#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা
১০.
কাঁচাফুলে সাজানো বাসরে বসে আছে লাবন্য। রাত বারোটার মতো বাজে। এখন ঘর ফাঁকা। তবে কিছুক্ষণ আগেও গিজগিজ করছিল লোকে ঘরটা। সকলে বউ দেখা পর্ব শেষ করে চলে গেছে। লাবন্যর খুব হাঁসফাঁস লাগছে।কিছুক্ষণ পর ইরফান এলো ঘরে। লাবন্য নিজের নখ খুঁটছে, মাথাটা ঝুঁকিয়ে রেখেছে নিচের দিকে। ইরফান দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, “লজ্জা পাচ্ছ নাকি? চ্যাহ! এজন্যই চেয়েছিলাম বিয়েটা প্রেম করে করতে। যাতে বউ বাসর রাতে লজ্জা না পায়, বরং নিজেই ঝাপিয়ে পড়ে আমার ওপর।ʼʼ
লাবন্য চোখ তুলে তাকাল। লোকটার মুখে কি কিছুই বাঁধে না? ইরফান হাসতে হাসতে এসে বসল বিছানার ওপর। কী আশ্চর্য! লাবন্যকে কি দেখতে জোকারের মতো লাগছে? লোকটা এত হাসছে কেন? লাবন্য ভ্রু কুঁচকায়। ইরফান হঠাৎ-ই একটু এগিয়ে বসল লাবন্যর দিকে। লাবন্য খুব করে চাইল একটু সরে যেতে, তবে আড়ষ্টতায় পারল না। ইরফান খুব নরম স্বরে বলতে লাগল, “আমি স্বামী হিসেবে কেমন হবো, তার কোনো নিশ্চয়তা আজ তোমায় দেব না। তবে এত তাড়াতাড়ি তোমার স্বামী হয়ে ওঠার ইচ্ছে নেই।ʼʼ
এটুকু বলে হঠাৎ-ই ইরফানের ভঙ্গিমা বদলে ফুরফুরে হয়ে উঠল, “দেখো, আমি স্বাধীনচেতা মানুষ। জীবনের সব ক্ষেত্রে ইনজয় করার আছে আমার, বিয়ের ক্ষেত্রেও। তোমায় সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সাধারণত যা করার ছিল তা হলো, প্রেম অথবা বন্ধুত্ব। অথচ তুমি সেসবের কোনটাই করার মতো মেয়ে নও। এজন্যই তোমাকে সরাসরি আজীবনের জন্য নিজের করার ইচ্ছে মাথায় এলো। নয়ত তো আর তুমি নিজের আশেপাশে ঘেষতে দিতে না। আর সেই হিসেবে এখন সম্পূর্ণ রাইট আছে আমার তোমার পেছনে চিপকে থাকার। এবার বন্ধুত্ব অথবা প্রেম যেকোনোটাই করতে পারো। তারপর প্রেম করার সাধ মিটলে অথবা বন্ধু হয়ে চলতে চলতে ভালোবাসা হলে স্বামী-স্ত্রী হব আমরা। ঠিক আছে?ʼʼ
উঠে দাঁড়াল শেরওয়ানীর বোতাম খুলতে খুলতে বিরক্ত হয়ে বলল, “এবার প্লিজ একটু সহজ হও, আমার সঙ্গে তোমার এই অপরিচিতর মতো আনুষ্ঠানিকতা ভালো লাগছে না। জোরে করে একবার হাসো তো! একদম যেন ঘরবাড়ি কেঁপে ওঠে, যেন সকলের মনে হয় পেত্নি সরি জিন ভর করেছে। এখন মনে হচ্ছে, কোনো বাকপ্রতিবন্ধি বিয়ে করে এনেছি। কথা বলো!ʼʼ
শেষের কথাটা কপট ধমকে বলল ইরফান। লাবন্য বুঝতে পারছে না এই পরিস্থিতিতে তার ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। হঠাৎ-ই কেন জানি হেসে উঠল নিঃশব্দে ইরফানের কাণ্ড দেখে। ইরফান থেমে যায়, সেও হাসতে হাসতে কোনো মতো একটা টিশার্ট গায়ে চড়িয়ে, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ছোটো বক্স এনে লাবন্যর সামনে রেখে নিজেও বসে পড়ল। সেটা খুলে একটা আংটি বের করল স্বর্ণের। লাবন্যর দিকে আংটিটা পরানোর উদ্দেশ্যে এগিয়ে নিয়ে গিয়েও আবার থেমে গেল। বলল, “নাও এটা পরে নাও। ধরো, বন্ধুত্বের তোহফা এটা আমার পক্ষ থেকে।ʼʼ
লোকটার কথাবার্তা খুব স্বাভাবিক, সাধারণ। এমন ভাবে মুখে স্পষ্ট চঞ্চলতা বজায় রেখে কথা বলছে যেন বহুদিনের সঙ্গী তারা। লাবন্য অদ্ভুত এক কাজ করে বসল। হাতটা বাড়িয়ে বলল, “আপনিই পরিয়ে দিন।ʼʼ
লোকটা হাসল একগাল। তাতেই বোঝা যায়—নিজে হাতে আংটিটা পরানোতে কতটা আগ্রহী লোকটা। আর এজন্যই বোধহয় লাবন্য মানুষটার সেই আগ্রহকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। ইরফান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, যাও এবার এসব ছালা-কম্বল ঝেরে এসো। তোমাকে দেখে আমারই ভারী অসস্তি লাগছে।ʼʼ
লাবন্যর এবার খুব কৃতজ্ঞতা বোধ লাগল, এই লোকটার এই কথাটার জন্যও লাবন্যর যেন লোকটাকে ভালো লাগছে। উফফ, এই মণখানেক ওজনের সাজ চাপিয়ে বসে আছে সেই কত ঘন্টা ধরে। অথচ সকলে বলে দিয়েছে বর ঘরে না আসা পর্যন্ত সাজ নষ্ট করা যাবে না। লাবন্য কৃতজ্ঞতা চাপতে না পেরে মেকি করুণ এক হাসি দিয়ে নিজের আনন্দ বোঝাল। এ পর্যায়ে লাবন্যর মুখভঙ্গি বেজায় হাস্যকর ছিল। ইরফান মুচকি হেসে লুটিয়ে পড়ল ফুল ছিটানো বিছানায়। কিছুক্ষণ পর লাবন্য চেঞ্জ করে এসে দাঁড়াল একটু সংকোচের সাথে। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই তা বুঝতে পারে ইরফান। এক লাফে উঠে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, “ঘুমিয়ে পড়ো, ক্লান্ত তুমি।ʼʼ
লাবন্য দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইরফান তা দেখে ভ্রু কুঁচকায়, “ভয় পাচ্ছ নাকি? নাটকের নায়িকাদের মতো বিছানা শেয়ার করায় সমস্যা থাকায় সোফায় ঘুমানোর পরিকল্পনা আছে? আমার রুমের সোফা ছোটো, তুমি আটবে না। যদি ভাবো আমি গিয়ে শোবো, তো তোমার অবগতির জন্য জানাই, আমি ওত ভালো না। তবে তুমি না চাইলে কিছুই হবে না, সেটুকু কন্ট্রোল আছে আমার।ʼʼ
বলেই চোখ মারল ইরফান। লাবন্য বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে, এবার মাথাটা নামিয়ে নিলো। ইরফান একটু এগিয়ে এলো এবার। তার মুখের দুষ্টুমি ভাব কেটে গেছে, এবার স্বাভাবিক হয়ে বলল, “খারাপ লাগবে এক বিছানায় ঘুমাতে? বুঝতে পারছি, হ্যাজিটেশন ফিল করছ..ʼʼ
লাবন্য এবার মুখ খুলল, “কিছু বলেছি আমি? নিজেই বলে যাচ্ছেন কখন থেকে। আমি বলেছি আমার সমস্যা আছে?ʼʼ
ইরফান এবার গম্ভীর স্বরে বলল, “তাহলে সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোমার মুখের ভাব দেখে আমার নিজেরই গিল্টি ফিল হচ্ছে, যেন কোন জবরদস্তি অশ্লীল আচরণ করে ফেলেছি। তুমি হয়ত ভয় পাচ্ছ আমায়!ʼʼ
লাবন্য এবার একটু লজ্জা পেল। ইরফান বলল, “ঘুমাও, আই বারান্দায় যাব। নাকি যাবে তুমি?ʼʼ
লাবন্য তৎক্ষণাৎ উপর-নিচ মাথা নাড়ে। ইরফান একটু অবাক হলো, সে মোটেই আশা করেনি লাবন্য বারান্দায় যেতে চাইবে।
হালকা কুয়াশা ঢাকা রাত। দুজন মানব-মানবী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এই শীতের রাতে নীরবে অন্ধকার বিলাস করছে। কেউ কোনো কথা বলছে না, কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঝিঝিপোকার ডাক শুনছে। কারও মনোভাব কেউ বুঝে উঠছে না, হয়ত চেষ্টা করছে, তবে তা অন্তর্গত। লাবন্যর মাঝে অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতিরা তোলপাড় শুরু করেছে। জীবনির ধারাবাহিকতা এত জটিল কেন? জীবন কদমে কদমে বাজি পাল্টায়। গতকাল রাতে লাবন্য চাপা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল এ সময়। আজ সে সম্পূর্ণ নতুন জায়গা, নতুন একটা অদ্ভুত মানুষ, আর কিছু অদ্ভুত গুমোট ভাবনাদের নিয়ে সদ্য জড়িয়ে যাওয়ার মানুষটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ-ই ইরফান উদাসী গলায় বলে উঠল,
“ঠাণ্ডা লাগছে তোমার, যাও লাগেজ থেকে নিজের গরম কাপড় বের করে নিয়ে এসো।ʼʼ
—
লাবন্যর শশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে সকলে। ফারজাদ গেছে গাড়ি ঠিক করতে। বেলা এগারোটা পেরিয়ে গেছে। দিলরুবা বেগম দ্বিজাকে তাড়া দিলেন জলদি গোসল সেরে নিতে। আম্মুর দিকে শান্ত চোখে তাকায় দ্বিজা। হঠাৎ-ই দিলরুবা বেগম চোখটা সরু করে তাকালেন, “কী হইছে তোর, দ্বিজা? কয়েকদিন দেখতেছি অন্যরকম চলাফেলা করতেছিস। কী সমস্যা, তোর ভাবভঙ্গি তো ভালো দেখাইতেছে না।ʼʼ
দ্বিজা একটু থতমত খেয়ে গেল। যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মহিলা দিলরুবা। তার কাছে যেন-তেন ভাবে পার পাওয়া যাবে না। দ্বিজা চট করে পরিস্থিতি পরিবর্তন করে নেয়। মুখটা গোমরা করে, “লাবন্য আপু চলে যাওয়ায় ভালো লাগতেছে না, আম্মু।ʼʼ
দ্বিজার ভঙ্গিমাটা নিখুঁত ছিল, বলতে হবে। দিলরুবা বেগম স্বাভাবিক হলেন। এ বাড়িতে একসঙ্গে মানুষ হয়েছে দুজন। খারাপ লাগাটা অস্বাভাবিক না। বললেন, “কী পরে যাবি?ʼʼ
দ্বিজার খুব বলতে ইচ্ছে হয়, না গেলে হয়না, আম্মু? তবে সাহস হলো না। দ্বিজা কথা বলছে না দেখে হাতের শাড়িটা দ্বিজার দিকে এগিয়ে দিয়ে বেশ কোমল স্বরে বললেন তিনি, “এই শড়িটা এবার চলে যাওয়ার আগে তোর আব্বু কিনে দিয়ে গেছিল। তোর তো খুব পছন্দের, এইটাই পর যা।ʼʼ
দ্বিজা একটু অবাক হলো। সে সাজতে খুব সৌখিন বলে আম্মুর কাছে খিস্তি জীবনে কম শোনেনি। আজ আম্মু নিজেই শাড়ি পরার কথা বলছে?
দিলরুবা বেগম চলে গেলেন। দ্বিজা বসে রইল ওভাবেই। একদম সাজতে ইচ্ছে করছে না, আর না যেতে। সে অবাক হয় নিজের মনোভাবের ওপর—সারাদিন ছটফট করে বেড়ানো দ্বিজা কেমন নিস্তেজ, শান্ত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
কিছুক্ষণ পর দিলরুবা বেগম আবার এলেন। দ্বিজা হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। দিলরুবা বেগম ভ্রু কুঁচকে আছেন। তার মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনি কিছু খেয়াল করছিন দ্বিজার মাঝে। দ্বিজা দ্রুত বলে ওঠে, “যাচ্ছিলামই তো আমি, কিন্তু লাবন্য আপুর বাথরুমে কে যেন ঢুকল।ʼʼ
দিলরুবা বেগম তাকালেন একবার বাথরুমের দিকে। দ্বিজা মনে মনে কষে নিজেকে দুইটা লাথি দেয়। বাথরুমের ছিটকিনি বাইরে থেকে লাগানো। দ্বিজা ধরে পড়ে গিয়ে চোরের মতো হেসে উঠল বলল, “যায় নি এখনও, যাবে। বলে গেল। বড়ো খালামণি যাবে।ʼʼ
দিলরুবা বেগম গম্ভীর স্বরে বললেন, “লাবন্যর বাথরুমে তো পানিই নেই আজ দুইদিন।ʼʼ
দ্বিজার মুখটা ছোটো হয়ে আসল, তবুও দৃঢ়তা বজায় রাখার চেষ্টা করল মেয়েটা। পারছে না, আম্মুর এই রূপ দেখলে খুব অপ্রস্তুত হয়ে সে। আম্মুর চোখ ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। দিলরুবা বেগম ওভাবেই গুমোট স্বরে সরু চোখে বললেন, “ফারজাদের বাথরুমে যা, ও নেই এখন। তাড়াতাড়ি বের হবি।ʼʼ
দ্বিজা ফারজাদের রুমে ঢুকল না। সম্ভব না, মন-মস্তিষ্ক সঙ্গে শরীরও সায় দিচ্ছে না ওই রুমে যাওয়ার ব্যাপারে। সে দুই মামীর বাথরুম চেইক করল। সবগুলোতে লোকে ভর্তি।আত্মীয়-স্বজন সব ঢুকেছে, সাথে সিরিয়ালে আছে আরও কিছু লোক। ফারহানা বেগম রূপা ও দ্বিজাকে বললেন, ফারজাদের বাথরুমে যেতে। কারণ, যাই হোক ওই ঘরে কেউ যায়নি কোনভাবেই। দ্বিজা চোখটা চেপে বুজে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আম্মুকে বোঝানোর উপায় নেই, কী করে বোঝাবে, কী বলবে, সব কথাই কী খুলে বলা যায় মানুষকে?
দ্বিজা ও রূপা একসঙ্গেই গোসল করছে। কিছু করার নেই, সময় সল্প, যখন তখন চলে আসবে কাটখোট্টা লোকটা। এলোও তাই, কিছুক্ষণ কপাল জড়িয়ে চেয়ে রইল নিজের বাথরুমে দরজার দিকে ফারজাদ। দ্বিজার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। দুটো যুবতী মেয়ে গোসল করছে, সেখানে এভাবে তার ঘরে থাকা বা তাদের এ মুহুর্তে তার উপস্থিতি জানান দেওয়া; মোটেই ভালো দেখাবে না ব্যাপারটা। দু পক্ষের কাছেই ব্যাপারটা অকওয়ার্ড। ফারজাদের রাগ হলো, আর কোন বাথরুম পায় নি নাকি? কিছু না বলে চোখ-মুখ কুঁচকে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
রূপা বেরিয়েছে আগেই। দু-মিনিট পর দ্বিজা গোসল করে বেরিয়ে ঘর ফাঁকা দেখে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। শাড়িটা কোনরকম গায়ে জড়িয়ে একদৌড়ে চলে যায় লাবন্যর রুমে। বড়ো খালামণি শুয়ে আছেন রুমে, ওরা ঢুকে দরজা আটকাতে গেলে তিনি বেরিয়ে গেলেন, এরপর দরজা আটকে দিলো রূপা। ক্ষণে ক্ষণে তার বুক কাঁপছে দ্বিজার।
কোনভাবেই সে ফারজাদকে জানাতে চায়না সে তার রুমে এসেছিল।
লাবন্যর রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ ওভাবেই থম মেরে বসে রইল শাড়িটা গায়ে পেঁচিয়ে। রূপার পোশাক পরা প্রায় শেষ। মনকে সে বোঝাতে চাইছে, একটু চঞ্চল হও, অন্তত আজকের জন্য হলেও। মন কথা শোনে না তো কারও, আবাধ্য মনের ওপর ক্ষোভ জমছে দ্বিজার। মন না চাইলেও উঠে দাঁড়াল শাড়ি পরার জন্য। শাড়ির কুচি বানানোর জন্য শাড়ির একপ্রান্থ ধরে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল আয়নার সামনে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বর দেখে একটু থামল সে, আনমনে তাকিয়ে রইল ওভাবেই। আনখেয়ালী হাতে কুচি করছে। এরই মাঝে বন্ধ দরজাটা খুলে রূপা কখন যে বেরিয়ে গেল, উদাসীনতায় সেদিকে মনোযোগ দিতে পারল না সে। মনটা বড়ো অচঞ্চল হয়ে আছে। নিস্তেজ মন-মস্তিষ্ক আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ করছে যেন তার।
হুট করে দরজা খুলে সেখানে প্রবেশ ঘটে লম্বা এক মানব মূর্তির। এটুকু আনমনা চোখে আয়নার ভেতরে দৃষ্টিগোচর হতেই মস্তিষ্কে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো দ্বিজার। দ্রুত ওভাবেই ঘুরে দাঁড়াল তড়িৎ গতিতে। ফারজাদের মতো নির্জীব পূরুষটা আজ থমকে গেল আকস্মিক। মস্তিষ্কের অপ্রতিভ সারায় চেয়ে দেখল সামনের সদ্য যুবতী মেয়েটার তড়িঘড়ি শাড়ির কুচি গুজে বুকে আচল নেওয়া দৃশ্যটুকু। এরই মাঝে মুহুর্তের মাঝে তার নজরে এসেছে, যুবতী এক নারীর ব্লাউজের ওপরের উড্ডমায় ভাজটা। অনাবৃত পেট, খুলা গলা, গোটা অর্ধখোলা শাড়িতে একটা রূপমাধুরী!
দ্বিজা ততক্ষণে আড়ষ্টতায় ঘুরে দাঁড়িয়ে লজ্জায়, সংকোচে, চোখটা খিঁচে বন্ধ করে শাড়ি চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ফারজাদ শুকনো একটা ঢোক গিলে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়। পুরো ঘটনাটা ঘটতে সল্প কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগেনি। অথচ ফারজাদের বুক কাঁপছে, ঢিপঢিপ করে অস্থির করে তুলছে। অপরাধবোধে পিষ্ট হচ্ছে মানসিকতা। ওমনিই ঘুরে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
সে অল্প কিছুক্ষণ আগে নিজের বাথরুমে দেখে এসেছে দ্বিজাকে। এরই মাঝে লাবন্যর রুমের আলমারির ওপর থেকে লাবন্যকে দেওয়ার জন্য কিনে রাখা নতুন কম্বলটা নিতে এসেছিল ফারজাদ। নিজের ওপর বেজায় রাগ হলো ফারজাদের। চোখ বুজে ভারী শ্বাস ফেলল। হঠাৎ-ই চোখের সামনে ভেসে উঠল কিছুক্ষণ আগের দৃশ্যটি। ফারজাদ দ্রুত চোখ খুলল। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল চারদিকে। মাথা ঝাড়া দিয়ে কপাল চেপে ধরল আঙুল দিয়ে। মস্তিষ্ক অবাঞ্ছিত ব্যাপার বেশি খেয়ালে রাখে, কী মুশকিল!
দ্বিজার বড়ো খালামণি দেখলেন ফারজাদ বেরিয়ে গেল রুম থেকে। তিনি গেলেন লাবন্যর রুমের দিকে। ভেতরে ঢুকেই দেখলেন দ্বিজা থমকে দাঁড়িয়ে আছে অর্ধ পরিহিত শাড়ি শরীরে কোনরকম পেচিয়ে। খালামণিকে দেখে দ্বিজার বুকটা ছলকে ওঠে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও অজানা শঙ্কায় বুকটা ধুক করে উঠল। সে ব্যস্ত হয়ে উঠল সাফাই গাইতে। খালামণির চোখে যে সন্দিগ্ধ অকথিত কটূক্তি তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, এটা কী-করে বোঝাবে দ্বিজা। খালামণি খুব একটা সুবিধার মানুষ নয়।
চলবে..
#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা
১১.
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে মাঝখানে। দ্বিজার পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। মেয়েটা পড়ালেখায় বেশ ব্যস্ত আজকাল। এমনটাই দেখতে পাওয়া যায় তাকে। সপ্তাহখানেক আগে তিনমাসের ছুটিতে দেশে ফিরেছেন দ্বিজার বাবা হাবিবুর রহমান। তার সঙ্গে দ্বিজার খুব একটা সখ্য নেই। ছোটোবেলা থেকেই বাবাকে কাছে পেয়েছিল না দ্বিজা, মামার বাড়িই তার সব।
দুপুরের খাওয়াটা একসঙ্গে খেয়ে এসে নিজের ঘরে জানালার পাশে বসে আছে সে। সামনে বই-খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটা বই তুলে কোলের ওপর রেখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ বইয়ের দিকে। উহু, মনোযোগ আসছে না। দ্বিজা বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে আজকাল। আগের মতো আর লাফালাফি বা চটপটে কথাবার্তা বলতে দেখা যায় না তাকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল দ্বিজা। জানালার ওপারেই দাদি কুমড়ো গাছ লাগিয়েছে। সেটা জানালার ধারে পোঁতা খুঁটি বেয়ে উপরে উঠে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সেই গাছের দিকে বেখেয়ালি দৃষ্টিতে। খুব খালি খালি লাগছে বুকটা। না ভেতরটা শুকিয়ি আসছে যেন পিপাসায়। জলের পিপাসা নয় বোধহয়, এ পিপাসা আত্মার, এ পিপাসা মনের! পাশে পড়ে থাকা ফোনটা চট করে হাতে তুলে নিলো দ্বিজা। দুপুর আড়াইটার মতো বাজে। ফোনে ভেসে থাকা নম্বরটার দিকে তাকিয়ে পেটে মোচর দিচ্ছে, বুকটা ঢিপঢিপ করছে কেন এত? আর একটু হলে তো বুক ফেটে যাবে, কী মুশকিল! দ্বিজা নম্বরটা ডায়াল করে দম আটকে বসে রয়। সে জানে না রিসিভ হবে কিনা, হলেও তারপর কী হবে?
“দ্বিজা!ʼʼ
ওপাশ থেকে সরাসরি এক ভরাট পূরুষালি গলা শোনা গেল। দ্বিজা কথা হারিয়ে ফেলেছে। দম ছাড়ছে না তার। চোখটা বুজে নিলো চেপে। এই কণ্ঠস্বর! গলা ভিজে এসেছে যেন দ্বিজার, তাহলে কী সে এই পিপাসায় কাতর ছিল? ফারজাদ আবার বলল, “কল করে চুপ করে থাকার মানে কী, দ্বিজা! কিছু বলবি?ʼʼ
চোখটা খুলল দ্বিজা। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “দুপুরের খাওয়া শেষ?ʼʼ
“না শুরু করব।ʼʼ
দ্বিজা দ্রুত বলে ওঠে, “ঠিক আছে, তাহলে খাও তুমি..ʼʼ
“খাব, তুই বল।ʼʼ
দ্বিজা একটা ঢোক গিলল অসস্তিতে, “কবে আসবেন আপনি?ʼʼ
প্রশ্নটা চরম বোকার মতো করেছে মেয়েটা, যেন ওকে অপেক্ষায় রেখে গেছে ফারজাদ। ভ্রূটা কুঁচকে ফেলে ফারজাদ সামান্য। কিছুক্ষণ কেউ-ই কোনো কথা বলল না। বেশ কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙে দ্বিজাই বলল, “একটা কথা বলার জন্য কল করেছি।ʼʼ
“শুনছি, বল।ʼʼ
“গতকাল এডমিট কার্ড আনতে গেছিলাম। সেখানে ওয়াহিদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।ʼʼ
“হুমম? তো?ʼʼ
“প্রায় দিনই বাড়ির সামনে দেখি এসে দাঁড়িয়ে থাকে।ʼʼ
ফারজাদ দ্বিজাকে অবাক করে দিয়ে ভারী গলায় হেসে ফেলল, “তুইও যদি দেখতে না যাস, তো ওর দাঁড়িয়ে থাকা দেখিস কীভাবে?ʼʼ
দ্বিজার মোটেই ভালো লাগল না কথাটা। তার আর এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করল না, মনটা আরও ভার লাগছে। তবে কল কাটল না ওভাবেই ধরে রাখল। ফারজাদের নিঃশ্বাসের আওয়াজ কী শুনতে পাওয়া যাচ্ছে? চোখটা বুজতেই থুতনিটা ভেঙে আসল মেয়েটার। এই লোকটাকে সে দেখে না প্রায় দুইমাস হলো। অথচ মায়া, টান, বুকের তীব্র উথাল-পাতাল অনুভূতি—কিছুতেই ভাঁটা পড়েনি কেন? ফারজাদের চোখের ওপরের চটা ভ্রুটা খুব সুন্দর। দেখতে খুব ভালো লাগে দ্বিজার, সে বহু আগেই এই ভালো লাগা টের পেয়েছিল। অথচ এখন সেই ভালো লাগার একটা নাম দিয়েছে সে, তৃষ্ণা। অথচ যে সরোবরে সে ডুবেছে তার তরল বড়ো রুক্ষ, তপ্ত। এই তপ্ত সরোবরের জল পান করা দুঃসাধ্য! হঠাৎ-ই ফোনের ওপাশে ফারজাদের আওয়াজে চোখ খূলল দ্বিজা,
“পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন?ʼʼ
“ভালো, তবে…
“কার সঙ্গে কথা বলতেছিস দ্বিজা?ʼʼ
দ্বিজা চমকে উঠে তাকায়, ফোনটা কান থেকে বিদ্যুতের গতিতে নামিয়ে এক আঙুলে কোনোমতো ফোন কাটল দ্বিজা। দিলরুবা চোখ ছোটো ছোটো করে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন। একটা মেয়ের কাছে এরকম পরিস্থিতিতে মায়ের ওই সন্দিহান দৃষ্টি ঠিক কতটা আতঙ্কের, তা দ্বিজার বুকের আন্দোলনে খানিক টের পাওয়া যায় বোধহয়। অথচ দ্বিজার মাঝেমধ্যেই নিজেকে চালাক মনে হয় বেশ। সে নিজেকে ভালো অভিনেত্রী মনে করে বসে কখনও কখনও। তেমনই এখন পরিস্থিতি লুকিয়ে অতিষ্ট ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে মুখে বেশ বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, “উফফ, এভাবে ভুতের মতোন ঘরে আহো কেন? তমার সাথে কথা বলছিলাম, রুটিনের ব্যাপারে।ʼʼ
অথচ মেয়েটা বোধহয় ভুলে গেছে তার চোখের পাপড়ি এখনও ভেজা। চোখের নিচের কালি দেখে সহজেই আন্দাজ করা যায়, বহুরাত মেয়েটার চোখ খুলে কেটেছে। দিলরুবা বেগম গম্ভীর পায়ে হেঁটে এসে খপ করে ফোনটা কেড়ে নিলেন। হাতে নিয়ে স্ক্রিন অন করে দেখলেন লক করা। বললেন, “তমার সাথে কথা বলতেছিলি, তো আমি আসায় এরম কল কাটলি ক্যান?ʼʼ
“আরেহ! চমকে উঠেছি তোমার এভাবে আসায়, হাতের চাপে কেটে গেলো কল।ʼʼ
দিলরুবা বেগম কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। দ্বিজা ওই চোখে নজর মেলাতে পারে না। সে একবার তাকাচ্ছে আবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দিলরুবা বেগম ফোনটা ছুঁড়ে মারলেন বিছানায়, বললেন, “ভালো করে পড়, পরীক্ষার আর দুইদিন আছে।ʼʼ
ব্যাপারটা এত সহজে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হজম হলো না দ্বিজার। বুকের কাঁপুনি থামছে না দিলরুবা বেগম চলে যাওয়ার পরেও। তার অজানা এক শঙ্কা হতে লাগল মনে। সেদিন খালামণি আম্মুকে কথাটা বলার পরেও আম্মু এখন অবধি নীরব। অবশ্য দ্বিজার প্রতি নজরদারী বেড়েছে, বহু গুণে বেড়েছে। একটা মেয়ের অর্ধ জড়িত শাড়ি পরা অবস্থায় একা রুম থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে যাওয়া, গ্রাম বাংলায় ব্যাপারটাকে মোটেই সহজভাবে নেওয়া হয় না। তাদের কোনো সাফাইয়ের পাত্তা দেওয়া হয় না। যেমনটা দ্বিজাকে কিছু জিজ্ঞেসই করা হয় নি আজ পর্যন্ত। অথচ দ্বিজার জীবনধারা খানিক হলেও বদলেছে। অযথাই আম্মুর চোখে সারাক্ষণ সে তার প্রতি সন্দিহান, বাঁকা নজর টের পায়। সেও কিছু বলে না, আম্মুও না।
দিলরুবা বড়ো আত্নসম্মানবোধ সম্পন্ন মহিলা। সম্মান জড়িত বিষয়ে তার কাছে প্রশ্রয় পাওয়ার চান্স নেই। আর হাবিবুর রহমান আগুনের দলা। আব্বুর যুক্তি ও মন মেজাজ দেখে দ্বিজার মাঝেমধ্যে মনে হয় আজও তার আব্বু অশিক্ষিত, আর কুসংস্কারের যুগের লোক। কেমন যেন শাসিত দৃষ্টিভঙ্গি তার। যদিও দ্বিজাকে তিনি কখনো কোনরকম গালমন্দ করেন নি। তবুও আব্বুর সঙ্গে সে সহজ হতে পারে না।
মেয়েটা ওভাবেই থম মেরে বসে রইল। তার বুকটা এখনও মৃদু কাঁপছে বোধহয়! ইশ! জীবনটা কেমন ঘোলা ঘোলা লাগে আজকাল। দিনদিন চঞ্চলতা হারিয়ে যাচ্ছে তার জীবন থেকে। আচ্ছা! জীবন কি এরকমই? উত্তর নেই, কে দেবে উত্তর? অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে, তার আজকাল শুধু তাই-ই মনে হয়।
—
রাজারবাগ পুলিশ লাইনের জলাশয়। চারপাশটা নারিকেল গাছে ঘেরা। রাত এগারোটার মতো বাজছে। ফারজাদ হালকা কুয়াশার ভিড়ে আধো অন্ধকারে নিজের ঘড়িতে সময় দেখল। জ্যাকেট ভেদ করে প্রবেশ করা ঠান্ডায় মাঝেমধ্যেই গা শিউরে উঠছে। ফারজাদ তাকিয়ে রইল জলাশয়ের কালো পানির দিকে। বুক ফুলিয়ে বেশ দীর্ঘ একটা শ্বাস নিলো। পানি থেকে চোখ তুলে শূন্যে তাকাল। তার ট্রেনিং শেষের দিকে। ক’দিন বাদেই ডিউটিতে জয়েন করবে সে।
নিজের প্রতি অভিযোগ করতে বসে যায় সে। তার এই অন্তর্মুখী স্বভাব তাকে সকলের থেকে কত দূরে ঠেলে দিয়েছে। ঠেলে দিয়েছে বলতে সে চলে এসেছে। সে নিজেই মাঝেমধ্যে নিজের মানসিক হাবভাব বুঝতে পারে না। হঠাৎ-ই দ্বিজার কথা খেয়ালে এলো, সে স্পষ্ট শুনেছে ফুপুর গলার স্বর। তার পর পরই দ্বিজা কল কেটেছে। ফারজাদ নিজের মনেই একবার উপহাসের হাসি হাসল। দ্বিজার পাগলামি বাড়ছে, মেয়েটা সামনে বেশ বড়োসড়ো ধাক্কা খেতে চলেছে। মেয়েটাকে আজও বোঝানো গেল না, ফারজাদ মৃত আত্মা। পড়ে আছে তাকে নিয়ে। আজ নিশ্চয়ই বাড়িতে একটা তামাশা হয়েছে? আর ঠিক কীভাবে বোঝালে বুঝবে পাগলিটা? ফরজাদ ফারজাদ হাঁ করে শ্বাস নিলো। আঙুলের মাঝে ঘুরাতে থাকা সিগারেটটা ঠোঁটের ভাজে চেপে একটা দিয়াশলাই ঘষল ম্যাচ বক্সে।
ঠোঁটের বিভাজন থেকে মুক্ত হয়ে উড়ে যাওয়া ধোঁয়ার কুণ্ডলিতে ফারজাদের ফেলে আসা কাল ভেসে ওঠে।
—
ফারজাদের বয়স আঠারো চলছে। তখন মাধ্যমিকে সাফল্যের সঙ্গে ভালো ফলাফল করার পর, ভাগ্যক্রমে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চান্স হয়ে গেল তার রাজউক কলেজে। গ্রামের এক রত্নই ছিল বটে ফারজাদ। তখন আসলাম সাহেব ও আফছানা বেগম ঢাকাতে থাকতেন। তাদের কাছে থেকেই পড়ালেখা চালিয়ে যেতে থাকল ফাদজাদ।
একাদশ শ্রেনিতে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার কয়েকদিন বাকি ফারজাদের। ক্লাসের শেষে ক্যাম্পাস থেকে বের না হয়ে মাঠের এককোণে কয়েকটা বন্ধুসহ বসে আছে সে। তখনই হঠাৎ তাদের সামনে একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল। মাথাটা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফারজাদ দেখল একবার তাকিয়ে। মেয়েটা মিনমিনে স্বরে ডেকে ওঠে, “ভাইয়া! গতকাল যে সাজেশন দিয়েছে ক্লাসে, আমি এসেছিলাম না জন্য পাইনি। ওগুলো দিতে পারবেন?ʼʼ
ফারজাদ প্রথমত অবাক হলো, সে কোনো মেয়ের কাছে সাজেশন না চেয়ে ওর কাছে কেন এসেছে? সে-সব বাদ দিয়ে দুষ্টু হেসে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “ভাইয়া!ʼʼ
মেয়েটা তখনও সংকুচিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে হাতের আঙুল খুঁটছে। ফারজাদ মৃদুহাস্য নজরে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলো মেয়েটার— বিণুণী গাঁথা চুলটা কাধ ঘুরিয়ে সামনে এনে রাখা, চোখ ও কপালের ওপরে কিছু এলোমেলো চুল পড়ে আছে বিক্ষিপ্ত ভাবে। দ্বিধা—আড়ষ্টতায় আধমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি মাথা নিঁচু করে। ফারজাদের হাসি চওড়া হলো একটু। চট করে উঠে দাঁড়াল মেয়েটির সামনে। তালগাছের মতো লম্বা ফারজাদের তুলনায় মেয়েটাকে নেহাত ছোটো দেখতে লাগে। ফারজাদ ঘাঁড় নেড়ে বলে, “তোমার হাইট অনুযায়ী অবশ্য আমায় ভাইয়া ডাকা ঠিকই আছে।ʼʼ
পাশ থেকে বন্ধুরা সব হেসে উঠল সমস্বরে। ফারজাদ ওদের দিকে তাকিয়ে শার্টের ওপর পড়ে থাকা টাই-টা টেনেটুনে আরেকটু ঢিলা করে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, “কীসের সাজেশন লাগবে?ʼʼ
“কাল দিয়েছে যেগুলো।ʼʼ
ফারজাদ কেমন করে যেন চেয়ে আছে মেয়েটার মুখের দিকে। সংকোচে বুদ হয়ে আসা ওই মুখে কিছু খুঁজছে বোধহয়! ভ্রুটা সামান্য কুঁচকে বলল, “দিয়েছে তো অনেকগুলোই। অত নেবে কীভাবে?ʼʼ
বলেই ফারজাদ আবার অলস ভঙ্গিতে বসে পড়ল। তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। মেয়েটা চোখ তুলে তাকায় এবার। ঘন পাপড়ি চোখের, দেখতে আফগানিস্তানিদের মতো লাগছে হুবহু। ফারজাদ কপাল জড়িয়ে চেয়ে রইল সেদিকে। মেয়েটা একটু ইতস্তত করে বলল, “এখন তো অত লিখে নেওয়া সম্ভব না। আপনার নাম্বারটা দেবেন, বাড়ি গিয়ে আম্মুর ফোন থেকে ছবি নিয়ে নেব!ʼʼ
ওরা সকলে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। ফারজাদ কেবল একদৃষ্টে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। আবার একবার চোখ ঘুরিয়ে মেয়েটিকে পরখ করে দেখল। জিজ্ঞেস করল, “এখানকার স্থানীয়?ʼʼ
মেয়েটা মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝায়। ফরজাদ আশেপাশে চোখ ঘুরায়। অনেককেই দেখা যাচ্ছে—কেউ দাড়িয়ে, তো কেউ বস আছে, কেউ হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফারজাদ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “মেয়েদের কাছ থেকেও তো নিতে পারতে। আমার কাছেই কেন?ʼʼ
“কাউকে চিনি না আমি, তেমন পরিচয় নেই। আর ওদের দেখেও ভালো মনে হচ্ছে না… মানে..ʼʼ
ফারজাদ কথা কেড়ে নেয়, “তো আমায় দেখে ভালো মনে হচ্ছে?ʼʼ
মেয়েটাকে একটু অপ্রস্তুত দেখায়। ফারজাদ খুব মজা পাচ্ছে কেন জানি মেয়েটার এই অস্বচ্ছন্দ, জড়তা ভঙ্গিতে।
ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “নাম কী?ʼʼ
মেয়েটা আস্তে করে বলল, “ইভা! আর আপনার নাম?ʼʼ
ফারজাদ চোখ বাঁকা করে দু পাশে ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকাল, বন্ধুদের উদ্দেশ্যে দাঁত চেপে বলল, “ভাই, মেয়েটাকে বোঝা—আমি ওর সেইম ইয়ার ব্যাচ। ভাইয়া, আপনি, আল্লাহর রহমতে কখন না জানি চাচা ডাকবে।ʼʼ
সকলে মুখ চেপে হেসে উঠল। ফারজাদ সবকিছুকে এড়িয়ে ইভার দিকে তাকিয়ে কেবল বলল, “আগামীকাল এখানেই এসো, আজ আনিনি সাজেশনগুলো। কাল নিয়ে আসব, লিখে নিও।ʼʼ
ইভা একটু থমকাল—আজব ছেলে!
চলবে..