তপ্ত সরোবরে পর্ব-৩৮ এবং শেষ পর্ব

0
1070

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

শেষপর্ব (প্রথমাংশ).

দ্বিজার ভারী মুখটাকে উপেক্ষা করে ফারজাদ আর বের হতে পারল না এদিন। সকালের বাসে যাবে, ঠিক করেছে। সন্ধ্যার পর ঘুম ভেঙেছে দুজনের। দ্বিজা উঠে চা বানাতে গেল ফারজাদ আর আজাদ সাহেবের জন্য।

লাবণ্যর শরীর ভালো নয়। আজ দুপুরের পর দু’বার বমি করেছে। ইরফান এসেছে বিকেলে লাবণ্যকে নিতে, লাবণ্য যাবে না। বাড়ির লোকও রাজী নয় যেতে দিতে। এ নিয়ে দুজনের মন কষাকষি হলো। ইরফান বলল, “তোমাকে ছাড়া একা ঘরে ঘুমাতে ভালো লাগে না আমার। একা থাকার অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে, বাড়ি চলো আজ। তুমি তো পাত্তাই দাও এই বাড়ি আসলে আমায়!ʼʼ

চোখ ছোটো করে তাকাল লাবণ্য, “আচ্ছা, তাই! এইযে বাড়ির লোকে শুধু আপনার পা ধরে ঝোলাটা বাকি রেখেছে, যে আপনিও থাকুন এখানে। তবুও আপনার মতো অকৃতজ্ঞ লোকের ঝুলিতে পাত্তার ঘড়া পুরো হচ্ছে না।ʼʼ

-“তোমার আমাকে ঘরজামাই রাখার প্লান আছে? কাপুরুষরা ঘরজামাই থাকে। আমি পুরুষ, সুতরাং আমার বউ আমার বাড়িতে থাকবে, আমি বউয়ের বাড়িতে না।ʼʼ

-“দুটো দিন থেকে গেলে যে সেটাকে ঘরজামাই থাকা বলে, তা জানতাম না।ʼʼ

-“তুমি আরও অনেক কিছুই জানো না। তোমাকে ওই বাড়িতে গোয়ালের গরু পালতে দেয়া হয়, যে এখানে এসে আরাম করছো? এতো বাপের বাড়ি থাকা লাগবে কেন?ʼʼ

-“আমার অতো জেনে কাজ নেই। আপনি থাকবেন আমার সাথে এখানে। সকালে উঠে এখান থেকে অফিস যাবেন। আমি বুঝিনা, আপনার অসুবিধা কোথায়? বারোমাস তো থাকছি না এখানে। এমনও নয়, বিয়ের পর ঘন ঘন এ বাড়িতে আসি আমি।ʼʼ

না খেয়ে-দেয়ে সন্ধ্যার আগে চলে গেছে ইরফান। তারপর শুরু হলো লাবণ্যর খচখচানি। আর কিছুই ভালো লাগছে না। শুধু গোমরা মুখটা মনে পড়ছে ইরফানের। হাস্যজ্জ্বল মানুষটার গোমরা মুখ দেখতে খুব বেমানান আর খারাপ লাগে। এখন নিতে এলে দৌড়ে বের হবে লাবণ্য, ইরফানের সাথে। কিন্তু তখন যে কীসের জিদ চেপে গেছিল এখানে থাকার! আজকাল মেজাজটা খুব খিটখিটে হয়ে থাকে, লাবণ্য নিজেও বোঝে, সে খুব খ্যাচখ্যাচ করে কথায় কথায়। গম্ভীর লাবণ্য প্রেগনেন্সিতে খুব অধৈর্য্য হয়ে গেছে। ডাক্তারও বলেছে, এখন ওকে উত্তেজিত না হতে। এ সময় মেজাজ ভালো না থাকাটা স্বাভাবিক।

বহুবার কল করেছে ইরফানকে। ফোন রিসিভ করছে না সেই লোক। সোফার ঘরে একটা ছোট্ট খাট রাখা আছে, সেখানেই শুয়ে আছে লাবণ্য। দ্বিজা আসল, কী যেন নিতে। লাবণ্যর মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে, লাবণ্য আপু! শরীর খারাপ লাগছে তোর?ʼʼ

লাবণ্য বলল, “মন খারাপ লাগছে।ʼʼ

দ্বিজা বিছানায় বসল, “কেন? ইরফান ভাইয়ের সাথে ঝামেলা হয়েছে?ʼʼ

লাবণ্য কথা বলল না। দ্বিজা বলল, “ফারজাদ টিকিট কাটতে যাবে, তুই চাইলে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে তোকে। যাবি?ʼʼ

-“না, ও এসে নিয়ে গেলে তবেই যাব। আমায় রেখে চলে গেল কীভাবে?ʼʼ

দ্বিজা হাসল, “তুই তো এমন আবুঝ আর জেদি ছিলি না, লাবণ্য আপু!ʼʼ

লাবণ্য মুখ গোমরা করে শুয়ে রইল ওভাবেই। রুমে ফিরল দ্বিজা। ফারজাদ রুমে নেই, বাথরুমেও নেই। বারান্দায় উঁকি দিলো, সেখানেও নেই। টিকেট কাটতে বের হয়ে গেছে এতো তাড়াতাড়ি? মামা ডেকেছিল ওদের দুজনকে। দ্বিজা জানালার কাঁচ লাগিয়ে পর্দা টেনে দিলো। মাঠ থেকে মশা এসে ঘর ভরবে নয়ত। দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে মামার ঘরে গেল। অবাক হলো দ্বিজা। ফারজাদ বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে। দু’হাতের তালু বিছানায় ঠেকিয়ে ঝুঁকে বসে আছে। সামনেই মুখিয়ে বসে আছেন ফারহানা ও আজাদ সাহেব। দ্বিজা দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফারজাদ বলল, “কাল সকালে ঢাকা যাচ্ছি। দোয়া করবেন আপনারা আমার জন্য। যেন ভালোভাবে নিজের কর্তব্য পালন করতে পারি, আর নিজেদের খেয়াল রাখবেন।ʼʼ

কথাগুলো শুনতে লাগল এমন–যেন নেহাত আনুষ্ঠানিকতার দায় নামাচ্ছে ফারজাদ কাঁধ থেকে। অন্তর থেকে আসেনি তার কথাগুলো। অবশ্য এটা ভেবেও মেনে নেয়া যায়–ফারজাদ আন্তরিক কথা জানেই বা কই! এ-ই অনেক তার মুখে। ফারহানা কেঁদে উঠলেন। ফারজাদ মাথা তুলে বলল, “চ্যাহ! আম্মা! কাঁদছেন কেন? কি সমস্যা?ʼʼ

ফারহানা উঠে এসে ছেলের গা ঘেঁষে বসলেন। বহুদিন ফারজাদের মুখে আম্মা ডাক শোনেননি তিনি। হঠাৎ-ই ফারজাদের বাহু আঁকড়ে ধরে ডুকরে উঠলেন, “তুই এতো ঘেন্না করিস ক্যান বাপ, আমাদের দুইজনরে! কেউ হই না আমরা তোর?ʼʼ

-“কীসব মূর্খের মতো কথা বলছেন! ঘেন্না করার প্রশ্ন উঠছে কেন? থামুন, কান্না থামান। এমনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলুন, শুনছি তো আমি!ʼʼ

-“তোর কাছে কোনো অপরাধ করে থাকলে, ক্ষমা করে দে, বাপ! একটাই তো মাত্র ছেলে আমার, তার বিরহ সয় না তো কলিজায়!ʼʼ

ফারজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা, “আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে ছোটো করছেন, আপনি। আমার কাছে আপনাদের কী অপরাধ থাকতে পারে, আশ্চর্য! জীবনের ধারাবাহিকতায় বয়ে যাওয়া কিছু বিষয় অবিশ্লেষ্য হয়, তার কোনো সংজ্ঞা থাকে না, বর্ণনার উপায় থাকে না। আমার জীবন এবং আচরণের সিংহভাগ আমি সেই তালিকায় সঁপেছি। যাহোক, এখন সেসব কথা বলার নয়। ভালো দোয়া দেবেন আমায়, আর আপনাদেরই মেয়ে যে এখন আমার জিম্মেদারী, তা রেখে যাচ্ছি আপনাদের কাছে, তার খেয়াল রাখবেন। আপনাদের ঋণের কাছে আমি চিরদিন ছোটো। আর সব সময় জরুরী নয়, একপক্ষ অপরাধ করলেই শুধু কেউ অভিমান করবে। ইভেন, অপরাধের বদলে অভিমান নয়, শাস্তি দেয়া হয়। আমি তো এটাও জানি না, আমার ওটা অভিমান ছিল নাকি অন্যকিছু হয়তবা! যার নাম নেই হয়ত। ধরে নিন, বুকের এবরোথেবরো ক্ষতগুলো জমে জমে এক প্রাচীর হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মাঝখানে। এখন দূরে যাচ্ছি, এটাও বুঝেছি, আমার ফেরা না ফেরা উপরওয়ালার হাতে। আপনাদের কাছে বেঁধে থেকে ওই অনিশ্চিত ক্ষেত্রে পা রাখার নয়। সমস্ত অপরাধ আর আমার ওপরে জমে থাকা খারাপলাগাগুলো ক্ষমা করে দেবেন।ʼʼ

আজাদ সাহেব চোখ মুছলেন। দ্বিজা ওড়নার প্রান্তে চোখ-মুখ মুছে এসে ফারহানাকে ধরল। ফারজাদ আব্বুর পায়ের কাছে হাঁটু ভাঁজ করে উবু হয়ে বসল। আজাদ সাহেব মাথা নিচু করে আছেন। ফারজাদ আলগোছে ওনার হাতের রাখল, হাত নাড়তে নাড়তে বলল, “আপনি ক্ষমা করবেন না, আমায়? আপনাদের তো বহুত অভিযোগ আমার ওপর। আমার কি নেই? আমারও আছে, তবে আজকাল কেন যেন মনে হয়–জীবন তো একটা। সেখানে এতো দেয়াল তুলে দিলে শেষে অসামাজিক প্রাণির মতো দুনিয়া ছাড়তে হবে। এক জীবনে এতো বাঁধিয়ে রেখে কী? সব তো মুছেই যায় মসজিদের খাটে চড়ার সাথে সাথেই।ʼʼ

আজাদ সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন। ফারজাদ উঠে দাঁড়াতেই আলিঙ্গন করলেন তিনি ছেলেকে। আবেগঘন মুহুর্ত কাটালেন ফারজাদকে বুকে মিশিয়ে।

ও ঘর থেকে বেরিয়ে ফারজাদ এলো বসার ঘরের দিকে। লাবণ্যর উদ্দেশ্যে বলল, “লাবণ্য! তোর কী অবস্থা!ʼʼ

লাবণ্য শুয়েছিল। হুড়মুড়িয়ে উঠল ফারজাদের কণ্ঠ পেয়ে। দ্রুত ওড়না, জামা ঠিক করে দরজার দিকে তাকাল। ফারজাদ ঢোকেইনি এখনও, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ডাক ছাড়ছে। এক চিলতে সন্তুষ্টি ও মুগ্ধতার হাসি মুখে ছড়াল লাবণ্যর। জবাব দিলো, “ভেতরে আসুন, ফারজাদ ভাই!ʼʼ

ফারজাদ ঢুকল মাথা নিচু করে। লাবণ্য আবারও হাসল একবার। সে অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকলেও ফারজাদের ডাক শুনে এতক্ষণে ঠিকঠাক হয়ে বসেছে নিশ্চয়ই! তবুও নজরটা নামিয়ে রাখার মানে কী? লাবণ্য বলল, “বসুন।ʼʼ

-“এমন ভাব করছিস যেন, তোর শশুরবাড়ি এসেছি, আর প্রাণভরে ভদ্রমহিলার মতো আপ্যায়ন করছিস!ʼʼ

মুখ গোজ করল লাবণ্য, “সেই সুযোগ দিয়েছেন কখনও? গিয়েছেন আমার শশুরবাড়ি? আর আপনার বাপের বাড়ি কী? এটা আমার বাপের বাড়ি না?ʼʼ

ফারজাদ হাসল অল্প, “চল ঘুরে আসি। ইরফান ভাই আসছে।ʼʼ

-“কোথায় আসছে?ʼʼ

-“যাই আগে চল, কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। আমাকে কল করে ইনক্যুয়েরী করাচ্ছে বারবার, তুই ঠিক আছিস নাকি, এতোবার কল করছিস কেন! কী মারাত্মক ত্যাগী ছেলে, দেখেছিস! তবুও নিজে কল ধরে শুনছে না, তুই মরেছিস না বেঁচেই আছিস এখনও!ʼʼ

ফারজাদের বলার ধরণ দেখে হেসে ফেলল লাবণ্য। এরপর মুখ শক্ত করে বলল, “যাব না আমি। আপনারা যান, ওর সাথে কোথাও যাচ্ছি না।ʼʼ

ফারজাদ দায়সারা কণ্ঠে বলল, “ওকে! তাহলে আরেকজনকে বুকিং করাতে হবে ইরফান ভাইয়ের জন্য। আসলে আমাদের প্লান ছিল, আজ দুটো কাপল শহর ঘুরব, খাবো-দাবো। কিন্তু ইরফান ভাইয়ের সাথে তো আর তুই যাবি না! আমাদের প্লান মোতাবেক ভাইয়ের কাপল লাগবেই! সে হিসেবে অন্যকাউকে হায়ার করতে হবে। আচ্ছা, তুই শুয়ে থাকর এমনিতেও অসুস্থ!ʼʼ

লাবণ্য দাঁতে দাঁত চেপে ধরে কোমড়ে হাত দিয়ে ফারজাদের দিকে তাকাল। চট করে আবার দাঁত কিড়মিড় করেই হেসে ফেলল। ফারজাদ হাসতে হাসতে বের হয়ে এলো ঘর থেকে।

দ্বিজা তৈরী হচ্ছে আয়নার সামনে বসে। ফারজাদ খোঁচা মেরে বলল, “রাণী ক্লিওপেট্টার মতো মাথায় একটা সাপের মুকুটও পরিস, সুন্দর দেখাবে!ʼʼ

দ্বিজা পাত্তা না দিয়ে বলল, “পরতাম। তবে আপনি বললেন জন্য পরব না আর।ʼʼ

ফারজাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল বিছানার ওপর। পায়ের ওপর পা তুলে দোলাতে লাগল। দ্বিজা কানে দুল পরছে। ঘাঁড় কাত করে দেখছে তা ফারজাদ। ভাবনা এলো মনে, একসময় এই মেয়ে কত পাগলামী করেছিল তার সহচর্য পেতে! হুট করে কবে যেন তার পাগলামী ফারজাদকেও প্রভাবিত করে ফেলল। নারী মাত্রই এক রহস্য! তাদে চোখের জল অদৃশ্য এক জাল। যা ফারজাদকে আটক করেছে সংগোপনে কোনো একদিন। ফারজাদ আসলেই কোনোদিন ভেবেছিল না সে সংসারী হবে, কোনো নারীর প্রতি আকৃষ্ট হবে, তাকে এভাবে প্রশ্রয় দেবে নিজের জীবনে। এই মেয়েটাকে ফারজাদ গোটাটা আজও আবিষ্কার করতে পারেনি। সে কখনও মেয়েদের সাথে চলেনি। এখন মনে হয়, এদের মন বোঝা একটা দুর্গম এডভেঞ্চারের চেয়ে কম নয়, তবুও নিশ্চিত নয়–শেষ অবধি গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে কি-না!

কালচে-কমলার সাথে কালোর কম্বিনেশনে সাজানো শাড়ি পরেছে দ্বিজা। ঝুমকো দুল কানে দিলো। ফারজাদের কিনে দেয়া চুড়িদুটোর ওপরই ঝনঝন করে বাজতে থাকা রেশমী চুড়িগুলো হাতের কব্জিতে ঢুকিয়ে নিলো। এই মেয়ে আগে পরেই সাজগোছে খুব পটু! ফারজাদের মনে পড়ল, ফারজাদ ওকে প্রত্যাখান করার পর সেই শখের সাজ ভুলে গেছিল মেয়েটা। মুখে মলিনতা, চোখে কালি পড়েছিল মোটা করে। ফারজাদের বুকে প্রশান্তি অনুভব হলো এটা ভেবে, সে এক নারীর অশান্তি কারণ সে ছিল, রঙহীন ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছিল রঙিন মেয়েটা তার কারণে। আবার তার সংস্পর্শেই রঙ পেয়েছে, চাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে, দেখলে মনে হয় খারাপ নেই তার কাছে মেয়েটা।এটা আত্মসন্তুষ্টি নয় তো কী! নারীকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা মায়াময়ী বলেছেন, সেই মায়াকে কাঁদানো পুরুষ তো নিতান্তই কাপুরুষ!

গুনগুন করছে দ্বিজা। ফারজাদ নিঃশব্দে মুচকি হাসল। সে উপন্যাসে পড়েছে, আর শুনেছেও–মেয়েরা সাজার সময় গুনগুন না করে নাকি সাজতে পারে না। মেয়েদের সবটুকু ফুরফুরে উৎফুল্লতা নিজেকে সুশ্রী করে সাজানোর মাঝে, চোখের কার্ণিশে কালো কাজল আঁকায়, ঠোঁটের পাতায় লাল রঙ লেপ্টে দেয়ায়। নিজেকে লাস্যময়ী সুন্দরী হিসেবে উপস্থাপনা করায় বাঙালী নারী খুব অভিপ্রায়ী! শাড়ি পরলে তাদের সমস্ত অভিলাষের যেন ষোলো আনা পুরো হয়!

হুট করে দ্বিজার নজর পড়ল ফারজাদের হাসিমুখটার দিকে–চোখও যেন তার দিকে চেয়ে হাসছে। দুষাটু বুদ্ধি এলো ভেতরে, আচমকাই জোরে করে গাইল,

‘স্কুল পলাইয়া একটা নজর দেখিতে যাইতাম,
টিফিনের সব টাকা জমাই আবেগ কিনিতাম..ʼ

ফারজাদ ভ্রু কুঁচকে চট করে উঠে বসল। দ্বিজা তাকে উদ্দেশ্য করে গানের কলিটুকু গেয়েছে। ফারজাদ উঠে দাঁড়িয়ে কাছে গিয়ে দ্বিজার মাথায় আলতো করে থাবর দিলো, “আমাকে টিজ করছিস? তুই নিজে জীবনে স্কুল কামাই দিয়ে প্রেম করিসনি?ʼʼ

-“তা করলে কী আর আপনার মতো খাঁটাসকে বিয়ে করতাম?ʼʼ

আবার একটা গাট্টা মারল ফারজাদ, “আমি প্রেম করেছি কে বলেছে তোকে? প্রেম হবার আগেই ছ্যাঁত একটা করে ছ্যাঁকা খেয়ে গেছি, তারপর দেবদাস আমার কাছে শিখতে আসতো দেবদাসগিরি।ʼʼ

দ্বিজা কনুই দিয়ে আঘাত করল ফারজাদের পেটের কাছে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কী কী বারে আসতো দেবদাস আপনার কাছে?ʼʼ

ফারজাদ বিছানায় বসল, “বেশ কিছুদিন আসে না। তাই এক্সাক্ট বারগুলো ভুলে গেছি। তবে এটুকু মনে আছে সপ্তাহে তিনদিন আসতো।ʼʼ

দ্বিজা হাসি আটকে বলল, “আপনি অল্প হলেও প্রেম করেছেন। তা-ই বা করবেন কেন? আপনি কোচিংয়ের টাকা মেরে প্রেমিকাকে মেলায় ঘুরিয়েছেন। সেই হিসেবে ঠকে গেছি আমি। আমি জীবনে প্রেম না করা মেয়ে আপনার মতো ছ্যাঁকা খাওয়া লোকের পাল্লায় পড়েছি।ʼʼ

কথা কেড়ে নিলো ফারজাদ, “আমি বলেছিলাম পড়তে? তোর বয়স আর আমার বয়স? আমার যখন প্রেম করার বয়স হয়েছে, তখন তুই মনেহয় প্রাইমারী স্কুল পাশ করিসনি। তোর যখন প্রেমে পড়ার বয়স যখন হলো, তখন কোনো এক কুক্ষণে তোর আমায় চোখে পড়ল। তো ততদিন আমি তোর জন্য অপেক্ষা করে মনটাকে ব্যাংকে বন্ধক রেখে আসতাম। আমার বাচ্চা ফুফাতো বোনটা কবে বড়ো হবে, আমি তার জন্য ইনট্যাক্ট থাকি, রাইট?ʼʼ

দ্বিজা আর কথা খুঁজে পেল না, তখন মুখ ভেঙচিয়ে বলল, “আমি প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম না। কিন্ডার গার্টেনে পড়তাম।ʼʼ

-“খুব কামাই করেছ তাতে! শেষমেষ ইন্টার পরীক্ষা না-ই দিতে বি-এ পাশ করে বসে আছো।ʼʼ

দ্বিজা ফিরে পিছনে তাকিয়ে দেখল ফারজাদকে। ঠোঁটে হাসি চেপে বলল, “আপনি হিসাবে কাঁচা, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এমনিতেও ভালো করতে পারতেন না। বিয়ে পাশ আমি ইন্টার পরীক্ষা দিয়েই করেছি।ʼʼ

রেস্টুরেন্টে বসে চারজনে খেলো একসাথে। তবে এরপর যে যার বউ নিয়ে আলাদা বের হয়ে গেল। বাইরে বের হবার পর লাবণ্যকে উৎফুল্ল লাগছে, গম্ভীর মেয়েটার মুখে তা ঠিকরে বেরোচ্ছে না ঠিকই, তবে চোখের পাতায় হাসি খেলে যাচ্ছে।

ইরফান হাঁটতে হাঁটতে বলল, “রাগ আমি করেছি, অথচ কথা বন্ধ করেছ তুমি! মেয়ে মানুষ!ʼʼ

লাবণ্য বলল, “মেয়ে মানুষ, তাই না? তাহলে বিয়েটা কোনো ভালো ছেলে দেখে করতে হতো।ʼʼ

-“ছিহ, লাবু! আমার রুচিতে দোষ নেই, আর না শরীরে সমস্যা। ছেলে বিয়ে করব কেন? কিন্তু, আসলেই কি রাগ আমার করা উচিত না?ʼʼ

-“হয়ত উচিত অল্প একটু। আর সেটা ভাঙানোর জন্য আমি ফোন করেছি বেশ কয়েকবার, আপনি রিসিভ করেননি। সুতরাং, রাগ ভাঙানোর ডিউরেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন আর কোনো তোষামদেপনা হবে না আমার দ্বারা।ʼʼ

ইরফান করুণ মুখে বলল, “এবার আমার আবারও বলতে ইচ্ছে করছে, মেয়ে মানুষ।ʼʼ

-“আমার জবাব ওই একই থাকবে।ʼʼ

-“ব্যাপার না। তুমি ছেলে হলেও তোমাকেই বিয়ে করতাম।ʼʼ

নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল লাবণ্য, “আসতাগফিরুল্লাহ!ʼʼ

ইরফান হো হো করে হাসল। লাবণ্য গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছি আমরা? হেঁটে আমার পা লেগে যাচ্ছে।ʼʼ

-“এটা বাংলাদেশের রাস্তা না হলে বহু আগেই তোমায় কোলে তুলে নিতাম। কিন্তু বাংলাদেশে যা-ই করো, চিপায়। খোলা আম বউয়ের সাথে প্রেম নট এলাউড, ইটস হারাম!ʼʼ

ইরফানের বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল লাবণ্য। লাবণ্যর আজকাল মনেহয়, পুরুষ যদি ইরফানের মতো হয়, নারীর সাধ্য নেই তাকে এড়িয়ে চলার। লাবণ্যর মতো অন্তর্মুখী মেয়েটা কবে কবে যেন এই লোকের সংস্পর্শে বাচ্চা মেয়ের মতো আহ্লাদি হয়ে গেছে। পুরুষের সার্থকতা কি এখানে নয়, যে সে কোনো নারীর পাশে সে শক্তি, প্রশান্তি, সুখ, অবলম্বন, এবং নিরাপত্তাদানকারী হিসেবে দাঁড়াবে! এই হিসেবে ইরফান সার্থক। লাবণ্য ভাবনায় এলো, আচ্ছা ইরফান যদি ইরফান না হতো সে কি ফারজাদ থেকে এতো সহজে বের হয়ে আসতো! উহু! পারতো না। সঠিক মানুষটা অপূর্ণতার পরিপূরক হিসেবে কাজ করে, যেখানে পর্বর্তিতীতে আসা ভুল মানুষটি অতীতের যন্ত্রণার আগুনে খড়ের ন্যায়।

ইরফানের বাহু আঁকড়ে ধরল লাবণ্য। ইরফান একটু চমকাল, পরে নিজেও হাত রাখল লাবণ্যর হাতের ওপর। লাবণ্য কেমন ভীত সংকুচিও গলায় প্রশ্ন করল, “আপনি কোনোদিন বদলে যাবেন না তো?ʼʼ

ইরফান হাসল, “যাব তো! তোমার মায়া এবং বদভ্যাস থেকে থেকে বের হতে পারলেই বদলে যাব, প্রমিস!ʼʼ

লাবণ্য বুঝেও অবুঝের মতো প্রশ্ন করে, “কবে বের হবেন আমি নামক বদভ্যাস থেকে?ʼʼ

-“এই জনমটা সময় দাও, বেরিয়ে যাব নিশ্চত!ʼʼ

লাবণ্য চোখ বুজে আবার তাকিয়ে বলল, “হুমম! কাব্যিক কথাবার্তা।ʼʼ

ইরফান রসিকতা করল, “মেয়ে পটাতে আরও কতকিছু করেছি কলেজ লাইফে! এখন বউ ঘরে রাখতে করতে হচ্ছে।ʼʼ

লাবণ্য দাঁত কিড়মিড় করে তাকাল ইরফানের দিকে। ইরফান হাসছে, ওই তার প্রাণখোলা, নিখাঁদ হাসি। লাবণ্য দুটো কিল মারল ইরফানের গায়ে। তারা বাচ্চাদের খেলনার দোকানের সামনে পৌঁছেছে। ইরফান হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে এসেছে ঘুরেফিরে। লাবণ্য অবাক হয়ে চেয়ে রইল সেদিকে।


ঘড়িতে বারোটা বাজছে। সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ।ফারজাদকে ডেকে ডেকে ফারহানার গলা বসে গেছে।ফারজাদ শহর ঘুরে, ফিরেই বসেছে ল্যাপটপটা নিয়ে।ঝুঁকে পড়ে বসে আছে ল্যাপটপের ওপর। রাতের খাবার দ্বিজা ঘরে নিয়ে এলো। কয়েকবার ডাকল, মাথা তুলল না ফারজাদ। ‘হুʼ, ‘হুʼ করল দুয়েকবার, তাকাল না চোখ তুলে। দ্বিজা বিরক্ত হয়ে বসল বিছানার ওপর। খাবার তুলে ধরল ফারজাদের মুখের সামনে। ফারজাদ ক্ষণকাল মাউসে হাত চালিয়ে তবে মুখ তুলে তাকাল। খাবার গালে নিয়ে আবার, ফিরল ল্যাপটপের দিকে। দ্বিজা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “রাত কয়টা বাজে? পুরো গ্রামের লোক নাক ডাকছে, আমরা কি চৌকিদারী করব?ʼʼ

খাবার গিলে বলল ফারজাদ, “কে বলে গেল তোকে গ্রামের পক্ষ থেকে, যে তারা সবাই ঘুমিয়ে নাক ডাকবে?ʼʼ

দ্বিজামুখ শক্ত করল, জবাব দিলো না। কাজ করতে করতেই ফারজাদ বলল, “তোকে আমার এখন তুমি বলে ডাকা উচিত নাকি?ʼʼ

-“হঠাৎ-ই এই খেয়াল এলো কেন?ʼʼ কথা শেষ করে খাবার দিলো দ্বিজা ফারজাদের গালে। ফারজাদ আর কথা বলতে পারল না। কেশে উঠল একটু। দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে গেলে, ফারজাদ হাত ইশারা করে নিষেধ করল। খাবার গিলে দ্বিজার ওড়নার প্রান্ত টেনে নিয়ে মুখ মুছল, এরপর বলল, “আজ ইরফান ভাইকে দেখলাম, লাবণ্যকে তুমি সম্বোধন করছে..ʼʼ

দ্বিজা ফারজাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল, “তারপর?ʼʼ

ঘাঁড় ঝাঁকাল ফারজাদ, “উহু! মুখে আসবে না মনেহয়। সময় লাগবে।ʼʼ

-“কী দরকার! শুনতে তো আর খারাপ লাগে না।ʼʼ

ভ্রু জড়াল ফারজাদ, “ভালো লাগে?ʼʼ

দ্বিজা উত্তর না দিয়ে খাবার এগিয়ে দিলো। দ্বিজার মুখে এখনও সাজ রয়েছে, ঘামে একটু এবরোথেবরো হয়ে গেছে কাজল, তা যেন আরও বেশি প্রাকৃতিক লাগছে মেয়েটার মুখের ওপর। ফারজাদ মুখ ঘুরাল, “আর খাব না, দিস না। তুই খেয়ে নে।ʼʼ

“যা খাবার বেঁচে আছে, আমি শেষ করতে পারব না। হাঁ করুন জলদি। সারারাত ভরে খাওয়াব না আমি।ʼʼ একটু কঠিন গলায় বলল দ্বিজা।

ফারজাদ হেসে ফেলল, “প্রেমে পড়লে কতকিছু সহ্য করতে হয়। পুচকে মেয়ের ধমক শুনছি আমি, কী অধঃপতন আমার!ʼʼ

ভ্রু উচাল দ্বিজা, “প্রেমে পড়েছেন?ʼʼ

ফারজাদ নজর নত করল। ক্ষণকাল ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখে জিজ্ঞেস করল, “প্রেম কী?ʼʼ

-“বুঝিনা।ʼʼ

-“ভালোবাসা বোঝো?ʼʼ

দ্বিজা তড়িৎ গতিতে চোখ তুলল। অদ্ভুত এক অনুভূতি, ফারজাদের ‘তুমিʼ সম্বোধনে। অবুঝের মতো থমকানো স্বরে মাথা নাড়ল, “উহু!ʼʼ

-“অথচ তবুও দাবী করিস, প্রেমে পড়ার, ভালোবাসার!ʼʼ

-“আর করব না?ʼʼ

জবাব দিলো না ফারজাদ। হাত দিয়ে প্লেট ঠেলে বোঝাল, সে আর খাবে না। ল্যাপটপটা গুটিয়ে বেড-সাইড টেবিলের ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল। দ্বিজা ডাকল, “কোথায় যাচ্ছেন এখন আবার?ʼʼ

-বহুদিন পর..

দ্বিজা চেঁচিয়ে উঠল, “ডাক্তার নিষেধ করেছে।ʼʼ

-“করেনি।ʼʼ

-“শুনেছেন আপনি, করেনি?ʼʼ

-“খেতেও বলেনি, মানাও করেনি। তাছাড়াও আমার হার্ট ড্যামেজ না, যে সিগারেট খেতে নিষেধ করবে।ʼʼ

-“তার মানে আপনি আমার কথা শুনবেন না তাই তো!ʼʼ

পেছন ফিরে তাকাল ফারজাদ, “নিজের কথাও সবসময় সবটা শুনতে নেই, দূর্বল ভেবে বসে মনটা।ʼʼ

-“নিজের মন নিজেকে দূর্বল ভেবে বসে?ʼʼ

-“হু, আর নিজের কাছে দূর্বল উপস্থাপিত হবার চেয়ে দূর্বলতা আর নেই। তাই তোর কিছু কথা মন চাইলেও শুনব না আমি। অর্ধেক হলেও টেনে আসি, তুই ঘুমানোর ব্যবস্থা কর।ʼʼ

দ্বিজা হতবিহ্বল চোখে চেয়ে রইল ফারজাদের যাবার পানে। আবারও মনে হলো, সে যতবার ভাববে সে ফারজাদকে আয়ত্ত করে ফেলেছে, ততবার তাকে হতাশ করে ফারজাদ নতুনভাবে নিজের অস্তিত্ব জানান দেবে। কিছু মানুষ হয় এমন, যারা মনস্তাত্বিক মারপ্যাচ জানে খুব ভালো। তাদের সম্বন্ধে সঠিক ধারণা পোষণ করার উপায় নেই, যেকোনো মুহুর্তে তা বদলে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিজার মনে হলো, সে নিজেও সেরকম একটা কিছু গ্রহন করে ফেলেছে নিজের মাঝে। যে মেয়েটা সকালে কেমন শক্ত সামর্থ্য রহস্যময়ী নারীর মতো নীরবে কেঁদেছে, সে কেমন অল্প সময়ের ব্যবধানে নিজের চাঞ্চল্যে ফিরে এসেছে। বাস্তব জীবনটা খুব রহস্যজনক। মানুষ তো বিলাসিতা করে গল্প, উপন্যাসে রহস্য খুঁজতে যায়। যেখানং রহস্য যত মানব মস্তিষ্কে নিহত।

সত্যিই ফারজাদ অর্ধেকটা শেষ করল সিগারেট। সেটাও পুরোটা টেনে নয়, হাতে ধরে রেখে ছাই করে ফেলে দিলো। রুমে ফিরে দেখল, দ্বিজা অপরপাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে। ফারজাদ হাসল একটু। একটানে দ্বিজাকে উঠিয়ে বসালো। বাহু চেপে ধরে রাখল, যাতে দ্বিজা আবার শুয়ে পড়তে না পারে। এরপর বলল, প্রথমত রাগ ভাঙানোর অভিজ্ঞতা আমার নেই। সুতরাং, রাগটাগ ঝেরে ফেল নিজে থেকেই, আমি কিন্তু সকালে চলে যাচ্ছি, এখন রাগ করে থাঞকা ঠিক হবে না। তার চেয়েও বড়ো কথা, এখন কাঁদবি না।ʼʼ

দ্বিজা শুয়ে পড়ল টান হয়ে। ফারজাদ উঠে গিয়ে বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে এসে মাথাটা ঠিক দ্বিজার বুকের বামপাশে রেখে, ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। টের পেল দেহের নিচের ছোট্ট দেহটা কেঁপে কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। ফারজাদ অস্পষ্ট স্বরে বলল, কাঁদিস না দ্বিজা। তোর কান্নার সুর আমার কানে গেলে আমি এলোমেলো হয়ে যাই, পাগলামী চড়ে বসে মাথায়। সকালে উঠতে হবে, এখন একটু ঘুম পাড়িয়ে দে। আবার কবে তোর কাছে ঘুমাই না ঘুমাই।ʼʼ

এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল দ্বিজা। ফারজাদ আরও শক্ত করে চেপে জড়িয়ে ধরল পুরো শরীরটা মেলে। দ্বিজার গলায় ওড়না ছিল, সেটাতে ফারজাদ বিঘ্ন বোধ করছিল। টান দিয়ে ওড়নাটা খুলে একপাশে রেখে, গলার কাছে মুখ এগিয়ে দ্বিজার হাতের তালু বালিশে চেপে ধরে চোখ বুজে পড়ে রইল ওভাবেই। গরম ভারী শ্বাস দ্বিজার গলায় উততলা ঢেউয়ের মতো আছড়ে আছড়ে পড়ছে। দ্বিজার শরীরে শিরশিরানি ধরে যায়, মন ও দেহ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে সেই নিঃশ্বাসের আওয়াজ কানে এসে লাগাতে। পুরো শরীরটা ফারজাদের দেহের নিচে। কান্না থামল। লোকটা কাল থেকে আর এভাবে চেপেচুপে ধরে শোবে না। সে কি বোঝে না, দ্বিজার আজকাল রাতবিরাত, যখন-তখন প্রয়োজন পড়ে যায় তার সহচর্যের! সব তো তার জন্যই হয়েছে! আজকাল বড্ড স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে শরীরটা। আর তা লোকটার জন্যই। এরপরেও সে একা মানুষটাকে ছাড়া থাকবে কী করে! এই অভ্যাস, স্পর্শআসক্তি, মায়ার টান, দিনে-রাতের বউ বউ কর্তব্য! কাঁপুনি দিয়ে উঠল শরীরটা। একহাতে ফারজাদের ঘাঁড়ের ওপরের চুল মুঠোয় আঁকড়ে, ওপর হাতে পিঠ খাঁমছে ধরল। ফারজাদের নিঃশ্বাস আরও ভারী হয়ে উঠেছে, উতলা লাগছে তার শ্বাসের উঠানামা।

চলবে…

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

শেষপর্ব (বর্ধিতাংশ).

আজানের পর পরই ঘুম ভাঙল দ্বিজার। এখনও পুরোপুরি ফর্সা হয়নি আকাশ। কেচি গেইট খোলার আওয়াজ পেয়েছে সে, আজাদ সাহেব ফজরের নামাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। সে উঠে বাথরুমে গেল গোসল করার উদ্দেশ্যে। ফারজাদ ঘুমাচ্ছে। ঘড়িতে পাঁচটা বাজতে চলেছে। সাতটার গাড়ি ফারজাদের। গোসল দিয়ে জাগালেই হবে।

গোসল শেষে বেরিয়ে ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিলো। ভেজা চুলে তোয়ালে চালাতে চালাতে বিছানার দিকে নজর গেল। নজর থামল। ফারজাদ এ কাত হয়ে শুয়ে আছে। দু হাতের তালু একত্র করে চোয়ালের নিচে রাখা। দেখতে বড্ড আদুরে লাগছে। লাইট জ্বলে উঠতেই একটু নড়েচড়ে উঠল। দ্বিজা হাসল মৃদু। এই হাসিতে যদিও বুক ছেঁড়া যন্ত্রণা দমবে না। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

একবেলা বৃষ্টি হয় তো পরের বেলা হালকা কুয়াশার দেখা মেলে। ভোর সকালের আধো ফর্সা আকাশ-বাতাসে ধোঁয়ার মতো হালকা কুয়াশা ছিটিয়ে আছে। দ্বিজার মনে পড়ে গেল–এরকমই এক কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে সে প্রথম অনুভব করেছিল ফারজাদকে। সেদিন সে ছিল এ বাড়ির নাতনী, ফারজাদের ফুফাতো বোন। আজ এ বাড়ির বউ, ফারজাদের ঘরনী। ঠান্ডা বাতাস টেনে নিলো গাঢ় নিশ্বাসের সঙ্গে। রান্নাঘরে গেল এক কাপ কফি বানাতে। ভালো বানাতে পারেনা কফি, ঢাকাতে ফারজাদের কফি খাওয়ার হলে নিজেই বানিয়ে নিতো। বেশ যত্ন করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করল কফিটা ভালো বানানোর।

কফির মগটা এনে রাখল বেড-সাইড টেবিলের ওপর। ফারজাদ এখনও ওভাবেই শুয়ে আছে এক কাত হয়ে। বিছানা ঘেষে হাঁটু ভেঙে বসল মেঝের ওপর। চুলে হাত বুলিয়ে ডাকল ফারজাদকে, “সকাল ছয়টা বাজতে যাচ্ছে, উঠুন। আপনার বাস সাতটায়, দেরি হলে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবেন না!ʼʼ কণ্ঠস্বরটা কেঁপে উঠল দ্বিজার কথাটা বলতে গিয়ে।

ফারজাদ চোখ খুলল। অলস ভঙ্গিতে উঠে বসতে বসতে বলল, “শাড়ি পরেছিস কেন?ʼʼ

-“আপনি চলে গেলে আর তো পরতে পারব না! আজ শেষবার পরেছি।ʼʼ

ফারজাদ হেসে ভ্রু জড়াল, “আমি যে গিয়ে শহীদ হয়ে যাব, তা কনফার্ম? আর ফিরব না, তুই শাড়িও পরবি না?ʼʼ

দ্বিজা অসহায় মুখে তাকাল। ফারজাদ হাসার চেষ্টা করল, “পাগলি, সিরিয়াস হচ্ছিস কেন? এমনি বলছি।ʼʼ

দ্বিজা অনুরোধ করে উঠল, “আমায় নিয়ে গেলে ক্ষতি কী হবে?ʼʼ

-“ক্ষতি আমার না, তোর হবে। ভরা ক্যারিয়ার গড়ার সময় তোর, সংসার করার সময় না। এখানে থাকবি, সবটুকু মনোযোগ পড়ালেখায় লাগাবি। এখানে সমস্যা হলে ফুপুর কাছে গিয়ে থাকবি। আমার সাথে বের হ, তোকে ও বাড়িতে রেখে যাই। ফুপা চলে যাবে, দু-একদিনের মাঝে। চলে গেলি ফিরে আসবি ইচ্ছে হলে।ʼʼ

ফারজাদ গোসলে ঢুকল। দ্বিজা বসে রইল উদ্ভ্রান্তের মতো। জানা নেই কতটুকু পারবে ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে। তবে সর্বোচ্চ চেষ্টায় থাকতে হবে। মাঝখানে যা হয়ে গিয়েছে, তা ভালো-খারাপ মিলে অবশেষে ভালোই হয়েছে। ফারজাদকে পাওয়ার পর তার আর চাহিদাই বা কী বিশেষ! এখন পড়ালেখা আর প্রতীক্ষা। দ্বিজা নিজেও চায়নি এতো তাড়াতাড়ি সংসারী হয়ে যেতে, তবে পরিস্থিতি জোর করল। আবার একটা সুযোগও দিলো নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার। পারিপার্শ্বিক সব মিলিয়ে চিন্তা করলে এর চেয়ে ভালো আর হয়না। ফারজাদকে পাওয়া চিরতরে, এ বাড়িতে সেই সুবাদে জায়গা পাওয়া, যেখানে তার সমস্ত ভালোবাসার মানুষ এবং সুখ রয়েছে, পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া– সবই তো হচ্ছে। এতো সব আশানুরূপ সুখের মাঝে বেশ খানিকটা প্রতীক্ষা তো, পরিপূরক। শুধুই সুখের মূল্য থাকেনা, নিখাদ সুখের কদর করা যায়না। সেটাকে সুখ নয় বরং পেয়ে যাওয়া সাধারণ এক অ-বিশেষ অনুভূতি মনে হয়। সুখের মাঝে অল্প খানিক অপূর্ণতা থাকলে সেটা বেশি কদরের এবং উপভোগ্য। সুখপাখি খোলা আসমানে উড়তে উড়তে এসে কখনও এক পলের জন্য কাছে বসে পর মুহুর্তে উড়ে গেলে বরং তার সঠিক মূল্যবোধ উপলব্ধিতে আসে। সেই অপরিপূর্ণতাজনক পরিপূর্ণতাটুকু হলো ফারজাদের ঘরে অবস্থান করে ফারজাদের প্রতীক্ষা করার প্রহরগুলো।

কথাগুলো ভাবতেই অল্প-সল্প সুখে মনটা নেচে উঠল। সব ভালো লাগছে, আর কোনো আফসোস বা হতাশা নাড়া দিচ্ছেনা ভেতরে। এই তো ফারজাদের ঘর! এখানেই থাকা হবে, ওই ফারজাদের টেবিলে বসে পড়া হবে। এককালে ওই টেবিলে বসে ফারজাদের কাছে পড়তো সে, লাবণ্য। ভুলভাল কথা বললে, চটপট তা শুধরে দিতো ফারজাদ। হেসে ফেলল দ্বিজা। এজন্যই বোধকরি বলা হয়–পরিস্থিতি ব্যাপক শক্তিমান, যা কতশত অবুঝকে বুঝমান, অসম্ভবকে সম্ভব, না মেনে নেয়া বিষয়গুলোকে সাবলীল রূপে মানিয়ে নিতে যত্ন করে শিখিয়ে দেয়। এই তো খুশি লাগছে। এই ঘর, এই বিছানা, এ বাড়ির যৌথ লোকগুলো, পেছনের বাগান, তার ওপারের মাঠ, নানুর ভালোবাসা, নিজের নাম ও ভাগ্যের সাথে জুড়ে যাওয়া ফারজাদের নাম—আর চাওয়ার মতো কিছু খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছেনা। সবই তো হাতে হাতে পেয়ে গিয়েছে কবে কবে যেন। স্বামী মানুষের বিদেশও থাকে, দূরেও থাকে। স্বামীই কেন, এবার প্রেমিক হোক ফারজাদ! প্রেমিকের তরে অপেক্ষা নাকি প্রেমিকার প্রেমমূলক ব্রত! সে নাহয় সেই ব্রতী হবে। প্রেম করার ইচ্ছে চাপা পড়ে গেছিল পরিস্থিতির কাছে, তবে রয়ে গেছিল সংগোপনে কোথাও। সেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠুক। আজ থেকে ফারজাদ প্রেমিক, মামাতো প্রেমিক। তাদের রিলেশন হলো–লং ডিস্টেন্স রিলেশনশীপ!

আনমনেই মুচকি হাসল দ্বিজা। হালকা লাগছে সবটা। প্রেমিক আজ চলে যাবে, দেখা করার জন্য আবার কতদিন অপেক্ষারত থাকতে হবে। মামাতো ভাই প্রেমিক যখন এসবি অফিসার, তার বাড়িতেই থাকে দ্বিজা, এবং অপেক্ষা করে প্রেমিকের বাড়ি ফেরার! আরে! দারুণ তো শিরোনামটা! ধীরে ধীরে ভাবনাগুলো দ্বিজাকে পুলকিত করে তুলল, যেন বাচ্চার হাতে তার কাঙ্ক্ষিত খেলনা তুলে দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা ভেবে মনে সুখ সুখ ঢেউ এঁকে-বেঁকে দোল খাচ্ছে।

ফারজাদ বের হলো, গোসল শেষে। দ্বিজা বলল, “নানু বলতো মেয়েরা মায়ের কপাল পায়। আমার ক্ষেত্রে তা সত্যি!ʼʼ

ফারজাদ কটাক্ষ করল, “ব্যাপারটা বিজ্ঞান দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়। স্বামী দূরে থাকার এই ক্যাপাসিটিটা তুই জেনেটিক্যালি তোর মায়ের কাছে পেয়েছিস। মানে জিনগত বৈশিষ্ট্য আর কী! এখানে আমার কোনো দোষ নেই।ʼʼ

দাঁত কিড়মিড় করল দ্বিজা। ফারজাদ বসল বিছানার ওপর। মাথা মুছতে মুছতে বলল, “তোকে বউ বউ লাগছেনা।ʼʼ

তোয়ালেটা কেড়ে নিলো দ্বিজা। নিজে মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “তো কি স্বামী স্বামী লাগছে?ʼʼ

-“স্বামীরা শাড়ি পরে আজকাল?ʼʼ

দ্বিজা জবাব দিলো না, চোখ বাঁকা করে তাকাল। ফারজাদ বলল, “প্রেমিকা প্রেমিকা লাগছে। ওই যে দেখিস নি, শাড়ি-টারি পরে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে আসে না, মানে ডেটে আসে পার্কে বা রবীন্দ্র সরোবরে? তবে খোঁপাতে আর্টিফিশিয়াল ফুলের ছড়া মিসিং, ইভেন তুই খোঁপাই করিসনি।ʼʼ

হাসি ফুটল দ্বিজার মুখে। মাথা নামিয়ে আস্তে করে বলল, “তাহলে খোঁপা করে ফেলি?ʼʼ

-“নাহ! সময়ের অভাব। যেহেতু ফুল কিনে গুজে দিয়ে প্রেমিক সাজার সুযোগ নেই আমার, সুতরাং তোরও খোঁপা করার যুক্তি নেই। আমার এ জীবনে প্রেমিক হবার নয়।ʼʼ

কথা বলতে বলতে শার্ট-প্যান্ট পরে ফেলল ফারজাদ। দ্বিজা বলে উঠল, “আমার তো প্রেমিকা হবার আছে!ʼʼ

উঠে দাঁড়াল ফারজাদ, “তাই নাকি?ʼʼ

-“হু, তা-ই তো রেখে যাচ্ছেন। ধরুন, দূরবর্তী প্রেম বলা চলে। স্বামী তো ঘরে থাকে, কাছে থাকে। আপনি দূরে চলে যাচ্ছেন, নিষিদ্ধ হচ্ছেন। নিরুপায় হয়ে যাচ্ছি আমি। যেখানে আপনাকে দেখার, ছোঁয়ার অনুমতি বা সুযোগ নেই। এরকমই হয় প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক!ʼʼ

ফারজাদ তাকিয়ে রয় ক্ষণকাল দ্বিজার মুখের দিকে, এরপর বলে, “তুই আমার প্রেমে কী দেখে পড়েছিলি?ʼʼ

-“প্রেমে পড়েছিলাম, তা বলেছি কখনও?ʼʼ ফারজাদের হাতে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফির মগটা তুলে দিলো দ্বিজা

-“না, বলিসনি। তাহলে?ʼʼ কফির মগে চুমুক দিলো ফারজাদ।

দ্বিজা নাক শিউরালো, “এই বাড়িতে, এই ঘরে কে বা কোথাকার মেয়ে আপনার বউ হয়ে এসে জল্লাদগিরি করবে, সব কিছুতে ভাগ বসাবে, দখল করবে সবটা। এটা ভেবে সহ্য হয়নি, গায়ে জ্বালা ধরে যেত। ছোটোবেলা থেকে এখানে আমাদের দখল চলছে, তাতে অন্যকারও হক সহ্য করা যায়না। তাই..

ফারজাদ ফিরে তাকাল, “মেয়ে মানুষ হিংসুটে হয় জানতাম, কিন্তু এমন সাংঘাতিক হিংসুটে হয়!?ʼʼ

দ্বিজা মুখ ভেঙচাল। ফারজাদ দুষ্টু হাসল, “তাহলে তোকে আরেকবার বিয়ে করতে হবে, ঠিক একইভাবে। আমার ছোটোচাচার ছেলে লিমন আছে তো! তারও তো বিয়ে হবে কয়দিন পর, তার বউ এসে দখলদারী করবে এখানে, তা ঠেকাবি না তুই?ʼʼ

দ্বিজা কপালে হাত ঠেকিয়ে হেসে ফেলল। ফারজাদ এগিয়ে এলো। দুই চোয়ালের দুপাশ চেপে ধরল দু হাতে। চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “যাবি না ওই বাড়ি?ʼʼ

দ্বিজা মাথা নাড়ল, “যাব, তবে আপনার সঙ্গে নয়। আপনার সাথে বেরিয়ে গেলে আপনি ফিরে আসার তাগিদ আর কর্তব্য ভুলে যাবেন। সান্ত্বণা থাকবে, আমার বাপের বাড়ি সঁপে দিয়ে এসেছেন আমায়। কিন্তু আপনি বেরিয়ে যাবেন, আমি এ বাড়ির দরজার কপাট ধরে দাঁড়িয়ে থাকব। যাতে সব সময় এই তাড়া থাকে আপনার, কেউ অপেক্ষা করছে আপনার ঘরে, যে করেই হোক ফিরতে হবে, তার জন্য ফিরতে হবে আপনাকে। আমি এখানেই, এই ঘরে থেকে পড়ব, আর অপেক্ষারত থাকব আপনার, বুঝেছেন, আপনি!ʼʼ

চোখ ছলছলে হয়ে উঠেছে মেয়েটার। ফারজাদ এক হাত গাল থেকে নামিয়ে দ্বিজার কোমড় খামছে আরও কাছে নিয়ে এলো ওকে। বুকের সাথে বুক মিশিয়ে দাঁড় করিয়ে গাঢ় একটা চুমু খেল দ্বিজার ঠোঁটের কিনারায়। এরপর কপালের মাঝ বরাবর একটা শক্ত চুমু দিলো। কপাল থেকে ফারজাদ ঠোঁট সরানোর পর, দ্বিজা পা উঁচিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। ফারজাদ হেসে নিজেই একটু নিচু হলো। দ্বিজা ফারজাদের দুই গাল, ঠোঁটের পাশ, কপাল, শেষ অবধি গলার উচু হয়ে থাকা স্বরযন্ত্রের ওপর চুমু খেল। ভেজা স্বরে সতর্ক করল, “খুব বেশি অপেক্ষা করাবে না, প্রেমিকবাবু। তাড়াতাড়ি ফিরবে। আমার কিন্তু বুক ভেঙেচুড়ে কান্না আসছে, আমি তবুও কাঁদছিনা। এই ধৈর্য্যের বদলে কী দেবে আমায়?ʼʼ

-“আমিটাকে নিবি? আর কিছু নেই তোর মতো পাগলিকে দেবার মতোন।ʼʼ

-“ও আমি বহু আগেই হাসিল করে ফেলেছি। নতুন কিছু দিন।ʼʼ

-“একটা বাচ্চা দিই, নিবি?ʼʼ কথা শেষে চোখ মারল ফারজাদ। চোখের পানি ছাপিয়ে লজ্জায় মাথা নুইয়ে হেসে ফেলল দ্বিজা।

ফারহানা বেগম কাঁদলেন ফারজাদকে ধরে। প্রতিবারই কাঁদেন এভাবে। যাওয়ার সময় এমনভাবে বিদায় দেন, যেন আর ফিরবে না ফারজাদ। প্রতিবার বিরক্ত হলেত আজ হলোনা, নরম কণ্ঠে বলল, “আম্মা! কান্না থামান। আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। দেখবেন ওই ফাঁকিবাজ যেন পড়ালেখায় ফাঁকি না দিতে পারে। আমি তো থাকবো না, এক নম্বরের ফাঁকিবাজ কিন্তু।ʼʼ

দ্বিজা ঠোঁট কামড়ে মাথা নত করে অল্প হাসল। ফারজানা বললেন, “তোর আব্বুর সাথে দেখা করলি না?ʼʼ

-“আরৎয়ে গিয়ে করে নেব। সাতটার গাড়িচলে গেছে অলরেডি। পরের গাড়িতে যাই, এজন্য গতকাল টিকেট কাটিনি।ʼʼ

ফারজাদ যখন বেরিয়ে গেল ব্যাগটা নিয়ে। দ্বিজা বাড়ির কেচি গেইটের পাল্লা একহাতে ধরে অদ্ভুত চোখে চেয়ে রইল ফারজাদের যাওয়ার দিকে। মনে মনে প্রার্থনা করে উঠল, ‘এভাবেই যে উল্টো পথে ফিরে আসে, খুব শীঘ্রই! সহিসালামতে ফিরে আসে যেন আবার একবার, কোনো বিপদ না হোক আর। জীবন তো একটাই, তবুও এত জটিলতা কেন থাকতে হবে?ক’টা দিন সরলভাবে বাঁচলে এমন কী ক্ষতি!ʼ

যতদূর দেখা গেল ফারজাদকে, চেয়ে রইল। বাকি জনেরা ভেতরে ঢুকে গেলেও দাঁড়িয়ে রইলেন ফারহানা বেগম, এবং দ্বিজার। ফারজাদ ফিরে তাকায় না আর, দ্বিজা আশাও করল না। ফিরে তাকালে আর যেতে দিতে ইচ্ছৃ করবেনা, চলে যাক। অপেক্ষা করার অতৃপ্ত সুখটুকু উপভোগ করার রয়েছে।


ঢাকা আসার পর সপ্তাহ দুয়েক পেরিয়ে গেছে। এরপর যতবারই ফারজাদ মাসুদের কাছে গেছে, খুব স্বাভাবিক এবং শান্ত আচরণ করেছে লোকটার সঙ্গে। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করেনি বিশেষ। কাল রাতে গোপন সূত্রে খবর এসেছে আলামিনকে ইন্ডিয়া পাঠানো হয়েছিল। দেড় মাসের বেশি সময় ইন্ডিয়াতে থেকে দেশে ফিরছে দিন দু-একের মাঝে।

ল্যাপটপ থেকে উঠে পড়ল। শরীরটা ক্লান্ত লাগছে, সকাল থেকে চা-বিস্কুট ছাড়া কিছু পেটে পড়েনি রান্নার অলসতায়। দ্বিজার কথা মনে পড়ে এইসব সময়ে খুব। মেয়েটা খুব একটা রান্নাবান্না জানেনা, তবুও চেষ্টা করতো, রান্না করে রাখতো। এটাই বোধহয় ঘরের ঘরনী। ঢাকা এসে সোজা নতুন ফ্লাটে ওঠা হয়েছে। এই ফ্লাটটা যেমন সুন্দর তেমন বড়োলোকি–ফারজাদের বক্তব্য। আগেরটা বেশ সংকীর্ণ আর ঘুপছি ধরণের ছিল, এটা খোলামেলা এবং অভিজাত। আর সঙ্গী হলো একাকীত্ব। আগে এই একাকীত্বটুকু কোনোদিন অনুভব হয়নি। এবার প্রথম, নতুন অভিজ্ঞতা। দ্বিজাকে বিশেষ কল করেনা নিজে থেকে। মায়া বাড়বে, কাজে মনোযোগভ্রষ্ট হবে, মেয়েটা নিজেও আশায় থাকবে নিয়মিত কলের, তাতে পড়ালেখা থেকে খেয়াল সরবে। দ্বিজা নিজেই কল দেয়। মাঝেমধ্যে তাও বন্ধ করে দেয় অভিমানে। ফারজাদ বোঝে, তার কাছঃকল না পাওয়ার ক্ষোভ ও অভিমান। বুঝেও নির্লিপ্ত সে। মাঝেমধ্যেই ইঙ্গিত-ইশারায় বোঝায় দ্বিজা, ফারজাদ দ্বিজাকে একটুও ভালোবাসে না, একটুও মূল্য নেই ফারজাদের জীবনে তার। ফারজাদের বুঝেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। মেয়েটাকে বোঝাতে গেলে বরং সঠিকটা তো কোনোদিন বুঝতে চাইবে না, উল্টো বুঝে কষ্ট পাবে। এখানে প্রতিটা দিন কাটছে একেকটা প্রজেক্টের পেছনে ছুটে। উপরমহল থেকে প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছে অফিসারদের ওপর। সেসব চাপ মোটেই ভদ্রভাবে দেয়া হয়না। প্রশ্ন তোলা হয় যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, কাজের প্রতি পরিশ্রমের তারতম্য এবং কর্তব্যপরায়নতার ওপর। যা সহ্য করা সহজ নয়। এসব বুঝবে না দ্বিজা কোনক্রমেই। সরকারী চাকুরী হলো ফরমায়েশ খাটা, তার চেয়ে বেশি সক্রিয়তার কাজে হলো প্রসাশনের কাজ। সুষ্ঠুভাবে এ কাজ সম্পন্ন করতে গেলে সর্বদা তৎপর থাকতে হয়। এমন নয়, এখন অলস লাগছে, পরে তুলে দেয়া যাবে অবসরে করে। এক সেকেন্ডের ব্যবধানে চাল বদলাতে পারে।

এরপর থেকে কেটে গেল আরও বেশ কিছুদিন। এখন আর দ্বিজাও কল করে না অভিমানে। ফারজাদের মিশন চলছে পুরোদমে। তারও ফুরসৎ নেই কল যোগাযোগ করার।

আলামিন দেশে এসেছে তা নিশ্চিত ফারজাদ। তবে কোথায় আছে সেটা খুঁজে বের করা খোঁজ না পেলে সুঁচ খুঁজে বের করার মতোই ব্যাপার।

সকালে উঠতে দেরি হলো পরিকল্পনার বিপরীতে। সাতটা বেজে গিয়ছে। আজ আর ওয়ার্কআউটের সময় পাওয়া গেল না। রান্নাঘরটা বেশ বড়ো এই ফ্লাটের, দ্বিজার আসলে রান্নাবান্নায় সুবিধা পাবে ভালোই। আনমনেই হাসল ফারজাদ। বেশ কিছুদিন কথা হয়নি তাদের। মেয়েটা নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করে অভিমান লুকিয়ে রেখেছে বুকে! রাতে ফেরার পথে পাউরুটি এনে রেখেছিল। একটা ডিম হালকা তেলের ওপর গড়িয়ে, এককাপ কফি বানালো। টেবিলে বসে হঠাৎ-ই আম্মার কথা মনে পড়ল। এতক্ষণে এই মাখন, পাউরুটি, কফি দেখলে নির্ঘাত বলতো, “বড়োলোক হইছে, জমিদারী ভাজ!ʼʼ

অফিসে গিয়ে সামাদের খোঁজ করল। সামাদ এসে পৌঁছায় নি এখনও। নিজের আসনে বসে মনিটরটা অন করতেই সামাদ এসে হুড়পার করে সালাম দিলো। মাথা না তুলে সালামের জবাব দিয়ে বলল ফারজাদ, “মাসুদ লোকটাকে কাস্টাডিতে শিফ্ট করুন, আর ওখানে আপনি-আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না। দ্রুত করুন।ʼʼ

সামাদ মাথা নেড়ে চলে গেলে ফারজাদও উঠে এড এসপি স্যারের সঙ্গে একবার দেখা করে কাস্টাডিতে গিয়ে পৌঁছাল।

মাসুদ বসে আছে চেয়ারে। তার চোখে-মুখে কোনোরকম চিন্তার ছাপ নেই। অবশ্য পুরোনো জখমগুলো কালচে হয়ে আছে। ফারজাদ গিয়ে তার সামনের চেয়ারে বসল। ডিউটিতে ফিরে বেশ কয়েকবার ফারজাদ লোকটাকে কাস্টাডিতে নিলেও বিশেষ প্রশ্ন করেনি। লোকটার নিশ্চিন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “আপনারা আমার কাছে কী চান? কোনোরকম ভনিতা না কর বলুন। দরকার পড়লে সময় নিন, চুপ থাকুন, এরপর জবাব দিন। তবে ভনিতা নয়। আমি যা জিজ্ঞেস করেছি, তার জবাব চাই শুধু।ʼʼ

মাসুদ মুখ খুলল, “আমি সামান্য এক এজেন্ট, স্যার!ʼʼ

ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, “আপনার টিমের সাথে লাস্ট কবে যোগাযোগ হয়েছে আপনার?ʼʼ

লোকটা জিতে যাওয়া হাসি হাসল, “দুদিন আগে।ʼʼ

ফারজাদ পাল্টা হাসল, “আমাদের অফিসাররা আপনাদের প্রতি বেশ অনুগত, বাধ্য! কলে কথা বলতে চেয়েছেন, নিরাশ করেনি। আসলে করা উচিতও নয়, যোগাযোগ হলো মানুষের মৌলিক চাহিদা। খুব সুন্দর একটা ব্যাপার। আসলে প্রথম প্রথম চাকরীতে ঢুকে আমি খুব ন্যায়পরায়ন হতে চাইছিলাম, নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে চেয়েছিলাম। তার ফল কী হলো? জান নিয়ে টান পাড়াপাড়ি! অথচ পরে দেখলাম, আমার সিনিয়রেরা ব্যাপক সচেতন। কারও কারও চাকরীর বয়স ত্রিশ পার হচ্ছে, তবুও একটা খাঁমছি অবধি খায়নি আতঙ্কবাদী অথবা স্মাগলারদের হাতে। শ্যাহ! শালার নিজের বোকামি বুঝতে সোজা বুকে গুলি খেতে হলো। তবে মানুষ ভুল করে হোঁচট খায়, এবং হোঁচটের ব্যথা থেকে শিক্ষাগ্রহন করে। আমার বুকের ব্যথা এখনও লেগে আছে, জ্বলজ্বল করছে ঘা। শুধু শুধু এই দুনিয়ায় ইনসাফ দেখাতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবার কোনো মানে নেই, এই কথাগুলো আমি বুঝেছি হাসপাতালের বেডে শুয়ে থেকে। আর তা বুঝে অন্যরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।ʼʼ

একদমে কথাগুলো বলে মাসুদের দিকে তাকাল ফারজাদ। লোকটা দ্বিধান্বিত চোখে চেয়ে আছে। বুঝে উঠতে পারছে না ফারজাদের হাবভাব অথবা কথাগুলোর সত্যতা। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে ঝুলছে লোকটা। ব্যাপারটা বুঝে চমৎকার হাসল ফারজাদ, “দেখুন, মাসুদ ভাই। জান বাঁচানো ফরজ, অপরাধী ধরা নয়। আর অপরাধী ধরতে গিয়ে যদি সেই জানে আঁচ আসে, ফরজ ছুটে যাবার আশংকা রয়েছে। যা ঠিক নয়। আমার বড়ো অফিসারেরা দিব্যি সরকারের কাছে বেতন পাচ্ছে, তার চেয়ে মোটে অঙ্ক হাতাচ্ছে আপনাদের কাছে। বিন্দাস দিন কেটে যাচ্ছে তাদের। আর আজকালকার দুনিয়ায় ওই কাগজের নোট ছাড়া আপনার মরদেহও অচল। ভালোভাবে মৃতদেহকে সৎকার করে, খয়রাত, জিয়ারত করতে গেলে যেখানে ভালো পরিমাণ টাকার প্রয়োজন! সেখানে বুঝুন, বেঁচে থাকতে টাকার ভ্যালুটা কত? অবশ্য আপনারা তো বুঝেছেনই, আমার বুঝতে বেশ দেরি হলো। আগে বুঝলে এতদিনে বেশ লাভবান হয়ে যেতে পারলাম। অবশ্য এই লাইনে ঢুকেছি বেশি দিন হয়নি, সবটা আয়ত্ত্ব করতে একটু তো সময় লাগবে!ʼʼ

একটু থামল ফারজাদ। লোকটার মুখে সুপ্ত মিটিমিটি হাসি দেখা যায় এবার। সামাদ অভিভূতের মতো চেয়ে আছে। কথার মারপ্যাচ এতো কেন জানবে একটা লোক? বিশ্বাস না করার উপায় রাখছেনা, এক ফোঁটা ফোঁক ফোকর থাকছে না ফারজাদের কথা এড়িয়ে যাবার। সামাদ মনে মনে সন্দেহে পতিত হলো, আসলে ফারজাদ কী চাইছে! সত্যিই বেইমানী করবে দেশের সাথে, নিজের কর্তব্যের সাথে? করতেই পারে, ইনসাফ নেই কোথাও, স্যার কোথায় পাবেন ইনসাফ? গুলি খেয়ে পাল্টি খেয়েছেন। কষ্ট হলো সামাদের, ফারজাদকে এভাবে খারাপদের সাথে তাল গোলাতে দেখে।

ফারজাদ লোকটার তাকিয়ে হাসল, “ভালোভাবে, নিরাপদ এবং অভিজাত জীবনযাপনের জন্য যা দরকার তা হলো ইরেসপন্সিভ থাকা। আপনারা আপানদের কাজ করবেন, আমি আমার মতো থাকব। এই ধান্দাটাও এক প্রকার কর্মক্ষেত্র। যেখানে আপনারা কাজ করছেন, আপনাদের জীবিকা নির্বাহ চলছে। সেখানে বাঁধা দেয়াটা কি আসলে ঠিক?ʼʼ

লোকটা চেয়ে আছে ফারজাদের দিকে। এবার তার চোখে লেগে থাকা অবিশ্বাস খানিক ঝাপসা হয়ে এসেছে। কপাল কুঁচকেছে। সামাদ মোহিতের মতো চেয়ে রইল ফারজাদের দিকে। এতো চতুর আর শান্ত লোক! ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, “আপনি জানেন আলামিন কেন এসেছিল আমার কাছে?ʼʼ

লোকটা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে পরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝায়। ফারজাদ বলল, “কেন?ʼʼ

মাসুদ বলল, “সে যাই হোক, তো আপনি কী বলতে চাচ্ছেন, আপনি সেই ডিলে রাজী?ʼʼ

-“ধরুন হলাম রাজী!ʼʼ ফারজাদ বলল।

লোকটা হাসল, “আপনাকে বিশ্বাস করব কেন অফিসার? আপনি লোকটা খুব চালাক আছেন। খুব সহজে ভড়কাতে চাইছেন?ʼʼ

ফারজাদ উঠে দাঁড়াল, “তাহলে তো আর কথা বলে লাভ নেই। আমি চেয়েছিলাম একটা আলাপ আলোচনা করে, ফাইনাল একটা পাকাপাকি চুক্তিতে আসতে। তবে এখন বোধহয় মত বদলাতে হবে, যেহেতু বিশ্বাসই করছেন না।ʼʼ

কথাগুলো বলতে বলতে হেঁটে ফারজাদ এতক্ষণে কাস্টাডি রুমের দরজার কাছে চলে এসেছে। বেরিয়ে যাবার আগ মুহুর্তে পেছন থেকে ডাকল মাসুদ, “আরে! এতো অধৈর্য্য হইলে ধান্দা হয় নাকি মশাই! এখনও দেমাগ যায় নাই মিয়া আপনার! শোনেন কথা..ʼʼ

ফারজাদ ফিরে তাকাল। মাসুদ বলল, “আগায়ে আসেন, কেমনে কী? এতো হাইপার হলে চলে? বসে কথা বলতেছিলাম, বলি!ʼʼ

ফারজাদ অনীহার সাথে চোখে-মুখে কপট বিরক্তি ফুটিয়ে এগিয় এসে বসল, “কী বলবেন?ʼʼ

মাসুদ বলল, “আপনি কী বলতেছিলেন? কী চান?ʼʼ

ফারজাদ বলল, “এখানে তো আর ডিল করা যায়না, এটা প্রসাশনের কার্যালয়। চাইছিলাম আলামিনের সাথে দেখা করে ওর শর্ত এবং চুক্তিটা ফাইনাল করতে। তবে আপনি তো বিশ্বাস…ʼʼ

মাসুদ বলে উঠল, “আর যদি চালাকি করো, অফিসার? গ্যারান্টি কী?ʼʼ

ফারজাদ বুকের ডানদিকে হাত দিলো, “আর একটা গুলি লাগলে সোজা ইন্না-লিল্লাহ হয়ে যাবে।ʼʼ

লোকটা খুশি হলো, মাথা নাড়ল, “এইডারে কয় সচেতনতা, বুঝলা মিয়া! তোমরাও লাভে থাকবা, আমরাও!ʼʼ

ফারজাদ সায় দিলো, “তা বুঝতে বুক ফুঁটো করতে হলো।ʼʼ

কাস্টাডি থেকে বেরিয়ে সামাদের সঙ্গে বেশ ঘন্টাখানেক আলোচনা চলল ফারজাদের। এরপর সে বেরিয়ে এলো মালিবাগে দাঁড়িয়ে থাকা এসপি ব্রাঞ্চের সদর দফতর খ্যাত দশতলা বিল্ডিংটা ছেড়ে।


দু’দিন কেটে গেছে মাঝে। ফারজাদের প্রস্তুতি শেষ। রাতের বেলা টুকটাক খাবার খেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট জ্বালাল একটা। দুটো টান দিয়ে, টাউজারের পকেট থেকে ফোন বের করল। ডায়াল করল দ্বিজার নম্বরে। মাসখানেকেরও বেশি সময় কথা হয়না। ভাবা যায়! মেয়েটা না জানি কতটা কষ্ট আর অভিমান জমিয়ে রেখেছে সযত্নে! সেসবে ফারজাদের আসলেই কিছু করার নেই। এসব মেনে নিয়েই চলতে হবে দ্বিজাকে। মেয়েটা যে ভালোবাসা, যেমন একটা সংসার, যে ধরণের প্রেমিক সঙ্গ চায়। তার জন্য ওর অন্যকাউকে বেছে নেবার ছিল, অথচ মেয়েটা ব্যাপক ভুল মানুষ ফারজাদকে চেয়েছে। ভুল করলে তার মূল্য চুকানো প্রকৃতির সর্ণালী-নিয়ম। যা সে চুকাচ্ছে।

কল রিসিভ করল না। কম-বেশি দশবার কল করেও ফারজাদ কলে পেল না দ্বিজাকে। না রিসিভ করছে, না কেটে দিচ্ছে। ফারজাদ হেসে আবার ডায়াল করল। আরও কয়েকবার কল যাবার পর রিসিভ হলো। তবে ওপাশ নীরব। নীরবই বা কী! এই তো ফারজাদ ভারী নিঃশ্বাস আর ওড়নায় মুখ চাপা কান্না শুনতে পাচ্ছে দিব্যি! ওই পাশে পুচকি মেয়েটা কোনোদিন কি বুঝবে, তার এইসব কাতরতা ফারজাদ নামক জীবন্মৃতকে রোজ একটু একটু করে আবার জীবিত করে তুলছে! আবারও প্রাণের সঞ্চার করছে তার ভেতরে। মানুষ একবার অপূর্ণতার বশ হয়ে গেলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া খুব কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। সম্ভব সেভাবে, যদি কেউ বোধহঢ় এভাবে জড়িয়ে রাখে পূর্ণতায়। তাহলে কতদিন অপূর্ণতার বশে থাকবে ফারজাদ! কেটে যাওয়া দেহে যেমন নতুন করে কোষ বিভাজনের ফলে কাটা স্থানের ক্ষত ভরাট হয়, দ্বিজার এই মসৃণ, নিখাদ প্রেম সেই বিভাজিত কোষ, যা ফারজাদের অপূর্ণ ঘায়ের জখমে ভরাট আনছে।

ফারজাদ আরও কিছুসময় দ্বিজার রাগ ও কান্না চুপচাপ শুনল। চোখ বুজে অনুভব করল দূরে থাকা মেয়েটার বিরহের ছটফটানি। এরপর বলল, “রাগ করিসনি কেন আমার ওপর? আমি তো আরও ভেবেছিল এতদিন পর কল করলে নিশ্চিত রাগ করবি, কথা বলবি না, কান্না করবি, কষ্ট পাবি। অথচ তুই তো দেখছি একদম ঠিক আছিস! রাগ নেই, কান্না নেই, অভিমান নেই, কষ্ট নেই। কেমন ফুরফুরে মেজাজে, হেসেখেলে কথা বলছিস! সাব্বাস দ্বিজা! আই ফিল প্রাউড টু ইউ! তোর মতো স্ট্রং বউ তো সকল এসবি অফিসার ডিজার্ভ করে, বাট ভাগ্য জোরে পেয়েছি আমি। ওয়েল ডান!ʼʼ

ফট করে ওপাশ থেকে লাইন কেটে গেল কথা শেষ হবার আগেই। ফারজাদ শব্দ করে হেসে ফেলল। বিরবির করল, “পাগলি আমার!ʼʼ আবার কল দিলো। দু’বার কল হবার পর রিসিভ হলো। ফারজার বলল, “সে তুই রাগ কর, কান্না কর, আর এক গ্লাস পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করে নে। আমি তো শুধু কল করেছিলাম, একটা বার্তা তোর কাছে পৌঁছানোর জন্য। তোর স্বামী-প্রেমিকের বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর। আগের কাল হলে বার্তা চিঠিতে যেত পিয়নের কাছে। কিন্তু এটা ডিজিটাল যুগ, তাই ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে দিচ্ছি। শুনবি?ʼʼ

ওপাশ থেকে জবাব আসেনা। ফারজাদ সিগারেটে একটা টান দিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিলো নিচে। এরপর বলল, “তুই শুনতে চাস বা না। আমার পৌঁছানোর দরকার তোর কানে পৌঁছে দিই। বার্তাটা এমন—’পুঁচকে কাঁদুনি বউ, তোমার ভাতার বাড়ি আসছে খুব শীঘ্রই। তাকে আপ্যায়ন করার ব্যবস্থা করো।ʼ

দ্বিজাকে বিস্ময় অথবা খুশি প্রকাশের সুযোগ দিলো না ফারজাদ। ফোন কেটে দিলো।


রাত সাড়ে এগারোটার মতো বাজছে। অন্ধকার আশপাশ, নির্জনতা ঘিরে আছে সেখানে। এখানেই আসতে বলা হয়েছিল ফারজাদকে। মাসুদের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছিল আলামিনের সঙ্গে। আলামিন ঠিকানা দিয়েছে, এখানে। ফারজাদ ভাবল, কোনো এক রাতে কেমন পাগলের বেশে, যাযাবরের গেট-আপে পেয়েছিল এই আলামিনকে রাস্তার ধারে। সে যদি এসবি অফিসার না হতো, সেও নিশ্চয়ই কোনোদিন সন্দেহ অবধি করতো না, জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে থাকা বসে থাকা আলামিন কী জিনিস! আচ্ছা, সমাজের সাধারণ মানুষগুলো নিশ্চয়ই প্রতিদিন আসল-নকল টুকাইদের মাঝে এভাবেই বিভ্রান্ত হচ্ছে! তারা কল্পনাও করে না, সন্দেহবাতিক কিছু। করারও কথা নয়।

ফারজাদ মশাদের বলতে চাইল, ‘আমার সম্মানিত মশা ভাইজানেরা, আপনারা যেটাকে সরকার প্রদত্ত পাবলিক
র ক্তে র টিউবয়েল ভাবছেন, ওটা আসলে আমার ঠ্যাং। ছেড়ে দিন, রক্ত ফুরিয়ে এবার হাড়ে ক্ষয় ধরে যাবে।ʼ

এরকম একটা নিশুতি রাতে, নির্জন জায়গায় ডিল হয়! জানা ছিল না ফারজাদের। আসলে জীবনে জানার কোনো শেষ নেই, কথাটি সত্য। চারদিকে তাকাল। অন্ধকার, চরম অন্ধকার চারদিকটা। হাতঘড়ি দেখার উপায় নেই, মোবাইল বের করে ঘড়ি দেখল– সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি। জায়গাটা মূলত বাবুবাজার ব্রিজের নিচে ঝোপের পাশে। ওপর দিয়ে মাঝেমধ্যে গাড়ি চলে যাচ্ছে আপন গতিতে । আবার নীরব হয়ে যাচ্ছে এলাকা। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে পা থাপড়ালো মাটিতে।

ফোন-আলাপের এক পর্যায়ে আলামিন বলেছিল, “আমি জানি আপনে খুব চালাক, অফিসার। তবে অতি চালাকি ঠিক না জানেন তো, গলায় দড়ির প্রবাদটা তো শুনছেন। ডিলের কথা বলে যদি পুলিশ ফোর্স আনেন আমারে ধরার পরিকল্পনায়, তাইলে তো… আসলে কেউ আসবেই না। জানেন তো, সবই আমাদে..ʼʼ–হো হো করে হেসেছিল আলামিন।

ফারজাদ জানে আলামিন চারদিকের খোঁজ-খবর নিয়েই আসবে। ফারজাদ কাউকে আনেনি। সে এসেছে ডিল করতে, কাউকে আনার প্রশ্নই ওঠেনা।

আলামিন এলো আরও মিনিট পনেরো পর। কোনো সতর্কতা নেই তার পায়ে। লতা-গুল্ম, ঝোরঝাপ, শুকনো পাতায় পা ফেলে মড়মড় করে এগিয়ে এসে ফারজাদের পাশে দাঁড়াল। ফারজাদ সরাসরি বলল, “আমি সেদিন জ্বরের ঘোরে ছিলাম, আপনার প্রস্তাবে সেভাবে মনোযোগ দিতে পারিনি। আবার বলুন শুরু থেকে।ʼʼ

জয়ের হাসি হাসল আলামিন, “আসলে স্মাগলিং কামডা প্রসাশনের সহায়তা ছাড়া হয়না, অফিসার। বর্ডার ক্রস থেকে শুরু করে, পুরো দেশে বিতরণের পুরো কার্যক্রম আসলে আপনাদের হাতেই। কারণ, নিরাপত্তাদাতা যেখানে আপনারা, নিজেরা ক্রেডিট নেই কেমনে! হাহহাহা!ʼʼ

স্পষ্ট ভাষায় প্রসাশনকে অপরাধীদের কুকুর বলে ফেলল আলামিন। তা শুনে ফারজাদও হাসল, আসলেই তার হাসে পাচ্ছে, আলামিন যে খাঁটি সত্যটা বলেছে, তা শুনে কষ্ট আসছে না। সত্যি কথা শুনে কষ্ট কীসের? আলামিনে শুদ্ধ-অশুদ্ধের মিশ্রণে বলা কথাগুলো দেশের প্রকটচিত্র ধারণ করছে। ফারজাদ বলল, “আমিও আপনাদের নিরাপত্তাদানকারীর তালিকায় নামযুক্ত করলাম। এবার বলুন, এর বদলে আমাকে খুশি করার মতো কী আছে আপনাদের কাছে?ʼʼ

আলামিন আরও খানিক হাসল। এরপর বলল, “অফিসার, আপনার মাঝে কিছু একটা আছে, বোজছেন! আপনের চোখে-মুখে, কথাবার্তায় কিছু আছে, যেইটা ওইসব চাকর শালার বাচ্চাদের থেইকা খুব আলাদা। এইজন্য আপনার দাম একটু বেশিই দেব। খারাপ কাজ করতে পারি, কিন্তু না-ইনসাফি না। আর ইনসাফ হইল, আপনার সততা ভালো দামে কেনা।ʼʼ

কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। আলামিন খুশি হয়ে বলল, আপনারে বিশ্বাস করেও করিনাই, আসলে হইতে পারতো আপনে চালাকি করে ফোর্স সাথে নিয়ে আসছেন। সেইটাই বা কেমনে হইতো, সব তো আমরা আমরাই। হাহহাহাহা! তবে আপনার কথা দিয়ে কথা রাখাডা ভাল্লাগছে।ʼʼ

কথা শেষ করে পকেট থেকে একটা অ্যালকোহল ভর্তি হিপ-ফ্লাস্ক বের করে, দুটো চুমুক দিলো। ফারজাদকে বলল, “লাগবে?ʼʼ

ফারজাদ মাথা নাড়ল। আলামিন হাত মেলালো ফারজাদের সঙ্গে। এরপর বলল, “আসি তাইলে। কাল না-হয় ডেরায় চলে আসবেন, দেখা হবে! কিন্তু আপনে এইখানে আজই ক্যান দেখা করতে চাইলেন বুঝলাম না। আস্তানায়ও তো দেখা করা যাইতো! ভালোভাবে বসে কথা কইতাম নাহয়! আমি আসলেই ভাবিনি আপনে খালি দেখা করবার জন্যে ডাকছেন এইখানে এখন এই রাইতে?ʼʼ হাসল আলাভিন।

ফারজাদ হাসল, “আসলে আজ বাড়ি যাব দিন কয়েকের জন্য। তার আগে আজকের জরুরী কাজটা করে রেখে যাওয়ার মান্নত করেছিলাম। সেটা পূরণ করার জন্য হলেও আজকে এই এখনই দেখা করতে হতো। অন্তত কুমিল্লার বাসে ওঠা আগ মুহুর্তে হলেও। এই ডিলটা খুব প্রয়োজন ছিল, সেটা যত দ্রুত হয়ে যায়, আমি সন্তুষ্ট মনে বাড়ি গিয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে অসতে পারি। আপনাদের আস্তানায় যাব তো, ফিরে এসে যাব। কিন্তু প্রাথমিক আলাপটা হয়ে গেলে একটা নিশ্চয়তা রইল। নয়ত কেমন একটা খচখচানি কাজ করছিল কাজটা না করে..

আলামিন খুব খুশি হলো। হাসল আবারও, “এইজন্য ভাল্লাগে আপনাকে আমার প্রথম থেকেই। যান, তাইলে। কয়দিন ঘুরে আসেন।ʼʼ

আবারও হাত মিলিয়ে আনুষ্ঠানিকতা আদায় করে হাঁটা ধরার আগে আলামিন বলল, “যাইবেন না আপনে?ʼʼ

-“নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে ভালোই লাগছে। হিসেব মেলাতে এর চেয়ে ভালো জায়গা হয়না। হিসেব বরাবর হলেই চলে যাব।ʼʼ

আলামিন বোধহয় বুঝল না ফারজাদের কথা। কেমন করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার একটু-আধটু মাতলামিও এসে গেছে, বেশ কয়েকটা চুমুক দিয়েছে হিপ-ফ্লাস্কে। ফারজাদ হাসল একটু শব্দ করে। তাতে খানিক আশ্বস্ত হয়ে এগিয়ে গেল সে ঝোপ পেরিয়ে এগিয়ে ব্রিজে ওপরে উঠে যাবার ঢালু পথে। পেছনে মৃদু আলো রেখা জ্বলে উঠল। ফোনের ফ্লাশ অন হয়েছে, সেটাও হয়ত আঙল দিয়ে আধো চেপে ধরে আধো আলো ছড়াচ্ছে। পেছনে ফিরে ব্যাপারটা বোঝার আগেই একটা বুলেট এসে বিঁধল আলামিনের বুকের ডান পাশটায় ঠিক ঘাঁড়ের ক্লাভিকল বোনের নিচে, যকৃতের ওপর দিকটায়। চিৎকার করার সুযোগ হলো না। ক্ষণিকের মাঝে আরও একটা বুলেট এসে বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল বাম পাশটায়। হৃদযন্ত্র ছিদ্র করে বোধহয় বেরিয়ে গেছে ওপর পাশ দিয়ে।

বুলেট বের হবার বিশেষ আওয়াজ হয়নি। দাঁত খিঁচে দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতু ফেলার মতো ক্যাচ করে দুটো শব্দ হয়েছে। লুটিয়ে পড়ে আলামিনের দেহটা। এখনও রুহু আছে তাতে।

ফারজাদ পিস্তলের মুজেল থেকে সাইলেন্সরটা খুলতে খুলতে এগিয়ে এসে বসল হাঁটু মুড়ে উবু হয়ে বসল আলামিনের লুটানো দেহের পাশে। আস্তে আস্তে বলল, “আইনকে মানার মতো সভ্যতা আমার নেই, যেখানে বাপ-মাকে ঠিকঠাক ক্ষমা করার মতো ক্যাপাসিটি নেই আমার। তবে আমার কোনো কাজ যুক্তিহীন এবং কারণবিহীন হয়না, তা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। বুকের ডানপাশে লাগা বুলেটটা দ্বারা কেবল আমি তোমার ধার ফিরিয়ে দিলাম। সেই ভাবে, যেভাবে তোমার দেওয়াটা আমার বুকের ডানপাশ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছিল। এবার প্রশ্ন করবে, দ্বিতীয়টা তো না-ইনসাফি হয়ে গেল। উহু, না-ইনসাফি করতে লজ্জা লাগে আমার। ওটা আমার কর্তব্য, দেশদ্রোহীর ওপর যেকোনো পরিস্থিতিতে ফায়ার করার সংবিধান কার্যকর রয়েছে আমার ওপর। এবার যদি বলো, হৃৎপিণ্ড তাক করে কেন গুলি চালিয়েছি? প্রথম ফায়ারটা তো পায়ে করার ছিল। তোমার শাস্তি ফাঁসি, তবে যেহেতু আমার সিনিয়রসহ সকল প্রসাশন তোমাদের কেনা, তারা তো ফাঁসি বা মৃত্যদণ্ড দেবেনা। আমি দিলাম। জীবনের প্রথম কেইসটা ইনসাফির সাথে লড়ে, পরের বার থেকে ঘুষ খাব। এটা ব্যবসাতে ইনভেস্টমেন্ট বলা চলে, অথবা বরকত হবার মিলাদ। প্রথম কেসে কিছু সততা ও কর্তব্য রাখলে এর বরকতে পরে যে ঘুষগুলো খাব, তাতে রহমত-বরকত থাকবে ভালো।ʼʼ

ততক্ষণে আলামিনের দেহটাকে নিথর করে রেখে পাপীষ্ঠ রুহুটা হয়ত অজানা গন্তব্যে পাড়ি দিয়েছে। বুক-পিঠ ছাপিয়ে হয়ত তরল, গরম র ক্তে র আন্দোলনহীন স্রোত কেটে চলেছে। যা দৃষ্টিগোচর হলো না অন্ধকারে।

ফারজাদ উঠে দাঁড়াল। পিস্তলটা হোলস্টারে গুঁজে রেখে সামাদের নম্বর ডায়াল করল। ওপাশ থেকে হন্তদন্ত কণ্ঠস্বর সামাদের, “স্যার, ঠিক আছেন আপনি? কী অবস্থা? কী করেছে ও, কী হয়েছে ওখানে?ʼʼ

ফারজাদ চুপ রইল ক্ষণকাল। তাতে সামাদের উত্তেজনা বাড়ছে, তা জানে। এবার শান্তস্বরে বলল, “মাসুদ তো এখনও কাস্টাডির হাজতে, তাই না?ʼʼ

-“জি, স্যার। কিন্তু…ʼʼ

ফারজাদ বলে উঠল, “রাতটুকু হায়াত দিন ওকে, সকালের খাবারে কিছু ভালোমন্দ মিশিয়ে দেবেন। আর বেশি দেরি করার দরকার নেই। কীট-পতঙ্গ যত কমবে, কীটনাশকের খরচা বাঁচবে।ʼʼ

সামাদ বুঝে গেল, যা হবার হয়ে গেছে। এবার তার কাজ শুরু। কিন্তু সংশয় তো কাটার নয়। পুরো পালের গাদার মাঝে মাত্র দুটোকে বধ করেছে তারা দুজন, বাকিগুলোর শিংয়ের গুতো কী করে সইবে ফারজাদ? কতদিন, কতভাবে, কীভাবে রক্ষা করে চলবে নিজেকে? ফারজাদের কী ভয় লাগে না? জীবন, পরিবার, ভবিষ্যত—কোনো কিছুর প্রতিই মায়া নেই? যেখানে পুরো ডিপার্টমেন্ট হাল ছেড়ে আরাম করছে, সে একা কেন নেমেছে কর্তব্য পালনে? ফারজাদ প্রতিক্রিয়াহীন, সংবেদনশীলতা নেই, ভয় নেই, চমক নেই। তাই বলে কি ধ্বংস হয়ে যাবার শঙ্কাটুকুও নেই? আসলে কিছু মানুষ পৃথিবীর বুকে অনন্য, যারা অস্বাভাবিক হয়, যারা মনস্তাত্বিক হয়, যারা দ্বিধাহীন হয়। কেন তারা এমন হয়ে ওঠে জানা নেই, হতে পারে কোনো কারণে নয়। শুধুই কিছু অতীত বা কারণ, কাউকে এতোটাও নির্লিপ্ত করে তুলতে পারেনা যে সে এমন অস্বাভাবিক, অ-সাধারণ হয়ে ওঠে। এসব ভুয়া কথা। কিছু মানুষের পাগলাটে হতে কোনো অতীত বা কারণ দরকার হয়না, জন্মগতভাবে তারা হয় মানসিকতভাবে সবার চেয়ে আলাদা, সবার চেয়ে উদ্ভট। ফারজাদ নিজেই বলে, সে আসলে ভং ধর থাকে। তার অন্তর ফাঁপা। ভেতরে ওসব কষ্ট-অতীত আর নাড়া দেয়না আজ। সেসবের বহুদিন পেরিয়েছে। মানুষটার প্রকৃতিই এমন উদ্ভান্তের মতো। সকলকে এক রকম, স্বাভাবিক আর সরল হতে হবে কেন? কিছু মানুষ মানসিক দিক থেকে থাকুক না জটিল, দুর্বোধ্য! ফারজাদ এমনই, সে কোনো কিছুর প্রভাবে এমন নয়। মোটকথা—সে এমন, তাই সে এমন। ফারজাদ নিজেই বলে, সে ভালো নয়, সে কোনো বর্ণনায় অধিনায়ক নয়, সে অ-বিশেষ, উদ্ভট এক সত্ত্বা কেবল। বর্ণনার প্রাধান্যতায় কেবল নিখুঁত, যোগ্য এবং সুন্দর ব্যক্তিত্বদের স্থান হবে কেন? আওলা-ঝাওলা মানসিকতার মানুষদেরও আওলা-ঝাওলা কাহিনি থাকে, কিছু সময় সেটাও প্রাধান্য পাক না বর্ণনায়! ফারজাদ আরও এমন বহু উদ্ভট কথাই তো বলে! সে-সবই বা মানতে হবে কেন?


ফারজাদের রুমের বারান্দা দিয়ে সরাসরি সরু অর্ধভাঙা পিচের রাস্তাটা দেখা যায়। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে অন্ধকার রাস্তার দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো দ্বিজা। গ্রামের রাস্তা। সবগুলো খুঁটির পোলে আলো নেই। মাঝেমধ্যেই দুটো তিনটা মিসিং। দূরের সেই সব আলো ভেসে এসে অন্ধকারে একটু-আধটু ব্যাঘাত ঘটাতে পেরেছে কেবল। এই রাস্তা পেরিয়ে সেদিন ভোর সকালে ফারজাদ বেরিয়ে গেছিল। তারপর থেকে রোজ অপেক্ষা কথা হয় ওই পথ চেয়ে। পড়তে পড়তে টেবিল ছেড়ে উঠে এসে বসে বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় অথবা দাঁড়িয়ে থাকে গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে। আর দিন কয়েক আছে এডমিশন টেস্ট শুরু হবে। প্রস্তুতি কেমন, আসলে জানা নেই দ্বিজার। খুব খারাপ নয়, অন্তত ফারজাদের চাওয়া মোতাবেক হলেও সবকিছু ঠিক রাখতে হবে।

সকাল থেকে রাত অবধি এ বাড়িতে বিশেষ কাজ নেই তার। পারলে দু বেলা রান্নায় দুই মামিকে সাহায্য করা হয়। যে কয়দিন লাবণ্য এসে থাকে, সেই দিনগুলো ভালো যায় তুলনামূলক। কিন্তু ইরফান সেই ধাঁচের নয়, যে বউকে ফেলে রাখবে শশুরবাড়ি। রাতগুলো ওই একই রকম গুমশুম, বিষণ্ন কেটে যাচ্ছে দিনের পর দিন পেরিয়ে মাস।

দু’দিন তিনরাত আগে কল এসেছিল ফারজাদের। কল দিয়ে কী বলল সেই খাটাশ লোক, সে কাঁদছে না কেন, রাগ করছে না কেন? কোনোদিন বুঝবে না লোকটা ওর কাতরতা। তবুও এই পর্বতের চূড়ার সম উঁচু অভিমান এক লহমায় ঝরঝর করে গুড়িয়ে পড়েছিল, যখন ফারজাদ বলল, “তোর ভাতার বাড়ি আসছে।ʼʼ

অভদ্র, অসভ্য, কূটিলমনা লোক! কতটা খুশি বুকে ছলকে উঠেছিল, তা কি বুঝবে কোনোদিন ফারজাদ? অথচ সেই খুশি শুধুই ওই নির্দয় পুরুষটির আশ্বাসে ছিল। শুধুই আশ্বাস এবং মিথ্যে আশা দিয়েছিল। আজ প্রায় তিনটে দিন তো দিব্যি পেরিয়ে গেল। কই ফেরেনি তো লোকটা? প্রতিদিন রাতে এমনিতেও যখন ফারজাদের ওই বিছানায় একা ঘুম না এসে দেহ-মনে ছটফটানি ধরে যায়, দৌঁড়ে চলে আসা হয় এই বেলকনিতে। আজ তিনটে রাত আর বিছানায় গা এলানোই হয়নি। রাতগুলো কাটছে এই বারান্দায়ই, ফজরের আজান হলে চোখ মুছে ঘরে চলে ঢুকে যেতে হয়। আজও কেন বসে আছে, জানে না! তবুও বিছানায় পিঠ ঠেকানোর ইচ্ছে হচ্ছে না।

রাত প্রায় ফুরিয়ে এলো। সেই কখন থেকে পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করে রাত তিনটে বাজার বার্তা দিয়েছে। এখন শুধু ফজরের আজান পড়ে অফিসিয়ালি সকাল হবার দেরি। আজও এলো না লোকটা!

ঠোঁট এলিয়ে মলিন হাসল দ্বিজা! ভেজা চোখদুটো মুছে নাক টানল আলগোছে। সেদিন পড়তে বসেছিল টেবিলে। খাতায় লেখার সময় মনোযোগভ্রষ্ট হলো, মনটা উদাসীন হয়ে পড়ল। খাতার একপাশে বাঁকা করে উক্তির মতো লিখে ফেলল দ্বিজা,

~সেই তো কবে আমায় রেখে ওই পথ ধরে হারিয়ে গেলেন আপনি। আপনার ছেড়ে যাওয়া মায়ার তপ্ততায় পুড়ে ছারখার হলো আমার এক সরোবর সম প্রেমজল।~

পঙক্তিদুটো লেখার সময় ভেসে ছিল চোখে সম্মুখে ফারজাদের মুখখানি, গেইট ছেড়ে বেরিয়ে ওই রাস্তা ধরে এগিয়ে যাবার রাস্তাটুকু!

এই ঘর, ওই বিছানা, আলনায় ঝুলছে লোকটার পুরো শার্টগুলো, আলমারীতেও আছে কিছু। যা প্রতিদিন বের করে এনে এলোমেলো করে আবার পরম যত্নে ভাঁজ করে তুলে রাখে সে। আসলে অভ্যাস তো! ঘরনীগত অভ্যাস! দ্বিজা তো ফারজাদের ঘরনী। এই ঘরের, ওই লোকের প্রতি বহু কর্তব্য দ্বিজার। দিনশেষে সেগুলো পালন না চরে বাঁচা মুশকিল! খুব মুশকিল। লোকটার যত্ন নেবার যে বদভ্যাসটা কিছুদিনে, কয়েক বেলায় গড়ে উঠেছিল এই ঘরের মধ্যে, তা এতোগুলো দিনেও কাটেনি।

চেয়ে রইল দ্বিজা ওই পথ চেয়ে। মাঠের বিস্তৃর্ণ ভূমির শূণ্যতা পেরিয়ে কোথা কোথা থেকে যেন ফজরের আজান ভেসে আসছে। মাথার ওড়নাটা তুলে দিলো মাথায়।

এতো রাতে রাস্তায় মানুষের চলাচল? এখনও তো আজান হয়নি এদিকে! এতো তাড়াতাড়ি নামাজে যাবারও কথা নয় কারও! আরে লোকটা তো এ বাড়ির পানেই এগিয়ে আসছে, দেখা যাচ্ছে! দ্বিজার বুকের ভেতরটায় মনে হলো কেউ পাথরের এক বড়ো খণ্ড দিয়ে ধরাম করে বাড়ি মারল। সেভাবেই যে কেঁপে উঠল বুকটা! এরপর থেকে ঘড়ির কাঁটার মতোন টিকটিক নয় বরং ঘন্টার মতো ঢংঢং করে বাজছে হৃদযন্ত্রটা। খুব কানে এসে লাগছে বাজনাটা। রীতিমত কশেরুকার বারোজোড়া হাড়ে কাঁপন ধরে গেছে।

ওই লোকটির অবয়ব আঁধার কেন, দ্বিজা মরেও চিনতে পারবে যেন! মন-মস্তিষ্ক, দেহপিঞ্জর, রক্তের প্রতিটা কণিকায় দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে ওই পুরুষটির অবয়বসহ গোটা পুরুষসত্ত্বাটি! লম্বাটে দেহের, প্রসস্থ বুক! হাঁটার ভঙ্গিমা! ওই তো একবার মুখ উঁচিয়ে তাকিয়ে দেখল লোকটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে যাওয়া দ্বিজার পানে।

দুনিয়ার পার্থিবতা ভুলে এক ছুটে বারান্দা ছাড়ল দ্বিজা। ঝনঝনে হাতে ঘরের ছিটকিনি কোনোমতো খুলে দৌঁড়ে ওপরতলা পার করে নিচে এলো। তার মাথার ওড়না পড়ে গেছে, কাঁধের একপাশ ছড়িয়ে, ওপর পাশে ঝুলছে, যা মেঝেতে ঘেঁষে যাচ্ছে। দ্বিজার এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো, তার দৌঁড় ঠিক পার্বতীর মতো লাগছে হয়ত দেখতে। গেইটের ওপারে দেবদাস দাঁড়িয়ে। উহু, দেবদাস দাঁড়িয়ে ছিল না, মৃত্যুশয্যায় পড়েছিল, চেয়েছিল ফটকের ওপার পেরিয়ে অন্দরমহলের পানে। দৌঁড়ে অনেকটা সেরকমই, পার্বতীর মতো কাতরতা থাকলেও পরিণতি এক নয়, একদম নয়। পার্বতী কেমন করে ওই পরিণতি সহ্য করেছিল জানা নেই। দ্বিজা পারতো না।

পার্বতীর জন্য সিহং-দরজা আটকে গেছিল, ওপাশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল দেবদাস, পার্বতী আঁটকে গেছিল সিংহ-কপাটের অন্তপুরীতে। অথচ দ্বিজাকে থামানোর কেউ নেই, সিংহ-কপাট আঁটকাবার কেউ নেই। সে নিজে গিয়ে খুলবে ওই ফটক। ঝাঁপটে ধরবে ফারজাদের বুক। এতো শক্ত করে চেপে ধরবে, ফারজাদের নিঃশ্বাস আঁটকে যাবে কিছু মুহুর্তের জন্য।

কেচি গেইটের সামনে গিয়ে দুনিয়াদারী পেছনে ফেলে ছুটে আসা দৌঁড় থামিয়ে হুড়মুড়িয়ে বসে পড়ল। ফারজাদ ধমক দিলো কপট, “এভাবে আসতে হবে কেন? আর এতো রাতে ছায়া দেখে তুই নেমে এসেছিস গেইট খুলতে? অন্য কেউও তো হতে পারতো! থাপ্পড় মারি একটা?ʼʼ

মাথা ঝুঁকিয়ে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলছিল দ্বিজা। এই লোকটার ঝরঝরে গম্ভীর কণ্ঠস্বর। চোখের পানি ছাপিয়ে ঠোঁটে হাসি এলো। এবার মাথা তুলে অদ্ভুত স্বরে হেসে ফেলল দ্বিজা। হেসে ফেলল কি কেঁদে ফেলল বলা এবং বোঝা দুটোই খুব মুশকিল। অতিরিক্ত খুশি এবং উত্তেজনায় মানুষ হাসতে হাসতে কাঁদে, কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেলে, সেরকম হাসি কান্না মিশ্রিত রয়েছে দ্বিজার অভিব্যক্তিতে। দ্বিজা হাসছে —তার আর পার্বতীর পরিণতি এক গ্লাস পানিতে গুলালে যে পরিণতির মিশ্রণ তৈরী হবে, তা ঘটেছে আসলে শেষ অবধি।

কোনোরকম উঠে দাঁড়াল দ্বিজা। ফারজাদ একহাত কেচি গেইটের ফাঁকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সেই হাতের ওপর নিজের ঘর্মাক্ত, উত্তেজিত, কম্পিত হাতটা রাখল দ্বিজা, সেই কান্না-হাসি মিশ্রিত গলায় প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “চাবি আনতে ভুলে গেছি।ʼʼ

ফারজাদ কপালে হাত রেখে গা দুলিয়ে অতিষ্ট হাসি হেসে ফেলল। শব্দ করে ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠল দ্বিজাও। তাদের দুজনের হাসির খিলখিল আওয়াজ ছাপিয়ে ফজরের আজানের ধ্বনি প্রকট হলো আকাশে-বাতাস মুখরিত করে। এবার কিছুক্ষণের মাঝে সূর্য উঠবে, একটা নতুন সূর্য। আলো ছড়াবে দিনভর, আবার দিন ফুরোলে নিভে যাবে পশ্চিমের দিগন্তে নিজেকে ডুবিয়ে।

~সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে