তবু মনে রেখো (২১ পর্ব)
.
বারান্দায় অন্ধকার। সে মজিদাকে দেখতে পেলেও তাকে দেখেনি।
ইলহাম তাসনিমের পেছনে গিয়ে পকেট হাতড়ে মাস্ক বের করে পরে নিল। মজিদা অন্ধকারে মানুষের ছায়ামূর্তি দেখে বললো,
– ‘এইখানে কে?’
রায়হান গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
– ‘মজিদা আমি রায়হান।’
– ‘চেয়ারম্যান চাচার ছেলে রায়হান নি?’
– ‘হ্যাঁ বৃষ্টির জন্য দৌড়ে এসে উঠলাম।’
– ‘লগে কারা? ঘরে আইয়া বসো।’
– ‘বন্ধু দুইজন। থাক আমাদের পায়ে কাদা। বৃষ্টি থামলেই চলে যাব।’
মজিদা আবার ঘরে চলে গেল। তাসনিম ফিসফিস করে ইলহামকে বললো,
– ‘কিরে তুই মাস্ক পরলি কেন।’
– ‘এই মেয়েকেই আমি ওইদিন পুষ্পিতাদের বাড়ির সামনে দেখেছি।’
রায়হান শুনে বললো,
– ‘তাই না-কি, মজিদা তাহলে সেখানে কাজ করে।’
ইলহাম আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘ওর কাছে পুষ্পিতার নাম্বার থাকতে পারে।’
– ‘তা থাকবে, কিন্তু আন্টি তো সেভাবে কিছু করতে চান না। ওর মাধ্যমে নাম্বার এনে লুকিয়ে যোগাযোগ করে লাভ নেই।’
তাসনিম ফিসফিস করে বললো,
– ‘তবুও দেখ নাম্বার আনা যায় কি-না। মুরব্বিদের মাধ্যমে হলে তো পুষ্পিতার সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ নেই। ওর মাধ্যমে নাম্বার এনে রাখলে ভালো।’
– ‘এখন দরকার নেই। এখন তো জানলাম ও সেখানে কাজ করে। পরে দরকার হলে আসবো। আগে বাড়ি যাই, আব্বার সাথে কথা বলি।’
দু’জনই সম্মতি জানায়। বৃষ্টি কিছুটা থেমে এলো মিনিট তিরিশেক পর। রায়হান বাইরে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– ‘কমে গেছে এখন চলে যাই।’
তিনজনই উঠানে বের হয়ে গেল। রায়হান যেতে যেতে বললো,
– ‘মজিদা বৃষ্টি থেমেছে আমরা চলে যাচ্ছি।’
মজিদা শুনেছে কি-না সেটা নিয়ে আর ভাবলো না তারা। বের হয়ে এলো রাস্তায়। কাদায় পিচ্ছিল রাস্তা। সোজা মিনিট দশেক হেঁটে ডান দিকে বাড়ির রাস্তায় যখন ঢুকে তখনই বিদ্যুৎ চলে এসেছে। রায়হান খুশিই হলো। গিয়ে শান্তিমতো পুকুরে গোসল করা যাবে।
চেয়ারম্যান বাড়ির পূবের ঘরের বারান্দায় বাতি জ্বলছে। রাস্তার দুইপাশে জমি৷ সোজা বাড়ির দক্ষিণদিকে গিয়ে রাস্তা লেগেছে। সেখানে শানবাঁধানো পুকুর।
বারান্দা পরে ফাঁকা কিছু জায়গার পর পাশাপাশি তিনটা সুপারি আর একটা আমগাছ। বাতির আলো গাছগাছালির ফাঁক গলে এসে রাস্তায় পড়েছে। অচেনা একটা বাড়িতে এভাবে কাদায় মাখামাখি অবস্থায় গিয়ে উঠতে হবে ভেবে তাসনিম আর ইলহাম এখন বিব্রতবোধ করছে। বিদ্যুৎ না এলেই বোধহয় ভালো হতো। অন্ধকারে কাপড় পালটে নেয়া যেত।
রায়হান তাদের নিয়ে পুকুরে এলো,
– ‘এখানে কাদা ছুটিয়ে নাও। পরে এসে পুকুর গোসল করে নিব।’
ইলহাম আগে ব্যাগটা মুছে নিল। ভেতরে কাপড়ের অবস্থা কি কে জানে। ভালোভাবে মুছে রাখলো বসার জায়গায়। তিনজনই প্যান্টের ময়লা পরিষ্কার করে নিল। ইলহাম সিঁড়ি থেকে বাড়ির দিকে তাকায়। পুব আর পশ্চিমের ঘরের মাঝখানে উঠান। সকল জেলার সব গ্রামেরই বাড়িঘর একইরকম হয় কেন কে জানে। সে ইতস্তত করে বললো,
– ‘রায়হান আমরা এভাবে গিয়ে মেইন ঘরে ঢুকবো না-কি?’
সে মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘না আমার সাথে আয়।’
রায়হান দু’জনকে পুবের ঘরের বারান্দায় রেখে বাড়ির ভেতরে গিয়ে চাবি নিয়ে এলো। তার সঙ্গে একটা ছেলে। খুলে দিল পুবের ঘরের দরজা। বদ্ধ ঘরের ভেতর থেকে বোটকা গন্ধ বের হচ্ছে। রুমে একটা আলনা। দু’টা পালঙ্ক। উপরে টিনের চালের চারদিকে চাদরের মতো মাকড়সার জাল। পাশে গরু-ছাগলের ঘর।
রায়হান তাদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বললো,
– ‘এখানে ব্যাগ-প্যাক রাখো। আমি দু’টা লুঙ্গি দিচ্ছি গোসল করে পরে নাও।’
– ‘আগে দেখি ব্যাগের কাপড়ের অবস্থা কি।’
– ‘ভিজা থাকলে বের করে বারান্দার দড়িতে মেলে দিয়ে দে।’
তারপর কাজের ছেলেটিকে বললো,
– ‘রতন আমরা গোসল করে আসতে আসতে তুই ঘরটা ঝেড়ে-ঝুড়ে বিছানা কর।’
– ‘চাচি শুনে বকতেছেন। তুমি মেহমান নিয়া আইবা আগে বলতে পারতা।’
রায়হান কোনো জবাব দিল না। ইলহাম ভেজা কাপড়গুলো বের করে ঝেড়ে-ঝুড়ে শুকোতে দিল। রায়হান ওদের দু’টা লুঙ্গি বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– ‘চল গোসল করে নিই।’
তিনজনই গিয়ে লাফিয়ে পড়লো পুকুরে। সাঁতার কাটলো দীর্ঘ সময়। রায়হান ডুব দিয়ে উঠে মাথা তুলে মুখ থেকে পানি ছুড়ে ফেলে বললো,
– ‘সাঁতার কাটতে যেয়ে টের পাচ্ছি শরীরে প্রচুর ব্যথা।’
ইলহাম শরীর ঘষতে ঘষতে বললো,
– ‘কেন?’
– ‘তোমরা তো শুধু ঢাকা থেকে সিলেট। আমি আগেরদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যে এলাম।’
– ‘হুম বুঝেছি।’
তিনজনই দীর্ঘ সময় পুকুরে সাঁতার কেটে এসে দেখে ছেলেটি ঘর মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছে। বিছানায় নতুন চাদর। ফ্যানটাও মুছে নিয়েছে। কিন্তু বোটকা গন্ধ এখনও আছে। তাসনিম এসেই কাপড় পালটে গন্ধ দূর করতে সিগারেট ধরালো। রায়হান খানিক পর মশার স্প্রে নিয়ে এলো। চারদিকে স্প্রে দিয়ে বললো,
– ‘বারান্দায় বেঞ্চে বসে সিগারেট খাওয়া যাবে৷ স্প্রে দিয়েছি একটু সময় দরজা বন্ধ থাকুক।’
তিনজন এসে বারান্দায় বসলো। সিগারেট ফেলে দিল তাসনিম। বাতির আলোয় যেকেউ এসে দেখে ফেলবে। তিনজনই ফোন টিপছে। তখনই এলেন চেয়ারম্যান সাহেব।
– ‘রায়হান এটা কিছু হইল বাবা। ফ্রেন্ড নিয়ে আসছো, আগে বলবে না। তাদের যত্ন-আত্মির একটা ব্যাপার তো আছে।’
রায়হান কোনো জবাব দিল না। তাসনিম এবং ইলহাম ব্যাপারটা কিছু হলেও আঁচ করতে পারছে। নিশ্চয় কোনো কারণে রায়হান রাগান্বিত। তারা চেয়ারম্যান সাহেবকে সালাম দিয়ে তাকিয়ে দেখছে। ভদ্রলোক বিরলকেশী৷ লুঙ্গি পেটের ওপরে পরা। সাদা সেন্ডো গেঞ্জির ফাঁক দিয়ে বুকের সাদা লোমগুলো উঁকি দিচ্ছে৷ তিনি সালামের জবাব দিয়ে ব্যস্ত হয়ে ডাকলেন,
– ‘রতন কই। এদিকে আয়।’
সে দৌড়ে এলো।
– ‘আমার মোবাইল নিয়ে আয়তো। কুদ্দুসরে কল দিতে হবে৷ আজ রাতেই খাসি জ*বাই করো।’
– ‘কি কন চেয়ারম্যান সাব। বৃষ্টি-বাদলার দিন।’
– ‘তো কি হইছে। আমার ছেলে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বাড়িতে এসেছে। একটা ভালো আয়োজন দরকার না? যা মোবাইল নিয়ে আয়। আর তুই বাজারে যা, রাতের জন্য মাছ-মাংস নিয়ে আয়।’
ইলহাম আর তাসনিম এই অতিরিক্ত খাতিরে অস্বস্তিবোধ করছে। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না৷ ঘণ্টা দুয়েকের ভেতরে দেখা গেল বারান্দায় তিন-চারজন মানুষও এসে গেছে৷ রায়হান বের হলো না ঘর থেকে। সে তাদের সঙ্গে পালঙ্কে শুয়ে চুপচাপ মোবাইল টিপছে।
তাসনিম ওকে নীচু গলায় বললো,
– ‘তোর বাবা তো তোকে খুব গুরুত্ব দেন মনে হচ্ছে।’
রায়হান কিছুই বললো না৷ সে উরুতে চিমটি দিয়ে বললো,
– ‘শা*লা ঘটনা কিরে? সামথিং ইজ রং।’
ইলহাম পাশ থেকে বললো,
– ‘বাদ দে এসব।’
তাসনিম তবুও আবার বললো,
– ‘দোস্ত যা বুঝলাম তুই ভালোভাবে তোর বাবাকে বললে তো ইলহামের সঙ্গে পুষ্পিতার জোড়া লাগবেই।’
– ‘আসল হইছে মেয়ে। মেয়ে চাইলে ডিভোর্স পর্যন্ত নিতে পারবে৷ পরিবারকে চাপ দিতে পারবে।’
– ‘বুঝেছি।’
– ‘এখনই কি বাবার সঙ্গে কথা বলে নিব? কাল আবার ভোরে না পেতে পারি।’
ইলহাম আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘হ্যাঁ তাইই করো।’
চেয়ারম্যান বারান্দায়। খাসি জ*বাইয়ের জন্য নেয়া হচ্ছে। রায়হান গিয়ে বললো,
– ‘বাবা তোমার সাথে ওদের কিছু কথা আছে।’
চেয়ারম্যান সাহেব ভ্রু-কুঁচকে বললেন,
– ‘ওদের আবার কি কথা?’
– ‘ঘরেই চলো বলছি।’
চেয়ারম্যান সাহেব ঘরে এলেন। বসলেন সামনের পালঙ্কে। রায়হান পালঙ্কের হাতলে এক হাত রেখে বললো,
– ‘তুমি তো এই এলাকার চেয়ারম্যান। সেই হিসাবে ওরা একটা বিচার নিয়ে এসেছে।’
চেয়ারম্যান সাহেব একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন,
– ‘ওরা তো তোমার বন্ধু তাই না?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘কি হয়েছো বলো।’
ইলহাম পুরো ঘটনা বিস্তারিত বললো। চেয়ারম্যান সাহেব খানিক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
– ‘ঘটনা সহজ মনে হলেও জটিল। প্রেম-পিরিতের বিচার-আচার তেমন হয় না। কে কাকে ছেড়ে কার কাছে বিয়ে বসলো এগুলো কেউ পাত্তা দেয় না। তাও বিয়ে বসে গেছে যে মেয়ে। প্রেমিক এসে বিচার বসাবে। এগুলো হয়নি কখনও। কিন্তু মা*রধ*র করেছে, হুমকি-ধমকি দিয়েছে। এর বিচার করা যেতে পারে। লোকদেরও তো চিনতে হবে। ইলহামকে তিনি বললেন তুমি কি চিনেছো তাদের বাবা? নাম বলতে পারবে?’
ইলহাম না করলো। তিনি সিগারেটে টান দিয়ে দীর্ঘ বিরতির পর বললেন,
– ‘তবে আমার ছেলের বন্ধুর সমস্যা যেহেতু সেটা তো যেভাবে হোক সমাধান করতে হবে। এখন তোমরা কি চাচ্ছ বলো। আগে বুঝি। বিচারটা কি চাও আসলে। অভিযোগটা কি?
রায়হান আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘ওরে কে মা*রছে। কে কি কেড়ে নিয়েছে। এটা নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। তার ইচ্ছা মেয়েটিকে ফিরিয়ে নেয়া। যেহেতু জো*র করে বিয়ে দিয়েছে।’
– ‘জো*র করে বিয়ে দিছে কি করে বুঝলা?’
– ‘জো*র করে না দিলেও তাকে ভুল বুঝে বিয়ে বসেছে। সে ভুল ভাঙাবে। মেয়েটি যদি চায় তখন ডি*ভোর্স দিবে।’
চেয়ারম্যান সাহেব হাসলেন।
– ‘দুনিয়া এত সহজ না বাপজান। তবে তুমি যেহেতু বন্ধুদের নিয়ে এসেছে একটা কিছু তো করতেই হবে। দেখি কোন কার্ডের কথা বলেছিলে।’
রায়হান মোবাইল বাড়িয়ে দিল। চেয়ারম্যান খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের মোবাইল টিপে কানে লাগালেন। ওপাশ থেকে খানিক পরেই রিসিভ করে সালাম দিল লোকটি।
– ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। মেম্বার সাব কি খবর?’
– ‘ভালো চেয়ারম্যান সাব, হঠাৎ কি মনে করে?’
– ‘কি শুনি এগুলো। তোমাদের এলাকায় জোরজবরদস্তি করে মাইয়া বিয়ে দিচ্ছ। এ কি শুরু করলা মিয়া।’
ওপাশে হাসি শোনা গেল।
– ‘এগুলো কি কন চেয়ারম্যান সাব।’
– ‘হ্যাঁ এরকমই তো অবস্থা৷ হেতিমগঞ্জ মহসিন খান কে? মেয়ের নাম পুষ্পিতা। মা সাবিনা বেগম।’
– ‘মাঝ পাড়ার খানের কথা বলছেন। কেন কি হয়েছে?’
– ‘পুষ্পিতা নামের মেয়েটির তো বিয়ে জো*র করে হইছে সেটা জানো?’
– ‘না তো, আমি তো জানি ওই মেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল আর প্রেমিক সোনা টাকা নিয়ে পালিয়েছে। এরপর মেয়েটি নিজ থেকেই বিয়ে বসেছে।’
– ‘আরে রাখো এসব কেচ্ছা-কাহিনী। ছেলে যদি সোনা টাকা নিয়ে পালায়। তাহলে সে আবার কোন সাহসে আমার কাছে বিচার চাইতে আসবে।’
– ‘বলেন কি! ছেলে আইছে না-কি?’
– ‘তো আসবে না? ওকে মে*রে টাকা সোনা এবং নিজের মোবাইল পর্যন্ত নিয়ে নিছিল খানের লোক। মেয়ে নিজেও সেটা জানে না।’
– ‘ছি*নতাইকারী নিয়েছে হয়তো।’
– ‘আরে না, ছি*নতাইকারী নিলে কি ওর থেকে জো*র করে মায়ের নাম্বার নিয়ে বলবে এই মেয়ের লগ ছেড়ে দিতে? তাছাড়া কে*টে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার একাধিকবার হু*মকি-ধা*মকি দিয়েছে।’
– ‘বলেন কি এসব! এতকিছু হলো বুঝলামই না।’
– ‘এখন আমাদের কাছে যখন বিচার এসেছে। তাহলে তো দেখে দিতে হবে।’
– ‘হ্যাঁ তো দিতে হবে।’
– ‘তুমি আগামীকাল খানকে ইউনিয়ন অফিসে না। আমার বাড়িতেই নিয়ে আসো।’
– ‘এলাকার লোক নিয়ে বসলে ভালো হয় না?’
– ‘আগে কথা বলি। দেখি কি বলে। শেষে লোক ডাকা যাবে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
পরেরদিন সকাল এগারোটা অবধি ঘুমিয়ে রইল তিনজনই। ইলহামের ঘুম ভাঙলো বারান্দায় কথাবার্তা শুনে। জানালা খুলে তাকিয়ে দেখে মেম্বার এবং খান সাহেব বেঞ্চে বসেছেন। চেয়ারম্যান চেয়ারে।
খান সাহেব রেগে-মেগে কথা বলছেন।
– ‘আমি অবাক হইলাম চেয়ারম্যান সাব। আপনি পোলাপাইনদের প্রেম-পিরিতের জন্য আমাকে এখানে ডেকেছেন।’
– ‘শুধু প্রেম পিরিত তো না। একটা ছেলেকে মা*রধ*র করে তার সব কেড়ে নিলে সে বিচার চাইতে পারে না?’
– ‘কে মা*রলো সেটা তো আমি জানি না। ছি*নতাইকারীও হতে পারে।’
– ‘ছি*নতাইকারী হলে আপনার মেয়ের সঙ্গে আর দেখা না করতে ভ*য় দেখাবে কেন? ছি*নতাইকারী আপনার পরিবারের শুভাকাঙ্খী কেন?’
– ‘সেটা ছেলে মিথ্যেও বলতে পারে। আমি তো বললাম আমি কাউকে পাঠাইনি। এখন যার সাথে ঘটনাটা হইছে সে বলুক কে মা*রছে, হু*মকি দিছে। তাকে আপনি ডাকেন। আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এগুলো তো টানার দরকার মনে করি না। আমি গেলাম।’
খান সাহেব প্রচণ্ড রাগ দেখিয়ে উঠে গেলেন। মেম্বার বসে রইলেন সামনে। চেয়ারম্যান একটা সিগারেট বের করে মেম্বারকে দিয়ে বললেন,
– ‘লোকটা ঘ্যা*ড়ত্যা*ড়া তো। কথা বসানোর আগেই লাফাইতে শুরু করল।’
মেম্বার সিগারেট ধরিয়ে বললো,
– ‘এখন কি করবেন চেয়ারম্যান সাব?’
– ‘তোমাদের এলাকার ব্যাপার যেহেতু। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের শোনাও। আর খানকে বলো বিচারের ডেট দিতে। সে তো আর পঞ্চায়েতের বাইরের কেউ না।’
– ‘তাহলে কি দাওয়াত দেওয়াব।’
– ‘হ্যাঁ দাও, তোমাদের স্কুলের মাঠে বসো।’
– ‘আচ্ছা আমি আজ কয়েকজনকে নিয়ে খানের কাছে ডেট নিব। এরপর দাওয়াত দিব এলাকায়।’
– ‘হ্যাঁ দাও।’
মেম্বার উঠে চলে গেলেন। ইলহাম সবকিছু ভেতর থেকে শুনেছে। ব্যাপারটা যত সহজ ভেবেছিল তার চেয়েও জটিল মনে হচ্ছে।
দুইদিন পরেই হেতিমগঞ্জ স্কুলের মাঠে বিচার বসেছে। ইলহাম আর তাসনিম একটা বেঞ্চে বসা। রায়হান দাঁড়িয়ে আছে তাদের পেছনে। চারদিকে শতাধিক মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুরব্বিরা সামনের চেয়ারে বসা। চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে বললেন,
– ‘আমার কাছে একটা বিচার এসেছে। আমি খান সাহেবকে ডেকেছিলাম। তিনি বিষয়টা গুরুত্ব দেননি। তাই আপনাদের ডাকতে হয়েছে। আপনারা এই ছেলেটার কাছে তার কথাগুলো শুনুন।’
তারপর ইলহামকে ইশারা করে বললেন।
– ‘বলো বাবা। তোমার কথাগুলো বলো।’
ইলহামের বুক ধুকপুক করছে। এরকম পরিবেশ হবে ভাবেনি সে। দুরুদুরু বুকে দাঁড়িয়ে সে সবকিছু খুলে বললো। কিছুই বাদ গেল না৷ তাকে মে*রে মোবাইল কেড়ে নেয়া হয়েছে। সে এরপর আর যোগাযোগ করতে পারেনি। এই বিয়ে জো*র করে দেয়া হয়েছে। সে সবকিছুর বিচার চায়।
উপস্থিত জনতা বড়োই অবাক হলো। এসবের আবার বিচার কিসের? একজন মুরব্বি দাঁড়িয়ে বললেন,
– ‘কারা মে*রেছে তুমি কি চেনো তাদের?’
– ‘না আমি তো এই এলাকার লোকদের চিনি না।’
চেয়ারম্যান বললেন,
– ‘যেহেতু মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নিষেধ করছে তাহলে বুঝা যায় মেয়ের অবিভাবকের পক্ষের লোক।’
উপস্থিত জনতা সায় দিল কথায়। একজন বললেন,
– ‘খান সাহেব বলুক উনি লোক পাঠিয়েছিল নিশ্চয়।’
খান সাহেব জানালেন তিনি কাউকে পাঠাননি। উপস্থিত সবাই অনেক তর্ক-বিতর্ক করে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। খান সাহেবের এক কথা। আমি কাউকে পাঠাইনি। তাসনিমের হঠাৎ মনে পড়লো ফুপুকে যেহেতু কল দিয়ে হুমকি দিয়েছে, তাহলে তো নাম্বার থাকবে।
সে মাঝখান থেকে বাইরে গিয়ে কল দিল। রিসিভ করলেন ওপাশ থেকে।
– ‘ফুপু, তোমাকে যে নাম্বার থেকে কল দিয়েছে নাম্বারটা দাও তো।’
– ‘আচ্ছা দিচ্ছি, কিন্তু কি অবস্থা তোদের?’
– ‘পরে বলছি, এখন তাড়াতাড়ি নাম্বার দাও। আর তোমার ফোনে এসবের রেকর্ড আছে?’
– ‘নারে বাপ, আমার এসব তো মাথায় আসেনি।’
– ‘আচ্ছা নাম্বার দাও।’
আম্বিয়া বেগম মেসেজে নাম্বার পাঠালেন। সে মাঝখানে গিয়ে বললো,
– ‘আমার একটা কথা ছিল।’
সম্মতি দেয়া হলো তাকে। সে মোবাইলে নাম্বার দেখিয়ে বললো,
– ‘এটা হচ্ছে হুমকি দাতার নাম্বার। আমি এখন ফুপুকে কল দিয়ে আনলাম।’
মেম্বার মোবাইল হাতে নিয়ে খান সাহেবের দিকে তাক করে বললেন,
– ‘এটা কার নাম্বার।’
তিনি ভালোভাবে তাকিয়ে বললেন,
– ‘বুঝতে পারছি না।’
তাসনিম ইতস্তত করে বললো,
– ‘উনার মোবাইলটা কি একটু আমার কাছে আনতে পারি।’
খান সাহেব রেগে বললেন,
– ‘এটা কেমন কথা।’
উৎসুক জনতা রোমাঞ্চিত বোধ করছে। কেউ কেউ বললো, ‘মোবাইল দিতে সমস্যা কি!’
মেম্বার এগিয়ে গিয়ে বললেন,
– ‘আচ্ছা দেন দেখি।’
তাসনিম হাতে নিয়ে স্টার টু হ্যাশ দিয়ে মিলিয়ে দেখলো খান সাহেবের নাম্বার না এটা৷ এরপর ওই নাম্বার উনার ফোনে ডায়াল করতেই বের হয়ে গেল। নাম্বারটি ইংলিশে সেভ করা “হায়দার” নামে। তাসনিম মোবাইল মেম্বারের দিকে দেখিয়ে বললো,
– ‘এইতো নাম্বার, হায়দার নামে সেভ।’
অপরিচিত ছেলেটির বিচক্ষণতা দেখে গ্রামের উপস্থিত লোকজন বিস্মিত হয়ে গেল।
মেম্বার খান সাহেবকে বললেন,
– ‘এটা তো হায়দার চাচার নাম্বার।’
খান সাহেব তবু নিভলেন না।
তিনি আরও জ্ব*লে উঠে বললেন,
– ‘তো হায়দার হুমকি দিলে আমি কি করবো। আমি তো তাকে পাঠাইনি।’
চেয়ারে বসা হায়দার সাহেবের গোষ্ঠীর মানুষও ছিল। তার মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে বললো,
– ‘তো হায়দার হুমকি দিছে তাতে কি অপরাধ হইছেনি? খান সাহেবের লগে তার বন্ধুর মতো সম্পর্ক। খানের মেয়ে বাইরের একটা ছেলে পালিয়ে নিয়ে গেলে সে আটকিয়ে তো ভালো কাজ করছে। এলাকায় কয়জন এরকম অন্যের মান-সম্মান বাঁচাতে চায়। হায়দার তো প্রশংসার কাজ করছে। বন্ধুর ইজ্জৎ বাঁচাইতে চাইছে।’
জনতার বেশিরভাগ সম্মতি দিল। গুঞ্জন উঠলো ‘হায়দার তো বন্ধুর কাজ করছে’ এরকম লোক এলাকায় কয়জন আছে।
___চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম