#তাসের ঘর
ঐশিতা সেন
পর্বঃ০১
তরকারিতে সামান্য লবণ কম হওয়ায় রিপন নিজের স্ত্রী দোলার গায়ে হাত তুলল।এটা আজ প্রথম না,প্রতিদিনের রুটিন।সামান্য বিষয়েই রিপন দোলাকে মারে,তাও খুবই নির্মম ভাবে।কখন লাঠি দিয়ে তো কখনো গলা টিপে ধরে।মেরে রক্তাক্ত করে দিতেও দুবার ভাবে না।রিপন যেন দোলাকে সহ্যই করতে পারে না।নিজের সংসার বাঁচানোর জন্য দোলাও সহ্য করে যায় কিছু বলে না।কেউ যেন ওর মুখে আঠা লাগিয়ে দেয়।রিপন তো সংসারটা ভাঙ্গতেই চায়।কিন্তু মাঝে মাঝে যখন সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায় তখন প্রতিবাদ করে।প্রতিবাদ করলে আরো বেশি জুলুমের শিকার হয়।রিপন কোনোদিনও দোলাকে বোঝার চেষ্টা করে নি।
কাল রাত থেকে দোলা জ্বরে ভুগছে।সেবা শুশ্রূষা তো দূর রিপন একবার দেখেও যায় নি।বরং জ্বরে যখন গোঙ্গাচ্ছিল তখন মুখে কসটেপ লাগিয়ে দিয়ে গেছে।সারারাত দোলা জ্বরের প্রকোপ সহ্য করে আর চোখের জল ফেলেই কাটিয়েছে।পাশে চার বছরের বাচ্চা ছেলেটার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা সহ্য করেছে।ভোরের দিকে চোখটা লেগেছিল।সকাল হতে না হতেই আবার এলার্মের শব্দে উঠতে হয়।দোলা তাড়াতাড়ি উঠে স্নান শেষে রান্না বসায়।ঠাকুরের জন্য প্রসাদ তৈরি করে তারপর পুজো দিতে বসে।রিপন উঠার আগে পুজো শেষ করতে হবে।নইলে আরেক অশান্তি।রিপন স্নান শেষে প্রসাদ খেয়েই দিন শুরু করে।ওর উঠার আগেই প্রসাদ রেডি চাই।তাই বলে কখনো মাসের বিশেষ দিনগুলো ছাড়া নিজে পুজো দিতে চায় না।দোলা হাজার অসুস্থ থাকুক না কেন দোলাকেই সব করতে হয়।রিপন কখনো দোলাকে সাহায্য করে না।পুজো সেরে দোলা নিজেদের জন্য রান্না চড়াতে যায়।এরই মধ্যে দোলার চার বছরের ছেলে দীপ উঠে মাকে ডেকে কাঁদতে থাকে।এদিকে এখন দীপের কাছে গেলে তরকারি পুড়ে যাবে।দোলা কি করবে বুঝতে পারে না।দীপের কান্নার আওয়াজে রিপনের ঘুম ভেঙে যায়।রিপন রেগেঃ দোলা এই দোলা কোথায় তুমি?দেখছ না তোমার ছেলে কাঁদছে।তাড়াতাড়ি সামলাও ওকে।উফ এই মেয়ে কোথায় গেলে?করছটা কি?কাজের কাজ তো কিছুই কর না সারাদিন শুয়ে বসেই কাটাও।একটা বাচ্চা সামলাতে পারছ না?
রিপনের কথায় খারাপ লাগলেও দোলা কিছু বলল না।মনে মনে শুধু বললঃ আমি তো কাজ করছি।তুমিও তো ছেলের কাছে যেতে পারো।ছেলে তো শুধু আমার না তোমারও।আমার প্রতি নাই বা করলে কিন্তু নিজের ছেলের প্রতি তো কিছু দায়িত্ব পালন করতে পারো।শুধু খাওয়া-পরার ভার নিলেও বাবা হওয়া যায় না।সারাক্ষণ আমাকে খোঁটা না দিয়ে কখনো নিজের ছেলের কথাও তো ভাবতে পারো।কিন্তু তোমার সেই সময় কোথায়?অন্যের স্ত্রীর কথা ভাবতে ভাবতেই তো জীবন পার করবে।
দোলা নিজের চোখের জল মুছে তড়িঘড়ি করে ছেলের কাছে যায়।ছেলেটা মাকে দেখেই কান্না থামিয়ে কোলে উঠার জন্য হাত বাড়ায়।দোলাও হাসিমুখে ছেলেকে কোলে নেয়।ছেলের চোখে মুখে আদর দিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে।ফুটফুটে বাচ্চা ছেলেটা মা-বাবার মতো ফর্সা হয়েছে।চেহারাটা বাবার মতো।আর মুখে মায়ের মতো একটা আলাদা মায়া কাজ করে।রিপন কি এই ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়েও নিজেকে শোধরাতে পারে না?
দোলা গরম জল করে ছেলেকে স্নান করিয়ে প্রসাদ খাইয়ে দেয়।ততক্ষণে রিপনও স্নান সেরে চলে আসে।রিপনের প্রার্থনা শেষ হলে দোলা রিপনকেও প্রসাদ দেয়।রিপন প্রসাদ খেয়ে ছাদে চলে যায় হাঁটতে।দোলা দীপকে খেলনা দিয়ে বসিয়ে রান্না শেষ করতে যায়।কিন্তু দীপ তো আর খেলনা নিয়ে বসে থাকার পাত্র নয়।দোলার পিছু পিছু কিচেনে চলে আসে।আর দোলাকে জ্বালাতে লাগে।এটাই প্রতিদিনের রুটিন।
দোলাঃ বাবাসোনা ড্রয়িংরুমে গিয়ে খেলো না।বাচ্চাদের রান্নাঘরে থাকতে নেই সোনাটা।মাকে জ্বালিও না পাখি।রান্না নষ্ট হয়ে যাবে।পরে তোমার বাবা রাগ করবে না?
দীপঃ মা তোমাল কাতে থাকব।দুত্তু কলব না।
দোলা আর কিছু বলল না।ছেলের জ্বালাতন দেখে ভাবে ওর বাবাও তো জানে ছেলেটা কত জ্বালায়।সাথে করে ছাদে নিয়ে গেলে কি হতো?দোলা ঠিক করে রান্নাটা তো করতে পারত।এমনিতেই অসুস্থ শরীর চলছে না।
হঠাৎ দোলার মাথা ভার হয়ে আসল।জ্বরটা আবার বেড়েছে।রাতে ঔষধ খাওয়ায় সকালের দিকে একটু কম ছিল।কিন্তু স্নান করায় আবার বেড়ে গেছে।সাথে মাথা ব্যথা ফ্রী।ইচ্ছে করছে এখন শুয়ে থাকতে।কিন্তু তা সম্ভব নয়।অনেক কাজ বাকি।ঘরটাও গুছানো হয় নি।আবার ৯টার আগে রান্না শেষ করতে হবে।রিপন অফিসে যাবে।দোলা মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে কোনোকিছুতে ধরে নিজেকে সামলায়।কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।সবটাই দীপ লক্ষ করে।মায়ের আঁচল টেনেঃ মা কি হয়েছে তোমাল?কত্ত হত্তে?বাবাকে দাকি?(কাঁদো কাঁদো হয়ে)
দোলা ছেলের মুখে হাত বুলিয়েঃ না সোনা কিচ্ছু হয় নি।মা ঠিক আছি।সোনা তুমি ওই রুমে গিয়ে খেল।তুমি না মায়ের ভালো ছেলে?মায়ের সব কথা শুন।যাও না সোনা।মা তাড়াতাড়ি রান্না সেরে তোমার কাছে আসব কেমন?
দীপঃ আত্তা মা।আমি তোমাল সব কতা সুনব।
দোলাঃ এইত্তো আমার লক্ষ্মী সোনা।
বলে দীপকে আদর করল।দীপও মায়ের গালে আদর দিয়ে ছুটে চলে গেল।দোলা কোনোরকমে রান্না করতে লাগল।শরীরটা অনেক খারাপ লাগছে।কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।
এদিকে ছাদে নীচের ফ্ল্যাটের রাত্রী দাশকে বসে থাকতে দেখে রিপনের মুখে হাসি ফুটে উঠল।ও চলে যায় রাত্রীর কাছে।দুজনে বসে হাসিমুখে গল্প করতে শুরু করে দেয়।রাত্রীর ৬বছরের মেয়ে অত্রিও আছে ছাদে।অত্রি খেলছে।কিছু বাদেই ছাদে প্রবেশ করেন উপরের ফ্ল্যাটের মি.দত্তের মা।উনাকে দেখে রিপন দাঁড়িয়ে পড়ল আর দুজনে স্বাভাবিক কথাবার্তা শুরু করে।যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা করছে।অত্রিও ছুটে যায় মি.দত্তের মায়ের কাছে।
অত্রিঃ দিদা দিদা আমার সাথে খেলবে?
মিসেস দত্তঃ(সৌজন্য মূলক হেসে)তুমি খেল বাছা।আমি একটু হেঁটে আসছি।
অত্রিঃ আচ্ছা আমিও হাঁটব।
মিসেস দত্তঃ আচ্ছা চলো।(কিছুটা বিরক্ত হয়ে)
মিসেস দত্ত একবার রিপন আর রাত্রীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলেন।মিসেস দত্তের কোনো কারণে অত্রিকে ভালো লাগে না।রাত্রীর মেয়ে বলেই।আবার দীপকে খুব আদর করেন।দীপের জন্য উনার মায়া কাজ করে।
রিপনঃ এই মহিলা আমার দিকে সবসময় এভাবে তাকান কেন যেন আমি কারো খুন করেছি?(ফিসফিসিয়ে)
রাত্রীঃ করো নি তো কি?করতে কতক্ষণ?
রিপনঃ মানে?
রাত্রীঃ কিছু না।আমি এখন বাসায় যাই বরং।এখানে বেশি সময় কথা বললে বুড়ি আবার সন্দেহ করবে।সকাল বেলা তো ছাদে কেউ আসে না শুধু এই বুড়িই হাঁটতে চলে আসে।
রিপনঃ হাঁটতে না আমাদের বিরক্ত করবে বলে আসে।
রাত্রীঃ তা ঠিক।
রাত্রী অত্রির কাছে এসেঃ অত্রি বাসায় চলো।
অত্রিঃ না আরো কিচ্ছুক্ষণ থাকি?
রাত্রী চোখ রাঙ্গিয়েঃ এসো তাড়াতাড়ি।বায়না করবে না।স্কুলে যেতে হবে তো।
অত্রিঃ(মুখ ভার করে) আচ্ছা।
ওরা দুজন চলে গেল।
রিপনও কিছুসময় হেঁটে বাসায় গেল।বাসায় গিয়ে দেখে যা দেখল তাতে মাথা গরম হয়ে গেল।
(চলবে)