#তনুশ্রী♥
#লেখক:হৃদয় আহমেদ
#পর্ব_৯
চকিত দৃষ্টি ছুড়ে তূর তনুর দিকে। আশপাশে থমকে গেছে তূরের। আমতা আমতা করে বলে,
– কি বললে?
তনু মাথা তুলে তাকায়। কন্ঠস্বর স্বাবাভিক সংযোত রেখেই বলে,
– কইতাছিলাম, কাল সন্ধ্যায় আমি তির্থ ভাইকে জুঁই আম্মার ঘরে ডুইকা…দেখছি! ‘
– মাথা ঠিক আছে তোমার? কিসব আজেবাজে কথা বলছো? ‘
– আমি সত্যো কই। কসম আল্লার আমি ঠিক দেখছি ও শুনছি! ‘
তূরের সবটা এলোমেলো হয়ে যায়। নিজেকে আটকানের বৃথা চেষ্টা করে তূর। কিন্তু পারে না। বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে যায় জুঁইয়ের ঘরের দিকে। তনু বিছানা থেকে উঠে দাড়ায়। তার কেমন ভয় হচ্ছে। কি হবে এবার?
বিনা অনুমতিতেই জুঁইয়ের ঘরে প্রবেশ করে তূর। জুঁই ঘরের কোথাও নেই। তূর খুব রাগী স্বভাবের। রাগলে নিজেকে সে আয়ত্ত করতে পারে না। সোজা নিচে চলে যায়। অন্দরমহলে এখন প্রায় সকলেরই রাধার ঘরে তাকা উচিত। তূর সেখানে যায়। পেছন পেছন ছুটে তনু। জুঁই গল্পে আর তরকারি কাটতে ব্যাস্ত। সেখানে সয়ং রিমি আখতার আরও চার বউ আছে। তূর জুঁইয়ের সামনে দাড়ায়। তরকারি কাটতে কাটতে বঠির সামনে দু জোরা পা দেখে উঠে দাড়ায় জুঁই। রিমি আখতার সহ সকলে উঠে দাড়ান। তূর যে রেগে আছে তা স্পষ্ট! অবস্থা বেগতিক হওয়ার সম্ভবনা সবথেকে বেশি। রিমি আখতার বলে ওঠেন,
– তূর তুই এখানে ক্যান? কিছু চাই?
তূর তাকিয়েও দেখে না। তূর জুঁইয়ের হাত ধরবে তখনি তনু তূরের হাত ধরে রাধার ঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসে। বিরক্তি নিয়ে তাকায় তূর। বলে ওঠে,
– কি সমস্যা?
– এমন কইরেন না। আগে পুরোডা হুনেন তারপর..’
– কি শুনবো? সবটা জেনেই খ্যান্ত হবো। আর বাকি রইলো তির্থ। ‘
– ভিতরে আম্মা আছে। আপনের কসম লাগে এমন করবেন না! ‘
– সৃষ্টিকর্তার ছাড়া কারোরই কসম খাওয়া যায়না তনু। ছাড়ো আমায়! ‘
তনু আরও জোড়ে খিচে নেয় তূরের হাত। তবে অতটুকু মেয়ের হাত এত বড় বলিষ্ঠ দেহের কাছে একেবারে দুধপানির মতো! তূর এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেয় তনুকে। তনু কিছুটা দূরে পড়ে। তূর হনহনিয়ে প্রবেশ করে ভিতরে। সরাসরি জুঁইকে প্রশ্ন করে ওঠে,
– তির্থ তোমার ঘরে কেন যায়?
চোখ বড়বড় করে তাকায় জুঁই। নিজ ইচ্ছায় বঠিতে পা রেখে গোড়ালির একাংশ কেটে ফেলে। জুঁই ফুপিয়ে ওঠে,
– আউচ! আহ্!
তৎক্ষনাৎ দৌড়ে আসেন রিমি আখতার। পা দিয়ে গলগলে তাজা রক্ত পরছে। তিনি পা চেপে ধরে তূরকে শাসান,
– কি হইছে তূর তর? মেয়েটা ভয়ের চোটে ক্যামনে পাডা কইটা ফেললো? ইশশশ! রক্ত পড়তাছে। যা গিয়া পাথরকুচির পাতা নিয়ে আয়। ‘
তনু ছুটে যায় বাইরে বাগানে। সেদিন সুপারি গাছের পার্ষে পাথরকুচির পাতা দেখেছিলো তনু। বেশ অনেকটাই কেটে গেছে। জুঁই এটা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত করেছে। তনু সচক্ষে ও সুস্থ মস্তিষ্ক তা দেখেছে। নিজে পা লাগিয়ে এটা করেছে জুঁই! কিন্তু কেন? তির্থের ব্যাপারটা কেন লুকাচ্ছে জুঁই?
তনু আর ভাবতে পারে না। পাতা ছিড়ে হাতে মতলে দিয়ে যায় অন্দর মহলে। জুঁইকে আনা হয়েছে বসার ঘরে। তনু পাতা এগিয়ে দেয় রিমি আখতারের সামনে। একটানে ছো মেরে নিয়ে যান রিমি আখতার। চেয়াল খিচে একবার অগ্নিসংযোগ করা চোখ নিয়ে তাকান রিমি তনুর দিকে। যেন এসব তনুর কারসাজি! রিমি জানেন এসব কিভাবে ছোটাতে হয়! মেয়ে বউয়ের বেশি বার কখনোই ভালো না। তিনি তা ছাঁটবেনই!
তিনি কোমল হাতে লাগিয়ে দেন ঔষুধি পাতা। জুঁই চিৎকার করে মুখে শাড়ি গুজে কাঁদছে। তূর দূরে দাড়ায়। বসার চেয়ারগুলোর হাতল শক্ত করে ধরে। তনু ধির পায়ে তূরের দিকে যায়।
– ক্যান এইসব করতে গেলেন?
চুপ তূর৷ তনু আবার বলে,
– আমার কওনই ন্যায্য হয়নাই।
– চাচী এইটা স্বেচ্ছায় করেছে।
তনু তূরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আপনিও বুজছেন?
– এটাতে বুঝার কিছু নেই। চাচী এগুলো লুকাতে চায়। কিন্তু কেন চায় এইটা বুঝতে পারছি না। ‘
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তনু।
– এইযে বড়বউ!
উঠে দাড়িয়ে জোড়ে ডেকে ওঠে রিমি আখতার। তনু সাথেসাথে পেছনে ফেরে। দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে আসেন রিমি। বলে ওঠেন,
– কাজ কামে তো অষ্টরম্ভা বুঝছি। নিজেতো কাজ করোনা। বিয়ার পর একবারও রাধার ঘরের দিকে চাইয়া দেখছোনা।এহন কি মজা লও? সয়তানি চাপছে? ‘
তূর ঘুরে দাড়ায়। চোখ ছলছল করে ওঠে তনুর। তনু মাথা নিচু করে দেয়। তনুর পক্ষে এসকল কথা হজম করা সম্ভব নয়। কথাগুলো কটাক্ষ স্বরে বলেছেন রিমি। তূরের কন্ঠ ভেজা,
– আম্মা তুমি ওর সাথে..’
– তুই চুপ কর তূর। তোর লাইগাই সর্বপ্রথম মোড়লবাড়ির বউরা এমন সয়তানি করতে পারছে। বউরে মাথায় তোলার কিছু নাই বুঝছোত? ‘
– সয়তানি? আম্মা তনু সয়তানি করেছে? সয়তানি? কি বলো এসব? ‘
রিমু মুখ বাকিয়ে বলেন,
– যা কই ঠিকি কই! ওই মাইয়া নিজের রুপ দেখাইয়া যে কত কিছু করতে পারবো তা বুঝছিলাম আগেই! ওই রুপ দিয়া সংসার হইবো না ওরে বুঝা ঠিকমতো! ‘
– আম্মাহহ!
– ওই তরে কি বুঝাইছে? বল তুই তোর চাচীর সাথে ক্যান এমন করলি? কি করছে ও? এই তনু ফনুই…’
– আম্মা চুপ করো! দয়া করে মুখটা বন্ধ করো। ‘
তনুর চোখ বেয়ে পড়ে সাদা অশ্রু! ধবধবে সাদা গালে কারো নজর কারবে না। বুকে যেন সৃষ্টি হয়েছে মানুষের লাগানো ঝড়! তূর দেখেছে তনুর হেঁচকি তুলে কাঁদা। রিমি সাবধানতার ইংগিতে বলেন,
– যদি ফের এমন কিছু চোখে পড়ে তাইলে ওই মাইয়ারে কিন্তু আমি…ভালো কইরা বুঝাই দিস! চল জুঁই!
তিনি জুঁইকে নিয়ে আস্তে আস্তে দোতলায় উঠে যান। তনুর জোড়ে কেদে দেয়। তার মনে পড়ছে লতিফার কথা। তার জন্মদত্রী মায়ের আদর গুলো!
তনুর কান্নায় তূরের বুক কেমন করছে! যেন প্রতি কান্নার ফোটাঁয় কেউ আঘাত হানছে বুকে। তূর চটজলদি তনুকে নিয়ে উপরে চলে যায়। ঘরের সামনে এসে তনুকে ঘরে পাঠিয়ে বেড়িয়ে যায় তূর। আড়মোড়া হয়ে বসে পড়ে বিছানায় তনু। চোখে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আর বুকে রক্তক্ষরণ!
তূর চম্পার ঘরের দিকে এগোয়। আস্তে করে একটা টোকা দেয়। আওয়াজ আসে ভেতর থেকে,
– কে?
– তূর!
– আয়।
তূর ভেতরে যায়। তির্থ কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। তূর গিয়েই পাঞ্জাবির গলা খামচে ধরে। তির্থ বোকা বনে যায়। তার কল্পনার বাইরে ছিলো এমন কাজ!
– তুই শেষে নিজের চাচীর সাথে…? ছিহ্।
তির্থ শোনামাত্র রেগে যায়। কপালে ভাজ পড়ে,
– তাতে তোর কি?
তূর তির্থের মাথায় এক থাপ্পড় মারে। বলে,
– হারামজাদা! তুই আবার মুখে মুখে এসব বলছিস? ‘
– তো তোর কি হইসে সেটা বল!
– কি হইসে মানে? তনু নিজে সবটা দেখেছে ও শুনেছে!
– ছাড় বলছি!
তূর ছেরে জোরে জোরে থাপ্পড় মারে তির্থকে। তির্থ বিছানায় পড়ে যায়। চিৎকার দিয়ে বলে,
– আর একটা মেরে দেখ, তোর সব কুকিত্তি গুলো তনু ভাবিকে বলে দিবো। তুই কি করবি ওর সাথে। কেন তাকেই বিয়ে করা হলো সব বলে দিবো! ‘
মূহুর্তে তূর দমে যায়। তির্থ হেঁসে পালঙ্ক থেকে ওঠে। আয়নার সামনে দাড়িয়ে প্রতিফলিত তূরের দিশেহারা চাউনি দেখে দাঁত বের করে হাসে তির্থ। পাঞ্জাবির গলা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,
– আমার কাজে বাধা হওয়ার চেষ্টা করিস না। করবি তো তোর আর আব্বার নতুন ব্যাবসার কথা পুরো মোড়লপাড়া জানবে। আব্বা কিসব চাল ডাল দান করে না? সেদিন সব ভুলে সবাই জুতো পেটা করবে! ‘
– তুই ও তো জড়িত!
তির্থ হেসে তূরের দিকে এগোয়। তূরের গালে আলতো চড় দিয়ে বলে,
– আমায় ইশয়াখ বাঁচাবে ভাই! আমার বউকে আমি যথাসময়ে পেশ করেছি তার কাছে। তুইতো এখনো পারিসই নি। তাই তোরা বাপ ব্যাটা মরলে ইশয়াখ দেখতেও আসবে না। আগে যে কতগুলো ছেলের প্রান নিয়েছিস তা শুধু তুই আর ওই বুড়ো মোড়লই জানে! ‘
তির্থ বাইরে হাটা ধরে। দিশেহারা লাগছে তূরের কাছে। চারপাশ আশ্চর্য ভাবে ঘুরছে তার। নিজের গলা চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ে তূর। তির্থ বাইরে এসে একপলক তাকায় তূরের দিকে। এই ভাইকেই তার দু চোক্ষে দেখতে ইচ্ছে করে না। ছোট থেকে পড়াশোনা থেকে শুধু করে সব সুযোগ সুবিধা পেয়েছে তূর। এমনকি বিদেশে ব্যাবসা গড়ে তুলেছে। হাহ্! এক পা এগিয়ে আবার তূরকে বলে তির্থ,
– ঘরে আবার কিছু চুরি-টুরি করিস না। তারাতাড়ি বের হ! ‘
বলে চলে যায় তির্থ। তূর ছুটে বাইরে আসে। চলে গেছে তির্থ! দরজার পর্দা জড়িয়ে চোখ বুজে নেয় তূর!
সিঁড়ি বেয়ে ধির পায়ে নামছে তনু। সে ঠিক করেছে এখন থেকে সবার মতন কাজ করবে। তাকে কেন কেউ ডাকে না? কাল তো রিমি আখতার পাশের ঘর থেকে চম্পাকে ডেকে নিয়ে গেল। তাহলে তনুকে একবারও ডাকলো না কেন?
তনু রান্না ঘরে চলে যায়। কেউ নেই! গরম ভাপ উঠা ভাত,তরকারি চুলোয়। তারমানে রান্না শেষ! সে দেড়ি করে ফেলেছে।তনু অন্দরঘরের পাশেই গুদাম ঘরে চলে যায়। সেখান থেকে কিছু ঝাড়ার আওয়াজ আসছে। সকল বৌ চাল ঝাড়ছে। মেঝেতে চাল ডালা। রিমি আখতার চাল থেকে ধান বাঁচছে। তনু ভেতরে যায়। তনুকে দেখেই রিমি চেঁচান,
– এহেনে আসছো ক্যান?
– কাম করোনের লাগি!
– লাগতো না!
কাজে মন দেওয়ার ভান ধরে রিমি। আড়চোখে একবার তনুকে দেখে,
– আয়ো। আমার সাথে ধান বাছো!
তনু সকলের সাথে বসে পড়ে। অনেক্ষণ রিমি সহ সকলের সাথে কাজ করে তনু। এ বাড়িতে বৌদের শাড়ি এমন ভাবে পড়তে হয় যেন পেটের কোন অংশই দেখা না যায়। অথচ বাড়ির বৌদেরই তারা শিকার করে বাজে ভাবে। তনুর হঠাৎ চোখ পড়ে টগরের কোমরে। বাম কমরের একটু উপরে বেশ খানিকটা কাটার দাগ!
___________
– তুই যাবি। আর হ্যা, ওই মহিলা যেন কিছুতেই বাঁচতে না পারে। আজিদ তুমি কি কও? ‘
ইশয়াখ ঘেঁটুর দলবল সহ প্রশ্ন ছুড়লেন আজিদকেও। আজিদের সামনে টাকা। দু বান্ডিল একশো একশো নোটের টাকা। আজিদ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
– মারুক ওরে। আমার কি?
ঘেঁটু বলে,
– কিন্তু ভাইজান আপনার বইনরে মারবো?
– আমার পথের কাটাতো আমার ভাইও হইছিলো। যে ছেলেটা আমায় পালন করলো তাকে মারতে হাত কাঁপলো না আর তো বইন। যা বলছি কর গিয়া। ‘
আজিদ টাকার উত্তেজনায় জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়ে। নিজের স্ত্রীকে মারতেও পিছু হটবে না সে। ঘেঁটুরা চলে যায় লতিফার বাড়ি উদ্দেশ্যে। ইশয়াখ টাকা পরে দিবেন বলে পাঠিয়ে দেয় আজিদকে। মন খারাপ নিয়ে রাতের অন্ধকার আচ্ছন্ন পথে হাঁটা ধরে আজিদ। কিছুটা সচল হয় মস্তিষ্ক! মনে পরে লতিফার কথা। বুক ফেঁপে ওঠে আজিদের। সাংসারিক জিবন তাদের কম হলেও উনত্রিশ বছর। কতই না সেবা করেছে লতিফা। জটালো মস্তিষ্ক পুরো সচল হতেই বুক হু হু করে ওঠে আজিদের। স্নেহ মমতা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। আজিদ ছুট লাগায়। ততক্ষনে পৌছে যায় ঘেঁটুর দল। লতিফা ঘরে ঘুমাচ্ছে। ঘেঁটুর দলবল শুরু করে তান্ডব লীলা। আজিদ পারবে তো নিজের সহধর্মিণীকে বাঁচাতে?
#চলবে…