#তবুও_মনে_রেখো।[০৪]
৯,
গ্রীন ভিলেজ রেস্টুরেন্ট এর সামনে অনেকক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছে রাহনাফ। পরনে তার হোয়াইট জিন্স আর ব্লু পাঞ্জাবি হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার প্রিয়তমার। প্রায় কুড়ি মিনিট পর একটা রিক্সায় করে মেহেরকে আসতে দেখা গেল। রহনাফ এগিয়ে যায় সেই দিকে। রাহনাফ রিক্সার কাছাকাছি আসতেই মেহের রিক্সা থামাতে বলে। রিক্সা থেমে যায়। রাহনাফ মেহেরের হাতে ফুলগুলো দিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় মেহেরের দিকে। মেহের রাহনাফের হাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার হাত বাড়িয়ে দেয়। রাহনাফের হাতে হাত রেখে রিক্সা থেকে নামে মেহের। মেহেরকে ছেড়ে রিক্সার বাড়া দেয় রাহনাফ। মেহের তখন অবাক হয়ে তাকায় রাহনাফের দিকে। রিক্সা চলে যেতেই রাহনাফ মেহেরকে বলে,
” চলুন ভিতরে যাই।”
মেহের মাথা নাড়ালো। অতঃপর দুজনে ভিতরে গিয়ে বসলো। ওয়েটার ডেকে খাবার অর্ডার করা হলো। তারপর দুজনে চুপচাপ বসে রইলো। রাহনাফ আড় চোখে মেহেরকে দেখে মুগ্ধ। মনে মনে বলল,
“প্রেয়সীর রূপের আগুন ঢাকার জন্য হলেও কালো শাড়ির আবরন প্রয়োজন। না হলে প্রেমিক হৃদয় দহনে পুড়ে যাবে।”
রাহনাফের দেওয়া ফুলগুলো নাড়াচাড়া করে মেহের। রাহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
” আপনার লাল গোলাপ পছন্দ?”
” হ্যাঁ। কেন?”
” আমার কিন্তু কালো গোলাপ পছন্দ।”
” কালো আমার বরাবরই অপছন্দ। তবে আজ ভালো লাগছে।”
মেহের পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রাহনাফের দিকে। রাহনাফ মৃদু হেসে মাথা চুলকালো।
মেহের সেদিন বাড়ি ফিরে সোজা রুপা রুমে যায়। রুপা তখন বিছানায় বসে ডাইরির পাতায় কলমের আচড় আটছিলো। মেহেরকে দেখে একগাল হাসে রুপা ডাইরি রেখে বলে,
” খুব সুন্দর লাগছে তোকে মেহু।”
মেহের রুপার পাশে গিয়ে বসে। বলে,
” মামাকে মিছ করছো?”
” না।” অকপটে জবাব দেয় রুপা।”
” তাহলে ডাইরিতে কি লেখছিলে এতক্ষণ?”
” সে সব তো একান্ত আমার মনের অনুভূতি।”
“তোমার সব অনুভূতি তো মামাকে ঘিরেই।”
রুপা কিছু বলল না। এটা সত্যি যে তার সব অনুভূতিই তার খাইরুল ভাইকে নিয়ে। যখন থেকে রুপা বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই খাইরুলকে নিয়ে তার এই অনুভূতি। খাইরুলের অনুপস্থিতিতেই এই অনুভূতিগুলো বেড়ে উঠেছে। তবে এখন মনে হচ্ছে প্রথম যেদিন খাইরুলের প্রতি অনুভূতি বুঝতে পারলো তখনি এগুলো পিষিয়ে মেরে ফেলা উচিৎ ছিলো তাহলে হয়তো এতটা কষ্ট তাকে পেতে হতো না। না চাইতেও আজ মন হিসাব কষে এত এত ভালোবাসার পরেও মন কি পেলো শুধু মাত্র অপেক্ষা ছাড়া। কষ্ট হয় রুপার। মনে হয় কেউ হৃদয়টাকে ছুড়ির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করছে আর সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বুকের ভিতরটায় কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নেয় রুপা। অধরে ফুটায় নকল হাসি। ডানহাতে মেহেরের গাল টেনে বলে,
” কেমন কাটলো প্রথম ডেট? ”
“ডেট!” এটা ডেট ছিলো? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মেহের।
রুপা হাসে। বলে,
” এত অবাক হচ্ছিস কেন? একটা সাধারণ ডেট নিয়ে।”
বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে যাওয় ডেটে যাওয়া এসব নিয়ে কোনদিনও মাথা ঘামায়নি মেহের। তবে মৌকে দেখেছে আলিহানের সাথে যখন প্রথম ডেটএ গেলো তখন যে কতটা এক্সসাইটেড ছিলো ফিরে এসে কতশত গল্প বলেছে তাদের প্রথম ডেট নিয়ে। তবে মেহেরের প্রথম ডেট এমন হবে এটা কি কখনো ভেবেছিলো সে। রুপার দিকে অসহায় মুখ করে বলল,
” এই সাধারণ ডেটটাই আমার জিবনে প্রথমবার খালা।”
” কেমন কাটলো তোর প্রথম ডেট?” রুপার ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে প্রশ্ন করলো মৌ। রুপা আর মেহের দুজনে মৌয়ের দিকে তাকায়। মৌ দরজায় হেলান দিয়ে বুকের উপর হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেরের চোখে চোখ পড়তেই একগাল হাসে মৌ। রুমের ভিতরে এসে মেহেরকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” বলনা বল কেমন দেখলি রাহনাফকে?”
মাথা নিচু করে নেয় মেহের। মৌ মেহেরকে ছেড়ে রুপার পাশে গিয়ে বসে। রুপা মেহেরের হাত ধরে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় মেহেরের মুখের দিকে। বলে,
” কিসের ভয় পাচ্ছিস মেহু।”
আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দেয় মেহের। রুপা মেহেরের দুইগালে হাত রেখে বলে,
” কাঁদছিস কেন মেহু। রাহনাফ তোকে কিছু বলেছে? বল আমাকে।”
মেহের অশ্রুসিক্ত নয়নে রুপার দিকে তাকিয়ে বলে,
” আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি খালা। আমার এতদিনের কঠোর মন ক্ষনিকের মধ্যেই দুর্বল হয়ে গেলো। প্রেম ভালোবাসা বিয়ে থেকে দূরে থাকবো বলে জিবনে কোনদিন কোন ছেলের সাথে মিশি নাই। এখনো পর্যন্ত আমার কোন ছেলে বন্ধু নাই। সেই স্কুল জিবন থেকে বাশার আমার পিছু ঘুরছে। কলেজে যাওয়ার সময় গলির মোরে ছেলেরা আমার অপেক্ষা করতো কোনদিন কাউকে পাত্তা দেইনি অথচ মাত্র কয়েকদিনের চেনা একটা ছেলের প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম।”
” কার কথা বলছিস তুই? কোন ছেলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছিস? ” প্রশ্ন করলো মৌ।
মেহের চোখ বন্ধ করলো। চোখের কোল বেয়ে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। দুঠোট কামড়ে ধরে অস্ফুটভাবে উচ্চারিত করলো সেই নাম,
” রাহনাফ।”
রুপা আর মৌ দুজনেই হাসলো। তাদের হাসির ঝলকে মুখরিত হলো পুরো রুম। সেই হাসির শব্দ শুনে সৈয়দা মাহবুবাও চলে এলেন রুপার ঘরের সামনে। দরজায় হেলান দিয়ে দৃষ্টি রাখলেন মেহেরের মুখের দিকে। রুপা বলল,
” বেশ তো। এখন দুর্বল কিছুদিন পর ভালোবাসবি।”
” ভালোবাসতে যে বড্ড ভয় হয় আমার।”
” কিসের এত ভয় তোর?”
মেহের চোখ তুলে তাকালো রুপার দিকে। সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রুপার বুকটা ধুক করে উঠলো। তার চোখের ভাষা স্পষ্ট। মেহেরের কেন এত ভয় বুঝতে অসুবিধা হলো না রুপার। চোখ বন্ধকরে নেয় রুপা। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে মেহেরের চোখে চোখ রেখে বলল,
” সব ছেলেরা এক হয়না মেহু। দুলাভাইয়ের সাথে সবার তুলনা করিস না। ভালোবাসা অনেক শক্তিশালী একটা শব্দ। এখানে না কোন কম্পিটিশন চলে আর না কম্পায়ার। বিশ্বাস সম্মান দায়িত্ব কর্তব্য দিয়ে ভালোবাসা অর্জন করতে হয়। ভালোবাসা যদি নাই থাকতো তাহলে চারিদিকে এত এত ভালোবাসার মানুষ থাকতো না। এমনও প্রেমিকযুগল আছে যারা সব সুখের বিনিময়ে শুধু প্রিয় মানুষটাকে কাছে যায়। আপাকেই দেখনা, দুলাভাই চলে গেছে কত বছর হলো আপাকি কারো সাথে ঘর বাধতে পেরেছে। পারেনাই। কেন জানিস? কারন আপা দুলাভাইকে সত্যি ভালোবাসেছিলো। আজও তাকে ভালোবাসে তাই নতুন করে কারো সাথে ঘর বাধতে পারেনি। ভালোবাসায় কোন এক্সপেকটেশন রাখতে নেই। শুধু নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসো। মন প্রান উজার করে ভালোবাসো। সে তোমাকে নাইবা ভালোবাসলো। পৃথীবির সব পথে গন্তব্য থাকে না সব অংকের পূর্ণ সংখ্যার উত্তর থাকেনা।
মৌ আর মেহের দুজনেই অবাক হয়ে রুপার কথা শুনলো। রুপার চোখও জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁট কামড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রুপা তারপর বলল,
“ভালোবাসার মতো সুন্দর অনুভূতি আর একটাও নেই। অথচ দেখো, ভালোবেসেই মানুষ নিঃস্ব হয়েছে, ভালোবেসেই মানুষ আত্মসম্মান হারিয়েছে, ভালোবেসেই মানুষ প্রতারিত হয়েছে, ভালোবেসেই মানুষ সব থেকে বেশি একা হয়েছে। ভালোবাসা জীবনে যা দেয়,তার থেকে অনেক বেশি নেয়। তারপরেও মানুষ ভালোবাসে,কাছে আসে, এক সাথে থাকে, ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও তার স্মৃতি নিয়ে বাঁচে। মানুষ সব থেকে বেশি নির্লজ্জ হয়েছে ভালোবেসেই। তারপরেও কিন্তু মানুষ ভালোবেসেই বাঁচার রাস্তা খোঁজে। ”
সৈয়দা মাহবুবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছেন। চোখের সামনে ভেসে উঠছে নওশাদের মুখ। মনে পড়ছে নওশাদের সাথে কাটানো মুহূর্ত। মুখে যতই বলুক নওশাদকে তিনি ভুলে গেছেন তাকে ছাড়া ভালো আছেন আসলে কি সৈয়দা মাহবুবা ভুলতে পেরেছেন নওশাদকে। হোক ভালোবাসা কিংবা ঘৃনার জন্যে মনে তো পড়ে নওশাদকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাতের উল্টোপিঠে চোখের জল মুছেন সৈয়দা মাহবুবা। ধীর পায়ে চলে যান সেখান থেকে।
আমাদের মেয়েদের কত শত ইচ্ছা যে মনের গহ্বরে চাপা পড়ে থাকে তার হিসাব নেই। আমরা অভিমান করেও অনেক সময় তা প্রকাশিত হতে দিইনা। এমনকি নিজেরাই নিজেদের মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে নিজেদের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখি। একসময় সবশেষ হয়ে যায়, তখন নিরুপায় হয়ে আবার নিজেদের মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে নিজেদের দুঃখ ভোলার নাটক করি। কিন্তু প্রতিবাদ করে সঠিক সময়ে নিজেদের মনের ইচ্ছাগুলো প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করি না সমাজ আত্মীয় পরিজনের চাপে।মৌ মেহেরের চোখের জল মুছে বলে,
” কাঁদিস না বোন। হয়তো এটা হওয়ারই ছিলো। রাহনাফের সাথে তুই খুব ভালো থাকবি দেখেনিস।”
মেহের ভেবেছিল রাহনাফের প্রতি তার দুর্বলতা ক্ষনিকের। তাই যতটা সম্ভব নিজেকে রাহনাফের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতো। তবে রাহনাফের কেয়ার দায়িত্ববোধ মেহেরকে বাধ্যকরে ভালোবাসতে। এখন রোজ রাতে নিয়মকরে তাদের কথা হয়। মাঝে মাঝে দূরে কোথাও যাওয়া হয়। চাঁদনী রাতে কিংবা বৃষ্টিভেজা দুপুরে তাদের কথার ফুয়ারা যেন শেষই হয়না।
১০,
রাত এগারোটা।পুরো শহর ঘুমে নিস্তব্ধ। সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত ব্যাস্ত শহর। ফাঁকা রাস্তায় মাঝে মাঝে দুএকটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে। আকাশে রুটির মতো গোলাকার চাঁদ তাকে ঘিরে হাজারো তারার মেলা। বারান্দায় বসে অফিসের কাজ করছে রাহনাফ। কোলের উপর ল্যাপটপ সামনেই সেন্টার টেবিলে মোবাইল মাউস আর এক কাপ কফি। একমনে ল্যাপটপে কিছু টাইপিং করছে রাহনাফ । চাঁদের জোৎস্নায় রাহনাফের মুখটা আরো সিগ্ধ লাগছে। বামহাতে কফির মগ ধরে দুই ঠোঁটে মাঝে বসিয়ে দিলো। কফির মগে চুমুক দিয়ে সেটা আবার সেন্টার টেবিলে রাখলো। ল্যাপটপে দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ল্যাপটপ বন্ধকরে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে উঠে দাঁড়ালো। টাওজারের পকেটে দুহাত রেখে তাকিয়ে রইলো তারাভরা আকাশের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সেন্টার টেবিল থেকে মোবাইল নিয়ে কল করলো মেহেরের নাম্বারে। দুইবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করলো মেহের। বলল,
” সরি, একটু ব্যাস্ত ছিলাম।”
” কি করছো?”
” একটা স্পিচ তৈরী করছিলাম।”
” আচ্ছা, তাহলে পরে কল করছি।”
” না না। আমার শেষ হয়েছে। ”
” ও আচ্ছা ।”
এরপর দুজনেই নিরব। শুধু একে অপরকে অনুভব করায় ব্যাস্ত। কিছুক্ষণ পর রাহনাফ বলল,
” কাল কি আমাদের দেখা হচ্ছে।”
” না হচ্ছে না।”
” কেন?” চোখ বন্ধকরে বড় করে শ্বাস নিলো রাহনাফ।
” ভার্সিটিতে যেতে হবে তারপর ডিবেট ক্লাবে বিকালের দিকে মাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যেতে হবে। মোট কথা কাল দেখা হচ্ছে না।”
” আমার কথাটা একটু ভাবুন লেখিকা সাহেবা। আপনার ভালোবাসার অভাবে শুকিয়ে রুক্ষ মরুভূমি হয়ে যাচ্ছি আমি সে খবর কি রাখেন।”
রাহনাফের কথা শুনে মেহের হাসলো। রাহনাফ যেন চোখের সামনে মেহেরের হাসিমুখটা দেখতে পেলো। ডানহাতটা বুকের বা পাশে রেখে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। বলল,
” এভাবে হাসবেন না লেখিকা সাহেবা। আমি যে খুন হয়ে যাবো।”
শব্দকরে হাসলো মেহের। বলল,
” আচ্ছা তাই বুঝি।”
” হ্যাঁ তাই।
রাহনাফ ও আলিহানের বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিলো ওদের দুই ভাইয়ের বিয়ে একসাথে দিবেন কিন্তু এতে বাধ সাধে মেহের। এই মুহূর্তে সে কিছুতেই বিয়ের জন্যে প্রস্তুত নয়। তাই আলিহান ও মৌয়ের বিয়ের দিন রাহনাফ আর মেহেরের রেজিট্রি করে রাখা হলো। মেহেরের পড়াশুনা শেষ হলে ওদের বিয়েটা সামাজিক ভাবে স্বীকৃতি পাবে। মৌ বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি চলে যায়। এবাড়িতে এখন শুধু সৈয়দা মাহবুবা রুপা আর মেহের। মেহের এখন পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত সময় পাড় করছে মাঝে মাঝে দু একটা ছোট গল্প লেখে পাঠিয়ে দেয় বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলের ফেসবুক পেইজে সেগুলো আবার নিউজ পেপারে ছাপা হয়। রুপার জিবনটা সেই আগের নিয়মেই চলছে। বাড়ি কলেজ আর অপেক্ষা। তার এই অপেক্ষার অবসান কবে ঘুচবে জানে না। তবে কিছুদিন আগে খাইরুল ভাই ফোন করে ছিলেন রুপাকে। সেদিন তিনি বড্ড খুশি ছিলেন। তার গলার স্বরে যেমন উৎফুল্লতা ছিলো তেমনি ছিলো আকুলতা। আকুল কন্ঠে সেদিন বলেছিলেন,
” অনেক তো অপেক্ষা করলি রুপা। আর মাত্র দুটো মাস অপেক্ষা কর তারপরেই আমি ফিরে আসবো।”
রুপা সেদিন কোন কথা বলেনি। খাইরুল মামুনের কথা শুনছিলো আর নিরবে চোখের জল ফেলছিলো। তার সাজানো স্বপ্ন গুলো মুঠোবন্ধি বালির মতো ঝড়ে পড়েছিলো সেই স্বপ্নগুলো আবার ধুলিঝড়ের মতো ফিরে আসছে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলো না রুপার। রুপার ভারি নিশ্বাসের শব্দ শুনে খাইরুল মামুন বলেছিলেন,
” কাঁদিস না রুপা। আজ আমার খুব খুশির দিন। এতদিন ধরে যে এনএম ট্রি নিয়ে রিসার্চ করছিলাম আজ সেটা নাসায় পাড়িয়েছি। নাসার বিজ্ঞানীরা সেগুলোর বিভিন্ন পরিক্ষা করার পর পৃথীবির উপর এপ্ল্যাই করবে। তারপরেই আমার সাকসেস। বিজ্ঞানীদের নামের তালিকায় আমার নামটাও দেখা যাবে। আমার এই সাকসেসের দিনে তুই কাঁদবি। তুই কাঁদলে আমার বুকটা যে ভারি হয়ে উঠেরে রুপা। ”
সেদিনই ছিলো রুপাকে দেওয়া খাইরুল মামুনের শেষ কল। আজ প্রায় দু সপ্তাহ হলো রুপা তার খাইরুল ভাইয়ের কোন খবর জানেনা। গায়ের কম্বল সড়িয়ে উঠে বসলো রুপা। বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। প্রতিটা সকাল জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। রাত্রির নিস্তব্ধতাকে কাটিয়ে শুরু হয় ব্যাস্ত জীবনের আরও একটি নতুন দিন। ঋতু বিশেষে সকালের পরিবেশটা হয় ভিন্ন। শীতের সকাল বললেই প্রকৃতির রূপের এক অন্য চিত্র ভেসে উঠে আমাদের কল্পনায়।হেমন্তের অন্তে শীতের কোমল ছোয়া লাগে সর্বত্র। পৌষ, মাঘ মাসে কয়েকদিনের জন্য শীতের প্রবল প্রকোপ পড়ে, আর সেটার টের পায় আমরা শীতের সকালে। শীতের সকাল থাকে শীত এবং কুয়াশার চাদরে ঢাকা। সবকিছু খুব ঘোলা দেখায়। ঘাস ভেজা থাকে শিশিরে। সূর্য উঠলে শিশির ফোঁটা মুক্তোর মতো ঝরঝরে হয়। প্রাণীগুলিও অসহায় হয়ে পড়ে। তারা নিজেকে ঘরের কোণে লুকিয়ে রাখে এবং বাইরের ঠাণ্ডা থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা। গায়ে চাদর জড়িয়ে দূর আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখলো রুপা। এখনো সূর্যিমামার দেখা নাই। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পুরো শহর।
১১,
বেলকনি ছেড়ে নিজের রুমে আসলেন সৈয়দা মাহবুবা। মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে তার। সারারাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়ে দিয়েছেন রাতটা। রাতে ঠিকমতো ঘুম না হওয়ার কারনে শরীরটাও ক্লান্ত লাগছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন সৈয়দা মাহবুবা। চোখদুটো বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুরনো দিনের কথা। টাংগাইল শহরের দক্ষিণে এক মাধ্য গ্রামে থাকতো মাহবুবারা। ভৌগলিক অবস্থানের দিকে থেকে বাংলাদেশ ছোট্ট একটা দেশ। এই দেশের অভ্যন্তরের ছোট্ট একটি শহর টাংগাইল। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য টাংগাইলকে এক বিশেষ ঐশ্বর্য দান করেছে। উত্তর ও পূর্বে প্রাচীন লালমাটির উঁচু ভূমির ধ্যানমগ্ন পাহাড়। তার মধ্যে নানা উপজাতি লোকের বিচিত্র জীবন যাপন, গজারী, গামার, কড়ি, মেহগনি বৃক্ষরাজির সারি অনন্তকাল যাবত নামাজের জামায়াতে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে সমতল ভূমি, তার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ছোট ছোট আঁকা বাঁকা নদী। পশ্চিমদিকে দুরন্ত যৌবনা বিশাল যমুনা নদী। নদীর মধ্যে মধ্যে অসংখ্য নতুন নতুন চর। চর তো নয় যেনো দুধের সর। সেখানে কূলে কূলে শিশুদের খেলা ঘরের মতো নিত্য নতুন ঘরবাড়ি নতুন জীবন। এ যেনো প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে বিজয়ী মানুষের উড্ডীন রাঙা পতাকা। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে একটা ছোট্ট গ্রাম এই গ্রামেই অবস্থিত একটা জমিদার বাড়ি। সময়ানুক্রমিক ও বংশপরম্পরায় এখনো টিকে আছে এই জমিদার বাড়ি। তবে এতে ছোঁয়া পেয়েছে আধুনিকতার। সেই সাথে পেয়েছে নগরের ছোঁয়া। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই এখানে গড়ে উঠেছে স্কুল কলেজ হসপিটাল মসজিদ মন্দির। এখানকার তাঁতের শাড়ি দেশ বিদেশে সনামধন্য। জমিদার বাড়ির কর্তা গ্রাম বাসির কাছে বড়বাবু আর কর্তাগিন্নি রানিমা। বড় বাবু আর রাণীমার চার সন্তান। এক মেয়ে আর তিন ছেলে। তিন ছেলের পর যখন কন্যা সন্তানের জন্ম হলো বড় সাহেব আদর করে তার নাম রাখলেন মাহবুবা। নামের মতোই অতি প্রিয় আদরে ছিলো মাহবুবা তার কাছে। মাহবুবার জন্মের পর সাতদিন জমিদার বাড়িতে খাওয়া দাওয়াত আয়োজন চলল। গ্রামের যত গরীব দুঃখী ছিলো বড় সাহেব তাদের সকলকে নতুন জামা কাপড় কিনে দিলেন। জমিদার বাড়িতে আয়োজন করা হলো যাত্রা পালা বিভিন্ন ধরনের নাটক ও সার্কেস খেলার। পুরো গ্রাম জুড়ে আনন্দে মেতে উঠেছিলো। বড় বাবুর খুব আদরের মেয়ে ছিলো মাহবুবা। স্কুলে পড়ার সময় শাকিলা ও রবিনের সাথে বন্ধুত্ব হয় তার। তাদের বন্ধুত্বটা ছিলো অন্তরের। তিনটি দেহে একটি প্রাণ। বন্ধুদের সাথে হাসি আনন্দ হৈ হৈল্লুর করে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠে মাহবুবা। কুমারী মাহবুবা একদিন বন্ধুদের সাথে মেলায় যায় পাশের গ্রামে। সেদিন সেই মেলায় এক সুদর্শন যুবককে প্রথম দেখায় নিজের মন দিয়ে বসে মাহবুবা। ধীরে ধীরে প্রণয়ের বাধা পরে দুজনে। তাদের এই প্রণয় থেকে পরিণয়ে পরিণত হতে বেশী সময় লাগে না। বড় বাবুর আদরের কন্যা ছিলো মাহবুবা তাই বড় বাবু তাদের সম্পর্কটা মেনে নেয়। নওশাদের নামে নিজের দুটো কাপড়ের দোকান লিখে দেন তারপর ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে হাড়ি পাতিল সব দিয়ে দেন মাহবুবার শ্বশুর ঘরে। বড়বাবু যখন মাহবুবাকে শ্বশুর ঘরে পাঠালেন তখন মনে হলো কেউ বুকের ভিতর থেকে হৃদপিন্ডটা বের করে নিয়েছে। তবে কে জানতো বিয়ের চার বছরের মাথায় মাহবুবা আবার তার কাছেই ফিরে আসবে। আসলে মানুষ অতি সহজে যে জিনিসগুলো পেয়ে যায় সেগুলোর প্রতি মানুষের গুরুত্ব কম থাকে। সুখেই কাটছিলো মাহবুবা আর নওশাদের বিবাহিত জিবন। মাহবুবা যেদিন জানতে পারলো তার গর্ভে একটা প্রাণ আছে তার শরীরে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে একটা ছোট্ট প্রাণ বেড়ে উঠছে সেদিন শহর থেকে নওশাদের এক বন্ধু আসে তার নতুন বিবাহিত বউকে নিয়ে। সেদিনই বোধহয় মাহবুবার প্রতি নওশাদের অবহেলার বীজ রোপন হয়েছিলো। অবহেলা থেকেই জন্ম নেয় অভিমানের তারপর বিচ্ছেদ। নওশাদের এই অবহেলার মাহবুবার মনে একটু একটু করে অভিমানের পাহাড় তৈরী করে। একটা সময় তাদের মধ্যে অনেকটা দূরত্ব তৈরী হয়। প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো সাথে তেমন কথা বলতো না। তারপর একদিন হঠাৎ করেই সবটা এলোমেলো হয়ে যায়। নওশাদ তার বন্ধুর বউয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। খবরটা শুনার পর মাহবুবা স্তব্ধ পাথর হয়ে যা। কত চোখের জল বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তুতা ফিরে আসেনি নওশাদ তার কাছে। তার কিছুদিন পর মাহবুবা তার নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। পরিবারের কেউ কিছু না বললেও সমাজের মানুষ তাকে নিয়ে নানা কথা রটিয়েছে। অপমান করেছে লাঞ্ছনা দিয়েছে। সকলের সব অপবাদ সহ্য করে নিয়েছে মাহবুবা। মেহেরের জন্মের পর নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারপর একদিন মেহের আর মৌকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমায় শহরের বুকে। মেহেরের জন্ম থেকে শহরের আসার প্রতিটা সময়ে মাহবুবার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন বড়বাবু। কখনো আর্থিক অনটনে পরতে হয়নি। সচ্ছলভাবে দুই মেয়েকে নিয়ে কাটিয়েছেন জিবন তবুও মাঝে মাঝে মন গভীরের থেকে কেউ যেন বলে উঠে ‘ নওশাদ’ যদি পাশে থাকতো। পরক্ষনেই নিজের মনকে ধমকে দেন। এতকিছুর পরেও কি করে তিনি নওশাদের সঙ্গ পাওয়ার ইচ্ছা করেন। দুচোখের কোল গড়িয়ে অশ্রু পড়তে লাগতো। নাক টেনে লম্বাশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন
“ভালোবাসার বিপরীতে সব সময় ঘৃণা থাকে না,থাকে অবহেলা।এই অবহেলাতেই মানুষ মরে। ধ্বংস হয়ে যায়।”
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা আফরিন শিখা