তবু মনে রেখো পর্ব-০৩

0
755

তবু মনে রেখো (৩য় পর্ব)
.
বৃষ্টি ওষুধের মতো তার মন ভালো করে দেয়। পুরুষ মানুষ, তাও আবার গ্রামের। বৃষ্টি নিয়ে যে এই মাতামাতিটা তার সঙ্গে যায় না, ইমাদ এ বিষয়ে অবগত। তাই এই বৃষ্টি উপভোগ সে অনেকটা গোপনেই করে। ইমার কামরা থেকে বের হয়ে ধীর পায়ে বারান্দায় যায়। পলকে শীতল হাওয়া গ্রিলের ফাঁক গলে এসে ভেজা চাদরের মতো তার গায়ে যেন জড়িয়ে গেল। প্রশান্তিতে চোখবুজে আসে ইমাদের। প্রবল বাতাসের সঙ্গে ঝুম বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির গান। বিদ্যুৎ চমকালে উঠোনে দেখা যায় মাটিতে জলের বিন্দু বিন্দু ফোটা পড়ে নৃত্য করছে। অনাবিষ্কৃত কোথাও থেকে লোকালয়ে ভেসে আসছে অচেনা-অজানা এক অদ্ভুত বুনো ঘ্রাণ। ইমাদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো গ্রিলের কাছটায় এগিয়ে যায়। চোখবুজে দু’হাত মেলে দেয় দু’দিকে। নাকে-মুখে এসে আছড়ে পড়ে বৃষ্টির ছাট।

পেছনে ফিক করে হাসির শব্দ শুনে আঁতকে উঠে তাকায় সে৷ অন্ধকারে মানুষের অবয়ব। চিনতে পারে সে ইমাকে। আকাশে বিদুৎ চমকালো তখনই। সেই ধার করা আলোয় ইমার পেছনে দেখা গেল পুষ্পিতাও এসেছে। পরনে কালো সেলোয়ার-কামিজ। মাথার মধ্যখানে ওড়না৷ ইমা এবার হাতের বাতি জ্বালিয়ে বললো,

– ‘মাইয়াদের মতো বৃষ্টি বিলাস তোমার আর গেল না ভাইয়া।’

‘হ্যাঁ সব বিলাস শুধু মেয়েরাই করবে’ বলে ইমাদ ওর মাথায় গাঁট্টা মারার জন্য কেবল হাত তুলেছে৷ পলকে ইমা মাথা সরানোর চেষ্টা করতেই ঢুস লাগলো গিয়ে পুষ্পিতার নিচের ঠোঁটে। অস্ফুটে ‘উফ’ বলে দুইহাতে চেপে ধরে বসে গেল সে। ইমাদ সঙ্গে সঙ্গে পিঠের দিকে বাঁ হাত নিয়ে ‘দেখি কি হয়েছে’ বলে ওর হাত আলগোছে সরিয়ে দেখে মুঠো ভরে গেছে র/ক্তে৷ একবার দাঁত কটমট করে ইমার দিকে তাকায়।

– ‘আমার কি দোষ, তুমিই তো মারতে চাইছিলে।’

ইমাদ আস্তে আস্তে পুষ্পিতাকে টেনে ধরে বললো, ‘বেশি ব্যথা লেগেছে? চলো, ঘরে চলো।’

পুষ্পিতা ঠোঁটে হাত চেপে রেখে দাঁড়ায়। ইমাদ বাঁ হাতে প্যাঁচিয়ে ধরে বললো,

– ‘আসো।’

পুষ্পিতা আদুরে বালিকার মতো গা ঘেঁষে আস্তে আস্তে হাঁটছে। ইমা পিছু পিছু আসে বাতি নিয়ে। করিডর পেরিয়ে রুমে এলো তারা। ইমাদ ওর বাহুতে ধরে রেখে বললো,

– ‘বিছানায় শুয়ে থাকো।’

পুষ্পিতা আস্তে করে বালিশে মাথা রাখে। ইমাদ বোনকে বললো,

– ‘পানি অল্প একটু গরম করে নিয়ে আয়, যা।’

ইমা রান্নাঘরে চলে যায়। ইমাদ শুকনো কাপড়ের টুকরো খুঁজতে গিয়ে সকল রুম তন্নতন্ন করেও পেল না। ভীষণ বিরক্ত হলো, কাজের সময় কোনোকিছু খুঁজে না পাওয়াটাই যেন নিয়ম। ফিরে এসে পুষ্পিতাকে বললো,

– ‘অন্যকারো কাপড় দিয়ে ঠোঁট মুছলে তোমার খারাপ লাগতে পারে৷ ওড়নাটা দাও, একমাথা ভালোভাবে ধুয়ে আনি।’

পুষ্পিতা ঠোঁট ফাঁক রেখে বললো,

– ‘এগুলো লাগবে না, এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে।’

সে নিজেই আস্তে করে টেনে ওড়না হাতে নিল। পুষ্পিতা সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে বালিশ টেনে ঢেকে নিল বুক। ইমাদ ম্লান হেঁসে বাথরুম থেকে ওড়নার একমাথা ভালো করে ধুয়ে নিয়ে আসে।

খানিক পর ইমা এসে বললো,

– ‘পানি গরম হয়ে গেছে।’

– ‘একটা গ্লাসে করে আগে অল্প পানি নিয়ে আয়। কুলি করে নিক আগে৷ এরপর রক্ত মুছা যাবে।’

ইমা ঠান্ডা পানি মিশিয়ে কুসুম গরম জল নিয়ে এলো৷ ইমাদ গ্লাস হাতে নিয়ে বললো,

– ‘পুষ্পিতা এই নাও, মুখে পানি নিয়ে কুলকুচা করো।’

পুষ্পিতা মুখে জল নিল। ইমাদ পালঙ্কের পাশের জানালা খুলে দিয়ে বললো,

– ‘এদিকে পানি ফেলে দাও।’

পুষ্পিতা কুলি করে জানালা দিয়ে পানি ফেলে এলো। ইমাদ বাতি নিয়ে এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলো ঠোঁটের ভেতর দিকে দাঁত লেগে অনেকটাই কেটে গেছে৷ ওড়নার মাথা গরম পানিতে ভিজিয়ে ঠোঁটে লাগাতেই পুষ্পিতা আর্তনাদ করে তার ধরে নিল।

– ‘একটু ধৈর্য ধরো, মুছে নিলে ভালো হবে।’

পুষ্পিতা এবার বিছানা খামচে ধরে চোখবুজে রইল।

ইমাদ রক্ত ভালোভাবে মুছে দিয়ে বললো,

– ‘ঘুমাও এখন, দিনে ডাক্তারকে বলে ওষুধ আনতে হবে।’

ইমা পানি নিয়ে চলে যায়। ইমাদ ওড়না ভালো করে ঝেড়ে-ঝুড়ে আলনায় মেলে দিয়ে দরজা আঁটকে হঠাৎ খেয়াল হলো মেঝেতে আলাদা বিছানা করা এটা ইমা দেখেছে। কি ভাববে কে জানে! এটা নিয়ে এতো না ভেবে মেঝেতে শুয়ে পড়ে সে। পুষ্পিতা আহত ঠোঁট ফাঁক রাখার চেষ্টা করে বললো,

– ‘প্লিজ বিছানায় আসো। আমাকে বিছানায় দিয়ে কেউ মেঝেতে থাকবে, এটা আমার খারাপ লাগছে।

ইমাদ খেয়াল করে দেখলো পুষ্পিতা আজ শুরু থেকেই তার সঙ্গে কোনো বিশেষণ ছাড়া কথা বলছে। আগে তাকে ‘ইমাদ ভাই’ বলেই ডাকতো। এখন হয়তো শুধু ‘ইমাদ’ না-কি ‘ভাই’ লাগিয়ে কথা বলবে দ্বিধায় আছে। সে নিজেকে নির্দয় পুরুষের চরিত্রে ফিরিয়ে এনে বললো,

– ‘ভাববে না আমি গলে গেছি। ইমাদ গলে যাওয়ার পাত্র নয়। যে মেয়ে মা-বাবার মান সম্মান বুঝে না, তার জন্য মন গলার প্রশ্নই আসে না। ঠোঁট কে’টেছে, তাই একটু বাড়তি যত্ন করেছি। রাস্তায় কেউ এক্সি/ডেন্ট করলেও মানুষ এগিয়ে যায়।’

পুষ্পিতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরিয়ে নিল। দু’দিন আগেও এই জীবন কি কল্পনা করেছিল সে? ইমাদকে আগে থেকেই চিনতো। শান্ত-শিষ্ট, ভদ্র, লাজুক ছেলে। কিন্তু ওর স্ত্রী হবে কখনও ভাবেনি। তাকে নিয়ে কখনও সেরকম অনুভূতিই ছিল না। পুষ্পিতা পেছনের সবকিছু ভুলে যেতে চায়। এখন ইমাদকে ঘিরেই একটা পুরো জীবন কাটাতে হবে। তাকে নিয়েই ভাবতে হবে। বিশ্বাসঘা/তক, প্র/তারক পুরুষ থেকে সহজ-সরল ইমাদই কি ভালো নয়? কিন্তু ইমাদ কি আদৌও তাকে মেনে নেবে? সে নিজেই বা কতটুকু মানতে পারছে? তবুও সে সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা করবে মানিয়ে নেয়ার। মা-বাবাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। সেই শিক্ষাটাও পেয়েছে। আর কোনোভাবেই চায় না এমন কিছু হোক। যেভাবেই হোক ইমাদের সকল অপমান-অবহেলা মুখবুজে মেনে নিবে। একদিন হয়তো সেও একটা সুন্দর সংসার গড়ে নিতে পারবে। যা দেখে মা-বাবার ক্ষত সামান্য হলেও সেরে উঠবে। এলোমেলো ভাবনা থেকে ধীরে ধীরে ক্লান্ত বিধ্বস্ত পুষ্পিতা গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

ইমাদ এখনও জেগে আছে। তার ভেতরে কেমন অস্থিরতা। এখনও সে বিশ্বাস করতে পারছে না পুষ্পিতা তার স্ত্রী। তারই সঙ্গে একটা বদ্ধ কামরায় শুয়ে আছে। বাবা সবসময় চাইতেন বন্ধুর মেয়েকে বউ করে আনতে। এটা ছিল তার লাগামহীন আশা। তবুও এটা জানার পর থেকে ইমাদ অবচেতনে পুষ্পিতাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো। গ্রামে ওরা আসছে শুনলে তাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে থাকতো। কিন্তু কখনও ভাবেনি এই ভালো লাগা প্রকাশ করবে। কখনও ভাবেনি এটা তার প্রেম। কখনও ভাবেনি ওকে পেতেই হবে। সে ভেবে নিয়েছিল পুষ্পিতা এক অধরা ভালোবাসা, ভালো লাগা। ও চাদের মতো দূর আকাশে তার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকবে, এটাই বিধাতার বিধি।

অথচ পুষ্পিতা আজ তারই স্ত্রী? কেউ কি জানে? পুষ্পিতার এমন হাজারটা অপরাধ সে ক্ষমা করে দিতে পারে? সে বরং এই দুঃসময়ে পুষ্পিতার পাশে থাকতে পেরে, ওর একটা উপকারে আসতে পারায় মনে হচ্ছে এটাই তার এই জন্মের সবচেয়ে বড়ো তৃপ্তির বিষয়।

ঘরে চার্জার বাতির ক্ষীণ আলো। পুষ্পিতার পরনে কালো সেলোয়ার-কামিজ। ডান হাত লম্বা করে পেটের ওপর দিয়ে কোমরে রাখা। ইমাদ বালিশে মাথা রেখে পালঙ্কের দিকে তাকিয়ে আছে। কি ভীষণ মসৃণ হাত ওর। মোমের মতো কোমল। পুষ্পিতাকে চাইলেই সে এখন স্পর্শ করে দেখতে পারে। তারই বিয়ে করা পত্নী। পুষ্পিতা নিজের দূর্বলতার কারণে বাধ্য হয়ে বিয়ে বসলেও তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। এই অহংকার, আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাস কিছুই এখন আর ওর নেই। তবুও সে এমন করবে না। শুধু বাবার কথা রাখতেও নয়। পুষ্পিতাকে আরও বুঝবে, জানবে, পুষ্পিতাকে সময় দেবে। অতীত ভুলে সে একদিন নিশ্চয় তাকে ভালোবাসবে। এই বিশ্বাস তার আছে। খানিক পর সেও ঘুমিয়ে গেল। রোজকার মতো তার ঘুম ভাঙলো ফজরের আজান শুনে। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে বসে ইমাদ। চার্জার বাতি নিভে গিয়ে ঘরজুড়ে রাজ্যের অন্ধকার। বিদ্যুৎ কি এখনও আসেনি? সে মোবাইলের স্কিনের আলোয় গিয়ে ড্রিম লাইটের সুইচ টিপলো। মিহি আলোয় ভরে গেল কামরা৷ বিছানার দিকে তাকালো সে। পুষ্পিতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার দিকেই পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। ঠোঁট অনেকটাই ফোলা। বালিশ বুকের সঙ্গে চেপে ধরা। এটা যেন তার ওড়নার বিকল্প। কপাল আর গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মুখ ঈষৎ লালচে হয়ে আছে৷ সে ফ্যানের সুইচ টিপে দিল। খোঁপা থেকে দলছুট হওয়া চুলগুলো এবার উড়ছে। একবার কি ছুঁয়ে দেখবে? খুব আদর করে গহিন থেকে হবে সেই ছোঁয়াটা। শুধু কপালে না হয় হাতটা রাখবে? নিজেকে প্রশ্রয় দিল না ইমাদ। ছোঁয়াগুলো তোলা থাকুক, অল্প অল্প করে জমে হোক মিনার। লুঙ্গিটা কোমরে প্যাঁচিয়ে থ্রি কোয়ার্টার খুলে টি-শার্ট পরে নিল সে। পুষ্পিতার যেন ঘুম ভেঙে না যায় তাই ধীরপায়ে টেবিলে রাখা টুপি নিয়ে বের হয়ে গেল মসজিদে।

নামাজ থেকে বের হতেই আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে৷ রাতের নীরবতাকে তাড়িয়ে দিয়ে পাড়ার গৃহস্থালি বাড়িগুলো থেকে মোরগের ডাক ভেসে আসছে। কোথাও কাক যাচ্ছে ‘কা কা’ করে। ইমাদ পুকুরের রাস্তায় খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে এসে ঘাট পাড়ে বসলো। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। এখনও রেষ রয়ে গেছে। আবার উঠোন পেরিয়ে গ্রিলের দরজা খুলে তার রুমে চলে এলো। পুষ্পিতা এখনও ঘুমোচ্ছে। আলগোছে দরজা বন্ধ করে সেও ঘুমিয়ে যায়। সকাল আটটার দিকে দরজায় নক পেয়ে দু’জনই উঠে বসে বিছানায়। পুষ্পিতা উঠে বললো,

– ‘খুলে দিচ্ছি আমি, তুমি ঘুমাও।’

সে হাত ইশারা করে থামিয়ে দিয়ে বালিশ রাখে পালঙ্কে। বিছানা ভাঁজ করে রাখে বালিশের নিচে। তারপর নিজেই দরজা খুলে দেখে ইমার পেছনে পুষ্পিতার মা সাবিনা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। ইমাদ সালাম দিল। তিনি জবাব দিয়ে ভেতরে এলেন। ঘণ্টা খানেক আগে থেকেই এসে অপেক্ষা করছেন সাবিনা বেগম। মেয়ের জন্য মনটা ছটফট করছিল। অপেক্ষায় আছেন দেখে ইমা নিজ থেকেই ডাকতে এলো। রুমে ঢুকেই মেয়ের কাছে এসে ঠোঁট দেখে মুখ মলিন হয়ে গেল সাবিনা বেগমের। আজ বাসর রাত ছিল। তাই মেয়েকে ঠোঁটে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেও দ্বিধায় ভুগছেন। এটা কি তাদের দু’জনের বেসামাল ঝড় তোলা প্রণয়ের ফল? আবার ঠোঁটের অবস্থা দেখে মনে হয় কেউ ঘুসি-টুসি কিছু একটা মেরেছে। তবুও তিনি এ বিষয়টা পুরোপুরি এড়িয়ে গেলেন। জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে বুকে।

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে