তবু মনে রেখো পর্ব-০৯

0
708

তবু মনে রেখো (৯ম পর্ব)
.
বাড়ির রাস্তায় পৌঁছে দেখা গেল সবাই তুমুল ব্যস্ত। বারান্দায় পুরাতন আসবাবপত্র বের করা হয়েছে। একজন কাজের লোকও হায়দার সাহেব এনেছেন। উঠানে এসে সিএনজি থামতেই ইমা দৌড়ে এলো। ইমাদ নেমে বললো,

– ‘কিরে আজ কলেজে গেলি না?’

ইমা জবাব না দিয়ে ভাবিকে নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হায়দার সাহেবও এগিয়ে এসেছেন। ইমাদ ভেতরে চলে গেল। তাদের রুমের মালপত্র সবকিছু বাইরে। ফাঁকা ঘর। পুষ্পিতাকে ইমা নিজের রুমে নিয়ে বসালো। হায়দার সাহেব এসে ইমাদকে বললেন,

– ‘যাও বাবা, রইসুরে নিয়ে পালঙ্কটা সেটিং করো৷’

ইমাদ কাপড় পালটে সেদিকে চলে যায়। তার বাবার আনন্দটা সে বুঝতে পারছে। সবাইই এরকম আনন্দিত হয়। কিন্তু ইমাদ এই আনন্দের কারণ আগে থেকেও বুঝতে পারতো না। এখন নিজে পেয়েও অনুভব করতে পারছে না। তাহলে কি বাবার কথাই ঠিক, সে ব’লদ শ্রেণির মানুষ। ছোটবেলা থেকেই গুরুজনদের থেকে এই গা’লিটাই সে খেয়ে এসেছে৷ তাই অনেক ভাবনাই প্রকাশ করার সাহস হয় না। তার ধারণা এই নিয়মটার কোনো ভালো যুক্তি নেই৷ একটা মেয়েকে আমার ঘরে বিয়ে করে আনলাম, সে এসে এখানে ঘুমানোর জন্য পালঙ্ক নিয়ে আসতে হবে? কাপড় রাখার জন্য আলমারি নিয়ে আসতে হবে? এটা কেমন যুক্তি, এটা কেমন কথা। ইমাদ একবার ফুফাতো ভাইয়ের বিয়েতে গিয়ে প্রচণ্ড অবাক হয়েছিল। বিয়ের আগেরদিন পালঙ্ক, সোফা, আলমারি সহ যাবতীয় জিনিসপত্র এসেছে। ফ্যামিলির মুরব্বিরা হাত দিয়ে ভালোভাবে দেখে এগুলো কোন গাছের কাঠ হতে পারে, ভালো কি-না মন্দ এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছেন৷ ফুফাতো ভাইও তাকে একবার বললো, ‘মালগুলো ভালোই দিয়েছে কি বলিস?’
সেদিনও তার কাছে মনে হয়েছে এরা এত খুশি হচ্ছে কেন, এগুলো নিয়ে আলোচনাই তো লজ্জার। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় এগুলোই হয়তো নিয়ম। এটাই হয়তো সমাজ। তার মতো ব’লদ শ্রেণির মানুষের নিয়ম নিয়ে ভাবনার কথা নয়। নিয়ম ভাঙার স্পর্ধা দেখানোর জ্ঞান-বুদ্ধি আর সাহস তাকে দেয়া হয়নি৷ তার কাছে জীবন খুবই সহজ, সরল। পালঙ্ক না থাকলে ফ্লোর আছে। আলনা না থাকলে রশি আছে৷ সোফা না থাকলে পাটি আছে। অবশ্য এরকম শোচনীয় অবস্থায় কেউ দান করলে ভিন্ন কথা। গরিবদের সমাজে চিকিৎসার টাকা দেয়া হয়। গৃহহীন মানুষকে ঘর বানিয়ে দেয়া হয়। সেরকমই যদি আর্থিক সচ্ছল শ্বশুরবাড়ি থেকে দেয়, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু নিজেরই প্রাপ্য ভেবে, সেটাকে নিয়ম বলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে আদায় করাটাই সমস্যা। এই কথাগুলো কাউকে বললেই হেঁসে উড়িয়ে দিয়ে ব’লদ বলে গা’লি দেবে। অসংখ্য সরল আর সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব’লদ শ্রেণির মানুষের মতো তার ভেতরেও বি’দ্রোহ জাগে না। প্র’তিবা’দী, বি’দ্রোহী হতে হলে নিজের মতাদর্শের প্রতি যে আত্মবিশ্বাসটুকু থাকতে হয়, তাদের হয়তো সেটা ক্রমশই বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইমাদ আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে রইসুর সঙ্গে কাজে লেগে পড়ে। জোহরের আগেই সবকিছু গোছানো হয়ে গেল। গোসল করে, খাওয়া-দাওয়া শেষে চলে গেল সে বাজারে। কিন্তু এই ব্যস্ত, কোলাহলে থেকেও সে যেন বারবার একা হয়ে যাচ্ছিল। পুষ্পিতার কথা ভাবছে। কোনোভাবেই কাজে মন বসছে না। আসরের আগেই কর্মচারি শফিককে বললো,

– ‘আমি চলে গেলে পারবি না একা? ভালো লাগছে না৷ নামাজ পড়ে চলে যাব।’

সামনের দোকান থেকে সমবয়সী একজন বললো,

– ‘পারবে ভাই পারবে, তুমি যাও। নতুন বিয়ে করছো দোকান-টোকান বন্ধ থাকুক কিছুদিন। এগুলো ব্যাপার না।’

ওর পাশের দোকান থেকে একজন বললো,

– ‘এভাবে বউ রেখে দোকানে এসে বসে থাকলে হঠাৎ একদিন দেখবা মিয়া বউ নাই।’

সবাই এক সঙ্গে হেঁসে উঠলো। ইমাদ ওদের রসিকতার ভাষা বুঝতে পারে। তর্কে জড়ায় না, কথা বাড়ায় না৷ পুষ্পিতাকে সে ভালোবাসে। সমাজ, মানুষ কি বললো তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না।
যে মেয়ে বিশ্বাস করে ধোঁ*কা খায়, সে বড়োজোর বোকা হতে পারে, চরি*ত্রহীন বা খা*রাপ মেয়ে নয়। যে বিশ্বাস ভঙ্গ করে সেইই বরং সমাজের এসব কথা শোনার যোগ্য। পুষ্পিতারা অবুঝ, শিশু, অন্ধ। বিশ্বাস করাই তাদের অপরাধ। আর যে বিশ্বাস ভঙ্গ করে তারাই বন্ধুমহলে হিরো। ইমাদ এই ভাবনাগুলো থেকেই পুষ্পিতাকে অবলীলায়, অনায়েসে গ্রহণ করতে পেরেছিল।

আসরের নামাজের পরেই শফিককে রেখে সে চলে এসেছিল বাড়িতে। সাবিনা বেগম আর মহসিন সাহেব এসেছেন। তারা হায়দার সাহেবের সঙ্গে বসে গল্প করছেন। সে সালাম দিয়ে ভেতরের রুমে চলে গেল। পুষ্পিতা আর ইমা লুডু খেলায় ব্যস্ত।

হাত-মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে বললো,

– ‘ইমা আজ আবার বিলে যাবি?’

ইমা খুশিতে লাফ দিয়ে উঠলেও পুষ্পিতা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ইমা বিষয়টা খেয়াল করে বললো,

– ‘ভাবি তোমার না ওইদিন ভালো লেগেছিল।’

– ‘ভালো লেগেছে, আমি এমনিই যাব না আজ।’

– ‘ও হ্যাঁ ভাইয়া, আন্টি-আঙ্কেল এসেছেন। আন্টি তোমাদেরকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চান।’

– ‘কবে?’

– ‘কালই, বাবার সঙ্গেই কথা হয়েছে৷ আমরা তিনজন আর আন্টি যাবে।’

– ‘কোথায় যাবেন।’

– ‘সেটা তোমরাই ঠিক করে নিবে।’

– ‘যাইহোক, তাই বলে আজ বিলে যাওয়া ক্যান্সেল?’

পুষ্পিতা লুডুর চাল দিয়ে বললো,

– ‘ক্যান্সেল হবে কেন? তুমি ইমাকে নিয়ে যাও৷ সে তো যেতে চাচ্ছে।’

ইমা অবাক হয়ে বললো,

– ‘ভাইয়া তো তোমার জন্যই যেতে চাচ্ছে ভাবি।’

পুষ্পিতা হেঁসে ফেললো কথাটি শুনে। ইমাদ হাসির অর্থ বুঝতে পারে৷ পুষ্পিতা ওই দিনের কথা মনে রেখেছে।
ইমা হঠাৎ উঠে যেতে যেতে বললো,

– ‘আমি গিয়ে রান্না বসাই, তোমরা দু’জন খেল।’

ইমা চলে যাওয়ার পর পুষ্পিতা লুডু বন্ধ করে নিল। ইমাদ বিছানায় বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

– ‘খেলার জন্যও তাহলে পছন্দসই মানুষ লাগে।’

পুষ্পিতা বিছানা থেকে নেমে লুডু রাখতে চলে গিয়েছিল৷ কথাটি শুনে ভ্রু কুঁচকে পিছু ফিরে তাকিয়ে বললো,

– ‘বুঝিনি কথাটা।’

– ‘বলেছি তুমি হয়তো যার-তার সঙ্গে খেলতে পছন্দ করো না।’

– ‘এটা কেন মনে হলো?’

– ‘এইযে আমার সঙ্গে না খেলে লুডু বন্ধ করে দিলে।’

পুষ্পিতা অবাক হয়ে বললো,

– ‘আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমার মতো কোনো চরিত্রহীন মেয়ের সাথে খেলবেই না।’

ইমাদের মুখটা নিমিষেই মলিন হয়ে গেল। সে খানিক পর আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘এটা কি বললে পুষ্পিতা, আমি কি এরকম কিছু বলেছি।’

– ‘সবকিছু কিছু তো বলতে হয় না, বুঝা যায়।’

– ‘কিভাবে বুঝলে? আর তোমাকে চরি*ত্রহীন ভাবলে কি বিয়ে করতাম?’

– ‘সেটা তুমিই জানো কেন বিয়ে করেছো। আমি আজ আসার সময় মায়ের কাছে মোবাইল চাইলাম, দেননি, তুমি না-কি চাও না। যার আমার প্রতি এতো ঘৃণা, অবিশ্বাস। একই বিছানায়ই থাকতে চায় না। সে যে আমার সঙ্গে খেলবে না তা তো স্বাভাবিক।’

– ‘কি বলো এসব? যাইহোক তুমি চাইলে মোবাইল ব্যবহার করো, আমার কোনো সমস্যা নেই।’

পুষ্পিতা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

– ‘আমি তো মোবাইলের জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছি না। নিষেধ আছে না জেনে চেয়েছিলাম। জানলে চাইতামই না৷ আমার মোবাইল ব্যবহার করার ইচ্ছা নাই।’

কথাগুলো বলে পুষ্পিতা রান্নাঘরে চলে গেল৷ ইমা আনাজ কাটছে৷ সে চেয়ারে বসে ভাবনায় ডুবে গেল। ইমাদের সঙ্গে এই রূঢ় আচরণ করার দরকারই ছিল না। ভেবেছিল সব অভিযোগ ঘৃ’ণা ভেতরে ক’বর দিয়েই সংসার করবে। অথচ প্রথমেই হেরে গেল নিজের কাছে। ইমাদ অনেক পালটে গেছে। সেটা লোভে হলেও সমস্যার কিছু নেই। মা-বাবা তো এটাই চেয়েছিলেন। তাহলে সে নিজে এতো ক্ষুব্ধ হচ্ছে কেন? কেন ইমাদকে এতো অসহ্য লাগছে৷ মোটেও এরকম করা ঠিক হয়নি। অসহ্য লাগলেও মানিয়ে নিতেই হবে।

– ‘কি হলো ভাবি? কি এতো ভাবছো?’

‘না কিছু না’ বলে পুষ্পিতা পুনরায় রুমে চলে গেল। ইমাদ দুইহাতে মুখ ঢেকে বিছানায় বসে আছে। পুরো পরিস্থিতি হালকা করার জন্য পুষ্পিতা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

– ‘পাশে বসলে তো জাত যাবে না? বসলে তো আবার ধমক খেতে হবে মনে হয়।’

ইমাদ মাথা তুলে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে তার মন খারাপ ভাবটা উধাও হয়ে গেল। পুষ্পিতা মুচকি হাসছে। সে পুনরায় বললো,

– ‘স্যরি, এতটা কঠিনভাবে বলতে চাইনি।’

– ‘কিযে বলো পুষ্পিতা, এটুকুর জন্য স্যরি বলতে হয়? বসো তো, পাশে বসো।’

পুষ্পিতা দুইহাত কোলে রেখে পাশে বসলো। পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে। যে মানুষটা দু’দিন আগেই তাকে অপমান-অপদস্থ করেছে, সে কি-না এত দ্রুত পালটে গেল? আসলেই মা-বাবা ঠিক। তারা যাইই বলেন সেটাই একটা সময় সঠিক হয়ে যায়। ঠিকই জানতেন বাসাটা দিলে ইমাদ খুশি হয়ে যাবে। একেবারে বাস্তবে প্রমাণ হয়ে গেল।

ইমাদের ইচ্ছা করছে পিঠের দিকে হাত নিয়ে ধরে বসবে। কিন্তু হাত যেন যাচ্ছেই না৷ একটু অন্ধকার হলে ঠিকই পারতো। দিনে-দুপুরে হাত নিলে পুষ্পিতা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে কে জানে। খানিক পর পুষ্পিতাই বললো,

– ‘লুডু খেলবে?’

– ‘হ্যাঁ খেলবো। লুডু আমার খুবই প্রিয় খেলা।’

ইমাদ কথাটা বলে নিজেই অবাক হয়ে গেল। সে মোটেও লুডু খেলা পছন্দ করে না, শেষ কবে খেলেছিল তাও মনে করতে পারছে না৷ পুষ্পিতা লুডু নিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বিছানায় গিয়ে বসে। ইমাদও ওর সামনে গিয়ে বসলো। পুষ্পিতা দু’জনের গুটি আলাদা করছে। ইমাদ তন্ময় হয়ে ওর আঙুলগুলো দেখছে। বুক শিরশির করছে৷ ইচ্ছে করে এই নরম কোমল আঙুলগুলো মুঠোয় নিয়ে গালে চেপে ধরতে। দরজা খোলা ছিল। সাবিনা বেগম এসে ঢুকলেন। দু’জনকে এক সঙ্গে লুডু খেলতে দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল৷ ইমাদ বিছানা থেকে নেমে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘বসুন আন্টি।’

সাবিনা বেগম ব্যস্ত হয়ে বললেন,

– ‘আরে বাবা নামছো কেন, খেলো দু’জন, যাও খেল। আমি চলে যাচ্ছি।’

__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে