তবুও মনে রেখো পর্ব-০২

0
381

#তবুও_মনে_রেখো। [০২]

৪,
ভোরের আলো ফুটে উঠার সাথে সাথে ঘুম ভাঙে মৌয়ের। অলসতা কাটিয়ে উঠে বসে সে। কাধে হাত রেখে মাথা দুদিকে ঘুরিয়ে নেয়। পাশে তাকাতেই মেহেরের ঘুমন্ত মুখখানা দেখতে পায়। একহাত বালিশে অন্যহাত পেটের উপর রেখে ঘুমাচ্ছে। মেহেরের ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মৌ। কতটা নিষ্পাপ আর আদুরে লাগছে তাকে। মৃদু হেসে মেহেরের গাল টিপে দিলো। ঘুমের ঘোরেই নাক চোখ কুচকালো মেহের। হাত সড়িয়ে নিলো মৌ। কাল সারারাত ঘুম হয়নি তার। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই কেটেছে তার রাত। চারদিন হলো তারা গ্রামে এসেছে। সেদিন নানার অসুস্থতার কথা শুনে সকলে গ্রামে ছুটে আসে। গতকাল আলিহানের সাথে কথা হয়েছে তার। এভাবে না জানিয়ে আসার জন্যে তার উপর বেশ রেগে আছে আলিহান। ঠিকমতো কথাও বলে নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছাড়লো মেহের। চারিদিকে তখন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। সোনার রবি দেখা যাচ্ছে পূব আকাশে। পাখিরা দল বেধে গান গেয়ে উড়ে যাচ্ছে দূর আকাশে। মৌ উঠোনে এসে দাঁড়ালো। অনেক জায়গা জুড়ে বিভিন্ন সবজি গাছ লাগানো আছে তাতে আবার হরেক রকম সবজি ঝুলছে। প্রশান্তিতে ভরে গেলো মন। শহরে এমন দৃশ্য দেখাই যায়না। যদিও কেউ কেউ ছাদে সবজির চাষ করে। তবে শহুরে মানুষ ছাদে সবজির চেয়ে ফুলের চাষ করতে বেশী পছন্দ করে। মৌ পুরো বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলো এমন সময় পিছন থেকে মামি বললেন,
” এত সকাল সকাল বাগানে কি করস মৌ।”
” কিছু না মামি। এমনি ঘুরে দেখছিলাম।” মৃদু হেসে জবাব দিলো মৌ।”
” সেই যে শহরে গেলি আর তোর দেখা পাওন গেলো না। রবিন মাঝে মাঝে আইসা আমাদের উপর চেঁচামেচি করতো। তোর ঠিকানা চাইতো।”
মামির কথা শুনে মৌ’য়ের হাসি মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলে। মৌ বলল,
” আমার ঠিকানা দিয়ে সে কি করবে?”
” তোরে ফিরিয়া আনবার চাইতো। ওর নাকি তোরে ছাড়া ভালো লাগে না এখন। একা একা কার ভালো লাগে?”
মৌয়ের ভালো লাগছিলো না এসব কথা শুনতে। সে মামিকে বলল,
” যখন কাছে থাকতে চেয়েছিলাম তখন কেন দূরে সড়িয়ে দিলো? তখন সে আমার কথা ভাবেনি।”

কথা শেষ করে উল্টোদিকে রাস্তায় হাটতে থাকে মৌ। পুরোনাম সামিরা জান্নাত মৌ। এটাই ওর গ্রাম। এখানে জন্ম এখানেই শৈশব কাটিয়েছে সে। মৌয়ের মা শাকিলা আর মাহবুবা ছেলেবেলার বন্ধু। শাকিলা আর রবিন একে অপরকে ভালোবেসে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করে। বছর তিন যেতেই সন্তানসম্ভবনা হয় শাকিলা। শাকিলা বয়স তখন কত? ষোলো কিংবা সতেরো। গর্ভঅবস্থায় নানা জটিলতা দেখা দেয় তার। ডক্টর তাকে গর্ভপাত করাতে বলে না হলে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি আছে। রবিন রাজি হলেও রাজি হয়না শাকিলা। সে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবে জেদ করে বসে। এটা নিয়ে অনেক ঝামেলাও হয় শাকিলা আর রবিনের মাঝে। তাদের এই ঝামেলার ইতি ঘটে মৌয়ের জন্মের সময় শাকিলার মৃত্যু দিয়ে। সদ্য জন্ম নেওয়া মৌ তার বাবার কাছে হয়ে উঠে মায়ের খুনি। মুখও দেখেনি রবিন তার নবজাতক সন্তানের। শাকিলাকে হাড়িয়ে রবিন হয়ে উঠে পাগল প্রেমিক। দিনের বেলা রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে রাখতো কারো সাথে কথা বলতো না আর রাতভর মদ খেয়ে কখনো পরে থাকতো রাস্তার ধারে আবার কখনো তাকে পাওয়া যেতো শাকিলার কবরের পাশে। তখন সেই নবজাত শিশু মৌকে মাহবুবা আর নওশাদ বুকে টেনে নেয়। তাকে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করতে থাকে। তার দুবছর পর মাহবুবা সন্তানসম্ভবনা হয়ে পরে। সেই অবস্থায় নওশাদও তাকে ছেড়ে চলে যায়। এলোমেলো হয়ে যায় মাহবুবার জিবন। বাড়ির এক কোনে অনাদরে অযত্নে বড় হতে থাকে মৌ। মৌ এর বয়স যখন ছয় বছর তখন সে তার বাবার কাছে চলে যায়। রবিনের তখনো মেয়ের উপর থেকে রাগ পরেনি। সে কারনে অকারনে মৌয়ের গায়ে হাত তুলতো। ঠিকমতো খেতে দিতনা।তাই ফিরে আসে মাহবুবার কাছে মৌ। তারপর একদিন মাহবুবা তাকে আর মেহেরকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমায় শহরের বুকে। সেখানে সে সৈয়দা মাহবুবার সন্তান হিসাবে বড় হয়ে উঠে। ভালোই কাটছিলো তাদের শহুরে জিবন। সৈয়দা মাহবুবা যখন চাকরি জয়েন করলো তখন তাদের দেখা শুনার জন্যে একজন মাধ্যবয়স্ক মহিলাকে রাখা হলো। কারন দুটো বাচ্চা বাড়িতে একা রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। সারাদিন খেলাদুলা আর খুনসুটিতে কেটে যাচ্ছিল তাদের সময়। সময় প্রবাহমান, সে বদলায়। কারো জন্যে থেমে থাকেনা। বড় হতে লাগলো মৌ আর মেহের একে অপরের বোন, বন্ধু হয়ে। একদিন হঠাৎ করেই রুপা ব্যাগপত্র নিয়ে হাজির হয় সৈয়দা মাহবুবার বাড়ি। সৈয়দা মাহবুবা তখন মৌ আর মেহেরকে পাড়াচ্ছিলেন। রুপাকে দেখে মেহের আর মৌ যেমন খুশি হয়েছে তেমনি অবাক হয়েছিলেন সৈয়দা মাহবুবা। তিনি ওদের দুজনকে নিজেদের ঘরে যেতে বললে ওরা চলে যায়। রুপা সৈয়দা মাহবুবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
” তোমার এই চোট্ট বাড়িটায় আমার আশ্রয় হবে না আপা? ”
সৈয়দা মাহবুবা অবাক হয়নি। সে রুপাকে একনজর দেখে বললেন,
” বাড়িতে ফিরে যায় রুপা। এটা তোর পাগলামির বয়স নয়।”
” আমি আর ওই বাড়িতে যাবো না আপা।”
” কেন যাবিনা।”
” সবাই আমাকে বিয়ের জন্যে জোর করছে কিন্তু তারা জানেনা আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। খাইরুল ভাইকে আমি কথা দিয়েছি আপা। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে আমি বিয়ে করবো না।”
” খাইরুল কি তোকে কথা দিয়েছে?
” না। সে শুধু জানতে চেয়েছে, আমি অপেক্ষা করতে পারবো কি না।”
” কতদিন?”
“বলেনি।”
“তাহলে কার জন্যে অপেক্ষা করবি তুই রুপা। কিসের উপর ভরসা করে থাকবি তুই?”
” আমার ভালোবাসার উপর। সে কোন দিন ফিরে না আসলেও আমি অপেক্ষা করবো। ভলোবাসি তাকে। আপা, দেখো আমার এই প্রতিক্ষাই তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে।”
সৈয়দা মাহবুবা কিছুক্ষণ রুপার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কতটা বিশ্বাস ভরসা নিজের ভালোবাসার উপর। অথচ কোনদিন হাতে হাত রেখে হাটেনি একাকি নির্জন রাস্তায়, ঘুরেনি কোনদিন বসে হুডখোলা রিক্সায়। চোখে চোখ রেখে কখনো বলা হয়নি ভালোবাসি প্রিয় তোমায়। তবুও কতটা বিশ্বাস করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সৈয়দা মাহবুবা।

__________________
মেহেরের ঘুম ভাঙে মুঠোফোনের শব্দে। বিছানা হাতরে মোবাইল হাতে নিয়ে স্কিনে তাকায়। স্কিনের উপর জ্বলজ্বল করছে মামু নামটা। ঘুম ছুটে যায় মেহেরের। অধরে ফুটে হাসি। কল রিসিভ করে অভিমানী সুরে বলে,
” এতদিনে আমার কথা মনে পরলো তোমার মামা?”
“ব্যস্ত ছিলাম।”
“তুমি তো সমসময়ই ব্যস্ত থাকো।”
“হ্যাঁরে পাগলি। কেমন আছিস বল?”
” ভালো আছি মামা। তুমি দেশে আসবে না? প্লিজ মামা ফিরে এসো। রুপা খালা আজও তোমার অপেক্ষায় দিনগুনে।”
ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন খাইরুল মামুন। বলেন,
” রুপাকে বলে দিস, সে যেন আমার জন্যে আর অপেক্ষা না করে।”
“কেন করবে না মামা? তুমি কি তাহলে আর আসবেনা?”
“জানিনা।”

খাইরুল মামুনের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় মেহের। মেহেরের খুব কষ্ট হয়। কষ্টে চোখে জল আসে। মামা তাহলে আসবে না। রুপা খালা কি তাহলে সারাজীবন শুধু অপেক্ষা করেই যাবে। বুকের ভিতরে ভিষন যন্ত্রণা অনুভব করে মেহের। রুপা খালাকে সে কি বলবে? মামা আর কখনো ফিরে আসবে না তুমি বিয়ে করে নাও। না। এটা বলতে পারবেনা মেহের। আগে যখন মামা বলতো সে খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসবে তখন দৌড়ে গিয়ে রুপাখালার গলা জড়িয়ে বলতো মামার দেশে আসার কথা। রুপা খালা লজ্জা পেতো তখন। লজ্জায় মুখ ঢাকতো দুহাতে। মেহের তাকিয়ে থাকতো রুপা খালার মুখের দিকে। লজ্জা পেলে তাকে কত সুন্দর দেখায়। দেখতে খুব ভালো লাগে। মনে মনে ভাবে মেহের, মামাকে তো ফিরে আসতেই হবে না হলে রুপা খালার কি হবে? তাকে কে বিয়ে করবে। রুপা খালার কথা ভাবলে তার কষ্ট হয় খুব। মেহের বলে
” পরিবারের থেকেও কি তোমার কাজ বেশী আপন মামা?”
“এটা আমার স্বপ্ন।”
“আর রুপা খালা?”
” আমার ভালো থাকার কারন।”
“তাহলে সব ছেড়ে চলে আসছো না কেন?”
” আমার হাত পা যে বাধা। স্বপ্ন ছুতে ন। পারলে মরেই যাবো হয়তো। এত সময় পরিশ্রম অপেক্ষ আশা আকাঙ্ক্ষা সব বিফলে যাবে।পারবোনা আমি।”
” কেন পারবেনা মামা?”
” যে স্বপ্ন পূরণ করতে পাড়ি দিয়েছি হাজার মাইল সেটা অপূর্ণ রাখি কি করে?”
“স্বপ্ন, এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে এতগুলো বছর পারিবার পরিজন এমনকি নিজের একান্ত প্রিয় মানুষটার থেকে দূরে আছো তুমি। তুমি ভালো আছো তো মামা?”
“হ্যাঁ, ভালো আছি।”
“কিভাবে? এই তো বললে তোমার ভালো থাকার কারন রুপা খালা। সে তো আমার কাছে নেই।”
“আমি হাজার মাইল দূরে থেকেও জানি রুপা আমার। তাহলে আমার ভালো না থাকার কারন আছে কি?”
জবাব দিতে পারলো না মেহের। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল রুপা আসছে। মেহের রুপাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“খালা এসো। বসো আমার পাশে।”
রুপা মেহেরের পাশে গিয়ে বসলো। জিগ্যেস করলো,
” কার সাথে কথা বলিস?
“মামা, তুমি কথা বলবে? এই নাও। মোবাইল রুপার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “তোমরা কথা বল আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।” রুপাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহের ওয়াশরুমে চলে যায়। এদিকে রুপা মোবাইল হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নির্বিকার বসে থাকে। রাগ হয় মেহেরের উপর। কি দরকার ছিলো ওকে মোবাইল ধরিয়ে দেওয়ার। লম্বা শ্বাস নিয়ে মোবাইল কানের কাছে ধরে বলে,
“হ্যালো।”
” কেমন আছিস রুপা?”
“তুমি যেমনটা রেখছো?”
” কেন এত অপেক্ষা করছিস?”
“সেদিন কি বলেছিলে মনে আছে তোমার?”
“সেদিনের কথা ধরে আজও বসে আছিস?”
“কেন থাকবো না।”
“তখন আবেগের বসে অনেক কথাই বলেছি। এখন আর কোন আবেগ নেই। তুই বিয়ে করে নি রুপা।”
“লোকে হাসবে।”
“কেন?”
“আমার বয়স কতো জানো? চৌত্রিশ বছর। এই বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসলে লোকে হাসবে।”
“যদি আমি কখনো তোর সামনে এসে দাঁড়াই তাহলে আমাকে বিয়ে করবি রুপা। নাকি লোক লজ্জায় ভয়ে পালিয়ে যাবি?”
” তোমার মতো বুড়োকে আমি বিয়ে করবোনা।”
“তাহলে অপেক্ষা করছিস কেন?”
” জানিনা।”
“বিয়ে করেনি রুপা। আমার জন্যে অপেক্ষা করিসনা। আমি শূন্যহাতে ফিরবো না।”
“তুমি পূর্ণতা পাও খাইরুল ভাই। আর আমাকে পূর্ণতা দাও। তোমার অর্ধাঙ্গিনী রুপে আমায় পূর্ণতা দাও খাইরুল ভাই।

৫,
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোয়া উড়াচ্ছে রাহনাফ। দু আঙুলের মাঝে সিগারেট নিয়ে ফুঁকছে আর মুখের ধোয়া উড়িয়ে দিচ্ছে উপরের দিকে। উপরের উঠতে গিয়ে অন্ধকারের মিলিয়ে যাচ্ছে সে ধোয়া। আজকের আকাশটা একটু বেশীই কালো। ঘন কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত আকাশ। আকাশে আজ চাঁদের দেখা নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা নিচে ফেলে দিলো। দুচোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি। মেহের। হ্যাঁ, এই মেহেরকেই সে দেখেছিলো প্রফেসর খাইরুল মামুন হক এর ল্যাপটপে। দিনটা ছিলো রবিবার। ইউনিভার্সিটি অফ বাসাতেও কোন কাজ নেই তাই সে প্রফেসর খাইরুল মামুন হক এর ল্যাবে যায়। রাহনাফ ছিলো তার প্রিয় ছাত্র তার উপর বাঙালি এজন্য বোধহয় স্যার তাকে একটু বেশীই পছন্দ করতেন। স্যারের ল্যাবে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছে রাহনাফ। সেদিন গিয়েছিলো খাইরুল স্যার যে নিউক্লিয়ার গাছ নিয়ে গবেষণা করছেন সেটা সম্পর্কে জানতে। রাহনাফ যখন ল্যাবে পৌঁছালো তখন খাইরুল স্যার তার ফাইভ জি কম্পিউটারের সামনে বসে কিছু করছিলেন আর তার পাশেই তার পুরনো ল্যাপটপের স্কিনে দেখা যাচ্ছিলো একটা মেয়ের ছবি। একটু ভালো করে খেয়াল করে দেখতে পেল তখন ভিডিও কনফারেন্স চলছিল। স্যার কাজ করছিলেন আর মেয়েটা দেখছিলো। রাহনাফ প্রথমে ভেবেছিল মেয়েটা হয়তো তাদের ডিপার্টমেন্টের কোন স্টুডেন্ট হবে। সে সেখানেই দাড়িয়ে দেখছিলো মেয়েটাকে। এমন মায়াবিনী মুখ ছিলো মেয়েটার যে রাহনাফ শুধু মেয়েটাকেই দেখে যাচ্ছিলো। পরে তাদের কথোপকথন থেকে বুঝতে পারলো মেয়েটা বাংলাদেশের। আর সে জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট নয়। সে তো বিজ্ঞানই পছন্দ করেনা। তার পছন্দ ইতিহাস। সেদিন সেই এক ঝলক দেখার পর মেয়েটা তার মনের গভীরে এমনভাবে ভালোলাগার বীজ বপন করেছে যে রাহনাফ ইংল্যান্ড ছেলে ভাটির দেশে চলে আসে। তবে রাহনাফ কি জানতো এত সহজে তার দেখা পাবে? সেদিন আলিহানের সাথে ওর হবু শ্বশুর বাড়ি গিয়ে মেহেরকে দেখে খুব অবাক হয়েছিলো। স্যার বলেছিলেন, মেহের তার একমাত্র ভাগ্নি তাহলে মৌ? মৌ কে? বেশী ভাবতে পারলোনা রাহনাফ। গভীর ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে রাহনাফ বলে,

“ভালোবাসি, বাগানের ঝরে যাওয়া ফুল। ভালোবাসি,
মেঘলা নদীর কুল। ভালোবাসি, উড়ন্ত এক ঝাক পাখি।
ভালোবাসি, তোমার ওই দুই নয়নের আখি।”

রাহনাফের ভাবনার মাঝেই বেলকনিতে আসলো আলিহান। আলিহান রাহনাফের কাধে হাত রেখে জিগ্যেস করলো,
” পাগল প্রেমিক। মেয়েটার কথা ভাবছিস?”
“হ্যাঁ।”
আলিহান রাহনাফের কাধ থেকে হাত সরিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো। বুকের উপর হাত ভাজ করে বলল,
” সারাক্ষণ শুধু মেয়েটার কথা ভাবেই যাবি। মেয়েটার খোঁজ করবিনা।”
“না।”
“যার জন্যে সুদূর যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে চলে আসলি তার খোঁজ করবি না। আচ্ছা তোর মাথায় চলছে টা কি?”
” আমার ভালোবাসার টানে সে নিজেই ছুটে আসবে।”
” ও আচ্ছা তাই নাকি। তা সে কবে আসবে শুনি?”
“তুই তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নি তাহলেই তোর আমার রাস্তা ক্লিয়ার।”
“তাহলে আমি তোর পথের কাটা।”
” হুম।”
আলিহান রেগে যায় রাহনাফের কথায়। সে রেগে জিগ্যেস করে,
” মেয়েটা কে শুনি?”
“তোর শালিকা।”
“শালিকা মানে! মেহের।” আশ্চর্য শুনায় আলিহানের কণ্ঠস্বর।
“হ্যাঁ, মেহের। এত অবাক হচ্ছিস কেন?”

রাহনাফ বেলকনি ছেড়ে রুমে চলে আসে। আলিহান সেখানেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু একটা মনে পরতেই সে রুমে চলে আসে।রাহনাফ তখন ওয়াশরুমে ছিলো। আলিহান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে। রাহনাফ ওয়াশরুমে থেকে চুল মুছতে মুছতে বের হয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে থাকা আলিহানকে একপলক দেখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিছানা থেকে আলিহান বলে,
” মৌ একবার বলেছিলে ওদের মামা ইংল্যান্ডের এক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।”
” হ্যাঁ ওদের মামাই প্রফেসর খাইরুল মামুন হক।”
“তুই তো বলেছিলে প্রফেসরের একমাত্র ভাগ্নির প্রেমে পরেছিস।”
“এখানে আসার আগ পর্যন্ত আমিও সেটাই জানতাম।”
বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে টিশার্ট ঝাড়া দেয় আলিহান। রাহনাফের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
” প্রেমে পরার মতো আর কোন মেয়ে পাইলি না। শেষ পর্যন্ত আমার শালিকার প্রেমেই পরতে হলো। যাই হোক আমি যাই ঘুম পাচ্ছে।”
রাহনাফ আলিহানের দিকে ঘুরে বলে,
“আজকের রাতটা এখানে থাক। ছোট বেলার মতো একসাথে ঘুমাই দুই ভাই।”
“ওকে।” জাম্প দিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে আলিহান। রাহনাফ মৃদু হেসে লাইট বন্ধকরে আলিহানের পাশে শুয়ে পরে।

সকালবেলা আফিয়া বেগমের ডাকে ঘুম ভাঙে রাহনাফের। দুহাতে চোখ কচলে উঠে বসে। আফিয়া বেগম কফির মগ সেন্টার টেবিলে রেখে রাহনাফের পাশে গিয়ে বসলেন। আদুরে হাতে রাহনাফের মাথায় হাত বুলিয়ে জিগ্যেস করেন,
“ঘুম কেমন হয়েছে?”
রাহনাফ মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে,
“ভালো।”
আফিয়া বেগম রাহনাফের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
” তোর বাবা একটা মেয়ে দেখছে তোর জন্যে। আমরা সবাই মেয়েটার ছবি দেখেছি ভারি মিষ্টি মেয়ে। আমাদের সকলের পছন্দ হয়েছে। এবার তোর পছন্দ হলেই কথা বলবো। আমরা চাই আলিহান আর তোর বিয়েটা একদিনেই হোক।”
রাহনাফ উঠে বসলো। মায়ের মুখোমুখি বসে বলল,
” আগে চাকরির খোঁজ করি তারপর নাহয় বিয়ের কথা ভাবা যাবে।”
” চাকরি পরেও পাওয়া যাবে।”
“তা যাবে কিন্তু বিয়ে করে বউকে খাওয়াবো কি?”
“আমাদের কি কোন অভাব আছে যে তুই বউকে খাওয়ানোর কথা ভাবছিস।”
“তা নেই তবে যখন কনে পক্ষের লোক প্রশ্ন করবে ছেলে কি করে কখন কি বলবে, ছেলে শিক্ষিত বেকার। বাবার ঘাড়ে বসে খায়।”
“তোর সাথে তর্কে পারবো না কখনোই।”
“তর্ক না এটা যুক্তি।
“হয়ছে হয়ছে। উঠে দাঁড়ান আফিয়া বেগম। বলেন,
“ফ্রেশ হয়ে নিয়ে আয় সবাই অপেক্ষা করছে এক সাথে নাস্তা করবি।”

চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে