ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৪৭+৪৮

0
2693

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৭
#Arshi_Ayat

মধুর মাথা বুকে চেপে ধরে রেখেছে ইয়াদ।মধু দু’হাতে ইয়াদের গলা জড়িয়ে রেখে কাঁদছে।ইয়াদের চোখেও পানি তবে সেটা আড়ালে।দশমিনিট ধরে এভাবেই বসে আছে দুজন।দশমিনিট আগেও ওরা ঘুমিয়েই ছিলো।কিন্তু হঠাৎ মধু ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে বসে।সেই কালোরাতের দৃশ্য চোখে ভাসে!ইশ!কি কষ্ট!কি আর্তনাদ!কেউ শোনার ছিলো না!কেউ বাচায় নি সেদিন!মধুর চিৎকারে ইয়াদও শোয়া থেকে উঠে বসে।তড়িঘড়ি করে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেখে মধু দুইহাতে মুখ ঢেকপ কাঁদছে।ইয়াদের বুঝতে বাকি রইলো মধু কেনো কাঁদছে।কিন্তু এই মুহুর্তে স্বান্তনা দেওয়ার মতো কোনো শব্দ ইয়াদের মাথায় নেই।ইয়াদ মধুকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে শান্তিতে কাঁদতে দিলো।যেনো কিছুটা সময় একান্তে কাঁদতে পারে।এর থেকে এখন বেশি কিছু করারও নেই ইয়াদের।

কান্না কিছুটা থেমে এলো মধুর।মধু নাক টেনে ইয়াদের বুক থেকে মাথা তুললো।চোখের পানিগুলো মুছে।পিঠময় ছড়া চুলগুলো হাতখোপা করে নিলো।তারপর ঠান্ডা গলায় বলল,’শুয়ে পড়ো।সকালে উঠতে হবে।’

‘তুমি শুবে না?’একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইয়াদ।

‘না,ঘুম আসছে না।’

‘আমারো না।চলো বারান্দায় গিয়ে বসি।চা খাবে?’

‘হ্যাঁ খাবো।’

‘আচ্ছা তুমি গিয়ে বসো।আমি চা নিয়ে আসছি।’

মধু ঘাড় নেড়ে বারান্দায় চলে গেলো।আর ইয়াদ কিচেনে গেলো চা বানাতে।

একটু পরই চা নিয়ে হাজির হলো ইয়াদ।তারপর দু’জনে চা খেতে খেতে কিছুটা সময় নিরবে কাটিয়ে দিলো।

কাল থেকে সাইদা খান ইয়াদের সামনে আসছে না।আজ নাস্তার টেবিলেও নেই।তবে ইয়াফ খান থাকলেও সে গম্ভীর হয়ে আছে।তেমন একটা কথাও বলছে না।এতে অবশ্য ইয়াদ মধু দুজনেরই খারাপ লাগছে কিন্তু কেউই প্রকাশ করছে না।

নাস্তা করে ওরা বেরিয়ে গেলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে।মধুর মা,বোন আর ওই বন্ধ ফোনটা আনতে যাচ্ছে ওরা।প্রথমে ইয়াদ বলেছিলো আইরিন রহমান আর মিলিকে ওদের বাসায় রাখবে কিন্তু মধু মানা করে দেয়।এমনিতেই ইয়াদের বাবা মা ওদের ওপর নারাজ।তার ওপর যদি ওনাদের এখানে আনা হয় তাহলে বিষয়টা খারাপ দেখায়।মধুর কথায় যুক্তি আছে!ইয়াদও চিন্তা করলো আসলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই এখন।তাই ওরা একটা বাসা কাল শপিং করে আসার সময়ই ঠিক করে নেই।ভাগ্য ভালো যে ভাংতি মাসে বাসা পাওয়া গেছে।এমনিতে তো ভাংতি মাসে বাসা পাওয়াটা খুব কঠিন।
————-
আজকে আইরিন রহমান আর মিলি ওদের সাথে ফেরে নি কারণ শুধু আসলেই তো হবে না।আসবাব পত্রগুলোও আনতে হবে তাই ওরা কয়েকদিন পর আসবে।এতে মধু ইয়াদ কেউই বাঁধা প্রদান করে নি।ওরা শুধু ফোনটা নিয়েই চলে আসলো।

ইফাজকে ওই বন্ধ ফোনটা দিয়ে আবার বাড়ি ফিরলো দু’জনে।আজকে সন্ধ্যায় ওরা সাজেক রওনা হবে।তাই দুপুর থেকেই প্যাকিং শুরু করলো।ব্যাগ গুছাতে গুছাতে টুকটাক কথা হচ্ছিলো।হঠাৎ ইরিন দৌড়ে এসে হাপাতে হাপাতে বলল,’ভাইয়া একটু আসো তো।আম্মু কেমন জানি করতেছে।’

সবকিছু রেখেই ইয়াদ মধু দুজনই ছুটলো মায়ের ঘরে।ঘরে গিয়ে দেখলো সাইদা খান শুয়ে আছে।এসি চলছে তবুও তিনি ঘামছেন,প্রচুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে আর বুকে হাত দিয়ে রেখেছেন।ইয়াদ দিক দিশা না পেয়ে ইফাজকে ফোন দিয়ে বলল।মধু আর ইরিন মাথায় পানি দিতে শুরু করলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ইফাজ অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিলো।ইয়াদ মাকে কোলে করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠালো।কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা হাসপাতালে পৌঁছে গেলো।ইফাজ আগেই জরুরি বিভাগ প্রস্তুত করে রেখেছিলো।সাইদা খানের অবস্থা বেশি খারাপ।উনাকে আইসিইউ তে নেওয়া হয়েছে।ইয়াফ খান জানতেন না।ওনাকেও খবর দেওয়া হয়েছে।আইসিইউ’র বাইরে সবাই চিন্তিত মুখে বসে আছে।কারো মুখে কথা নেই।ইয়াদ তো কতকিছু বসে তো কতক্ষণ পায়চারি করে।ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
———–
কিছুক্ষণ পর ইফাজ আইসিইউ থেকে বের হওয়ার পরই ইয়াদসহ সবাই এগিয়ে গেলো।ইফাজ মাক্স খুলে বলল,’আরেকটু দেরি হলে অনেক ক্ষতি হতো।প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারতো।কিন্তু এখন ঠিক আছে।বেশি ট্রেসের ফলে আর ঔষুধ নিয়মিত না খাওয়ার ফলে হয়েছে।এখন কোনো রকমের উত্তেজিত করে এমন কথা বলা যাবে না।কেবিনে দিচ্ছি একটু পর।’

সাইদা খানকে কেবিনে দেওয়ার পর প্রথমে ইয়াফ খান দেখা করলেন।তারপর ইরিন।এরপর ইয়াদ।কিন্তু ইয়াদের সাথে সাইদা খান কথা বললেন না।ইয়াদ মায়ের বেডের সামনে এসে অপরাধী কন্ঠে বলল,’মা কথা বলো।’

সাইদা খান অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।ইয়াদের দিকে তাকালো না।ইয়াদ কি করবে বুঝতে পারছে না।ওর ও তো কষ্ট হচ্ছে।মায়ের সাড়া না পেয়ে আবার বলল,’ও মা কথা বলো।’

তারপরেও সাইদা খান কিছু বললেন না।ইয়াদ নিরুপায় হয়ে চলে যেতে নিলেই সাইদা খান বলে উঠলো,’কথা বলবো তোর সাথে তবে এক শর্তে।তুই ওই মেয়ে কে চলে যেতে বলবি তোর জীবন থেকে।হয় ওই মেয়ে নাহয় মা।’

ইতিমধ্যে ইফাজও রুমে চলে এসেছে এবং সেও শর্তের কথা শুনেছে।ইয়াদ করুণ চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো।ইফাজ ইশারায় বলল মা যা বলছে তা করতে।কিন্তু ইয়াদের মন মানছে না।কথা মুখে আটকে আসছে।

ইরিন মধুকে নিয়ে কেবিনে ঢুকলো।মধু ধীরে ধীরে সাইদা খানের বেডের দিকে এগিয়ে গেলো।সাইদা খান ইয়াদকে ইশারা দিলেন।ইয়াদ মধুর দিকে করুণ চোখে চাইলো।ইয়াদের চাহনী দেখেই মধু কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো।নিজেকে সামলে নিলো।যাইহোক সে মেনে নিবে।ইয়াদ অনেক্ক্ষণ ধরে বলার চেষ্টা করছে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ওর মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না।

অনেক চেষ্টা করে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,’মধু তুমি আ আমার জীবন থেকে চলে যাও।’এটা বলার পর ইয়াদ খেয়াল করলো ও কান্না করছে।ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।মধুর চোখেও পানি এসেছিলো কিন্তু নিজেকে সামলে একটা ম্লান হাসি দিয়ে মধু বেরিয়ে গেলো।ইয়াদও পেছনে যেতে নিলে সাইদা খান ওর হাত ধরে ফেলেন।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে মধু ফুটপাতের রাস্তা ধরে হাটতে থাকে।ভিষণ রোদ।দরদর করে ঘামছে মধু।তবুও হাটা থামাচ্ছে না।সাথে ফোন,টাকা কিছু নেই।জানেও না কোথায় যাবে।ফোন থাকলে নাহয় আরিয়াকে বলা যেতো কিন্তু এখন!

হাঁটতে হাঁটতে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই দেখলো ওকে কেউ ধরে ফেলেছে।সামনের মানুষটার দিকে তাকাতেই দেখলো আরিয়া ওকে ধরে আছে।কি অদ্ভুত!এখনই মনে মনে আরিয়াকে স্মরণ করছিলো আর এখনই দেখা হয়ে গেলো।
এমন বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আরিয়া বিচলিত হয়ে জিগ্যেস করলো,’কি রে,কি হইছে তোর?এই অবস্থা কেন?ভাইয়া কই?’

মধু হাসলো।বলল,’কয়টার উত্তর দিবো।আস্তে আস্তে বল।’

‘একটা একটা করে উত্তর দে।’

‘দেব।আগে বল তোর বাসায় আজ রাতটা থাকতে পারবো তো?’

আরিয়া পূর্বের চেয়েও বেশি বিচলিত হয়ে বলল,’কি হয়েছে রে তোর?দাড়া আমি এখনি ভাইয়াকে ফোন দিচ্ছি।’

মধু বাধা দিয়ে বলল,’পাকনামি করিস না।যেটা জিগ্যেস করলাম সেটার উত্তর দে।তা নাহলে বলে দে আমি অন্য কোথাও যাই।’

‘থাকতে পারবি সমস্যা নেই।আগে বল কি হয়েছে?’

‘বলবো।তার আগে তুই বল এখন কোথায় যাচ্ছিস?’

‘বাসায় যাচ্ছি।’

‘তাহলে চল।বাসায় গিয়েই বলি।’

আরিয়া একটা রিকাশ নিলো।তারপর দুজনেই সেখানে চড়লো।বাসায় এসে মধুকে রুমে নিয়ে বসালো।তারপর বলল,’তুই শুধু একঘন্টা অপেক্ষা কর।আমি একটা প্রাইভেট পড়িয়ে আসছি।শাওয়ার নিলে নিয়ে নে।আমার জামা কাপড় আলমারিতে আছে।ফ্রিজেও খাবার আছে।খেয়ে নিস।বোরিং লাগলে টিভি/ল্যাপটপ যেটা ইচ্ছা চালাবি।আর কেউ নক করলে খুলবি না।আমার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে।’

‘আচ্ছা এবার তুই যা।’মধু বালিশে হেলান দিয়ে বলল।

আইরিন একগ্লাস পানি খেয়ে বেরিয়ে গেলো।

একঘন্টার জায়গায় দেড়ঘন্টা পর এসেছে আরিয়া।ততক্ষণে মধু শাওয়ার নিয়ে খেয়ে টিভি দেখতে লাগলো।আরিয়া বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে দু’কাপ চা নিয়ে আসলো।এক কাপ মধুকে দিয়ে নিজের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল,’এবার বল কাহিনি কি?ভাইয়ার সাথে কি রাগ করেছিস?’

‘না।অন্যকিছু।’

‘তো বল না।’

মধু একে একে সব বলল।সব শুনে আরিয়া বলল,’এখানে ইয়াদ ভাইয়ের দোষ নাই।সে নিরুপায়।’

‘আমি জানি ইয়াদের দোষ নাই।দোষটা আমারই।বিয়েটাই করা উচিত হয় নি।’

‘এভাবে বলিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।’আরিয়া স্বান্তনার স্বরে বলল।

এরইমধ্যে ইয়াদ আরিয়াকে ফোন দিয়েছে।আরিয়া ফোন ধরতে নিলেই মধু মানা করে দেয়।মধু বারণ করায় আর ধরে নি তবে আরিয়ার মনে হলো বলে দেওয়া উচিত কিন্তু মধুর জন্য পারবে না।

চা খেয়ে শাওয়ার নিতে গেলো আরিয়া।এরইমধ্যে আরিয়ার ফোনে অনেকবার কল দিয়ে ফেলেছে ইয়াদ।

চলবে…

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৮
#Arshi_Ayat

আরিয়া ফোন না ধরায় বারবার মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা আসছে ইয়াদের।কোথায় গেলো মেয়েটা?ওর সাথে তো ফোনও নেই।সন্ধ্যাও হয়ে আসছে।এদিকে আরিয়াও ফোন তুলছে না।ইয়াদ আরিয়াকে প্রায় পঞ্চাশবারের মতো ফোন দিয়েছে কিন্তু আরিয়া ধরে নি।তাই আর ফোন না দিয়ে ওর বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

সন্ধ্যার সময় সাইদা খানকে বাসায় নিয়ে আসা হলো।এখন অনেকটাই ভালো আছেন তবে ইয়াদকে কাছ ছাড়া করছেন না এইজন্যই ইয়াদ চাইলেও আরিয়ার বাসায় যেতে পারছে না।এদিকে টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে।যদি মধু আরিয়ার বাসায় না যায় তবে?ইয়াদ মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করছে যেনো মধু আরিয়ার বাসায়ই যায়।যেনো ওর কোনো ক্ষতি না হয়।
————–
তিন/চার মাস ধরে বইয়ের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই মধুর।অনেকটা পিছিয়ে গেছে।তার ওপর মিডটার্মও দেয় নি।সামনে আরেকটা পরীক্ষা আছে।স্যারের সাথে কথা বলতে হবে।এবার তো ফাইনাল ইয়ার।কোনোমতেই খামখেয়ালি করা যাবে না।এই চিন্তায় মধু আরিয়ার সাথে বই নিয়ে বসলো।কিন্তু পড়ায় মন বসে না।অস্থির লাগছে!কোনো এক অজানা কারণে রাগ হচ্ছে ইয়াদের ওপর।কিন্তু ওর ওপর রাগ করে তো লাভ নেই।কতক্ষণ বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু একি!মনোযোগের বালাই ও নেই।বইটা বন্ধ করে আরিয়াকে বলল,’তোর ফোনটা দে তো একটু।’

‘কেনো?ভাইয়াকে ফোন দিবি?’

‘না।এমনি সময় দেখবো কয়টা বাজে।’

‘দেয়ালেই তো ঘড়ি আছে।ওখানে দেখলেই তো পারিস।’

মধু দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’দিতে বলছি দিবি।এতো কথা বলিস কেন?’

আরিয়া আর বাক্যব্যয় না করে মধুকে ফোন দিয়ে দিলো।সময় দেখা তো কেবল বাহানা মধুতো দেখতে চেয়েছিলো ইয়াদ আর ফোন দেয় কি না!কিন্তু না আর দেয় নি।মধুর অভিমান হলো!এই তাহলে ভালোবাসা?একটু খোঁজও নিলো না!মধু মুখ গোমড়া করে আরিয়াকে ফোন আবার ফেরত দিলো।এদিকে একটু আগে আরিয়া মেসেজে বলে দিয়েছে মধু ওর বাসায়।আরিয়ার মেসেজ পেয়েই ইয়াদ নিশ্চিন্ত হয়েছে।মেসেজ দিয়েই আরিয়া ডিলিট করে দিয়েছে।যেনো মধু না দেখে।দেখলেই চুল টেনে ছিড়বে।
————
রাত ১১.০০ টা..
মাত্রই ইয়াদ ছাড়া পেয়েছে।সাইদা খান সবে মাত্র শুয়েছে।এতক্ষণ ওনার পাশেই বসিয়ে রেখেছিলেন প্রাণের ছেলে ইয়াদকে।মা’কে শুইয়ে দিয়ে ইয়াদ নিজের রুমে গেলো।রুমে আসতেই মন খারাপ হয়ে গেলো।ইশ!সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এতক্ষণে ওরা সাজেক থাকতো।

ইয়াদ অগোছালো অবস্থা পড়ে থাকা জামা কাপড়গুলো ভাজ করে আলমারিতে রাখলে।ট্রলিগুলোর চেইন বন্ধ করে খাটের পাশে ফেলে রাখলো।তারপর একটা শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে দেখলো ড্রেসিং টেবিলের ওপর ইফাজের গাড়ির চাবি আর ওটার নিচে একটা কাগজের টুকরা।ইয়াদ চাবিটা সরিয়া কাগজটা নিলো।কাগজে লেখা,”ইয়াদ,মা ঘুমালে তুই মধুর কাছে চলে যাস।ও ওর বান্ধবীদের বাসায় আছে আমি জানতে পেরেছি।গাড়ির চাবি দিলাম।ভোরের আগে ফিরে আসবি।তোর বারান্দায় আমি মই লাগিয়ে দিয়েছি।আর শোন যাওয়ার আগে দরজা লক করে যাবি।দেরি করিস না।’

লেখাটা পড়ে ইয়াদের ঠোঁটে হাসি ফুটলো।আসলেই এখন গাড়ির চাবিটার খুব প্রয়োজন ছিলো।মনে মনে ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা ভেতর থেকে লক করে ইয়াদ বেরিয়ে গেলো প্রিয়তমার অভিমান ভাঙাতে।
——————
দুই বান্ধবী খাওয়া দাওয়া করে কতক্ষণ গল্পগুজব করলো।এখন শুতে যাওয়ার পালা।কিন্তু আরিয়া আজ মধুর সাথে শোবে না কারণ রাতে ইয়াদ আসতে পারে।আসার সম্ভবনা নাইন্টি পার্সেন্ট।তাই বাহানা দিয়ে আরিয়া অন্যরুমে ঘুমাতে গেলো।মধু মন খারাপ করে রুমে এসে শুয়ে পড়লো।শুয়ে তো পড়লো কিন্তু ঘুম তো আসে না।তবুও অনেক্ক্ষণ চেষ্টা করার পর চোখটা লেগেছে।কিন্তু হঠাৎ করে রুমে কিছু একটার শব্দ হলো।মধুর ঘুম ছুটে গেলো।ভয়ে উঠে বসলো ও।অন্ধকারে একটা মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে।মধু ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো।আর সাথে সাথেই অবয়ব দ্রুত মধুর মুখ চেপে ধরে কানেকানে বলল,’চিল্লাইয়ো না মধু।আমি ইয়াদ।রিল্যাক্স।’

গলা শুনে মধু বুঝতে পারলো এটা ইয়াদ।ইয়াদ মধুর মুখ থেকে হাত সরাতেই মধু উঠে গিয়ে লাইট জ্বালালো।আশ্চর্য হয়ে বলল,’আপনি আসলেন কিভাবে?’

‘আরিয়া দরজা খুলে দিয়েছিলো।’

মধু কপট রাগ নিয়ে বলল,’ওর একদিন কি আমার একদিন।এইজন্যই বলি আমার সাথে শুলো না কেনো আজ!এই তার কারণ।’

‘জ্বি ম্যাম।’

‘তো আসছো কেনো?’কঠর গলায় বলল মধু।

‘বউয়ের অভিমান ভাঙাতে।’

মধু গম্ভীর স্বরে বলল,’আমি অভিমান করি নি।তুমি বাড়ি ফিরে যাও।তোমার মা যা বলে করো।’

ইয়াদ বসা থেকে উঠে গিয়ে মধুর সামনে দাড়ালো।দুইহাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো কিন্তু মধু নিজের দুইহাত দিয়ে ধাক্কা প্রদান করতে ব্যস্ত তবুও ইয়াদ ওকে বাহুতে আবদ্ধ করেই ফেললো।কিছুক্ষণ ওভাবে থাকার পর মধু শান্ত হলো।চুপচাপ লেপ্টে আছে ইয়াদের বুকের ওপর।মধু শান্ত হবার পর ইয়াদ শান্ত কন্ঠে বলল,’বউ,ও বউ শুনছো?’

‘বলো।’মধু ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো।

‘রাগ হয়েছে আমার ওপর?’

মধু মাথা নেড়ে ‘না’ বলল।ইয়াদ আবার বলল,’তাহলে কি অভিমান করেছে আমার বউ?’

পূর্বের ন্যায় মধু ঘাড় ওপর নিচ করে ‘হ্যাঁ’ বলল।ইয়াদ হাসলো।তারপর ফিসফিস করে বলল,’ঠিকাছে আজ তাহলে অভিমান ভাঙাই বউয়ের।’

দূরে কোথাও নিশাচর পাখি ডাকছে।হয়তো খাবারের সন্ধানে বের হয়েছে।রাতের এই প্রহরে সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে।কেউ হয়তো রাত জাগা পাখি হয়ে ভালোবাসার মানুষের সাথে কথাবলায় ব্যস্ত তো কেউ আবার ঘুমাতে।আবার কেউ কেউ তার ভালোবাসার মানুষের অভিমান ভাঙাতে।এই দলে ইয়াদও আছে।সে ব্যস্ত তার ভালোবাসার মানুষের অভিমান ভাঙাতে।

রাতের প্রায় শেষ প্রহর।মধু ইয়াদের বুকে চুপটি করে শুয়ে আছে।ইয়াদ চুপ।মধুর চুলগুলো একবার হাতে পেঁচাচ্ছে আবার খুলছে।একটা পর্যায়ে ইয়াদ বলল,’জানপাখি,আমার যে এবার যেতে হবে।ভোর হয়ে আসছে।’

মধুর নিমিষেই মন খারাপ হয়ে গেলো।সম্পর্কটা এমন কেনো হয়ে গেলো?বৈধতা থাকা স্বত্তেও বউয়ের কাছে লুকিয়ে আসতে হয়!মধু ক্ষীণ গলায় বলল,’আচ্ছা আমাদের সম্পর্কটা কি ঠিক হবে?’

‘হবে বউ।সব হবে।আমি সব ঠিক করবো।আমার মা তোমাকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিবে।কথা দিলাম।শুধু একটু সময় দাও।বিশ্বাস রেখো।’

‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি ইয়াদ।’

যাওয়ার সময় ইয়াদ মধুকে চেপে ধরলো নিজের সাথে।তারপর দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,’অভিমান কি এখনো আছে বউ?’

মধু লজ্জা লাল নীল হয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলো।ইয়াদের মজাই লাগছে মধুকে লজ্জা দিতে তাই আবার বলল,’আমার এখন গিয়ে আবার গোসল করতে হবে।ভাই/ভাবি কি ভাববে বলো তো?’

এবার মধু কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’তাহলে আসছো কেনো?আমি আসতে বলছিলাম?’

‘জানপাখি রাগ করে না।আমি তো এখন চলে যাবে।যাওয়ার আগে একটা আদর দাও।’

‘ইশ!এতো বেহায়া তুমি?যাও তো!’

‘তাড়িয়ে দিচ্ছো?’

‘না না আসো আমার কোলে বসে থাকো।’

এবার সত্যি মধু রেগে যাচ্ছে বলে ইয়াদ ঠান্ডা করার জন্য বলল,’আচ্ছা ঠিকাছে যাচ্ছি।তুমি তো দিবে না।আমিই দিয়ে দেই।’
এটা বলেই ইয়াদ টুকুস করে কপালে একটা চুমু দিয়ে মধুকে ছেড়ে দিলো।

ইয়াদকে বিদায় দিয়ে মধু ঘরে এসে শাওয়ার নিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।এখন সাড়ে চারটা বাজে।ঘুমের চৌদ্দটা বেজে গেছে।তবুও মধুর মনের আঙিনায় বসন্তের হাওয়া দিচ্ছে,কোকিল ডাকছে,ফুল ফুটছে।মধু আনমনেই লজ্জা পেলো।তারপর দুইহাতে মুখ ঢেকে হাসলো।কিন্তু ইয়াদের মায়ের কথা মনে হতেই চোখে পানি চলে এলো।কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টায় মেতে উঠলো।

এদিকে ইয়াদও ঘরে ফিরে শাওয়ার নিলো।তারপর হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিলো।নইলে চুল ভেজা দেখলে মায়ের সন্দেহ হতে পারে।কিছুদিন এভাবেই চলতে হবে।তারপর একটা ব্যাবস্থা নিতেই হবে।

সকাল দশটা বাজে ইয়াদ ঘুম থেকে উঠলো সাইদা খানের ডাকে।সাইদা খান ইয়াদের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,’বাবা ওঠো।ফ্রেশ হও।চা নিয়ে আসছি।চা খাও।’

ইয়াদ আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো।সাইদা খান ছেলেকে ফ্রেশ হয়ে চা খেতে বলে চলে গেলেন।ইয়াদ ফ্রেশ হয়ে আরিয়ার ফোনে ফোন দিলো।মধু রিসিভ করতেই ইয়াদ বলল,’কি করো বউ?’

‘শুয়ে আছি।তুমি?’

‘তোমাকে মিস করি।’

‘এই যে ধান্দাবাজি কম করো সোয়ামি।আমি সব বুঝি।’

‘কিচ্ছু বোঝো না তুমি।আচ্ছা এখন ওঠো ফ্রেশ হও।নাস্তা করো।’

‘জ্বি জনাব উঠছি।আপনিও নাস্তা করেন।’

মধুর কথা শেষ হতেই ইয়াদ হুট করে বলল,’এই শোনো দেখো তো তোমার চুল শুকিয়েছে কি না?না আবার মানুষ সন্দেহ করতে পারো।’

‘ইশ!কি অসভ্য।’
এটা বলেই মধু ফোন রেখে দিলো।আর ইয়াদ হাসতে হাসতে চায়ে চুমুক দিলো।

চলবে….

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে