তবু মনে রেখো পর্ব-১৩

0
703

তবু মনে রেখো (১৩ পর্ব)
.
পুষ্পিতা করপুটে মুখ ঢেকে বিছানায় বসে যায়। কনুই দুই হাঁটুতে ঠেকানো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খোঁপা ছেড়ে দিয়েছিল। এখন চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে পড়েছে।
ইমাদ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, বিরক্ত ছিল। পুষ্পিতা পাশে এসে বসায়, একবার তাকালো ওর দিকে। কিছুই বললো না সে। পুষ্পিতা খানিক পর হাত সরিয়ে মাথা তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘তুমি আসলেই কিছু জানতে না?’

ইমাদও আরও খানিকটা বিরক্ত হলো।

– ‘পুষ্পিতা এই বিষয়টা নিয়ে এভাবে কথাই বা বলছো কিভাবে আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি কখনও এগুলো চেয়েছি? তোমাকে কি আমি কখনও এগুলোর ইঙ্গিত করেছি? তাহলে আন্টি কিভাবে এগুলো বললেন? উনার মাথায় কেন এলো আমাকে এগুলো দিলে সুখে রাখবো। তাছাড়া বললেন কিভাবে যা চাই তা পাব। শুধু তোমাকে সুখে রাখতে হবে। এসবের মানে কী!’

পুষ্পিতার মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই যদি ইমাদ এগুলো না জেনে থাকে। তাহলে বড়োই অন্যায় করা হয়েছে। আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘আমি তো জানি না।’

ইমাদ খানিক ভেবে বললো,

– ‘তুমি নিশ্চয় কিছু বলেছো, না হলে ওরা কেন এগুলো ভাববে।’

পুষ্পিতা আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘আসলে আড়াই দিন পর আমরা যখন বেড়াতে গিয়েছিলাম, মা কেন যেন অদ্ভুত সব কথা বলতে শুরু করেছিলেন। আমাদের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন। একপর্যায়ে বললেন নাতি-নাতনিদের কথা। এরপরই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বলে দিয়েছিলাম আমাদের মাঝে সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই। আলাদা বিছানায় থাকি।’

ইমাদের রাগে-অপমানে চোখে জল চলে এসেছে। ওরা ভেবেছিল পুষ্পিতাকে সে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি৷ তাই মন-ভোলানোর জন্য এগুলো দিতে চেয়েছে। তার বাবাও সেগুলো মৌখিকভাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন৷ আর সে যখন পুষ্পিতার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশেছিল। সবাই তখন ভুল বুঝেছে। কাকতালীয় তার অজান্তেই এত ঘটনা ঘটে গেল৷ ইমাদ দুইহাত মাথার নিচে রেখে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ে। খানিক পর পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল দেয় তার বাবাকে, দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হয়।

– ‘হ্যালো।’

– ‘হ্যাঁ ইমাদ তোমরা কি চলে গেছো বাবা।’

তার শরীর রীতিমতো কাঁপছে। ইমাদ খানিক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

– ‘বাবা, তুমি আমার সঙ্গে এমন করলে কেন?’

হায়দার সাহেব অবাক হয়ে বললেন,

– ‘কি হয়েছে বাবা? তোমার কথা এরকম শোনা যাচ্ছে কেন?’

ভেতর থেকে গুলিয়ে আসা কান্না আঁটকে ইমাদ বললো,

– ‘বাবা, আমি বাড়ি ফেরার আগে তুমি একটা কাজ করতে হবে।’

– ‘কি?’

– ‘পুষ্পিতাদের সকল আসবাবপত্র ফিরিয়ে দিতে হবে।’

পুষ্পিতা বিস্ফোরিত চোখে ইমাদের দিকে তাকায়। হায়দার সাহেব ফোনের ওপাশ থেকে অবাক হয়ে বললেন,

– ‘কি বলো এসব? কি হয়েছে? পুষ্পিতা মায়ের সাথে কি কোনো ঝগড়া হইছে?’

– ‘কিছুই হয়নি বাবা, তুমি আমাকে আর কত ছোটো বানাবে? তোমার কথা কবে আমি শুনিনি? সব কথাই মেনে চলেছি। তাই বলে আমার স্ত্রী, শ্বশুরবাড়িতে আমাকে এভাবে ছোটলোক বানাবে তুমি।’

হায়দার সাহেব অবাক হয়ে বললেন,

– ‘কি বলো এসব? হয়েছে কি?’

– ‘তোমার কথা শুনে শুনে আমার কি সর্বনাশ হতে চলেছিল৷ যাইহোক এগুলো বলতে চাই না৷ আমি ফেরার আগেই চাই সবকিছু ফেরত পাঠাও।’

– ‘মাতব্বরি করবে না ইমাদ। যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলো না। তুমি আমাকে হুকুম দিচ্ছ আজ তাই না?’

– ‘বাবা আমি হুকুম দিচ্ছি না। তোমার কথায় তো আমি বিয়েও করেছি। আসবাবপত্র তোমার সঙ্গে কথা বলেই দিয়েছে ওরা। তাই তোমাকে ফের‍ত পাঠিয়ে দিতে বলেছি।’

– ‘তুমি আমার কথা শুনে বিয়ে করেছো, তাই না? লম্পট কোথাকার, তুমি ওকে পছন্দ করতে তাই তোমার দিকে চেয়েই বউ করে এনেছি৷ বউ পেয়ে তুমি আসমানের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি হয়েছো। এখন বলছো আমার কথায় রাজি হয়েছো। আমি যে বাবা হয়ে তোমার জন্য এই মেয়েকে গ্রহণ করেছি এটাই তো অনেক। কোনো বাবা আছে এমন ঘটনার পর এই মেয়েকে বউ করে মেনে নিবে? আমি কেন এনেছি, তোমার জন্যই৷’

ইমাদ খানিক নিভে গেল৷ তবুও জোর দিয়ে বললো,

– ‘বাবা এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না৷ বিয়ে হয়ে গেছে শেষ। তুমি এসব ফেরত পাঠাও।’

– ‘চুপ বেয়াদব, এগুলো ফেরত পাঠাও৷ কোথাও দেখেছিস এগুলো না দিতে? আর এখন বাড়ি থেকে এসব ফেরত পাঠালে মানুষ কি বলবে? আর তোমার বউয়ের কি ইজ্জত থাকবে? শ্বশুরবাড়ির মান-ইজ্জত থাকবে। লোকে শুনলে ভাববে ঝামেলা হয়েছে৷ এখন মাতব্বরি না করে বলো কি হয়েছে৷ ঝগড়া হলে আমরা আছি শেষ করে দেয়া যাবে৷ তাই বলে মাল ফেরত পাঠিয়ে দিতে হবে এটা কেমন কথা?’

ইমাদ আর কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দিল। পুষ্পিতার ভয় ভয় করছে। সে ফোনের ওপাশের কথআ কিছুই শুনতে পায়নি। তবুও বুঝতে পারছে ইমাদ রেগে আছে৷ আসবাবপত্র সব ফেরত পাঠাতে বলছে। এত শান্তশিষ্ট একটা মানুষ এরকম রেগে গেল কিভাবে! পুষ্পিতা দুরুদুরু বুকে একটা বালিশ নিয়ে এসে ইমাদের মাথার নিচে রাখে। ইমাদ বিছানা থেকে লাল পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিকেই চোখ স্থির রেখে বললো,

– ‘পুষ্পিতা, আমি জানি আসবাবপত্র এখন ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না৷ তাই সেগুলো নিয়ে আর কিছু বলছি না৷ তবে এই বাসা আমার নামে লিখে দেওয়া, ইতালি পাঠানোর আলাপ এবং জমি যা কিনেছিলেন আঙ্কেল সেগুলো কাগজ করে না আনা। এর কোনোকিছুই যেন না হয়। আমি তোমাকে বিয়ে করেছি, বিক্রি বসার ইচ্ছা আমার নেই।’

পুষ্পিতা শঙ্কিত গলায় বললো,

– ‘স্যরি, আম্মুর এভাবে বলাটা হয়তো ঠিক হয়নি।’

– ‘এভাবে-ওভাবে যেভাবেই হোক। আমাকে তোমরা লোভী ভেবেছো। এটা বুঝতে আমার আর বাকি নেই।’

– ‘কি যে বলো লোভী ভাববো কেন।’

– ‘শোনো পুষ্পিতা, এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আমার কথা বলতেই লজ্জা লাগছে। আর তোমারা ভেবেছো এসব পেয়ে আমি খুবই খুশি হয়েছি। দয়া করে এই বিষয়ে আলাপচারিতা বন্ধ করবে। আঙ্কেলকেও তুমি বলে দিয়ো। আর ওরা তো তোমাকে সুখী দেখতে চায়। তুমি কিভাবে সুখে থাকবে জানি না। তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো সুখে রাখার৷’

পুষ্পিতা আমতা-আমতা করে বলল,

– ‘একটা প্রশ্নের জবাব দেবে?’

– ‘কি?’

– ‘ওইদিন বাবা আঙ্কেলকে এসব বললেন। উনি বাজারে গিয়ে তোমাকে পাঠালেন। তখন যদি সবকিছু তুমি না জেনেই থাকো। ওইদিনের পর থেকে পালটে গেলে কেন?’

ইমাদ অতি শোকে মলিন মুখে হেঁসে বললো,

– ‘তুমি ভেবেছিলে এসবের লোভে পালটে গিয়েছিলাম? যাইহোক তোমার কোনো দোষ নেই। আমার কপালেই এগুলো ছিল।’

পুষ্পিতা ওর মাথায় হাত রেখে বললো,

– ‘স্যরি, আসলে আমার বুঝতে ভুল হয়েছে। তুমি হয়তো শুরুর দিকে আমার পালিয়ে যাওয়ার জন্য মানতে পারোনি। শেষে ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছিলে। আমিই ভুল বুঝেছিলাম।’

বাবার কথা সে বলতে চাইল না আর পুষ্পিতাকে। কিন্তু বাবার তার প্রতি প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে৷ পুষ্পিতার সঙ্গে তার বিয়ে দেয়ায় সে খুশি হয়েছিল। মনে হচ্ছিল উনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। ইমাও শুরুতে মানেনি। বলেছিল এরকম ঘটনার পর বিয়ে করালে এলাকায় চলাফেরা করবে কিভাবে। বাবা তাকে ধমক দিয়ে বন্ধ করেছিলেন। শেষে ইমাও স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে। আত্মীয়-স্বজন সহ এলাকার মানুষ নানান কথা বলেছিল। বাবা নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। মামা-খালাকে রীতিমতো তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বারবার মনে হয়েছে বাবা বটবৃক্ষের মতো তাকে ছায়া দিচ্ছেন৷ আকাশ থেকে ছিনিয়ে এনে দিচ্ছেন পূর্ণিমার চাঁদ। উনি ছাড়া এতকিছু সম্ভব হতো না। ইমাদের এসব দেখে শ্রদ্ধা, ভক্তি বেড়ে পাহাড় সমান হয়ে গিয়েছিল। উনার কথা মানেই মনে হয়েছিল ঐশ্বরিক বাণী৷ যাই বলেছেন, মনে হয়েছে তাতে অবশ্যই কোনো মঙ্গল আছে। কিন্তু আজ সে ভেবেই পাচ্ছে না উনি কেন পুষ্পিতাকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে না করেছিলেন। আর কেন সেদিন নিজেই আবার বলেছিলেন এখন থেকে পুষ্পিতার সঙ্গে ভালো আচরণ করতে। উনি এটাও বলেছিলেন, বড়োলোকের মেয়ে, একটু গরম থাকতে বলেছি না হলে দাম পেতে না। এখন ওরা বুঝেছে জামাই গরিব হলেও নরম না। যা ইচ্ছা বলা যাবে না। বাবার এই ব্যখ্যা নিয়ে তার মনে এখন ক্ষীণ সন্দেহ আছে। উনি হয়তো এই বাসা, আসবাবপত্র, জমি-জমার জন্যই সেদিন খুশি হয়ে বলেছিল কথাটা। ইমাদ পরক্ষণেই আবার নিজের পিতাকে নিয়ে এসব বাবার কারণে মনে মনে শাসিয়ে অন্যকিছু ভাবতে চেষ্টা করলো। পুষ্পিতা তার মাথায় এখন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এটা কি শুধু একজন রাগান্বিত পুরুষকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য? গতরাতে পুষ্পিতার মুখের সেই অভিব্যক্তি তার এখনও মনে আছে। ইমাদ চোখ মেলে পুষ্পিতার দিকে তাকায়। মুখটা লাল হয়ে আছে ওর। ভীষণ আদর করতে ইচ্ছা করে তার। পুষ্পিতা তার গালে হাত দিয়ে বললো,

– ‘এভাবে তাকাচ্ছো কেন?’

– ‘এমনিই।’

পুষ্পিতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

– ‘আচ্ছা যদি তোমার কোনো কিছুর প্রতি লোভই না থাকে। তাহলে কেন বিয়ে করলে? আঙ্কেলের চাপে?’

– ‘এগুলোর উত্তর দিয়েছিলাম তো।’

– ‘না ইমাদ, তখন আমি এভাবে বুঝিনি, এখন আবার হলো।’

পুষ্পিতার মুখে নিজের নাম শুনে তার মনটা ভালো হয়ে গেল। ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘বাবার চাপে না।’

পুষ্পিতা ধরা গলায় বললো,

– ‘তোমার মা-খালাও তো আমাকে চ*রিত্রহীন বলে গেছেন। তাহলে তুমি কেন আমাকে গ্রহণ করলে?’

– ‘এটাও বলেছিলাম।’

– ‘আবার বলো প্লিজ।’

মুচকি হাসলো ইমাদ। তারপর বললো,

– ‘তুমি কাউকে অন্ধভাবে ভালোবেসেছো, বিশ্বাস করেছো, এটা সবাই পারে না। এগুলো পারে বোকারা। ম*তলববাজ মানুষের ভীড়ে এই বো*কারা হয়তো বসবাসের অযোগ্য। তারা বিশ্বাস করে বসে, সবাইকে নিজের মতো ভালোই মনে করে। বিশ্বাস করে প্র*তারিত হয়। অথচ আমরা প্র*তারক রেখে তাদেরকেই নানান কথা বলি। আমি সেসব মানি না। আমি বড়োজোর বলবো তুমি বোকামি করেছো বিশ্বাস করে, মা-বাবাকে কষ্ট দিয়েছো পালিয়ে গিয়ে। তাই বলে চ*রিত্রহীন না।’

পুষ্পিতার ছলছল চোখ। ঝাপসা লাগছে সবকিছু। ইমাদের মুখটা দেখতেই পারছে না সে। দুইহাতে মুখ ঢেকে ইমাদের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। ইমাদ ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যায়। তারপর পিঠে হাত রেখে বললো,

– ‘কাঁদছো কেন? দেখি উঠো, উঠো।’

ইমাদ ওর মাথা তুলে চোখের জল মুছে দিয়ে বললো,

– ‘কি হয়েছে, চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে।’

– ‘নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে ইমাদ। তোমাকে নিয়ে কি না কি ভেবেছিলাম।’

– ‘তোমার কোনো দোষ নেই পুষ্পিতা। আমি হলেও ভাবতাম।’

পুষ্পিতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

– ‘মাত্র গতকালই মানুষের প্রতি তীব্র ঘৃণা ছিল। মনে হয়েছিল এক প্র*তারকের থেকে আরেক লোভীর ঘরে এসেছি সংসার করতে। আমার এখন গিল্টি ফিল হচ্ছে।’

ইমাদ হেঁসে ফেললো।

– ‘তাহলে আমাকে নিয়ে এগুলো তোমার মনে ছিল?’

পুষ্পিতা লজ্জায় ইমাদের বুকে মুখ লুকিয়ে বললো,

– ‘স্যরি, সত্যিই এখন লজ্জা হচ্ছে।’

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে