ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৫১+৫২

0
2615

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৫১
#Arshi_Ayat

‘ডাক্তার ইফাজ এটা কিন্তু অনেক রিস্কি!’সিনিয়র সার্জন ডাক্তার সাইদ বললেন।

‘আমি জানি এটা রিস্ক।কিন্তু এছাড়া আর উপায়ও তো দেখছি না।’ও’ নেগেটিভ ব্লাডও পাওয়া যাচ্ছে না আবার পারফেক্ট কিডনি ম্যাচিংও হচ্ছে না।’ইফাজ চিন্তিত মুখে জবাব দিলো।

ইফাজের কথার জবাবে হাসপাতালের সবচেয়ে সিনিয়র সার্জন নিয়াজ বললেন,’না ইফাজ এই ঝুঁকিটা নেওয়া সম্ভব না।তোমার লাইফ রিস্ক আছে।তোমার আর পেশেন্টের রক্তের গ্রুপ সেম আবার তোমাদের কিডনিও ম্যাচ করে কিন্তু কিডনি প্রতিস্থাপন করতে তোমারও কিন্তু রক্তের প্রয়োজন সেক্ষেত্রে যদি তুমি পেশেন্টকে রক্ত দাও তাহলে তোমার লাইফ ৯৯% রিস্কে চলে যায়।বুঝতে পারছো ইফাজ?’

‘বুঝতে পারছি স্যার কিন্তু এই অবস্থায় কি করবো?’ও’ নেগেটিভ রক্তেরও তো জোগাড় হচ্ছে না।রক্তের জোগাড় হলে তো কোনো সমস্যাই হতো না।’ইফাজ কাতর গলায় বলল।

ইফাজের আরেক কলিগ বলল,’ও’নেগেটিভ রক্ত খুব রেয়ার!হাসপাতালে শুধু তোমার আর দারোয়ানের ‘ও’নেগেটিভ রক্ত আছে।তাও দারোয়ানের রক্তে হেপাটাইটিস বি আছে।’

কথাটা শুনেই ইফাজের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো।ইফাজ হুট করেই বলল,’আচ্ছা একটা প্ল্যান আছে আমার কাছে।’

ইফাজের কথা শুনে সবাই আগ্রহী হয়ে চাইলো ওর দিকে।ডাক্তার নিয়াজ বললেন,’কি প্ল্যান ইফাজ?’

‘স্যার ভাবছিলাম কি দারোয়ানের রক্ত যদি আমি নেই আর আমার রক্ত যদি পেশেন্টকে দেই তাহলে কিন্তু কোনো সমস্যা থাকছে না।আর হেপাটাইটিস বি এর ট্রিটমেন্ট তো করা যায়ই।’

ডাক্তার নিয়াজ ধমক দিয়ে বললেন,’ইফাজ তুমি কি পাগল হয়েছো?বুঝতে পারছো কি বলছো?হেপাটাইটিস একবার শরীরে ঢুকতে পারলে কি হবে সেটা তুমিও জানো।তাহলে এমন অবুঝের মতো কথা বলছো কেনো?’

‘স্যার কিন্তু….’
ইফাজের কথা শেষ করতে না দিয়েই ডাক্তার নিয়াজ বললেন,’কোনো কিন্তু না ইফাজ।আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো কিন্তু তোমাকে রিস্কে ফেলতে পারবো না।একজনকে মেরে আরেকজনকে বাঁচানোর কথা কোনো জায়গায়ই নেই।’
ডাক্তার নিয়াজের কথায় সবাই সায় দিলো।অতঃপর কোনো সিদ্ধান্তে না পৌঁছাতে পেরে মিটিং এখানেই সমাপ্ত হলো।

ইফাজ মধুর অপারেশন এর বিষয়ে কথা বলতে একটা ইমিডিয়েট মিটিং অ্যারেঞ্জ করেছিলো।যেখানে হাসপাতালের কয়েকজন সিনিয়র সার্জন থাকবেন।মিটিং শেষে ইফাজ একবার মধুর কেবিনে গেলো।মধু ঘুমিয়ে আছে।ওর পাশে আইরিন রহমান আর মিলি বসে আছে।সাইদা খান আর ইয়াফ খান একবার দেখে চলে গেছেন বাসায়।ইরিন গেছে নিহাদের বাসায়।নিহা নাকি আসবে।তাই ওকে আনতে গেছে।এদিকে ইয়াদ হন্যে হয়ে ছুটছে রক্ত আর কিডনির জন্য।বেশ কয়েকটা ব্লাড ব্যাঙ্কেও খোজ করা হয়েছে।কিন্তু রক্ত মিলছে না।মিললেও হয় রক্তে নিকোটিনের পরিমাণ বেশি নয়তো এইচআইভি অথবা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত!অবশ্য ভালো রক্ত খুব কমই পাওয়া যায় ব্লাড ব্যাঙ্কে।কারণ ওখানে যারা ব্লাড বিক্রি করে ওদের মধ্যে অনেকেই নেশার টাকা জোগাড় করার জন্যই বিক্রি করে।

ইফাজ মধুর পালস’টা আবার চেক করলো।খুব ধীর গতিতে চলছে!যেনো মনে হচ্ছে শুধু জানটাই আটকে আছে!সারা শরীর নিথর হয়ে আছে!অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল।কালকের মধ্যেই অপারেশন করতে হবে।কিন্তু সবকিছু থেমে আছে দু’টো জিনিসের জন্য।ইফাজ কিছুক্ষণ অনিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার না হওয়া প্রিয়তমার দিকে যাকে ধরা ছোয়া যাবে না শুধু দূর থেকে ভালোবাসা যাবে।তবুও এতোদিন তো দূর থেকে ভালোবেসেই তো ভালো ছিলো সে কিন্তু নিয়তি যদি পৈচাশিক কোনো খেলায় মেতে উঠে!যদি ছিনিয়ে নেয়!তাহলে?আর ভাবতে পারলো না ইফাজ।চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরার আগেই মুছে বেরিয়ে গেলো।কিন্তু দরজার সামনে আসতেই নিহা আর ইরিনের মুখোমুখি হলো।নিহা উদ্বিগ্ন গলায় বলল,’কি অবস্থা ওর?’

‘ভালো না।ঘুমিয়ে আছে।কালকের মধ্যেই অপারেশন লাগবে।’

‘আমি একটু দেখে আসি?’নিহা অনুমতি চাইলো।’

‘যাও।’
অনুমতি পেতেই নিহা আর ইরিন কেবিনে গেলো আর ইফাজ ল্যাবে গেলো নতুন কয়েকজনের রক্তের রিপোর্ট দেখতে।
—————–
রাত ১০ টা…
ইয়াদ হাসপাতালে ফিরেছে।খুব ক্লান্ত লাগছে।অনেক জায়গায় ঘুরেছে কিন্তু আশানুরূপ কিছু পাওয়া যায় নি।হাসপাতালে ফিরে ভাইয়ের চেম্বারে গিয়ে বসলো।ইফাজ চিন্তিত মুখে বলল,’কি রে রক্তের কি খবর?’

ইয়াদ হতাশ গলায় বলল,’হয় নি।’

ইফাজ ভরসা দিয়ে বলল,’চিন্তা করিস না।কালকের মধ্যেই কিছু একটা হবে।কিচ্ছু হবে না মধুর।’

ইয়াদ মাথা নাড়লো।কিন্তু কথা বলল না।কি বলবে?কষ্টে মুখ দিয়ে কথাও বের হচ্ছে না।এতো কঠিন পরীক্ষা কি না দিলে হতো না?

ভাইয়ের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ইয়াদ মধুর কেবিনে চলে এলো।কেবিনে এখন কেউ নেই আইরিন রহমান আর মিলিকে ইফাজ বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন জোর করে আর ইরিনও নিহাকে নিয়ে বাসায় চলে গেলো।তবে ইয়াদ,ইফাজ কেউই যাবে না।

সন্তপর্ণে বেডের কাছ থেকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলো ইয়াদ।পরম আদরে প্রিয়তমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।কয়েকদিনেই চেহারাটা শুকিয়ে গেছে!মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে।মধু আস্তে আস্তে চোখ খুললো।ইয়াদকে দেখে অক্সিজেন মাস্কটাও খুললো।তারপর ও হাতটা ধরে বলল,’ইয়াদ কি হয়েছে আমার?’

মধুর প্রশ্নটা শুনে এমুহূর্তে মন চাচ্ছে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে।কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে কষ্ট করে একটু হেসে বলল,’কিচ্ছু হয় নি তো!একটু শরীর দুর্বল তোমার।ঠিক হয়ে যাবে।’

মধু মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বলল,’যদি সত্যিই তোমার কথাই সত্যি হতো!’এটা ভেবেই মধু দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো।মধু আগেই জানতো!কিন্তু ইয়াদকে বলে নি।ওই বাড়ির প্রতি একটা অভিমান জমে গিয়েছিলো ওর!

তারপর কথা ঘুরিয়ে বলল,’খেয়েছো তুমি?’

‘না।’

‘যাও খেয়ে আসো।’

‘না মধু আজ খেতে ভালো লাগছে না।’

মধু কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’না খেলে কিন্তু আমি ভালো হবো না,তোমার সাথে কথাও বলবো না।’

মধুর এই বাচ্চামি কথাগুলো শুনে ইয়াদ মলিন হাসলো।এখন সুস্থ থাকলে সময়টা অন্যরকম হতে পারতো!মধুর কথা রাখতেই ইয়াদ খাবার আনতে বাইরে গেলো।এমনিতে গলা দিয়ে নামবে না খাবার কিন্তু এখন মধুর জন্য কিছু হলেও খেতে হবে।

খেয়ে এসে দেখলো মধু ঘুমিয়ে গেছে।ইয়াদ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ওর দিকে।তারপর বেডের পাশের চেয়ারে বসে ঘুমন্ত মধুর হাতটা শক্ত করে ধরে বসে রইলো।একটা সময় ইয়াদের ঘুম চলে আসলে সেও ঘুমিয়ে গেলো।
————-
একজন নার্সের ডাকে ইয়াদের ঘুম ভেঙে গেলো।ইয়াদ ঘুম থেকে উঠে বসলো।মধুর এখনো ঘুম ভাঙেনি।ইয়াদ নার্সকে স্যালাইন লাগানোর সুযোগ করে দিয়ে বাইরে চলে গেলো।চেম্বারে আসতেই দেখলো ইফাজ কি একটা রিপোর্ট খুব গুরুত্ব নিয়ে দেখছে।ইয়াদকে দেখে সহাস্যে বলল,’খুব ভালো খবর আছে ইয়াদ।চারজন ভলেন্টিয়ার পাওয়া গেছে।ওনাদের ব্লাড গ্রুপ ‘ও’ নেগেটিভ।ওনারা রক্ত দিবেন বলেছেন।’

‘রক্তের জোগাড় তো হয়েছে।কিন্তু কিডনি?’

‘কিডনির ব্যবস্থাও হয়েছে।একজন দিবে বলেছে।তবে নাম পরিচয় অজ্ঞাত রেখেছে।’

‘কিন্তু ওনার কিডনিতে যদি কোনো সমস্যা থাকে।’

‘আমরা চেকআপ করেছি।উনি সম্পূর্ণ সুস্থ।’

‘আচ্ছা তাহলে অপারেশন কবে হবে?’

‘আজ দুপুরেই কিন্তু আমি থাকতে পারবো না রে।’

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,’কেনো ভাইয়া?’

‘আমাকে ইমিডিয়েট লন্ডন যেতে হবে।কল এসেছে।আজ দুপুরেই ফ্লাইট।’

ইয়াদ কাতর স্বরে বলল,’প্লিজ। ভাইয়া প্লিজ।এই সময়টা তোমাকে আমাদের খুব প্রয়োজন।যেও না প্লিজ।’

‘আমি জানি কিন্তু সম্ভব না ইয়াদ।তবে আমি সবকিছুর অ্যারেঞ্জ করেছি।মধুর অপারেশন অনেক সিনিয়র সার্জন করবেন।ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই।’ইফাজ ইয়াদের কাঁধে ভরসার হাত রেখে বলল।

‘কে অপারেশন করছে আমি জানি না।কিন্তু তোমাকে থাকতেই হবে ভাইয়া।’

‘না রে। আমি পারবো না।’
এতোবার অনুরোধ করার পরেও ইফাজের বারবার ‘না’ করার কারণে ইয়াদের প্রচন্ড মেজাজ গরম হয়ে গেলো।ও রেগে বলল,’কেমন ভাই তুমি?যে ভাইয়ের বিপদে পাশে থাকতে পারবে না?যদি আজকে তুমি না থাকো তাহলে তুমি আমার ভাই না।’

এটা বলেই ইয়াদ চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলো।ইয়াদের যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো ইফাজ।মনে মনে বলল,’আমার কিচ্ছু করার নেই রে।সত্যিই কিচ্ছু করার নেই।’

আসলে কিডনিটা ইফাজই দিবে।তবে নাম পরিচয় গোপন রেখে।এইজন্যই এই মিথ্যাটা বলতে হলো।যদি সরাসরি দিতো তাহলে নিহা মানতে পারতো না।আবার সবাই জেনে যেতো যা ইফাজ চায় না।ও চায় ওর ভালোবাসার কথা কেউ না জানুক।ডুবে ডুবেই ভালোবাসতে চায় সারাজীবন।

সবকিছু রেডি হচ্ছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই মধুকে ওটিতে নেওয়া হবে।এদিকে ইফাজও ফ্লাইটের জন্য বেরিয়ে গেছে।ওর সাথে নিহা আসতে চেয়েছিলো কিন্তু ইফাজ মানা করে কারণ আসলেই ধরা পড়ে যাবে।যাওয়ার সময় সবাই টুকটাক কথা বলেও ইয়াদ একটা কথাও বলে নি।ইফাজও কিছু বলে নি।

মধুর সাথে একে একে সবাই দেখা করছে।আরিয়াও এসেছে।কাল ওকে কেউই খবর দেয় নি।পরে ইয়াদকে ফোন করে জানতে পেরে ছুটে চলে এসেছিলো।সবাই দেখা করলেও সাইদা খান দেখা করেন নি।সবার সাথে দেখা হওয়ার পর ইয়াদ গেলো কেবিনে।কেউ নেই এখন।শুধু ওর দু’জন।দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক।ইয়াদ মধুর হাতটা ধরে বলল,’আমি আছি মধু।একদম ভয় পাবে না।তোমার কিচ্ছু হবে না।সাহস রাখো।তোমাকে ফিরতেই হবে।তুমি ফিরলে ওই কথাটা বলবো।’

‘কোন কথাটা?’মধু ধীর কন্ঠে জিগ্যেস করলো।

‘যেটা তুমি বারবার শুনতে চেয়েছিলে কিন্তু আমি বলি নি।’

মধু মলিন হাসলো।ইয়াদ আবার বলল,’ফিরবে তো?’

‘ফিরবো।’মৃদু হেসে দৃঢ় কন্ঠে বলল।

একটু পরই মধুকে ওটিতে নেওয়া হলো।পাশাপাশি দু’টি বেড।একটিতে মধু,আরেকটিতে ইফাজ!

চলবে…

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৫২
#Arshi_Ayat

মধুকে এনেস্থিসিয়া দিয়া অজ্ঞান করা হয়েছে।তারপর ইফাজকে এনেস্থিসিয়া দেওয়া হয়েছে।জ্ঞান হারানোর পূর্বে একবার নিজের পুরো পরিবার আর মধুর কথা মনে করলো তারপর কালেমা পড়তে পড়তে জ্ঞান হারালো।

ভেতরে অপারেশন চলছে আর বাইরে ইয়াদ কখনো চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে তো কখনো সাইডে পাতানো বেঞ্চে বসছে।ওর অস্থিরতা চোখে পড়ার মতো।সবাই বুঝতে পারছে ভেতরে ভেতরে কি চলছে ওর।মধুর মা আর বোনও হাসপাতালের বাইরে বসে আছে।ইরিন একটু আগে বাসায় গেছে আবার আসবে।নিহাকে নিয়ে সাইদা খান আর ইয়াফ খান বাসায় চলে গেছেন।

প্রায় তিনঘণ্টা পর ডাক্তার নিয়াজ অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হলেন।উনি বের হওয়ার সাথে সাথেই ওনাকে দ্রুত ঘিরে ধরলো ইয়াদ।উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,’ডাক্তার অপারেশন কেমন হয়েছে?সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?’

ডাক্তার নিয়াজ আস্বস্ত করে বললেন,’অপারেশন সাকসেসফুল মিস্টার ইয়াদ।কিন্তু ২৪ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরলে বোঝা যাবে বাকিটা।চিন্তা করবেন না।ওনার জন্য দোয়া করুন।’

‘ওকে একবার দেখে আসা যাবে?’ইয়াদের কন্ঠে অনুরোধ।

‘এখন না।জ্ঞান ফেরার পর আমরা বেডে শিফট করার পর দেখতে পারবেন।’

এগুলো বলেই ডাক্তার নিয়াজ চলে গেলেন।এদিকে অপারেশন এখানে হলেও সবার আড়ালে ইফাজকে অন্য হাসপাতালের আইসিইউতে হস্তান্তর করা হয়েছে।অবশ্য সব ইফাজের ইচ্ছাতেই হয়েছে।
———-
মধুর জ্ঞান ফিরেছে ১২ ঘন্টা পর।ওকে এখন বেডে দেওয়া হয়েছে।সবার আগে ইয়াদ গেলো দেখা করতে।মধুর মুখে অক্সিজেন মাস্ক।ও খুলতে চাইলে ইয়াদ বাঁধা দিয়ে বলল,’কথা বলো না।জমিয়ে রাখো।একটা সুন্দর পূর্ণিমায় আমার কাঁধে মাথা রেখে বলবে।আমি সেদিন তোমার প্রেমিক স্বামী হয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনবো।কিন্তু এখন না!সুস্থ হয়ে নাও তারপর।’

আরো কিছুক্ষণ মধুর সাথে কথা বলে ইয়াদ বের হয়ে আসলো।এরপর একে একে ওর মা,বোন,ইরিন গেলেন।সবার শেষে ইয়াফ খানকে ঢুকতে দেখে উপস্থিত সবাই একটু আঁড়চোখে চাইলো।ইয়াফ খান কেবিনে প্রবেশ করে সন্তপর্ণে মধুর বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসলো।তারপর ধীরে ধীরে মধুর মাথায় হাত রাখলো।কারো হাতের গভীর ছোঁয়া পেয়ে মধু চোখ খুলে তাকালো।ধীরে ধীরে হাতের মালিকের দিকে চাইলো।ইয়াফ খানকে দেখে মাক্স খুলতে চাইলে উনিও মধুকে থামিয়ে দিলেন।স্নেহময় গলায় বললেন,’থাক মা।কথা বলতে হবে না।বিশ্রাম নাও।বাড়ি ফিরেও কথা বলা যাবে।’

শ্বশুরের কথায় মধু আর মাস্ক খুললো না।আজকে কেউই ওকে কথা বলতে দিচ্ছে না।তবে শ্বশুরের এমন অপ্রত্যাশিত স্নেহময় আচরণে শত কষ্টের মধ্যেও ভালো লাগছে মধুর।ইয়াফ খান কিছুক্ষণ মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।মধু চোখ বন্ধ করে নিজের বাবার কথা মনে করতে লাগলো।সে থাকলে নিশ্চয়ই এভাবেই আদর করতো।

কেবিনের বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে ইরিন আর ইয়াদ দুজনেই এই দৃশ্যটা দেখে শান্তি পেলো।ইরিন ফিসফিস করে বলল,’বাবা মনে হয় মেনে নিয়েছে।এখন মা মানলেই হয়।’

ইয়াদও সমস্বরে উত্তর দিলো,’সমস্যা নেই।মা ও মেনে যাবে।তবে এই ভেবে শান্তি লাগলো যে বাবা সহজেই মেনেছে।’

‘হুম।ঠিক বলছো।’
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভাই বোন দুজনেরই কথোপকথন চলতে লাগলো।
————-
ইফাজের জ্ঞান ফিরেছে পনেরো ঘন্টা পর।জ্ঞান ফেরার পর ওকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে।নার্সরা সর্বাধিক তত্ত্বাবধানে রেখেছে।ইফাজ নিজের ফোনটা চেয়ে নিয়ে নিহাকে আর বাবা মাকে মেসেজ দিয়ে দিলো।এখন ফোনে কথা বললে ধরা পড়ে যাওয়া নিশ্চিত।তাই মেসেজ করতে হলো।সুস্থ হওয়া পর্যন্ত ওদের সাথে কথা বলা যাবে না।কিন্তু মনটা বড় ছটফট করছে মধুর জ্ঞান ফিরেছে কিনা জানার জন্য।এখন কেমন আছে?সবকিছু জানার জন্য কেবল অস্থির হয়ে পড়েছে ইফাজ।তাই একজন নার্সকে ডেকে বলল,’আপনি কি একটু ডাক্তার আশরাফকে ডেকে দিতে পারবেন?’

‘জ্বি,অবশ্যই।’নার্স ডাক্তার আশরাফকে ডাকতে বেরিয়ে গেলেন।ডাক্তার আশরাফ ইফাজের ব্যাচমেট।একসাথেই পড়াশোনা করেছে।তারপর দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত।তবে হাসপাতালদ্বয় এক কিলোমিটারের মধ্যেই।মাঝেমধ্যেই দেখা হয়,সৌজন্যমূলক কথাও হয়।আজকে ডাক্তার আশফাকের সার্বিক তত্ত্বাবধানেই আছে ইফাজ।আর এখন ওকে ডাকার কারণ হলো ওকে দিয়েই ডাক্তার নিয়াজকে ফোন দিয়ে মধুর খবর জানবে।অবশ্য ফোন নিজেই দিতে পারতো কিন্তু ধমক খাওয়ার ভয়ে দেন নি কেননা উনি ইফাজকে কোনো এক অজানা কারণে একটু বেশিই ভালোবাসেন।আর এখন ইফাজ ফোন দিলে কিছু তো বলবেনই না উল্টো রাম ধমক খাওয়ার সম্ভবনা একশোতে একশো।

পাঁচমিনিটের মধ্যেই ডাক্তার আশরাফ কেবিনে পৌঁছালো।উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,’এনি থিং রং ইফাজ?’

‘না না।তেমন কিছু না।তুমি একটু নিয়াজ স্যারকে ফোন দিয়ে জানতে পারবে রোগীর কি অবস্থা?’

‘হ্যাঁ জেনেছি আমি।একটু আগেই স্যার আমাকে ফোন দিয়ে বলেছেন রোগী সুস্থ আছে।জ্ঞান ফিরেছে।কেবিনে দেওয়া হয়েছে।’

‘ওহ!অনেক ধন্যবাদ।’
আশরাফ সৌজন্য হেসে বলল,’আচ্ছা।তবে তুমি বিশ্রাম করো।কোনো সমস্যা হলে আমায় ডাকবে।’

‘আচ্ছা।’
তারপর আশরাফ চলে গেলো।আর ইফাজ নিশ্চিন্ত মনে চোখ বুঝলো।যাক মধু ভালো আছে!
————
একসপ্তাহ পর মধুকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে।এখন মোটামুটি কাটা জায়গা শুকিয়েছে তবে ঔষধ কন্টিনিউ করতে হবে আর ভারি কাজ করা যাবে না একদম বেড রেস্টে থাকতে হবে।একমাস পর এসে সেলেই কাটাতে হবে।হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাওয়ার পর ইয়াফ খান নিজেই মধুকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন।এতে সাইদা খান কিছু না বললেও মনে হলো না এই ব্যাপারে তিনি খুশী।কিন্তু এই অবস্থায় কোনো কথা বলাটা বোকামি তাই কিছুই বললেন না।সবাই মিলে মধুকে বাসায় নিয়ে এলো।বাসার সামনে এসে মধুকে কোলে করে নিজের বেডরুম পর্যন্ত নিয়ে আসলো ইয়াদ।পিছনে বাকিরাও ছিলো।সবাই কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলো।ইয়াফ খান আইরিন রহমানকে বলেছিলেন মধুর কাছে থাকতে কিন্তু উনি থাকেন নি।মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থাকতে কেমন একটা লজ্জা লাগে।তবে না থাকলেও প্রতিদিনই আসবেন মেয়েকে দেখতে।

ইয়াদের বাসায় মধুর সেবা যত্নের তেমন কোনো ত্রুটি হয় না।ইয়াদ যখন ভার্সিটিতে যায় তখন মধু ঘরেই থাকে।কখনো একা একা গান শোনে আবার কখনো শ্বশুরের সাথে গল্প করে।এই কয়দিনে শ্বশুরের সাথে অনেকটাই ভালো সম্পর্ক হয়েছে মধুর।তবে শ্বাশুড়িকে একবারের জন্যেও আসতে দেখে নি।এই নিয়ে মধুর মন খারাপ হলেও কিছু বলে না।মাঝে মাঝে ইরিন আর নিহাও আসে।নিহার সাথেও এই কয়দিনে মোটামুটি কথা হয়েছে।আগে তেমন কথা হয় নি।আর ইয়াদ ফিরলে ইয়াদের সাথে কখনো কখনো রোমান্টিক কথাবার্তা হয় আবার কখনো মিষ্টি ঝগড়া করে।আবার কাল ইয়াদ মধুর বাসায় গিয়ে ওর বইগুলোও নিয়ে এসেছে।আজ থেকে নাকি পড়তে হবে।বই দেখেই মধু বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করেছিলো,’বই আনলে কেনো?’

‘কেনো আবার?তুমি পড়বে এইজন্য।’

‘আমি তো অসুস্থ!এখন অনন্ত অফ রাখি।’

‘অনেক ফাঁকিবাজি করছো তুমি।এটা কিন্তু ফাইনাল ইয়ার।এমনিতেও চারমাস নষ্ট করে ফেলছো।এবার থেকে খামখেয়ালি করলে চলবে না।ফাইনাল ইয়ারে আমি ভালো একটা সি জিপিএ চাই।’

মধু মুখ বাকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল,’এহ!ভালো একটা সি জিপিএ চাই!বললেই হলো?আমি কিচ্ছু পারি না।ফেল করবো।’

‘ফেল করলে আমি ভার্সিটিতে আমার নাক কাটা যাবে।স্টুডেন্টরা বলবে ইয়াদ স্যারের বউ ফেল্টু।এখন তুমিই বলো তুমি তোমার জামাইর বেইজ্জতি করতে চাও?’

ইয়াদ কথাও মধু একটু কনভিন্স হলেও জিদ ধরে বলল,’আচ্ছা বেশি পড়বো না।অল্প একটু পড়বো।’

ইয়াদ মধুর জিদ মেনে নিয়ে বলল,’আচ্ছা অল্পই।কিন্তু পড়তে হবে প্রতিদিন।’

‘আচ্ছা।’

এখন ভরদুপুর।মধু চোখে চশমা পরে বই পড়ছে।ইয়াদ বলেছে ও আসার আগেই যেনো পড়া শেষ হয়।এসে যদি দেখে পড়া হয় নি তাহলে নাকি কথা বলবে না।এই ভয়েই মধু পড়তে বসলো।হঠাৎ দরজায় নক হওয়ায় ও মুখ তুলে চাইতেই দেখতে পেলো নিহা এসেছে।মধু হাসিমুখে বলল,’ভাবি দাড়িয়ে আছো কেনো?আসো।বসো।’

নিহা ভেতরে এসে বিছানায় বসতে বসতে বলল,’কি করছো?’

‘কি আর করবো বলো।তোমার দেবর আমাকে পড়তে দিয়ে গেছে।পড়া নাহলে নাকি কথা বলবে না।তাই পড়ছি।’

নিহা হাসলো।বলল,’ও আচ্ছা।তাহলে বোধহয় বিরক্ত করলাম।পরে আসি তাহলে।’

এটা বলেই নিহা উঠতে নিলে মধু বাধা দিয়ে বলে,’আরে না ভাবি কোনো বিরক্ত করো নি।বসো তো।পরে পড়বো।এমনিতেও ভালো লাগছিলো না।’

নিহা আবারও হাসলো।মধুর অনুরোধে আর উঠলো না।তারপর দুই জা মিলে টুকটাক গল্পসল্প শুরু করলো।তারপর হঠাৎ কিছু একটা মনে হওয়ায় মধু বলল,’ভাবি,বাবুকি কিক মারে?’

নিহা মুচকি হেসে মধুর হাতটা নিজের পেটের ওপর রেখে বলল,’নিজেই বুঝে নাও।’

মধু অনুভব করলো একটা ছোট্ট পা পেটে লাথি মারে।কিছুক্ষণ পেটে হাত রেখে অনুভব করলো।তারপর হাত সরিয়ে ফেললো।নিহা দেখলো মধুর চোখে পানি।নিহা জিগ্যাসু গলায় বলল,’তুমি কাঁদছো?’

‘না।ভাবি।’মধু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল।তারপর ম্লান হেসে বলল,’ভাবি তুমি কতো লাকি।তোমার বাবু হবে।তুমি মা হবে।’

নিহা মধুর হাত ধরে বলল,’না বোন আমার চেয়ে বেশি ভাগ্যবতী তুমি।আল্লাহ সবাইকে সবদিক দিয়ে পূর্ণতা দেন না।তোমাকে একদিক দিয়ে অপূর্ণতা দিলেও অন্যদিকে দিয়ে কিন্তু পূর্ণ করে দিয়েছেন তেমন আমাকেও।’
মধু ভেবে পায় না নিহা ওকে বারবার ভাগ্যবতী বলে কিন্তু কেনো?ওর তো বাবুও হবে না তাহলে ভাগ্যবতী কিভাবে হলো?নিহাকে এইকথা জিজ্ঞেস করলে সে কিছু বলে না।শুধু একটু হাসে।

নিহার কথা শেষ হতে না হতেই ইয়াদের আগমন।দুই জা কে একসাথে দেখে ইয়াদ সহাস্যে বলল,’আরে দুই জা দেখি একসাথে।তা কি ফুসুরফাসুর চলছে?নিশ্চয়ই আমার নামে বদনাম করছে মধু।’

নিহা উঠে গিয়ে ইয়াদের সামনে দাড়িয়ে বলল,’আরে না দেবর সাহেব।আপনার নামে কোনো বদনাম হয় নি।আমরা তো আমাদের সুখ দুঃখের আলাপ করছিলাম।’

‘ওহ!তাহলে উঠে এলে কেনো ভাবি।যাও বসো।কথা বলো।’

‘না।তুমি ফ্রেশ হও।আমি ঘরে যাই।পরে আসবো।’

এই বলেই নিহা বেরিয়ে গেলো।
——————-
রাত ৮.১০…
বাইরে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব।আকাশ কালো হয়ে আছে।মাঝারি ধরনের বাতাস হচ্ছে বাইরে।নিহা বারান্দার ইজি চেয়ার থেকে বিরক্ত মুখে উঠে ঘরে চলে এলো।ওর বিরক্তি কারণ মোটেও মেঘলা আকাশ নয়।কারণটা ইফাজ।আজ একবারও ফোন ধরে নি।দশদিন হয়ে গেলো এখনো ফিরছে না ফেরার কথা বললে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে।এই সব মিলিয়েই নিহা চরম মাত্রায় বিরক্ত হয়ে আছে।মন চাচ্ছে ইফাজকে সামনে বসিয়ে ইচ্ছেমতো ঝাড়তে।কিন্তু ঝাড়া তো দূরের কথা কথাই তো বলা যাচ্ছে না।ধূর!নিজের রাগ নিজে হজম করে জানালা বন্ধ করতে লেগে গেলো।জানালা গুলো বন্ধ করে পেছনে ফিরতেই দেখলো ইফাজ কাক ভেজা হয়ে আছে।এভাবে হঠাৎ দেখে নিহা ভিষণ অবাক হলো।এটা সত্যি ইফাজ তো!নাকি ওর বেশে অন্য কেউ।নিহা ইফাজের সামনাসামনি এসে দাড়ালো।ইফাজ চুলের পানি ঝাড়তে ব্যস্ত।নিহা ইফাজের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,’তুমি সত্যিই ইফাজ তো?’

ইফাজ হেসে দিলো।হাসতে হাসতেই বলল,’এনি ডাউট?’

‘না কিন্তু তুমি তো বলো নি আজ আসবে।আর কখনো পৌঁছেছো?আমাকে বলো নি কেনো?বললে তো ইয়াদ অথবা বাবাকে পাঠাতাম।’

নিহার অস্থিরতা দেখে ইফাজ বলল,’এতো কথা একসাথে বলো কিভাবে।একটু জিরিয়ে জিরিয়ে বলো। আমি আজ সকালেই এসেছি।হাসপাতালে ছিলাম।তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো বলে ফোন ধরি নি।আর আমি একাই আসতে পারি।চিন্তা করতে হবে না।’

সবশুনে নিহা বলল,’আচ্ছা।তাহলে ফ্রেশ হয়ে নাও।ড্রেস চেন্জ করে আসো।’

‘আচ্ছা।’
ইফাজ জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।ওয়াশরুমে এসে শার্ট টা খুলে নিজের ক্ষত তে একবার হাত বুলালো।একবারের জন্যও নিহা ওকে সন্দেহ করে নি।যাক এখন কয়েকটা দিন সাবধানে চলতে হবে।সেলাই খোলার আগে ক্ষতটা যেনো কেউ না দেখে।

চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে