#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৩৭.
অনুষ্ঠানের পরের দিন দ্বিজাকে নিয়ে হাবিব সাহেবের দাওয়াত রক্ষা করতে গিয়েছিল ফারজাদ। দ্বিজা রাতটা ছিল, গতকাল সন্ধ্যার পর ফারজাদ গিয়ে নিয়ে এসেছে আবার।
পরদিন সকাল সকাল কল এলো ফারজাদের কাছে রুহুল স্যারের। ফারজাদ ঘুম থেকেই ওঠেনি। বিরক্ত হয়ে দুবার কেটেও দিয়েছে। কাল ব্যস্ততার কারণে একবারও ওষুধ খাওয়া হয়নি, সব মিলিয়ে শরীর এবং মন দুটোই চেতে গেল। নিশ্চয়ই এখন ডিউটিতে ফেরার তাগিদ দেবে! সে বলেছে সুস্থ হলে ফিরে আসবে। তারপরেও কল করে চিপকে থাকার মানে কী? তৃতীয়বারে কল রিসিভ করল। রুহুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “শরীর কেমন এখন?ʼʼ
-“ভালো। ওদিকের খবর কী? সব ঠিকঠাক?ʼʼ
-“তুমি কি আর এই তালে আছো? ঠিকঠাক হলেই বা তোমার কী? তুমি আছো ফূর্তিতে। শুনলাম বিয়ে করলে, আগের জনের কী হলো? নাকি ওটাকে ছেড়ে..ʼʼ
-“ওটাকেই আবার বিয়ে করলাম।ʼʼ
-“তা কেন?ʼʼ
-“শখ, স্যার। খুব ইউনিক কিছু করার শখ হলো। কী হয়েছে, বলুন!ʼʼ
-“মাসুদকে কাল শক থেরাপি দেয়া হয়েছে মাঝরাতে।ʼʼ
-“কোনো বিশেষ ফায়দা হলো তাতে?ʼʼ
-“হলো না মানে? অকর্মা ভাবছো নাকি আমাদের? ওরা প্রয়োজনে কোথায় দেখা করতো সবাই, সেই ঠিকানা বলেছে। জানি না, ঠিক বলেছে কিনা! তবে দ্রুত সেখানে একটা অভিযান চালাতে হবে। তুমি কি বুঝতে পারছো আমার কথা?ʼʼ
-“পারছি। যেদিন আলামিন আমার কাছে এসেছিল, শেষ পর্যায়ে সে আমাকে মোটা অঙ্কের হিসেব অফার করেছিল। এতে আপনার মনে হয় না, আলামিন অনেক কিছু একটা এই গ্যাঙের! অথচ ও আমার হাতের নাগালেই আছে, আমি চাইলেই ধরতে পারব।ʼʼ
-“হু, এটা আমিও ভেবেছি। না না, ও তোমার হাতের নাগালে কী করে? একটা কথা বলো, তোমাকে মারার পরপরই সে পালালো কীভাবে ফ্লাট থেকে? কেউ আর কাউকে খুঁজে না পেয়ে এটা সুইসাইড ধরে নিয়েছিল। ছেলেটার এলেম আছে এ বিষয়ে, কীভাবে অত তাড়াতাড়ি পালালো!ʼʼ
ফারজাদ তাচ্ছিল্যের সাথে চোখ উল্টে শান্ত গলায় বলল, “ও ফ্লাটেই ছিল। সেন্সলেস হওয়ার আগে ইশারা করেছিলাম আমি লোকেদের, তারা বুঝতে পারেনি, শুধু আমায় নিয়ে হায়হায় করে গেছে। ইভেন, ফ্লাট থেকে সকলে বের হবার পর বহুক্ষণ সে ফ্লাটেই ছিল।ʼʼ
-“তুমি জানলে কী করে?ʼʼ
-“গুলি বুকে খেয়েছি, মাথায় না।ʼʼ
-“ফ্লাটে থাকার উদ্দেশ্য কী?ʼʼ
-“আমার হ্যান্ডগান থেকে নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মুছেছে, ম্যাগাজিন খুলে বুলেট লোড করে রেখেছে। সবকিছু ওলোট-পালোট করে বিশেষ দরকারী কিছু খুঁজেছে তা হাতানোর জন্য, হতে পারে ওদের বিরুদ্ধে কোনো উইটনেস অর এভিডেন্স! এরপর আবার সব গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে গেছে। আলামিন খুব ভালো, স্যার! আমার বউয়ের চুড়িটা নিয়েছিল না।ʼʼ
দ্বিজা বাথরুমে কাপড় ধুচ্ছিল। এ কথা শুনে মুখ বের করে দেখল ফারজাদকে। রুহুল সাহেব সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কীভাবে জানলে এসব? তুমি কি ফ্লাটে গেছিলে?ʼʼ
-“গিয়েছিলাম। আমার আগে ফ্লাটে ঢুকেছে ও। আমার গান থেকে বুলেট বের করে নিয়েছে সবগুলো। জ্বরের ঘোরে বন্দুকের ওয়েট অত খেয়াল না করেই পিস্তলকে নিজের সেফটি বানিয়ে ওর সামনে চলে গেছিলাম। ম্যাগাজিন খালি ছিল আমার পিস্তলের। ইভেন, ওর ছোঁড়া বুলেটটাও আমার বনুদকেরই ছিল। আমারটা সেমি অটোমেটিক হ্যান্ডগান। ওতে নাইন এমএম ক্যালিবারের বুলেট ছিল। আলামিন আমার ফ্লাটে যখন ঢুকেছে, আমি ছিলাম না সেখানে। আমার হ্যান্ডগানে বুলেট ছিল চারটা। ও ম্যাগাজিন খুলে সেখান থেকে বুলেট বের করেছে, একটা নিজের পিস্তলে লোড করেছে, এবং তা দিয়ে নিজের পিস্তল থেকে গুলিটা চালিয়েছে আমার ওপর। তার মানে বোঝা যায়, ওর পিস্তলের ব্যারেলের ব্যাস নাইন এমএম ক্যালিবারের। আর ধরুন তাতে যদি ওকে কোনোভাবে ধরাও হয়, যুক্তি বেরিয়ে আসতো, বুলেট যেহেতু আমার, গুলিও আমি নিজেই চালিয়েছি নিজের ওপর। এতে কী বুঝতে পারছেন?ʼʼ
-“তুমিই বলো!ʼʼ
-“ওরা সেফ নয় আপাতত! নয়ত আমাকে মারতে এতো সতর্কতার প্রয়োজন ছিল না। মেরে বের হয়ে যেতে পারতো। এতো কৌশলের সাথে আমার মৃত্যুটাকে আত্মহত্যা প্রমাণ করার একটা চান্স রাখার কী দরকার পড়ল! অর্থাৎ, আমরা একটু চেষ্টা করলেই ওদের কাছে পৌঁছাতে পারব, এটা ওরা জানে। তবে তা তাড়াতাড়ি করতে হবে। হতে পারে আপাতত দেশ ছাড়ার বা আন্ডারগ্রাউন্ড হবার প্লানে আছে। আপনি মাসুদের ওপর নজরদারি বাড়ান, আমি খুব শীঘ্রই ফিরব।
দ্বিজা চেঁচাতে চেঁচাতে বেরিয়ে এলো, “আপনাকে যেতে দিলে তবে না যাবেন! আপনি আর ওই চাকরিতে ফিরছেন না। অন্তত আমি থাকতে এরকম কিছুই হবে না। আপনি ফোন করে রিজাইন করে দিন..ʼʼ
ফারজাদ বিরক্ত হলো, “শান্ত হ, মা আমার! চুপ থাক অল্প সময়।ʼʼ বলেই ফোন কানে চেপে ধরল আবার। সামাদকে বলল, “আমার ফ্লাট রেডি?ʼʼ
-“জি, স্যার রেডি। কবে ফিরছেন, কেমন আছেন?ʼʼ
-“আপনাকে দাওয়াত দিলাম, আসলেন না! এখন খোঁজ খবর নিয়ে ভালো মানুষ সাজার বিশেষ কারণ দেখছি না।ʼʼ
সামাদ হাসল, “কোনো একদিন আপনার সাথে গিয়ে আপনাদের গ্রাম ঘুরে আসব, ছুটি পেলে। আপনার ফ্লাট রেডি, ভাবীর জন্য এবার থাকার অসুবিধা অনেকটাই কমবে। খুব সুন্দর একটা ফ্লাট, আমার তো খুব পছন্দ হয়েছে।ʼʼ
-“ভাবী আসছে না এখন। সে এখানেই থাকবে।ʼʼ
দ্বিজা উত্তেজিত হয়ে উঠল, “পাগলামী করছেন আপনি? আর আমি ভাবী আপনার…ʼʼ
দ্রুত একহাতে দ্বিজার মুখ চেপে ধরে ওকে শুইয়ে ফেলল ফারজাদ। ইশারা করল চুপ করতে। সামাদ বোধহয় শুনেছে, মুখ চেপে হাসছে নিশ্চয়ই! কল কেটে ফারজাদ ঝুঁকে দাঁড়াল বিছানায় পড়ে থাকা দ্বিজার ওপর, “মারব এক থাপ্পড়! কথা বলার মাঝখানে মেয়ে মানুষ চিৎকার করবি কেন? মিশনে যাচ্ছি আমি বলা চলে। সেখানে তোমাকে নিয়ে গিয়ে আল্লাহর নামে বলি দিয়ে দিই, চমৎকার প্লান! এখানেই থাকবি তুই, আমি সময় সুযোগ পেলে এসে থেকে যাব দু একদিন, আগে যেমন আসতাম। তোর আমাকে বিয়ে করতে চাওয়ার সাধটাও মিটুক হালকা করে!ʼʼ
মুখ ছেঁড়ে দিলো। শাড়ির আঁচল ঠিক করে জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিয়ে শক্ত দুটো কিল বসাল ফারজাদের বাহুতে। ফারজাদ আর্তনাদ করে উঠল, “আহহ!ʼʼ হাতে থাপ্পড় তুলল দ্বিজার দিকে। সেই হাত টেনে নিয়ে একটা কামড় দিলো দ্বিজা। বামহাত দিয়ে দ্বিজার মাথার ওপর গাট্টা মারল ফারজাদ, “দ্বিজা! তুই তো মাংসাশী হয়ে গেছিস! দেখি নখ দেখি! রাতেও খামছেছিস। তোর মতো জাহিলকে ওখানে নিয়ে গেলে আমার কাজকাম আর করা লাগবে না। যা নেইল কাটার আন। এক যুগ আগে মরা পেত্নির মতো নখ গজিয়েছে হাতে, কাটার আন যা! নয়ত তোর বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ!ʼʼ
দ্বিজা চেঁচাল, “নিজেই যেতে পারি আমার বাপের বাড়ি, ইভেন আপনি যদি ওই ডিউটিতে আবার যান, আমি আর ফিরবই না।ʼʼ
-“কার সাথে পালাবি ঠিক করেছিস?ʼʼ
-“কী মুখের ভাষার ছিরি! আপনার মতো নাকি আমি?ʼʼ
-“আমার মতো কী? আমি কয়টা নিয়ে পালিয়েছি?ʼʼ
দ্বিজা আর কথা বলতে পারল না। তার কান্না পাচ্ছে, গলা আটকে আসছে। তার জীবনে সুখ স্থায়ী হয় না কেন? কাল রাতটা সুখের ছিল, কাঙ্ক্ষিত পুরুষটি তার কাছে ছিল। সূর্যোদয়ে সঙ্গে সমান্তরাল হারে পাল্লা দিয়ে বিষাদ ঘনিয়ে আসছে! ফারজাদ বাথরুমে গেল ফ্রেস হতে, ওভাবেই শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে বসে রইল বিছানার ওপর। ফারজাদ ঠিকই বলেছিল, তাকে চাওয়া দ্বিজার একদম ঠিক হয়নি। অন্তত এরকম মরণঘাতি পেশার জন্য হলেও ঠিক হয়নি। যে পেশা জীবন নিয়ে টানাটানি ডেকে আনে, সেই পেশাগত একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী সরূপ মানুষকে চাওয়া দ্বিজার একটুও ঠিক হয়নি।
দরজায় ধাক্কা পড়ল। দ্রুত চোখ-মুখ মুছে নিলো দ্বিজা, কাতান শাড়ির আচলের ঘষায় মুখটা লাল হয়ে উঠল। ফারহানা ঢুকলেন ভেতরে। দ্বিজার ভেজা চুল থেকে পানি পড়ছে। ফারহানা বললেন, “এখনও মাথা মুছতে শিখিসনি? সে কই?ʼʼ
-“বাথরুমে। তুমি বসো, মামি।ʼʼ
ভ্রু কুঁচকালেন ফারহানা, “চোখ-মুখ এমন লাগতেছে ক্যান? কী হইছে?ʼʼ
মাথা ঝাঁকাল দ্বিজা, “কিছু না।ʼʼ
ফারহানা মানলেন না, “কী হইছে, ফারজাদ কিছু বলছে?ʼʼ
দ্বিজার বাঁধ ভাঙল, “মামি! তোমার ছেলে আবার যাবে ওই চাকরিতে, আজকেই!ʼʼ
কেঁদে ফেলল দ্বিজা। ফারহানা বেগম থমকালেন। আস্তে করে বসলেন বিছানায়, অপারগ কণ্ঠে বললেন, “আমার ভাল্লাগেনা এইসব আর। আমার কথা শুনলে বুঝাইতাম। ছেলে আমার সাথে কথাই বলে না, আর আমার কথা শুনবে!ʼʼ
মামির আহত স্বরের আফসোস শুনে দ্বিজার আরও খারাপ লাগল। ফারহানা কাছে টেনে নিলেন দ্বিজাকে। চোখ মুছে দিয়ে বললেন, “আমি ব্যর্থ ছেলে মানুষ করতে। আমি মা হিসাবে ব্যর্থ, ছেলের মন জয় করে চলতে পারি । নাই। আমার কিছু কওয়ারও নাই এইখানে। আমি কিছু বললে সে শুনবে না, তখন আরও খারাপ লাগে আমার। তুই একটু বুঝা ওরে ভালো করে। মার কথা না-ই বা শুনল বউয়ের কথা শুনবে। তোর জন্যেই তো এবার কথা বন্ধ করছে!ʼʼ
কথাটা ভালো লাগল না শুনতে দ্বিজার। মামি যেন ঘুরিয়ে পেচিয়ে শাশুরিদের মতো কথা বললেন। তার ছেলে দ্বিজার জন্য তাদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেছে, আকার ইঙ্গিতে তা-ই বুঝিয়ে দিলেন যেন! মলিন হাসল সে, “তোমার ধারণা ভুল। আমার সাথেও তার এমন সম্পর্ক নেই, যে আমি বললেই যেকোনো কথা রাখার তাগিদে তা মেনে নেবে। মামাকে বলো নাহয়।ʼʼ
ফারহানা চলে গেলেন। দ্বিজার মন আরও খারাপ হয়ে উঠল। বাড়িতে এখনও অনেক লোক। আরও আসবে দুপুর হতে হতে। ওই বাড়িতে যেতে হবে। ফারজাদ গোসলে ঢুকেছে, গোসল করেই কি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করবে?
বিছানাটা গুছিয়ে ফেলল। ফুলের গন্ধ ঘরজুড়ে এখনও অল্প-সল্প পাওয়া যাচ্ছে, অথচ তা আর দ্বিজাকে আনন্দ দিচ্ছে না। বিছানায় ফুলের ছেঁড়া পাপড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তা দেখে দ্বিজা উপহাসের হাসি হাসল। তার জীবনে আবার ফুল আর সুখ! দুটোই মরিচিকা। দেখতে দেখা যায়, ধরার উপায় নেই। সে বোঝে, ফারজাদের পেশাটা এমনই। তবুও কেন জানি ছাড়তে সাহস হয় না ফারজাদকে। একবার একদিন ছেড়ে এসে, যা হারাতে বসেছিল, জীবন চলে গেল তার মাশুল গুণতে। আবার ছাড়বে ফারজাদকে, অসম্ভব। মরতে তো অসুবিধা নেই, একটুও নেই, যদি ফারজাদ পাশে থাকে। অথচ পাশে রাখতেই লোকটার কত আপত্তি!
ফারজাদ বের হলো গোসল সেড়ে। জিজ্ঞেস করল না, আম্মা এসেছিল কিনা! সরাসরি দ্বিজার দিকে তাকাল, মাত্রই চোখদুটো মুছেছে, জল শুকায়নি। সদ্য গোসল করা মেয়েদের শাড়ি পরে বের হওয়া ঠিক না, ফারজাদ মনে মনে ঘোষনা করল। মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হতাশ শ্বাস ফেলল। ফারজাদ বোঝাতে পারে না, আর এরা বোঝেও না! ঢাকায় নিয়ে যাবে দ্বিজাকে, সে যা করতে যাচ্ছে, তাতে যেকোনো কিছু হতে পারে, যেকোনো কিছু। একবার বেঁচে ফিরেছে কারণবশত। ওরা মারতে চায়নি বিধায় দ্বিতীয় আরেকটা গুলি চালিয়েছিল না। অথচ এবার আর ছাড়বে না পেলে, হতে পারে লাশও পাওয়া যাবে না। সেই অনিশ্চিত ক্ষেত্রে এই মেয়েকে নিয়ে গিয়ে এর খারাপ কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করার উপায় কী! মরেও শান্তি পাওয়ার নয়। একবার যা হয়েছে তাতেও তো খানিকটা বুঝ এসে যাবার কথা এদের মাঝে! সেদিন দ্বিজা ফারজাদের সাথে থাকলে হতে পারতো জঘন্য কিছু ঘটতে পারতো এই মেয়ের সাথে। ফারজাদ তো শেষ, বেশি র ক্তক্ষরণ হলে ঘটনাস্থলেই কাহিনি শেষ হতে পারতো। আর তারপর? তারপর দ্বিজার কী হতো? ফারজাদ তো সুপারহিরো নয়! সাধারণ মানুষ! একা ফ্লাটে রেখে গিয়ে বুকের কপাটিকায় বিশাল এক তালা মেরে রাখতে হয়, তবুও ভেতর থেকে ধাক্কায় প্রতিক্ষণে। কখন কী হয়ে যায়, কার নজরে পড়ে যাবে, তারপর রেজাল্ট বের হয়েছে, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চেষ্টা করার মতো পড়ালেখার ব্যস্ততায় সময় কাটবে। ঢাকায় নিয়ে গিয়ে কোথায় পড়াবে, কী দিয়ে কী করবে? প্রতিক্ষণে ওর সাথে ফাদজাদের থাকতে হবে ঢাকার শহরে। তা সম্ভব নয়। এই মেয়ে বুঝবে এসব? সম্ভাবনা নেই। তাকে রেখে যেতে ফারজাদের ব্যথা হচ্ছে কোথাও, রোজ রোজকার ঝগড়া, মাথার চুল টেনে দেয়া, একসাথ বসে খাওয়া, কতকিছুই তো মিস করে ব্যথা করবে ফারজাদের বুকে।
বিরক্ত হয়ে উঠল ফারজাদ। ধপ করে বসল বিছানায় পা ঝুলিয়ে। ঝুঁকে বসে চুল আঁকড়ে ধরল নিজের। ধমকে উঠল দ্বিজাকে, “বলেছিলাম না তোকে আমার থেকে দূরে থাকতে? বলেছিলাম আমার জীবনের নিশ্চয়তা নেই, আমার সাথে নিজেকে জুড়ে নরকে ঝাপ দিস না! বলেছিলাম কি-না! জুকার মনে হয় আমাকে তোর, এমনিই বালছাল বকতে থাকি রাইট?ʼʼ
দ্বিজা এগিয়ে এসে বসল ফারজাদের কাছে। আবদারের সুরে বলল, “আচ্ছা, আপনি যান ডিউটিতে, কিন্তু আমি যাব আপনার সঙ্গে।ʼʼ
ফারজাদ ঘুরে বসল দ্বিজার দিকে। সোজা নজর দিলো দ্বিজার কম্পনরত ঠোঁটের দিকে, কখন জানি ভেঙে পড়বে তা কান্নার তোড়ে। চট করে দ্বিজার পেছনের চুল মুঠো করে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। গাঢ় এক চুম্বন শেষে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, “এতো মায়া লাগাচ্ছিস কেন, দ্বিজা? তোর ভাঙা ঠোঁট, ভেজা চোখ আমায় ডিউটিতে ছলনা করাতে উস্কানি দিচ্ছে। যেটা পাপ হবে। বিশ্বাস কর, তোর এই ঠোঁটের মায়া আমায় মনোযোগভ্রষ্ট করে তুলেছে নিজের ওপর থেকে। আজকাল খুব কর্তব্যজ্ঞানহীন হয়ে উঠেছি, ইচ্ছে করে তুই কেঁদে ফেলার আগেই তোর সব কথা মেনে নিই, কাঁদতে প্রস্তুত চোখদুটো হেসে উঠুক, আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।ʼʼ
দ্বিজা আবার কেঁদে উঠল আবারও, আমি থাকতে পারব না আপনাকে ছাড়া। আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে, আমি মরে থাকব এই ঘরে একা আপনি ছাড়া। আপনি কোথায় কীভাবে থাকবেন…ʼʼ
ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আর কথা বলতে পারল না দ্বিজা। ফারজাদের অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের মাঝটায়। অবরুদ্ধ হয়ে আসছে শ্বাস যেন! বহুত জ্বালা সে সয়েছে এই জীবনে, তবে এটা আলাদা! ফারজাদ বুঝতে পারে, এটা একদম আলাদা! এরকম জ্বালা আগে হয়নি। এই মেয়ের কান্না তাকে বিশ্রীভাবে দূর্বল করে তুলছে, অস্থির লাগছে ভেতরটায়। দুহাতে দ্বিজার মুখটা আজলা ভর্তি পানির মতো চেপে ধরল। কাঁদছে মেয়েটা, তাকে হারানোর ভয়ে, তার থেকে দূরত্বের ভয়ে কেউ কাঁদছে। নেহাত ছোট্ট একটা মেয়ে কাঁদছে কেমন হাহাকার করে। বারবার দু’দিকে মাথা নাড়ছে, “আমি থাকব না এখানে, চলুন আমি যাব ঢাকাতে, এবার আর একটুও কষ্ট হবে না আমার একা থাকতে। সত্যি বলছি, সারাদিন একা একা থাকব, অপেক্ষা করব রাতে আপনার ফ্লাটে ফেরার।ʼʼ
ফারজাদ এক ঝটকায় শক্ত করে বুকে চেপে ধরল দ্বিজার মাথাটা। হা করে শ্বাস ফেলল দুটো। বুকের ওপর পড়ে ছোট্ট শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিন্তু তাকে তো যেতে হবে। চাকরি ছাড়াটা অনেকটা চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতো হয়ে যাবে। চুলে হাত বুলিয়ে বুক থেকে তুলল দ্বিজাকে। মৃদু ধমক দিলো, “কান্না বন্ধ কর। নিয়ে যাব, এখন চুপ কর। এবার যাই, বেশিদিন এখানে থাকতে হবে না। এরপরের বার ফিরেই নিয়ে যাব। তবে যদি ঢাকার কোনো ভার্সিটিতে চান্স হয়। নয়ত পড়ালেখার জন্য হলেও এখানেই থাকতে হবে! এখন সংসার ঝেরে ফেলে পড়ালেখায় মনোযোগ দে। ভাববি, তোর বিয়েই হয়নি, টুকটাক প্রেমে পড়ছিস কেবল আমার, মাঝেমধ্যেই অল্পক্ষণের জন্য মনে পড়বে, এরপর আবার পড়তে বসা। রেজাল্টের পর ভার্সিটির ভর্তিপরীক্ষার আর বেশি সময় থাকে না। ওখানে গেলে পড়ালেখা হবে না। আর এটা তোর সংসার করার নয়, ক্যারিয়ার গড়ার সময়। এসব না বুঝেই অবুঝের মতো কাঁদলে একটা থাবড়া মেরে কান গরম করে দেব।ʼʼ
দ্বিজা নাক টানল, ফারজাদ তাকে কী বলছে মাথায় ঢুকেও ঢুকছে না। কত সহজে বলে দিলো মাঝেমধ্যে মনে করতে। অথচ একটা মুহুর্ত না ভেবে থাকা সম্ভব নয়। দু’দিনের জন্য এসে যে সংবাদ সে পেয়েছে, এরপর প্রতিটা প্রহর এই গণনায় কাটবে কীভাবে কোথায় আছে ফারজাদ, কখন কোন খবর এসে পৌঁছায়! মুখে দ্বিজার আন্তরিকতার ছাপ ফুটে উঠল, ভারী হয়ে উঠল মুখটা, শুকনো নাক টেনে আস্তে করে জড়িয়ে ধরল ফারজাদকে। এবারের জড়িয়ে ধরায় ব্যাকুলতা নেই, আছে অন্যকিছু। ফারজাদ আঁতকে উঠল। কীসের এক অদম্য শক্তি যেন নাড়া দিলো তাকে শক্ত মুখে মাথাটাও শক্ত করে চেপে ধরল ফারজাদের বুকে দ্বিজা। চোখটা বুজে নিলো চেপে। ফারজাদ না চাইতেই দিশেহারার মতো চেপে ধরল মেয়েটাকে। দ্বিজা নীরবে তাকে শুষে নিচ্ছে যেন নিজের মাঝে, চির অ-বিদায় দিচ্ছে ফারজাদকে। কঠোর এক অনুভূতির অভ্যন্তরীণ বহিঃপ্রকাশ যেন এই নির্লিপ্ততা। গা’টা শিউরে উঠল দ্বিজার। তা ফারজাদকে আবারও বোঝাল, দ্বিজা তাকে গ্রহন করছে চিরতরে, সে আর হারালেও হারাবে না কোনোদিন দ্বিজার মাঝ থেকে। তাকে কেঁড়ে নেয়ার সাধ্যটা কেঁড়ে নিলো বোধহয় দ্বিজা প্রকৃতির কাছ থেকে। যে ভেতরে রয়ে যায় তার চলে যাওয়ার উপায় কী? সেভাবে গ্রহন করছে দ্বিজা ফারজাদকে।
এক নিঃশব্দ শত্রুতায় নামল দ্বিজা প্রকৃতির সঙ্গে। হাতরে হাতরে ফারজাদকে বুকের গভীর থেকে গভীরে চাপতে চাইছে দ্বিজা। অথচ কাঁদছে না মেয়েটা। এই কঠিনতম তরান্বয়ের নাম কী দেবে ফারজাদ! হুট করে মনে হলো, মনে মনে আর কতটুকু ভালোবাসা যায়! অন্তত ততটা নয়, যতটা লোকসম্মুখে চলে আসা পাগলদের বুকে জমে থাকে। ভালোবাসা নীরবে হয়, তবে ততটা নয় যতটা কারও সামনে চলে আসা ভালোবাসারা হয়। সামনে এসে পাগলামী রূপে ধরা দেয় কোন ভালোবাসা? যে ভালোবাসার তীব্রতা বুকের এত গভীর আর জায়গা পায় না, তীব্রতাটুকু স্বতঃস্ফূর্ত প্রকিয়ায় বুকের দেয়াল চিড়ে বাইরে আসে, অতি অবশিষ্টটুকু বোধহয় বাইরে বেরিয়ে আসে পাগলামী বা আসক্তি রূপে। যা নাম বদলে তখন ভালোবাসা থেকে ইংরেজিতে ‘পেশনʼ হয়ে ওঠে।
লালচে একটা শাড়ি পরনে দ্বিজার, সেটাও অযত্নে শরীরে পরে আছে। ফারজাদ বয়ে গেছে কোখাও ভাসমান সবুজ শেওলার মতোন! সেই মানসিক আসক্তি ছাপিয়ে এক পর্যায়ে দ্বিজার লাবন্যময়ী শরীরটাও খুব টানল ফারজাদকে। নির্লজ্জের মতো আবদার করে বসল, “রাতের গাড়িতে যাব ঢাকা, এখন তোকে লাগবে আমার, একটা বেলা তোর আমাকে দে!ʼʼ
চলবে..