের শেষপ্রান্তে আধা শোয়া আধা বসা অবস্থায় দুই পা বিছানার নিচে ঝুলিয়ে রেখে পড়াশোনায় ব্যাস্ত নুরি। মুখটা একেবারে কাঁদো কাঁদো অবস্থা। রাফিদ সদ্য অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই বুঝতে পারে মেয়ের অভিব্যাক্তি। আজও নিশ্চয়ই নম্রমিতার কাছে বকা খেয়েছে সে। রাফিদের আদুরে কণ্ঠ শুনে জোরে জোরে কেঁদে দেয় নুরি। একদৌড়ে ছুটে গিয়ে কোমর পেঁচিয়ে জাপ্টে ধরে তাকে। কাঁদতে কাঁদতে নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে সে।
রাতের দ্বিতীয় প্রহর। রাফিদের কাঁধে মাথা রেখে মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে আকাশপানে চেয়ে আছে নম্রমিতা। ফুরফুরে শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে সর্বাঙ্গ। শরীর জুড়ে কেমন যেনো এক ঝিম ধরা অনুভূতি। অনুভূতি শিয়রে পৌঁছে গেলে যেমন অবশ হয়ে পড়ে শরীর, তেমনই এক অনুভূতিতে ছেয়ে আছে তার দেহ মন। বড্ডো ভালো লাগছে। আবেগে রাফিদের হাতখানি আরও খানিকটা শক্ত করে চেপে ধরে সে। ঠোঁটের হাসি চওড়া হয় রাফিদের। দুষ্টুমিরা কিলবিল করতে থাকে মাথায়। অতঃপর একহাতে নম্রমিতার কোমর জড়িয়ে ধরে আরও খানিকটা কাছে টেনে নেয়। মোহনীয় কণ্ঠে বলে ওঠে,
“নম্র, আমার একটা ইচ্ছে অপূর্ন আছে আজও।”
“কি ইচ্ছে?”
“খোলা আকাশের নিচে আমাদের দ্বিতীয় বাসর।”
“ছিঃ! অসভ্য।”
“ওরে আমার সভ্যবতি। আপনার মতো সভ্য হলে এতদিনে আর মা ডাক শুনতে হতো না আপনাকে।”
“হয়েছে হয়েছে। রুমে চলো এবার। নুরি একা ঘুমিয়ে আছে।”
“উহু, একদমই নাহ। মাঝরাতে ছাদে এসে চন্দ্রবিলাস করার ইচ্ছে জেগেছিলো তোমার। আমি সঙ্গ দিয়েছি। এবার আমাকে একটু আমার চন্দ্রে পাড়ি দিতে দাও!”
“বুড়ো বয়সে এসব আদিখ্যেতা করতে লজ্জা করেনা তোমার!”
“একটুও নাহ।”
বেশ খানিকটা সময় রাফিদের কোলে বসে নম্রমিতা কিছু একটা ভাবলো। অতঃপর মুখে হাসি ফুটিয়ে মুখোমুখি বসে রাফিদের। উল্লাসি কণ্ঠে বলে ওঠে,
“ওকে, আমি রাজি। তবে আমারও একটা শর্ত আছে।”
“কী?”
“নুরির তো ছয় বছর হয়ে গেল। তুমি কী চাওনা ওর একটা ভাই আসুক!”
রাফিদ এক ঝটকায় কোল থেকে সরিয়ে দেয় নম্রমিতাকে। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় নম্রমিতা।আক্রোশে ফেটে পড়ে রাফিদ। আঙ্গুল উঁচিয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। থমথমে মুখে নেমে যেতে নেয় ছাদ হতে। নম্রমিতার আবেগের পসরা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই কথাটুকু বলার জন্য ঠিক কতখানি সাহস সঞ্চয় করতে হয়েছে সেটা একমাত্র সেই জানে। ঠোঁট ভেঙে কান্না আসে তার। ছাদের কার্নিশ ধরে মেঝেতে বসে পড়ে সে।
#চলবে!