তিক্ত বুকের বাঁপাশ পর্ব-২৩

0
665

#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_২৩(নিঃস্ব বুক)

বাকরুদ্ধ রাফিদ। জীবনের এতো বড়ো একটা খুশির দিনে অনুভূতি প্রকাশ করতে ভুলে গেছে সে। কেমন যেনো থম মেরে বসে আছে সেই থেকে। বাবা হওয়ার অনুভূতি যে এতো বেশি সুখের তা জানা ছিলো না তার। অদ্ভূত এক শিহরণ খেলে যাচ্ছে দেহ মনে। নম্রমিতা এখনও অজ্ঞান। এ খবর তার জানা নেই। জানলে হয়তো খুশিতে এতক্ষণে কান্না করে দিতো সে।

চৌধুরী বাড়িতে দ্বিতীয় খুশির আমেজ। একসাথে দুটো নতুন সংবাদে মুখরিত বাড়ি। তোহা পারে তো পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নাচে। সবচেয়ে বেশী খুশী লাগছে তাকে। তোহা রুমে গিয়ে কল করে রনককে।

“শুনুন, একটা গুড নিউজ আছে।”

“গুড নিউজ!”

“হ্যা। একটা ছোটো বাবু আসতে চলেছে।”

“নাউজুবিল্লাহ। কিসব বলো তোহা! আমি তো এখনও টাচ পর্যন্ত করলাম না তোমাকে। শুধু একটু আদটু চুমু খেয়েছি শুধু।”

বেডে বসে কপাল চাপড়ায় তোহা। তার আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো এই লোক ফাজিলের একনম্বর। যেনো পড়াশোনা নয় ফাজলামির উপর কোর্স করেছে সে। আস্ত এক ফাজিলের হাড্ডি। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে তোহা বলে ওঠে,

” পাপা নয় ফুফা হতে যাচ্ছেন আপনি।”

“ওহ তাই বলো। আমি তো আবার ভাবছিলাম..”

ঠাস করে মুখের উপর কল কেটে দেয় তোহা। প্রথমে চমকালেও পরবর্তীতে হো হো করে হেসে ওঠে রনক।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে রাফিদ বসে নম্রমিতার পাশে। কিছুক্ষণ আগেই জ্ঞ্যান ফিরেছে তার। তবে শরীরটা ভালো লাগছেনা। তাই বেড থেকে ওঠেনা আর। পাশে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলে তাকায় নম্রমিতা। আচমকা তার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে রাফিদ। নম্রমিতা ডানহাত রাখে রাফিদের মাথার পিছে। ঝাঁকড়া চুলগুলোতে আলতো হাতে হাত বুলিয়ে মিহি কণ্ঠে বলে ওঠে,

“এমন করছো কেনো? ঠিক আছি তো আমি।”

“ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে অনেক।”

“পাগল একটা।”

“হুম”

“শোনো, খুশি তো তুমি!”

“এতো বেশী খুশি যে প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা।”

২৬.

তোহাকে সাথে নিয়ে বিয়ের কেনাকাটা করতে এসেছে রনকের পরিবার। রনক আর তোহা মিলে বিয়ের শাড়ী পছন্দ করছে। বাকিরা গয়না দেখছে পাশের স্টোরে। আচমকা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে তোহা। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পায় রুহেলকে। ঢিলেঢালা পোশাক, কেমন যেনো ছন্নছাড়া। অবাক হলেও মুখে তা প্রকাশ না করেই আগের মতো ব্যাস্ত হয়ে পড়ে সে শাড়ি দেখতে।

“তোহা, কেমন আছো?”

“ভালো। তুমি?”

“এইতো আছি।”

“ওহ”

“একা!”

“উড বি হাসবেন্ড আছে সাথে।”

“তুমি বিয়ে করছো?”

“কেনো বিয়ে কী মানুষ করেনা নাকি? আর আমার বিয়ে নিয়ে এত বিস্ময় প্রকাশের কী আছে?”

“গত চারদিন ধরে কলেজের সামনে তোমার জন্য
অপেক্ষা করেছি তোহা। কিন্তু তুমি আসোনি। তবে এই সেই কলেজ না আসার কারণ!”

“প্রথম কথা হলো, আমি জানতাম না তুমি অপেক্ষা করছিলে আমার জন্য। আর দ্বিতীয় হলো, আমি জানলেও আসতাম না। তুমি এমন কোনো স্পেশাল মানুষ না আমার কাছে, যে আমাকে তোমার অপেক্ষা করা দেখে ছুটে যেতে হবে।”

হাসে রুহেল। তার কন্ঠ কাঁপছে। দুরু দুরু বুকে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে ওঠে,

“আমাকে মাফ করা যায়না তোহা!”

“মাফ! কিন্তু কেনো! তোমার আমার কাছে মাফ চাওয়ার মতো তো কিছু নেই। আর তুমি যদি মনে করো যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তবে সেটা একদমই ভুল। আমি বাসিনা ভালো তোমাকে।”

“কিন্তু আমি বাসি তোহা। অনেক বেশি ভালোবাসি।”

রাগ হয় তোহার। এই মুহূর্তে তার সব রাগ গিয়ে পড়ছে রণকের উপর। তোহাকে একা রেখে সে যদি অন্যদিকে না যেত, তবে রুহেল এতো কথা বলার সাহস পেতো না। মাথা ঠাণ্ডা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তোহা বলে,

“দেখো রুহেল। প্লীজ এখান থেকে যাও, এটা আমার অনুরোধ।”

“প্লীজ তোহা। বিয়েটা কোরোনা। মরে যাবো আমি।”

“তবে মরে যাও। কিন্তু এই ধরনের কথা আর কখনো বলবে না আমার সামনে। বিয়ে করবো না মানে কি? ছেলেখেলা পেয়েছ? দেখো রুহেল, তোমার জীবনটা ছেলেখেলা হতে পারে, আমারটা নাহ। একের পর এক মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করা তোমার স্বভাব হতে পারে আমার নাহ। বিয়ে আমার কাছে খুব পবিত্র একটা জিনিস, আল্লাহর রহমত।”

“আমি আর আগের মতো নেই তোহা। একদম চেঞ্জ হয়ে গেছি। শত সুন্দরী মেয়েদের দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করেনা আর। আমার চোখে তো একজনই আঁটকে গেছে। তাকে ভুলতে পারছি না কিছুতেই।”

“প্লীজ, চুপ করো। এসব নাটক আমার সহ্য হচ্ছে না। আর একটাও বাজে কথা বললে আমি ভুলে যাবো তুমি আমার সিনিয়র। নিজের সম্মান বাঁচাতে চাইলে এখনই বেরিয়ে যাও এখান থেকে।”

মাথা নীচু করে ফেলে রুহেল। স্টোর থেকে বের হতে গিয়ে আবারও ফিরে আসে তোহার কাছে। মৃদু কণ্ঠে বলে,

“আমি আবারও আসবো তোহা। আমার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আসবো তোমার কাছে। একটু বাঁচার লোভে বারবার ছুটে আসবো তোমার কাছে। প্রয়োজনে তোমার পায়ে পড়ে যাবো। একটু ভালোবাসা চেয়ে নেবো ভিক্ষা স্বরূপ। কতোদিন আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারো, আমি দেখতে চাই। একটা কেনো একশত বিয়ে হয়ে গেলেও অবচেতন মনে শুধু তোমাকেই চাইবো আমৃত্যু।”

কথাটুকু বলে আর দাঁড়ায়না রুহেল। বের হয়ে যায় স্টোর থেকে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তোহার। রুহেলের এমন পাগলামী সহ্য হচ্ছে না তার। রুহেল যে সত্যিই চেঞ্জ হয়ে গেছে সেটা তার চোখে মুখে স্পষ্ট। তার প্রতিটা কথায় ছিলো আকুতি। কাওকে সত্যিকারের ভালোবাসলেই এমন আকুতি করা যায়। যেমন সে বাসে রনককে। দুনিয়া এপার ওপার হয়ে গেলেও সে রনককেই চাইবে। তোহার সকল অভিযোগ জমা হলো উপরওয়ালার কাছে। আসমানের দিকে তাকিয়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“যারে বানাওনি যার তরে, কেনো বাঁধিলে তারে মনের ঘরে!”

২৭.

কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে তোহা ওয়েট করছে রনকের। বিয়ের মাঝে কলেজে আসার ইচ্ছে একবারেই ছিলো না তার। কিন্তু নতুন সেমিস্টারের কিছু কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন্য আসতে হয়েছে। বিগত একঘন্টা ধরে সে অপেক্ষা করছে রনকের জন্য। অথচ সে একেবারে লাপাত্তা। রাগ হয় তোহার। মনে মনে বেশ খানিকটা বকাঝকাও করে তাকে। অতঃপর খানিকটা দূর থেকে রনকের গাড়ি দেখতে পেয়ে মুখে হাসি ফুটে ওঠে তার। তোহার সামনে গাড়ী দাঁড় করিয়ে দরজা খুলে দেয় রনক। তোহাও বিনাবাক্য ব্যয়ে উঠে বসে গাড়িতে। গন্তব্যহীন পথে চলছে গাড়ি। মূলত রনক তোহাকে নিয়ে বেরিয়েছে লং ড্রাইভে যাওয়ার জন্য। বিয়ের আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। প্রেমীক প্রেমিকা হিসেবে এটাই তাদের শেষ ঘোরাঘুরি। ফুরফুরে মেজাজে জানালা থেকে মাথা বের করে বসে আছে তোহা। রনক বেশ কয়েকবার বারণ করলেও কথা কানে নেয়নি সে। তাই রনকও আর জোর করেনি।

সামনের একটা স্টলে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে তোহা। রনক ভাবে তোহা হয়তো সেই স্টোর থেকে কিছু কিনবে। তাই গাড়ি সাইড করে ফেলে। রনককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তোহা দৌড়ে যায় রাস্তার অপরপাশে। একজন হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতা বৃদ্ধ লোক লাঠি হাতে দাড়িয়ে আছে সেখানে। তোহা একদৌড়ে বৃদ্ধার কাছে গিয়ে অনেকগুলো হাওয়াই মিঠাই কিনে ফেলে। দুইহাত উঁচু করে দূর থেকে সেগুলো দেখায় রনককে। তোহার বাচ্চামি কান্ড দেখে হেসে ফেলে রনক। তোহার এই সরলতার জন্যই তো এতো বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে। হালকা হেসে সামনের দিকে তাকাতেই ধক করে ওঠে রণকের বুক। দুই হাতে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে আসা মেয়েটার দিকে ধেয়ে আসছে একটা দ্রুতগামী গাড়ী। গাড়িটা যতদূর সম্ভব ব্রেক ফেইল করেছে। নয়তো ব্যাস্ত রাস্তায় এতো স্পিডে গাড়ি চলার কথা নয়। বুক কেঁপে ওঠে রণকের। তোহা একবারও মাথা তুলে আশেপাশে তাকাচ্ছেনা। সে ব্যাস্ত হাতের হাওয়াই মিঠাই নিয়ে। কলিজার পানি শুকিয়ে আসে রণকের। তীব্র ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে বুক। এই দৃশ্য দেখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে সে। কথা বলার চেষ্টা করছে অথচ মুখ থেকে শুরু আআ জাতীয় শব্দ ছাড়া কিছু বের হচ্ছে না। মুহুর্তেই রবের কাছে তোহার প্রাণ ভিক্ষা চায় সে। গাড়িটা যতোই তোহার কাছে আসছে রনকের হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তোহার নিস্পাপ চেহারা, সেই হাসিমুখ। চোখের কোণঘেঁষে গড়িয়ে পড়ে মোটা মোটা অশ্রুকণা। খালি খালি লাগে বুকটা। গাড়িটা একেবারে তোহার কাছাকাছি আসতেই দুই চোখের উপর হাত চেপে তোহার নাম ধরে চিৎকার করে জ্ঞ্যান হারায় রনক।

#চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে