তবু মনে রেখো পর্ব-০৫

0
689

তবু মনে রেখো (৫ম পর্ব)
.
সন্ধ্যার আগেই তারা বাড়িতে ফিরে এলো। পুষ্পিতাকে ভীষণ হাসি-খুশি দেখাচ্ছে। দু’জনকে রেখে ইমাদ নাও দিয়ে আসতে পুনরায় চলে গেল রহমত চাচার বাড়িতে। স্থলপথে ফিরছিল সে। অন্ধকার হয়ে গেছে। পুকুর পাড় পেরিয়ে উঠোনে আসতেই হায়দার সাহেব ঘাট থেকে ডাক দিলেন,

– ‘ইমাদ এদিকে আসো।’

সে এগিয়ে গিয়ে বললো,

– ‘কি বাবা?’

– ‘বসো।’

ইমাদ বসলো। হায়দার সাহেব খানিক্ষণ গম্ভীরমুখে বসে থেকে বললেন,

– ‘বাবা এতো অস্থির হইও না। বউ তো আর চলে যাচ্ছে না তোমার। বিয়ে যখন করেছো বউ থাকবো। প্রেম-ভালোবাসা সবই হইব। আমিও বাবা হিসাবে নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চাই। কিন্তু বাবা এখন তোমার কাজ ছিল রা’গারা’গি চি’ল্লাচি’ল্লি করা। তুমি বুঝতে চাচ্ছ না কেন, তোমাকে জোর করে বিয়ে করানো হইছে। তোমার অনেক রা’গ ভেতরে৷ একটা জলজ্যা’ন্ত মানুষকে জো’র করে বিয়ে করানো কি মুখের কথা বাবা? বিয়ে করলেও সে কি সহজে বউ নিয়ে সংসার করবো? নৌকা ধার-কর্জ করে এনে বউ নিয়ে ঘুরতে যাইব? তোমার বিবেকে কি কয় বাবা?’

ইমাদ খানিক চুপ থেকে বললো,

– ‘কিন্তু আমাকে তো জো’র করে বিয়ে করানো হয়নি। আমার তো কোনো আপত্তি ছিল না।’

– ‘আবার সেই একই কথা। মুরব্বিদের কথা মানতে হয়। তোমার ভালো ছাড়া মন্দ হবে না।

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

– ‘এখন বাজারে যাও। সাজু দোকানে একা।’

‘আচ্ছা’ বলে ইমাদ ঘরে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে পুষ্পিতাকে বললো,

– ‘বাজারে যাচ্ছি, ফিরতে রাত হবে।’

পুষ্পিতা আয়নার সামনে থেকে বললো,

– ‘আচ্ছা।’

ইমা ঢুকলো লুডো নিয়ে,

– ‘ভাবি লুডো খেলবে?’

– ‘হ্যাঁ আসো।’

দু’জন লুডো খেলতে বসে গেল। ইমাদ চলে গেল বাজারে। নিজের আবেগকে খানিক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাবার কথা পুরোপুরি অমান্য করতে চায় না সে। তাই রোজকার মতো রাতে দোকান বন্ধের পর পাশের দোকানে ক্যারাম খেলায় মেতে উঠে। খেলতে খেলতে রাত প্রায় একটা বেজে যায়। তাখন বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় সে। উঠোনে এসে লাইট জ্বেলে দেখে গ্রিলে তালা ঝুলছে। একটা চাবি তার কাছেই থাকে। সবাই ঘুমোচ্ছে হয়তো। ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে খুলে ভেতরে যায়। অন্যদিনের মতো টেবিলে খাবার রাখা নেই। নিজের রুমে গিয়ে দেখে ড্রিম লাইট জ্বলছে। ইমাদকে দেখেই পুষ্পিতা বিছানা থেকে উঠে রান্নাঘরে চলে যায়। সে মুখ-হাত ধুয়ে কাপড় পালটে নিল।

– ‘আসো, খাবার দিয়েছি।’

পুষ্পিতার দিকে মাথা তুলে তাকায় সে। বিকেলের শাড়ি পরে আছে এখনও। চোখগুলো লাল। তার জন্যই কি শুধু জেগে ছিল এতক্ষণ? ইমাদ টেবিলে গিয়ে বসলো। পুষ্পিতা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।

– ‘তুমি খেয়েছো?’

পুষ্পিতা মাথা নেড়ে না করলো।

– ‘তাহলে এখন খাও।’

– ‘না, ভালো লাগছে না আমার, খাব না।’

পাশের চেয়ার দেখিয়ে বললো,

– ‘এখানে এসে বসো বলছি। খেতে হবে তোমাকে। খাবারে বি’ষ মিশিয়ে রেখেছো মনে হয়।’

পুষ্পিতা বিস্মিত হয়ে আহত নয়নে তাকিয়ে বললো,

– ‘কি বলো এগুলো!’

– ‘কি বলছি আবার। তোমাকে দিয়ে কি বিশ্বাস আছে? তুমি এখানে বসে আগে খাবে। তারপর আমি খাবার মুখে দেবো, তার আগে না।’

পুষ্পিতা রান্নাঘর থেকে প্লেট আনতে যাচ্ছিল। ইমাদ থামিয়ে বললো,

– ‘প্লেট আনতে হবে না। এখানে এসে বসো।’

পুষ্পিতা জল ছলছল চোখে কয়েক কদম এগিয়ে এসে চেয়ারে বসে। ইমাদ প্লেটে ভাত মাখাতে মাখাতে বললো,

– ‘ভেবো না তোমার জন্য বিকেলে বিলে গেছি। ইমা অনেকদিন থেকে বলেছিল তাই নিয়ে গেলাম।’

পুষ্পিতা চোখ তুলে তাকায়। তাহলে ইমা তাকে কি মিথ্যে বলে নিয়েছিল?

ইমাদ এক লোকমা ভাত এগিয়ে দিয়ে বললো ‘হা’ করো। পুষ্পিতা বাঁধা দিয়ে বললো,

– ‘ঠোঁটে ব্যথ্যা লাগবে।’

– ‘তো ব্যথা লাগলে লাগবে। আমি কি পিরিতি দেখিয়ে খাওয়াচ্ছি না-কি?’

পুষ্পিতা বিভ্রান্ত হয়ে ‘হা’ করে। ইমাদ এক লোকমা ভাত মুখে দিল ওর।

– ‘এটুকুতে রিয়েকশন বুঝা যাবে না। পুরো প্লেট খেতে হবে।’

পুষ্পিতা প্লেট টেনে নিয়ে নিজেই খেতে শুরু করে৷ ইমাদ চুপচাপ দর্শকের মতো বসে রইল পাশে৷ খাওয়া শেষে পুষ্পিতা প্লেট ধুয়ে এনে টেবিলে রেখে রুমে চলে যায়৷ ইমাদ অগোচরে মুচকি হেঁসে নিজের প্লেটে খাবার নেয়৷ খাওয়া শেষে সবকিছু রান্নাঘরে রেখে রুমে চলে গেল৷ পুষ্পিতা বিছানায় শুয়ে আছে। সেও নিজের বালিশ এনে বিছানা বিছিয়ে ঘুমিয়ে যায়।

সকাল দশটার দিকে হায়দার সাহেব ঘর থেকে বের হলেন। ইমাদ দোকানে চলে গেছে। ছেলেটা পুষ্পিতাকে পছন্দ করে। তাকে দিয়ে কিছুই হবে না। কিন্তু উনার তো কিছু করতে হবে। পুরোনো অনেক ক্ষ’ত আছে। তিনি নেহাতই ভালো মানুষ তাই কোনোদিন সেসব নিয়ে ভাবেননি। কিন্তু এখন যেহেতু সুযোগ পেয়েছেন। তাহলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন কেন? বিধাতার নিয়মেই এগুলো হচ্ছে, তিনি কেবল ঘটে যাওয়া কাজগুলোর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছেন, এটুকুই। খান বাড়ির মেইন গেইট টেনে খুলে তিনি ভেতরে গেলেন। খান সাহেব টিভির রুমে। হায়দার সাহেব গেলেন সাবিনা বেগমের কাছে। কাজের মেয়েটি উনার মাথা টিপে দিচ্ছে।

– ‘তুমি একটু যাও তো মা। ভাবির লগে আমার কিছু কথা আছে।’

মেয়েটি উঠে চলে গেল। হায়দার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুষ্পিতার মাকে বললেন,

– ‘ভাবি ছেলেটারে বিয়ে দিয়ে তো বোকাই বনে গেছি। ভুল করলাম কি-না সঠিক কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার একটা মাত্র ছেলে। কাজটা কি যে করলাম। তখন তো গরম গরম কারবার হয়ে গিয়েছিল।’

– ‘কি বলেন ভাই, কি সমস্যা হলো আবার?’

– ‘সেরকম কিছু না। বুঝতেই তো পারছেন সমাজ নিয়ে থাকি। নানা লোকে নানান কথা বলে। গতকাল তো দেখলেনই ছেলের মামা-খালা কি কাণ্ডটা না করলো।’

সাবিনা বেগমের মুখটা মলিন হয়ে গেল। তিনি আর কিছু বললেন না। হায়দার সাহেব পুনরায় বললেন,

– ‘ছেলেরও মতি-গতি বুঝতে পারছি না৷ তবুও আমি বাবা হয়ে কম চেষ্টা তদবির করছি না। ছেলের মা নাই৷ সবকিছু তো আর আমি বাবা হয়ে খেয়াল করতে পারি না৷ ওদেরকে আমি খেতে বসলেও পাশাপাশি বসতে বলি। কিন্তু রুমের খবর তো জানি না ভাবি৷ প্রথম রাতে মেয়েকে বের করে দিয়েছিল। আমি নিয়ে দিয়েছি। গতরাতে আবার ঘরেই এসেছে রাত ৩টার দিকে। বুঝতেই তো পারছেন। ওদের মিল মহব্বত আছে বলে মনে হয় না৷ এরকম তো চলে না। তাছাড়া ছেলের রিলেশনও আছে একটা। তাই বাচ্চা-কাচ্চা তাড়াতাড়ি হয়ে গেলে মঙ্গল ছিল। এই যুগের পোলাপান, এখন কথা শুনছে, হঠাৎ পালটে যেতে পারে।’

– ‘এখন কি করবো বলেন ভাই।’

– ‘আজ বিকেলেই ওরা দু’জনকে এখানে পাঠাবো৷ বিয়ের পর তো আসতে হয় এমনিতেই। আপনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করে জানবেন একটু। ওদের মিল-মহব্বত হলো কি-না। তাকে শলা-পরামর্শও দিবেন। কি আর করার, আমরা সবাইই তো এখন বিপদে আছি৷ লজ্জা-শরম রেখে তো আর কাজ হবে না। আমি তো আর বাবা হয়ে ছেলেকে এসব নিয়ে কিছু বলতে পারি না।’

– ‘না না ভাই, আপনি এসব নিয়ে তাকে বেশি কিছু বলবেন না। মনের উপর জোর চলে না৷ দেখা যাক কি হয়।’

– ‘হ্যাঁ, সেটাই। শুধু আপনি সবকিছু খেয়াল করবেন।’

– ‘আচ্ছা ভাই৷ আমি পুষ্পিতার সাথে কথা বলবো।’

হায়দার সাহেব খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেলেন। তিনি নিউজ শুনছেন। কাজের মেয়ে দু’জনকে এনে চা দিয়ে গেল। অনেক্ষণ তাদের গল্প-গুজব হলো। জোহরের আগেই বাড়ি ফিরে এলেন হায়দার সাহেব। ইমাদ তখন বাজার থেকে এসে গোসল করছে৷ তিনি ঘাটে গিয়ে হাত-মুখ ধুতে ধুতে বললেন,

– ‘গোসল করে খেয়ে পুষ্পিতাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যাও বাবা। বিয়ের আড়াইদিন পর তো যেতে হয়। আর ওখানে গিয়ে কারও সঙ্গে এত মেশার দরকার নেই৷ গম্ভীর হয়ে থাকবে। আর সকালে দোকানে চলে যাবে, রাতে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরবে।’

ইমাদ পুকুরে ডুব দিয়ে উঠে বললো,

– ‘ওদের বাড়িতে থাকতে হবে?’

– ‘হ্যাঁ, এখন আমি বাজারে গিয়ে মিষ্টি-টিষ্টি আনি৷ এগুলো নিয়ে যেতে হবে তোমার। নিয়মকানুন তো কিছু মানতে হয়। ওরা তো কিছুই মানলো না।’

– ‘কি মানলো না বাবা?’

– ‘আসবাবপত্র তো দিতে হয় জামাইকে।’

– ‘হুট করে বিয়ে তাই হয়তো দেয়নি।’

– ‘হুট করে কিভাবে। তার তো বিয়ে ছিল সেদিন।’

– ‘সেটা তাদের নিজেদের মাঝে ছিল বাবা।’

– ‘তা বুঝেছি৷ কিন্তু হুট করে বিয়ে হলেও। এখনও তো খবর নেই।’

– ‘এগুলো নিয়ে আমি ভাবছি না।’

হায়দার সাহেব হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এই ব’লদ ছেলেকে দিয়ে কিছুই হবে না৷ তিনি পুষ্পিতাকেও রেডি হতে বলে বাজারের উদ্দেশ্যে বের হলেন।

_চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে