ডুমুরের ফুল ২৩.

0
1937

ডুমুরের ফুল ২৩.

মনোজ সাহেব নষ্ট মোবাইল হাতে নিয়ে বায়তুল আমানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। অফিস আজকে আর যাওয়া হবেনা তার। ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের জন্য পেয়ারা নিলেন দুই কেজি আর শ্বাশুড়ির জন্য কমলা আর আপেল নিলেন। মেয়েটা প্রচুর পরিমাণে পেয়ারা পছন্দ করে। পুরোপুরি মায়ের মতো। দোলা তো দিনে এক কেজির উপরে পেয়ারা খেয়ে ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিতো। পেয়ারা বেশি খাওয়ার সাইড ইফেক্ট হিসেবে প্রথমে পেটে ব্যথা তারপর পেট খারাপ।
লাইলী বানু ফ্রিজ থেকে মাছ বের করছিলেন। দরজায় কলিং বেল বাজাতে বেশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতে গেলেন।
অসময়ে মানুষের আনাগোনা বেরে যায়। এদিকে হেমলতার ভাবসাবও তার কাছে ভালো ঠেকছে না। সেই কখন মোবাইল নিয়ে রুম আটকে বসে আছে আর বের হবার নামই নেই।
দরজা খুলে মনোজকে দেখে অবাক হলেন। হাতের প্যাকেট গুলো লাইলী বানু নিয়ে নিলেন। মনোজ ভেতরে ঢুকেই মেয়ের রুমের দিকে গেলেন।
লাইলী বানু প্যাকেট গুলো রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন।
হেমলতা ফ্লোরে বসে পায়ে আলতা পড়ছিলো। দরজায় টোকার শব্দে হেমলতা জিজ্ঞেস করলো
– কে?
মনোজ সাহেব উত্তর দিলেন
– আমি।
হেমলতা আলতার বোতল ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দরজা খুলে দিলো।
মনোজ সাহেব বিছানায় বসে পকেট থেকে মোবাইল বের বললেন
– তোমার ছোটো বোনটা মোবাইলকে গোসল করাইছে।
– কী?
– বাথরুমে বালতি ভরা পানিতে মোবাইল চুবাইছে।
বাবার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে হেমলতা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। অনেক কান্নাকাটি করে এই মোবাইলটা নানীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনেছিলো।
সবার হাতেই দামী এন্ড্রয়েড মোবাইল আর তার হাতে বাটন মোবাইল।
নানী তাকে আর মোবাইল কিনে দিবে না। জাদিদকে সে কী বলবে? জাদিদ যদি মোবাইল পাঠিয়ে দেয় তখন নানীকে কী বলবে সে?
ভয়ে আর চিন্তায় হেমলতার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে।
– চিন্তা করিসনা আমি মোবাইল কিনে দিবো।
– কবে দিবা?
– আজকেই দিবো। তোর নানীর সাথে দেখা করে তারপর যাবো।
হেমলতাকে রুমে রেখে মনোজ ড্রয়িংরুমে গেলো। টিভি ছেড়ে দিয়ে ছোফায় আরাম করে বসলেন।
আজ আরাম করে টিভি দেখা যাবে। বাসায় আরাম করে টিভি দেখার সুযোগই নেই।
মিসেস জয়নাবের ঘুম ভেঙলো লাইলীর বানুর ডাকে।
চুল খোঁপা করে মিসেস জয়নাব বললেন
– ঘুম থেকে কেউ এভাবে ডেকে তোলে?
– জামাই আইছে, কী রান্না করবো?
– মনোজ আসলো কখন?
– আইছে মিনিট খানিক হবে।
– ইলিশ মাছ মেথি দিয়ে রান্না করো। মসুর ডাল মাখামাখা করে রান্না করবা।
– ভাজি টাজি কিছু করতে হইবো?
– যদি পারো করো।
– এখন কি চা খাবেন?
– তিন কাপ চা করো।
মিসেস জয়নাব বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে হাত মুখ ধোয়ার জন্য গেলেন।
চোখ জ্বালা করছে তার, অর্ধেক ঘুম ভাঙার জন্য।
জাদিদ তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভুল রুমে ঢুকে পড়েছিলো। সেখানে ক্লাস এইটের ইংরেজি ক্লাস নিচ্ছিলেন অল্প বয়সী একজন ছেলে। অনার্স পড়ুয়া স্টুডেন্ট হবে। ক্লাসের মেয়েরা জাদিদের দিকে হা করে করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করলো।
কয়েকজন তো হাসতেই লাগলো। জাদিদ দ্রুত সেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
তিনতলার ডান পাশের রুমে যাওয়ার কথা আর সে দোতলার ডান পাশের রুমে এসে হাজির হয়েছে।
কোনোরকমে মাঝের দিকে একটা সিট খালি পেয়ে বসে পড়লো জাদিদ। এতো স্টুডেন্ট হবে তার জানা ছিলোনা। জানা থাকলে দশ পনেরো মিনিট আগে আসলেই সামনের বেঞ্চে সিট পেয়ে যেতো। মেয়েরা বসেছে ডান সারির বেঞ্চ গুলোতে আর ছেলেরা বাম সারির। হেমলতার কথাটা সে মানতে পেরেছে শেষ পর্যন্ত।
জাদিদের পাশের ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো
– তুমি কোন কলেজ থেকে এসেছো?
বেশ গম্ভীর মুখের ছেলেটার সাথে কথা বলার তার কোনো ইচ্ছাই নেই। তারপরও সে সংক্ষিপ্তে উত্তর দিলো
– সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।
– আমি রেসিডেন্সিয়াল থেকে।
– হুম।
এখন কথা বলার কোনো ইচ্ছাই তার নেই।
মনে অনেক প্রশ্ন জাগা সত্ত্বেও সে নিজেকে দমিয়ে রাখলো।

ড্রয়িংরুমে তিন জনে চা খাওয়ার পর্ব শেষ করে হেমলতার পড়াশোনার বিষয়ে কথা উঠালো মনোজ।
মনোজ তার শ্বাশুড়িকে বললেন
– আমার তো ইচ্ছা ছিলো হেমলতাকে ঢাকায় কোচিং সেন্টারে পাঠানোর কিন্তু ওর অসুস্থতা আর আপনার অসুস্থতায় ওকে পাঠানো হলো না।
মিসেস জয়নাব নীরস কণ্ঠে বললেন
– মেয়ে মানুষের অতো ঢাকা ঢুকায় কোচিং করার কোনো দরকার নেই।
এমন উত্তর মনোজ সাহেব আশা করেননি।
– তাহলে এখানে ভর্তি করাই?
– কোচিং করিয়ে করবাটা কী?
– ইউনিভার্সিটি এডমিশন টেস্টে কোচিং করা ছাড়া তো চান্স পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
– কোনো ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করা লাগবেনা ওর। এখানে রাজেন্দ্র কলেজ আছে, অনেক ভালো কলেজ। এখানেই ও পড়বে।
– কিন্তু আম্মা কোথায় ইউনিভার্সিটি আর কোথায় রাজেন্দ্র কলেজ।
হেমলতাও আনন্দের সাথেই বললো
– হ্যাঁ নানী, এটা তো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। যেহেতু আমার সুযোগ আছে হাতে সেহেতু…..
মিসেস জয়নাব ধমকে উঠে বললেন
– আমার এখানে থাকতে হলে আমার রুলস মানতে হবে।
মনোজ আর কথা বলার সাহস পেলেন না। হেমলতা ভয়ে কুঁকড়ে গেলো। বাবার কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য মনে আশা জমেছিলো, ঢাবিতে তার না হোক, জগন্নাথে হলেও জাদিদের কাছাকাছি থাকা যেতো। দুজনে একই ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করার আনন্দটাই আলাদা।
ড্রয়িংরুম ছেড়ে নিজের রুমে চলে এলো হেমলতা।
হঠাৎ করে তার মন খারাপ হয়ে গেলো। আজ যদি মা থাকতেন তাহলে হয়তোবা তার স্বপ্নটা অপূর্ণ থাকতো না।

ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শেষে হাতে রজনীগন্ধার স্টিক নিয়ে গ্রুপ ছবি তুলে কেবল রাস্তায় এসে দাঁড়ালো তখন পাশ থেকে একটা মেয়ে জাদিদের উদ্দেশ্যে বললো
– তোমার নামটা যেন কী?
জাদিদ শান্তস্বরে বললো
– জাদিদ।
মেয়েটা নিজ থেকেই বললো
– আমার নাম শাম্মী। তুমি কোন কলেজ থেকে এসেছো?
– সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ।
– আমি ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে।
– হুম।
– তোমার সেল নাম্বারটা দাও তো।
জাদিদ ভূত দেখার মতো করে তাকিয়ে বললো
– কেনো?
– কোচিং-এ একজনের সাথে ভালো সম্পর্ক, যোগাযোগ রাখতে হয়। এতে করে দুজনেরই উপকার হয়। কোনো কারণে আমি কোচিং-এ আসতে না পারলে তোমার কাছ থেকে আপডেট নেয়া যাবে।
– তাই বলে আমি কেনো?
– কারণ তোমাকে আমার বিশ্বস্ত মনে হয়েছে।
– সেল নাম্বার এক শর্তে দেয়া যাবে।
– একটা নাম্বাদের জন্য আবার শর্ত জুড়ে খুব দরকার।
– অবশ্যই।
– তাহলে বলো কী শর্ত?
– প্রয়োজন ছাড়া কখনো ফোন বা ম্যাসেজ করা যাবেনা।
– আমি প্রয়োজনের জন্যই নাম্বার নিচ্ছি। আমারও আজাইরা সময় নাই যে আপনাকে দিন রাত ভরে ফোন দিবো।
জাদিদ সেল নাম্বার দিয়ে চলে গেলো। শাম্মী নাম্বার সেভ করে আপন মনেই হেসে উঠলো। ছেলেটা অতি মাত্রায় ভদ্র। আর চুলগুলো অসম্ভব সুন্দর।
শাম্মী জাদিদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। যখন সে দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে গেলো তখন শাম্মী নিজের বাসার দিকে পা বাড়ালো।
জাদিদ বাসায় এসে গোসল সেরে নিলো। রুটিন টেবিলের সামনের দেয়ালে ঝুলিয়ে দিলো।
ফ্রিজের খাবার বের করে রেখে। খাতা কলম নিয়ে বসলো। নিজের জন্য সুন্দর একটা রুটিন বানাতে হবে।
পেটে হালকা ব্যথা অনুভব করছে জাদিদ। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের মিষ্টি তার খাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিলোনা। পাশের ছেলেটার জোরাজোরিতে খেতে হলো। এখন পেটের মধ্যে কেমন লাগছে। উফফ…

দুপুরে মনোজ চলে গেলেন। শ্বাশুড়ির এক ধমকেই তিনি চুপ হয়ে গেছেন। হেমলতাকে মোবাইল কিনে দেয়ার কথা ছিলো সেটাও তিনি সাহস করে আর বলেননি। হেমলতা দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ক্ষণিকের জন্য তৈরি করা স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কষ্টে।
হেমলতার ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যায়। জাদিদের সাথে কথা বলতে পারলে হয়তোবা মন খারাপটা কমে যেতো। নানীর কাছে মোবাইল চাওয়ার সাহস কেনো যেন পাচ্ছেনা।
জাদিদ মোবাইল হাতে নিয়ে হেমলতার ফোনের অপেক্ষা করছে। সেই সকালে একবার কথা হয়েছিল আর তো ওর খোঁজই নেই। ওর নাম্বারটাও সুইচড অফ বলছে।
হেমলতার নানীর নাম্বারে ফোন দেয়ার সাহস পাচ্ছেনা। এইটুকু কষ্ট সহ্য করতে না পারছেনা সে আর যদি সারাজীবনের জন্য দূরত্ব তৈরি হয়, তখন কীভাবে সহ্য করবে?
মোবাইল টা দূরে সড়িয়ে রেখে জাদিদ বারান্দায় গিয়ে বসলো।
সন্ধ্যা থেকে কীভাবে রাত নামে পৃথিবীর বুকে সেটাই আজকে মনোযোগ দিয়ে দেখবে সে।

চলবে……!

© Maria Kabir

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে