তবু মনে রেখো (১৫ পর্ব)
.
সাবিনা বেগমের মেজাজ ফুরফুরে৷ রাতে ভালো ঘুম হয়েছে৷ প্রশান্তির ঘুম। খাওয়ার টেবিলে পুষ্পিতার চেহারা দেখার মতো ছিল। এখানে আসার পর থেকে দু’জন রুম থেকেও বের হচ্ছে না। আল্লাহ পাক হয়তো তাদের মধ্যে মিল-মহব্বত ঢুকিয়ে দিয়েছেন। রাতে স্বপ্নও দেখেছেন একটা- সুস্বপ্ন। পুষ্পিতার কোলে ফুটফুটে শিশু। কিন্তু ছেলে না মেয়ে বুঝার আগেই ঘুম ভেঙে গেছে৷ আবার ঘুমিয়ে সেই স্বপ্নের বাকিটুকু দেখতে পারেননি। স্বপ্নের এই এক অদ্ভুত স্বৈরাচারী স্বভাব। যতটুকু ইচ্ছা দেখিয়ে আর আসার নামগন্ধ থাকে না। আজ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিছনাকান্দি যাবেন না। মেয়ে জামাই আছে। তিনি শাশুড়ি হয়ে সঙ্গে যাওয়ার মানেই হয় না। প্রেম-ভালোবাসা জমে অন্ধকারে, আড়ালে, নির্জন-নিভৃতে। আর প্রেম-ভালোবাসা পালায় গুরুজন দেখলে। তিনি তাদের গুরুজন। সুতরাং সঙ্গে যাবেন না। ওদের প্রেম-ভালোবাসা জমুক। রাতের স্বপ্ন থেকে শিশুটিকে বাস্তবে আনতে হবে। তখন মেয়ে না ছেলে হয়েছে দরকার হয় প্যান্ট টেনে খুলে দেখবেন। যতক্ষণ ইচ্ছা বাচ্চাটাকে দেখবেন। ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয় নেই। ইমা এসে রান্নাঘরে ঢুকেছে দেখে বললেন,
– ‘তোমারে তো পুষ্পিতা ভুলে গেছে।’
ইমা মুচকি হাসলো কেবল। তিনি আবার বললেন,
– ‘দু’জনকে কি সুন্দর মানায় দেখেছো?’
– ‘হ্যাঁ আন্টি।’
– ‘আল্লাহ পাক চোখ থাকতে অন্ধ করে দিছিলেন আমাদের। এত ভালো জামাই চোখের সামনে রাইখা মিনারের লগে বিয়ে দিতে গিয়েছিলাম। আরে ব্যাটা তোর বাপ এক খ’বিশ তুই আরেকটা। আমার মেয়েরে বিয়ে করিসনি। তাতে আটকে গেছে বিয়ে। তোরে আরেক বেডি ছাইড়া চলে গেছে৷ তোর আবার ঠেস। আল্লাহ পাক যা করেন ভালোর জন্য করেন।’
– ‘হ্যাঁ আন্টি।’
– ‘যাও মা হাত-মুখ ধুয়ে নাও। আর ওরা আরেকটু ঘুমাক।’
ইমা হাত-মুখ ধুতে বাথরুমে চলে গেল।
পুষ্পিতা এখনও ঘুমোচ্ছে। ইমাদ আজ ফজরের আজান শুনতে পায়নি। ভোর ছয়টার দিকে হঠাৎ উঠেছে। পুষ্পিতার সঙ্গে শারীরিক কিছু না হলেও গোসল করে নামাজ আদায় করে। এরপর আর ঘুম আসেনি তার। চেয়ারে বসে জানালা দিয়ে দীর্ঘ সময় সকালের সজীব চা-গাছ আর সবুজে মোড়ানো উঁচু-নীচু পাহাড় দেখেছে। ভোর সাতটার উপরে এখন। ক্রমশই জানালার গ্লাস ভেদ করে আলো রুমে ঢুকে পড়ছে। পিছু ফিরে পুষ্পিতার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খেয়াল হওয়ায় পর্দা টেনে দিল। বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই মায়াবিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে অনায়াসে উপেক্ষা করা যায়। ইমাদ পাশের বালিশে গিয়ে মাথা পেতে দিল। মুচকি হাসলো সে। ঘুমন্ত অবস্থায় চেহারা শিশুদের মতো লাগছে। কিন্তু ক্ষীণ সময় পরেই তার ভুল ভেঙে গেল। শাড়ির আঁচল সরে গিয়ে পুষ্পিতার উম্মুক্ত পেট জানান দেয় পুষ্পিতা মোটেও শিশু নয়। ইমাদ খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে-আস্তে ওর নাভিতে নাক-ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। ঘুমের ভেতরেই পুষ্পিতা কেঁপে উঠে ওর মাথা চেপে ধরে। আবার ক্ষীণ সময় পর ঘুম ভেঙে গেলে, চোখ মেলে তাকায়। আচমকা এই দৃশ্যটি দেখে ‘আরে কি হয়েছে’ বলে উঠে বসলো পুষ্পিতা৷
– ‘যাহ বাবা, তোমার ঘুম ভেঙে যাবে ভাবিনি, স্যরি।’
– ‘না সমস্যা নেই। আমি হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম দেখে।’
ইমাদ বালিশে মাথা রেখে পুষ্পিতাকে বুকে টেনে নিয়ে বললো,
– ‘ঘুমাও।’
পুষ্পিতা হাই তুলে বললো,
– ‘না, ঘুম ভাঙায় ভালোই হয়েছে। তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। বিছনাকান্দি যেতেও অনেক টাইম লাগে।’
– ‘তাহলে যাও, হাত-মুখ ধুয়ে নাও।’
পুষ্পিতা বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ইমাদের গালে চুমু দিয়ে কানে ফিসফিস করে বললো, ‘স্যরি, তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি শুধু। বিয়ে নিয়ে তোমার হয়তো কত স্বপ্ন ছিল। আমার জন্য শুধু ঝামেলা হচ্ছে। তবে খুব শিগগিরই নিজেকে উজাড় করে দেবো তোমার কাছে৷’
ইমাদ মুচকি হেঁসে ওর কপালে চুমু খেয়ে বললো,
– ‘কোনো সমস্যা নেই ম্যাডাম৷ এসব নিয়ে ভেবো না।’
পুষ্পিতা উঠে বললো,
– ‘যাই দেখি নাশতার কি হলো।’
নাশতার পর্ব শেষ করে দশটার দিকেই তারা রেডি হয়ে বের হয়ে যায়। গাড়ি সিলেট এয়ারপোর্ট রোড় দিয়ে দ্রুত চলছে। ইমা এক পাশে, ইমাদ অন্যপাশে আর পুষ্পিতা মাঝখানে। সুন্দর পরিষ্কার পিচঢালা রাস্তা। রাস্তার দুইপাশের উঁচু-নীঁচু পাহাড় বেয়ে উঠেছে চা গাছ। ঘণ্টা খানেকের ভেতরেই তারা গোয়াইনঘাট উপজেলার পীরের বাজার এসে পৌঁছায়৷ ড্রাইভার বললো, এখান থেকে নৌকায় চলে যান। হাঁদারপাড় থেকেও যাওয়া যায়। তবে সেদিকের রাস্তা শুনেছি ভালো না৷ পুষ্পিতা আর ইমা গাড়ি থেকে নেমে রঙিন টুরিস্ট নৌকা দেখে বললো,
– ‘এখান থেকেই যাই। নৌকা ভ্রমণও হয়ে যাবে।’
একটা নৌকা ভাড়া করে তারা উঠে গেল।
তিনজনই সামনের চেয়ারগুলোতে বসেছে৷ নৌকা চলছে সচ্ছ পানির টলটলে পানি দিয়ে। দুইপাশে নদী পাড়ের গ্রামীণ জীবন-যাপনের কিছু কিছু ঝলক দেখা যাচ্ছে। নৌকা যাচ্ছে দ’পাশের সবুজ মাঠে, গরু ছাগল আর ধান খেত পেছনে ফেলে। মাঝে মাঝে নদীতে বাঁশ দিয়ে বানানো নড়বড়ে ঘাটগুলোতে ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু যুবতী মেয়ে অবধি গোসল করতে দেখা যাচ্ছে। আঁকাবাঁকা এই নদীটি ধরে নৌকা আরও খানিকটা যেতেই উঁকি দিতে শুরু করলো ভারতের আকাশ ছোঁয়া পাহাড়৷ দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে সবুজ নয় এগুলো সাদা মেঘের পাহাড়। শুভ মেঘগুলো ঢেকে রেখেছে সবুজকে ইমা বিস্ময়ে বললো,
– ‘ওয়াও, ভাবি এইগুলো কি পাহাড়?’
পুষ্পিতা মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘হ্যাঁ, এটা ভারতের।’
– ‘মনে হচ্ছে মেঘের সঙ্গে মিশে গেছে।’
– ‘দূরে তাই এমন মনে হচ্ছে।’
– ‘কিন্তু মনে হচ্ছে আমাদের নৌকা কাছে চলে যাচ্ছে।’
– ‘হ্যাঁ এরকমই লাগে।’
ক্রমশই পাহাড়গুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। যেন পাহাড়গুলো তাদের স্বাগত জানাচ্ছে অলিক কোনো ভুবনে। চারপাশ যেন ছবির মতো সুন্দর। নদীর দুইপাশে যেন রূপকথার সুন্দর গ্রাম। সামনের মেঘজমা মোহনীয় পাহাড় প্রকাশ পাচ্ছে দ্রুত। দু’টা পাশাপাশি পাহাড় দেখে পুষ্পিতা বললো,
– ‘ইমা যাও তোমার একটা ছবি তুলি।’
ইমা সামনে যেতেই ইমাদ ওর কয়েকটি ছবি তুলে নিল।
ইমা এসে বললো,
– ‘তোমরা যাও। আমি তুলি।’
ইমা তাদের ছবি তুলে বললো,
– ‘ওই দুইটা পাহাড়ে যেন হেলান দিয়ে আছো তোমরা।’
পুষ্পিতা মিষ্টি হেঁসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে। তারপর চুপচাপ বসে থাকে তারা। মুগ্ধ হয়ে দেখে চারপাশ। যেদিকে তাকায় নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
নদীতে চলতে চলতে চোখ ধাঁধানো দৃশ্যগুলো বিমোহিত তারা। এক সময় দূর থেকে দেখতে পাওয়া পাহাড়ের কাছেই চলে আসে। পাহাড়ের কোলে এসে চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ পাথর কেয়ারি। বর্ষায় পাথর কেয়ারি পানিতে ডুবু ডুবু। এখান থেকে একটু সামনেই সীমান্ত ঘেঁষা পাথর-জলের বিছনাকান্দি।
ভারতের পাহাড় ভেদ করে বাংলাদেশের বুকে জল গড়িয়ে আসছে। এই অগভীর জলের নীচে আছে পাথরের প্রলেপ। প্রকৃতি এতো সুন্দর করে পাথর বিছাতে পারে, সেটা ইমা ভাবতেই পারছে না। সে এর আগে জাফলং বিছনাকান্দি কোথাও যায়নি। সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চিত সে।
– ‘ভাবি ওই জায়গা কি ভারত?’
– ‘হ্যাঁ, ওই দেখো ভারতের মানুষ দেখা যায়।’
ইমা সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকায়। তারপর জুতো খুলে রাখে সে। নিচে পাথরের বিছানা যেন। আস্তে আস্তে গিয়ে পানিতে পা দেয়। অস্ফুটে বলে উঠলো ‘ওয়াও এত ঠাণ্ডা পানি।’
ইমাদ নিজের প্যান্ট গুটিয়ে নিতে নিতে বললো,
– ‘দেখিস পড়বি। এখানে পড়লে যেদিকেই লাগবে রক্ত বেরুবে। চারদিকেই পাথর।’
ইমার সেদিকে খেয়াল নেই। হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে তার। আঁজলা করে ঠাণ্ডা সচ্ছ জল মুখে দিল সে।
পুষ্পিতা জুতা খুলে বললো,
– ‘ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরে পানি বেশি থাকে। টিউব নিয়ে সাঁতার কাটতে পারতে। এখানে পানি কম।’
ইমাদ প্যান্ট গুটিয়ে নিয়ে মাথা তুলে বললো,
– ‘তুমি তো আর সাঁতারই জানো না।’
পুষ্পিতা মুচকি হেঁসে সামনে তাকায়।
একটু আগের কথাটার উত্তর দিয়ে দেয় এখানকার প্রকৃতি। ছোট বড়ো ডুবু-ডুবু পাথর বিছিয়ে আছে চারদিকে। পাথরের বিছানার উপর দিয়ে পাশের পাহাড় থেকে অনবরত স্বচ্ছ পানির ধারা বহমান।
পুষ্পিতা ইমাদের কাঁধে ধরে বললো,
– ‘এখানে পানি কম থাকায় পাথর দিয়ে হাঁটা যাবে। মাঝখানে গিয়ে ছবিও তোলা যাবে।’
– ‘হ্যাঁ।’
ইমা বেশিদূরে গেল না। পুষ্পিতা আর ইমাদ পানিতে হাঁটাহাঁটি করছে৷ ক্যামেরাম্যানকে পুষ্পিতা ডেকে এনে বললো,
– ‘ইমা ছবি তুলো।’
ইমা নানানভঙ্গিতে কিছু ছবি তোলার পর পুষ্পিতা একেবারে মাঝখানের বড়ো পাথর দেখিয়ে বললো,
– ‘আমরা দু’জন সেখানে গিয়ে তুলতে চাই।’
ক্যামেরাম্যান সম্মতি দিয়ে বললো,
– ‘চলুন।’
পুষ্পিতা আর ইমাদ দু’জন দু’জনকে ধরে খুবই সাবধানে হাঁটছে। পাহাড় থেকে নেমে আসা জল পাথরের উপর দিয়ে মৃদু কলকলানির শব্দ তুলে ছুটে যাচ্ছে। পুষ্পিতা বারবার পাথরে পা দিয়ে পড়ে যাচ্ছে। ইমাদ ধরে আছে তাকে শক্ত করে। দু’জন এক সময় এসে পাথরে উঠে। পেছনে দু’টি পাহাড়। মাঝখান দিয়ে জলের ধারা।
পুষ্পিতা ইমাদকে বললো,
– ‘তুমি আমাকে পিছু থেকে ধরে ক্যামেরার দিকে তাকাও।’
ইমাদ সাবধানে পেছনে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকায়। এভাবে তোলার পর পুষ্পিতা দুইহাত দু’দিকে দিয়ে বললো,
– ‘এভাবে তুমিও দুইহাত মেলে আমার আঙুলগুলোর ফাঁক তোমার আঙুল নিয়ে ধরো।’
ইমাদ ঠিকঠাক ধরতে পারছিল না। ক্যামেরাম্যান বুঝিয়ে দিয়ে সামনে গিয়ে পুনরায় বললো,
– ‘আরেকটু সামনে আসেন।’
পুষ্পিতা ভাবলো তাকে বলছে৷ খানিকটা এগুতে গিয়েই পা পিছলে ধড়াম করে পড়লো পাথরে সে। পলকেই পিছলে সে পড়লো গিয়ে পানিতে। আলগোছে পিছলে পড়ায় নিতম্বে ব্যথা ছাড়া তেমন কিছুই হলো না ওর। কিন্তু নড়ে যাওয়ায় সোজা দাঁড়িয়ে থাকা ইমাদ পেছন দিকে প্রায় ছিটকে পড়লো। দুই কনুই লাগলো গিয়ে দু’টা পাথরে। খুবই বাজেভাবে মাথার পেছন দিক পড়লো তৃতীয় পাথরে। আর্তনাদ করে উঠলো ইমাদ। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুল দুই কনুই এবং মাথা থেকে।
_চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম