তপ্ত সরোবরে পর্ব-১২+১৩+১৪

0
704

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা

১২.

পরদিন কলেজ ছুটির পর ইভা পুরো ক্যাম্পাস খুব খুঁজল ফারজাদকে, অথচ দেখা পেল না। পরীক্ষার আর সপ্তাহখানেকও নেই। কখন সাজেশন নিবে, কবে পড়বে? ক্ষুন্ন মনে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়ে খানিক দূর অগ্রসর হতেই সামনে এলো ফারজাদের দুই বন্ধু মাহদি ও নাহিদ। ওরা একটু হাপাচ্ছে, সাথে চোখে-মুখেও বিরক্তি। ওর হাতে একটা খাতা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “নাও তোমার সাজেশন। কালকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেবে, মনে থাকে যেন।ʼʼ

ইভা অবাক হয়—অক্ষত অবস্থায়! কেন, সে কি খাতাটার সঙ্গে মারামারি করবে নাকি? তখনই মনে পড়ল ফারজাদের কথা–অদ্ভুত ছেলে! কাল বলল, খাতা দেবে, আজ দেখা নেই। কৌতূহল মেটাতে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এই খাতাটা কার?ʼʼ

মাহদি এমনিতেই চরম দুষ্টু। ও দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বলল, “কেন? তার ছাড়া আর কারও খাতা নেবে না নাকি, হু?ʼʼ

ইভা হকচকাল, একটু অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকাল।

মাহদি আর নাহিদ ওকে রেখেই দৌঁড়ে যায় গেইটের বাইরে কলেজের পেছনের দিকটায়। ফারজাদ দাঁড়িয়ে কোকের ক্যান খুলছে। পেছন থেকে নাহিদ গিয়ে পিঠে একটা চাপর মেরে বলল, “মামা, তোমার ঘাঁড়ে জিন আছে এইডাতে সন্দেহ নাই। কখন কী করোছ, নিজে বুঝোছ তো আবার?ʼʼ

ফারজাদ ক্যানে কয়েকটা চুমুক দিয়ে রিলাক্সলি খানিকটা কোক খেয়ে নিয়ে মাহদির দিকে ক্যানটা প্রায় ছুড়ে দিয়ে বলল, “মেয়েদের আশেপাশে খুব যেতে নেই। ওরা সস্তা ভাবে, সাথে হ্যাংলাও!ʼʼ

“ও আমার মূল্যবান! মেয়েটাই তোর কাছে এসেছিল, আবার নম্বারও চেয়েছে। আমার তো মনে হচ্ছে তোর ওপর পিছলে গেছে, মামা!ʼʼ

ফারজাদের কপাল সবসময় কুঁচকেই থাকে, এবার মুখটা বিকৃত করে বলল, “পিছলে গেছে, টেনে তোল। মানবিকতা কাজে লাগা।ʼʼ

“মামা! এই সুযোগ হতছাড়া করবি তুই?ʼʼ

ফারজাদ নাহিদের হাত থেকে ক্যানটা কেঁড়ে নিলো, তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “এটা সুযোগ? তুই আমার বন্ধু মানুষ, তোকে দিয়ে দিলাম, কাজে লাগা।ʼʼ

মাহদি হেঁয়ালি করে, “তালা খুলতে সঠিক চাবির প্রয়োজন। অন্য চাবি দিয়ে শত ঘুরালেও কাজ হবে না।ʼʼ

তিন বন্ধু এবার সশব্দে হেসে উঠল হেলেদুলে। ওরা জানে, ফারজাদ চরম সুফি টাইপের লোক। কারও গা ঘেঁষার মধ্যে নেই। এ নেহাত এক মজাই কেবল। ফারজাদ জীবনেও মাখামাখি সম্পর্কে তাও আবার এই বয়সে জড়াবে না, শুধু বন্ধুত্বও না।

পরদিন ইভা এলো ওদের সামনে। ফারজাদ মনোযোগ সহকারে খাতায় লিখছে মাঠের এককোণে বসে। মেয়েটা এসে দাঁড়িয়েছে, তা সে টের পেয়ে আড়চোখে দেখেছে, অথচ চোখ তুলে তাকাল না। ইভা আজ চরম কৌতূহলের সাথে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ফারজাদকে। তা লক্ষ করে মাহদি, নাহিদ হাসছে একাধারে। একসময় ইভা খাতা এগিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার খাতা!ʼʼ

ফারজাদ মাথা তুলে তাকায়। যাক খানিক মতিগতি হয়েছে মেয়েটার, তুমি বলছে। ফারজাদ মৃদু মাথা নেড়ে খাতাটা নিয়ে পাশে রেখে দিয়ে আবার মনোযোগ দিলো নিজের কাজে। ইভার আগ্রহ ও কৌতুহল বাড়ছে ফারজাদকে নিয়ে। সে নিজে নম্বর দিতে চেয়েছে ছেলেটা নেয়নি, নিজের নাম বলেনি, গতকাল দেখা করেনি। আর প্রথমবার তাও বেশ কয়েকটা কথা বলেছিল। আজ ঠিকঠাক তাকাচ্ছেও না, ইভা জড়তা কাটিয়ে চটপটে গলায় বলল, “বসব এখানে?ʼʼ

ফারজাদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল একবার ইভার মুখের দিকে, আবার নিজের পাশে ফাঁকা জায়গায় তাকিয়ে ঘাঁড় নেড়ে ইশারা করল বসতে। মেয়েটা মনোযোগ সহকারে দেখছে ফারজাদের লেখালেখি। সে অদ্ভুত এক টান অনুভব করছে ছেলেটার প্রতি। হঠাৎ-ই মনে হচ্ছে ছেলেটা সবার থেকে আলাদা। নিজে থেকে আগ্রহ কেন নেই তার ইভার সঙ্গে আলাপ করতে? এই বিষয়টা ইভাকে যেমন বিব্রত করছে, তেমন টানছে। সে দেখল ফারজাদ নোট করছে, তবুও জিজ্ঞেস করল, “নোট তৈরী করছ?ʼʼ

ফারজাদ মাথা নেড়ে অস্পষ্ট উচ্চারণ করল, “হু!ʼʼ

ইভা কথা খুঁজে পায় না আর। সে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে এলোমেলো চোখ ফেলে। কিছুটা সময় ফারজাদ নিজেই জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে নাকি?ʼʼ

বলেই সে তাকাল ইভার দিকে। চোখাচোখি হয় দুজনের। ইভা চট করে চোখ নামাল। ফারজাদ হেসে ফেলে নিঃশব্দে। গত পরশু মেয়েটাকে দেখার পর থেকে তার মনে হচ্ছে— মেয়েদের চোরা, নাজুক নজর বেশ আকর্ষনীয় এক বিষয়বস্তু, নাকি শুধু এই মেয়েটারই। আসলেই ইভার চোখের পাপড়ি জোড়া সুন্দর। ফারজাদ যে কয়বারই তাকিয়েছে মুহুর্তের জন্য হলেও আটকে গেছে। ইভা বেশ ইতস্তত করে কিছুক্ষণ পর বলল, “ফ্রেণ্ড হবে আমার?ʼʼ

ফারজাদ বিশেষ অবাক হলো না, মেয়েটা আর সবাইকে রেখে ওর ফ্রেণ্ড হতে চাইছে। এরকমটা হয়েছে বরাবরই ওর সঙ্গে। হয়ত ওর নিজেকে গুটিয়ে চলা স্বভাবের জন্যই মানুষ আগ্রহী হয় ওর মাঝে! ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, “ঢাকাতে তো নিজস্ব বাসা না, কোথা থেকে এসেছ?ʼʼ

“বাবা বড়ো পুলিশ কর্মকর্তা। ঢাকাতে বদলি হয়েছে, এজন্যই এখন আপাতত ঢাকাতে আছি। আর তুমি?ʼʼ

ফারজাদ বুঝল, এজন্যই মেয়েটা সবার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারছে না। ছোটো থেকে এভাবে জায়গা বদলে মানুষ, আর পুলিশের ছেলেমেয়েদের জীবনযাত্রা এমনিতেই একটু একঘরে টাইপের হয়। তবে এবারের কথাটা ইভা তুলনামূলক চটচটে কণ্ঠে বলেছে। ফারজাদ দেখল, মেয়েটা সহজ হচ্ছে ওর সঙ্গে। বলল, আমি কুমিল্লা থেকে এসেছি, “চাচার বাসায় থেকে কলেজ করছি।ʼʼ

“তোমার নাম তো বললে না এখনও?ʼʼ

“ওপপস! বলিনি না? ফারজাদ ইয়াজরান খান।ʼʼ

ইভার মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হলো তার খুব পছন্দ হয়েছে নামটা। প্রসন্ন চিত্তে মেয়েটা হাসল। ফারজাদের আচমকা মনে হয় মেয়েটা সুন্দর, খুব সুন্দর, আদুরে! ফারজাদ যখন অন্যদিকে তাকাচ্ছে, ইভা ওকে দেখছে, এটা বুঝতে পেরে ফারজাদ বারবার ইভার দিকে ফিরে তাকিয়ে ওকে বিব্রত করছে। এই-যে মেয়েটা খুব অপ্রস্তুত হচ্ছে, ফারজাদের মজা লাগছে খুব। মাহদি আর নাহিদ ওদিকে স্ট্যাচুর মতো বসে আছে। তারা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না আপাতত। হঠাৎ-ই ইভা হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। তাকে বিক্ষিপ্ত দেখায়, ছটফটে হাতে ব্যাগটা মাটি থেকে তুলে কাধে তুলে সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে দৌঁড়ে গেল সামনের দিকে। ফারজাদ ভ্রু কুঁচকে ওর যাওয়ার দিক অনুসরণ করে তাকায়। দেখল, একটা পুলিশ এসে মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ইভা গিয়ে দাঁড়াল তার সামনে। ইভাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায় লোকটা।

নাহিদ এবার ফারজাদকে ধাক্কা দিলো, “কিরে! এইডা তোর হবু শশুর আব্বা নাকি, মামা?ʼʼ

ফারজাদ ওকে একটা থাবর মেরে গম্ভীর মুখে তাকাল, “ওই লোকটাকে দেখে তোর মনে হলো, যে এরকম কলেজ পড়ুয়া একটা মেয়ে থাকতে পারে তার?ʼʼ

নাহিদ মাথা চুলকায় বোকার মতো। মাহদি বলল, “আরে শুনলি না? বড়ো পুলিশ অফিসার ওর বাপ। এইটা হয়ত কনস্টেবল হবে, বড়ো স্যারের মেয়েকে নিতে এসেছে। জানিস তো এদের সব জায়গায় নিরাপত্তা!ʼʼ

ফারজাদ খাতা ব্যাগে ঢুকাচ্ছে। হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে মাহদি ফারজাদকে ডেকে বলল, ভাই! এসব আহ্লাদী মেয়েদের সাথে প্রেম করলে ফাঁসবি, মামা! এরা বন্দি পাখির মতো একা একা জীবন-যাপন করতে করতে অসামাজিক আর মানবিকতাহীন হয়ে পড়ে। এই মেয়েটা যদিও আলাদা, তবে এরা কিন্তু খুব রুলসের মধ্যে চলে, বলতে পারিস রোবট টাইপের। মেয়েটাকে দেখেছিস, আর পেছন ফিরে দেখলও না তোকে। মনে হয়, বাপকে খুব ভয় পায়?ʼʼ

ফারজাদ বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল ব্যাগ নিয়ে। মুখ বিকৃত করে বলল, “তো? এসব পুঁথি আমায় শোনাচ্ছিস কোন দুঃখে?ʼʼ

মাহদি দুষ্টু হেসে নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল, “নাহ, বলছি আর কী! গরীবের কথা পুরাতন হলে মনে পড়ে।ʼʼ

ফারজাদ মৃদু একটা লাথি দিলো ওর পায়ে, বলল, “সর, শালা। তোর নতুন পুরাতন কথা রাখ। বউমা অপেক্ষা করবে, আমার যাওয়া লাগবে।ʼʼ

এরপর থেকে ইভার সাথে ফরজাদের অদ্ভুত এক সম্পর্ক গড়ে উঠল। শুরুটা ইভা করেছিল, নিজে যেচে পড়ে। নিঃসঙ্গ জীবনে হয়ত বিরক্ত হয়ে মেয়েটা ফারজাদকে বেছে নিলো কলেজের সময়টুকু কোনো এক অদ্ভুত সুন্দর ছেলের সাথে লুকোচুরি খেলে সুন্দর সময় কাটানোর জন্য। প্রতিদিন ছুটির পর যতটুকু সময় ইভার গাড়ি না আসতো সে চলে যেত ফারজাদের কাছে। ফারজাদের থেকে নম্বর নিলো। ইভা মাঝেমধ্যে কল দিতে দিতে একসময় নিয়মিত কর্ম হয়ে দাঁড়াল। ফরজাদ বদলালো, বদলায় তার নিত্যদিনের রুটিন। এই ফারজাদকে আজকাল খুব হাসতে দেখা যায়, পড়ালেখা থেকে দুরত্ব বাড়তে থাকল তার, বিকেল হলে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময়টুকু সে কাটাতো ইভাদের বাড়ির গলির আশেপাশে ঘুরে ফিরে। বারান্দায় এসে কখন ইভা দাঁড়াবে, সেই জন্য ওদের কলোনির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে ফারজাদকে।

যখন দুজনেই ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে, ফারজাদের পড়ার ঘাটতি পড়ে গেছে এর মাঝে বহুত। বাংলাদেশের রেংকিংয়ে সেরা কলেজগুলোর মাঝে একটাতে পড়ে ফারজাদ, অথচ তার আপাত পড়ালেখার মান তার সহপাঠীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। তবে ফারজাদ চাইলেও আর আগের মতো পড়ালেখায় মনোযোগী হতে পারে না। নিজেকে বাহানা দিতে শিখলে মানুষের আর কারও আশকারার প্রয়োজন হয় না। তখন সে নিজেই নিজের সর্বোচ্চ সাফল্য অথবা ধ্বংস হয়ে দেখা দেয়। ফারজাদের এই নিজেকে দেওয়া বাহানা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে তা ভাবার ফুরসত পায় না আজকাল। পড়তে বসলেই উড়ুউড়ু মন বাহানা বানায়—আরে সে যা ব্রিলিয়ান্ট, এই পড়াগুলো পরীক্ষার আগেই করে ফেলতে পারবে। এখনও যথেষ্ট সময় আছে হাতে।

ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় পায়চারী করতে করতেই কেটে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। ইভাকে যখন-তখন কল দেওয়া যায় না। মেয়েটা কল দিলে তবেই সে কল ব্যাক করে কথা বলতে পারে।

ইভা আজকাল আবদার করে তার কাছে। একসাথে সময় কাটানোর ব্যবস্থাপনার বুদ্ধিগুলোও তারই। কলেজের সময়টুকু তারা দুজনে বের হয়ে যায় ঘুরতে, ইভা অবাক চোখে চেয়ে দেখে শহর-বাজার, ফুসকার স্টল, মেলায় চুড়ির দোকানগুলো, অথবা পার্কের এককোণে বসে মাঝেমধ্যে বাদাম খাওয়া। ফারজাদ তো মুখে প্রকাশ করতে পারে না তার অনুভূতি, তবে মনের আনন্দে তার জোয়ার আসে, যখন ইভার চোখমুখে সে উপচে পড়া খুশি দেখে। ইভা হাঁটতে হাঁটতে কখনও নির্জন রাস্তা পেলে ফারজাদের হাতের মাঝে নিজের আঙুল গুজে দেয়। ফারজাদ কেন জানি মানা করতে পারে না। বরং আবেশে চোখটা বুজে বুক ফুলিয়ে একটা শ্বাস নেয়। কোথাও সে আটকে যাচ্ছে এই মেয়েতে, জঘন্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মেয়েটা। যা তাকে তার জাগতিক চিন্তাভাবনা, নিজের পথচলা, ক্যারিয়ার, নিজস্ব স্বভাব–সবকিছু থেকে দূরে এনে ফেলেছে।

কেটে যাচ্ছে দিন। তাদের এই সম্পর্কের বছর পার হয়ে গেছে। আর দুমাস বাদে ফাইনাল পরীক্ষা। অথচ ফারজাদ দিন-দিন মগ্ন হয়ে যাচ্ছে এই মেয়েটার মাঝে। ইভা মাঝেমধ্যে অনেক কিছুই বোঝায়, বলে। অথচ ফারজাদ নিজেকে মেলে ধরতে পারে না। সে কতদিন কতভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যায় ইভার সামনে, অথচ সামনে গেলেই জিহ্বায় আটকে যায়। মেয়েটা মিষ্টি, খুব কোমল, আর ভয়টা তার একটু বেশিই নিজের পরিবারকে নিয়ে। ফারজাদ যদিও কখনোই কোনো ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করা অথবা জোরপূর্বক সম্পর্কে কোনোরকম মাখামাখি বিষয় উপস্থাপন করে না। এমনকি ছেলেটা আজ অবধি সরাসরি প্রপোজটাও করতে পারেনি। ইভা প্রায়ই প্রস্তুতি নিয়ে আসে আজ হয়ত ফারজাদ তাকে বন্ধু থেকে প্রেমিকা বানানোর প্রস্তাব দেবে। যদিও ইভা বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর থেকে সম্পর্ক শুরু হলেও তার মাঝে বন্ধুত্বের চেয়ে প্রেমময় টান’টাই বেশি ছিল। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে ফারজাদের স্বভাব গুলো ইভার। নিজে থেকে কখনও কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করে না ছেলেটা। ইভাই বরং দু-একবার হাত অথবা বাহু চেপে ধরেছে ফারজাদের।

ফারজাদের ভাবার সময় নেই নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে। সবসময় ইভা, ইভার সঙ্গে কাটানো মুহুর্ত, ইভাকে নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনার মাঝে কেটে যাচ্ছে সময়। ফারজাদ অবাক হয়, দিন যাচ্ছে, সে বড়ো হচ্ছে, আর ভেতরে একটা সঙ্গীর চাহিদা অদম্যভাবে বাড়ছে তার মাঝে। আর সেই সঙ্গীকে কল্পনা করলেই সামনে ভেসে ওঠে ইভার সরল, ভয়াতুর, চোরা চোখের নাজুক মুখটা। ইভার বিড়ালের ন্যায় ঘন পাপড়ি মেলানো চোখের পাতাটা।

সেদিন মেয়েটা বায়না করল, উত্তরাতে মেলা বসেছে, তারা যাবে। এইচএসসির প্রস্তুতি ব্যাচে একই কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে তারা। কোচিংয়ের সময়টা মেরে দিয়ে ইভাকে নিয়ে গেছিল ফারজাদ। অথচ হাতে টাকা না থাকায় কিছুই কিনে দিতে পারেনি। এ ব্যাপারে সে যেমন লজ্জিত। তেমনই দুঃখিত।

আজকাল মেয়েটাকে তার উপহার দিতে ইচ্ছে করে, তারপর তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে ইভার খুশি হওয়া হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা। হঠাৎ-ই একমাসে সে এক প্রাইভেটের টাকা মেরে দিলো। যাবে না আর পরবর্তিতে সেই প্রাইভেটে কোনোদিন। প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ছেলেটা হুট করে এই ছোটো কাজটা করে বসল। মনের মধ্যে খচখচ করছে খুব, অস্থির লাগছে। তবুও পরেরদিন কলেজে ওভাবেই টাকাগুলো নিয়ে ইভার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আবেগ ঘিরে ধরল ঊনিশ বছর বয়সী যুবক ফারজাদকে। ভুলে গেল আপাতত নিজের করা ছোটো কাজটা। তারা দুজন মেলাতে যায়। ফারজাদ ঘুরে ঘুরে ইভাকে ফুসকা খাওয়ায়, চুড়ি কিনে দিলো, সাথে কয়েকটা চুলে ক্লিপ, আংটি প্রভৃতি ছোটোখাটো অনেক জিনিস। শেষ অবধি হাতে দুটো সাদা ও গোলাপি রঙা হাওয়াই মিঠাই জোর করে কিনে দেয় ফারজাদ। ইভা ভয় পাচ্ছে–সে এসব রাখবে কোথায়? তবুও ফারজাদের জোরাজুরিতে নিলো। ফারজাদ আশ্বাস দিলো,

“ছোটো ছোটো জিনিসগুলো তুমি আজই নিতে পারবে। বাকিগুলো আমার কাছে থাকবে, দিনে দিনে নিয়ে যাবে।ʼʼ

কলেজের শেষ পিরিয়ড চলছে। দুজনে কলেজে ফিরে গেইটের সামনে এসে, হঠাৎ-ই ইভার মুখের রঙচঙ উড়ে বিবর্ণ হয়ে গেল, গেইটের সামনে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে..

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৩.

দুপুরের তপ্ত রোদ মাথার ওপরে। ইভা ঘামছে, তার বুকের কাঁপুনি বোধহয় ফারজাদও টের পাচ্ছে। গাড়িটা ফাঁকা, গাড়িতে কেউ নেই। ইভা কাঁপা বুকটা নিয়ে ভেতরে ঢূকল গেইট দিয়ে। ফারজাদ তার সঙ্গে হাঁটছে। কলেজের মাঠে পৌঁছে ইভা চাপা স্বরে বলে ওঠে, “তুমি আমার সঙ্গে হাঁটছ কেন? দূরে যাও, কেউ যেন বুঝতে না পারে তুমি আমার সঙ্গে আছো।ʼʼ

ফারজাদ অবাক হয় একটু। তার ইগোতে লাগল যেন কথাটা, সাথে বুকেও। মেয়েটা অতিরিক্ত ভয় পাচ্ছে, এজন্যই ফারজাদ ওর সঙ্গে যাচ্ছে, যাতে খারাপ কোনো পরিস্থিতি তৈরী হলে সামলে নেয়া যায়। ফারজাদ কিছু বলল না। মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে গম্ভীর মুখে হাঁটছে। হঠাৎ-ই সামনে দেখা গেল ইভাকে নিতে আসা পুলিশ অফিসারটা মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফোন কানে নিয়ে কথা বলছে। পাশেই আরও দু-তিনজন দাঁড়ানো। ইভা থমকে দাঁড়ায় মাঠের মাঝখানে। ফারজাদ আস্তে করে বলল, “রিল্যাক্স, ইভা! এগিয়ে যাও, কিছু হবে না।ʼʼ

ততক্ষণে ইভার বাবা ওবায়দুল হককে কলেজের বিল্ডিং ছেড়ে নিচে নেমে আসতে দেখা গেল, সঙ্গে আসছেন অধ্যক্ষ মহাশয় এবং আরও কয়েকজন শিক্ষকেরা। ইভা তড়িঘড়ি হাতে থাকা ছোট্ট ব্যাগটা পেছনে সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওবায়দুল হক দাপুটে পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন ইভার সামনে। ফারজাদ পাশেই একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ফারজাদ প্রথমবার দেখল ইভার বাবাকে। স্বাস্থবান, অভিজাত লোকটা। পরনে পুলিশের পোশাক, চোখে চশমা, চলনভঙ্গি ভারী। মুখটা অসামান্য রাগে লাল হয়ে আছে। চোখে তার আগুনের হলকা ছুটছে যেন। তিনি এসেই রোষাগ্নি দৃষ্টিতে ইভাকে পরখ করে দেখলেন। হাত অবধি উনার অগ্নিদগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হতেই ইভা চট করে হাতের জিনিসগুলো সহ ব্যাগটা পরিত্যক্ত হালে ফেলে দেয় মাঠের মাঝখানে, যেন বড়ো অপ্রয়োজনীয়, মূল্যহীন নিতান্তই ইচ্ছের বিরুদ্ধে সে হাতে ধরে ছিল ব্যাগটা।

ফারজাদের বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠল এবার। সে অপ্রতিভ চোখে তাকিয়ে রইল পড়ে থাকা ব্যাগটার দিকে। ওই ব্যাগের ভেতরে থাকা ছোটো ছোটো উপহারে জড়িয়ে আছে তার বছরখানেকে জমানো এক বুক আবেগ, কেবলইমাত্র নষ্টা আবেগ! এই উপহারগুলোতে সে বলি দিয়েছে নিজের আত্মমর্যাদাবোধ, নিজের সভ্যতা, নিজের শিক্ষাজ্ঞানটুকু। সেটা ইভা বাবার এক নজর দৃষ্টি মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। কই ফারজাদ তো এসেছিল না মেয়েটার কাছে? সে কখনোই আগ্রহী ছিল না নিজের এই অধঃপতনকে কাছে ডাকতে। মেয়েটা কী ওকে নিজে কাছে টেনে ফের ঝেরে ফেলল?

ওবায়দুল হক হুংকার দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় গিয়েছিলে? কোথায় গিয়েছিলে, বলো?ʼʼ

ইভার গা শিউরে উঠল। সে মাথা নিঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত-পা বোধহয় রীতিমত কাঁপছে। তিনি ঝুঁকে পড়ে ব্যাগটা তুললেন, ভ্রুযুগল কুঁচকে উল্টেপাল্টে দেখলেন ব্যাগটা। এরপর তা উপুড় করে ধরলেন, তাতে ব্যাগের সবকিছু ঝরঝর করে পড়ে যায় মাটিতে। ফারজাদ কেবল চেয়ে দেখছে। কারও অবহেলিত হাতে উপুঢ় করে ধরা ব্যাগ থেকে ঝরে পড়া জিনিসগুলো তার প্রাইভেটের মেরে দেওয়া টাকা নাকি তার আবেগ? কোনটা আজ এমন বিদ্রুপের সামগ্রী হিসেবে উপহাসের ছলে মূল্যহীন হয়ে ঝরে পড়ছে? ইভা মাথা নিঁচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ওগুলোকে উদ্দেশ্য করে ওবায়দুল সাহেব বললেন, “কোথায় পেলে এগুলো? জবাব দাও, নয়ত …

ইভা তুতলিয়ে ওঠে। সে কী বলল বোঝা গেল না। ততক্ষণে পুরো কলেজ এসে মাঠের চারপাশ দিয়ে বিল্ডিংয়ে বিল্ডিংয়ে জড়ো হয়েছে। অধ্যক্ষ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন পাশেই। যেখানে মামলা স্বয়ং পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের, সেখানে তারা কেবল দর্শক-ই বটে!

জরুরী ভিত্তিতে আজ ইভার মা কোনো কারণে গ্রামের বাড়িতে যাবেন। যে কারণে ইভাকে আজ দুই পিরিয়ড পরেই ছুটি করিয়ে নিতে এসেছিল ড্রাইভার। এসে তাকে পুরো কলেজে যখন পাওয়া যায় নি, তখন কল করা হয়েছে এসপি সাহেবের কাছে। তিনি এসে পৌঁছেছেন মিনিট পাঁচেকের মতো। পুরো কলেজ আবার তল্লাশি করা হয়েছে, পুলিশের মেয়ে, খারাপ কিছু হতেই পারে! অথচ এখন ইভা একটা ছেলেকে সঙ্গে করে কলেজে ঢুকছে। সম্মানের আর কিছুই বাকি নেই বলে ধারণা এসপি সাহেবের। তার মেয়ের এমন কড়া নিরাপত্তার পরেও এরকম কিছু ঘটে গেছে! তিনি এবার ফারজাদের দিকে ফিরলেন। গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি, তার চোখে-মুখে উদ্বেগ নেই, চোখের ভাষা দুর্বোধ্য! ফারজাদের দিকে তাকিয়ে ইভাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, “ছেলেটা কে?ʼʼ

ইভা জবাব দিলো না। তিনি এবার গর্জন করে উঠলেন, “ছেলেটা কে, ইভা?ʼʼ

পরিবেশ গরম হয়ে ওঠে। সকলে নিশ্চুপ। ইভা ভাঙা ভাঙা স্বরে মাথা ঝাঁকাল, “চিনি না, বাবা।ʼʼ

ফারজাদের বুকে সূঁচাল এক বিষবাণ এসে বিঁধে যায় বোধহয়, একটা তিক্ত ধাক্কা অনুভব হলো, তবুও সে অটল, অবিচল দাঁড়িয়ে। চোখজোড়া লাল হয়ে উঠেছে তার, চোখের শিরা-উপশিরার মাঝে র ক্ত জমে গেছে, হয়ত ভেতরে এসে সদ্য ভিড় করা ভাঙনের তীব্র হাহাকার, আর আক্রোশগুলো র ক্ত দানার মতো চোখে ফুটে উঠেছে। এসপি সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন, “তাহলে এগুলো কোথায় পেলে?ʼʼ

ইভা এবার তাকায় বাবার দিকে। তার রুহু ছলকে ওঠে, আর কোনোদিকে গ্রাহ্য করবার সাহসটুকু সঞ্চয় হলো না তার ভেতরে। বাবার চোখে দৃষ্টি রাখতে তার সব গুলিয়ে যায়, শুধু মস্তিষ্ক তাকে একটা সংকেত দিলো বোধহয়—নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে হবে। নিজের সম্মান, বাবার সম্মান বাঁচিয়ে নিতে হবে, আর সব কিছু জাহান্নামে যাক, তার নিজেকে সামলে নিতে হবে যে কোনো মূল্যে!

“কিছু জিজ্ঞেস করেছি, উত্তর দাও!ʼʼ দাঁত চেপে বললেন এসপি ওবায়দুল হক।

“আমাকে গেইটের বাইরে ডেকে নিয়ে গেছিল ছেলেটা, তারপর এগুলো হাতে ধরিয়ে দিলো।ʼʼ

ফারজাদ যেন কারও বিদঘুটে নৃশংস ক্ষত দেখেছে, ওভাবে ব্যথিতর ভঙ্গিতে সমবেদনা জানানোর মতো করে ঠোঁট গোল করে শ্বাস নেয়। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে তাকায় এদিক-ওদিক। পাগলের মতো করে মৃদু মাথা নাড়তে নাড়তে চট করে খানিক হেসে ফেলল নিঃশব্দে। আবার আবার ইভার দিকে, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অদ্ভুত নজরে ইভার দিকে। দুর্বোধ্য, ধারাল সেই দৃষ্টি ছেলেটার ইভাকে যেন দূর থেকেই চিড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে। ফারজাদের ভেতরে কী হচ্ছে তা আন্দাজ করার উপায় নেই মুখ দেখে। অধ্যক্ষ সাহেব এগিয়ে এলেন এবার। নরম কণ্ঠে শুধালেন, “তুমি ওগুলো নিলে কেন, ইভা মা?ʼʼ

ইভার বাবা রুষ্ট নজরে তাকিয়ে আছে ইভার চোখ বরাবর। ইভা বাবার চোখে একবার তাকিয়ে হরবর করে বলে ওঠে, “জোর করে দিয়েছে।ʼʼ

ফারজাদ চোখজোড়া সন্তর্পণে বুজে নিয়ে হতাশ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যেন কিছুই হয়নি, কেবল হালকা একটু চোট পেয়েছে কোথাও ছেলেটা, তবে ব্যাপার না, চলবে এটুকু জ্বালা। ইভার কথা ফুরাতেই আচমকা অধ্যক্ষ সাহেব ঝড়ের বেগে সশব্দে খোলা মাঠের প্রান্তরে একট ভারী থাপ্পড় লাগালেন ফারজাদের গালে। ফারজাদ তখনও অবিচল দাঁড়িয়ে। নাহিদ আর মাহদি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে ফারজাদের পেছনে। এবারে বোধহয় তারা কিছু বলতে যায়, ফারজাদ অতি সন্তর্পণে হাতটা চেপে ধরল। যেখানে যার সত্য স্বীকার করার, সে-ই তো নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়েছে, ফারজাদের কোনো অনুভূতিই এত জাহেরী নয়, যে তা তৎক্ষণাৎ সাধারণ রূপে লোক সম্মুখে এসে পড়বে। তীব্র গোমরা ছেলেটার সবকিছুই কেমন জমে থাকা অগ্নিলাভার ন্যায় শীতলতম উষ্ণ! ইভা কাঁদছে এবার, ফারজাদ নিজের আত্মমর্যাদাবোধ, আত্মসম্মান, নিজের অহংকার, স্বভাবসুলভ বেপরোয়া ভাবকে দাফন করে সবাইকে অগ্রাহ্য করে, অপার্থিব স্বরে স্বীকার করে নিলো, “জি স্যার, আমি নিয়ে গিয়েছিলাম ইভাকে।ʼʼ

এবার বোধহয় এসপি সাহেব, সত্যকে ঢেকে ফেললেন মিথ্যার কুলষিত চাদরে, নিজের তথাকথিত সম্মানটুকু বাঁচাতে তিনিও হাত চালালেন ফারজাদের শক্ত গালে। মেয়ের কৃতকর্মকে ফারজাদের গায়ে লাগানো দোষের ধামার নিচে চাপা দিয়ে, মেয়ে ও নিজের সম্মানটা বাঁচিয়ে নিলেন সন্তর্পণে। ফারজাদ পর্বতের ন্যায় অনড় দাঁড়িয়ে কেবল, শিলাখণ্ডে তৈরী ছেলেটার আগামী বড়ো অদ্ভুতই হবার কথা!


ফারজাদ বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল। উজ্জ্বল পথচলাকে অন্ধকারে ছেঁকে সে-বছর পরীক্ষায় সে উচ্চতর গণিত পরীক্ষায় ফেইল করার মাধ্যমে পরীক্ষায় ফেইল করল। এরপর বাড়িতে তার মূল্য উঠে এলো বাড়ির গোয়ালা ফরিদের জায়গায়। ফারজাদ বাড়ির লোকেদের কাছে লাঞ্ছিত হয়েছে, কটূ কথা শুনেছে, অপমানিত হয়েছে, অথচ কোনোদিন কোনো জবাব দেয়নি। বন্ধুমহলে, পুরো কলেজে বদনাম হয়ে গেল সে। এসব অবশ্য গ্রামের লোক জানে না।

ইভাকে ফারজাদ ঘৃণা করে না, ফারজাদের মতে ইভার প্রতি ফারজাদের যে অনুভূতি, সেটাকে ঘৃণা বললে, শব্দটা বেশ সহজ আর ছোটো হয়ে যায়। ঘৃণা তো তাকে করা যায়, যাকে একসময় ভালোবাসা হয়েছিল। ফারজাদ জঘন্যতম খারাপ মানসিকতার ছেলে, তার মতে– তার মনে এত মানবিকতা বোধ নেই, যে সে সেই মেয়েকে ভালোবাসার দাবী করবে, যার কাছে ভালোবাসার মূল্য বাপের চোখের দৃষ্টির কাছে মাটি হয়ে যায়। আবেগকে ঘৃণা করে ফারজাদ। সেই আবেগকে—যা তার কাছ থেকে তার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে, ফারজাদ সেই বেড়ে ওঠার বয়সটাকে ঘৃণা করে যে বয়সে মানুষ এত হীন, নিচু কাজ কাজগুলো করে বসে আবেগের তাড়নায়। ফারজাদের সবচেয়ে বড়ো ঘৃণা মেয়ে মানুষে, যারা পরিবারের কাছে মুখোশধারী, নিষ্পাপ। ফারজাদের ঘৃণা নারী জাতির কোমলতায়, যা একসময় পরিবারের চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যার কলুষিত চরম অবাস্তবতায় পরিণত হয় মুহুর্তের মধ্যেই।

ফারজাদের কাছে ওই ঘটনার মাসখানেক পর পরীক্ষার কিছুদিন আগে ইভা এসেছিল। মেয়েটা কেঁদে পড়ল, সেদিন সে বাবার সামনে ভয় পেয়েছিল প্রচুর–অথচ সে আজকাল ফারজাদকে ছাড়া থাকতে পারছে না।

ফারজাদ মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল সবটা। আলতো হেসে বলেছিল তাকে, “চলে যাও। খুব বেশিক্ষণ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো সংযম নেই আমার মাঝে। সেদিনের হারানো সম্মান, আর জীবন থেকে হারিয়ে ফেলা আমার উজ্জ্বলতা টুকু আমার ভেতরে নাড়া দিয়ে উঠলে, তোমায় এই মুহুর্তে খু ন করতে আমার কোনো পূর্ব-প্রস্তুতির প্রয়োজন হবে না, ইভা। আমি জানি আমার ভবিষ্যত শেষ, আমি জানি আমি আমার মানসিকতা বোধটুকু হারিয়ে ফেলেছি খুব খারাপভাবে। তাই তোমার সঙ্গে আজ খারাপ কিছু করতে না আইনের ভয় আছে, আর না বিবেকের।ʼʼ

নিজের ওপর ফারজাদের ঘৃণা আসমান ছুঁয়ে যায় এটা ভেবে—সে নাকি সেই মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়ে নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করে ফেলেছে যে মেয়েটা বাপের সামনে তাকে পরিচয় দিতে পর্যন্ত অস্বীকার করেছে। হায়রে! পরিচয় পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না–ফারজাদ ইভার বাবার সামনে! ফারজাদ শুনেছিল— সময়, স্রোত ও প্রেমের নাকি প্রতিবন্ধকতা নেই? আচ্ছা! যে প্রেমকে স্রোতের সাথে তুলনা করা হয়েছে, সেই প্রেম ঠেকে গেল বাপের নজরের সামনে? ফারজাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, ইভার বাপের নজরের কী তাহলে অসীম জোড়? নদীর জোয়ার আটকাতে দেওয়া বাধের চেয়েও শক্তিশালি সেই নজর, যে শক্তির কাছে এক মুহুর্তে পরিচয়টা অবধি মুছে যায়? কথাটা কতটুকু সত্য, তা জানে না ফারজাদ। তবে প্রেম বলতে যা বোঝায়, মায়ার টান যা হয়, তাতে যে অদম্য শক্তি থাকে, তা মানে ফারজাদ।

যে মেয়েটা তার উপহারকে এক মুহুর্তে মাটিতে পতিত করেছে, পুরো কলেজের সামনে হীন, লাঞ্ছিত, তিরস্কৃত, তাচ্ছিল্যের পাত্র বানিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে ফারজাদ আর চেয়েও পড়ালেখায় মনোযোগী হতে পারেনি। দুই বছরের পড়া দুই মাসে সম্পন্ন করা অসম্ভব ছিল, তার ওপর মানসিক অবস্থার বিপর্যস্ততা!

ফারজাদ ফেইল করেছে, পরের বছর আবার পরীক্ষা দিয়েছে। প্রতিটা পরীক্ষায দিন এক্সাম-হলে তার মুখ লুকানোর জায়গা ছিল না। সে কলেজের পরিচিত মেধাবী এক মুখ, সেই ছেলেটা জুনিয়রদের সাথে মান উন্নয়ন পরীক্ষা দিয়েছে অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে। এরপরেও তার রেজাল্ট আহামরি কিছু হয়েছিল না। কোনোরকম চলাচল এক রেজাল্ট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখা ছেলেটা ভর্তি হয়ে গেল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবিতে অনার্সে। এ খবর বাড়ির লোক জানে কেবল।

পরীক্ষার সেই অনাকাঙ্খিত ফলাফলের পর থেকে ফারজাদের মনে হয় সে মৃত। তার শ্বাস চলে কেবল জিদে, অথচ সে দাফন হয়ে গেছে সেই কবে তার ক্যারিয়ারের সাথে। স্বপ্নভাঙা মানুষ তো মৃত-ই। মানুষ জীবিত রয় কোনো এক প্রত্যাশাকে কেন্দ্র করে। একটা দুর্দমনীয় চাহিদার শক্ত কাঠামোতে চেপে মানুষ জীবন অতিবাহিত করে। যার কিছুই আর ফারজাদের মাঝে অবশিষ্ট নেই। সে কবে জলন্ত অগ্নিশিখায় পরিণত হয়েছে। যা জ্বলছে,ছাই হচ্ছে, তার তপ্ততা বিকিরিত হচ্ছে প্রতিক্ষণে। ফারজাদ অনুভূতিহীন যন্ত্রের ন্যায় এক মেশিন আজ। যা থেকে কেবল ক্ষতিকর উত্তপ্ত ক্ষতিকর বিষাক্ত ধোঁয়ার নির্গমন হয়, যে নির্দয় অসীম ক্ষমতার অধিকারী– স্বপ্ন পুড়ে ছাইয়ের স্তুপে রূপ নেওয়া ধ্বংসাবশেষ মাত্র!

চলবে..

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৪.

মাসখানেক কেটে গেছে। দ্বিজার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষের দিকে। ব্যবহারিক বাকি আছে। পরীক্ষার আগে ব্যবহারিক খাতাগুলো লেখা সম্পূর্ণ হয়নি। মনের অবস্থা ভালো ছিল না, এখন করতে হচ্ছে রাত-দিন জেগে। মাঝরাতের দিকে একদমই মনোযোগ হারিয়ে ফেলল মেয়েটা আঁকাআঁকি থেকে। ফোনটা বের করে গ্যালারিতে ঢুকে ফারজাদের একটা ছবির দিকে তাকিয়ে রইল ক্ষণকাল। এই মাসখানেকের মাঝে আর কথা হয়নি লোকটার সাথে। তাদের এক আজব সম্পর্ক, দুই পক্ষের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম আর অদ্ভুত মনোভাবের মাঝ দিয়ে রহস্যজনক ভাবে নকেটে যাচ্ছে মাঝের দিনগুলো। মনের জড়তাকে পাশ কাটিয়ে একবার কল করেই বসল দ্বিজা ফারজাদের নম্বরে। লোকটা কেমন আছে, নিশ্চয়ই খুব পরিশ্রম করছে ট্রেনিংয়ে। ট্রেনিং শেষ হয়েছে কিনা, তাও তো জানা হয়নি। কল রিসিভ হলো না। দ্বিজা একটা লম্বা শ্বাস ফেলে ফোনটা ছুঁড়ে মারল বিছানার ওপর। কিছুই ভালো লাগছে না আর।

রাত একটার মতো বাজে। শান্তিনগর মেইন রোডের একপাশ দিয়ে হাঁটছে ফারজাদ। পরনের ছাইরঙা ডেনিম জ্যাকেটের পকেটে হাত গোঁজা। মাঘের শেষের দিকটা, আজ দু’দিন ঢাকাতে ঠাণ্ডার প্রকোপ খানিক কম, অবশ্য যে-কোনো সময় বেড়ে যেতে পারে। ফোন বেজে শেষ হবার মুহুর্তে বিরক্ত হাতে একবার ফোনটা বের করে দেখল দ্বিজার কল। ততক্ষণে কল কেটে যায়, ফারজাদ ফোনটা আবার রেখে দিল পকেটে।

হাঁটতে হাঁটতে বেঙ্গল টাওয়ার পেরিয়ে স্কয়ার পার্কের সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রায় ফাঁকা শহর, অন্য শহর হলে এতক্ষণে জনশূন্য হয়ে যেত, ঢাকা বলে এখনও জাগ্রত লাগছে শহরটাকে। ফারজাদ আরও খানিক এগিয়ে যায়, হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট ধরায় একটা। আর একটু এগিয়ে গেলেই বড়ো ভিআইপি রোড সামনে। সামনে রাস্তার পাশে একটা লোক বসে আছে। ফারজাদ এগিয়ে গিয়ে বসে লোকটার পাশে। লোকটা হাতের ব্যাগটা কাধে তুলে নিয়ে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফারজাদ আরাম করে ফুটপাথের ওপর বসে শান্ত চোখে তাকায় লোকটার দিকে। ঠিক লোক নয়, ছেলে। চোখ দ্বারা ইশারা করল, পাশে বসতে। ছেলেটা বসতে চায় না, ফারজাদ হাত ধরে টেনে বসায়। ছেলেটার চোখে-মুখে ভয় নেই, তবে বিরক্ত হচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। ফারজাদ জিজ্ঞেস করল,

“ঝোলাতে কী? দামী সম্পদ মনে হচ্ছে!ʼʼ

“তুমার জানার কী কাম?ʼʼ

ফারজাদ বলল, “কাম থাকলে এভাবে এসে তোমার পাশে বসে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করতাম না, কাম নেই কোনো। নাম কী তোমার?ʼʼ

ছেলেটা এবার আড়চোখে তাকায় ফারজাদের দিকে, “আলামিন।ʼʼ

ফারজাদ বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে ছেলেটার কাধে হাত রাখে। এতে ভরকাল আলামিন, তার গায়ে জীর্ণ ময়লা পোশাক, তাতেও ফারজাদ একদম জড়িয়ে বসেছে ওকে। কাঁধে হাত রেখে বেশ ফুরফুরে কণ্ঠে বলল, “আল-আমিন শব্দের অর্থ জানো?ʼʼ

ছেলেটা বোকার মতো তাকিয়ে আছে। যেন সে বোঝার চেষ্টা করছে ফারজাদের গতিবিধি। ফারজাদ বলল, “ অর্থ হলো, সত্যবাদী, বিশ্বাসী। এবার নাম অনুযায়ী কাম করো। ঝোলাতে কী?ʼʼ

“যাও তো মিয়া, আর নয়ত আমারে যাইতে দেও।ʼʼ

আলামিনকে একটু ভড়কে দিয়ে চট করে ফারজাদ হেসে ফেলল,“তুমি মেয়ে হলে না-হয় ধরে রাখার চান্স নিতাম, আফটার অল ব্যাচেলর মানুষ। তবে তোমার কাজের ঠিকানা তো এখানেই। সারারাত তুমিও বসে থাকবেনা, আর আমিও না। প্রশ্নের উত্তর দাও।ʼʼ

“কিডা তুমি? তুমারে ক্যান জবাব দিতাম?ʼʼ

ফারজাদ কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ-ই বলল, “খরিদ্দারের অপেক্ষা করছ, নাকি মালিকের?ʼʼ

ছেলেটা চমকিত চোখে তাকায়, এক পলকে তার অভিব্যক্তি বদলে চোখেমুখে ভয় জড়ো হয়েছে। ওর আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চোখ রেখে দুর্বোধ্য হাসে ফাদজাদ। ছেলেটা এবার ছটফট করছে, ফারজাদের হাত কোনোমতো কাঁধ থেকে সরিয়ে কখন জানি দৌঁড় লাগায়। ফারজাদ বলল, “কেমন মাল দেখি? কোকেইন?ʼʼ

ছেলেটা চরম ঘাবরেছে এবার। একটু এলোমেলো স্বরে বলল, “আমার কাপুড়-চুপুড় আনছি এই ঝুলায়। আর কিস্সু নাই। ছাড়ো তো আমারে!ʼʼ

“হু, তার তো অবশ্যই। তবে তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি পুলিশ-টুলিশ না। সবে ট্রেনিং চলছে, শেষের দিকে অবশ্য। দেখি বের করো, একটু টেস্ট করি।ʼʼ

ছেলেটা শুকনো এক ঢোক গিলল। পুলিশের লোক ফারজাদ, ট্রেনিং শেষের দিকে, অথচ বলছে পুলিশ না! কাঁপা হাতে বের করে ধরল খাতার পৃষ্ঠায় মুড়ানো সাদা আটার মতো পাউডার। ফারজাদ বলল, “এমনভাবে ভয় পাচ্ছ কেন? খুব বেশি ক্ষতিকারক না মালটা, এতটুকুতে বড়োজোর টুকটাক জরিমানা করবে। আমার যখন নিজের এই নষ্ট জীবনের প্রতি বেশি ক্ষোভ জমে, আমিও তৎক্ষণাৎ সুখের জন্য মাঝেমধ্যেই দু-এক চালান শুঁকে নিই। এখন খুব দরকার, তোমার উপকারের প্রতিদান পাওনা রইল।ʼʼ

উল্টোপাল্টা কথাবার্তা ফারজাদের–বলেই মনে হলো আলামিনের। ফারজাদ মুড়ানো কাগজটা খুলে দু আঙুলের চিমটির মাঝে সামান্য পাউডার তুলে হাতের তালুতে রেখে তা নাক দিয়ে কয়েকবার নিঃশ্বাসের সঙ্গে তুলে নেয়। আঙুলের অগ্রভাগ জিহ্বায় চেটে বলল, “খাঁটি মাল, কোথা থেকে আমদানী হচ্ছে রে?ʼʼ

আলামিন এবার ফারজাদের কাণ্ডে বোধহয় আশ্বস্ত হলো। বলল, “বসের থেইকা শুনছি, যদ্দূর সম্ভব আমেরিকা থেইকা।ʼʼ

ফারজাদের হাতের সিগারেট পুড়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। সেটায় টোকা দিয়ে ছাই জমে থাকা ছাই ফেলল, এরপর পুরো সিগারেটটাই কী মনে যেন ফেলে দিলো। ঘাঁড় নাড়ল, “হুউউউউ! এখানে বসে আছ কেন?ʼʼ

“একজন নিতে আইব এইডা। তুমি তো একটু নিলা, দাম জানো মিয়া?ʼʼ

ছেলেটার কথার ভাব বদলেছে, তাহলে সে বিশ্বাস করেছে ফারজাদ যাই হোক, ওদেরই দলের এক মাতাল। ফারজাদ পকেট থেকে চট করে একটা পাঁচশো নোট বের করে দিয়ে বলল, “অল্প একটুই নিয়েছি, চলবে?ʼʼ

আলামিন পাঁচশো টাকা দেখে খুব একটা সন্তষ্ট হয়নি, তা মুখ দেখে বোঝা গেল। না হওয়ারই কথা, কেজি প্রতি কোটি টাকার মাল বলে কথা। ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, “কোথায় থাকো?ʼʼ

“মোহাম্মদপুর বস্তিত।ʼʼ

“কে কে আছে পরিবারে?ʼʼ

ছেলেটা বিরক্ত হয়ে তাকাল, বখাটেদের মতো ভাব নিয়ে বলল, “আবার জিগায়! মা আছে, তিনডা ছোডো বোইন আছে।ʼʼ

“বাপ নেই?ʼʼ

“হ আছে। এহন মনেহয় কুনো মা*গী*র কাছে যাইয়া পইড়া আছে।ʼʼ

ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, “তোমার আম্মা অসুস্থ নাকি?সংসার কী তোমার উপার্জনেই চলে?ʼʼ

“হ, মার কী জানি হইছে, সারা গা’য় ঘাও হইছে, মাং স পঁইচে গেছে।ʼʼ

“একটা ডিল করি চলো।ʼʼ

“কী করতাম?ʼʼ

“চুক্তি।ʼʼ

“চুক্তি?ʼʼ

“হুম, চুক্তি। আমি তোমার একটা উপকার করব, তার বদলে তুমি আমার একটা কাজ করবে।ʼʼ

“কী কাম?ʼʼ

“তোমার বস কে? তার খোঁজ দেবে আমায়, এর বদলে তোমায় আমি ভালো একটা কাজ পাইয়ে দেব, ভালো বেতন পাবে। রাত ধরে মশার সাথে বসে গান গাইতে হবে না।ʼʼ

ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল ফারজাদের দিকে, হুট করে পেছন থেকে অপর হাতটা বের করল। হাতে তার পকেট ছুরি, তা দিয়ে আঘাত করল ফারজাদের হাতে, ফারজাদের বামহাত ছুটে যায় আলামিনের কাঁধ থেকে। আলামিন উঠে ঝড়ের গতিতে দৌঁড়াবে, তার উঠে দাঁড়ানোর গতি তা-ই বলে। ফারজাদ খপ করে হাতটা ধরে বসিয়ে দেয় জোর করে, অপর হাতে বন্দুকের নল ঠেকায় আলামিনের কোমড়ের একটু ওপরে। রাস্তা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ-ই সাঁ করে গাড়ি চলে যাচ্ছে ওদের পেরিয়ে। ফারজাদের বাম হাত থেকে র ক্ত ঝরছে। ওই হাত দিয়েই আলামিনের কলার চেপে, বন্দুকের নলটা আরেকটু চেপে ধরে বলল,

“অবশ্য আমাকে অফিশিয়ালি এখনও ওয়েপন দেয়া হয়নি, এটা চোরাই বন্দুক। তবে ম্যাগাজিনে লোড হওয়া বুলেট কিন্তু একদম পিওর বারুদের। অফারটা ভালো দিয়েছি তোমায়, অভাবীদের প্রতি আমি সর্বদা সদয়, তবে সেই অভাবকে পুঁজি করে ক্রাইম করা.. চ্যাহ! ইটস ভেরী ব্যাড।ʼʼ

আলামিন বলল, “তুমি কীসের কাম দিবা? আমি এই কামেই ভালো আছি। আমার দরকার নাই অন্য কামের, ভালো কথা কইতাছি আমারে ছাড়ো, তুমি জানো না আমার বসের হাত কত বড়ো।ʼʼ

ফারজাদ হতাশ শ্বাস ফেলল, “আইনের চেয়ে বড়ো না। শোনো নি— আইনের হাত বহুত লম্বা হয়? আর আমিই বা কোথায় সারাজীবন এমন ইমানদারীর সাথে কাজ করব? এই ধরো ঠিকঠাক কয়েকটা পদে প্রমোশন হয়ে গেলে এরপর শুরু করব পকেট গরম করা। আজ তোমায় ধরতাম না, ওই যে ওই মালটুকুর লোভ, আর চাকরির আগেই যদি একটা স্মাগলার ধরে দেই, একলাফে কোন উচু পদে পড়ে মাজা ভাঙবে, বলা তো যায় না। বলতে পারো স্বার্থের জন্যেই আজ তোমার ওপর এই দয়াটুকু করছি?ʼʼ

এটা দয়া? আলামিন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে, চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক সাথে কৌতূহল। এখন অবধি ফারজাদের আচরণে কিছুই স্বাভাবিক লাগেনি তার ফারজাদের মাঝে, এখন আরও গোলমেলে লাগছে কথাবার্তা। এখন পর্যন্ত ওর সাথে কোথা থেকে কী ঘটে গেল, পুরোটা মিলছে না যেন। ফারজাদ শান্ত স্বরে বলল, “আমি যেখানে নিয়ে যাব, চুপচাপ যাবে। তুমি কোনোরকম তামাশা বা চালাকি করার পরিকল্পনা করবে, আমি বিনা পরিকল্পনায় তোমার মাথার করোটিটা উড়িয়ে দেব। জোয়ান এসবি অফিসার তো, মাথার টেমপার হাই।ʼʼ


পরদিন সন্ধ্যায় দ্বিজার ডাক পড়ল আব্বুর ঘরে। দ্বিজার খুব একটা ভালো ঠেকছে না ব্যাপারটা। গিয়ে বসল আস্তে করে একটা চেয়ারে। হাবিব সাহেব আধশোয়া হয়ে বসে আছেন বিছানায় হেলান দিয়ে। ছোটোবেলা থেকে আব্বুকে কাছে না পাওয়ায় দ্বিজার খুব একটা আন্তরিক সম্পর্ক নয় আব্বুর সঙ্গে, সেই সাথে হাবিব সাহেব খুব মেজাজি মানুষ। দ্বিজা আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবেন, আব্বু?ʼʼ

হাবিব সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “নিয়মিত ছাদে যাও নাকি?ʼʼ

দ্বিজার মুখটা শুকিয়ে যায় এবার। সে জানে কোন প্রসঙ্গের শিরোনাম দিচ্ছে হাবিব সাহেব। আজও শুকনো কাপড় ওঠাতে গিয়ে দেখেছ ওয়াহিদ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার একপাশে বাইক নিয়ে। দেখতে আসলেই খুব দৃষ্টিকটু লাগে ব্যাপারটা, গ্রামের লোকের মুখে না জানি কবে এমন বাজে কথা শুনতে হয়। দ্বিজা জবাব দিলো না। এবার আরও খানিক কড়া শুনতে লাগল হাবিব সাহেবের গলাটা, “ছেলেটা কে? কতদিন ধরে দাড়ায়ে থাকে এসে এরকম?ʼʼ

দিলরুবা বেগম নিরস মুখে ঘরে ঢুকলেন। দ্বিজার বুক কাঁপছে। একটা আতঙ্কিত ঢোক গিলে বলল, “আব্বু! আমি এসবের কিছুই জানি না।ʼʼ

কথা কেড়ে নিলেন হাবিব সাহেব, “ও তাই নাকি?ʼʼ

দ্বিজার অসস্তি লাগছে এবার। সে দ্রুত বলে উঠল, “লাবন্য আপুর চাচাতো দেবর।ʼʼ

“দুই বোন এক বাড়িতে যাবার পরিকল্পনা করছো নাকি? ভালোই মানুষ করছে তোমার মা তোমারে। তা নানির বাড়ি যাবা নাকি, পরীক্ষা তো শেষের দিক, চলো রেখে আসি।ʼʼ

স্পষ্ট ভৎসনা হাবিব সাহেবের কণ্ঠে। অবশ্য এ আজ নতুন নয়—সে কোনদিনই দিলরুবার মায়ের বাড়ির সঙ্গে এত খাতির পছন্দ করেন না। তার ধারণা–এতে ছেলে মেয়ের জীবন নষ্ট হয়েছে, খুব ছাড় পেয়ে অসভ্য আর বাউন্ডুলে হয়ে গিয়েছে দ্বিজা ও দিহান। দিলরুবা বেগম চুপচাপ কাপড় ভাজ করছেন। এ সময় কিছু বলা মানে, খিস্তি শোনা। দ্বিজা আর বলার মতো কথা পেল না এ মুহুর্তে। সত্যিটা না শুনেই যখন মন্তব্য করে বসে সামনের মানুষটা, সাফাই গাওয়ার পরিস্থিতি থাকে না তখন আর। আর আব্বুর সামনে তো মোটেই নেই তার। হাবিব সাহেব আবার বললেন,

“পড়ালেখায় নাকি খুব মনোযোগী শুনছি, তোমার মা বলছে। আসার পর থেকে তেমন কিছুই পাই নাই, সবসময় আনমনাই দেখছি তোমারে। এই যে দেড়মাস হইলো আসছি, একবার আসছো আমার কাছে দুই দণ্ড কথা বলার জন্য? ঘর থেকেই বার হওনা। কথাও বলো না ঠিকমতো, বয়স খারাপ যাইতেছে তোমার, মেয়ে! এ জন্যই বাপের শাসন ছাড়া সন্তান ভালোভাবে গড়ে ওঠে না। কিন্তু আমি কয়দিক যাব? কামাই রোজগার করে খাওয়ানোর দায়িত্ব তো আছে বাপ হিসেবে নাকি? শোনো মেয়ে, সব সইতে পারি, খালি সম্মানের হানি সওয়ার জায়গা নাই আমার ভিতরে, মনে রাইখো।ʼʼ

দ্বিজার চোখটা ভিজে উঠতে চাইছে, মেয়েটা খুব কষ্টে সামলে নিলো তা। সে অনেক চেষ্টা করেছে আব্বুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে, অথচ সংকোচ কাটে না। ছোটোবেলা থেকে টুকটাক ফোনেই যা কথা, তাই চাইলেও আর পাঁচটা বাপ-মেয়ের মতো মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। তবে সে যে আব্বুকে ভালোবাসে না, তা মোটেই নয়। আজ আব্বুর আক্ষেপ শুনে খারাপ লাগছে। তবে আজ তো আব্বু ওর কোনো কথাই শুনল না, শুধু চোখের দেখার ওপর ভিত্তি করে কত কথা শুনিয়ে দিলো। অবশ্য তার সব কথা মিথ্যে নয় মোটেই। দ্বিজা আনমনা থাকে, পড়ালেখার মনোযোগ হারিয়েছে, তবে ওয়াহিদের ব্যাপারটা শুধুই ভুল বোঝাবুঝি। সঙ্গে তার আজ অবধি কথাই হয়নি। রাগ হলো খুব। নিজের ওপর রাগ হলো–এতদিনে ব্যাপারটাকে এত সহজ ভাবে না নিয়ে কিছু পদক্ষেপ নেয়ার ছিল আসলেই। তবে এবার আর সে চুপ থাকবে না। এবার সীমা ছাড়িয়ে গেছে ছেলেটা। যদি ব্যাপারটা আব্বুর চোখে পড়ে যায় এভাবে, তাহলে পাড়ায় কথা রটে নি?

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে