তিক্ত বুকের বাঁপাশ পর্ব-১০

0
831

#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_১০(প্রণয়ের সূচনা নাকি পরিণাম!)

ক্যাম্পাসের সিনিয়র জুনিয়র সব বিল্ডিং খুঁজেও তোহাকে কোথাও পাওয়া গেলো না। লাইব্রেরী থেকে শুরু করে প্রতিটা করিডোর, এমনকি ছাদেও খুঁজতে বাদ দেয়নি রনক। কিন্তু ফলাফল শুন্য। অজানা আশঙ্কায় বুক ধুকপুক করছে তার। তোহার সাথে করা ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত সে। মেয়েটাকে একটু বেশিই বকে ফেলেছে সে। সদ্য কিশোরী তোহার টলমলে অশ্রুসিক্ত চোখ, তার দৃষ্টি এড়ায়নি। তবুও রাগের কাছে অনুভূতিরা নত স্বীকার করেছে।

ক্যান্টিনে ব্যাগের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে প্রীতি। হুট করেই তার রাগ হচ্ছে তোহার উপর। মেয়েটা আসবে বলেই তো সে এসেছিল কলেজে! কিন্তু একেবারে লাপাতা সে। একা একা ক্লাস করতে কোনোমতেই রাজি নয় প্রীতি। মনে মনে তোহাকে শ খানেক গালি দিয়ে ব্যাগ কাঁধে উঠে দাড়ায় সে। উদ্দেশ্য বাড়িতে যাওয়া। পিছন ঘুরতেই হুট করে রনককে দেখে খানিকটা ভড়কে যায় প্রীতি। সাথে অবাকও হয় বেশ। রনককে কেমন যেনো অস্থির লাগছে। কিছু নিয়ে কি চিন্তিত উনি!

“আসসালামু আলায়কুম স্যার। কিছু বলবেন?”

বেশ খানিকটা অস্বস্তি হচ্ছে রনকের। প্রীতিকে কিভাবে জিজ্ঞাসা করবে বুঝতে পারছেনা। আবার না জিজ্ঞাসা করেও উপায় নেই। চিন্তা হচ্ছে তার ভীষণ। উপায়ান্তর না পেয়ে রনক আমতা আমতা করে বলে ওঠে,

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যা আসলে তোহাকে খুঁজছিলাম। দরকার ছিলো একটু।”

রনকের কথা শুনে প্রীতি কিঞ্চিৎ অবাক হলেও মুখে তা প্রকাশ করেনা। মলীন কণ্ঠে বলে ওঠে,

“ও তো আজ আসেনি স্যার। ক্লাসে তো দেখলাম না।”

“তোহা এসেছিলো। আমি আসলে একটা কাজ দিয়েছিলাম। সকালে ব্যাস্ত থাকায় কথা বলার সময় পায়নি।”

“কিন্তু আমার তো ওর সাথে দেখা হয়নি। আপনি দাড়ান আমি দেখছি কল করে। যদি ক্যাম্পাসে থাকে তো চলে আসবে।”

বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন তোলে তোহা। বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে। ঢুলু ঢুলু চোখে ফোন রিসিভ করে।

“তোহা, কোথায় তুই? ক্যাম্পাসে এসেছিস শুনলাম।”

প্রীতির কথা শুনে ঘুম ছুটে যায় তোহার। আবারও মনে পরে রনকের বলা কথাগুলো। ঠোঁট ফুলিয়ে কান্নারা ভীড় জমাতে চায়। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“ভালো লাগছিলো না। তাই বাড়িতে চলে এসেছি। এখন রাখছি, পরে কথা বলবো।”

প্রীতির কথা শোনার অপেক্ষা না করেই কল কেটে দেয় তোহা। মনটা বড্ডো ভার হয়ে আছে আজ। মনে মনে ঠিক করে নেয় রনকের সাথে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলবে সে। আর কখনো বন্ধুত্বের দাবিদার হবেনা সে। স্যার হিসেবে ঠিক যতটুকু প্রয়োজন সেটুকুই কথা বলবে। এর বেশি নয়। জোর করে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয়না। রনক বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে তো কি হয়েছে! বাড়ানো হাত গ্রহণ করতেই হবে এমন কসম তো কেউ দেয়নি! সে ফিরিয়ে দেবে। রাখবেনা কোনো সম্পর্ক রনকের সাথে। রনক চাইলেও না।

তোহা বাড়ীতে চলে গেছে, কথাটা শুনে খানিকটা মনঃক্ষুন্ন হয় রনকের। তবুও মুখে অমায়িক হাসি বজায় রেখে প্রীতিকে বিদায় জানিয়ে নিজেও চলে যায় গন্তব্যে। তোহাকে তার ভালো লাগে এটা রনক জানে। তবে এতটা উতলা তো কখনো হয়নি! আজ হটাত করেই এমন উন্মত্ততা কিসের! তোহা তো কোনো দোষ করেনি! বরং সে রুহেলকে ভাই বানিয়ে কথাটা বলেছে। তাও কেনো সে মেনে নিতে পারছেনা? কেনো মনে হচ্ছে তোহা তাকে ছাড়া আর অন্য কাউকে গুরুত্ব না দিক। তবে কী সে ভালোবেসে ফেলেছে তোহাকে! নাহ নাহ এ সম্ভব নয়। তোহা তার স্টুডেন্ট। টিচার মানেই হলো গুরু। গুরুজনের যায়গাকে এভাবে কলঙ্কিত করার অধিকার তো তার নেই।

১১.

সকালে ঘুম ভাঙতেই নম্রমিতার চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাফিদের মুখ। তাকে অস্তেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সে। যেনো ছেড়ে দিলেই কোথাও পালিয়ে যাবে। ঘুমের মাঝের প্রতিটা নিঃশ্বাস এসে ঠেকছে নম্রমিতার গলায়। অদ্ভুত এক ঊষ্ণ শিহরণে রোমাঞ্চিত হচ্ছে দেহ মন। ভালো লাগছে রাফিদকে এত কাছ থেকে দেখতে। নম্রমিতা ডান হাত বাড়িয়ে আলতো হাতে এলোমেলো করে দেয় রাফিদের চুল। আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয় রাফিদের আদুরে ঠোঁট। যা বেশ আদুরে ভঙ্গিতে ফুলিয়ে শুয়ে আছে রাফিদ। হাসে নম্রমিতা। ঠোঁট এগিয়ে চুমু খায় কপালে। অতঃপর নাকের ডগায়।

সকাল সকাল গোসল শেষে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে নম্রমিতা। ততক্ষনে রাফিদ সজাগ। ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষন আগে। ফোলা ফোলা চোখে নম্রমিতার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে ওঠে সে। ভ্রু কুঁচকে তাকায় নম্রমিতা। অসময়ে এহেন উচ্চস্বরে হাসির কারন বোধগম্য হচ্ছেনা তার।

“রাতে কিছু কী হয়েছিলো নম্র!”

“নাহ তেমন কিছু তো হয়নি।”

“আচ্ছা, কেমন কিছু হয়নি? বাই এনি চান্স তুমি কি আমার ঘুমের সুযোগে….”

রাফিদের টেনে টেনে বলা দুষ্টুমি ভরা কথা শুনে লজ্জায় অন্যদিকে ফিরে যায় নম্রমিতা।

“ছিঃ! খালি খারাপ কথা তোমার তাইনা! খারাপ লোক।”

“তুমি খারাপ কাজ করতে পারো, আর আমি বললেই দোষ! উহু এটা তো ঠিক নয় নম্র। লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে আদর করবে আর আমি কোনো সুযোগ পাবোনা তা কী করে হয়!”

“চুপ করো প্লিজ। কীসব উল্টা পাল্টা কথা বলছো সকাল সকাল!”

“আচ্ছা, তাহলে সকাল সকাল গোসুল করলে কেনো বলো! আমি যতদূর জানি হাসবেন্ড অনেক বেশি বেশি আদর করলে সকালে গোসল করতে হয়।”

চোখ পাকিয়ে তাকায় নম্রমিতা। একপ্রকার তেড়ে যায় গলা চেপে ধরার ভঙ্গিতে।

“ভাইয়া আসবো?”

তোহার কণ্ঠ শুনে ছিটকে দূরে সরে যায় নম্রমিতা। অতঃপর মিষ্টি হেসে তোহাকে ভেতরে আসতে বলে।

“ডিস্টার্ব করলাম নাকি ভাবি?”

“আরে না না। তোমার যখন ইচ্ছে আসবে। পারমিশন নেওয়ার দরকার নেই বুঝলে!”

মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ায় তোহা। যার অর্থ সে বুঝেছে।

“বাবাহ! এতো সকাল সকাল গোসল করেছো যে ভাবি! রাতে কী হয়েছিলো?”

তোহার কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় নম্রমিতা রাফিদ দুজনেই। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। দুজনের দিকে সন্ধিহান চোখে তাকায় তোহা। অতঃপর ফিক করে হেঁসে বলে ওঠে,

“নিশ্চই এই কাজ ভাইয়ার তাইনা?”

“মানে?”

“এইযে বিছানায় টয়লেট করে দেওয়া। সেই জন্যই গোসল করতে হয়েছে সকাল সকাল তোমাকে তাইনা!”

হাঁফ ছেড়ে বাঁচে নম্রমিতা। এতক্ষন কী না কী ভেবে অহেতুক লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল সে। অতঃপর গমগমে কণ্ঠে বলে,

“হ্যা হ্যা। একদম ঠিক বলেছো তুমি। তোমার। ভাইয়াই তো।”

“এই এই কিসের আমি? আমি কি বাচ্চা নাকি যে বিছানায় টয়লেট করবো?”

রাফিদের রাগি কণ্ঠ শুনে হা হা করে হেঁসে ওঠে নম্রমিতা আর তোহা দুজনেই। মলীন চোখে তাকায় রাফিদ।

“শোনো তোহা, আসলে এমন কিছু নাহ। সকাল সকাল অনেক গরম লাগছিলো তো, তাই গোসল সেরে নিলাম।”

সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে রাফিদের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে চলে যায় তোহা। নম্রমিতা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কাগজে কি আছে দেখার জন্য। অজানা জিনিস জানার প্রতি মানুষের আগ্রহ অনেক বেশি থাকে। নম্রমিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। কাগজে কি আছে তা দেখার আগ্রহ হচ্ছে তার ভীষণভাবে। রাফিদ পেপারগুলো চেক করতে করতে আড়চোখে তাকায় নম্রমিতার দিকে। অতঃপর সেগুলো এগিয়ে দেয় নম্রমিতার দিকে।

“এগুলো কী?”

“তোমার মাস্টার্স এর জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলাম আমি। সেই পেপারগুলোই তুলে আনতে বলেছিলাম তোহাকে। তোহাদের কলেজেই অ্যাডমিশন করিয়েছি। দুজনে একসাথে যাতায়াত করতে সুবিধা হবে।”

বেশ খুশি হয় নম্রমিতা। কিন্তু পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে মলীন করে ফেলে মুখভঙ্গি।

“কি হলো?”

“আমি এখন এই বাড়ির বউ রাফিদ। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়ির বউদের পড়াশোনা করা ভালো দেখায় না।”

“এসব নিয়মের তোয়াক্কা করা কবে থেকে শুরু করলে তুমি?”

“যখন থেকে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি আমার পাশে কেউ নেই। বাঁচতে হলে এই সমজের নিয়ম নীতির আওতায় বেঁধে থাকতে হবে। নয়তো পদে পদে অপমান, অবমাননা আর নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছুই পাবোনা। ঠিক তখন থেকেই তোয়াক্কা করা শুরু করেছি।”

“প্রেম আঙিনায় আগত সমস্ত কাঁটায় পা ফেলার আগে একজোড়া হাত পাবে আমৃত্যু অবদি, পা আর কাঁটার মাঝে দেওয়াল হয়ে। কথা দিলাম।”

#চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে