#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_২২(সূচনা নাকি অন্ত!)
“নাতবউরে আজ ঘরে নিয়া চলো বৌমা। এই মেলা সুন্দরী ঘরের বাইরে রাখবার নয়। এক্কেরে চাঁদের টুকরা মুখখানি।”
রনকের দাদীর কথায় তোহা বাদে রুমে উপস্থিত সবাই উচ্চস্বরে হেঁসে ওঠে। হাসে রনক স্বয়ং। লজ্জায় একহাত দিয়ে অপরহাতের নখ খুঁটছে তোহা। এতটা লজ্জা এতো বছরের জীবনে সে কখনো পায়নি। একে তো নার্ভাসনেসে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, তার উপর রণকের দাদির লাগামছাড়া কথাবার্তা। লজ্জায় কান লাল হয়ে যাচ্ছে যেনো তার।
বড়োরা বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি করতে ব্যস্ত। তোহা আর রণককে আলাদা করে নিজেদের মতো বোঝাপড়া করার জন্য পাঠানো হয় তোহার রুমে। বেডের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে রণক। সামনের জানালা ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চিন্তায় মগ্ন তোহা। হুট করেই তোহা হুড়মুড় করে এসে বসে রণকের পাশে। কণ্ঠ খাদে ফেলে প্রশ্ন করে,
“আপনার কিছু জানার নেই?”
“নতুন করে জানার মতো কিছু কী আছে? যা জানার সবই তো জানা মোটামুটি। তুমি আমাকে ভালোবাসো, এর চেয়ে বেশি কিছু আমার জানার নেই।”
“কিন্তু আমার বলার আছে।”
“না বললে হয়না? চলোনা পুরোনো কথা ভুলে বরং ফিউচার প্ল্যান করি। এক হালি নাকি এক ডজন বাচ্চা নেবো সেসব নিয়ে ভাবি।”
“অসভ্য, ফাজিল একটা।”
“এই যাহ, আগের বারের কথা দেখি তোমার মনে নেই। শ্বশুরের বাড়িতে এসে একটু আমার অসভ্যের প্রমাণ নিতে চাইছো নাকি তোহা!”
“প্লীজ চুপ করুন। আপনি আজকাল বড্ডো লাগামছাড়া কথা বলছেন। ঠিক হচ্ছেনা কিন্তু।”
“ইশরে হবু হাফ বউটা রেগে যাচ্ছে। নাকি লজ্জা পাচ্ছে!”
“চুউউউউপ। একেবারে চুপ। এখন শুধু আমি বলবো আর আপনি শুনবেন।”
“আচ্ছা বলো।”
“রুহেলকে আমার ভালোলেগেছিলো। আবারো বলছি ভালোলেগেছিলো, ভালোবাসিনি। প্রেম জীবনে বহুবার হলেও ভালোবাসা হয় একবারই। ভালোবাসা হতে গেলে ভালোলাগা থাকতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। ভীষণ ভালোলাগতো একজন বন্ধু হিসেবে আপনাকে। কিন্তু হুট করেই আপনার খারাপ ব্যবহারগুলো দাগ কাটতে শুরু করলো আমার কোমল হৃদয়ে। ভালো লাগাটা পরিণত হলো খারাপ লাগাতে। ঠিক সেই সময় রুহেলের কাছাকাছি আসা, নতুন অনুভূতির সাথে পরিচয়, প্রেমের মিষ্টি মিষ্টি কথা, সবকিছুই ভালো লাগতে শুরু করে। আপনার খারাপ ব্যবহারের কাছে এগুলো অনেক মধুর লাগতে শুরু করে। হেলে পড়ি সেদিকে। সময় গড়াতেই বুঝতে পারি রুহেলের জীবনে আমি প্রথম কিংবা শেষ নই। আগেও এসেছে অনেকে, ভবিষ্যতেও আসবে। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসতো না। ঠিক এই জায়গাটাই ছিলো সবচেয়ে চিন্তার। ভালোবাসার মানুষের পাশে তো কাকপক্ষির উপস্থিতিও সহনীয় নয়। তবে আস্ত সুন্দরী সুন্দরী রমণীদের কিভাবে সহ্য করতে পারছি আমি! তাও গায়ে মাখিনা ততটা। নব্য প্রেমের অনুভূতিতে ভাসতে ভাসতে হুট করেই যেনো তীর খুঁজে পাই। বুঝতে পারি বাস্তবতা। এর মাঝে আপনিও কলেজ ছেড়েছিলেন। অনেককিছু বলার ছিল যেনো আপনাকে। কিন্তু ঠিক কী বলার ছিল আমার জানা ছিলো না। আপনার বিদায়বেলা আমাকে ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে গিয়েছিলো। কেমন যেনো অজানা এক কষ্টে ভেঙে পড়েছিলাম আমি। যার উৎস ছিলো নিজেরও অজানা। সেদিন আপনার বলা অসুখের কথা আমি না বুঝলেও আপনার চলে যাওয়া আমাকে বুঝিয়েছে সবটা। প্রতি মুহূর্তে টের পাইয়ে দিয়েছে আমিও যে সেই অসুখের ভুক্তভুগী। সুধারূপে করেছি পান প্রেমের গরল। আমাদের কখনও ঘটা করে বিচ্ছেদ হয়নি। তবে কেউ কারোর দিকে তাকানোর প্রয়োজনও মনে করিনি। এরপর থেকে শুধু একজনই আমার সবটা জুড়ে ছিলো। যাকে ঘিরে সাজিয়েছি অগণিত অগোছালো স্বপ্ন। যার পূর্ণতা পাওয়ার কোনো আশা কিংবা আকাঙ্খা বেঁচে ছিলো না। তবুও অবুঝ মন বারবার চেয়ে গেছে তাকে। বেসেছে তাকেই ভালো।”
একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তোহার আঁখিকোটর থেকে। রণক গড়িয়ে পড়ার আগেই তা তুলে নেয় আঙ্গুলের ডগায়। সিক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“এটাই প্রথম আর এটাই যেনো শেষ কান্না হয় তোমার, তোহা। কথা দিলাম, সজ্ঞানে আমার কারণে কখনও একফোঁটা জলও গড়াবেনা এ আঁখি হতে। তারা শুধু সাক্ষী হবে আমার ভালোবাসার। আমার নির্লিপ্ত গভীর চুম্বনে মত্ত হয়ে সুখ খুঁজে নেবে। আর বিষাদ নয়, এবার স্বাদ হবে সুখের।”
প্রাপ্তির হাসি হাসে তোহা। ডানহাত রণকের বুকের মাঝে রেখে মাথা রাখে বামপাশে। রণকও গভীর আলিঙ্গণে জড়িয়ে ধরে তার প্রিয়তমাকে।
“আমাকে মাফ কোরো তোহা। নিজের অজান্তেই অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। তুমি আগে থেকেই এতটা ছটফট করেছো যন্ত্রণায় জানা থাকলে দার্জিলিং এ নতুন করে আর কষ্ট দিতাম না। দেখা মাত্রই বুকে জড়িয়ে নিতাম। যে শান্তির খোঁজে ছিন্নভিন্ন হয়েছ, উজাড় করে দিতাম সেই শান্তি তোমার আঁচলে।”
খানিকটা মাথা তুলে তোহা ডানহাতের তর্জনী রাখে রণকের ঠোঁটে। অতঃপর চোখে চোখ রেখে আবেগী কণ্ঠে বলে ওঠে,
“ভালোবাসি। ভালোবাসি আমার একান্ত ব্যাক্তিগত রাগী মানুষটাকে। ভালোবাসি আমার সান্নিধ্যে আসা লুচ্চা মানুষটাকে। ভালোবাসি, ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি।”
কিছুক্ষন নিরবতা কাটিয়ে রণক ফিসফিস করে বলে ওঠে,
“এখন উত্তর দিলাম না বলে রাগ করো না আবার যেনো! বিশেষ দিনে বিশেষ মুহূর্তের জন্য তোলা রাখলাম এর উত্তর।”
২৫.
স্নিগ্ধ সকালের মুক্ত বাতাসে নেই কোনো কালিমা। ফুরফুরে মেজাজে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানে তোহা। রুম থেকে ফোন এনে কল করে রণককে। দুই বারের মাথায় ঘুমে আচ্ছন্ন কণ্ঠে ফোন রিসিভ করে রণক। অস্পষ্ট সুরে বলে,
“হ্যালো কে?”
“আপনার বউ”
“বউ, ঘুমাতে দাও না একটু! এমনিতেই কাল রাত করে ঘুমিয়েছি।”
“রাগ জেগে কথা বলতে কে চেয়েছিল শুনি!”
“আমি সব দোষ মাথা পেতে নিচ্ছি। কিন্তু এখন একটু ঘুমাই প্লিজ।”
“এই এই একদম না। আজ না আমাদের বিয়ের লেহেঙ্গা কিনতে যাওয়ার কথা!”
“হুম তুমি রেডি হয়ে থাকো, আমি দশটার মধ্যে তোমাকে পিক করে নেবো। এখন রাখছি, টাটা।”
তোহাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কল কেটে দেয় রণক। অতঃপর আবারো আচ্ছন্ন হয়ে গভীর ঘুমে। আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাদের বিয়ে। হাতে একমাস এর মতো সময় আছে প্রায়।
সকাল থেকেই নম্রমিতা বেশ খানিকটা অসুস্থ। কেমন যেনো দূর্বল দূর্বল লাগছে শরীরটা। ঘুম থেকে উঠতে গিয়েও মাথা ঘুরে গিয়েছিলো বেশ খানিকটা। সাধারণ দুর্বলতা ভেবে সেভাবে মাথা ঘামায়নি আর। সামনের মাসে বিয়ে। একে একে সব কাজগুলো গোছানো বাকি। রাফিদ অফিসের জন্য রেডি হতে হতে ডাক দেয় নম্রমিতাকে। কিচেনের গ্যাস অফ করে অস্থির পায়ে রুমে এর দিকে চলল সে। কোমরে গুঁজে রাখা আঁচল দিয়ে মুখে জমে থাকা ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে রাফিদের কাছে। হুট করেই মাঝপথে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে ভীষণভাবে। নম্রমিতা পড়ে যেতে গেলে তাকে দুইহাতে আগলে ধরে রাফিদ। ব্যাস্ত পায়ে টেনে আনে বেডের কাছে।
“নম্র, ঠিক আছো তুমি? শরীর খারাপ লাগছে? আগে বলোনি কেনো আমাকে? আম্মা, আম্মা শোনো এদিকে জলদি আসো আম্মা। তোহা, পানি নিয়ে আয়।”
রাফিদকে পাগলের মতো সবাইকে ডাকতে দেখে হাত খামচে ধরে নম্রমিতা। শরীর কেমন যেনো গুলিয়ে আসছে তার। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও বহু কষ্টে ক্লান্ত কণ্ঠে বলে,
“এভাবে ব্যাস্ত হবেন না প্লীজ। আমি ঠিক আছি তো।”
“কী ঠিক আছো তুমি? ঠিকভাবে কথাটাও বলতে পারছ না। আর বলছো ঠিক আছো! এতটা অসুস্থ কিভাবে হলে তুমি! একটুও যত্ন নাওনা নিজের প্রতি। নম্র তোমাকে এভাবে অসুখ করতে দেখতে পারিনা যে আমি! কেনো নিজের অযত্ন করো? এভাবে বেখায়ালি করবে আমাকে কে সামলাবে বলো! তুমি যে অসুস্থ আমাকে একবার কেনো বললেনা? এই অবস্থায় আবার কিচেনে গেছো রান্না করতে! ইশ কেমন করে তাকিয়ে আছো দেখো! এভাবে দেখোনা নম্র কষ্ট হচ্ছে তো আমার।”
নম্রমিতার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে কেঁদে দেয় রাফিদ। মুখের উপর টপটপ করে পড়া জলে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে নম্রমিতা। আলগোছে হাত রাখে রাফিদের গালে। বহু কষ্টে উচ্চারণ করে কয়েকটা শব্দ।
“ইশ, পাগলের মতো এভাবে কাঁদতে হয়না রাফিদ। পাগল একটা।”
অতঃপর আলগা হয়ে যায় হাত। ছেড়ে দেয় শরীর। দম বন্ধ হয়ে আসে রাফিদের। একের পর এক আলতো থাপ্পর দিতে থাকে নম্রমিতার গালে। অতঃপর হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বুকে জড়িয়ে নেয় নম্রমিতাকে। মনে মনে প্রশ্ন করে, এ কী সূচনা নাকি অন্ত!
#চলবে!