#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৯
#Arshi_Ayat
দুইদিন পরের কথা….
বিকেলে ইরিনের শ্বশুরবাড়ির লোক আসবে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে।এঙ্গেজমেন্টের সময় কথা হয়েছিলো ইয়াদ ফিরলে বিয়ে হবে।এখন তো ইয়াদ ফিরেছে তাই আর শুভ কাজটা ফেলে রাখতে চাইলো না ওনারা।এতে ইরিনের বাবা মায়েরও কোনো আপত্তি নেই।এবার মেয়ের বিয়েটা দিয়েই দিবেন।
মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক আসবে সেইজন্য ইয়াদকে বাজারে পাঠিয়েছে সাইদা খান।কাজের লোকই যেতো কিন্তু ইয়াদ নিজেই চাইলো করতে।তাই সাইদা খান আর কিছু বললেন না।
ইয়াদ বাজার করলো দুইভাগে।একভাগ নিজের বাসার জন্য আরেকভাগ মধুর বাসার জন্য।আইরিন রহমান আর মিলি ওরা কালই নতুন বাসায় উঠেছে সাথে মধুও আছে।সেইজন্য ভাবলো ওদের জন্যও বাজার নিয়ে যাওয়া যাক।
বাজার করে ফিরতি পথে মধুর বাসায় গিয়ে বাজারটা দিয়ে এলো।আইরিন রহমান বসতে বললেন কিন্তু ইয়াদ তাড়া দেখিয়ে বেরিয়ে গেলো।যাওয়ার সময় মধুর ফোনটাও দিয়ে গেলো।
এই দুইদিন ধরে কথা বলা,কাছে আসা সবই গোপনে হচ্ছে।রাতের বেলা ইয়াদ মধুর বাড়ি থাকে ভোর হওয়ার আগেই নিজের বাড়ি চলে আসে।অবশ্য সাইদা খান এখনো ধরতে পারে নি বিষয়টা।তিনি মনে করেছেন ছেলে হয়তো নিজেকে কন্ট্রোল করছে তার জন্য!এইজন্য তিনি ইয়াদের ওপর একরকম বেশিই খুশী এইদিকে এই খবর নিহা,ইফাজ আর ইরিন জানে।ইয়াফ খান সন্দেহ করলেও হাতেনাতে ধরতে পারে নি তাই কিছু বলে নি।তবে ইয়াদের খুব মন খারাপ হয়।কাল সন্ধ্যার সময়ই ছাঁদে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের সাথে সুখ দুঃখের আলাপ করছিলো।ইফাজ স্বান্তনা দিয়ে শান্ত করেছিলো ওকে।
আপাতত ইরিনের বিয়ে মিটে যাওয়া অব্দি চুপই থাকতে হবে পরে নাহয় কিছু একটা করা যাবে।
ইয়াদ বাজার নিয়ে বাসায় আসলো।বাসায় রান্নাবান্না হচ্ছে।সাইদা খান সবকিছুর তদারকি করছে।সাথে ইরিনও আছে তবে সে একটু পরপর আসে আর যায়।নিহাও চেয়েছিলো সাহায্য করতে কিন্তু ইফাজের চোখ রাঙানি আর সাইদা খানের কঠিন বারণে নিহা আর কিছু করতে পারলো না।ইদানীং বোরিং লাগে সবকিছু নিহার।ইফাজ একটা কাজও করতে দেয় না।যখন বাসায় থাকে তখনও আবার বাইরে গেলে সাইদা খান আর ইরিন!কয়েকদিন ধরে বাবা মায়ের কাছেও যেতে ইচ্ছে করছে তাই ভাবছে ইরিনের বিয়েটা মিটে গেলেই কয়েকদিন গিয়ে থেকে আসবে।
একটু আগেই ইরিনের শ্বশুর বাড়ির লোকেরা চলে গিয়েছে।বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক।সামনের শুক্রবার বিয়ে হবে।সেই অনুযায়ী আগেরদিন গায়ে হলুদ পরেরদিন বৌ ভাত।সপ্তাহজুড়ে সবার ব্যস্ততা।ইয়াদের এই ভেবে মন খারাপ হলো এই আনন্দগুলোর শামিল মধু হতে পারবে না।অথচ ও কিন্তু এই বাড়িরই বউ!
সারাদিন ইয়াদ একা হাতেই সব সামাল দিয়েছে।ইফাজ হসপিটালে ছিলো।ওর ও থাকার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু ইমার্জেন্সি পড়ে যাওয়ায় আসতে পারে নি।
সন্ধ্যার সময় নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপ অন করলো।কিছু কাজ আছে ওগুলো শেষ করে খাওয়া দাওয়া করে সবাই ঘুমালে বেরিয়ে পড়বে।
কাজ করতে করতেই সাইদা খান ইয়াদের ঘরে আসলো চা নিয়ে।ওকে চা টা দিয়ে বলল,’ইয়াদ,একটু কথা বলবো তোর সাথে।’
ইয়াদ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,’হ্যাঁ বলো।’
‘তুই ওই মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে দে।তারপর ইরিনের বিয়ের পর তোর বিয়ে দিবো।’
ইয়াদ পূর্ণচোখে চাইলে মায়ের দিকে।কপাল কুঁচকে বলল,’মা,আমি মধুকে ডিভোর্স দিবো না।আর ওর সাথে আইনত আমার বিয়ে হয়েছে।আমি ওকে ছাড়া আর কাউকে আমার বউ হিসেবে মানবো না।’
সাইদা খান বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন,’দেখ ইয়াদ,এগুলো আবেগ।আবেগ কয়দিন পরই কেটে যাবে।’
ইয়াদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,’মা তুমি আটাশ বছরের ছেলেকে আবেগ বোঝাও?আবেগের বয়স শেষ আমার।কোনটা আবেগ আর কোনটা ভালোবাসা আমি তা বুঝি মা।’
‘না ইয়াদ তুই ভুল করছিস।ওই মেয়েটার সাথে তুই শান্তিতে থাকবি না।একে তো মেয়েটা ধর্ষিতা তারওপর বাচ্চাও হবে না।এমন অনেক সংসার বাচ্চার জন্য ভেঙেছে।’
‘মা প্রথমত আমি ওকে ভালোবাসি।আমি সারাজীবন ওর সাথে থাকতে পারলেই সবচেয়ে শান্তিতে থাকবো বিশ্বাস করো।আর ও ধর্ষিতা বিয়ের আগে ছিলো বিয়ের পর না।বিয়ের পর শুধু ও ইয়াদের বউ।আর বাচ্চার জন্য যারা সংসার ভাঙে তারা আসলে ভালোবাসা কি সেটাই জানে না।’
সাইদা খান গম্ভীর গলায় বললেন,’ইয়াদ তুই কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস।আমার কথা শোন।’
‘দুইদিন আগেও তোমার একটা অন্যায় আবদার রেখেছি।আর পারবো না মা।তোমার অন্যায় আবদার রাখতে গিয়ে আমি আরেকজন কে কষ্ট দিতে পারবো না।’
এটা বলেই ইয়াদ ল্যাপটপটা অফ করে অর্ধপূর্ণ চায়ের কাপটা রেখে বাইরে চলে গেলো।
আর সাইদা খান গম্ভীরমুখ নিয়ে উঠে চলে গেলেন।
—————–
নিখিল কিছুদিনের জন্য ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলো তাই ওকে ওই ফোনটা দিতে পারে নি ইফাজ।নিখিল অবশ্য বলেছিলো ও আসলে তারপর কাজ শুরু করবে কিন্তু ইফাজের হাত গুটিয়ে রাখতে ইচ্ছে হলো না তাই কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে নিজের বিশ্বস্ত কয়েকজন লোককে দায়িত্ব দিয়ে দিলো।ফোনটা ওদের কাছে দিয়ে সিমটা নিজের কাছে রাখলো।ওই ফোনের গ্যালারিতে একটা ছেলের ছবি আছে।এখন উদ্দেশ্য ওই ছেলেকে খুঁজে বের করা।
রাত ১.০০ টা…
নিহা ঘুমিয়ে গেছে।ইফাজ ওর পাশ থেকে উঠে গেলো।ইফাজও ওর পাশেই শুয়েছিলো।অপেক্ষা করছিলো নিহা ঘুমানোর ও ঘুমিয়ে পড়লেই সিমটা নিজের ফোনে লাগিয়ে নাম্বারগুলো চেক করবে।হয়তো কোনো ক্লু পাওয়াও যেতে পারে।
ফোন চালু করে নাম্বারগুলো টুকে নিতে লাগলো হঠাৎ করেই ইফাজের চোখেট একটা পরিচিত নাম্বার ধরা পড়লো।ইফাজ শিউর হওয়ার জন্য নাম্বারটা আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।নাহ!কোনো ভুল নেই কিন্তু এই নাম্বার এখানে কি করে।ও অন্য একটা কগজে এই নাম্বারটাও টুকে নিলো।হতে পারে এটার সাথেও কোনো যোগসূত্র আছে।
————-
সারা সপ্তাহ জুড়ে শপিং থেকে শুরু করে যাবতীয় আয়োজন সব দায়িত্ব নিয়ে করেছে ইয়াদ আর ইফাজে
বোনের বিয়ের আয়োজনে ভাইয়েরা কোনো ত্রুটি রাখে নি।
আজ ইরিনের গায়ে হলুদ।ইয়াদের অনেক ইচ্ছে ছিলো পুরো বিয়েতে মধু থাকবে কিন্তু ওকে আসতে বলতো কোন মুখে?মাঝেমধ্যে নিজেরই ভিষণ খারাপ লাগে।মন চায় সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে কিন্তু পিছুটানের জন্য আর যাওয়া হয় না।
দুইভাই মিলে বোনকে স্টেজে নিয়ে বসালো।ইরিন আজ অনেক খুশী।নিজের বিয়েতে পরিবারের সবাই আছে কিন্তু একটা বিষয়ে খারাপ লাগছে যে তার ছোটভাই হাসিখুশি থাকলে ওর মনটা খারাপ।কেনো খারাপ সেটাও অজানা নয়।তাই ইরিন ভাইকে খুশী করতে ওর কানে কানে বলল,’ভাইয়া ভাবিকে মিস করছো?’
ইয়াদ মলিন হাসলো।কিছু বলল না।ইরিন আবারও ফিসফিসিয়ে বলল,’ভাবিকে আসতে বলেছি।’
ইয়াদ চমকে উঠে বলল,’ও কি বলেছে?আসবে?’
‘হ্যাঁ আসবে কিন্তু তোমার বউ হয়ে নয় আমার বান্ধবী হয়ে।’
‘সমস্যা নাই।ও আসলেই চলবে।’
‘এবার খুশীতো?’ইরিন দাঁত কেলিয়ে বলল।
ইয়াদ কিছু বলল না।কিন্তু ওর মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে ও অনেক খুশী।
মধু চকলেট কালারের একটা শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নিলো।বের হওয়ার আগে শেষবারের মতো একবার আয়নাতে নিজেকে দেখে বের হতে নিলেই আইরিন রহমান বললেন,’কোথায় যাচ্ছিস মধু?’
‘মা,আজ ইয়াদের বোনের গায়ে হলুদ।ওখানেই যাচ্ছি।’
‘তোকে যেতে বলেছে?’
মধু আমতা আমতা করে বলল,’মা আসলে ইরিন বলেছিলো আসতে।’
‘আর ওমনি তুমি চলে যাচ্ছো?ইয়াদ কি একবারও বলেছিলো?বা ওর বাব মা কেউ বলেছে?’
মধু নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,’না।’
‘তাহলে যাচ্ছিস কেনো?আবার অপমানিত হতে?ওইদিন অপমান হয়ে শিক্ষা হয় নি।আজ আবার সবার সামনে অপমানিত হতে ভাল্লাগবে?’
মধু কিছু বলল না।চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।আসলেই মায়ের কথাগুলে সত্যি!আইরিন রহমান আবার বললেন,’তোর যেতে মন চাইলে যা কিন্তু কিছু হলে বাসায় এসে কাঁদতে পারবি না।এই বলে দিলাম।’
মধু আর দরজার দিকে পা বাড়ালো না।নিজের ঘরে চলে গেলো।দরজা বন্ধ করে দিলো।ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়ালো।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো নিজেকে।কি কমতি আছে ওর?একটা হাত নেই নাকি পা নেই?নাকি কানা?নাকি প্রতিবন্ধী?নাহ!কোনো কমতিই তো নেই তাহলে এতো অবহেলা কেনো?কেনো বিয়ের আগে যারা ভালোবাসতো একটা দুর্ঘটনার জন্য তারা বিয়ের পর ভালোবাসতে পারছে না?তাহলে কি তারা নারীকে নয় নারীর সতিত্বকে ভালোবাসে?
————-
প্রায় দশটা বেজে গেছে।এখনো মধু আসছে না।ইয়াদ বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছে।কয়েকবার ফোনও দিয়েছে কিন্তু ফোন রিসিভও হচ্ছে না।এখনো আসছে না কেনো?আসার তো কথা ছিলো।কোনো সমস্যা হয়েছে কি না কে জানে!এখন তো এদিকটা ছেড়ে যাওয়াও যাবে না।এদিকে ইরিনের সাথেও কথা বলা যাচ্ছে না অনেক আত্মীয়রা ওকে ঘিরে আছে।
মধুর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ।সবাই যে যার মতো ঘুমাতে চলে গেছে।ইয়াদও ঘরে এসেছে।হলুদের পোশাক পাল্টে বিছানায় বসে মধুকে কল দিলো।মধু রিসিভ করতেই ইয়াদ বলল,’আজকে আসো নি কেনো?’
‘আসার কি কথা ছিলো?’
‘ইরিন তো বলেছিলো আসতে।’
‘তুমি বলেছিলে?’
এই কথার উত্তর পেলো না ইয়াদ।নিজের কাছেই নিজের লজ্জা লাগছে।ইয়াদের জবাবের অপেক্ষা না করে মধু বলল,’রাত হয়ে গেছে অনেক।কাল বিয়ে।ঘুমিয়ে পড়ো।রাখছি।’
এটা বলেই মধু ফোনটা রেখে দিলো।ফোনটা রাখার পর চোখ ছাপিয়ে কান্না চলে আসলো মধুর।সন্ধ্যা থেকে একটুও কাঁদে নি কিন্তু এখন খুব করে কান্না পাচ্ছে।
চলবে…..
#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৫০
#Arshi_Ayat
ভাইদের চোখের মণির আজকে বিদায়।দুই ভাইয়েরই মন ভার হয়ে আছে।ছোটবেলা থেকেই দুই ভাইয়ের আর বাবা মায়ের ভিষণ আদরের ছিলো ইরিন।কখনো ভালোবাসার কমতি অনুভব করে নি কিন্তু আজ যাবার বেলায় বাড়ির সবার মন খারাপ হয়ে আছে।সাইদা,ইয়াফ দুজনেই কান্না করেছেন মেয়ের বিদায়ে।ইয়াদ,ইফাজ প্রথমে কান্না করে নি।শক্তই ছিলো কিন্তু যখনই ইরিন এসে ভাইদের জড়িয়ে ধরে কান্না করা শুরু করলো তখন দুই ভাইয়ের কেউই তাদের কান্নার লাগাম টেনে ধরতে পারে নি।তিনভাই বোন খুব কাঁদল।তারপর ইফাজ বোনকে কোলে কোরে নিয়ে গাড়িতে বরের পাশে নিয়ে বসালো।বরের হাত ধরে ইফাজ ভেজা গলায় বলল,’ও আমাদের খুব আদরের বোন।আমাদের চোখের মণি।আজ আমরা আমাদের জানটাকে তোমার হাতে দিলাম কখনো কষ্ট দিও না।যদি আমার বোন কখনো তোমার কারণে কাঁদে আর আমি যদি জীবিত থাকি তাহলে ওইদিন তোমার শেষদিন হবে।’
এটা বলে বোনের কপালে একটা চুমু খেয়ে সরে এলো।তারপর ইয়াদ গেলো।ইয়াদ যেতেই ইরিন ওকে জড়িয়ে ধরে আরেক দফা কাঁদল।ইয়াদ নিজেকে সামলে ইরিনের চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে ইরিনের হাত বরের হাতে দিয়ে বলল,’আগলে রেখো সারাজীবন।’
তারপর বাকি আত্মীয় স্বজন মিলে ইরিনকে বিদায় দিলো।একমাত্র মেয়ের বিদায়ে সাইদা খান আর ইয়াফ খান দুজনেরই মন খারাপ।ইরিনের বিদায়ের পর বাড়ি আস্তে আস্তে খালি হতে শুরু করে।যাদের বাড়ি কাছাকাছি তারা চলে গেলো।আর বাকি আত্মীয়রা রয়ে গেলো।
ইরিনকে বিদায় দিয়ে ইয়াদ নিজের ঘরে আসলো।ঘড়িতে এখন রাত নয়টা।ড্রেস চেঞ্জ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো।ভালো লাগছে না।আজ একমাত্র বোনটার বিয়ে হয়ে গেলো।ভাই হয়ে বোনের বিদায়ে কতো কষ্ট এটা আজ বুঝতে পারছে ইয়াদ।কিছুক্ষণ সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ইরিনের সাথে দুষ্টুমির মুহুর্তগুলো মনে করতে লাগলো।ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করেই মনে পড়লো মধুর কথা।কালকে রাতের পর থেকে এখন পর্যন্ত একবারও কথা হয় নি।এমনিতেও ইয়াদের ভালো লাগছে না হয়তো মধুর সাথে কথা বললে ভালো লাগবে তাই ফোন দিলো।কেটে যাওয়ার আগেই রিসিভ হলো।ইয়াদ শান্তকন্ঠে বলল,’ইরিনটার বিয়ে হয়ে গেলো আজ।সব খালি খালি লাগছে।ও যাওয়ার পর থেকেই ওর শূন্যতাটা চোখে লাগছে।কিছুই ভালো লাগছে না।’
স্বামীর অস্থিরতার কথা শুনে মধু স্বান্তনা দেওয়ার জন্য বলল,’মেয়েরা এমনই ইয়াদ।ওদের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই।জন্ম হয় বাবার বাড়িতে বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি,বৃদ্ধ হওয়ার পর ছেলের বাড়ি নাহয় বৃদ্ধাশ্রম!’
ইয়াদ কিছু বলল না।চুপচাপ কানে ফোন চেপে বসে রইলো।এমুহূর্তে কারো সঙ্গ প্রয়োজন।মধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’খেয়েছো?’
‘না।ইচ্ছে করছে না।তুমি খেয়েছো?’
‘না।আমারও ইচ্ছে করছে না।’
তারপর আবারো কিছুক্ষণ নিরবতা।এবার ইয়াদ অনুরোধের স্বরে বলল,’আসবো?’
‘আসো।’মধুও সায় দিলো।
——————
ইরিনের বিয়ে মিটে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর পর নিহা কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়ি চলে যায়।এদিকে ইফাজ নিজের চেম্বার আর ইয়াদ নিজের ভার্সিটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।মধুও নিজের বাসা থেকে যাওয়া আসা করে ক্লাস করা শুরু করে।ভার্সিটিতে এতোদিনে চাউর হয়ে গেছে ওরা বিবাহিত।তবে কয়েকদিন ধরে ইয়াদ লক্ষ করছে মধু ওকে এড়িয়ে চলছে।ফোন দিলে ফোন ধরে না,তেমন একটা কথা বলে না।কি হয়েছে সেটাও কয়েকবার জিগ্যেস করেছে ইয়াদ কিন্তু কোনো আশানুরূপ উত্তর পাওয়া যায় নি।এদিকে আবার আজকে ও ক্লাসেও আসে নি।আরিয়াকে জিগ্যেস করতেই বলল আজকে নাকি আসবে না।কি কারণ সেটা বলল না।তাই ইয়াদ নিজেই কল দিলো।কয়েকবার কল দেওয়ার পরও মধু কল ধরলো না।এখনই ওর বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু আরো ২ টা ক্লাস নিতে হবে।এখন ক্লাস ছেড়ে যাওয়াও যাবে না।তাই ইয়াদ কোনরকম দুইটা ক্লাস শেষ করে দুপুর তিনটার সময় বেরিয়ে গেলো মধুদের বাসার উদ্দেশ্যে।
ওদের বাসায় এসে নক করতেই মিলি দরজা খুললো।ইয়াদ মৃদু হেসে বলল,’কেমন আছো?’
মিলি থমথমে মুখে বলল,’ভালো না।আপুর শরীর খারাপ।’
মিলির মুখে মধুর শরীর খারাপের কথা শুনে ইয়াদে বুকটা ধড়াস করে উঠলো।ভয় পাওয়া গলায় বলল,’কি হয়েছে ওর?’
‘জানি না কয়েকদিন থেকেই।কেমন জানি দুর্বল হয়ে পড়েছে।অনেক শ্বাসকষ্টও হচ্ছে।আজকে ওয়াশরুমের সামনে জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলো।পরে আমি আর আম্মু বিছানায় আনি।’
ইয়াদ মিলির কথা শুনে আরো ভয় পেয়ে গেলো।মিলির পেছন পেছন মধুর ঘরে গেলো।দেখলো মধু লম্বা হয়ে শুয়ে আছে।আইরিন রহমান ওর শিয়রের পাশে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে।ইয়াদকে দেখে তিনি উঠে দাড়িয়ে বসতে বললেন।ইয়াদ বসলো।চিন্তিত ও ভয়ার্ত স্বরে আইরিন রহমানকে জিগ্যেস করলো,’কি হয়েছে মা ওর?’
‘জানি না বাবা।ডাক্তার দেখাতে চাইলাম বলল লাগবে না।এমনিই নাকি সেরে উঠবে।’
‘আপনি আমাকে একবারও জানালেন না কেনো?’
আইরিন রহমান কিছু বলার আগেই মধু বলল,’আমি বারণ করেছি।কিছু হয় নি আমার।সুস্থ হয়ে যাবো এমনিই।’
ইয়াদ চোখ রাঙিয়ে বলল,’তুমি চুপ থাকো।একটা কথাও বলবে না।’
মধুকে শাসিয়ে ফোনটা বের করে ইফাজকে ফোন দিলো।সব শুনে ইফাজ বলল হাসপাতালে নিয়ে আসতে।ইয়াদ মধুকে হাসপাতালে নিতে চাইলে মধু আর্তনাদ করে বলল,’প্লিজ ইয়াদ।আমি যাবো না হাসপাতালে।বললাম তো আমি ভালো আছি।’
ইয়াদ কোনো কথার উত্তর দিলো না।কোলে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলো।রাস্তায় এসে একটা সি এন জি ডেকে নিলো।সেখানে মধুকে জোর করে উঠালো।সারা রাস্তা মধু কাঁদতে কাঁদতে এসেছে।মুখে একটাই কথা আমি হাসপাতালে যাবো না।কিন্তু কে শোনে কার কথা।হাসপাতালে নিয়ে আসার পর দুইজন নার্স মধুকে একটা কেবিনে নিয়ে গেলো।একটু পর ইফাজ এসে প্রেশার মাপলো।প্রেশার হাই হয়ে আছে।এরমধ্যেই আবার মধুর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে।ইফাজ দ্রুত অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে গেলো।আর ইয়াদ মধুর হাত শক্ত করে ধরে ওকে সামলানোর চেষ্টা করছে।হাসপাতালের বিছানায় মধু ছটফট করছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই অক্সিজেন দেওয়া হলো।তারপর মধু কিছুটা শান্ত হলো।এক দেড়ঘন্টা পর ইফাজ মধুকে কিছু পরীক্ষার জন্য পাঠালো।এই পরীক্ষাগুলো করলেই বোঝা যাবে সমস্যা কিন্তু।মধু পরীক্ষা করাতে নারাজ।তবে ইয়াদের শাসনের কাছে হার মেনে পরীক্ষাগুলো করতেই হলো।পরীক্ষা করিয়ে আবার বেডে শিফট করা হলো মধুকে।
ইফাজের কথায় ইমিডিয়েট রিপোর্টগুলো তৈরি করা হলো।রিপোর্টগুলো দেখে চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ বসে রইলো।যা সন্দেহ করেছিলো তাই হয়েছে।ইয়াদ ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করলো,’ভাইয়া রিপোর্ট কি খারাপ?’
ইফাজ নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,’যা বলবো মনোযোগ দিয়ে শুনবি।ওর দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে।ইমিডিয়েট কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে।আমরা দেখছি কিডনির ব্যাবস্থা করতে পারি কি না।কিন্তু তুই শক্ত থাকিস ভাই।ওকে কিছু বলিস না।এখন মানুষিক সাপোর্টটা খুব প্রয়োজন।’
ইফাজের কথা শুনে ইয়াদ কিছুক্ষণ বোবা হয়ে বসে রইলো।মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।এমন কিছু স্বপ্নেও চিন্তা করে নি ইয়াদ।কষ্ট হচ্ছে ভিষণ।মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে কেউ পাথর চেপে ধরে রেখেছে।চুপচাপ ভাইয়ের কেবিন থেকে বেরিয়ে মধুর কেবিনক গেলো।কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে!মুখে অক্সিজেন মাক্স।হাতে স্যালাইন লাগানো।নিঃশব্দে ইয়াদ মধুর পাশপ গিয়ে বসলো।একটা হাত ওর হাতের ওপর রাখলো।চেখভর্তি হয়ে গেলো জলে।কেনো?সব কষ্ট এই মেয়েটাকেই পেতে হবে কেনো?সেই প্রথম থেকে কিছু না কিছু হয়েই যাচ্ছে।একদন্ড শান্তি পায় নি।ভেবেছিলো বিয়ের পর শান্তি মিলবে তাও হলো না।শ্বশুরবাড়িতেই তো ঠাই হলো না!
ইফাজ মধুর ব্লাড স্যাম্পল পরীক্ষা করতে পাঠালো আর কিডনি ডোনেটের গ্রুপকে জানালো।কিন্তু আফসোসের বিষয় আপাতত এখন দেওয়ার মতো কোনো কিডনিই নেই।থাকলেও এটা মধুর টিস্যু, কোষের সাথে ম্যাচ করে না।এদিকে অতিদ্রুত অপারেশন করতে হবে।প্রচুর রক্তেরও প্রয়োজন কিন্তু মধুর রক্ত O নেগেটিভ হওয়ায় এই রক্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।এটা খুব রেয়ার রক্ত।এদিকে ভেতরে ভেতরে ইয়াদ আর ইফাজ টেনশনে মরে যাচ্ছে।আইরিন রহমান আর মিলিও চিন্তিত মুখে মধুর পাশে বসে আছে।তবে ওনারা এসবের কিছুই জানেন না।
কথায় আছে দুঃসংবাদ বাতাসের আগে পৌছায়।তেমনই মধুর হাসপাতালে ভর্তির খবর ইরিন,ইয়াফ খান,সাইদা খান ওনাদের কাছেও পৌঁছে গেছে।ওনারাও আসছেন।
কিন্তু কোনো আশার খবর নেই।না রক্ত জোগাড় হচ্ছে না কিডনি!
চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।রি চেক করা হয় নি।)