তবু ভালো আছি পর্ব-০৭

0
605

#তবু_ভালো_আছি
#রাজেশ্বরী_দাস_রাজী
#পর্ব_৭

বিকেল হয়েছে সবে। মৃন্ময়ের বাবা মাকে স্টেশন অবধি এগিয়ে এসে শ্রুতি, রুশা, মৃন্ময় নিজেদের মাঝে কথা বলছিল। তখনই শ্রেয়া একটা আঁকার খাতা হাতে ছুটে এলো তাদের কাছে। খাতাটা শ্রুতির হাতে দিয়ে উৎসাহিত কণ্ঠে বলল,

“মা মা, এটা দেখো। তোমাদেরকে তো এটা দেখাতেই ভুলে গিয়েছিলাম।”

শ্রুতি খাতাটা হাতে নিলো, সাদা পাতার ওপর রঙ পেনসিল দিয়ে কাঁচা হাতে আঁকা একটা ছবি, ছবিতে দেখা যাচ্ছে শাড়ি পরিহিতা কোনো রমণীর হাত ধরে আছে একটি বাচ্চা মেয়ে। ছবিটা শ্রেয়ার আঁকা, সে যে এই ছবিটাই কাদের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছে সেটাও বেশ বুঝেছে শ্রুতি। মৃন্ময় আর রুশাও ছবিটার দিকে তাকালো। শ্রেয়া আগের ন্যায়ই বলল,

“কালকে স্কুলে ম্যাম আমাদের নিজেদের ফ্যামিলি মেম্বারদের আঁকতে বলেছিলেন, এবং বলেছিলেন সকলকে ফ্যামিলি সম্পর্কে কিছু বলতে। আমি এটা এঁকেছি, ম্যাম আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘একি শুধু তুমি আর মা, বাবা কোথায়?’ আমি আঙুল দিয়ে তোমাকেই দেখিয়েছি। আর কী বলেছি বলো তো?”

শ্রুতি শ্রেয়ার গালে আলতোভাবে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল,

“কী বলেছো মা?”

“আমি বলেছি যে তুমি থাকতে আমার বাবার কোনো প্রয়োজনই নেই, তুমি হলে আমার মা বাবা দুজনই, তুমি একাই একশো, তুমি তো আমার সুপার ওমেন।”

শেষের কথাটা বলে শ্রেয়া খানিকটা লাফিয়েই উঠলো, শ্রুতি শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা ছোট হলেও বুদ্ধিমতী, কীভাবে যেন অনেককিছু বুঝে ফেলে। একটু বুদ্ধি হওয়ার পরেই তার বাবার কথা সে আগে জিজ্ঞাসা করতো, তখন শ্রুতি কী বলবে বুঝতে না পেরে কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো। তবে তারপর তাকে বলা হয়েছিল যে তার বাবা তাদের থেকে আলাদা থাকে, দূরে থাকে, তার সাথে তার বাবার কোনো সম্পর্ক নেই, তার মাই হলো তার মা বাবা দুটোই। সম্পর্কের এত-শত মারপ্যাঁচ তার বোঝার কথা না। কথাটা সে কতটা বুঝেছিল জানা নেই তবে সে আর কথা বাড়ায়নি, মেনে নিয়েছিল যে তার মাই তার বাবা এবং মা, তার মাই তার সব। মৃন্ময় তাদের দুজনের দিকে চেয়ে ছিল এতটা সময়, তাদের দিকে চেয়েই অন্যমনস্ক হয়ে বিড়বিড় করে আপনমনে প্রশান্তির নিঃশ্বাস টেনে বলে ফেলল সে,

“তুমি সত্যিই এখন সবটা একাই সামলে নিতে পারবে শ্রুতি, অবশ্য আগেও পেরেছো। আমার কোনো চিন্তা নেই। এই নিয়ে মনে কোনো দ্বিধাও নেই।”

মৃন্ময়ের ধ্যান ভাঙলো রুশার মৃদু ধাক্কায়। রুশা প্রশ্ন করলো,

“কীরে! কী বিড়বিড় করছিস?”

মৃন্ময় সামান্য হকচকিয়ে উঠলো, বলল,

“না, কিছু না।”

শ্রুতি বিষয়টা লক্ষ্য করেই শুধাল,

“তুমি কি কিছু বলবে মৃন্ময়?”

মৃন্ময় হয়তো কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিক বলে উঠতে পারলো না। বলা ভালো শ্রেয়ার মুখের দিকে চেয়ে এখনই কিছু বলার সাহস যুগিয়ে উঠতে পারলো না সে। বড়দের এইসব কথোপকথনের মাঝেই শ্রেয়া দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালো। সে এখন ঘড়িতে সময় দেখতে শিখেছে। বড় আর ছোট কাঁটা দেখে কিছুটা হিসেব-নিকেশ করে সে এখন সময় বলতে পারে। শ্রেয়া কিছুসময় ঘড়ির দিকে চেয়ে ঘড়ির কাঁটাগুলোকে গভীর পর্যবেক্ষণ করে সময় অনুমান করে মৃন্ময়কে বলল,

“ভালো আঙ্কেল তুমি তো আমাকে বলেছিলে আগের দিন যে আজকে পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাবে। কখন যাবে?”

শ্রুতি বলল,

“আজকে সবাই অনেক টাইয়ার্ড তো, ভালো আঙ্কেলও টাইয়ার্ড। অন্যদিন পার্কে ঘুরতে যাবে শ্রেয়া, আমি তোমায় নিয়ে যাবো, আজকে অযথা জেদ কোরো না।”

শ্রেয়া জেদ করলো না, তবে মন খারাপ করলো। ব্যপারটা তার মুখ দেখেই বোঝা গেলো, মৃন্ময় সাথে সাথেই শ্রেয়াকে কাছে টেনে বলল,

“আরে কীসের টাইয়ার্ড? আমি আমার প্রিন্সেসকে কথা দিয়ে কথা রাখবোনা এমনটা কখনো হয়েছে? আমরা পার্কে যাবো তো ঘুরতে এখনই।”

শ্রেয়ার মুখটা আনন্দে ঝলমল করে উঠলো। শ্রুতি হয়তো সংকোচ বোধ করে কিছু বলতে গেলো, তবে রুশা তাকে বাঁধা দিয়ে বলল,

“থাক না শ্রুতি, বাঁধা দিও না। বাচ্চা মানুষ, শুধু শুধু মন খারাপ করবে। আর ঘুরে এসোই না একটু তোমরা গিয়ে ক্ষতি কী? আমিও তো বেরোবো বাড়ি ফেরার জন্য, একসাথেই বেরোই তবে আমরা? আমি বাড়ির দিকে চলে যাবো, তোমরা পার্কে চলে যেও।”

শ্রুতি উপায়ন্তর না পেয়ে মাথা নেড়ে বলল,

“বেশ ঠিক আছে।”

বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শ্রুতি রুশাকে বলল,

“এখনই চলে যাচ্ছো? আমাদের সাথে একটু ঘুরে এসে তারপরেও তো ফিরতে পারতে।”

রুশা একদফা নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলল,

“না শ্রুতি, আজ নয়। আজকে দেরি হয়ে যাবে, কাজ আছে। আমি তো আসবোই আবার, অন্যদিন একসাথে ঘুরতে যাবো শ্রেয়াকে নিয়ে। কী শ্রেয়া, চলবে তো?”

শ্রেয়া বাধ্য মেয়েটির মতো মাথা দোলালো, রুশা হুট করেই শ্রুতিকে প্রশ্ন করলো,

“তোমার মা বাবা তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল না কিছুদিন আগে? কথা হয়েছে?”

শ্রুতি দরজাটা বাইরে থেকে আটকে রুশার দিকে ঘুরে বলল,

“হ্যাঁ কথা হয়েছে, ক্ষমা চাইছিল তারা সেইসময় আমার পাশে থাকতে পারেনি তাই বা যা যা অন্যায় আমার সাথে তারা করেছে সেগুলোর জন্য। কারোর জন্য নিজের মনে ক্ষোভ পুষে রেখে আমি নিজেকে কেন কষ্ট দেবো বলো? ক্ষমা করে দিয়েছি। তবে বর্তমানে ওদের জন্য আমার মনে তেমন কোনো অনুভূতিই নেই।”

শ্রুতি রুশাকে জড়িয়ে ধরে আবারো বলল,

“রুশা দি থ্যাংক ইউ।”

“কেন?”

রুশার প্রশ্নে শ্রুতি রুশাকে ছেড়ে রুশার দুই হাত ধরে বলল,

“তোমরা আমার জন্য যা যা করেছো সেগুলো কি বলে শেষ করতে পারবো?”

“তুমি যেটা করেছো সেটা নিজের ইচ্ছেশক্তির জোরে করেছো, নিজে করেছো শ্রুতি।”

“যেই সময়ে আমার মা বাবাই আমার পাশে ছিল না, সেই সময়টাই তোমরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলে, তোমাদের সেই অবদান যে আমি কখনো ভুলে যাবো এতটা অকৃতজ্ঞ আমি নই।”

পাশেই শ্রেয়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল মৃন্ময়। রুশা একদফা মৃন্ময়ের দিকে চেয়ে মুখে অভিমানের ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল,

“দেখছিস কেমন আবার এইসব কথা বলা শুরু করেছে? আচ্ছা শ্রুতি, দিদি হয়ে তোমার পাশে থাকতাম না আমি? এটুকু করতাম না বোনের জন্য? তুমি বারবার এমন বললে কিন্তু এবার আমি খুব রাগ করবো, আর আসবোই না বলে দিলাম।”

শ্রুতি মুচকি হেসে বলল,

“তুমি না আসলে আমি তোমার কাছে চলে যাবো। আর এমনিতেও তুমি মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না? এইযে পুচকু দুষ্টুমির ভান্ডারটা, ওকে না দেখে থাকতে পারবে তুমি বেশিদিন?”

রুশা হেসে শ্রেয়ার গাল টেনে বলল,

“দেখছিস তোর মা ঠিক আমার দূর্বলতা বুঝে ফেলে আমার ওপর টর্চার করার ফন্দি আটছে কেমন?”

শ্রেয়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। বাচ্চা মেয়েটাকে হাসলে কতই না স্নিগ্ধ দেখায়! শুধুমাত্র তার এই হাসিতেই যেন ঝলমলিয়ে উঠে আশেপাশের সবকিছু।

.
.

পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে ক্লান্ত সূর্য। এখনো চারিপাশ পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে সূর্যের নিস্তেজ আলোয়। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। পার্কের একটি দোলনায় বসে আছে শ্রেয়া, মৃন্ময় তার পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে দোলাচ্ছে। চারিপাশে আরো কিছু বাচ্চাদের ভিড়, কোথাও বা কোনো কপোত কপোতী হাতে হাত ধরে হাঁটছে, কেউ বা নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা ভাগাভাগি করে নিতে ব্যস্ত।

“তুমি আমাকে গিটার বাজানো শেখাবে ভালো আঙ্কেল প্লীজ? আমিও তোমার মতো গিটার বাজিয়ে সুন্দর করে গান করবো।”

শ্রেয়ার প্রশ্নের উত্তর মৃন্ময় বেশ স্বাভাবিক স্বরেই দিলো,

“আরেকটু বড় হও তারপর শিখবে কেমন?”

শ্রেয়া “ঠিক আছে।” বলে চুপ করে আবারো বলল,

“আচ্ছা ভালো আঙ্কেল, তুমি আর মা তো একে-অপরকে সেই স্কুল লাইফ থেকে চেনো। তারমানে তো তোমরা অনেক ভালো বন্ধু তাইনা?”

মৃন্ময় একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ফেলে ছোট্ট করে উত্তর দিলো,

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা মা কি তখন খুব কাঁদুনে ছিল যেমন অন্যান্য কিছু বাচ্চারা হয়, কথায় কথায় ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে বসতো? নাকি তখনো রাগী টিচার টাইপ ছিল, একটু এদিক ওদিক হলেই পিঠে দুমদাম বসিয়ে দিতো?”

শ্রেয়ার এমন প্রশ্নে মৃন্ময় হেসে ফেলল, শ্রেয়ার দিকে ঝুঁকে মজার সুর টেনেই বলল,

“আগের কথা তো জানি না কিন্তু তোমার এইসব কথা শুনলে তোমার মাম্মা এখন এসে আমাদের দুজনের পিঠে দুমদাম বসিয়ে দিতে পারে।”

শ্রেয়া প্রচন্ড আগ্রহ দেখিয়ে বলল,

“উফ বলো না মা কেমন ছিল? কাঁদুনে নাকি ব্রেভ নাকি ভীতু?”

“সে প্রচন্ড সাহসী ছিল, ঠিক যেমন সে এখন। ভীতু তো আসলে আমিই ছিলাম।”

শেষের কথাটা বলার সময় মৃন্ময়ের মুখটা সামান্য মলিন দেখালো।

“তুমি ভীতু ছিলে? সত্যিই? আর মা প্রচন্ড ব্রেভ গার্ল ছিল, একদম আমার মতোই ব্রেভ?”

শ্রেয়ার কৌতূহলী কথায় হেসে ফেলে মৃন্ময় বলল,

“হ্যাঁ, একদম তোমার মতোই ব্রেভ।”

তাদের কথার মাঝেই শ্রুতি এসে উপস্থিত হলো সেখানে। ভ্রু উঁচিয়ে তাদেরকে প্রশ্ন করলো সে,

“কী ব্যাপার? কী কথা চলছে?”

শ্রেয়া আর মৃন্ময় একে অপরের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আবার শ্রুতির দিকে তাকালো। দুজনেই ঘাড় মৃদু উঁচিয়ে বলল,

“কোই? কিছুই তো না।”

শ্রুতি সরু চোখে তাকালো তাদের দিকে, তারা হেসে উঠলে শ্রুতিও সেটা দেখে দুদিকে সামান্য মাথা নাড়িয়ে হাসলো মৃদু। পার্কে আর কিছুটা সময় থেকেই বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়ালো তারা। আসার সময় পাশেই পার্কে এক ব্যক্তির ওপর চোখ পড়লো শ্রুতির। ব্যক্তিটা রণজয়, রণজয়ও তাকালো শ্রুতিদের দিকে, পাশে শ্রেয়া আর মৃন্ময়ের দিকেও তাকালো সে ঠিকই। ছোট্ট শ্রেয়ার দিকে চোখ পড়তে মুখে কেমন যেন বিরসতা ফুটে উঠলো তার। হয়তো এতো বছর পরে নিজের মনে মনে সামান্য হলেও অনুতাপ অনুভব করলো সে। তবে এর ব্যতীত আর কোনো ঘটনাই ঘটলো না। শ্রুতি সামনের দিকে চেয়ে শ্রেয়ার হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে হেঁটে বাইরে চলে এলো। রণজয়ের সাথে একটা মেয়ে ছিল, মেয়েটা খুব সম্ভবত রণজয়ের বর্তমান স্ত্রী। তবে মেয়েটা অদিতি নয়, শুনেছিল অদিতির সাথে তার সম্পর্কটাও নাকি খুব বেশিদিন টেকেনি। শ্রুতি আর রণজয়ের ডিভোর্সের পর পরই তাদেরও সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল, ভেঙেছিল অদিতিই তাও আবার অন্য কোনো পুরুষের জন্য, আর তারপর? তারপর শোনা গিয়েছিল সেই পুরুষের চক্করেই কী একটা যেন অপরাধে যুক্ত থাকার কারণে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল অদিতিকে। ব্যপারগুলো হাস্যকর শোনালেও সত্যি। এটাকেই বোধ হয় বলে রিভেঞ্জ অফ নেচার! সে যা হোক, পরে হয়তো সেই মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল রণজয়। হতেও পারে আবার নাও, তবে এইসব জানার কৌতুহল অবশ্য শ্রুতির এখন নেই, আর না তাদের নিয়ে ভাববার ইচ্ছে তার আছে। শ্রুতির ভাবনা এখন কেবল নিজেদের মাঝেই সীমাবদ্ধ, নিজের এবং নিজের সন্তানের ভালো থাকার মাঝে।

চলবে,…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে