তবু মনে রেখো (২০ পর্ব)
.
সকাল দশটায় দু’জন মহাখালীতে এলো। রায়হান রাতে এখানে একটা হোটেলে উঠেছে৷ তাসনিম কল দিয়ে বললো,
– ‘দোস্ত আমারা মহাখালি এখন। তুই কোথায়?’
– ‘তোরা বক্ষ ব্যাধি হসপিটালের কাছে আয়। আমি আসছি।’
– ‘কেন? বাস স্টেশনেই তো আছি, তুই চলে আয়।’
– ‘আরে না, তোরা আয়, হোটেলে ফ্রেশ হবি। আমিও গোসল করবো। তারপর নাশতা করে যাব।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
তাসনিম আর ইলহাম রিকশা থেকে নেমে দেখে রায়হান হসপিটালের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশা ভাড়া চুকিয়ে তারা এগিয়ে গেল। ইলহাম দূর থেকে ভালোভাবে পরখ করে রায়হানকে। গোলগাল সারল্য মুখ, কান অস্বাভাবিক মোটা। বাঁ হাত প্যান্টের পকেটে রেখে সিগারেট ফুঁকছে। এরকম চেহারার লোকেরা কতটুকু পরোপকারী হয় কে জানে৷ তবে প্রথম দর্শনেই ইলহাম যেন ভরসা পেয়ে গেল। তাসনিম চুপিচুপি গিয়ে ওর পিঠে একটা চাপড় দেয়। চমকে উঠে পিছু ফিরে তাকায় রায়হান। ওদের দেখে মুচকি হেঁসে হাত বাড়িয়ে দিল সে।
– ‘আপনিই সেই ইলহাম।’
সেও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ।’
তারপর তাসনিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘চল হোটেলে আগে যাই। আমি ভোরে তোর কল রিসিভ করে আবার ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। এখন গোসল করেই বের হয়ে নাশতা করবো।’
– ‘হুম চল, কিন্তু কথা হলো গোসল এত জরুরি হয়ে পড়লো কেন।’
রায়হান ওর পেছনেই ছিল। পিঠে ঘু*সি দিয়ে বললো,
– ‘শা*লা, এতদূর জার্নি করে কাল এসেছি। এখন আবার গোসল না করে যাব না-কি। গোসল করলে সবকিছু ভালো লাগে।’
– ‘হুম তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।’
তিনজন হোটেলে ফিরলো। ইলহাম ব্যাগটা খুলে রাখলো বিছানায়। দু’জনে একটা ব্যাগই নিয়েছে। ক’দিন থাকতে হবে বুঝতে পারছে না। তাসনিম তাড়া দিয়ে বললো,
– ‘যা গোসল করে নে।’
রায়হান গেঞ্জিটা খুলে একটা গামছা নিয়ে ঢুকে গেল। খুব একটা দেরি হলো না তার। মিনিট বিশেকের ভেতরে পরনের প্যান্টই আবার পরে গামছা দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে বের হয়। তাসনিম বিছানা থেকে পা লম্বা করে ওর পেছনে লা*ত্থি দিয়ে বললো,
– ‘শা*লা তোর স্বভাব আর গেল না।’
ইলহাম বুঝতে পেরে হাসছে৷ রায়হান গামছা নিয়ে বেলকনিতে যেতে যেতে বললো,
– ‘বাথরুমে কি আর কেউ থাকে যে আরেকটা কাপড় পরাই থাকতে হবে? তাছাড়া গামছা এখন ভিজালে শুকাবে না।’
– ‘তুই তো ফকিন্নি, একটা গামছা ফেলে গেলে কি হবে? কয় টাকা একটা গামছা।’
রায়হান আবার রুমে ফিরে এসে বললো,
– ‘তোরা হাত-মুখ ধুয়ে নে, এবার নাশতা করে আসি৷’
– ‘নাশতা করে আসব কেন আবার? একেবারেই চলে যাই।’
– ‘আরে না, রাস্তার ওপাশেই একটা হোটেল আছে নাশতা করে আসি।’
– ‘শা*লা তুই এত উলটা কেন? তাহলে নাশতা করেই উঠতাম।’
– ‘গোসল করে নাশতা করা আলাদা শান্তি আছে।’
তাসনিম বাথরুমে যেতে যেতে অস্ফুটে বললো,
– ‘প্রশান্তি না-কি কোন অঘটন ঘটিয়েছিস সেটা বল।’
রায়হান গেঞ্জি দিয়ে মারার আগেই তাসনিম বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিল। রায়হান গেঞ্জিটা গায়ে দিয়ে চুলটা হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে ইলহামকে বললো,
– ‘আপনার মামাতো ভাই খুবই অ*শ্লীল। ওর মুখ খুলেছে মানেই নোং*রা কথা।’
ইলহাম স্মিথ হাসলো। রায়হান বাথরুম থেকে বললো,
– ‘আপনি আপনি করো কেন তোমরা? দু’জন কি খুব ভদ্রলোক? চু*তিয়ামি না করে ডায়রেক্ট ‘তুই’ করে কথা বলো।’
ইলহাম সম্মতি জানিয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ, তাই হোক। তাসনিমের বন্ধু মানে আমারও বন্ধু।’
রায়হান কেডস এর ফিতা বাঁধতে বাঁধতে মাথা নেড়ে বললো, ‘তা ঠিক।’
তাসনিম বের হয়ে ইলহামকে বললো,
– ‘বাথরুমে যাবি?’
– ‘না।’
তিনজন বাইরে এসে নাশতা করে পুনরায় উপরে গিয়ে সবকিছু নিয়ে বের হলো। বাসে ইলহাম জানালার পাশে একা বসেছে। তার সামনের সিটে পাশাপাশি তাসনিম আর রায়হান। তীব্র গরম। ঘেমে-নেয়ে একাকার। অসহ্য গরমে কোনো কথা হলো না তাদের। বাস চলতে শুরু করার পর ধীরে ধীরে পরিবেশ শীতল হয়ে এলো। পকেটে কেঁপে উঠলো ইলহামের মোবাইল। আম্বিয়া বেগমের কল। ইলহাম রিসিভ করে।
– ‘হ্যাঁ মা বলো।’
– ‘ছেলেটাকে পেয়েছিস?’
– ‘হ্যাঁ, আমরা এখন সিলেটের বাসে উঠে গেছি।’
– ‘তোর বাবা ফোন দিয়েছিল। শুনে আমাকে বকেছে।’
– ‘বুঝিয়ে ম্যানেজ করে নাও মা।’
– ‘আচ্ছা ওই ছেলেটার কাছে দে তো। কথা বলি।’
ইলহাম খানিত ইতি-উতি করে তাসনিমকে বললো,
– ‘আম্মু রায়হানের সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন।’
– ‘আচ্ছা দে।’
তাসনিম রায়হানের কাছে মোবাইল দিল। সে কানে লাগিয়ে সালাম দিল।
– ‘বাবা ছেলেটাকে যেতে দিয়ে মনে হচ্ছে বোকামি করলাম। খুব ভয় করছে। ওর বাবাও রাগ করেছে শুনে। তাসনিমের কথায় শুধু রাজি হয়েছি। ছেলেটার যা অবস্থা হচ্ছে দিন দিন। ভাবলাম একবার দেখা করে নিশ্চিত হলে শান্তি পাবে। দোদুল্যমান কিছুই ভালো না। মেয়েটার মুখ থেকে একটা কিছু শুনে ক্লিয়ার হোক। সমাধান হলে হয়তো সান্ত্বনা পাবে।’
– ‘বুঝেছি আন্টি, ভয় পাবেন না৷ আমি তো আছি। কিছুই হবে না৷’
– ‘কোনো ঝামেলা হবে না তো বাবা? লোকগুলোর কথাবার্তা শুনে ওইদিন খুবই ভয় পেয়েছি। মোটেও ভালো না ওরা।’
– ‘কারা এমন করেছে সবই পাব আন্টি। যাচ্ছি যখন সবই হবে। চিন্তা করবেন না।’
– ‘আচ্ছা বাবা, আর তোমার দাওয়াত। একদিন বেড়াতে আসবে ওদের সঙ্গে। আন্টিকে দেখে যাবে।’
– ‘আচ্ছা আন্টি যাব একদিন।’
– ‘আর শোনো বাবা, বুঝতেই তো পারছো ছেলের অবস্থা দেখে মা হয়ে এগুলোতে প্রশ্রয় দিচ্ছি। কয়টা মাস থেকে ছেলেটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। এগুলো দেখে আর সহ্য হয় না৷ তাই প্রশ্রয় দিতে হয়েছে৷ তাই বলে পালিয়ে যেন না আনে। মুরব্বিদের মাধ্যমে যেটা হয় কইরো। মেয়ে যদি চায় আমার ছেলেকে। তাহলে বিবাহিত হলেও আমি বউ করে আনবো। আগে বেকার ছিল। আর এত সিরিয়াস ভাবিনি। তাই না করতাম। কিন্তু এখন এসব ভাবছি না৷ হয়তো জোর করেই বিয়ে দিয়েছে। শুনেছি গ্রামে এসব হয়। তাই মেয়েটা যদি চায়। মুরব্বিদের মাধ্যমে সুন্দরভাবে ডিভোর্স দিক। আমি বউ করে আনবো। পালিয়ে আনতে দিয়ো না বাবা। এগুলো সুন্দর সমাধান না৷ ঝামেলা লেগে থাকবে।’
– ‘আচ্ছা আন্টি বুঝেছি।’
– ‘ওকে বাবা, আল্লাহর হাওলা।’
ফোন রেখে দিল রায়হান। বাড়িয়ে দিল ইলহামের কাছে।
– ‘বাহ আন্টি তো খুব পজিটিভ।’
তাসনিম মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘মোটেও না, এখন ছেলের অবস্থা দেখে মেনেছেন। আগে না-কি মানেননি।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘উনি তাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের টিচার। আমি ছোটবেলায় তাদের ওখানে পড়তে গেছিলাম প্রচুর মা*র খেয়েছি স্কুলে।’
– ‘ওইখানে পাঠশালা দিয়েছিস না-কি?’
– ‘না, এক বছর পরেই আবার চলে এসেছি। আম্মুকে ছাড়া তখন থাকতে পারতাম না।’
– ‘হুম বুঝেছি।’
এসব এলোমেলো আলাপচারিতায়, মোবাইল টিপে, ঘুমিয়ে তাদের দীর্ঘ জার্নির সময় কেটে গেল। সন্ধ্যায় চলে এলো তারা সিলেট। হেতিমগঞ্জ বাজারে আসতে না আসতেই এশার আজান। সিএনজি থেকে নেমেই রায়হান পরিচিত একটা ছেলেকে দেখে ডাকলো।
– ‘এই রাতুল দাঁড়া।’
ছেলেটি তাকে দেখে এগিয়ে এলো,
– ‘আরে এতদিন পর বাড়িতে এলি তাহলে।’
সিএনজি ভাড়া চুকিয়ে তারা এগিয়ে গেল। রায়হান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ অনেকদিন পর এলাম। কোথায় যাচ্ছিস এখন?’
– ‘বাজারে এসেছি, আড্ডা দেবো। তুইও আসিস, রাতে ক্যারাম খেলা হয়।’
– ‘আচ্ছা ওই ব্রিজের দিকে চল। কিছু কথা আছে।’
– ‘কি কথা?’
– ‘আরে আয় না।’
রাতুলকে নিয়ে রায়হান এগিয়ে গেল। তাসনিম আর ইলহাম গেল পিছু পিছু। খালের ছোট্ট ব্রিজের ওপর গিয়ে রায়হান মোবাইল থেকে বিয়ের কার্ড বের করে বললো,
– ‘পুষ্পিতা জান্নাত মেয়েটা কে? পিতা মহসিন তালুকদার।’
রাতুল কার্ডের দিকে তাকিয়ে হেঁসে ফেললো।
– ‘এই মেয়ের খবর নিয়ে ঘুরতেছিস কেন? এই মেয়েকে একটা ছেলে খেয়ে ছেড়ে দিছে।’
তিনজনই অস্বস্তিতে পড়ে গেল। রায়হান তবুও আবার বললো,
– ‘কাহিনিটা কি বলতো।’
– ‘বাজারে লোকমুখে শুনেছি। ওই মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু সে বিয়ের রাতে বাড়ির সোনা, টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে চলে যায়। মানুষ পরেরদিন বিয়েতে গিয়ে ফিরে আসে। কয়েকদিন পর বাড়ি ফেরেছে ওই মেয়ে। ওরে নন-সিলেটি একটা ছেলে খেয়ে সোনা আর টাকা নিয়ে পালিয়েছে।’
কথাগুলো শুনে ইলহামের কান দিয়ে যেন গরম ভাপ বেরুচ্ছে৷ শরীর মৃদু কাঁপছে।
রায়হান আবার জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আচ্ছা এরপর কি হলো?’
– ‘এরপর যার সাথে বিয়ে ঠিক ছিল সেও বিয়ে করেনি। একটা খাওয়া মেয়েকে কে বিয়ে করবো রে ভাই?’
– ‘কিন্তু শুনলাম তো বিয়ে হইছে, সেটা কার সাথে?’
– ‘বাজারে মাঝগলিতে একটা কাপড়ের দোকান আছে না৷ হায়দার বস্ত্র বিতান। ওর ছেলের সাথে হইছে। মেয়েটা সুন্দর আছে। যার সাথে বিয়ে হয়েছে একেবারে বলদা টাইপ। আসলে মেয়েকে আর কে বিয়ে করবো। তাই কোনোভাবে বিকাইল আরকি।’
– ‘ছেলেটাকে তো চিনি না। কাপড়ের দোকানও খেয়াল নেই।’
– ‘কিন্তু এতকিছু তুই জিজ্ঞেস করছিস কেন? কাহিনি কি?’
– ‘কারণ আছে জানতে পারবি৷ আর ওই মেয়েকে ছেলে খেয়ে ছেড়ে দেয়নি। মাঝখানে কাহিনি আছে। ওই ছেলেও টাকা আর সোনা নিয়ে পালায়নি।’
– ‘বলিস কি? তুই কিভাবে জানলি।’
– ‘এখনই সব বলার দরকার নেই। জানবি সব। এখন যা, পরে দেখা হবে।’
রাতুল চলে গেল। রায়হান মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে বললো,
– ‘চলো যাই।’
ইলহাম অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে। একটু দূরে গিয়ে অবাক গলায় তাসনিম বললো,
– ‘কিরে ভাই, ঘটনা দেখি এইখানে ভিন্নভাবে জানে সবাই।’
– ‘গ্রামগঞ্জে এরকমই হয়। একটা ঘটনা থেকে রটনা বেশি হয়ে যায়৷ যা বুঝলাম মেয়েটাকে সবাই চ*রিত্রহী*ন হিসাবে নিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে একটা ছেলে ধরে কোনোভাবে বিয়ে দিতে হইছে। কারণ এমনিতে পালিয়ে গিয়ে বাড়ি ফিরলে হয়তো কেউ জানতো না। পরেরদিন বিয়ে ছিল তো। আত্মীয়-স্বজন এবং গ্রামের মানুষ সবাইই গেছে। গিয়ে সব একে অন্যের থেকে জেনে ফেলেছে। ব্যস পুরাই ফেঁসে গেছে পরিবার। গ্রামে একটা প্রেমও যদি করে কোনো মেয়ে, সেটাও লোকে শুনলে অবস্থা শেষ। আর এটা তো অনেক বড়ো ঘটনা।’
ইলহাম খানিক পর বললো,
– ‘কিন্তু পুষ্পিতা তো এভাবে বিয়ে না বসে, আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারতো।’
তাসনিম জবাব দিল,
– ‘তোর কথাই ঠিক। পুষ্পিতার বাবা হয়তো লোক পাঠিয়েছিল। ওর পরিবার সোনা-টাকার বিষয় হাইড করায় পুষ্পিতা ভেবেছে তুই এগুলো নিয়ে পালিয়েছিস।’
ইমাদের শরীর লোমগুলো দাড়িয়ে যায়। ভালোবাসার মানুষের মনে এমন জ*ঘন্য মানুষ হয়ে থাকার যন্ত্রণা কত ভয়াবহ সে টের পায়। ভুল ভাঙতে না পারার জন্য বড়ো অসহায় লাগে। রায়হান খানিক পর বললো,
– ‘কিন্তু রাতুল যে বললো যার সাথে নিয়ে ঠিক ছিল সে বিয়ে করেনি। এরপর যার সাথে বিয়ে হয়েছে সে ব’লদা টাইপ। তাহলে পরিবার ওর কাছে বিয়ে না দিয়ে তখনও তো পুষ্পিতাকে সবকিছু বলে দিতে পারতো। ওর মাধ্যমে ইলহামের সাথে আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে পারতো।’
তাসনিম তাচ্ছিল্য করে বললো,
– ‘পরিবারগুলো এসব বুঝে না। তাদের জেদই বড়ো।’
ইলহাম খানিক পর বললো,
– ‘আর ওই ছেলে যে বললো, পুষ্পিতা কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরেছে। তা কেন হবে? সে তো কয়েক ঘণ্টা পরই অপেক্ষা করে না পেয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা।’
তাসনিম ওর কথায় সম্মতি জানায়। রায়হান অন্যমনস্ক, সে অন্যকিছু ভাবছে। তাসনিম তার বন্ধু মানুষ। তার এলাকায় একটা সমস্যা। বিষয়টা হালকাভাবে নেয়া যায় না৷ তাছাড়া ইলহামের মায়ের কথা শুনেও মনে হয়েছে কিছু একটা করা দরকার। বাবাকে বললেই এসব ঠুনকো বিষয় সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়। ভদ্রলোক কমবয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করেছেন। তার মা না পারতে ব্যাপারটা মেনে নিলেও সে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। রাগ করে বাড়িও আসে না৷ বাবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে মনে হয় বাবার সঙ্গে কথা বলতেই হবে। বিষয়টা ভাবতে তার আমিত্বে লাগছে। তবুও বলতে হবে। যতটুকু করা যায় সর্বোচ্চ করবে সে।
তাসনিমের কথায় তার ধ্যানভঙ্গ হলো।
– ‘এত অন্ধকার কেন রে রাস্তা।’
– ‘গ্রামে তো চারদিকে বাতি থাকে না।’
– ‘কিন্তু সামনে কি বাড়িঘর নেই। অন্ধকার কেন?’
– ‘বিদ্যুৎ নেই হয়তো।’
– ‘আর কতক্ষণ? বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে তো মনে হচ্ছে।’
রায়হান হাত মেলে বললো,
– ‘হ্যাঁ, তাইতো। তাড়াতাড়ি হাঁটো। আরও দশ-পনেরো মিনিটের মতো হাঁটতে হবে।’
– ‘রাস্তা তো ভালোই। গাড়ি আসে না এদিকে?’
– ‘সরি দোস্ত, আসে কিন্তু খেয়াল করিনি। আর বৃষ্টি আসবে ভাবিনি।’
– ‘আচ্ছা তাড়াতাড়ি হাঁটো।’
বৃষ্টি ক্রমশই তীব্র হতে শুরু করলো। তারাও হাঁটার গতি বাড়াতে বাড়াতে এবার দৌড়াচ্ছে। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। আসমান ডেকে এখন বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। সঙ্গে মৃদু বাতাস। তিনজনই ভিজে একাকার। ইলহামের ব্যাগ ভিজে ভারী হয়ে গেছে। সে দৌড়াতে পারছে না। ব্যাগ যেন পেছনের দিকে টানছে। পলকেই যেন কাঁচা রাস্তাও পিচ্ছিল হয়ে গেল। দৌড়াতে গিয়ে মনে হচ্ছে পড়ে যাবে সে। কিন্তু সে পড়লো না৷ তাসনিম পা পিছলে পড়তে পড়তে বাঁচার জন্য জাপটে ধরলো রায়হানের গেঞ্জি। রায়হান টাল সামলাতে না পেরে চিত হয়ে পড়লো। তাতে শেষ রক্ষা হলো না তাসনিমেরও। রায়হানের কাঁধের ধাক্কা তার পায়ে লেগে রাস্তার সাইটে গিয়ে পড়লো। ইলহাম হাসতে হাসতে গিয়ে তাসনিমকে টেনে তুললো। রায়হানের মোবাইল মাটিতে পড়ে আকাশের দিকে বাতি জ্বলছে। ইলহাম সেটা তুললো গিয়ে৷ রায়হান কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে। সে উঠে বললো,
– ‘সামনে একটা বাড়ি আছে। তাড়াতাড়ি হাঁটো, বাড়িতে উঠি গিয়ে।’
তাসনিম হতাশ গলায় বললো,
– ‘তার আর দরকার কি? অবস্থা তো এমনিতেই খারাপ।’
– ‘মোবাইল তো বাঁচাতে হবে। ভিজে গেছে এমনিতেই।’
– ‘ব্যাগে ঢুকিয়ে নে, কাপড়ের ভাঁজে রাখ।’
ইলহাম বিরক্ত হয়ে বললো,
– ‘ব্যাগই তো ভিজে ভারী হয়ে আছে। আপাতত একটা বাড়িতেই উঠি।’
তিনজন দৌড়ে গিয়ে একটা বাড়িতে ঢুকলো। মাটির ঘর৷ খোলা বারান্দা। দরজার ফাঁক দিয়ে হারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে। একটা বাচ্চা সুরে সুরে পড়ছে,
“আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি….।”
তিনজন চুপিচুপি গিয়ে বারান্দায় উঠে। কেউ একজন দরজা ঠেলে বের হলো তখনই। মানুষটিকে দেখে ইলহাম অবাক হয়ে গেল।
_ চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম