#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_১৮(বিচ্ছেদ বিড়ম্বনা)
২০.
প্রবল বর্ষণের ধারার ন্যায় তুষারের ফোয়ারা আছড়ে পড়ছে বাইরে। নম্রমিতা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। অথচ পছন্দের সেই তুষারপাত এক মুহূর্তের জন্যও আকৃষ্ট করতে পারছেনা তাকে। মনের মাঝে খেলে চলেছে অদ্ভুত এক দোলাচল। জীবনের হিসাব মেলাতে মেলাতে সে ক্লান্ত। আর কোনো হিসেব মেলানোর চেষ্টা করেনা। তবুও কিভাবে যেনো সব গড়মিল তার জীবনের সাথেই ঘটে।
তুষারপাতের ফলে আজকে সকালে শীতের প্রকোপ একটু বেশীই। ঘুমের ঘোরে ব্ল্যাঙ্কেটটা আরো খানিকটা টেনে নিয়ে বেডের ডানপাশে হাতড়ায় রাফিদ। বেশ কিছুক্ষন খোঁজাখুঁজি করে কাউকে না পেয়ে চট করে চোখ খুলে ফেলে। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ একহাতে কচলে তাকায় রুমের আশেপাশে। জানালার কাঁচ লাগানো। বাহিরের দিকে দৃষ্টি মেলে নিমগ্ন হয়ে কিছু একটা ভাবছে নম্রমিতা। রুমের মধ্যে হিটার থাকায় শীত কম। তাও কেমন যেনো একটা শীত শীত ভাব থেকেই যায়। আস্তে ধীরে সেদিকে এগিয়ে যায় রাফিদ। তড়িৎগতিতে নম্রমিতাকে কোলে তুলে ধপাস করে ফেলে দেয় বিছানায়। অতঃপর নম্রমিতার বুকে মাথা রেখে আগের মতো শুয়ে পড়ে সে। একহাত দিয়ে গলা পর্যন্ত টেনে নেয় কম্বল।
ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে হুলস্থুলরকম ভাবে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় নম্রমিতা। যতক্ষণে বোধগম্য হলো ততক্ষনে বেশ ভারী ভারী নিঃশ্বাস ছাড়ছে রাফিদ। তপ্ত শ্বাস ফেলে রফিদকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় নম্রমিতা। অবাক হয়ে তাকায় রাফিদ। টেনে ধরে নম্রমিতার বাহু। নম্রমিতা ছিটকে সরিয়ে দেয় হাতের বাঁধন। ভ্রুজোড়া আরো খানিকটা কুঁচকে যায় রাফিদের। ঘুমের রেশ ছুটে গেছে সেই কখন। তবুও আস্তে ধীরে উঠে বসে সে। রাশভারী কণ্ঠে বলে,
“মন খারাপ?”
হাসে নম্রমিতা। আয়নার সামনে দাড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিজেকে। দেখে চোখের নিচের কালো দাগগুলো। এবড়ো খেবড়ো মুখের ত্বক ছুঁয়েও দেখে। দেখে এলোমেলো চুলগুলোকে। বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠে বলে ওঠে,
“মনের খবর রাখতে জানলে, মন খারাপের কারণ হতেনা।”
ভারী চমকায় রাফিদ। একে একে মনে করতে থাকে নিজের কর্মকাণ্ড। নাহ! কোথাও তো সে মন খারাপ হওয়ার মতো কিছু করেনি! তবে কেনো এ অভিযোগ! মনের কথা মনের মাঝে চেপে রেখে এগিয়ে যায় নম্রমিতার কাছে। বাহু ধরে টেনে বসায় বেডে। নিজেও বসে পড়ে পাশে। নম্রমিতার দুইহাত ভরে নেয় নিজের হাতের মুঠোয়। অতঃপর দীর্ঘ এক বিরতি নিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,
“সমস্যাগুলো কখন বড়ো হয় জানো? যখন আমরা তার সমাধান করিনা। একটা ছোটো বিষয়, ছোটো আঘাত অভিমান আকারে মনে পুষতে পুষতে একসময় তা দীর্ঘকায় রূপ নেয়। মানুষ তো সেখানেই থাকে, তবে মাঝে তৈরি হয়ে যায় এক অদৃশ্য দেয়াল। একজন অভিমান ভাঙ্গিয়ে দেয়াল টপকে ওদিকে পৌঁছাতে পারেনা। আবার অপরজন অভিমানে সিক্ত হয়ে দম্ভে দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করেনা। ফলে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একসময় অসহ্য রকম অসহনীয় হয়ে ওঠে একে অপরের কাছে। অতঃপর বিচ্ছেদ। অথচ একে অপরকে ভালোবেসে সংসার পেতেছিলো তারা।”
নিশ্চুপতাকে সঙ্গী বানিয়ে নিঃস্তব্ধ থাকলো নম্রমিতা। মুখে রা ও কাটলো না। তপ্ত শ্বাস ফেলে খানিকটা এগিয়ে গেলো রাফিদ। বামহাতের বাহু দ্বারা চেপে ধরলো নম্রমিতার মাথা নিজের বুকে। সাথে সাথেই ভেজা অনুভব করলো বুক। বিস্মিত দৃষ্টি তাক করে ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে টেনে তুললো নম্রমিতার সিক্ত কপোল। মুক্ত কণার ন্যায় বারিরাশি উপচে পড়ছে আঁখিকোটর হতে। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে থাকে রাফিদ। মস্তিষ্ক শুন্য শুন্য লাগছে। দূরত্ব কমিয়ে আরো খানিকটা কাছে টেনে নিলো নম্রমিতাকে। একেবারে বুকের সাথে জাপ্টে ধরে পিষে দেবে যেনো! বাড়লো কান্নার গতি। এবার সশব্দে কেঁদে উঠলো নম্রমিতা। প্রিয়মানুষের ছোঁয়া বোধহয় এমনি! একটু বেশিই আহ্লাদি। তাইতো আহ্লাদে আটখানা হয়ে ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে অশ্রু। বুকের মাঝে তির তির করে বিঁধছে প্রিয়তমার প্রতিটা অশ্রুকণা। ছারখার হচ্ছে ভেতরটা। যন্ত্রণায় হিম হয়ে আসছে শরীর। খানিকটা সময় অতিবাহিত হতেই ছিটকে দূরে সরে গেলো নম্রমিতা। হুট করেই যেনো কোনো অশরীরী ভর করলো তাকে। কান্নার ফলে ফুলে ওঠা চোখ মুছে ফেললো এক নিঃশ্বাসে। অতঃপর আবারো এগিয়ে এসে এক হাতের মুঠোয় ভরে টেনে ধরলো রফিদের কলার। শান্ত দৃষ্টিতে হিশহিশিয়ে বলে উঠলো,
“প্রতিশোধের জন্য বিয়ে করেছিলে তাইনা! আমাকে ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ করাই তোমার একমাত্র লক্ষ্য ছিলো! দেখো আমি কষ্ট পাচ্ছি। কষ্টের বুনোজালে জড়িয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। শান্তি মিলছে খুব তাইনা! কেনো আমাকে বিয়ে করলে রাফিদ? কেনো! কেনো! আমি তো জোর করে তোমার জীবন থেকে যাইনি। পরিস্থিতির স্বীকার তো আমিও হয়েছিলাম! দুজনে তো একইভাবে ঠকেছিলাম। অথচ কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো আমাকে একাই। পুরুষ নামক এক নরপিশাচের সাথে কাটাতে হলো দিনের পর দিন। তোমার দেওয়া লাঞ্ছনা মাথা পেতে নিয়ে তোমার ভালো থাকা চেয়েছিলাম। কোনটা আমার অন্যায় বলো! বাসস্ট্যান্ডে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পরও যখন সেই মানুষটা আসেনা, আমার তখন কী করা উচিত ছিলো? বাবার মাথা সকলের সামনে নত করে নিজের গায়ে পলাতক তগমা লাগানোর জন্যও তো প্রস্তুত ছিলাম আমি। শুধুমাত্র তোমাকে ভালোবেসে। এইযে এতগুলো দিন এমন নোংরা এক পুরুষের সাথে রাত কাটানো কি খুব সহজ ছিল আমার পক্ষে? ঘেন্না হতো আমার। গা গুলিয়ে আসতো। মাঝরাতে মুখে বালিশ চেপে কান্না করতাম ভাগ্যের উপর। তুমি তো শুধু মানসিক যন্ত্রণায় ছিলে, আর আমি! মানসিক যন্ত্রণার সাথে সাথে শারীরিক যন্ত্রণায় ভুগতাম প্রতিনিয়ত। বিবাহিত নারীদের মাঝরাত হয় সোহাগের। স্বামীর আদরে নির্ঘুম রাত কাটে। অথচ প্রতি রাতে আমি হতাম ধর্ষিতা। মাঝরাতে ড্রিংক করে এসে বউয়ের পরামর্শবিহীন তাকে ছোঁয়াকে সমাজ ধর্ষণই বলে। ক্লাবে, পাবে মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করে ঘুরে বেড়ানো একটা ছেলের সাথে একই বিছানায় ঘুমাতেও ঘেন্না করতো আমার। মাঝে মাঝে মনে হতো নিজেকে শেষ করে দিই। নিঃসঙ্গ রাতগুলোর মাঝে হুট করেই একটা মুখ চোখের সামনে ভেসে আসত সবসময়, মনে হতো কেমন আছে সে! নতুন প্রেমিকার সাথ পেয়ে নিশ্চই আর মনে নেই আমাকে! সে ভালো থাকুক। অন্তত আমার মতো দগ্ধ ঘা তার না হোক!”
থামে নম্রমিতা। ডুকরে কেঁদে ওঠে। রাফিদ নিঃশব্দে আবারও বুকে টেনে নেয় তাকে। একহাত মাথার পিছে দিয়ে নিঃশব্দে ভরসা দেয়। চুলের মাঝে এঁকে দেয় গভীর চুম্বন। সরে যায় নম্রমিতা। নিজেকে ধাতস্থ করে কাঠ কাঠ গলায় বলে ওঠে,
“ডিভোর্স দিয়ে দাও আমাকে রাফিদ। কথা দিচ্ছি, কখনও তোমাদের মাঝে সমস্যা সৃষ্টি করবো না। যে প্রতিশোধ এর নেশায় হুট করেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে, তা তো পূর্ণ হয়েছে। এবার মুক্তি দাও আমাকে। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায়না।”
বিস্ময়ে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রাফিদ। নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। ডিভোর্স! এতো ভারী একটা শব্দ এতো সহজে বলে ফেললো নম্রমিতা! কিভাবে পারলো! মুক্তি চায় সে! কথাগুলো ঘূর্ণিঝড়ের মতো গোলগোল ঘুরে বারেবারে যেনো ধাক্কা দিচ্ছে তার কানে। মুহুর্তেই চোয়াল শক্ত করে রাগী চোখে তাকায় নম্রমিতার দিকে। চেপে ধরে নম্রমিতার চোয়াল শক্ত করে। অতঃপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
“মুক্তি পাওয়ার যদি এতই সাধ জাগে তবে মেরে ফেলো আমাকে। বেঁচে থাকতে এই জীবনে কখনো মুক্তি পাবেনা আমার থেকে। একবার ভুল করে হারিয়েছি, আর নয়। ডিভোর্সের নাম মুখে আনলে জানে মেরে দেবো একদম। এরপর দুজনে একসাথে মরে যাবো।”
আঙ্গুলগুলো দেবে যাচ্ছে একে একে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে নম্রমিতা। পানি গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। সম্মতি ফিরে পায় রাফিদ। ছেড়ে দেয় নম্রমিতার চোয়াল। কাঁপা কাঁপা হাতে আলতো করে ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই থামিয়ে দেয় নম্রমিতা। ফিচেল কণ্ঠে বলে ওঠে,
“তবে তুমি কী চাইছো রাফিদ? ঠিক একই জায়গায় একই হোটেলে তারিন নামের মেয়েটা কিভাবে আসে? এতোকিছু সবই কি কাকতালীয়? তোমার প্রাক্তন প্রেমিকা, সরি প্রাক্তন নয় বর্তমানও বটে। তো তোমার প্রেমিকা আর তুমি কি প্ল্যান করেই এসেছো! কিভাবে ম্যানেজ করবে দুজনকে? ছুটি যেহেতু এক সপ্তাহের তো দুজনকে তিনদিন তিনদিন করে দেবে নাকি! তবে তো আজ রাত তোমার প্রেমিকার জন্য বরাদ্দ!”
সপাটে এক চড় খেয়ে ছলছল চোখে তাকায় নম্রমিতা। রাফিদ নিজেও হতভম্ভ। এটা কী করে ফেললো সে ! তার নম্রকে আঘাত করলো! ফুলের টোকা না দিতে চাওয়া মানুষটাকে সে নিজের হাতে আঘাত করলো! যার কষ্টগুলো স্পঞ্জের মতো শুষে নিতে চেয়েছিল, আজ তাকেই কষ্ট দিলো!
নিস্তব্ধ পরিবেশ। একেবারে যাকে বলে পিনপতন নিরবতা। রাফিদ মাথায় হাত ঠেকিয়ে বসে আছে বেডে। নম্রমিতা এলোমেলো বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে বসে আছে মেঝেতে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কান্না করে যাচ্ছে সে। জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করে রাফিদ। অতঃপর শান্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারীর দিকে চোখ তুলে তাকালে আমার এ চোখ ধ্বংস হোক।”
#চলবে!