#তবুও_মনে_রেখো।[০৩]
৬,
চাকরির ইন্টার্ভিউ দিয়ে বাড়ি ফিরছে রাহনাফ। হাতে একটা ফাইল যার ভিতরে ওর শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমান। মানে সার্টিফিকেট। এই নিয়ে চারটা ইন্টার্ভিউ দেওয়া হলো। ডানহাতে গলার টাইটা একটু আলগা করে নিলো। আজকের আবহাওয়া বেশ থমথমে। আকাশে রোদের দেখা না থাকলেও গরম পড়েছে বেশ ভালোই। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে লম্বাশ্বাস নিলো রাহনাফ। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় বিশ মিনিট অতিবাহিত
হওয়ার পরেও কোন রিক্সা পেল না। তাই ধীর পায়ে হাটতে লাগলো। কিছুদূর আসার পরেই পরিচিত একটা মুখ দেখে দাঁড়িয়ে পরে রাহনাফ। মৃদু হেসে এগিয়ে গেলো তার কাছে।
ডিবেট ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহের। ছোটবেলা থেকেই যেকোন ডিবেটে অংশগ্রহণ করে সে। জিতেছে অনেক পুরষ্কার। পেয়েছে জাতীয় খ্যাতি। তাই ক্লাবে যে কোন ডিবেট প্রতিযোগীতার আগে তার ডাক পরে। আজও এসেছিলো তার জন্যেই। সামনেই জাতীয় স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগীতা তাই ক্লাব থেকে তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাস্তার এপাশ ওপাশ দেখতে লাগলো মেহের। তখন তার চোখ আটকে যায় রাহনাফের দিকে। রাহনাফ হাসি মুখে তার দিকে এগিয়ে আসছে। রাহনাফ মেহেরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“হাই। কেমন আছেন? ”
“ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
“এই তো ভালো। এখানে কি করছেন?”
“ক্লাবে আসছিলাম। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“চাকরির ইন্টার্ভিউ দিয়ে আসলাম।”
“আচ্ছা” মেহের রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো রিক্সা আসছে কি না। রাহনাফ এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার মেহেরের দিকে তাকালো। আসলে এখন কি বলা উচিৎ সেটা বুঝতে পারছেনা সে। তবে কথা যে তাকে বলতেই হবে। এতদিন পর মেয়েটার দেখা পেয়েছে কিছু বলবেনা এমন হতে পারেনা। এই মুখটা একপলক দেখার জন্যে দিনরাত ছটফট করে তার মন। এত সহজে তাকে যেতে দেওয়া যাবে না। মেহেরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কি বলা যায়। রাহনাফকে এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহের বলল,
“কি দেখছেন?
“আপনাকে?”
অবাক হলো মেহের। বলল,
” আজ কি প্রথম দেখছেন?”
” আপনাকে যখনই দেখি নতুন লাগে।”
“আচ্ছা।
“হ্যাঁ। চলুন সামনে হাটি এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো।
“হ্যাঁ চলুন। দুজনে পাশাপাশি হাটতে লাগলো। রাহনাফ বলল,
” গতকাল ভোরের আলো পত্রিকায় আপনার লেখা গল্প পড়ছিলো রাহি। আপনি কি লেখালেখি করেন?”
“একটু আকটু।”
“বই বের হয়েছে আপনার?”
“না । তবে খুব তাড়াতাড়ি হবে। ”
“একটা কথা রাখবেন লেখিকা সাহেবা?”
“বলেন।”
“আপনার প্রথম অটোগ্রাফটা না হয় আমায় দিবেন।”
“এখনো বই নিয়ে ভাবিনি আর আপনি অটোগ্রাফ চাইছেন?”
“আমি তো বইতে আপনার অটোগ্রাফ চাইনি।
“তাহলে কোথায়?”
রাহনাফের খুব করে বলতে ইচ্ছে করলো,
“আপনার প্রথম অটোগ্রাফটা আমাদের কাবিননামায় চাই লেখিকা সাহেবা।” কিন্তু মুখে বলতে পারলোনা। আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো শুধু। মেহের তার হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো।মানুষটার হাসি সত্যিই অনেক সুন্দর। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো মেহের। সামনের দিকে তাকিয়ে আনমনেই হাসলো। ছেলেটা একটু বেশীই সুন্দর। আড়চোখে আপাদমস্তক দেখতে লাগলো মেহের।রাহনাফের পুরো মুখটা ঘামে একাকার। কিছু চুল কপালে লেপ্টে আছে। দাঁড়িগুলো ছোট ছোট করে কাটা। গালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। মেহেরে দৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্যে স্থির হয়ে রইলো রাহনাফের গালের দিকটায়। মনে মনে বলল,”ছেলেটার সৌন্দর্য চোখে পড়ার মতো।” মুখে বলল,
” আজ একটু বেশীই গরম।”
“বেশীক্ষণ থাকবে না। মনে হচ্ছে এখনি বৃষ্টি নামবে।”
কিছুক্ষণ পর জোরে হওয়া বইতে শুরু করলো সাথে ঝিরঝিরি বৃষ্টি। রাহনাফ আর মেহের একটা দোকানে আশ্রয় নিলো। ধীরে ধীরে বৃষ্টির বেগ বাড়তে শুরু করলো। ইলশেগুঁড়ি থেকে মুশলধারায়। মেহের হাত বাড়িয়ে দিলো বৃষ্টি বিলাশ করতে। বৃষ্টির পানি পরছে মেহেরের হাতে। মেহেরের চোখ মুখে খুশির ঝিলিক। রাহনাফ সেইদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। দেখতে লাগলো বৃষ্টিবিলাশী এই রমণীকে। মনের ভিতর থেকে কেউ যেন বলে উঠলো,
“শহর জুড়ে বৃষ্টি নামুক।তুমি খুঁজে নিও ঠাই।প্রতিটি বৃষ্টির কণায় লেখা থাকুক, শেষ অবধি তোমাকে চাই।”
৭,
প্রায় আধ ঘন্টা যাবৎ ফোর ডি মডেলের সুপার কম্পিউটারের সামনে বসে আছেন প্রফেসর খাইরুল মামুন। গভীর মনোযোগ সহকারে কম্পিটারের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। শুধু একটা সংকেত। একটা সংকেত পেলেই তার লক্ষটা আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে। তার এতদিনের স্বপ্ন আজ প্রায় পূরণ হতে যাচ্ছে। এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে তাকে পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। নিজ দেশ, নিজের জন্মভূমি ছেড়ে পরে আছে ইংরেজদের দেশে। আজ প্রায় ত্রিশ বছরের কাছাকাছি হবে ভাটির দেশে পা রাখেনি। আসলে দেশে ফিরার সময়টা হয়ে উঠেনি। এবার তার লক্ষে পৌঁছালে ফিরে যাবে নিজ দেশে।
পৃথিবী বদলে গেছে অনেক। অনেক এগিয়ে গেছে বিজ্ঞানও। গ্রাম বলতে এখন আর সবুজ শ্যামল ফিরোজা রুপালি দৃশ্য মেলেনা। শহর আর নগর সভ্যতায় ধ্বংশ হচ্ছে সবুজ শ্যামল প্রকৃতি। শস্যশ্যামল মাঠ ঘাটে আজ তৈরী হচ্ছে বড় বড় কারখানা। যেখানে আর্টিফিশিয়াল কালচার মিডিয়ামে মানুষের খাবারের জন্যে শস্য উৎপাদন করা হয়। যাতে থাকে সেই পরিমান নিউট্রিসেন্স যা একজন মানুষের প্রয়োজন তার বাড়তি একটুও না। কলকারখানার ধোয়া বাতাশে কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে। যার কারনে রোগ জিবানুর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার অন্যতম কারন হলো প্রয়োজনীয় পরিমান অরন্যের অভাব। কার্বনডাইঅক্সাইড থেকে অক্সিজেন এ রুপান্তর করার জন্যে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের পাওয়ার প্ল্যান্ট আবিষ্কার করছে। যা সূর্যের আলো আর বাতাশ থেকে কার্বনডাইঅক্সাইড শোষন করে প্রচুর পরিমানে অক্সিজেন দেয়। এই পাওয়ার প্ল্যান্ট বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে তবুও এতে যেন আমরা প্রয়োজনীয় পরিমান অক্সিজেন পাচ্ছি না। এজন্যে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর খাইরুল মামুন হক এমন একটা আবিষ্কারের কথা বলেন যা অসম্ভব কে সম্ভব করবে। যা দিয়ে পৃথীবির পুরো বায়ু মন্ডলকেই পাল্টে দেওয়া যাবে।
প্রফেসর খাইরুল মামুন হক প্রায় তেইশ বছর যাবৎ যে বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করছেন তা হলো এনএম ট্রি। Nucleus Modifier tree. যেই গাছ তার ক্ষমতা বলে পরমানুর নিউক্লিয়াস বিভাজন করে পদার্থের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের যে সিংহভাগ কার্বনডাইঅক্সাইড আছে তাকে শোষন করে অক্সিজেন বানিয়ে নিতে পারবে ওই গাছ। অবশিষ্ট কার্বনকে নিউক্লিয়াস বিভাজন ঘটিয়ে পরিণত করবে হাইড্রোজেন এ, যা থেকে পরিণত হবে পানি। শুধু তাই নয়, এই গাছগুলোর উচ্চতা রাখা হবে হাফ কিমি। ফলে এই ধরনের গাছ থেকে পৃথিবীর ধূলিঝড় থেকেও আড়াল পাওয়া যাবে।
রাত দুইটা পঁয়তাল্লিশ। প্রফেসর খাইরুল মামুন তার কম্পিটারে শেষমেশ এনএম ট্রির ডিএন এ বিটা ভার্সনের নয়শত সাতাত্তরটা বাগ ফিস্কিং করার কাজে সবে মাত্র শেষ করে ফেললেন। তার সুপার কম্পিটারের ফোর ডি মডেলে সুন্দর ভাবে দেখাচ্ছে কিভাবে সময়সাপেক্ষে বেড়ে উঠবে গাছটা। না আর কোন ভুল নেই।চার হাজার তিনশত আটাশিটা ক্রোমোজোম তাতে আরো কয়েকলাখ জিন সব নির্ভুল। এবার ঘুৃমাতে যাওয়ার পালা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন খাইরুল মামুন। লম্বা হাই তুলে ল্যাব থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
ঘুমানোর জন্যে চোখ দুটি বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক মায়াবিনীর মুখ। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন,
” শূন্যতা একদিন পূর্নতা পাবে ইনশাআল্লাহ। শুধু সময়ের অপেক্ষা”
উঠে বসলেন খাইরুল মামুন। সেন্টার টেবিল থেকে মোবাই নিয়ে কল দিলেন তার প্রিয়সীর নাম্বারে। দুই বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো।
“কেমন আছিস রুপা?”
অতি প্রিয় সেই গম্ভীর কন্ঠটা শুনে চোখ বন্ধকরে ফেলল রুপা। চোখের কোল বেয়ে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করেই রুপা বলে,
“খাইরুল ভাই।”
বুকের বা পাশটায় তীক্ষ্ণ এক ব্যাথা অনুভব করলেন খাইরুল মামুন। দীর্ঘ সময় নিয়ে বললেন,
“রুপা।”
দুজনের বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলো। মনে তাদের হাজারো কথার ফুয়ারা কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছেনা। শুধু একে অপরকে অনুভব করায় ব্যস্ত তারা। মৌনতা ভেঙে খাইরুল মামুন বললেন,
“কি করছিস রুপা?”
” তোমার ফেরার অপেক্ষা করছি খাইরুল ভাই।”
কথাটা খাইরুল মামুনের বুকে আঘাত করলো। চোখ বন্ধ করলেন তিনি। বললেন,
” আর মাত্র কয়েকটা দিন ব্যাস। তোর এই অপেক্ষার অবসান ঘুচবে তবে।”
” অবশেষে তুমি ফিরবে?”
” ফিরতে তো আমাকে হবেই রুপা।”
” আর কতদিন অপেক্ষায় প্রহর কাটাবো আমি।”
” এইবার বসন্তে ফিরবো যে।”
” এই বসন্তে।” বলেই মৃদু হাসলো রুপা। হাসলেন খাইরুল মামুনও। রুপার হাসি মুখটা কল্পনা করলেন তিনি। বললেন
“হাসছিস রুপা।”
রুপা কিছু বললো না। এই চৌত্রিশ বছর বয়সে এসেও সে টিন এজ আরদের মতো লজ্জার মাথা নুইয়ে নিলো। চোখ মুখে লজ্জার লাভা ফুটে উঠলো। খাইরুল মামুন যেন তার লজ্জা রাঙা মুখটা দেখে ভারি খুশি হলেন। মৃদু হেসে বললেন,
“একি রুপা তুই লজ্জা পাচ্ছিস?”
“খাইরুল ভাই।”
“বিয়ের পরও কি আমায় ভাই ডাকবি?”
“তোমাকে বোধহয় আর বিয়ে করা হবেনা খাইরুল ভাই?”
“এটা কেমন কথা বলছিস রুপা?
” ভুল বললাম কি?”
” আমার দেশে ফিরার একমাত্র কারন তুই।”
“এমন কথা বলো না,যার জন্য নিজেকে আফসোস করতে হয়। মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যেতে পারে, শুধু নিতে পারে না কথার ভার, ভুলতে পারে না কথার মার। ছোট্ট একটা কথার মারেই তো কত মানুষ জীবন থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। তোমাকে ভালোবেসে দুই যুগ ধরে অপেক্ষ করছি খাইরুল ভাই। বিয়ের জন্যে তো আমৃত্যু অপেক্ষা করতে হবে। তুমি দেখে নিও খাইরুল ভাই, তোমার আর দেশে ফিরে আসা হবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন, যদি অন্তর থেকে কাউকে ভালোবাসো তাহলে বেদনা প্রাপ্তি নিশ্চিত।” এই ভালোবাসার সম্পর্কটা ঠিক দাঁড়িপাল্লার মতো। দুদিককে সমান সমান ভার না চাপালে ব্যালেন্স যেমন সমান থাকে না, তেমনি জীবনের দাঁড়িপাল্লাতো দুজনের প্রচেষ্টা আন্তরিক এবং সৎ হতে হবে না হলে ব্যালেন্স ঠিক থাকবে না। এই কারণেই সঙ্গী বা সঙ্গিনী সৎ এবং আন্তরিক না হলে আঘাতপ্রাপ্তি এবং দুর্ঘটনা ঘটা নিশ্চিত। বিশ্বাস শব্দটা খুব ছোট হলেও বাস্তবে খুব ভারী। তাই সঠিক মানুষকে বিশ্বাস না করলে জীবনে প্রতি পদে বিনা অপরাধে চরম আঘাত সহ্য করতে হয়।শরীরের সবচেয়ে মূল্যবান অঙ্গ হলো হৃদয় যেখানে স্থান পাওয়ার অধিকার সকলের থাকে না। আমি তোমাকে আমার হৃদয়ে স্থান দিয়েছি খাইরুল ভাই তাই হয়তো আমার অপেক্ষার প্রহর এত ভারী।”
“তুই কি বলতে চাইছিস, আমি তোকে তোর মতো করে ভালোবাসিনি।”
“হয়তো, আবার হয়তো না। তুমি সবসময় নিজেকে গুরুত্ব দিয়েছো। তাইতো এই আটাশ বছরে একবারের জন্যেও দেশে ফিরোনি। সবসময় বলে এসেছে আমার রিসার্চটা শেষ হলেই চলে আসবো। যেটা আজও শেষ হলো না। আচ্ছা খাইরুল ভাই তোমার গবেষণা শেষ হবে তো।”
খাইরুল মামুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
” নিজেকে নিঃশেষ করে কাউকে কিছু দিতে নেই। নিজের জন্যে কিছু রাখতে হয়। তোকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছি নিজের বলতে আছে শুধু এই স্বপ্নটা। এটা না থাকলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবরে রুপা।”
“আমি খুব বোকা বুঝলে খাইরুল ভাই। নিজের মূল্য নিজেকেই দিতে হয়। অন্যকেউ দিবে এমনটা আশা করাই বৃথা।”
” রাগ করছিস। ভালোবাসার জমিতে ভালোবাসাই চাষ হোক। অবহেলা নয়, ভালোবাসা থাক।”
অঝর ধারায় জল পড়তে লাগলো রুপার চোখ থেকে। কল কেটে মোবাইল বিছানার উপর রেখে বালিশের নিচ থেকে ডাইরি বের করলো। ডাইরিতে হাত বুলিয়ে চোখের পানি মুছে কলমের আচর কটলো,
“অভিমানী মন করে অকারণ,
আশায় এই প্রতীক্ষা।
বুঝবে একজন
তার অভিমান।
ঘুচে যাবে সব অপেক্ষা।
সময় বড় নিষ্ঠুর
সুযোগ দেয় না ভরপুর,
করে নির্মম প্রহার;
অভিমান জমে গিয়ে
প্রস্তরে রূপান্তরিত হয়ে;
আঁচড় কাটাই হয় দুষ্কর।
কত অব্যক্ত যন্ত্রণা
কত স্বপ্ন হারিয়ে যায় সময় কালে।
বোকা মন শুধু খুঁজে ফিরে তবু,
কেউ একজন আসবে বলে।
যদি আর না ফিরে আসো
আমায় তবুও মনে রেখো।”
৮,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর ওই আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে মেহের। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির ছিটা এসে পড়ছে মেহেরের চোখমুখে। সেদিকে হুস নেই তার। আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে ভাবছে এটা কি আধো হওয়ার ছিলো। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্যে সে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। আজ সকালে আলিহানের বাড়ি থেকে মৌয়ের জন্যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। সেখানে রাহনাফ ও তার বাবা মাও ছিলো। মূলত আলিহান আর রাহনাফরা যৌথ পরিবার।যেহেতু আলিহান আর মৌ একে অপরকে পছন্দ করে তাই কোন কথা কিংবা চাওয়া পাওয়ার বিষয়টা উঠে নি। বিয়ের দিন তারিখ সবই ঠিক হয়। আনন্দে মেতে উঠে মেহের। মৌকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“শেষ পর্যন্ত তুই ও তোর ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পাবি। আর মাত্র কয়েকটা দিন।”
মৌ লজ্জায় মাথা নিচু করে মৃদু হাসে। আলিহান সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে।তার মুখেও হাসির রেখা। রাহনাফ এবাড়িতে আসার পর থেকেই মেহেরকে দেখছিলো। মেহেরের উপর থেকে তার চোখ যেন সরছিলোই না। এই ব্যাপারটা খেয়াল করে রাহনাফের বাবা আরমান হাসান। তিনি সৈয়দা মাহবুবাকে বলেন,
“আমার কিছু বলার আছে।”
সৈয়দা মাহবুবা আরমান হাসানের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝার চেষ্টা করেন। তারপর বলেন,
“হ্যাঁ বলুন।”
আরমান হাসান একবার মেহেরের দিকে তাকান তারপর রাহনাফের কাধে হাত রেখে বলেন,
” ছেলে হিসাবে আমাদের দুটো ছেলেই রত্ন। আলিহান যেহেতু আপনার বড় মেয়েকে পছন্দ করেছে এই ব্যাপারে আমাদের পরিবারের কোন দ্বিমত নেই। তবে আমাদের এই ছেলের জন্যে আপনার ছোট মেয়েকে চাচ্ছি।”
আরমান হাসানের কথা শুনে সবাই তার দিকে তাকায়। মেহের ও রাহনাফ একে অপরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আরমান হাসান যে এমন একটা প্রস্তাব দিবে সেটা কেউই ভাবতে পারেনি। রাহি হেসে বলে,
” ভাইয়ার সাথে মেহের আপুর দারুন মানাবে।”
রাহনাফ রাহির দিকে একপলক তাকিয়ে মেহেরের দিকে তাকায়। মেহেরের চোখমুখে বিরক্তি। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সৈয়দা মাহবুবার দিকে। হয়তো সৈয়দা মাহবুবার মতামত জানতে চায়ছে সে। রাহনাফ আরমান হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” বাবা, এসব তুমি কি বলছো। আমরা এখানে আলিহানের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছি আমার জন্যে নয়।”
আরমান হাসান রাহনাফের কাধে রাখা হাতটা পিঠে নামিয়ে নেন। রাহনাফের পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন,
” কেন তোর এতে আপত্তি আছে? দেখ মেহেরকে আমার পছন্দ হয়েছে। তাই তোর আপত্তি থাকলেও শুনবোনা।”
রাহনাফ কোন জবাব দেয়না না নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার বাবার মুখের দিকে। রাহনাফের মা বলেন,
” মেহেরকে আমারও খুব পছন্দ হয়েছে। আপা আপনি না করবেন। আমার ছেলেটা খুব দায়িত্ববান। আপনার মেয়েকে যত্নে রাখবে।”
সৈয়দা মাহবুবা একবার মেহেরের দিকে তাকালেন। মেহের তখন ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেরের চোখে চোখ পড়তেন মুচকি হাসলেন সৈয়দা মাহবুবা। তারপর আরমান হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আপনাদের দুটো ছেলেকেই আমার বেশ পছন্দ। মেহেরের সাথে রাহনাফের বিয়েটা হলে মন্দ হয়না।”
সৈয়দা মাহবুবা কথা শুনে সকলে বেশ খুশি হলেন শুধু মাত্র মেহের ছাড়া। মৌ দুহাত তুলে বলল আমিন। আলিহান একহাতে রাহনাফকে জড়িয়ে ধরলো। রাহনাফের দৃষ্টি তখন অপর পাশে বসে থাকা রমণীর দিকে। মেহের চোখ ছোট ছোট করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার মায়ের এই সিদ্ধান্তে খুশি নয় সে। রাহনাফের চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্ট আরো গাঢ় করলো।
মাথায় শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে ভাবনার ছেদ ঘটে মেহেরের। কোনদিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলো কে হতে পারে। বুঝবেই না কেন? ছোট থেকে এই একটা হাতই তো তাকে আগলে রেখেছে। সুখের সঙ্গী আর বিপদে ঢাল হয়ে পাশে থেকেছে। গাঢ় অন্ধকারে দৃষ্টি রেখে মেহের বলল,
“এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলে মা?”
সৈয়দা মাহবুবা মেহেরের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
” রাহনাফ খুব ভালো ছেলে। তোকে অনেক ভালো রাখবে।”
” কিন্তু আমি যে তার সাথে থাকার চেয়ে তোমার সাথে বেশী ভালো থাকবো মা।”
সৈয়দা মাহবুবা হাসেন। বলেন,
” স্বামির যত্ন পেলে আমায় ভুলে যাবি।”
মায়ের কথা শুনে মেহেরের রাগ হয়। গলার স্বর শক্ত করে বলে,
” কেন সবসময় শুধু অন্যের কথা ভাবো বলতো। একবার কি নিজের জন্যে ভাবতে পারোনা। মৌয়ের বিয়ে হলে এ বাড়ি ছেলে চলে যাবে। মামা ফিরে এলে রুপা খালাও চলে যাবে। আমাকেও বিয়ে দিয়ে তাড়াতে চাও। তোমার কি হবে তখন? একা একা কি করে থাকবে তুমি মা। এখন বলোনা যে, সবাই যেভাবে থাকে সেই ভাবেই থাকবে। তোমার সাথে সবার তুলনা হয়না মা। সবার জীবনে জীবন সঙ্গী আছে তোমার নেই। যৌবনে যে পুরুষ ভালোবেসে আদর করে বুকে আগলে রাখে বৃদ্ধ বয়সে সে হয় বেচে থাকার শক্তি, অবলম্বন। একে অপরের কষ্টের ভাগিদার হয় তারা। আচ্ছা মা জিবন নিয়ে তোমার আফসোস হয়না?”
মেহেরের কথা শুনে দুচোখ সিক্ত হয়ে উঠে সৈয়দা মাহবুবার। তিনি জানতেন ঠিক এই কারনেই মেহের বিয়ে করতে রাজি হবে না। কিন্তু তা কি করে হয়। বিয়ে তো মেহেরকে করতেই হবে। রাহনাফের চেয়ে ভালো ছেলে বোধহয় মেহেরের জন্যে আর পাবেনা । সৈয়দা মাহবুবা বলেন,
” আমার জিবন থেকে আমি যা পেয়েছি তাতেই খুশি। তোর মতো একটা মেয়ে পেয়েছি যে আমার সব সময় খেয়াল রাখে এটা কি আমার কম বড় পাওয়া বল।”
মেহের সৈয়দা মাহবুবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” তোমার মতো করে তোমার খেয়াল রাখতে পারি কই? প্লিজ মা বিয়েটা ভেঙে দাও।”
“এটা হয়না মা। এমনটা বলিস না। আমাকে তোর কাছে অপরাধী করে দিস না। এখন যা ঘুমা। আর হ্যাঁ কাল কিন্তু রাহনাফের সাথে দেখা করতে যাবি।”
“মা,,,
“আমি আর কিছু শুনতে চাইনা। আমার সিদ্ধান্ত বদল হবে না। বিয়ের জন্যে তৈরী হয়ে যা।”
সৈয়দা মাহবুবা নিজের ঘরে চলে যান। মেহের দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অন্ধকারছন্ন বৃষ্টিভেজা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে,
“আমরা সবাই সার্থপর মা। কেউ নিজেকে ভালো রাখতে সার্থপর হয় আর কেউ আপনজনদের ভালো রাখতে স্বার্থপর হয়। তবে সত্যি এটাই আমরা সবাই স্বার্থপর।
পরেরদিন বিকালবেলা, মেহের বারান্দায় বসে আনা ফ্রাঙ্কের ডাইরি বই পড়ছে। বইয়ের পাতায় তার এতটাই মনোযোগ যে সেই কখন মৌ তাকে এক কাপ চা দিয়েছে যেটা এখন ঠাণ্ডা হয়ে শরবতে পরিণত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত চায়ের কাপে এক চুমুক ও দেওয়া হয়নি। একমনে বই পড়ছে। মাঝে মাঝে নিজেকে আনার সাথে তুলনা করছে। ইহুদীদের প্রতি তৈরী করা এডলফ হিটলারের নিয়ম কানুন ওর তাদের উপর হওয়ার হিটলারের অত্যাচারের কথা যতবার পড়ছে ততবারই হিটলারের প্রতি ঘৃনায় মনটা ভরে উঠছে। আনার জন্যে কষ্ট হয় খুব। ফুটফুটে সুন্দর চঞ্চল একটা মেয়ের কি করুন পরিণতিই না হয়েছিলো। কষ্টে দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে।নিজের মনকে শক্ত করে আবার বই পড়ায় মনোযোগ দেয় মেহের।
মৌ এসে মেহেরের সামনে থেকে বইটা ছিনিয়ে নেয়। মেহেরের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় মৌয়ের উপর রাগ হয় মেহেরের। মৌয়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন কিছু বলবে তার আগেই মৌ বলে উঠে,
“আম্মু তোকে ডাকছে।”
“কি দরকার।”
“সেটা গেলেই দেখতে পারবি।” মিটিমিটি হাসে মৌ।
” হাসছিস কেন?”
” এমনি, এখন চল তো চল আম্মু অপেক্ষা করছে।”
মেহের আর মৌ সৈয়দা মাহবুবার রুমে যায়। মেহেরকে দেখে সৈয়দা মাহবুবা বললেন,
” আয় বস এখানে।” মেহের বিছানায় বসলো। সৈয়দা মাহবুবা আলমারি থেকে একটা কালো শাড়ি বের করে মৌয়ের হাতে দিয়ে মেহেরকে বললেন,
” গ্রীন ভিলেজ রেস্টুরেন্টে রাহনাফ তোর জন্যে অপেক্ষা করবে। মৌ এই শাড়িটা ওকে পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিবি তো।বাসায় তো সারাক্ষণ খালাম্মা সেজে থাকে। আজ একটু সুন্দর করে সাজিয়ে দিবি।”
মৌ হেসে বলে,
” তুমি একদম চিন্তা করোনা আম্মু। এমন সুন্দর করে সাজিয়ে দিবো যে আমার দেবরটা চোখই ফেরাতে পারবেনা।”
মেহের কড়া চোখে মৌয়ের দিকে তাকালে মৌ বলে,
” দেখছো আম্মু কেমন করে তাকাচ্ছে।”
সৈয়দা মাহবুবা হাসলেন। মেহেরের গালে হাত বুলিয়ে বললেন,
” তোরা যা এখান থেকে। মৌ ওকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিবি। রাহনাফ আসলো বলে।”
মৌ বলল,
” রাহনাফ কি বাড়িতে আসবে?”
” না রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করবে।”
সৈয়দা মাহবুবা মোবাইল হাতে নিয়ে বিছানায় বসেন। মৌ আর মেহের চলে যায়। রুমে এসে বিছানায় বসে জোরে জোরে শ্বাস নেয় মেহের। মৌ মেহেরের কাধে হাত রাখে। মেহের বলে,
” এই রাহনাফকে আমি ছাড়াবোনা।”
” ছাড়তে বলছে কে? ভালোবাসার শিকলে বেধে ফেল।”
মৌ হাসে আর বলে। মেহের কড়া চোখে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
” খুব মজা লাগছে তাইনা।”
“একদম। এখন উঠতো তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।”
মেহের উঠে দাঁড়ায়। তারপর রেডি হয়।
পরনে কালো শাড়ি আর খোলা চুল। দুহাত ভর্তি কালো চুড়ি কানে ঝুমকো চোখে গাঢ় কাজল। দেখতে অপরুপ লাগছে মেহেরকে। মৌ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আজ তো রাহনাফ তোর প্রেমে পড়বেই পড়বে।”
চলবে,,,,,,
মাহফুজা আফরিন শিখা।