তবু মনে রেখো (১৮ পর্ব)
.
ইমা বাবার হাত ধরা। হায়দার সাহেব প্রচণ্ড রেগে আছেন। পুষ্পিতা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে৷ হায়দার সাহেব পুনরায় ইমাদের দরজার দিকে ধেয়ে গিয়ে বললেন,
– ‘তুই মাতব্বরি শুরু করেছিস। মুখের উপর কথা বলিস। শু*য়ো/রের বাচ্চা…।’
ইমা আবার কোমরে টেনে ধরে নিতে নিতে বললো,
– ‘বাবা আসো তো, ভাবি সবকিছু শুনছে।’
ইমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে বললেন,
– ‘শুনুক, ব/ল*দের বাচ্চা কয় তার সোনামুখো বউ পাইয়াই সে সুখী, আর কিছুই লাগবে না৷ বল গিয়ে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাক। এখনই ওরা বের হয়ে যাক।’
ইমা করিডর দিয়ে বাবাকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। তিনি অশ্রাব্য ভাষায় গা*লাগা*ল করে ঘর থেকেই বের হয়ে গেলেন। ইমা এসে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে কেঁদে ফেললো। পুষ্পিতার লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেছে। বিষয়টা সে বুঝতে পারছে। হায়দার সাহেব বাসা এবং জায়গা জমি সবই চান। পুষ্পিতা রান্নাঘরে চলে গেল। হায়দার সাহেব পুকুর পাড় পেরিয়ে এসে রাস্তার কিনারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। মাথা ঘুরছে। পুরো পাঞ্জাবি ঘেমে ভিজে গেছে। ছেলের নির্বুদ্ধিতা দেখে তিনি বিস্মিত হয়ে গেছেন। এই কাজটা কিভাবে করলো ইমাদ। সে তো জোর করে নিচ্ছে না৷ কারও কাছ থেকে চেয়েও নিচ্ছে না৷ তবে কেন সরাসরি না করে দিল। এটা কি হয়ে গেল। ভাবতেই পারছেন না তিনি। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে অস্ফুটে বারবার বলছেন, ‘ব*লদে/র বাচ্চা এইটা করলটা কি। এটা কি হইল। আমার সবকিছু শেষ… সবকিছু শেষ করে দিল..।’
পুষ্পিতা মা-বাবাকে এগুলো বলেনি। তাই মহসিন সাহেব ইমাদের কথা ভেবে দু’দিন পর হায়দার সাহেবকে ডাকলেন। জায়গা রেজিস্টারের বিষয়ে আলাপ করলেন। বিপাকে পড়ে হায়দার সাহেব নিজ হাতে ভূমির জমে থাকা খাজনা দিয়ে এলেন। তারপর রেজিস্টারি করে দিলেন জমিগুলো। এই ক্ষো*ভ, হতাশা ধীরে ধীরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেললো তাকে। তবুও কিছুদিন পর তিনি মহসিন সাহেবকে সরাসরি গিয়ে বললেন,
– ‘জমি তো দিয়ে দিলাম খান ভাই৷ বলছেন যখন বাসাটা দিয়ে দেন কাগজ করে। ছেলেটা এমনিই না করছে আরকি। এগুলো সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নাই।’
মহসিন সাহেব রেগে গেলেন। তিনি কড়া গলায় বললেন,
– ‘দেখো হায়দার। ছেলে না করছে। সিরিয়াসলিই না করেছে। তুমি এসব নিয়ে আমার সাথে আর আলাপ করতে আসবে না। তুমি তো মিয়া দেখছি লোভী মানুষ। পাগল হয়ে যাচ্ছ৷ জমি রেজিস্টারি করতেও কত গাঁইগুঁই করছিলে।’
হায়দার সাহেব সেদিন লজ্জায় অপমানে মুখ কালো করে বাড়ি ফিরেন। হতাশা তাকে ঘিরে ধরেছিল চারদিক থেকে। ভাবতেই পারেননি একেবারে হাতে আসা সবকিছু হঠাৎ এভাবে হারিয়ে যাবে। বাড়িতে ফিরেই তিনি বঁ*টি নিয়ে ধেয়ে গেলেন ইমাদের দিকে, ‘এই তুই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা৷ আজকেই বের যাবি। না হয় বঁ*টি দিয়ে জ*বাই করে ফেলবো। ন*ষ্টা বউ নিয়ে তুই বের হয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।’
পুষ্পিতা দৌড়ে গিয়ে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। ইমা বাবাকে টানাটানি করে আঁটকে রাখার চেষ্টা করে। হায়দার সাহেব দরজায় লা*ত্থি মারতে শুরু করেন। চিল্লাচিল্লি শুনে আশেপাশের মানুষও দৌড়ে আসে। বঁ*টি কেড়ে নেয়।
কিন্তু এরপর এরকম ছোটখাটো ঘটনা প্রায়ই ঘটতে শুরু করল। হায়দার সাহেব দিনকে দিন আরও বেপরোয়া হয়ে যেতে থাকলেন। ক্রমশই পুষ্পিতার দিকে তার ক্ষো*ভ বাড়তে লাগলো। ন*ষ্টা চ*রিত্রহীন গা/লি রোজই দেন।
পুষ্পিতা এসব দেখে একদিন ইমাদকে ধরলো। বললো,
– ‘চলো আমরা বাসায় চলে যাই।’
ইমাদ রেগে গিয়ে বললো,
– ‘এগুলোর জন্যই তো এতো ঝামেলা। আমার বাপ যখন মান-সম্মানের চিন্তা না করে এতকিছু করলো আমি কখনও আর বাসা নিতে রাজি হব না।’
পুষ্পিতা ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,
– ‘তুমি তো বাসা নিবে না। খালি পড়ে আছে। আমরা গিয়ে থাকবো কিছুদিন। শ্বশুর আব্বা একটু স্বাভাবিক হলে চলে আসবো।’
তবুও ইমাদকে রাজি করানো গেল না। ক’দিন পর এক সন্ধ্যায় মহসিন সাহেবও তাকে কল দিয়ে বাড়িতে ডাকলেন। সে দোকান থেকে সোজা সেখানে চলে গেল। মহসিন সাহেব তাকে রূঢ় গলায় বললেন,
– ‘তোমার বাবা তো পাগল হওয়ার অবস্থা ইমাদ। সবই তো খবর পাই৷ না আছে আমার মেয়ের নিরাপত্তা, না আছে তোমার।’
– ‘এখন কি করবো বলুন। নিজের বাপকে আমার কি করার আছে।’
সাবিনা বেগম এসে পিঠে হাত দিয়ে কাতর গলায় বললেন,
– ‘তুমি বাসায় চলে যাও বাবা৷ আপাতত সেখানে যাও পরে যা হয় হবে৷ কথাটা রাখো বাবা।’
ইমাদও বিষয়টা নিয়ে ভাবে। পুষ্পিতা প্রে/গন্যা*ন্ট। হঠাৎ যদি তাকে আ*ঘাত করে বসে বাবা। তাহলে সমস্যা। ওরা তখন তাকেও দোষারোপ করবে। সবকিছু ভেবে কিছুদিন পরেই পুষ্পিতাকে নিয়ে সে বাসায় চলে যায়। হায়দার সাহেব ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করেন। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে হাঁটেন। কিছুই বুঝা যায় না। এখন তপ্ত রোদে ছাতা না টানিয়ে হাতে নিয়ে হাঁটছেন। বাজারে ঢুকেই কয়েকটা কু*কু*র দেখে ছাতা হাতে তাড়া করে গলি থেকে বের করে দিয়ে এলেন। শফিক ছাড়া আশেপাশের সকল দোকানের মানুষই আজকাল উনার কর্মকাণ্ড নিয়ে হাসি-তামাশা করে। শফিক সালাম দিয়ে বললো,
– ‘চাচা আপনার আসতে হবে না৷ এত রোদে আসেন কেন। বাড়িতে চলে যান। আমি তো আছিই।’
– ‘হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি তো আছো৷ তুমি ওই ব*লদ থেকে ভালো৷ করলোটা কি। হ্যাঁ অনেক রোদ। ঠিকই বলেছো। আর রাস্তাঘাটে খালি কু*কু/র আর কু/কু*র। বাজারে আর আসব না। তুমি তো আছোই।’
একা একা কথাগুলো বলতে বলতে তিনি বাজার থেকে বের হয়ে গেলেন। শফিক এভাবেই কৌশলে রোজ তাকে দোকান থেকে বিদায় করে দেয়। ইমাদের সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে।
পুষ্পিতার প্রেগন্যান্ট এর তিনমাস। বাসায় ওরা দু’জনই শুধু থাকে। আছিয়া এসে রান্না-বান্নার কাজ করে দিয়ে যায়৷ সন্ধ্যায় দু’জন বসে টিভি দেখছে৷ পুষ্পিতা হঠাৎ বললো,
– ‘এভাবে বেকার বাসায় আর কতদিন থাকবে শুনি।’
ইমাদ চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,
– ‘বেবি হওয়ার আগপর্যন্ত এখানেই থাকি। এরপর দেখা যাবে। বাড়িতেই চলে যাব না হয়। দোকান তো আছেই।’
– ‘বাবা ওইদিন কি বলেছেন জানো?’
– ‘কি?’
– ‘আমাদের বাসার নিচে যে দোকান আছে। ওইটা তো ভাড়া দেয়া। তুমি সেখানে দোকান দিলেই পারো। আমরা এখানেই থাকলাম। আর ইমাকে ইন্টার শেষে বাসায় এনে ভার্সিটিতে ভর্তি করে দিলে।’
– ‘আইডিয়াটা ভালোই। কিন্তু বাবাকে কি করবো?’
– ‘উনাকে বাসায় এনে পারবে? শুনছি মাথায় পুরাই সমস্যা এসে গেছে।’
– ‘সেজন্যই তো বাড়িতে একা রাখা যাবে না। ইমাকে থাকতে হবে।’
– ‘মজিদাকে বলবো গিয়ে রেঁধে দিতে। এমনিতে বাবা-মাও তো আছেন সেখানে।’
– ‘হুম বুঝেছি।’
পুষ্পিতা ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘বাবা তোমাকে বলতে ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু উনি সিরিয়াস। আমাকে বললেন তোমাকে জিজ্ঞেস করে জানাতে। তাহলে ওই দোকানদারকে ছেড়ে দিতে বলবেন।’
– ‘থাক, এখনই এসব না। আগে বেবি হোক। এরপর বুঝা যাবে। তাছাড়া বাড়ি-ঘর রেখে শ্বশুরের বাসায় থাকার ইচ্ছা নেই।’
– ‘ঘাড়ত্যা*ড়ামি করবে না তো। এটা তো প্রয়োজনে থাকবে। তাছাড়া বাবারও স্বার্থ আছে। আমরা বাসায় থাকলে ওরা গ্রামে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে।’
ইমাদ পেছনে হাত নিয়ে ওর কাঁধে রেখে বললো,
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। উনি দোকানদারকে না করুক। এরপর ভেবেচিন্তে যা করি করবো।’
পুষ্পিতা খুশি হয়ে ওর কাঁধে মাথা রাখলো।
– ‘আরও দু-এক মাস পর মা’কে বলবো চলে আসতে। তখন আমার অনেক হেল্প হবে।’
ইমাদ চ্যানেল পালটে বললো,
– ‘কেন আমার যত্নে পোষাবে না বুঝি ম্যাডামের?’
পুষ্পিতা মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘তা না, তবুও ভয় লাগে। প্রথম তো। মা থাকলে ভরসা পাব।’
– ‘বুঝেছি আমার উপর ভরসা নেই।’
পুষ্পিতা ওর উরুতে চি*মটি দিয়ে বললো,
– ‘তোমার উপর ভরসা কেন থাকবে শুনি। তোমার কি এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে?’
ইমাদ টিভির দিকে তাকিয়ে আনমনেই জবাব দিল,
– ‘না থাকার কি আছে।’
পুষ্পিতা হাসতে হাসতে বললো,
– ‘তুমি বুঝি প্রে*গন্যা*ন্ট হয়ে কয়েকটা সন্তান জন্ম দিয়েছো?’
___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম